স্বপ্নের বৃষ্টিমহল – ১৫

১৫

রোজ সকালে ঠিক একই সময় ম্যাসেজ আসে। অচেনা এক নম্বর থেকে। আজকে লিখেছে, ঠিক এগারোটার সময় একবার ক্যান্টিনে আসবেন? দূর থেকে দেখব শুধু। আপনি কিন্তু প্রতিদিনের ঐ বিশ্রী সাদা শার্টটা পরবেন না। ওটায় হলুদ দাগ পড়ে গেছে। আজকে বরং সবুজ পরে আসুন। অবশ্য আপনার গায়ের রং অতটা পরিষ্কার নয়। সবুজে মানাবে না। আপনার আকাশী রঙের শার্ট আছে? প্লিজ আজকে আকাশী শার্ট পরে আসুন।

আকাশ কুঞ্চিত ললাট নিয়ে বার্তাটা পড়ে শেষ করল। পুরোটা পড়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তবুও কেন পড়ল কে জানে! এমনভাবে পড়ল যেন ম্যাসেজটা এ টু জেড পড়তে সে বাধ্য। ডাইনিং টেবিলে তারা আর ঝুমকি বসে আছে। তারার ক্লাস আছে সকাল দশটায়। একটু পরেই বেরিয়ে পরতে হবে। ক্লাস শেষে যাবে ছাত্রীর বাসায়। দুই বোনকে একসাথে অংক করায় সে। ভেবেছিল এ মাসে কলেজের কাছাকাছি একটা গার্লস হোস্টেলে মুভ করবে। টিউশনির টাকা দিয়ে মোটামুটি খেয়ে-পড়ে চালিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু আকাশ কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। সে চায় তারা এই বাসায় থেকেই পড়াশোনা করুক। আকাশের কোনো ছোট ভাই-বোন নেই। তারাকে সে নিজের ছোটবোন হিসেবেই গ্রহণ করেছে। বড়ভাই জীবিত থাকা অবস্থায় ছোটবোন হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করার বিষয়টা দৃষ্টিকটু। ছোটবোন হিসেবে এই স্বীকৃতি তারাকে আবেগে ভাসিয়েছে। জীবনে এত সুন্দর উপহার সে এর আগে কখনো পেয়েছে বলে মনে হয় না। আকাশ যেন ওর পিতা-মাতাহীন অসহায় জীবনে জলজ্যান্ত এক আশীর্বাদ। সাধারণ, হাসিখুশি, বিবেকবোধ সম্পন্ন, দায়িত্ববান ছেলেটাকে সে মনের গভীর থেকে শ্রদ্ধা করে, ভালোও বাসে! সেই আবেগ থেকেই এই বাসা ছেড়ে আর যাওয়া হলো না কোথাও। তাছাড়া খালার কাছাকাছি থাকতে ওর ভালো লাগে। রক্ত সম্পর্কের আত্মীয় বলতে এক খালাই তো আছে তার জীবনে। নিজের পিতা এবং মামারা তো থেকেও নেই!

‘কী হয়েছে ভাইয়া?’

তারার প্রশ্ন শুনে সম্বিৎ ফিরল আকাশের।

‘কী হবে?’

‘নাক মুখ ওরকম কুঁচকে রেখেছ কেন?’

আকাশ বলল, ‘একটা আননোন নাম্বার থেকে প্রায় প্রতিদিন টেক্সট আসে। কে এই ফাজলামোটা করছে ঠিক বুঝতে পারছি না। কল করলে

দেখা যায় ফোন বন্ধ।

তারা মুচকি হেসে বলল, ‘নিশ্চয়ই তোমার কোনো স্টুডেন্ট হবে।’

‘কী জানি! আমার ফাজিল বন্ধুগুলাও হতে পারে। হয়ত ওদের মধ্যেই কেউ ফাজলামো করছে কিন্তু ধরা দিচ্ছে না।’

ঝুমকি রান্নাঘর থেকে চায়ের কাপ হাতে বেরিয়ে এলো। আকাশের সামনে ধোঁয়া ওঠা কাপটা নামিয়ে রেখে বলল, ‘এই শুক্রবারে আসবে ওরা। গতকাল রাতেই কনফার্ম করল।’

আকাশ ভ্রু-কুঁচকে তাকাল, যেন ঝুমকি কীসের কথা বলছে সে ধরতে পারছে না। পরমুহূর্তেই তার মনে পড়ল কিছু একটা। প্রসন্ন কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ও আচ্ছা! কখন আসছে? দুপুরে নাকি রাতে?’

‘সন্ধ্যায়।’

আকাশ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তারাকে একঝলক দেখল। মনে হলো প্রসঙ্গটা ওঠার সাথে সাথেই একটু গম্ভীর হয়ে গেছে। মেয়েটা কি এখনও বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয়? কিন্তু মুখ ফুটে কোনো আপত্তি তো জানায়নি। আকাশের মনে হয়েছে এই প্রস্তাবটা বেশ ভালো। পাত্র ব্যাংকার। ঢাকায় নিজের একখানা ফ্ল্যাট আছে। তিন ভাই-বোনের ছিমছাম সংসার। তারার কোনো নিজস্ব পছন্দ আছে বলেও মনে হয় না। মা মরা মেয়ে, বাবাটা লম্পট এবং লাপাত্তা। ঝুমকির মতে এই ছন্নছাড়া পরিবারের মেয়ের জন্য এত ভালো প্রস্তাব পরবর্তীতে আর আসবে না।

কলিংবেল বেজে উঠল। তারা দ্রুত পায়ে দৌড়ে গেল দরজার দিকে দরজা খুলতেই মনীষা ঘরের ভেতর এক পা বাড়িয়ে দিয়ে ব্যস্ত গলায় বলল, ‘একটু চায়ের পাতা হবে? আজ সকালে উঠে দেখলাম চাপাতা শেষ। উপায় না পেয়ে ভিখিরির মতো তোমাদের কাছে হাত পাততে হলো। কিছু মনে করো না ভাই।’

তারা সহাস্যে বলল, ‘চাপাতা আছে। এমনকি চাও রেডি। আপনি আসুন।’

মনীষা ভেতরে ঢুকতেই আকাশের সাথে চোখাচোখি হলো। সৌজন্যতার হাসি হাসল দুজনেই। ঝুমকি বলল, ‘বসো। আমাদের সাথেই চা খেয়ে নাও।’ তারা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বলল, ‘আমি আসি।’

‘কখন ফিরবে?’ ঝুমকির প্রশ্ন।

‘বিকেল হবে।’ উত্তরটা ছুড়ে দিয়ে বেরিয়ে যাবার জন্য উদ্যত হলো তারা। মনীষা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে না বসতেই পিতৃদেব হাজির হলেন দৃশ্যপটে। এই ব্যক্তির উপস্থিতি সকলের মধ্যেই একটু অস্বস্তির উদ্রেক করে। ঝুমকি রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে ধোঁয়া ওঠা লিকার ঢালছিল। মনীষা উঠে পড়ল। এগিয়ে গেল রান্নাঘরে। আকাশও উঠল। পিতৃদেব বললেন, ‘বসো বসো। তোমার সাথে একটু কথা আছে।’

বিরক্তি মাখা চোখে তাকাল আকাশ, ‘কী কথা?’

‘বস। তারপর বলছি।’

‘আমার হাতে সময় নেই। এখুনি বেরোতে হবে।’ কথাটা বলতে বলতে চেয়ারে আবারও বসল আকাশ।

‘কিছু টাকা চেয়েছিলাম। মনে আছে?’

‘টাকা দিয়ে আপনি কী করবেন?’

‘ব্যবসায় লাগাব।’

‘ব্যবসা করার কী দরকার আপনার? আমি তো সংসারের দায়িত্ব নিয়েছি।’

‘আমার হাতখরচের একটা বিষয় আছে না?’

আকাশ লোকটার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। কদিন পয়সার অভাবে মদ খেতে পারেনি বিধায় চেহারায় একটু সুস্বাস্থ্যর ছাপ পড়েছে। তবুও চোখের নিচে গভীর কালো দাগ। একটা সাদা স্যান্ট গেঞ্জি পরনে। গলার বাদামী কুঁচকে যাওয়া চামড়ায় তিন চারটা দগদগে কালো আঁচিল। আকাশ সেদিকে চেয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, ‘হাতখরচ দিয়ে কী করবেন? মদ খাবেন?’

লোকটা নিপাট ভালো মানুষের গলায় বলল, ‘না ওসব তো ছেড়ে দিয়েছি।’

‘আমার বিশ্বাস হয় না আপনার কথা।’

‘একটাবার বিশ্বাস করেই দ্যাখো না।’ কণ্ঠস্বর চমকে দিল আকাশকে। এমন অনুরোধের সুরে লোকটা কখনও কথা বলেনি আগে। সব সময় এর কথায় একটা প্রচ্ছন্ন হুমকি থাকে, তেজ থাকে। আজকে হঠাৎ এই তেজহীন ন্যাতানো অনুরোধ শুনে লোকটাকে নিতান্তই ব্যক্তিত্বহীন বলে মনে হলো আকাশের। সারাজীবন স্ত্রী এবং সন্তানের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে। এখন শেষ বয়সে পৌঁছে নিরুপায় হয়ে ভিক্ষুকের মতো হাত পেতেছে সেই সন্তানের কাছে যার প্রতি কোনোদিন পিতা হিসেবে কোনো দায়িত্ব পালন করেনি। মা যতদিন বেঁচে ছিলেন পড়াশোনার খরচ যোগান দিতেন। মা চলে যাবার পর নানা বাড়ি থেকে পাওয়া ফ্ল্যাটের ভাড়া টুকুই হলো আকাশের সম্বল। প্রতি মাসে ভাড়া বাবদ বিশ হাজার টাকা পেত বলেই কোনো রকমে পড়াশোনাটা চালিয়ে নিতে পেরেছে। এই লোক কোনোদিন জানতে চায়নি কীভাবে আকাশের দিন কাটছে। একমাত্র সন্তান পড়াশোনা না করে মদ খেয়ে, জুয়া খেলে বখে গেলেও তার কোনো ক্ষতি হতো না। আজ সেই পুত্রর সামনে ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে দাঁড়াতে লোকটার বুক কাঁপল না একবারও।

‘আমার পক্ষে এখন ব্যবসার মূলধন দেয়া সম্ভব নয়।’

‘তোমার একটা কোটিপতি বন্ধু আছে না? তাকে বলো কিছু টাকা ধার দিতে।’

আকাশ বিতৃষ্ণাভরা চোখে কয়েক নিমেষ চেয়ে রইল শুধু। বলল না কিছু। পাশের চেয়ারে রাখা ল্যাপটপের ব্যাকপ্যাক কাঁধে ঝুলিয়ে প্রস্থানদ্যত হলো। বুকটা জ্বালা করছে। মেজাজটাও গেছে খিঁচড়ে। দরজার কাছে পৌছুতেই মনীষার কণ্ঠস্বর ভেসে এল পেছন থেকে, ‘ভার্সিটি যাচ্ছ?’

আকাশ ঘুরে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ।’

‘আমিও বেরোচ্ছি এখুনি।’

আকাশ কী যেন ভেবে নিয়ে বলল, ‘আমি বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত রিকশায় যাব। আপনার অফিস তো এর আগেই পড়বে। চলুন আপনাকে নামিয়ে দেই।’

মনীষা খুশি হলো প্রস্তাব শুনে। হাসিমুখে বলল, ‘বেশ তো। চল যাই।’

গলির মুখেই রিকশা পাওয়া গেল। সকাল বেলায় চনমনে রোদ উঠে গেছে। বাতাসে উষ্ণ ঝাপটা। নীল আকাশে কিছু পলকা মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে বটে, তবে বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা নেই। এত রোদে হুড ফেলে বসা যায় না। কিন্তু হুড তুলে দিলে মনীষার বসতে সমস্যা হতে পারে ভেবে আকাশ চুপচাপ রইল। বাসা থেকে মনীষার অফিস দশ মিনিটের পথ। সকাল বেলার এই সময়টায় স্কুলের কারণে খুব জ্যাম হয়। ওরা গলির মুখের জ্যামেই আটকে রইল মিনিট পাঁচেক সময়। আকাশের ক্লাস বেলা এগারোটায়। তেমন তাড়া নেই। তাড়া থাকলে রিকশা ছেড়ে বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরতে হত।

‘আঙ্কেলের ব্যাপারটা কী বলো তো? উনি কি সব সময়ই এরকম ছিলেন?’

আকাশ একটু অপ্রতিভ হলো। ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে বন্ধুরা ছাড়া অন্য কারো সাথে আলাপ করতে সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। কেউ কখনো এভাবে জানতেও চায়নি। কিন্তু প্রশ্ন করে ফেলার পর এড়িয়ে যাওয়াটা অভদ্ৰতা হয়ে যায়। সে একটু বাধো বাধো গলায় বলল, ‘হুম… এরকমই ছিল। আমি উনাকে জ্ঞান হবার পর থেকেই এমন এলোমেলো দেখে আসছি। মা বেঁচে থাকা অবস্থায় ঝামেলা লেগেই থাকত। বাবা হিসেবে কখনো কোনো দায়িত্ব পালন করেনি।’

মনীষা আকাশের দিকে তাকাল। লাবণ্যমাখা সলজ্জ মুখের ছেলেটার জন্য বড় মায়া হলো তার। একটা হাত আকাশের বাদামি রঙের ছিপছিপে রোমশ হাতের ওপর রেখে সে মৃদু গলায় বলল, ‘আমি তোমার কষ্টটা বুঝি আকাশ। আমার ছেলেটারও তো তোমার মতোই অবস্থা। ওর বাবাটা মানুষ না। এখন জেল খাটছে মাদকের মামলায় সেই খবরটাও আমি ছেলের কানে দিতে পারিনি। হাজার হলেও বাবা তো। শুনে কষ্ট পাবে। পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটবে। খুব ভয় হয় জানো? যদি আমার কিছু হয়, আমিও যদি তোমার মায়ের মতো মরে টরে যাই তাহলে ছেলেটার কী হবে?’

‘এসব ভাবার কোনো কারণ নেই। আপনার কিছু হবে না ইনশা আল্লাহ। সব ঠিক থাকবে।’

‘ওই লোকটা জেল থেকে বেরিয়ে পড়লেই আবার ঝামেলা শুরু করবে। জামিন পেয়ে যাবে শীঘ্রই।’

আকাশ মনীষার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমাদের এখানে যতদিন আছেন আপনাকে কেউ বিরক্ত করবে না। আমি গার্ডদেরকে উনার ছবি দেখিয়ে সতর্ক করে দিয়েছি। বিল্ডিং-এ ঢুকতে পারবে না।’

‘ওই লোকটা একটা ডাকাত। কোন সময় তোমাদের ক্ষতি করে দেয় ঠিক নেই। আমি ভাবছি খুব শীঘ্রই বাসাটা ছেড়ে দেব। আমার অফিসটাও তো সে চিনে ফেলেছে। এই চাকরি কতদিন করতে পারব জানি না। তাছাড়া সেপারেশনের ব্যাপারটা অফিসে কাউকে জানাইনি এখনো।’

‘কেন?’

মনীষা একটু গম্ভীরভাবে বলল, ‘স্বামীহীন মেয়েদের কর্মক্ষেত্রে নানা রকম সমস্যায় পড়তে হয়। তুমি ঠিক বুঝবে না।’

আকাশ পাশ ফিরে দেখল মনীষাকে। সাদা আর গোলাপির মিশেলের একখানা তাঁতের শাড়ি ওর পরনে। চুলে এখনো লেপ্টে আছে স্নানের জল। সমুদ্র-গভীর দুটো চোখের কার্নিশে কালো রঙের গাঢ় কাজলরেখা টানা। মনীষার মতো নিখুঁত সুন্দর মেয়ে খুব কম দেখেছে আকাশ। শুধু বাহ্যিক রূপ নয়, ওর সহজ-সরল নিষ্কলুষ মনটার ছায়া সর্বক্ষণ সাগরের মতো প্রগাঢ় চোখের তারায় ডানা মেলে উড়তে থাকে। ঐ চোখের দিকে তাকালে চট করে ওর মনটা পড়ে ফেলা যায়। এত ভালো একটা মেয়ের জীবন এমন নরকের মতো হবে ভাবাই যায় না। জ্যাম ছেড়ে যাওয়ায় রিকশাটা চলতে শুরু করেছে। উষ্ণ বাতাসে মনীষার খোলা চুল উড়ছে। উড়ছে শাড়ির আঁচল। সরু নাকের ওপর কয়েক বিন্দু ঘাম জমে আছে। চিকচিক করছে রোদে।

‘এই চাকরিটা ছেড়ে দেবেন?’

‘হুম… ছেড়ে দিতে হবে।’

‘অন্য কোথাও অ্যাপ্লাই করেছেন?’

মনীষা একটা হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘করেছি কয়েক জায়গায়। দেখি কেউ ডাকে কি না।’

একটু বিরতির পর চোখে দূরের দৃষ্টি নিয়ে মনীষা কেমন আবিষ্ট গলায় বলল, ‘আমার মাঝে মাঝে কী ইচ্ছা করে জানো? ইচ্ছা করে দূরে কোনো পাহাড়ি এলাকায় চলে যাই। ছিমছাম একটা গ্রামে নিজ হাতে চাষাবাদ করব। আর একটা গানের স্কুল দেব। গ্রামের সব বাচ্চারা রোজ সকালে আমার কাছে গান শিখতে আসবে। কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, মিথ্যে জাঁকজমক নেই, টানাপোড়েন নেই… এরকম একটা জীবন হলে আর কী লাগে বল?’

আকাশ মনীষার সুন্দর দুটি সাগর চোখের ওপর স্থির দৃষ্টি ন্যস্ত করে বলল, ‘এত সাধারণ স্বপ্নও মানুষ দেখে? আপনি সত্যিই খুব অদ্ভুত।’

মনীষা হাসে, ‘সাধারণ হতে চাওয়া মানুষগুলোর জীবনেই সব সময় অসাধারণত্বের অভিশাপ লেগে থাকে, জানো?’ কথাটা বলেই যেন হঠাৎ সম্বিৎ ফিরল ওর। একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘যাক গে। এসব কথা বাদ দাও। আমি খুব বোরিং তাই না?

আকাশ অপ্রস্তুত হলো, ‘নাহ… বোরিং হবেন কেন?’

‘বোরিং তো বটেই। তোমরা বন্ধুরা সারাক্ষণ কত হাসি তামাশা কর। আর আমি সব সময় হা-পিত্যেশ করতে থাকি। এসব হতাশার কথা শুনতে নিশ্চয়ই তোমার ভালো লাগে না। বয়স হয়ে গেছে তো। এখন সারাদিন মাথায় নানারকম দুশ্চিন্তা ঘুরে বেড়ায়। মিড লাইফ ক্রাইসিস বলতে পার।’

‘আপনাকে আমার মোটেও বোরিং মনে হয়নি কখনো। আর বয়সের কথা বলছেন? আপনাকে দেখলে মনে হয় খুব বেশি হলে পঁচিশ কি ছাব্বিশ।’

‘বলছ কী? দারুণ কমপ্লিমেন্ট! তেত্রিশে পড়লাম।’

আকাশ মাথা নেড়ে বলল, ‘কেউ বিশ্বাস করবে না!’ একটু থেমে আকাশ আবার বলল, ‘আপনি গান শেখাতে চাইলে তো এখনও শেখাতে পারেন। আমাদের পাড়ার অনেক ছেলে-মেয়ে নিশ্চয়ই আগ্রহী হবে। আমরা বিল্ডিং-এর সামনে একটা পোস্টার লাগাতে পারি। পোস্টারে লেখা থাকবে এখানে গান শেখানো হয়।

মনীষা খুব খুশি হয়ে বলল, ‘সত্যি?’

‘মিথ্যা হবে কেন? এটা কোনো ব্যাপার?’

মনীষা সাদা শার্ট পরা, সাধারণ, দীঘল চেহারার শ্যামবরণ ছেলেটার দিকে মায়াভরা চোখে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে বলল, ‘তোমরা আমার জন্য আর কত করবে আকাশ? তুমি, রুদ্র, তারা, ঝুমকি আন্টি… তোমরা কয়টা মানুষের কাছে আমার অনেক অনেক ঋণ হয়ে যাচ্ছে। এই ঋণ আর বাড়ানো ঠিক হবে না।’

‘আরে… কী যে বলেন। আপনি আমাদেরকে এখনো আপন ভাবতে পারেন নাই, তাই না?’

‘আপন তো বটেই। তোমরা আমার ছোট ভাই-বোনের মতো। ভীষণ ভালোবাসি তোমাদের!’

‘ছোট ভাই-বোন?’ প্রশ্নটা করে একটু চোখ নাচায় আকাশ। রিকশা গন্তব্যে পৌঁছে গেছে তখন। মনীষা রিকশা থেকে নামতে নামতে বলে, ‘ভাই-বোন হতে আপত্তি আছে?’

আকাশ হাসে। হাসে চোখ। সুন্দর দেখায়। মনীষার মনে হলো আকাশের হাসিটায় ম্যাজিকের মতো কিছু আছে। ওই হাসি দেখলে মন ভালো হয়ে যায়।

‘কিছু বলছ না যে?’

‘উত্তরটা খুঁজে পাচ্ছি না। তবে ভাই-বোনই কেন হতে হবে? আমরা তো বন্ধুও হতে পারি তাই না?’

মনীষা ব্যাগ থেকে খুচরো টাকা হাতড়ে বের করে রিকশাঅলার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘এত পিচ্চি পিচ্চি মানুষজনের সাথে বুঝি বন্ধুত্ব করা যায়?’

আকাশ খুচরো টাকাগুলো নিজের হাতে তুলে নিল, ‘সমস্যা কী আপনার? ভাড়া দিচ্ছেন কেন?’

‘দিব না?’

‘না।’

‘তাহলে টাকাগুলো তুমি রেখে দাও। চকলেট কিনে খেও। বাচ্চা মানুষ!’

আকাশ হেসে ফেলল, ‘আপনি আমার বয়স নিয়ে খোঁটা দিচ্ছেন কেন বারবার?’

মনীষা আকাশের আকাশময় সুন্দর হাসির দিকে চেয়ে বলল, ‘অকাল পক্ক ছেলে-মেয়েদের বয়স স্মরণ করিয়ে দিতে হয়। নইলে এরা বখে যায়।’

‘তাই?’

‘হুম তাই।’ কথাটা বলে মনীষা ঘুরে দাঁড়াল। কয়েক পা এগিয়ে গিয়েই ফিরে তাকাল আবার। ঝলমলে উত্তপ্ত রোদের নিচে ওর ঘর্মাক্ত মুখখানা বড় সুন্দর দেখাল সেই সময়। আকাশ উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করল ‘কিছু বলবেন?’ মনীষা কী যেন বলতে গিয়ে হোঁচট খেল। দুদিকে মাথা নেড়ে বলল, ‘নাহ কিছু বলার নেই। খোদা হাফেজ।’

বেলা তিনটায় বন্ধুদের সাথে দেখা করার কথা। ক্লাস শেষে সঙ্গে সঙ্গে বেরোনো গেল না। দুজন ছাত্রী মিড টার্মের রিটেক এক্সাম দিল। চল্লিশ মিনিট সময় ব্যয় হলো সেখানে। সেই সময়টায় কুইজের খাতা দেখল সে। বিকেল চারটার আগে ক্যাম্পাস ছাড়তে পারল না। এতসব ব্যস্ততার ভেতরে কী কারণে যেন মনীষার সাগর দুটি চোখ বারে বারে মনোযোগে বিঘ্ন ঘটাচ্ছিল। কী যেন বলতে গিয়েও বলেনি মেয়েটা। কী বলার ছিল ওর? বলল না কেন? এটা নিশ্চয়ই ভাববার মতো গুরুতর কোনো বিষয় নয়। কিন্তু না চাইতেও ভাবনাটা তার মস্তিষ্কে অকারণে ঠকঠক করে যাচ্ছে। আজব ব্যাপার!

১৬

বন্ধুদের সাথে দেখা হলো সন্ধ্যে ছটায়। বনানীর টাইম আউট রেস্তোরাঁয় বিকেলের পর থেকে একটু ঠান্ডা হাওয়া বইছিল। তাই রেস্টুরেন্টের প্যাটিওতে বসেছে ওরা। প্যাটিওতে চেয়ার টেবিল আছে। আছে সবুজ পাতা বাহার এবং নানা রকম আলোকসজ্জা। আকাশ এসে দেখল তিন বন্ধু গোমড়া মুখে বসে আছে। অমৃতা আর রুদ্রর আঙুলের ফাঁকে সিগারেট। হৃদির চোখ ফোলা। দেখে মনে হচ্ছে কান্নাকাটি করেছে। আকাশ একটা চেয়ারে বসে বলল, ‘কী হইছে তোদের?’

রুদ্র বলল, ‘ঘটনা তো ঘটে গেছে।’

উদ্বেগ ফুটে উঠল আকাশের মুখে, ‘কী ঘটনা?’

‘অমৃতার তো ভিসা হয়ে গেছে। উড়াল দিবে কিছুদিনের মধ্যেই।’

আকাশ খবরটা শুনে কেমন নিষ্প্রভ হয়ে গেল। ভিসা হয়ে গেছে এটা নিঃসন্দেহে সুখবর। অমৃতা উচ্চশিক্ষার জন্য বিলাত যাবে। স্বাবলম্বী হবে। নিকট জনেরা এই সাফল্যে আনন্দ প্রকাশ করবে, গর্বিত হবে। কাছের মানুষদের মধ্যে যেসব ঈর্ষাপরায়ণ লোক বাস্তবিক অর্থে আনন্দিত হতে পারবে না, তারাও আনন্দিত হওয়ার অভিনয় করবে। এটাই নিয়ম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে অমৃতার বন্ধুদের অভিনয়ের ক্ষমতা নেই। এরা জানে না ভদ্রতার মুখোশের আড়ালে কী করে মনের দহন জ্বালা লুকোতে হয়। দিনকে দিন পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ এবং যাতায়াত এখন কোনো কঠিন বিষয় না। দেশের অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। ঊর্ধ্বমুখী জনসংখ্যা, দুর্নীতির দৌরাত্ম্য এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদেরকে বিদেশ মুখী করে তুলেছে। সবার মাঝেই ধারণা চলে এসেছে, এই দেশে থেকে কোনো উন্নতি সাধন হবে না। আকাশের স্কুল কলেজের ক্লাসমেটদের মধ্যে অনেকেই পড়াশোনার জন্য বিদেশে চলে গেছে। জীবনের তাগিদে কাকে কখন কোথায় ছুটে বেড়াতে হবে তা অদৃষ্ট ছাড়া কেউ জানে না। বাস্তব যত কঠিনই হোক না কেন মেনে নেয়া ছাড়া মানুষের আর গতি তো নেই! সব কিছু বুঝে শুনেও অদ্ভুত এক কষ্টে আকাশের বুক ফেটে যাচ্ছিল। বিভা নেই… রুদ্র চলে যাচ্ছে… চলে যাবে অমৃতাও। হৃদি আর সামি হয়ত নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। তারপর এই বন্ধুহীন নিঃসঙ্গ শহরে অবসরের বিষণ্ন সন্ধে গুলোয় একলা আকাশ কী করে সময় কাটাবে? কার কাছে যাবে? কার সাথে আড্ডা দেবে?

নতমুখে কিছুক্ষণ বসে থেকে সে বাষ্পঘন কণ্ঠে বলল, ‘কবে যাচ্ছিস?’

‘এক তারিখে টিকেট করব ভাবতেছি।’

‘রুদ্র তুই কবে যাচ্ছিস?’ রুদ্রর দিকে তাকাল আকাশ।

‘তিন তারিখ।’

আকাশ শক্ত গলায় অনেকটা হুমকির স্বরে অমৃতাকে বলল, ‘তুইও তিন তারিখেই টিকেট কর। একসাথে দুইজনকে বিদায় দিব। আমাদের আর দুইদিন কষ্ট করতে হবে না। কী বলিস হৃদি?’

হৃদি ফোলা ফোলা চোখ দুটো টিস্যু দিয়ে একবার মুছে নিয়ে রাগ থমথমে গলায় বলল, ‘এখনই বিদায় দিয়ে দেই। হুদাই আরও একটা মাস এদেরকে সহ্য করার কোনো কারণ আছে?’

আকাশ বিজ্ঞভাবে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল, ‘রাইট। যাবেই যেহেতু এখনই যাক গা। আমার কেন যেন সহ্য হচ্ছে না এদেরকে। হৃদি চল, উঠি।’

রুদ্রর সিগারেটের নেশা আজকাল বেড়েছে। দিনের পঞ্চম সিগারেটটায় লাইটার দিয়ে আগুন ধরিয়ে সে বলল, ‘ধুর মামা, কী আজাইরা প্যাঁচাল পারতেছিস। চল এই একটা মাস আমরা খুব দারুণভাবে সেলিব্রেট করি। অনেকদিন হয়ে গেছে কোনো হৈ-চৈ হয় না। কেমন যেন মরা মরা ভাব।’

হৃদি বলল, ‘যাওয়ার আগে মজ-মাস্তি করবা তারপর আমাদের রাইখা চইলা যাবা। তোমরা বিদেশ গিয়া একেকজন ডক্টরেট হবা, ব্যারিস্টার হবা আর আমরা এইখানে নিজেদের কাম কাজ ফালায় রাইখা তোমাদের মনোরঞ্জন করব। এইসব হবে না মামা। এইসব হবে না। আকাশ চল। আজকে থেকে এদের সাথে আমাদের কথা নাই।’

আকাশ রোবটের মতো উঠে দাঁড়াল। উঠল হৃদিও। রুদ্র একটা বিরক্তিসূচক চ-কারান্ত শব্দ করে বলল, ‘কী বালের সিনামা শুরু করছস। কষ্ট কি শুধু তোদেরই হইতেছে? আমাদের হয় না? দেশ ছাইড়া, বাবা মা চৌদ্দ গুষ্টি ছাইড়া বিদেশ যাইতে কি আমাদের কষ্ট হবে না?’

‘কষ্ট হইলে যাইস না। যাইতেছিস ক্যান?’ হৃদির সহজ-সরল অকপট মন্তব্য।

রুদ্র গম্ভীর হয়ে গেল, ‘লাইফে কিছু জিনিস ইচ্ছা না করলেও করতে হয়। এইটা তো না বুঝার কথা না।’

অমৃতা গম্ভীর ভাবে সিগারেট ফুঁকছিল। সে চায়নি নিজের পরিবার আর বন্ধুদের ছেড়ে, প্রিয় দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে। কেউ তো জানে না কতটা বাধ্য হয়ে, অপারগ হয়ে, নিরুপায় হয়ে তাকে দেশ ছাড়তে হচ্ছে। সামি হয়ত তাকে কোনোদিনও ক্ষমা করবে না। এই দ্বন্দ্বের কারণে অন্যান্য বন্ধুদের সাথেও সামির যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে যাবে। সম্পর্ক খারাপ হবে। হৃদির সাথে ওর দাম্পত্য কলহ অমৃতার উপস্থিতিতে নিষ্পত্তি যোগ্য নয়। সময়ের সাথে সাথে হয়ত সবকিছুই বদলায়, মৃত্যু শোকও কেটে যায়। কিন্তু চাঁদের গায়ের কালো দাগের মতো কিছু কিছু কলঙ্কের দাগ বোধহয় আজীবন গেঁথে থাকে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের দেয়ালে। আগের মতো হবে না কিছুই। অন্তত সামির সাথে ওর বন্ধুত্বটা… আর কখনই… ভাবতে গেলে অমৃতার কান্না পায়! বুকটা খাঁ-খাঁ করে। এত কাছের, এত ভালোবাসার, এত প্রিয় বন্ধুটিকে হারাতে হলো নিজের করা গর্হিত ভুলের কারণে। এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত তো তাকে করতেই হবে। তাই আপাতত নির্বাসনে যাওয়াই উত্তম। নির্বাসন? হ্যাঁ… বাবা মা, বোন, বন্ধু আর প্রিয় দেশের বিরহে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকার মর্মান্তিক চেষ্টা তো এক প্রকার নির্বাসনই বটে। তাছাড়া সেই মানুষটার এত কাছাকাছি থেকেও একটাবার তাকে দেখতে না পাবার ভয়াবহ যন্ত্রণা থেকে অমৃতা মুক্তি চায়। নিজের ওপর আর আগের মতো ভরসা নেই। আত্মবিশ্বাস শূন্যের কোঠায়। মাঝে মাঝেই মাথায় পাগলামো চেপে বসে। ইচ্ছে করে এখুনি ছুটে যায় মানুষটার কাছে। অনেক কষ্টে অবাধ্য বেপরোয়া মনটাকে সামলায় সে। কিন্তু নিজেকে নিজে কতদিন পাহারা দিয়ে রাখবে? হঠাৎ যদি নিয়ম ভাঙা দুর্মর বাসনা দুর্বৃত্তের মতো গলা টিপে ধরে? যদি নিজেকে বেঁধে রাখার, দমিয়ে রাখার সকল শক্তি ক্ষয় হয়ে যায়… তখন? কী করবে তখন অমৃতা? এর চেয়ে দূরে চলে যাওয়াই সমীচীন।

আকাশ আর হৃদিতা সত্যি সত্যিই বেরিয়ে যাচ্ছিল। রুদ্র উচ্চকণ্ঠে হাঁক ছাড়ল, ‘কই যাস?’

অমৃতা মুখ খুলল এতক্ষণে, ‘যেতে দে।’

‘তোর আবার কী হইল?’

অমৃতা আঙুল ঝাঁকিয়ে অ্যাশট্রেতে ছাই ফেলল। ঠান্ডা স্বরে বলল, ‘দ্যাখ যার যা মন চায় করতে দে। ফোর্স করিস না।’

অমৃতার নিস্পৃহ বক্তব্য শুনে খ্যাঁক দিয়ে উঠল রুদ্র, ‘কেন ফোর্স করব না? একশবার করব!’

আকাশ ঘুরে দাঁড়িয়ে রুদ্রকে বলল, ‘কী চাই তোর?’

‘এদিকে আয়। বস এখানে। আদেশ করল রুদ্র।

আকাশ কয়েক পা এগিয়ে এসে চেয়ার টেনে বসল, থমথমে গলায় বলল, ‘পাঁচ মিনিট সময় দিলাম। এর মধ্যে যা বলার বল।’

‘বিভা আসতেছে পরশুদিন। জানিস তো!’ রুদ্র বলল।

‘হুম জানি।’

‘আমি ঢাকায় আর দুই তিনদিনের বেশি থাকতে পারব না। চিটাগাং যাইতে হবে। ফ্যামিলিকে টাইম দিতে হবে।

হৃদি ফিরে এসে চেয়ারের ওপর ধপ করে বসে পড়ে বলল, ‘তো আমরা কী করব?’

‘তোরা আমার সাথে চল চিটাগাং। অনেক দিন হয়ে গেল ফানিমুনে যাই না।’

অমৃতা বলল, ‘সময় হবে না। দেশ ছাড়ার আগে অনেক কাজ আছে।’

‘দুই তিনদিনের জন্য কিছু হবে না। তোরা চল আমার সাথে। এক রাত আমাদের বাসায় থাকলি। পরের দিন গেলাম কক্সবাজার। দুই রাত থাইকা ঢাকায় ব্যাক করবি।’

তাৎক্ষণিকভাবে কেউ কিছু বলল না। চুপচাপ যে যার ভাবনায় মশগুল হয়ে রইল। ওয়েটার খাবার দিয়ে গেল। হৃদি আর অমৃতার খিদে নেই। একটু আগে ফুচকা খেয়েছে রাস্তার ধারে। রুদ্রর পেটে সব সময়ই অল্পবিস্তর খিদে থাকে। সে নিজের জন্য গ্রিন কারি অ্যান্ড এগ ফ্রায়েড রাইস অর্ডার করেছিল। আকাশ ভার্সিটিতে লাঞ্চ করেছে তবে তার মুখখানা এখন বড় শুকনো এবং ফ্যাকাশে। রুদ্র ওর দিকে খাবারের প্লেট ঠেলে দিয়ে বলল, ‘খেয়ে নে। তোর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সারাদিন কিছু খাস নাই।’

আকাশ প্রত্যুত্তর করল না। খাবারের প্লেট টেনে নিয়ে যন্ত্রের মতো খাওয়া শুরু করল। রুদ্র একটু নড়েচড়ে বসে বলল, ‘লিসেন ফোকস, আই নিড ইউ টু প্রমিস মি ওয়ান থিং, নো ম্যাটার হোয়াট… আমি দেশ ছাড়ার আগ পর্যন্ত… মানে আমার সামনে তোরা কেউ মন খারাপ করে থাকবি না। হাসিখুশি থাকবি। প্লিজ!’

১৭

আবাল্য চেনাজানা, একান্ত নিজস্ব শোবার ঘরে আজকাল সামির থাকতে ইচ্ছে করে না। বাড়িটাও মাঝে মাঝে নরকতুল্য মনে হয়। বিপ্লবের দুই রুমের বাসাই বরং ঢের আরামদায়ক। আরাম ব্যাপারটা তো শুধু শরীরী বা বস্তুনির্ভর নয়। মনেরও আরাম আয়েশের প্রয়োজন আছে। নরম বিছানা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুসজ্জিত আড়ম্বরপূর্ণ বাসস্থান যে কারো শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্যের কারণ হবে, কিন্তু মনের বিশ্রাম ভোগ সামগ্রী থেকে আসে না। বিনোদন আর বিশ্রাম একে অপরের সমার্থক নয়। বিনোদন হয়ত সাময়িক আনন্দ দিতে পারে কিন্তু মানসিক ক্লান্তি দূর করতে পারে না। সামির মনে হচ্ছে তার মন বড়ই ক্লান্ত। যন্ত্রণার আগুনও বোধহয় জ্বলতে জ্বলতে একসময় অবসন্ন হয়। সামি বুকের ভিতর এখন আর আগুনের আঁচ টের পাচ্ছে না। বরং ফাঁকা ফাঁকা একটা ভাব। এতটা ফাঁকা… এতটা একা….. জীবনে এর আগে কখনো বোধ হয়নি ওর! বেডরুমের সোফায় চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল সামি। বিছানায় শুতে ইচ্ছে করে না। বিছানার চাদরে আর বালিশের কাভারে হৃদির শরীরের ঘ্রাণ লেগে আছে এখনো। সামির মতো হৃদিরও কি আজকাল একা একা লাগে? একা লাগে কি বাবারও? মায়েরও? জীবনভর পাশাপাশি থেকে দুটো মানুষ দিনের পর দিন তিলতিল করে একটা নিরেট নিঃসঙ্গতার জাল বুনে গেছে। সেই নিঃসঙ্গতার জালটা এখন খালি চোখে ধরা পড়ছে।

শোয়া থেকে উঠে পড়ে সামি। অস্থির পায়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করে ঘরের ভেতর। সিগারেট নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। বড্ড গরম! এসি রুম থেকে বেরিয়ে পৃথিবীটাকে জ্বলন্ত চুল্লি বলে মনে হয়। উষ্ণ বাতাসে গায়ের চামড়া চিটচিট করে। মাথায় আবোলতাবোল চিন্তা আসে। আচ্ছা অমৃতা কেন চিঠিতে এতটা নিশ্চিত হয়ে বলেছিল লোকটার মনের ঘরে কখনো সে ছাড়া অন্য কোনো মানুষ বসত গড়তে পারেনি? লোকটা কি ওকে বলেছে কখনো, যে সে কোনোদিন সামির মাকে ভালোবাসেনি? এর মানে সামি জন্মের পর থেকে যা দেখে এসেছে তার সবটাই মিথ্যা এক ভ্রম ছাড়া কিছুই না। অথচ একটা মাস আগেও সামির মনে হতো ঐ দুজন মানুষ একে অপরের পরিপূরক। পৃথিবীতে কি তাহলে আমরা প্রতিনিয়ত ভুল দৃশ্য দেখতে থাকি? সকল মার্জিত সভ্য মানুষের ভেতরেই কি তবে বসত করে একটি করে আদিম সত্তা? সেই সত্তা মানুষ চেনে না… পরিবার… সন্তানসন্ততি… সমাজ চেনে না। শুধু চেনে নারী, পুরুষ। চেনে ক্ষুধা, তৃষ্ণা এবং কাম। সমাজ, সভ্যতা, নৈতিক মূল্যবোধের কপট আতিশয্যের ভিড়ে মানুষ কি নিজের পাশবিক সত্তাটিকেই আড়াল করে আসতে চাইছে যুগ যুগ ধরে? এই কপট সভ্যতা কি মানবজাতিকে মুক্তি দিয়েছে? নাকি গলায় পরিয়েছে পরাধীনতার শৃঙ্খল? ভদ্রতার মুখোশধারী প্রতিটি মানুষই কি তবে আভ্যন্তরীণ সেই আদিম, বর্বর, বন্য অভীপ্সার অবশ্যম্ভাবী শিকার? এমনই অজস্র এলোমেলো প্রশ্ন সামির ক্লান্ত মন এবং মস্তিষ্ককে সারি বাঁধা পিঁপড়ার মতো ঘিরে ধরে চারিদিক থেকে। হাঁসফাঁস লাগে। শ্বাসকষ্ট হয়। আজ সকালে একটা অদ্ভুত কাণ্ড হলো। সামি ভেবেছিল ওই কলঙ্কিত ঘটনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষটা হলো তার মা। ঐ একজনের অমনুষ্য, অতলশায়ী কষ্টর কথা চিন্তা করেই মনে মনে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিল সামি। আজ মাকে নিয়ে চিরতরে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিল এই লাঞ্ছিত জীবন থেকে, ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল মায়ের ন্যায্য সম্মান। অথচ বোকা মানুষটা বাড়ি থেকে বেরোনোর ঠিক আগ মুহূর্তে কান্নায় ভেঙে পড়ল। সামি অবাক, ‘কাঁদছ কেন?’

ওরা দাঁড়িয়ে আছে সদর দরজার মুখ বরাবর। একজন গৃহকর্মী রোমেলার ভ্যানিটি ব্যাগ বহন করছে। রোমেলা ছেলের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে মেয়েটিকে ধমকে উঠে বললেন, ‘দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে যা!’

মেয়েটি গর্জন শুনে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। হাতের ব্যাগ নিয়েই দৌড়ে পালাল। রোমেলা অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘এই বাড়ি ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারব না বাবা!’

সামির ভ্রু কুঁচকে গেল, ‘কেন?’

‘মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি এখানেই থাকতে চাই।’

‘কী আশ্চর্য! কেন?’

‘এটাই আমার সংসার, এটাই আমার একমাত্র ঠিকানা।

তারছেঁড়া এক বন্য রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠল সামির। গর্জে উঠে বলল, ‘এটা তোমার ঠিকানা হয় কী করে? এত কিছুর পরেও তুমি ঐ লোকটার সাথে একই ছাদের নিচে থাকতে চাইছ? তোমার ঘেন্না হচ্ছে না?’

রোমেলা আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, ‘ভুল তো মানুষই করে। সেও মানুষ। তার একটা ভুল হয়েছে। ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে আমার কাছে। একটা উটকো বাজে মেয়ের জন্য আমাদের এত বছরের সংসার ভেঙে যেতে পারে না। ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা কর।’

সামি বড় বড় চোখে কিছুক্ষণ মায়ের দিকে চেয়ে থেকে বিস্ময়-বদ্ধ কণ্ঠে বলল,

‘ওই লোকটা তোমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে?’

‘হ্যাঁ চেয়েছে।’

‘চাওয়ামাত্র তুমি ক্ষমা করে দিলে?’

রোমেলা আনতনয়নে বললেন, ‘ক্ষমা জিনিসটা অত সহজ নয়। তবে একটা সুযোগ তো দেয়াই যায়, তাই না?

সামি কঠোরভাবে বলল, ‘কিন্তু আমি কোনো সুযোগ দিতে চাই না। অসম্ভব!’

রোমেলা ছেলের হাতে হাত রেখে ব্যাকুল গলায় বললেন, ‘লক্ষ্মী বাবা আমার! সোনামানিক আমার! তুমি তোমার বাবাকে ক্ষমা করে দাও। এখানে উনার কোনো দোষ নেই। সব দোষ ওই বে-আদব অসভ্য মেয়েটার। ওই অসভ্য মেয়েটা টাকার লোভে পড়ে এসব করেছে। এর মাঝে নিশ্চয়ই অনেক টাকা তোমার বাবার কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে। টাকা নিয়ে শান্তিতে থাকুক সে। তার লোভের জন্য আমাদের সংসার কেন নষ্ট হবে?’

সামি চোখ সরিয়ে নিল অন্যদিকে। কথাগুলো কেন যেন শ্রাব্য বলে মনে হলো না তার। ভেতরে একটা অস্বস্তি কাঁটা দিয়ে উঠল অমৃতা নির্লজ্জ বেহায়া হতে পারে, গোঁয়ার হতে পারে, কিন্তু লোলুপ লোভী কিছুতেই হতে পারে না। কিন্তু ওই লোকটা মায়ের কাছে ক্ষমা চাইবার নাটক কেন করেছে? মা বড্ড বোকা। একজন প্রতারক ক্ষমা চাওয়ার মিথ্যে অভিনয় করেছে নিখুঁতভাবে। মা সেই কপট অভিনয় ধরতেই পারেনি। চট করে বিশ্বাস করে ফেলেছে। সামি জানে লোকটা মনে মনে বিন্দু মাত্র অনুতপ্ত নয়। সেই সকালের প্রতিটা খুঁটিনাটি স্পষ্ট মনে আছে। লোকটা নিজ মুখে সবকিছু স্বীকার করেছিল। ওই চেহারায় অপরাধবোধের ছাপ ছিল না। সামি মায়ের চোখে চেয়ে উত্তেজিতভাবে বলল, ‘তুমি কি বাই এনি চান্স আমার কথা ভেবে এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছ? দ্যাখো মা, আমি তো মাইনর নই। আই ক্যান হ্যান্ডেল মাইসেলফ। আমার জীবন আমি চালিয়ে নিতে পারব। তুমি আমার জন্য নিজের সাথে কোনো কমপ্রোমাইজ করো না। আমার কাছে তোমার সম্মানটাই বড়। আমি চাই না তুমি কোনো প্রতারকের সাথে একই ছাদের নিচে বসবাস কর।’

মা করুণ গলায় বললেন, ‘এই বয়সে আমি স্বামীর সংসার ছেড়ে কোথায় যাব বল?’

‘আমার সাথে থাকবে তুমি। আমি তোমাকে অনেক ভালো রাখব। তোমার কোনো কষ্ট হবে না।’

‘আমি জানি তুমি আমাকে খুব ভালো রাখবে। কিন্তু আমার স্বামীর প্রতি আমার একটা কর্তব্য আছে। পুরুষ মানুষের দু’ একবার পদস্খলন হতেই পারে। মেয়েদের ধৈর্য ধরতে হয়। তোমার বাবা দুশ্চরিত্র নয়। ওই অসভ্য মেয়েটাই তার মাথা খেয়েছে। তাই আমি ঠিক করেছি তাকে আরেকটা সুযোগ দেব।’

সামি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘বেশ তো…থাকো তাহলে তুমি। আমি চললাম।’

একথা শুনে রোমেলা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। কিছুতেই তিনি ছেলেকে বাড়ি ছেড়ে যেতে দেবেন না। অগত্যা… সামির আর যাওয়া হলো না।

সেলফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ। আকাশের ফোন। ফোনের স্ক্রিনে বন্ধুর নামটা দেখামাত্র একটু ভালো লাগল কি সামির? ক্লান্ত মনের ওপর দিয়ে হালকাভাবে বয়ে গেল কি এক পশলা আরামদায়ক মনোরম বাতাস? কে জানে!

ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল আকাশের সরস কণ্ঠস্বর।

‘ওই শালা…’ যত গালি জানা আছে সবগুলো একবার করে উচ্চারণ করে নিয়ে আকাশ কথার শেষে যোগ করল, ‘করস কী এত রাতে ব্যাটা?

ঘুমাস না ক্যান?’

সামিও মনের হাউশ মিটিয়ে উজাড় করে দিল গালির ভাণ্ডার। তারপর বলল, ‘তুই ঘুমাস না ক্যান? মাঝরাতে ফোন দিয়া জ্বালানোর মানে কী?’

পাশ থেকে রুদ্রর গলার আওয়াজ ভেসে এলো, ‘আসল কথাটা বল।’

‘আসল কথা মানে?’ সামির প্রশ্ন।

আকাশ একটু গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বলল, ‘আচ্ছা… খবর হইতেছে দুইটা… এক নম্বর হইল, বিভা আসতেছে পরশুদিন। আমার ফ্যাকাল্টির ক্রিকেট ম্যাচ আছে। সো এয়ারপোর্ট যাইতে পারব না। তুই যাবি রুদ্রর সাথে।

সামি নিশ্চুপ। আকাশ বলে চলল, ‘আর দুই নম্বর খবরটা সবচেয়ে জোশ।’

‘কী খবর?’ উৎসুক গলায় প্রশ্ন করে সামি।

‘খবরটা তোর বউ সম্পর্কিত।’

‘তাই?’

‘হ… তোর বউয়ের তো একটা জ্বীন বয়ফ্রেন্ড হইছে!’

‘ধুর বাল… এমনে কইতে আইছস আমি ভাবছিলাম আমার বউ প্ৰেগনেন্ট।’

রুদ্র বলল, ‘জ্বীন বয়ফ্রেন্ডের নাম শুনবি?’

‘নাম শুইনা করুম কী?’

‘শুইনা রাখ। তার নাম হইতেছে হালুলুকা।’

‘ঠিকই আছে। জ্বীনের নাম তো এরকমই হবে।’ সামির শুষ্কং-কাষ্ঠং মন্তব্য।

‘হালুলুকা নাকি মারাত্মক ড্যাশিং। চোখে কাজল দেয়…ঠোঁটে লিপ্সটিক দেয়।’

সামি হাসতে হাসতে হালকা ভাবে বলল, ‘দ্যাটস দ্য স্টুপিডেস্ট থিং আই হ্যাভ এভার হার্ড। যাই হোক… হৃদি কেমন আছে?’

আকাশের কথার সুর পালটে গেলো আচমকা, ‘ভালো থাকার কি কোনো চান্স আছে সামি? তুই কাজটা ঠিক করিস নাই।’

‘আমি আবার কী করলাম?’

‘তুই ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিছিস ক্যান?’

সামি অসহায়ভাবে বলল, ‘আর কোনো উপায় ছিল না।’

‘এখানে হৃদির কী দোষ?’

‘ও আমাকে কিছু বলে নাই। ওর উচিত ছিল জানা মাত্র ব্যাপারটা আমার সাথে শেয়ার করা… আসলে তোরা বুঝবি না… ইটস ওয়ে টু কমপ্লিকেটেড।’

রুদ্র ফোনটা ছিনিয়ে নিল আকাশের কাছ থেকে। কানে ঠেকিয়ে বলল, ‘শোন সামি… একটা কথা বলার ছিল।’

‘হুম বল।’

‘আমি তো নেক্সট মান্থের তিন তারিখ যাইতেছি। জানিসই তো।’

‘হুম।’

‘সো আমি চাই যাওয়ার আগের কয়টা দিন আমরা যেন আগের মতো মিলেমিশে থাকতে পারি। আবার কবে দেখা হয় ঠিক নাই দোস্ত। বুঝতে পারছস? সো তোর কাছে আমার একটা রিকোয়েস্ট, আমাদের ওপর রাগ ক্ষোভ যা আছে কয়টা দিনের জন্য ভুইলা যা প্লিজ। আমাদের ফ্রেন্ডশিপের খাতিরে হলেও ভুইলা যা।’

সামি একটা যন্ত্রণাবিদ্ধ, আহত শ্বাস ফেলল। হায় ফ্রেন্ডশীপ! বন্ধুদেরকে সে জীবনে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছে এবং জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাতটাও এসেছে এই বন্ধু দলের কাছ থেকেই! এটা কী রকম ভয়ঙ্কর কষ্ট তা কাউকে বলে বোঝানো যায় না… বন্ধুদেরকে উপেক্ষাও করা যায় না!

‘চুপ করে আছিস কেন?’ জানতে চাইল রুদ্র।

‘চেষ্টা করব।’ বলল সামি… বাধো বাধো গলায়।

‘হুম…আরেকটা বিষয়…।’ একটু থামে রুদ্র। তারপর ক্ষীণ স্বরে বলে,

‘অমৃতাও চলে যাচ্ছে।’

সামি থমকায়, ‘মানে কী? কোথায় যাচ্ছে?’

‘লন্ডন। অ্যাডমিশন হয়ে গেছে।’

‘ও…!’ শব্দটা অস্ফুটে উচ্চারণ করে সামি। বুকের কোণে কেন যেন একটা চিনচিনে ব্যথা ওঠে। ধীর গলায় বলে, ‘ঠিক আছে… এখন রাখি…পরে কথা হবে।’

১৮

তারা অ্যাসাইনমেন্টের কাজ করছিল। রাত প্রায় বারোটা। ড্রয়িং রুমের দেয়াল-ঘেঁষা সিঙ্গেল খাটের ওপর বসেই সে পড়াশোনা করে। কোলের ওপর একটা বালিশ। বালিশে ল্যাপটপ। এই ল্যাপটপ তার নিজের নয়। বান্ধবীর কাছ থেকে ধার করে আনা হয়েছে। প্রযুক্তিগত সুবিধা না থাকলে আজকাল পড়াশোনা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু তারা কম্পিউটার কিনবে কী করে? টিউশনির টাকা তো কলেজের যাতায়াত খরচেই খতম হয়ে যায়। অনলাইনে অ্যাসাইনমেন্টটা সাবমিট করে দিয়ে ল্যাপটপ বন্ধ করল তারা। বাতি নেভানোর সময় আচমকা মনে হলো রুদ্র হয়ত একটু পরেই বেরিয়ে আসবে। বাতি নেভানো দেখলে ভেবে নেবে তারা ঘুমিয়ে পড়েছে। এই ভেবে ফিরে যাবে ঘরে। তাহলে কি ওর জন্য আরেকটু সময় অপেক্ষা করা উচিত? কিন্তু কেন? সিগারেট ফুঁকা তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ নয়। একটা সিগারেট ঐ ছেলেটার ফুসফুসে না পৌঁছুলে ক্ষতি কিছুই হবে না। বরং এটাই মঙ্গলজনক। সাত-পাঁচ ভেবে বাতিটা নিভিয়ে দিতে গিয়েছিল তারা। ঠিক সেই সময় খুব সন্তর্পণে দরজা খোলার শব্দ হলো। বাতি তখনো নেভেনি। রুদ্রর পা-জোড়া পর্দার ওপাশে থমকে দাঁড়াল, ‘তারা জেগে আছ? আসব?’

এমন কেন হলো জানে না তারা। হঠাৎ একটা অপ্রত্যাশিত ভালো লাগায় মনটা চনমন করে উঠল। মৃদু গলায় বলল, ‘আসুন।’

রুদ্র পর্দা সরিয়ে ঢুকল ভেতরে। সাদা পাতলা টিশার্ট, কালো হাফ প্যান্ট। হাড্ডিসার শীর্ণ বাদামি রঙের হাঁটু আর ঠ্যাংঠ্যাঙা লম্বা পা দুটো দেখতে একটুও ভালো লাগে না তারার। ফুলপ্যান্ট পরলেই তো পারে!

‘একটা গুড নিউজ আছে।’ রুদ্র বলল সহাস্য বদনে।

তারা সোফার ওপর বসল। সেন্টার টেবিলের ওপর স্তূপ করে রাখা ম্যাগাজিনগুলো থেকে একটা তুলে নিয়ে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলল, ‘কী নিউজ?’

‘এই শনিবারে চিটাগাং চলে যাচ্ছি। কিছুদিন থাকব আব্বা আম্মার সাথে।’ তারা ম্যাগাজিনের ওপর থেকে দৃষ্টি তুলে নিয়ে রাখল রুদ্রর মুখের ওপর। আজকে ওর মাথায় তেল নেই। একরাশ কালো চুল ফুলেফেঁপে আছে মুখের চারধারে। চশমার ভেতরের আয়ত দুটি চক্ষুতে বিভ্রম ফুটিয়ে তুলে সে বলল, ‘গুড নিউজটা শুনতে চাচ্ছি।’

রুদ্রর ঠোঁটে রোজকার সেই ঝলমলে হাসি। একটা মানুষ এত সুখী হয় কী করে? তারার অবাক লাগে!

‘আমি চলে যাচ্ছি এটাই তো তোমার জন্য গুড নিউজ হওয়ার কথা। মাঝরাতে কেউ বিরক্ত করবে না।’ এটুকু বলে রুদ্র চোখ পিটপিট করে কী যেন ভাবল, ‘নাকি তুমি আমাকে মিস করবা?’

তারা নজর নামিয়ে নিল ম্যাগাজিনের পাতায়। অস্বস্তি নিয়ে বলল, ‘বয়েই গেছে!’

রুদ্র এগিয়ে গিয়ে বারান্দার দরজা খুলল।

‘এত সিগারেট খাওয়া ভালো নয়। জানেনই তো। তবুও এই অভ্যাসটা ছাড়ছেন না কেন?’ তারার কণ্ঠস্বর ভেসে এল পেছন থেকে। রুদ্র বারান্দায় পা রাখার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল তারাকে। সারা মুখে হাসির দীপ্তি ছড়িয়ে বলল, ‘ছেড়ে দেব। যেদিন কোনো সুন্দরী মেয়ে ভালোবেসে অনুরোধ করবে… সেদিন ঠিক ঠিক বদ অভ্যাসটা ছেড়ে দেব।’

তারার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। এই ছেলের সব সময় ফাজলামো! কথা বলাই মুশকিল!

রুদ্র গ্রিলের ধারে এসে সিগারেট ধরাল একটা। গুমোট রাত। এক ফোঁটা বাতাস নেই। বহুদিন বৃষ্টি হয় না। এই খরার দিন কবে কাটবে কে জানে! গ্রিলের ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা নারকেল গাছের মাথায় একলা চাঁদ জেগে আছে অনেকখানি আকাশ আলোকিত করে। জোছনার একটা নীল টুকরো এসে পড়েছে বারান্দার মেঝেতে। গলির মাথায় কুকুর ডাকছে ঘেউ ঘেউ করে। নিজস্ব এই চেনাজানা ভুবন ছেড়ে দূর দেশে গিয়ে থাকতে রুদ্রর কেমন লাগবে কে জানে! আদৌ পারবে কি? না পারলে কষ্ট পাবে বাবা। ওই মানুষটার বহুদিনের লালিত-পালিত আরাধ্য স্বপ্ন হলো, ছেলে একদিন বিশ্বের বিখ্যাত বিজ্ঞানী হবে। পত্র-পত্রিকায় নাম ছাপা হবে। দেশের লোক গর্ব করবে। অতটা পারবে না রুদ্র। কিন্তু চেষ্টায় ঘাটতি ছিল না, এতটুকু অন্তত পিতার সামনে বুক চিতিয়ে বলতে পারার সাহস অর্জন করতে চায় সে।

তারা ম্যাগাজিনের পাতা উল্টে যাচ্ছিল। রুদ্র চলে যাবে এটা সত্যিই ভালো খবর। এই ছোট্ট বাসায় এত লোকের উপস্থিতি বড্ড বেমানান। সবচেয়ে খুশি হবেন খালু। রুদ্রকে তিনি দু চোখে দেখতে পারেন না। তারাও হয়ত এখানে খুব বেশিদিন থাকবে না। পরশুদিন তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। বিয়ে করার মতো মানসিক প্রস্তুতি নেই। আকাশ এবং খালার মতের বিরুদ্ধে যাবার মতো সাহস বা স্পৃহাও নেই। তার জীবনে আপন বলতে এখন ঐ দুটি মাত্র মানুষ। এদের সিদ্ধান্তে আপত্তি জানাবে কোন সাহসে?

রুদ্র সিগারেট শেষ করে ঘরের ভেতর ঢুকল। বারান্দার দরজা আটকে দেবার আগে ফুর্তিবাজ গলায় বলল, ‘বাইরে চমৎকার জোছনা। চাইলে দেখতে পার।’

তারা একটু অস্বস্তিবোধ করল। জোছনা তাকে টানছে না এই মুহূর্তে। তার মধ্যে রোমান্টিসিজম ব্যাপারটা এখন আর নেই। মা মারা যাবার আগের পৃথিবীটা রূপবতী ছিল। তখন ভোরের বাতাস ভারী পবিত্র লাগত, বর্ষায় মেঘের ডাকে পছন্দের কবিতা মনে পড়ত, ভালোলাগত জোছনা রাতে ছাদের ওপর একলা দাঁড়িয়ে আবোলতাবোল স্বপ্ন বুনতে। আজকাল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে আলাদা কোনো মাধুর্য খুঁজে পায় না সে। তার কাছে এখন বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে জরুরি। রোজ তিনবেলা দুমুঠো খাবার আর রাতে ঘুমানোর জন্য একটা নরম বিছানা, এতটুকু পেলেই সে সন্তুষ্ট। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে রুদ্র বলল, ‘কী হলো? কথা খুঁজে পাচ্ছ না?’

তারা নিশ্চুপ। কিছুটা নার্ভাস। রুদ্র বারান্দার দরজা আটকে দিয়ে বলল, ‘এইজন্যেই বলছিলাম কথা শিখার ক্লাসটা কর। কথা বলাটা একটা আর্ট বুঝছ?’

তারা এবারেও কিছু বলল না। চুলে ঝুঁটি বাঁধা বিড়াল চোখের মুখভর্তি হিজিবিজি দাড়ি ওয়ালা ছেলেটার দিকে নির্বাক চেয়ে থেকে সে ভাবতে লাগল… আসলেই মাঝে মাঝে তাকে একদম বোবা ভূতে পেয়ে বসে। বলার মতো কোনো শব্দই খুঁজে পায় না। পুরো মাথা ব্ল্যাঙ্ক হয়ে যায়।

‘তোমার বয়স কত?’ রুদ্রর প্রশ্ন।

তারা ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া গলায় বলল, ‘কেন জানতে চাইছেন?’

‘কত বয়স তোমার? সত্তর, নাকি আশি?’

তারা জানে এটাও রুদ্রর কৌতুকের একটা অংশ। তাই উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। রুদ্র খুব সিরিয়াসভাবে বলল,

‘তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি সত্তর আশি বছরের বৃদ্ধা। আমি আজ পর্যন্ত তোমারে কখনো হাসতে দেখি নাই। সমস্যা কী তোমার?’

চশমার আড়ালের চোখদুটো হঠাৎ একটু জলসিক্ত হয়ে উঠল। কাঁপন ধরল ঠোঁটে। একথা তো ভীষণ সত্যি যে হাসতে ভুলে গেছে তারা। কীসে হাসি পায় মানুষের? কীসে হয় আনন্দ? তার জীবনে তো হাসির উদ্রেক ঘটানোর মতো কোনো ঘটনাই ঘটে না। রুদ্রর মতো সুখী মানুষের কাছে এমন গোমড়ামুখো রসহীন মেয়েকে অসংগতিপূর্ণ লাগাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারার মতো সাধারণ নগণ্য এক মেয়ের হাসিমুখ নিয়ে তো কেউ কখনো ভাবেনি! সবাই ধরেই নিয়েছে সে হাসতে পারে না। রুদ্র কী মনে করে যেন সোফার ওপর বসল। নিতান্তই স্বল্পমূল্যের বাদামি রঙের থ্রি-পিস পরিহিতা শ্যামবর্ণের মেয়েটির অশ্রুসজল চোখের দিকে চেয়ে রুদ্রর হঠাৎ মনে হলো এই ইন্ট্রোভার্ট মেয়েটি আসলে ভীষণ একা! এমন আগাপাশতলা একাকিত্বে ডোবা মেয়ে রুদ্র আগে কখনো দেখেছে কিনা মনে পড়ে না। কিন্তু ওর মুখটায়… কী যেন একটা আছে! দেখলেই ঝিরঝিরি ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগে বুকে।

‘দ্যাখো, আমাকে কিছু বলতে হবে না তোমার। তুমি বরং এমন কোনো বন্ধু খুঁজে নাও যার সাথে ব্যক্তিগত বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করতে পারবে। হতে পারে সে তোমার বাবা মা, কিংবা ভাই-বোন, কিংবা কোনো বন্ধু…!’

‘আমার মা নেই। বাবা থেকেও নেই।’ একটু কেঁপে উঠল তারার কন্ঠস্বর।

রুদ্র নিভল, ‘সরি টু হিয়ার দ্যাট… এক্সট্রিমলি সরি।’

তারা দেখল রুদ্রর মুখে এখন হাসির ঝিলিক নেই। কেমন অন্যরকম দেখাচ্ছে ওকে।

‘শোন তারা, বাবা মা সবসময় সাথে থাকে না। মানুষকে নিজের জন্যই বাঁচতে হয়।’

‘আমি নিজের জন্যই বেঁচে আছি! খেয়ে পড়ে কোনো রকমে বেঁচে থাকতে পারলেই আমি সন্তুষ্ট। হাসিখুশি থাকার মিথ্যে অভিনয় করার কোনো প্রয়োজনবোধ করি না।

‘খাওয়া পরা ছাড়াও দেয়ার ইজ অ্যা হোল ওয়ার্ল্ড আউট দেয়ার। দেখার মতো চোখ থাকতে হয় শুধু।’

‘ওসব না দেখেও দিব্যি দিন কেটে যায় রুদ্র ভাইয়া!’

‘তোমাকে ভাইয়া ডাকতে নিষেধ করেছি। ভাইয়া ডাকবে না।

‘কেন?’

রুদ্রর মুখে একশ’ ভোল্টের হাসিটা ফিরে এলো। ফিচেল গলায় বলল, ‘সুন্দরী মেয়েরা ভাইয়া ডাকলে আমার ভালো লাগে না।’

তারা বিব্রতবোধ করল। নিজেকে কখনো সুন্দরী মনে হয়নি। সচরাচর কেউ রূপের প্রশংসাও করে না। রুদ্র নিশ্চয়ই সব মেয়ের সাথেই এসব সস্তা রসিকতা করে থাকে। একজন আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন মার্জিত রুচির মেয়ে হিসেবে তারার নিশ্চয়ই এখন খুব কড়া কথা শুনিয়ে দেয়া উচিত রুদ্রকে। কিন্তু কোনো এক বিচিত্র কারণবশত সে রাগ করতে পারল না। বরং নিজেকে নিজে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে কেমন মিনমিনে গলায় বলল, ‘আমি একটুও সুন্দর না।’

রুদ্রর বিড়াল চোখে দুনিয়ার সব বিস্ময় যেন ফেটে পড়ল, ‘সুন্দর নও?’

তারা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে চুপ করে রইল। রুদ্র তারার সহজ-সরল শ্যামবর্ণের মুখটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে শান্ত হেসে বলল, ‘তুমি শুধু যে সুন্দর তাইই না… বরং তোমার চেহারায় একটা শান্তি-শান্তি ভাব আছে। দেখলে আরাম লাগে!’

তারা জানে কথাটা নিছক মনরক্ষার খাতিরে বলা হয়েছে। কিন্তু সত্য মিথ্যা যাই হোক না কেন, এত সুন্দর করে কেউ কোনোদিন ওর প্রশংসা করেনি। কথাগুলো শুনে খুশির উষ্ণ উত্তাপে মন ভরে গেছে। আলতো করে চোখ তুলে তাকালো ও রুদ্রর দিকে। ওই মুখে এখনো ফকফকা হাসি। তারার ইচ্ছে হলো বলে, আমি তো হাসতে জানি না, আপনি আমাকে একটু হাসি ধার দেবেন?

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ হলো। মিনিট না গড়াতেই পর্দা ঠেলে গলা বাড়িয়ে দিল আকাশ। সারা মুখে ঘুমের রেশ জড়ানো। চোখ লালচে, মাথার চুল এলোমেলো। ভারী অবাক গলায় বলল, ‘কী ব্যাপার? এত রাতে কী করিস তোরা? ঘুমাস নাই?’

ওদের দুজনের মধ্যে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেছে। দুজনেই চমকানো, থমকানো এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ওরা কোনো চুরি ডাকাতি করছিল না তবুও ভাব দেখে মনে হচ্ছে যেন পুকুর চুরি ধরা পড়ে গেছে। রুদ্র বেকায়দায় বলল, ‘এইত… ঘুম আসতেছিল না। তাই ভাবলাম…’

‘কী ভাবলি?’

আকাশের ভ্রু-কুঁচকে গেছে। চোখে উঁকি দিচ্ছে তেজ।

রুদ্র হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘বিড়ি টানতে আসছিলাম। তুই উইঠা আইলি ক্যান? ঘুম ভাঙল ক্যামনে হঠাৎ?’

আকাশ উত্তর না দিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলো। এল রুদ্রও। দরজাটা আবজে দিয়ে আকাশ বলল,

‘তোরে নিষেধ করছিলাম।’

‘মানে কী?’

‘তোরে বলছিলাম ওর থেকে দূরে থাকতে। বলি নাই?’

রুদ্র হাসল, ‘কাছে তো যাই নাই। দূরেই ছিলাম।’

আকাশের চোখ দুটো হঠাৎ হিংস্র জন্তুর মতো ধকধক করে জ্বলে উঠল, ‘ফাইজলামি করস?’

রুদ্র শ্রাগ করল, ‘ফাইজলামির কী আছে মামা? আজব! তুই ওভাররিঅ্যাক্ট করতেছিস ক্যান?’

‘করতেছি কারণ, তোরে আমি চিনি। মেয়ে দেখলেই আজাইরা কথা না বললে তোর পেটের ভাত হজম হয় না।’

‘একটু আজাইরা কথা বললে সমস্যা কী?’ রুদ্রর করুণ প্রশ্ন।

‘সমস্যা হচ্ছে তারা আমার কাজিন। আর ও খুবই সিম্পল একটা মেয়ে। তোর এইসব সস্তা রসিকতা ও বুঝবে না। রাত বিরাতে একটা ভদ্র মেয়ের সাথে তুই ফ্লার্ট করতেছিস। তোর মাথা ঠিক আছে?’

রুদ্র একটু কড়াভাবে বলল, ‘ফ্লার্ট করতেছিলাম না। কথা বলতেছিলাম।’

‘কী কথা?’

‘তোকে বলা লাগবে?’

‘হ্যাঁ লাগবে।’

‘আকাশ বাড়াবাড়ি করিস না।’

‘আমি বাড়াবাড়ি করতেছি না। তুই করতেছিস।’

রুদ্র একটু অদ্ভুত হাসল, ‘তোর কি ভয় হচ্ছে যে ওর সাথে আমার সত্যিই প্রেম হয়ে যাবে?’

আকাশ গমগমে গলায় বলল, ‘তোরে আমি খুব ভালো মতোই চিনি। দুইদিন পর তোর অন্য কাউরে ভালো লাগবে। প্রেম-ট্রেম তোর হবে না। কিন্তু তারা ছোট মানুষ। ওর মন নিয়ে খেলিস না। সে তোর কথাবার্তা সিরিয়াসলি নিয়ে নিলে সমস্যা আছে।’

রুদ্র হেসে ফেলল, ‘ধুর ব্যাটা! সিরিয়াসলি নেয়ার মতো কিছুই বলি নাই। হুদাই প্যারা নিস না।’

১৯

বিভা ল্যান্ড করবে বেলা বারোটায়। বন্ধুরা বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো দশটার দিকে। সামি গাড়ি নিয়ে প্রথমে রুদ্রকে পিক করল। তারপর চলল হৃদির বাসায়। হৃদি তৈরি হয়ে বাসার নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর পরনে বেগুনি কটন সিল্কের সালওয়ার কামিজ আর ওড়না। খোলা চুল। ঠোঁটে হালকা ম্যাট লিপ্সটিক। বাসার কলাপসিবল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে স্মার্টফোন হাতে নিয়ে আবিষ্টভাবে ফেসবুক ব্রাউজ করছিল সে। হঠাৎ একটা কণ্ঠস্বরে ঘোর ভাঙল তার। পলক তুলে দেখল বছর বিশেকের একটি তরুণ ছেলে লাজুক মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

‘কিছু বলবেন?’ হৃদি প্রশ্ন করল।

‘স্লামালিকুম আপু।’

‘ওয়ালাইকুম সালাম।’

‘আপু একটা প্রশ্ন ছিল, রাগ করবেন নাতো?’

হৃদি বেশ অবাক হলো। ছেলেটাকে আগে কোথাও দেখেছে বলে মনে পড়ে না। ভ্রু-কুঁচকে বলল, ‘কী প্রশ্ন?’

ছেলেটি একটু বিব্রতভাবে বলল, ‘আপু আপনার নাম কি কাজল?’

‘কী?’

‘না মানে… আপনাকে দেখতে একদম বলিউডের নায়িকা কাজলের মতো তো, তাই আমার বন্ধুরা বেট ধরেছে যে আপনার নাম নিশ্চয়ই কাজলই হবে।’

বিস্মিত হৃদি কী বলবে খুঁজে পেল না। মুখ হাঁ করে আগডুমবাগডুম চোখে চেয়ে রইল শুধু। জীবনে অনেকেই বলেছে কাজলের সাথে তার চেহারার বিশদ মিল আছে, কিন্তু এই মামুলি ব্যাপার নিয়ে যে কেউ বাজি ধরতে পারে… এই ঘটনা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। হঠাৎ অ্যাপার্টমেন্টের সামনে একটা মার্সিডিজ বেঞ্চ এসে থামল। সেকেন্ড গড়ানোর আগেই গাড়ির জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে দিল রুদ্র, ‘তাড়াতাড়ি উঠে পড় গাড়িতে। টাইম নাই।’

হৃদির বিস্ময়ের পাল্লায় ডাবল ডোজ পড়ল। প্রথমত এই অচেনা তরুণের আজগুবি ভাষ্য, দ্বিতীয়ত তার বন্ধুর আগমন হয়েছে সামির গাড়িতে চড়ে। এয়ারপোর্টে সামিও যাবে, এই তথ্য ছিল অজানা। তরুণটি খুব সম্ভবত রুদ্রকে দেখে একটু ভড়কে গিয়েছিল। একটা সালাম দিয়ে দ্রুত প্রস্থান করল জায়গাটা থেকে। সামি নামল গাড়ি থেকে। রুদ্রকে বলল, ‘ওয়েইট কর। আমি একটু আসতেছি।’ হৃদির দিকে এক ঝলক তাকিয়েই চোখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। হনহনিয়ে ঢুকে গেল বিল্ডিং-এর ভেতর। যাচ্ছে কোথায় মহাশয়? হৃদির বাসায় এসে হৃদিকেই অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। চমৎকার!

হালকা আকাশি রঙের একটা ফতুয়া পরেছে সামি। কালো গ্যাবার্ডিং প্যান্ট। চোখে দামি ব্র্যান্ডের রোদ চশমা। টানা অনেকগুলো দিন পরে ওকে দেখতে পেয়ে হৃদির মনে হলো এই মানুষটা সত্যিই অন্য সবার চাইতে একটু বেশি ঝলমলে। দেখলেই বোঝা যায় এর শরীরে সম্ভ্রান্ত বংশের রক্ত বইছে। যেন আভিজাত্যের প্রতিমূর্তি! হৃদি অবিন্যস্ত পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। জানালায় মুখ নামিয়ে অস্থিরভাবে বলল, ‘ঐ শয়তানটাকে সাথে নিয়ে আসছিস ক্যান? আমি উঠব না ওর গাড়িতে।’

রুদ্র গম্ভীর ভাবে বলল, ‘তাহলে এক কাজ কর দোস্ত!’

‘কী কাজ?’

‘হালুলুকাকে ডাক দে। সে উড়ায় নিয়ে যাবে তোকে এয়ারপোর্ট। তুই হালুলুকার সাথে উড়তে থাকবি আকাশে। আমরা তোদের নিচে নিচে গাড়ি চালাইতে থাকব।’

হৃদি রুদ্রর মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলল, ‘সবসময় কুত্তামি না করলে ভালো লাগে না?’

রুদ্র বলল, ‘ক্যান খারাপ কিছু তো কই নাই। দারুণ আইডিয়া। দৃশ্যটা কল্পনা করেই আমার খুব আনন্দ লাগতেছে। তুই মামা এখুনি ডাক হালুরে।’

হৃদি গোমড়া মুখে বলল, ‘হালু এখন ঘুমাচ্ছে।’

‘অসময়ে ঘুমায় ক্যান শালা?’

‘ও রাতে জেগে থাকে। দিনে ঘুমায়।’

‘কেন নাইট গার্ডের চাকরি নিছে নাকি?’

‘চাকরি নিবে কেন?’

‘জ্বীনেরা কি চাকরি-বাকরি, কাজ কাম কিছু করে না দোস্ত? নাকি তোর মতো গাধা টাইপ মানুষদের ঘাড় মটকানোই ওদের একমাত্র কাজ?’

হৃদি রেগেমেগে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই সামির আবির্ভাব হলো।

‘উঠে পড়, উঠে পড়! হালু যেহেতু ঘুমাচ্ছে এই গাড়ি ছাড়া তোর আর গতি নাই।’ কথাটা বলতে বলতে রুদ্র দরজা খুলে বেরিয়ে এসে হৃদিকে জোরজার করে গাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে দিল।

‘কই গেছিলি তুই?’ সামির উদ্দেশ্যে রুদ্রর প্রশ্ন।

‘শ্বশুর শাশুড়ির সাথে দেখা কইরা আসলাম।’

হৃদি ভেংচি কেটে অনেকটা ফিসফিস করে বলল, ‘বউয়ের খবর নেয়ার বালাই নাই। গেছে শ্বশুর শাশুড়ির খোঁজ নিতে! আদর্শ জামাই!’

সামি কথাটা শুনেও না শোনার ভান করল। মনোযোগের সাথে ড্রাইভ করতে লাগল গাড়ি। কথা বলল খুব কম। কথা বলল না হৃদিও। কিন্তু রুদ্রকে থামানোর সাধ্য আছে কার? তার একচ্ছত্র বকবকানি টেপ রেকর্ডারের মতো বাজতে থাকল সারাটা রাস্তাজুড়ে। বিমানবন্দর পৌঁছে দেখা গেল অ্যারাইভাল গেটের সামনে বেজায় ভিড়। গরমে দরদর করে ঘামছে সবাই। বাতাসে আগুনের হলকা। সেই এক দঙ্গল লোকের ভিড়ের মধ্যে গিয়েই দাঁড়াতে হলো ওদের।

‘তুই কি আগের চাইতে কালো হয়ে গেছিস নাকি দোস্ত? কেমন জানি ময়লা ময়লা লাগতেছে তোকে দেখতে।’

রুদ্রর প্রশ্ন শুনে চোখ কটমট করে তাকালো হৃদি। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘এখনই ক্যান তোর এই ফালতু কথাটা বলা লাগল?’

রুদ্র দায়সারা গলায় বলল, ‘ক্যান? এখন কি কোনো স্পেশাল টাইম নাকি?’

হৃদি গলা খাদে নামালো, ‘সামনে একটা সুন্দর ছেলে দাঁড়ায় আছে। রণবীর কাপুরের মতো জোশ একটা ছেলে। একটু পরপর আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমাকে একটু ভাব নিতে দে প্লিজ। বিরক্ত করিস না।’

রুদ্র দেখল কয়েক হাত দূরে একটা লম্বা ফর্সা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। রণবীর কাপুরের চেহারাটা এই মুহূর্তে মনে পড়ল না। সামি দাঁড়িয়ে ছিল বিরস মুখে। রুদ্র ওর দিকে চেয়ে বলল, ‘কীরে? তোর বউ এইসব কী কয়?’ হৃদি ফুঁসে উঠল কালনাগিনীর মতো, ‘আমি কারো বউ-টৌ না। ছিলাম এক সময়। এখন আর নাই।’

সামি চোরা চোখে কয়েক হাত দূরে দাঁড়ানো ছেলেটাকে পর্যবেক্ষণ করছিল। হৃদির সাথে ছেলেটার চোখাচোখি হচ্ছে ঘন ঘন। হৃদির ঠোঁটে প্রশ্রয়ের হাসি। চোখে চাপা আনন্দের ঝিলিক। হৃদি কি কাজটা ইচ্ছাকৃতভাবে করছে সামিকে জ্বালানোর জন্য? কে জানে! সামি ঠিক করেছে সে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে না। হৃদির বুঝতে হবে সামি এখন আর ওকে বিন্দুমাত্র কেয়ার করে না। সামিকে চুপ থাকতে দেখে রুদ্র অধৈর্য গলায় বলল, ‘আমার বউ যদি এমন কিছু করত আমারই সামনে দাঁড়াইয়া। এক থাবড়া দিয়া দাঁত ফালায় দিতাম সবকটা।’

‘এইজন্যেই তোর বউ নাই। হবেও না কোনও দিন।’ কড়া মন্তব্য ছুড়ে দিল হৃদি।

সামি গম্ভীর গলায় বলল, ‘বাদ দে তো! ফালতু লোক ফালতু কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক। করতে দে।

হৃদি কথাটা শুনতে পেয়েও পাত্তা দিল না খুব একটা। কারণ, ঠিক সেই মুহূর্তেই রণবীর কাপুর ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি হেসেছে। রুদ্র হাসিটা তেরছা চোখে লক্ষ্য করে বলল, ‘তুই না বাথরুমে যাইতে চাইছিলি?’

‘হ্যাঁ, চাইছিলাম তো। কোথায় বাথরুম? তুই একটু খুঁজে দ্যাখ।’

রুদ্র ‘আচ্ছা দেখতেছি।’ বলে জায়গাটা থেকে সরে দাঁড়ালো। যাবার সময় সামির দিকে চেয়ে এক চোখ টিপল। সামি নীরস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শুধু। কিছু বলল না। পকেট থেকে সিগারেটের বাক্স বের করে আগুন ধরালো। দেখতে পেলো ভিড় ঠেলে ছেলেটা হৃদির দিকে এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি এসে কী যেন বলল। চারপাশে বেজায় হই হট্টগোল। সামি কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের কথোপকথন স্পষ্টভাবে শুনতে পাচ্ছে না। শুধু দেখছে ছেলেটার হাসিমাখা ঠোঁট নড়ছে। হাসছে হৃদিও। বলছে কিছু একটা। সামি সিগারেটে টান দিতে ভুলে গেলো। বুকের মধ্যে কাটা পেঁয়াজের ঝাঁজওয়ালা একটা অনুভূতি টগবগ করে ফুটে উঠছে। হঠাৎ আকাশ ফুঁড়ে নেমে এল রুদ্র। চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘হৃদি! দোস্ত বাথরুম পাইছি! পাঁচ টাকা টিকেট। পেশাব করলেও পাঁচটাকা। পায়খানা করলেও পাঁচটাকা। তুই কোনটা করবি?’

হৃদির হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা দপ করে নিভে গেলো। সামনে দাঁড়ানো অপরিচিত ছেলেটি অপ্রস্তুত ভাবে একবার তাকালো রুদ্রর দিকে। রুদ্র নির্বিকার গলায় বলল, ‘স্বামী স্ত্রীর জন্য আছে বিশেষ অফার। মানে একসাথে টিকেট কাটলে দুইটাকা ডিস্কাউন্ট। আটটাকায় দুইজন যাইতে পারবি।’ একটু থেমে খুব গম্ভীরভাবে সামিকে আদেশ করল, ‘তুই যা তোর বউয়ের সাথে।’

সামি মুখ লুকিয়ে হাসতে লাগল। রুদ্র হাসল না। দরাজ গলায় হৃদিকে বলল, ‘কোনটা করবি দোস্ত? যা করার তাড়াতাড়ি কর। বিশাল লম্বা লাইন। ভাঙতি টাকা আছে তো?’

অপরিচিত ছেলেটি ভড়কে গেছে। হৃদির অপমানে টসটস করা মুখের দিকে চেয়ে সামিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘উনি আপনার হাজবেন্ড?’

হৃদি চোখ নামালো নিচে। কিছু বলল না। ছেলেটি খুব ধীর স্বরে বলল, ‘আমি বরং আসি। আপনি বোধহয় ব্যস্ত আছেন এই মুহূর্তে।’ কথাটা বলে শেষ করেই ছেলেটি কেটে পড়ল।

‘রুদ্রর বাচ্চা! তুই এইটা কী করলি?’ আগুন ঠিকরে বেরোলো হৃদির চোখে থেকে। মনে হলো এখুনি রুদ্রর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আঁচড়ে কামড়ে দেবে।

‘আমি আবার কী করলাম! করবি তো তুই। পাঁচ টাকায় যা মন চায় তাই করতে পারবি।’

হৃদি তেড়ে এসে রুদ্রর পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিল। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘শালা কুত্তা! মনের আনন্দে একটু ফ্লার্ট করতেছিলাম সহ্য হইল না! আজেবাজে কথা বলে মুডটাই নষ্ট করে দিলি।’

সামি মিটমিট করে হাসছিল আর নিঃশব্দে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছিল। হৃদি কুটিল বক্র চোখে একবার ওকে দেখে নিয়ে বজ্রকণ্ঠে রুদ্রকে বলল, ‘তোর ফ্রেন্ড ভিলেনের মতো হাসতেছে ক্যান?’

সামি রুদ্রর দিকে ঠান্ডা চোখে তাকাল, ‘দোস্ত আমি এখন হয়ে গেছি ভিলেন। আর অন্য পোলা হইল সিনামার নায়ক। কী জানি একটা কাপড়? নাম ও তো জানি না শালা।’

‘অনিল কাপড়।’ রুদ্র বলল বিজ্ঞ গলায়।

‘না জেনে কথা বলবি না। আর কাপড় না কাপুর। রণবীর কাপুর। খ্যাতের বাচ্চা খ্যাত কোথাকার।’ রাগে গজগজ করে উঠল হৃদি।

সামি রুদ্রর দিকে চেয়ে বলল, ‘শুনো মামা বিয়ার আগে তুমি থাকবা নায়ক, আর বিয়ার পরে খলনায়ক। বুইঝ কিন্তু হিসাবটা। ভুলেও বিয়াশাদী করার কথা চিন্তা কইর না। যেমন আছ এমনেই থাকো। ব্যাচেলার লাইফই বেস্ট।’

হৃদি কোমর বেঁধে ঝগড়ার ময়দানে নামতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগে বিভাকে এক ঝলক দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল রুদ্র। হাত নেড়ে গলা উঁচিয়ে ডাকল, ‘বিভাবরী! আমরা এইদিকে!’

বিভা ঘুরে তাকালো। একটা নীল রঙের ঢিলাঢালা জাম্পস্যুট পরেছে ও। পিঠে ছড়ানো একগুচ্ছ রেশমি কালো চুল। চোখে ব্লু স্মোকি আইশ্যাডো। ঠোঁটে কফি কালারের ম্যাট লিপস্টিক আর কপালের সিঁথিতে এক থোকা থ্যাবড়ানো লাল সিঁদুর। ওকে দেখা মাত্র হৃদির মনে পড়ল, বিভা চলে যাবার পর থেকে সে সাজগোজ করতেই ভুলে গেছে। কেউ এখন আর ওর সাজসজ্জার ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয় না। জোরজার করে সাজতে বাধ্য করে না। বিভাটা কী সুন্দর! দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। মন চায় ওর মতো স্টাইলিশ হতে, ফ্যাশন্যাবল হতে, সুন্দরী হতে…! রুদ্র বান্ধবীর জন্য ফুলের মালা নিয়ে আসতে ভুলেনি। মালা হাতে নিয়ে নাচতে নাচতে এগিয়ে গেল সে বিভার দিকে। মুখে বলতে লাগল, শুভেচ্ছা স্বাগতম, বিভাবরীর আগমন! সামি আর হৃদিও ওর সাথে গলা মিলিয়ে দিল। বিভা ইলেকশনে মনোনয়ন পাওয়া নেত্রীর মতো বিজয়ীর হাসি হাসতে হাসতে গলায় মালা পরল। তারপর উপস্থিত জনতার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তে লাগল। যেন তাকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছে আমজনতা। বন্ধুরা নয়। লোকজনের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। কে এই সুন্দরী? কোনো বিখ্যাত মডেল নয়ত?

রুদ্র খোশ মেজাজে নাচতে নাচতে বিভাকে জড়িয়ে ধরার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল। বিভা এক লাফে ওর কাছ থেকে কয়েক কদম দূরে সরে গিয়ে বলল, ‘দোস্ত তোকে দেখে মনে হচ্ছে ঘাম দিয়ে গোসল করে আসছিস। প্লিজ এখন ধরিস না আমাকে। দোহাই লাগে।’

কে শোনে কার কথা। রুদ্র ওকে জড়িয়ে ধরল ঝপ করে। মুখে বলল, ‘বিভাবরী… কতদিন পর দেখা!’ হৃদিও বিভাকে জড়িয়ে ধরল পেছন থেকে। এই হাঁসফাঁস গরমে দুই বন্ধুর জাপটে ধরা ভালোবাসায় দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হল বিভার। সামি অদূরে দাঁড়িয়ে ছিল। বিভা দুই বন্ধুর হাত থেকে কোনো রকমে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সামির দিকে এগিয়ে গেল। সামি আর অমৃতার জন্যই মন বেশি কাঁদছিল এ কদিন। বিভার মনে হলো সামি অনেক শুকিয়ে গেছে। চোখে ক্লান্তির গাঢ় ছাপ। সামি কয়েক পা এগিয়ে এসে আলতোভাবে আলিঙ্গন করল ওকে। মুখে বলল, কেমন আছিস?’

‘আমি ভালো। তুই কেমন আছিসরে সামি? অনেকদিন তোর সাথে কথা হয় না। ফোনই তো ধরিস না।’

‘এইতো আছি দোস্ত। একটু ঝামেলায় ছিলাম… জানিসই তো।’

রুদ্রর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘শোন সবাই। আমরা কিন্তু পরশুদিন চিটাগাং যাচ্ছি।’

‘বলিস কী? কবে প্ল্যান করলি? আমাকে তো কিছুই জানাস নাই।’ বিভা অবাক।

‘এইতো জানাইলাম।’ রুদ্রর প্রত্যুত্তর।

বিভার বাবার বাড়িতে সবাইকে নামিয়ে দিয়ে সামি চলল বিপ্লবের ফ্ল্যাটে। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস ওখানে রয়ে গেছে। তাছাড়া স্কুলের চাকরিটা করা হবে না এই খবরটাও বিপ্লবকে দেয়া দরকার। মা খুব করে চাইছেন হক অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস এর অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবেই সামি কাজ করুক। অতএব অনিচ্ছা সত্ত্বেও পিতার বাণিজ্য কারবারেই আত্মনিয়োগ করতে হবে শেষমেশ। মাকে সে আর কষ্ট দেবে না। জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষটির দ্বারা এত বীভৎসভাবে প্রতারিত হবার পর মা যে বেঁচে আছে এই তো বেশি! সামি ঠিক করেছে এখন থেকে মায়ের সব কথা মেনে চলবে।

বিপ্লবের বাসার একটা স্পেয়ার চাবি ছিল সামির কাছে। তাই ওর অনুপস্থিতিতেও ভেতরে ঢুকতে সমস্যা হলো না। জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে চুপচাপ বসে অপেক্ষা করতে লাগল সামি। বিপ্লব এল দুপুর দুটায়। একসাথে খাওয়াদাওয়া করে শরতের গুমোট তপ্ত বিকেলটায় অযথাই ঘুরাঘুরি করল দুজনে। অন্যমনস্ক, বিষণ্ণ সামির ভাবনায় বন্ধুরা এসে হানা দিচ্ছিল বারংবার। বিভা এসেছে কতদিন পরে! উচিত ছিল বিভাকে সময় দেয়া। রুদ্রটাও চলে যাবে… অমৃতাও! দুর্ঘটনার পর থেকে অমৃতাকে আর দেখেনি সে। এমনকি ভাবতেও চায়নি ওর কথা। মনের ওপর থেকে ইরেজার দিয়ে ঘষে ঘষে নামটা মুছে ফেলতে চেয়েছিল। এত কালের চেনা বন্ধুটা হঠাৎ কী করে এমন অচেনা হয়ে উঠল সামি তা আজও বুঝে উঠতে পারে না। সে ভেবেছিল বন্ধুদের মনের অলি-গলির প্রতিটি রন্ধ্র সম্পর্কে সে অবগত। ওরা একই সাথে চলাফেরা করে, একই সাথে নিঃশ্বাস নেয়, একই ভাবে চিন্তা করে, একই রকম স্বপ্ন দেখে! একই ধাতে গড়া মনের মাঝেও যে আচমকা এমন ব্যতিক্রমী ঢেউ লাগতে পারে তা কে জানত! নাকি অমৃতাকে সে কখনো চেনেনি? চেনেনি নিজের জন্মদাতা পিতাকেও!

বাড়ি ফিরল সন্ধ্যের পর। বাড়িতে থাকাকালীন সময়ে হৃদির কথা বেশি বেশি মনে পড়ে। তাই বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না আজকাল। কিন্তু ফিরতে হবে। মা যতক্ষণ আছে… বাড়িতে সামির ফিরতেই হবে। উত্তরার এই প্রাসাদতুল্য আবাসস্থলে সর্বদা লোকজনের আনাগোনা লেগেই থাকে। রাজনৈতিক দলের লোকরা ভিড় জমায় হরহামেশা। আত্মীয়স্বজনেরও কমতি নেই। আজ ড্রয়িংরুমে কিছু অপরিচিত মুখ দেখতে পেল সামি। সকলেই মধ্যবয়সী মহিলা। সাজপোশাক দেখে ঠাওর করা যায় সমাজের উঁচুতলায় এদের বিচরণ। রোমেলা ম্যাজেন্টা রঙের একটা মসলিন সিল্কের শাড়ি পরেছেন। গলায় কানে ম্যাচিং অর্নামেন্টস। সাজসজ্জায় বরাবরই খুব মনোযোগী তিনি। ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে কথা বলছিলেন। সামি ঢুকতেই উপস্থিত অতিথিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভদ্রতা রক্ষার্থে একটা তাড়াহুড়ার সালাম দিয়ে সামি দ্রুত কেটে পড়ল জায়গাটা থেকে। এত লোকজন আছে জানলে বাড়ির পেছন দিকের দরজা দিয়েই প্রবেশ করত। তবে মায়ের হাসিখুশি চেহারাটা দেখে ভালো লাগছে। মা যে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা করছে এতেই ভীষণ সন্তুষ্ট সামি। ডাইনিং-এ পানির বোতল নিতে এসেছিল। লোকটাকে দেখতে পেল। ঘরোয়া টিশার্ট আর ট্রাউজার পরনে। চাপা চোয়ালে অবহেলার দাড়ি। আবিষ্ট মনে রুটি আর সবজি খেয়ে যাচ্ছে। লোকটা আজীবনই খুব স্বল্পাহারী। ঘরে অন্য কারো উপস্থিতি নেই। সামির আগমন টের পেয়ে রাশেদ চোখ তুলে তাকালেন। শুষ্ক, নিষ্প্রাণ দুটি চোখে প্রচ্ছন্ন এক প্রফুল্লতার ছায়া পড়ল যেন। অপ্রস্তুত হলো সামি। ফ্রিজ থেকে চট করে একটা পানির বোতল বের করে নিয়ে ত্রস্ত পায়ে প্রস্থান করল জায়গাটা থেকে। দোতলার সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে হঠাৎ তার মনে একটা অদ্ভুত প্রশ্নের উদয় হলো, কে বেশি নিঃসঙ্গ? তার মা? ওই লোকটা? নাকি সে নিজে?

বেডরুমে প্রবেশের মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই একজন কাজের লোক এসে দরজায় ধাক্কা দিল।

‘ভাইয়া, আপনাকে স্যার ডাকে।’

সামি থমকে গেল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। মনের অজান্তেই শক্ত হয়ে উঠল চোয়াল। শক্ত গলায় বলল,

‘আমি এখন দেখা করতে পারব না। টায়ার্ড।’

তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢুকল। ঠান্ডা মসৃণ জলের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতে সামি ভাবছিল… জ্ঞান হবার পর থেকে দেখেছে বাড়ি ভর্তি অতিথি, লোক সমাগম, হৈচৈ… মা ব্যস্ত আছে আতিথেয়তা নিয়ে। বাবা আকণ্ঠ ডুবে আছে কর্মজীবনের ব্যস্ততায়। পারিবারিক গেট টুগেদার গুলোতে তার উপস্থিতি বিরল। এই অবহেলায় মায়ের কোনো অনুযোগ অভিযোগ নেই। সে নিজস্ব ভুবনে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে আছে। অথচ অভিযোগ থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল। মা ভীষণ সহনশীল একজন মানুষ বলেই কখনো এসব নিয়ে প্রতিবাদ করেনি। ঐ লোকটা তার মাকে সব দিক দিয়েই ঠকিয়েছে! হঠাৎ ভাবনায় একটা অন্যরকম ঢেউ এসে লাগে। জীবনে প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করে সামি, যে এই দৃশ্যটা আসলে বড়ই প্রাচীন! বহুবার দেখেছে মা আত্মীয়স্বজন নিয়ে হৈচৈ করছে। নির্জন ডাইনিং-এ একজন নিঃসঙ্গ তমসাচ্ছন্ন মানুষ নিবিষ্ট মনে রুটি সবজি খেয়ে যাচ্ছে। তার চোখের দৃষ্টি গভীর এবং উদাস, মুখের খাঁজে খাঁজে বৈরাগ্যের বিচরণ। সামি বাড়ি ফিরেছে রাত করে। মা হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে। স্টাডি রুমের বাতি জ্বলছে। নির্জন ঘরে সেই তমসাচ্ছন্ন মানুষটা নিবিষ্ট মনে বই পড়ছে। গভীর রাত, ঘুম আসছে না। জানালায় দাঁড়াতেই অদূরের গোল বারান্দা সংলগ্ন লাইব্রেরি চোখে পড়ে। ওখানে বাতি জ্বলছে। টেবিলে ল্যাপটপ আর ফাইলপত্র নিয়ে একলা বসে আছে একজন অন্ধকার মানুষ। ভাবতে গিয়ে সামির বুকের ভেতরটা চিনচিন করে ওঠে অবিদিত এক রহস্যময় যন্ত্রণায়। চিরচেনা দৃশ্যটা বিষাক্ত সরীসৃপের মতো কিলবিল করতে থাকে মস্তিষ্কের শিরা উপশিরায়। রাতে ঘুমাতে পারে না সে। চোখ বুজলেই মনের মঞ্চে ভেসে ওঠে তার জীবনে দেখা সবচেয়ে নির্জনতম মানুষটার বিষাদগ্রস্ত মুখ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *