স্বপ্নের বৃষ্টিমহল – ৩০

৩০

বেলা দশটার মধ্যে বন্ধুরা সবাই নাশতার পাট চুকিয়ে ফেলল। শুধু সামি লেট। সোয়া দশটার দিকে টেবিলে এসে দেখল বন্ধুদের কেউ উপস্থিত নেই। রুদ্রর বাবা নাশতা করছেন। রুদ্রর আম্মা পাশে দাঁড়িয়ে স্বামীকে এগিয়ে দিচ্ছেন এটা-সেটা। সামি একটি চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। রুদ্র এল বন্ধুকে সঙ্গ দেয়ার জন্য। পাশে বসে বলল, ‘আজকের প্ল্যান করে ফেলছি। রাত দশটা পর্যন্ত তুই বুকড। ঢাকা ফিরবি দশটার পরে।’

সামি কোনো উত্তর দিল না। তাকে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। চোখের সামনে ঘটতে থাকা দৃশ্যটার দিকে কেন যেন চোখ আটকে গেছে আঠার মতো। তার মনে হচ্ছে নিজের বাড়িতে সে বাল্যকাল থেকে কখনো এরকম দৃশ্য দেখেনি। মা কখনো বাবা খাবার সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকে না। সার্ভ করে না। এমনকি ছুটির দিনগুলোতেও বাবা একা একা ডিনার করে। সামি বাড়িতে উপস্থিত থাকলে বাবা তাকে ডেকে এনে পাশে বসান। ছুটির দিনে মায়ের আলাদা প্রোগ্রাম থাকে। ক্লাবের কিটিপার্টি নইলে খালাদের সাথে আউটিং। সামিদের বাড়িতে ডজনের ওপরে গৃহকর্মী। মায়ের কাজ করার কোনো অবকাশই নেই। তবুও সামির হঠাৎ মনে হলো মাকে এমন ঘরোয়া সংসারী রূপে দেখতে পেলে তার হয়ত ভালো লাগত। কিন্তু তার মা কখনো এতটা সাধারণ হবে না। অর্থের প্রাচুর্য তার কাছ থেকে বহু আগেই আটপৌরে সাধারণত্ব ছিনিয়ে নিয়েছে।

‘কী হইল তোর?’

রুদ্রর প্রশ্নে চমকে ওঠে সামি। অস্ফুটে বলে, ‘কিছু না!’

৩১

দুপুরে চট্টগ্রাম রেডিসন ব্লুতে লাঞ্চ করল ওরা। অমৃতার আপত্তি ছিল। সে চেয়েছিল সাধারণ কোনো রেস্তোরাঁয় কবজি ডুবিয়ে খেতে। পাঁচ তারকার লাঞ্চ সামিকেই স্পন্সর করতে হবে। আপাতত সামির পৃষ্ঠপোষকতা গ্রহণ করার মতো মানসিকতা অমৃতার নেই। সে বলতে গেলে কিছুই খেলো না। হৃদির মুখখানাও অমাবস্যার চাঁদের মতো অন্ধকার। তবুও একসময় বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠল ঠিকই। হাস্য কোলাহলে খড়কুটোর মতো ভেসে গেল মনের মেঘ। হেসে গড়াগড়ি দিতে লাগল সকলে। রেডিসন থেকে বেরিয়ে যখন পতেঙ্গা সিবীচে এলো, তখন সবার মন প্রফুল্ল, ফুরফুরে! বড় বড় চৌক পাথর পেরিয়ে সাগরের ধারে নেমে এসেছে ওরা। আকাশে সাদা মেঘের হাওয়াই মিঠাই। স্রোতের সাথে সন্ধি করবে বলে, আকাশ আর রুদ্র নেমে গেছে সাগরে। সামিও নামবে নামবে করছে। উত্তাল জোয়ারের ধাক্কায় সরে যাচ্ছে পায়ের তলার বালি। পড়ন্ত বিকেলের চকচকে পিচ রঙের রোদ্দুর ডানায় মেখে সাগরের বুক ছুঁয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে কয়েক জোড়া সাদা শঙ্খচিল। মাঝ সাগরে কয়েকটা জাহাজ দেখা যাচ্ছে। হৃদি নরম বালিতে পায়ের ছাপ ফেলে স্রোতের বিপরীতে হাঁটছিল। প্রবল বাতাসের ঝাপটায় ওর চুলের খোঁপা গেছে খুলে। একগুচ্ছ কালো চুল পিঠের ওপর দাপাদাপি করছে নাগিনীর মতো। গলার ওড়না উড়ছে। বন্ধুদের দল থেকে একটু বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল সে। দূরে… যেখানে সাগর আর আকাশের দিগ্‌বলয় টানা আছে ঠিক সেখানে নিবদ্ধ হয়ে আছে তার বিষাদপূর্ণ, বৈরাগ্য মাখা দুটি চোখ। চারিদিকে উন্মত্ত সাগরের দুরন্ত ঢেউয়ের নাচানাচি। তেজি বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দ।

আকাশ, রুদ্র আর সামি ঢেউ পায়ে ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছিল সামনে। হঠাৎ আকাশ বলল, ‘হৃদি একা একা কী করে? দ্যাখ তো সামি!’

সামি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল দৃশ্যটা। হৃদির কোমর পর্যন্ত জল। বেলাশেষের পীচ রঙের রোদ্দুরে ঝিকোচ্ছে শ্যামলা মসৃণ মুখ। সামির বুকের কোথায় যেন একটুখানি ব্যথা নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়ে ওঠে চিনচিন করে। পড়ন্ত বিকেল গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে থাকা ঐ একলা সুন্দর মেয়েটা শুধু তার স্ত্রীই নয়, বরং প্রাণাধিক প্রিয় বন্ধুও। তবুও মেয়েটির সাথে আজ তার অনতিক্রমণীয় দূরত্ব। চাইলেই এই দূরত্ব কাটিয়ে ফেলা যায় না। কোত্থেকে যেন ধেয়ে আসে বাধা, সংকোচ আর অস্বস্তি।

অনতিদূরে একদল তরুণ পানিতে নেমে হইচই করছে। সামি এক ঝলক দেখামাত্রই বুঝল তরুণদের দলটা হৃদিকেই লক্ষ্য করছে। ঘনঘন তাকাচ্ছে, হাসছে, এমনকি মন্তব্যও ছুড়ে দিচ্ছে। হৃদি কিছুই শুনছে না। তার শূন্যতাভরা দৃষ্টি বিঁধে আছে দূরের দিগন্তে। একটি ছেলে গলা উঁচিয়ে বলল, ‘আপা কি একা? কেউ সাথে নাই?’

সামি স্রোতের ধাক্কা খেয়ে খেয়ে এগোতে লাগল। হৃদির ডান হাতের কব্জি খপ করে চেপে ধরে বলল, ‘কী করিস?’

হৃদি চমক ভাঙা ঘোর ঘোর চোখে তাকাল সামির দিকে। দুই ভ্রুর মধ্যবর্তী ইঞ্চি পরিমাণ ত্বকে সৃষ্টি হলো কুঞ্চন। বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘তাতে তোর কী?’ সামি ছেলেদের দলটা আড়চোখে লক্ষ্য করে একটু শক্ত গলায় বলল, ‘একা একা থাকিস না। একসাথে থাক। আর তুই পানিতে নামছিস কেন? ভেজা জামা কাপড় নিয়ে বাসায় যাবি কীভাবে?’

হৃদি নিজের হাত সামির দখল থেকে ছাড়িয়ে নিল। সামনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে কঠোর গলায় বলল, ‘আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। যা এখান থেকে।’ মস্ত আকারের স্ফীত, বিক্ষুব্ধ সব ঢেউ ওদের ঘিরে উদ্দাম নৃত্য নেচে যাচ্ছিল। পায়ের তলা থেকে সরে যাচ্ছিল নরম বালি। সরতেই আবার নতুন বালির পরত এসে টিকিয়ে রাখছিল ভারসাম্য। তরুণদের দলটা তখনো ওদের লক্ষ্য করে যাচ্ছে। স্যান্ট গেঞ্জিপরা একজন ষণ্ডা চেহারার বখাটে মতো ছেলে সরাসরি সামির দিকে ক্রূর চোখে তাকিয়ে আছে। যেন এখুনি খপ করে গিলে খাবে। সামি হৃদির হাত খামচে ধরল আবার, চাপা স্বরে বলল, ‘ঐদিকে চল!’

হৃদি হাতটা ঝাঁকি দিয়ে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল, পারল না। মৃদু ধস্তাধস্তি লেগে গেলো দুজনের মধ্যে। ততক্ষণে জলের স্রোত হৃদির কোমরের আরো একটু ওপরে উঠে এসেছে। ষণ্ডা চেহারার ছেলেটা এগিয়ে এসেছে কাছে। ধমকে উঠে বলছে, ‘এইযে মিস্টার, আপনি উনাকে বিরক্ত করছেন কেন? সমস্যা কী?’

রগচটা সামির মাথায় আগুন ধরতে বেশি সময় লাগল না। রুক্ষ চোখে ছেলেটার দিকে চেয়ে রুক্ষ গলায় বলল, ‘আপনার সমস্যা কী? কী চাই?’

ছেলেটা মারমুখো ভঙ্গিতে বলল, ‘সাহস তো কম না আপনার! একটা মেয়েরে একা পেয়ে ডিস্টার্ব করছেন আবার বড় গলায় কথা বলছেন!’ সামির চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। রক্তের কণায় কণায় বিভীষণ এক রাগের ছোবল টের পায় সে। আগপাছ না ভেবেই স্যান্ট গেঞ্জি পরা তামা রঙের যুবকটির রোমশ বুকে একটা জোর ধাক্কা বসিয়ে দেয়। পিচ্ছিল মসৃণ বালিতে ছেলেটা ভারসাম্য ধরে রাখতে পারে না, ঝপ করে পড়ে যায় জলের ওপর। টের পেয়ে তার সঙ্গী-সাথীরা আক্রমণাত্মক হয়ে এগিয়ে আসে। তুমুল বিক্ষোভের সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে সামির ওপর। দিশাহারা হৃদি পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকে। সমুদ্রের গর্জন আর বাতাসের কোলাহল ছাপিয়ে ওর আর্ত নিনাদ ছড়িয়ে পড়ে উন্মুক্ত, বিস্তৃত সাগরপাড়ে। দৌড়ে আসে বন্ধুরা।

চারজন শক্ত সমর্থ যুবক সামিকে তখন এলোপাতারি কিল, ঘুষি, লাথি মেরে যাচ্ছে। সামির শরীর ডুবে যাচ্ছে পানির নিচে। ছেলেগুলো ওর কলার চেপে ধরে হিড়হিড় করে টেনে তুলছে ওপরে। সামি শ্বাস টানার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার আগেই পুনরায় জলের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে ওর শরীর। স্রোতের পাহাড় মাথার ওপর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে অনায়াসে। কান, নাক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মুখে ঢুকে যাচ্ছে লবণাক্ত বালি। রুদ্র, আকাশ আর অমৃতা ছেলেগুলোকে পেছন থেকে টেনে ধরে নিরস্ত করার চেষ্টা করল। দুই পক্ষে মারামারি হাতাহাতি লেগে গেল। বিভা হৃদির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আতঙ্কে সাদা হয়ে গেছে ওদের মুখ। হৃদি মৃগী রোগীর মতো কাঁপছে ঠকঠক করে। হঠাৎ কী মনে করে যেন সে উল্টো দিকে ঘুরে দৌড়াতে আরম্ভ করল। ছাতার নিচে যেখানে ব্যাগ, জুতা রাখা আছে, ঝড়ের বেগে ছুটে গেল ঠিক সেখানে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ডায়াল করল শ্বশুরের নম্বরে।

ছেলেদের সাথে মারপিট করতে অমৃতার কোনো অস্বস্তি নেই। এই অভিজ্ঞতা প্রথম নয়। প্রতিপক্ষ দলের একটি ছেলে হঠাৎ বুঝে গেল ঢোলা শার্টপরা যে ছেলেটা তার টিশার্টের কলার চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলছে, ‘এসব বন্ধ কর! সবকটাকে জেলের ভাত খাওয়াব!’ এই তেজস্বী ছেলে আসলে ছেলে নয়, জলজ্যান্ত একটা মেয়ে। সত্যটা টের পাবার পর সে হুঙ্কার ছেড়ে বলল, ‘মেয়ে মানুষ হয়ে আপনে এখানে কী করেন হ্যাঁ? কী সমস্যা আপনার?’

‘মেয়ে মানুষ’ শব্দটা শুনলে অমৃতার মনে হয় যেন কেউ কুরুশ কাঁটা দিয়ে শরীরে এফোঁড়-ওফোঁড় দাগ কেটে দিচ্ছে। অন্ধ রাগ এবার ধৈর্যের সমস্ত বাধ ভেঙে দিল। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে একটা জোর ঘুষি বসিয়ে দিল ছেলেটার ডান চোয়াল বরাবর। ভয়ঙ্কর শীতল কণ্ঠে বলল, ‘মেয়েমানুষ শব্দটা আর কোনোদিন উচ্চারণ করবি না। মনে রাখিস কথাটা।’

লোকজনের ভিড় হয়ে গেছে। কিছু স্থানীয় নিরপেক্ষ লোকজনের প্রচেষ্টায় কলহ থামল। পুলিশ আসতে খুব বেশি সময় লাগল না। হামলাকারী যুবকরা তখনও জানে না দেশের অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তির সন্তানের ওপর তারা আক্রমণ চালিয়েছে। বন্ধুদেরকে হালকাপাতলা জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দিল পুলিশ। প্রতিপক্ষের ছেলেদেরকে তুলে নিল গাড়িতে। যে ছেলেটি সবার প্রথমে সামির সাথে কথা বলেছিল সে হৃদিকে বলল, ‘আপা আপনাকে বাঁচানোর জন্য আমরা প্রতিবাদ করলাম। আপনি এখন চুপ করে আছেন। কিছুই বলছেন না। এটা কি ঠিক?’

হৃদি তখনো কাঁপছিল ভয়ে। সামির রক্তাক্ত, ফ্যাকাশে মুখ ওর শরীরের রোমকূপে রোমকূপে আতঙ্কের ঝড় তুলছে। সে স্খলিত কণ্ঠে বলল, ‘আমি তো আপনাদের সাহায্য চাইনি। সে আমার হাসবেন্ড। আপনাদের তো কেউ বলেনি আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে!’

ছেলেটা এ কথার পর কিছু বলতে পারল না। বিস্মিত, বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল শুধু।

সামির নাকে, চিবুকে আর কপালে ব্যান্ডেজ পড়ল। এই অবস্থায় আগামীকাল মিটিং-এ যাওয়া সম্ভব হবে না। ঠিক করল আজ রাতটাও রুদ্রদের বাসায় থেকে যাবে। হৃদিকে তার শ্বশুরমশাই নির্দেশ দিয়েছেন, রাতের মধ্যেই যেন চট্টগ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে যায় ওরা। তিনি পুত্র এবং পুত্রবধূর জন্য প্লেনের টিকেটের ব্যবস্থা করেছেন। বাকি বন্ধুরা ধীরে সুস্থে গাড়ি নিয়ে ফিরুক। কিন্তু আহত শরীর নিয়ে সামি যেন ঢাকা-চিটাগাং হাইওয়ের দীর্ঘ যাত্রা থেকে বিরত থাকে। আজকের বিপদমুক্তির পেছনে যে বাবার হাত আছে বিষয়টা সামি প্রথমে বুঝতে পারেনি। পুলিশের লোকের অপ্রত্যাশিত ভদ্র ব্যবহারও তার মাথায় কোনো প্রশ্নের উদ্রেক করেনি। করল তখন, যখন হৃদি ফ্লাইটের টিকেটের প্রসঙ্গ উত্থাপন করল। রুদ্রদের ড্রয়িংরুমে বসে ছিল ওরা। ঘড়িতে সন্ধ্যা সাতটা। চা, নাশতার পাট চলছে। সামি সোফার পিঠে হেলান দিয়ে বসেছে। মাথাটা সিলিং ফ্যানের দিকে উঁচু করে রাখা। হৃদি বলল, ‘আমার শ্বশুর এয়ার টিকেট বুক করেছেন। রাত দশটায় ফ্লাইট। উনার মতে সামির এই অবস্থায় লং জার্নি না করাই ভালো।’

সামি হেলানো অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসল, ‘উনাকে কে জানাইল এই ঘটনা?’

আচমকা হুঙ্কারটা চার দেয়ালের বদ্ধ ঘরে বজ্রপাতের মতো প্রতিধ্বনিত হলো। হৃদি অস্ফুটে বলল, ‘আমি জানাইছি।’

‘কেন?’ কঠিন, ক্রূর এবং রুক্ষ গলায় প্রশ্ন করে সামি। ব্যান্ডেজ লাগানো ভাঙাচোরা মুখ থেকে তেজের আগুন উঠে আসে। মুহূর্তের জন্য কেমন ভয়ঙ্কর দেখায় ওকে। হৃদি একটা বড় শ্বাস টেনে নিল। কাঁপা কণ্ঠটাকে সুস্থির করার আপ্রাণ চেষ্টা করে বলল, ‘কেন আবার? তুই বিপদে পড়ছিস… এই বিষয়টা তোর বাপরে জানাইতে হবে না?’

সামি গগনবিদারী চিৎকার করে উঠে বলল, ‘না জানাইতে হবে না! আমার বাপরে জানাইতে হইলে আমি জানাব! তুই কে? তোকে কে বলছে এসব মাতব্বরি করতে?’

হৃদির মুখটা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল। ফুলে উঠল নাকের পাটা। অপমানের কালো ছায়া ঢেকে দিল চোখ। এতদিনের জমে থাকা রাগ, ক্রোধ আর অভিমান এবার যেন নিমেষে বেরিয়ে আসার পথ পেয়ে গেল। সাপের মতো ফুঁসে উঠে বলল, ‘তোর প্রব্লেমটা কী? সব সময় তুই আমার সাথে এমন কুত্তার মতো বিহেভ করিস কেন? মানুষের সামনে অলওয়েজ আমাকে ইনসাল্ট করিস কেন?’

সামির কণ্ঠস্বরের তেজ কমে না। উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। গলা ফাটিয়ে বলে, ‘তুই আমার বাপকে কেন জানাইছিস আমার অনুমতি ছাড়া সেটা আগে বল।’

হৃদি এবার কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমার ইচ্ছা হইছে তাই জানাইছি। তোর ব্যবহার এত জঘন্য হয়ে গেছে যে তোর সাথে আমার আর থাকতেই মনে চাচ্ছে না। ঘেন্না হচ্ছে!’ বিভা দৌড়ে এসে হৃদির একটা হাত ধরেছে। ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলছে, ‘দোস্ত আস্তে। বাসার মানুষ শুনবে। একটু শান্ত হয়।

হৃদি কান্নাজড়ানো গলায় সামিকে বলল, ‘তোর যদি আমাকে আর ভালো না লাগে বলে দিতে পারিস। কিন্তু এভাবে সারাক্ষণ বিশ্রী বিহেভ করবি না। এসব আমি আর নিতে পারতেছি না।’

সামি কোনো কথা বলল না। হৃদির কান্নাটা তাকে থমকে দিয়েছে। নিভু নিভু হয়ে এসেছে ক্রোধের আগুন। থমধরা চোখে বসে আছে সে নিশ্চল পাথর হয়ে। অন্য বন্ধুরা হৃদিকে ঘিরে ধরেছে। সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে। সামি আরো কিছুক্ষণ বিমর্ষ, দুঃখী মানুষের মতো চুপচাপ বসে থেকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো গেস্ট রুমের দিকে।

অমৃতা বিবর্ণ মুখে চেয়ে চেয়ে দেখছিল এই ঘটনা। বুকের ভেতরটা পুড়ছে নিঃশব্দে। সামির এই অধঃপতনের পেছনে সে নিজেই দায়ী। সহজ স্বাভাবিক এক প্রাণোচ্ছল ছেলেকে আপাদমস্তক অন্য মানুষ বানিয়ে দিল, ভেঙেচুরে ছারখার করে দিল ছিমছাম একটি সংসার। ধিক তোমাকে অমৃতা! শত সহস্ৰ ধিক!

কতক্ষণ কেটেছিল জানে না সামি। একটু ঝিমঝিম ভাব হচ্ছিল। হঠাৎ বাতিটা জ্বলে উঠল ভস করে। ডান হাত উঁচিয়ে চোখ ঢেকে সামি বিরক্তি জড়ানো গলায় বলল, ‘কে?’

‘আমি!’ চেনা কণ্ঠস্বরটা সামিকে নীরবে ধাক্কা দিয়ে গেলো। চোখের ওপর থেকে হাতটা অল্প একটু সরিয়ে নিয়ে আড়চোখে অমৃতাকে দেখল সে।

‘লাইটে সমস্যা হচ্ছে? নিভিয়ে দেব?’

সামি নড়ল না। কিছু বললও না। হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে আগের ভঙ্গিতেই শুয়ে রইল বিছানায়। অস্বাভাবিক নিঃশ্বাসে তার বুক ওঠানামা করছে। টিশার্টটা কোমরের দিকে অবিন্যস্ত হয়ে আছে। দেখা যাচ্ছে মেদবর্জিত, টানটান রোমশ ফর্সা পেটের অল্প বিস্তর অংশ। অমৃতা বিছানার পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে উল্টো ভঙ্গিতে বসল। চেয়ারের পিঠে রাখল চিবুক। পা দুটো ছড়িয়ে দিল সামনে, যেন সাইকেলের গদিতে বসেছে। তার মুখখানা অন্ধকার। চোখে খেলছে দ্বিধা আর অস্বস্তি। ভীষণ রোগা হয়ে গেছে মেয়েটা। হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন দীর্ঘদিনযাবত কোনো জটিল ব্যাধিতে ভুগছে।

সামি একটা প্রলম্বিত শ্বাস টেনে নিয়ে ভেতরকার অস্থিরতা চাপা দেয়ার চেষ্টা করল। শান্ত গলায় বলল, ‘আমি একা থাকতে চাই।’

‘আমি খুব বেশি সময় নিব না। অল্প কিছু কথা বলেই চলে যাচ্ছি।’ সামি বিরক্তি মিশ্রিত চোখমুখ নিয়ে উঠে বসল। টেনেটুনে ঠিক করল পরনের কাপড়। অমৃতা ভয়ে ভয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল ওর মুখের দিকে। ফাটা বাঁশির মতো বেসুরো কণ্ঠে বলল, ‘এখন কেমন আছিস?’

উত্তরে সামি বিছানার ওপর রাখা সেলফোনটা হাতে তুলে নিল। ব্যান্ডেজ বাঁধা কুঞ্চিত ললাটে স্ক্রিনের দিকে চেয়ে বলল, ‘যা বলার তাড়াতাড়ি বল। টাইম নাই।’

‘সামি শোন…! আমার একটা ভুলের জন্য নিজেকে এভাবে কষ্ট দিস না। হৃদিকে কষ্ট দিস না…।’ অমৃতার গলা এমনভাবে কাঁপছিল যে কথার মাঝখানে থেমে পড়তে হলো। সামি হাতে ধরা সেলফোনের দিকে কটমট করে চেয়ে আছে অপলক। ফর্সা গালের নীল শিরা প্রকটভাবে দৃশ্যমান। কপকপ করে কাঁপছে রাগে। অমৃতা ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, ‘আমাকে তুই মাফ করতে পারবি দোস্ত? যা হইছে ভুলে যা। আমি ভুলে গেছি। মনে রাখার মতো বিষয়ই না এইটা। উনার প্রতি… মানে তোর বাবার জন্য আমার কোন ফিলিংস নাই। ছিলও না! পুরা বিষয়টা জাস্ট একটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল।’ সামি চকিতে মুখ তুলে তাকায় অমৃতার দিকে। আহত নাকের হাড়ে খট করে লাগে একটু। ব্যথায় কনকন করে। ওই মৃত মানুষের মতো ঠান্ডা দৃষ্টি অমৃতার অন্তরাত্মায় কাঁপন ধরায়। ভয় পেয়ে চোখ নামিয়ে নেয় সে। সামি গা ছমছমে তুষার-শীতল গলায় বলে, ‘মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল?’

অমৃতার কণ্ঠস্বর কেঁপে ওঠে, ‘হ্যাঁ দোস্ত… তোর বাবার সাথে… আসলে বিষয়টা ইম্পসিবল। আর আমার মনে তখনো কিছু ছিল না। এখনো নাই। তুই প্লিজ… প্লিজ সবকিছু ভুলে যা!’ অধোবদনে অসংলগ্ন কথাগুলো বলে শেষ করে অমৃতা। গভীর শ্বাস পড়ে। সামি শৈত্যপূর্ণ চোখে দেখতে থাকে অমৃতার আনত দুটি চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য। দেখতে থাকে নাকের পাশ ঘিরে নেমে আসা অশ্রুজলের বাঁকা রেখা। দেখতে থাকে কপালের দগদগে ক্ষতচিহ্ন। হঠাৎ সামির দৃষ্টিবিভ্রম হলো। মনে হলো ঐ বীভৎস চিহ্নটা স্মাইল ইমোজির মতো দুদিকে প্রসারিত হয়ে অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে চিৎকার করে বলছে, তুই খুনী! তুই খুনী!

সামির মুখটা ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। চট করে উঠে পড়ল সে বসা থেকে। পায়ে স্যান্ডেল পরতে পরতে অপ্রকৃতস্থ গলায় বলল, ‘এসব কথার কোনো মানে হয় না। যা হবার হয়ে গেছে।’

অমৃতা ওর পথ আটকে দাঁড়াল, ‘তুই তো জানিস আমি চলে যাচ্ছি আগামী মাসে। চলে যাবার আগে শুধু এতটুকু নিশ্চিত হতে চাই যে তুই আমাকে ক্ষমা করে দিছিস। প্লিজ দোস্ত!’

সামি অমৃতাকে পাশ কাটিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। কয়েক কদম ফেলার পর থমকে দাঁড়ায় আবার। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে বলে, ‘তোদের মধ্যে এখন কিছু নাই?

অমৃতা চোখ তুলে তাকায়। পরক্ষণেই নিচের দিকে নামিয়ে নেয় আবার। অস্ফুটে বলে,

‘না নাই! তেমন কিছু ছিলও না।’

‘আমাকে ইমেইলে তাহলে কী লিখছিলি? সব মিথ্যা ছিল?’

অমৃতা দমবন্ধ করে বলে, ‘হ্যাঁ, সব মিথ্যা ছিল!’

সামি অদ্ভুত গা শিউরে ওঠা হাসি হাসে। লোহার চেয়েও কঠিন স্বরে বলে, ‘আমাকে কি এতটাই বোকা মনে হয় তোর?’

‘কী ছিল না ছিল জানি না! শুধু এটা জানি যে এখন কিছু নাই। ঐ লোকটার কথা আমি এখন ভাবিও না। আমার কোনো ফিলিংস নাই উনার জন্য। বিশ্বাস কর!’ সামি সাপের মতো ঠান্ডা দৃষ্টিটা আরো কয়েকটা ক্ষণ অমৃতার অবনত মুখের ওপর ধরে রেখে গটগট করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

৩২

সে রাতে বন্ধুদের আর ঢাকা যাওয়া হলো না। বুয়েটের একদল ছেলে-মেয়ে চট্টগ্রাম বেড়াতে এসেছে। রুদ্রর ব্যাচের। রুদ্র ওদেরকেও বাড়িতে ডেকে আনল। রুদ্রর মা এই কাঠফাটা গরমের মধ্যে ঘেমে-নেয়ে একগাদা রান্না করলেন। এত খাটুনির পরেও তার মুখে প্রশান্তির হাসিটি লেগে রইল। বন্ধুপাগল ছেলে বন্ধু ছাড়া টিকতে পারে না। ছেলে বাড়িতে থাকলে সকাল. দুপুর, রাত্রি দলে দলে বন্ধুরা আসতে থাকে। তিনি এই অতিথি সমাগম মন ভরে, প্রাণ ভরে উপভোগ করেন। এখন ছেলে চলে যাবে দূরের দেশে। কতদিন পর বাড়ি ফেরার সুযোগ পাবে কে জানে! এসব কথা চিন্তা করে তার মনটা বিষণ্ণতায় ভারী হয়ে উঠছে। তিনি রান্নাঘরে কাজ করতে করতে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে নিচ্ছেন বারেবারে। বাড়িতে দুজন বাঁধা কাজের লোক আছে। তবুও রোজকার রান্নাটা তিনি নিজ হাতেই করেন। সংসারের কাজে তার ক্লান্তি নেই।

ভোজন পর্ব শেষ হবার পর অনেক রাত অবধি ছাদের ওপর গান বাজনা হলো। নাচানাচি হলো। পাশের বাড়ি থেকে আরিয়ান ছুটে এল ওদের ছাদে। অভিমানী গলায় রুদ্রকে বলল, ‘ভাইয়া… আপনি কি আমাকে ভুল নম্বর দিয়েছিলেন? আকাশ ভাইয়ের নম্বরে ফোন করলে প্রতিবার একটা মেয়ে কথা বলে ওঠে।

রুদ্র কপট গাম্ভীর্যের সাথে বলল, ‘নাহ… ভুল নম্বর দেইনি। আসলে ফোনে কথা বলার সময় আকাশের ভয়েসটা মেয়েদের মতো হয়ে যায়।’

আরিয়ান গালে হাত রেখে ভারী অবাক গলায় বলে, ‘সত্যি?’

‘হ্যাঁ সত্যি!’

‘ওয়াও… তার মানে ওটা আকাশ ভাইয়াই ছিল?’

‘হ্যাঁ!’ শব্দটা ছুড়ে দিয়ে রুদ্র আরিয়ানের সামনে থেকে কেটে পড়ে। গান বাজতে থাকে স্পিকারে। বন্ধুরা হাত পা ছুড়ে নাচে… হাসে… বেসুরো গলায় গান গেয়ে ওঠে। আঠারোশ স্কয়ার ফিটের চৌকো ছাদটা একদল যুবক যুবতীর উন্মত্ত উপস্থিতিতে সরগরম হয়ে ওঠে। ভিড়ের মধ্যে আরিয়ান আকাশের পাশে এসে দাঁড়ায়। চাপা গলায় বলে, ‘ভাইয়া, ফোনে আপনার ভয়েসটা খুব হাস্কি! আই রিয়েলি লাইক ইট!’

আকাশ চমকানো বক্ষ নিয়ে তাকায় ছেলেটার দিকে। এই চিড়িয়ার সাথে তার আবার কখন ফোনে কথা হলো? সে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘ভুল হচ্ছে। তোমার কথা হয়েছে রুদ্রর সাথে। আমার সাথে না।’

আরিয়ান চোখ পিটপিট করে, ‘সত্যি?’

‘হ্যাঁ সত্যি! ফোনে রুদ্রর ভয়েস একদম অন্যরকম। সেক্সি অ্যান্ড হাস্কি!’ কথার শেষে আকাশ এক চোখ ব্লিংক করে। দ্বিধাগ্রস্ত আরিয়ান কিছু বলতে পারে না। বোকা মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। যেন একটা কঠিন সমীকরণ সমাধান করার দায়িত্ব পড়েছে তার কাঁধে।

সামি ছাদের রেলিং-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে চুপচাপ সিগারেট ফুঁকছিল। বড্ড গরম! ঘামের আঠায় শরীর ভরে থাকে সর্বক্ষণ। বুকটা খরার আসমানের মতো খাঁ-খাঁ করে। তেষ্টা পায় ঘনঘন। বাংলাদেশটা কি চির গ্রীষ্মের দেশ হয়ে গেল নাকি শেষমেশ? সারা বছর আগুন বাতাসের ঝাপটা। পরিবেশ দূষণে এবারেও প্রথম স্থান দখল করেছে খুব সম্ভবত। তবুও মানুষগুলোর টনক নড়ছে না। দিন দিন জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন চলছে পথে ঘাটে। নতুন রাস্তা হচ্ছে, বহুতল ভবন হচ্ছে, ব্রীজ হচ্ছে, মেট্রোরেলের কাজ চলছে। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন হচ্ছে না। আজ পতেঙ্গা সিবীচে গিয়ে মাথা ঘুরে গিয়েছিল। বছর দেড়েক আগেও মনে হয় এত ভিড় ছিল না। রুদ্রদের এই দেবপাহাড়ের বাড়িটা আগে সব সময় এক বুক বাতাসে ডুবে থাকত। সন্ধ্যার পর ছাদে এলে মনে হতো নদীর পাড়ে বসে আছে। এবারের মতো ভ্যাপসা দম আটকানো গরম তো বাপের জন্মে দেখেনি কখনো! প্রকৃতি কি তবে শোধ নিচ্ছে? গাছ কেটে ফেলে, বনাঞ্চল উজাড় করে পৃথিবীর বুকে ইট, কাঠ, পাথরের নিষ্প্রাণ নগর গড়ে তোলার মর্মান্তিক প্রতিশোধ?

বন্ধুরা উল্লাস করছে, হাসি তামাশা আর কৌতুকের ফুলঝুরিতে উড়িয়ে দিচ্ছে ভ্যাপসা গরমের ঘাম, তাপ, বায়ু বদ্ধতা! কিন্তু এসব আনন্দের কোনো রেশ সামিকে ছুঁয়ে যাচ্ছে না। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, বাবা মায়ের ভঙ্গুর সংসার, বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতার মতো খুঁটিনাটি নানা দুশ্চিন্তায় তার ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে অবিরত। হঠাৎ পিঠে একটা ঢিল এসে পড়ে। চমকে উঠে পায়ের কাছে কাগজের বলটা আবিষ্কার করে সামি। তুলে নিয়ে দেখে তাতে লেখা আছে, ‘এবার লাথি মেরে কর্নফুলী নদীতে ফেলে দেব। দূর হ এখুনি!’

রাগ হলো না সামির। বরং হাসি পেল। মুখ তুলে দেখল তিন চারটা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ছাদের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছেলে- মেয়েরা। রুদ্র ওর বুয়েটের বন্ধুদের সাথে ব্যস্ত। আকাশ, অমৃতা আর বিভা গোল হয়ে বসে আছে মেঝেতে। সামি ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে শান্ত গলায় বলল, ‘এটা কার হ্যান্ড রাইটিং রে?

তিন বন্ধু সামির হাতে ধরা চিরকুটটার দিকে তাকাল। বিভা ঠোঁট উল্টে বলল, ‘জানি নাতো!’

আকাশ বলল, ‘আমি জানি। এটা হৃদির জ্বীন বয়ফ্রেন্ডের হাতের লেখা।’

‘হৃদি কোথায়?’

‘হালুলুকার সাথে ডেটিং-এ আছে মনে হয়।’ আকাশের নির্বিকার উত্তর।

সামি কোনো উত্তর না দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে গেলো ছাদ থেকে। সিঁড়ি ভেঙে নেমে এল নিচে। গেস্টরুমের দরজা খোলা ছিল। ভেতরে একটা টিউবলাইট জ্বলছে। সামি চৌকাঠে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখল হৃদি অতি যত্ন সহকারে কাপড় গুছিয়ে রাখছে ব্যাগে। ভ্রমরকৃষ্ণ রেশমি চুল এল হয়ে পড়ে আছে নির্মেদ অথচ পর্যাপ্ত প্রশস্ত পিঠে। ঘরটা সিলিং ফ্যানের শোঁ-শোঁ রুক্ষ বাতাসে ভরে আছে। জানালার পর্দা উড়ছে ফরফর করে। উড়ছে হৃদির গায়ের ওড়না। শ্যামবরণ মুখের মসৃণ চামড়ায় ঘামের রেশ নেই। চকচকে সুন্দর একটা আভা চমকাচ্ছে ঐ মুখে। দৃশ্যটা যেন বাইরের ধুলো বালি মাখা কঠিন পৃথিবীর অংশ নয়। এই দৃশ্য অন্য কোনো জগতের। যে জগত্‍টায় এখনো মানুষের বুকের কোণে একটু একটু ভালোবাসা লেগে আছে। লেগে আছে মন কেমনের মায়া। চৌকাঠে লম্বা ছায়ামূর্তি দেখে একটু থমকে দাঁড়াল হৃদি। পলক তুলে চাইল একবার। কপালে, চিবুকে আর নাকে সাদা ব্যান্ডেজ বাঁধা সামিকে ভূতের মতো দেখাচ্ছিল। ভাঙাচোরা চেহারার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। চোখ সরিয়ে নিল হৃদি।

সামি এগিয়ে এল কয়েক পা। হৃদির পেছনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তোর নাকি একটা জ্বীন বয়ফ্রেন্ড হইছে শুনলাম। ঘটনা কি সত্য?’

হৃদি আবিষ্ট মনে শাড়ি ভাঁজ করছিল। অন্যমনস্ক গলায় উত্তর দিল, ‘সত্য।’

সে কি এই মুহূর্তে এখানে আছে?’

হৃদি প্রশ্নটা শুনে সন্দেহের চোখ তুলে তাকাল সামির দিকে। কয়েক সেকেন্ড তীক্ষ্ণভাবে কিছু একটা পরখ করে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ আছে তো!’

সামির ঠোঁটে দুষ্টু দুষ্টু বঙ্কিম হাসি ফুটে ওঠে, ‘আমি তো দেখছি না! হৃদি জানালার দিকে আঙুলের ইশারা করে বলল, ‘ঐতো ওখানে দাঁড়িয়ে আছে।’

সামি চোখ ঘুরিয়ে দেখল শূন্য জায়গাটা। আরো এক পা এগিয়ে এসে হৃদির কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলল, ‘সে কি এই মুহূর্তে আমাদেরকে দেখছে?’

‘হ্যাঁ দেখছে।’

‘গ্রেট!’ শব্দটা উচ্চারণ করেই সামি ঝড়ের গতিতে হৃদিকে ঘুরিয়ে নিল নিজের দিকে। তারপর ওর ঠোঁটে একটা গভীর পাগলাটে চুমু খেয়ে ক্ষ্যাপা গলায় বলল, ‘ঐ শালাকে আস্ক কর সিনটা দেখতে কেমন লাগল?’ হৃদি এই আচানক আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তার ভেতরটা অবশ হয়ে এসেছে। দুর্বল লাগছে। কাঁপা গলায় বলল, ‘হুট করে এসবের মানে কী? যা এখান থেকে।’ সামি নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরল হৃদিকে।

‘দরজাটা খোলা!’ হৃদি বলল অস্ফুটে।

‘খোলা থাক। কিছু হবে না!’

‘ছি! কেউ চলে আসলে কী হবে?’

‘কেউ আসবে না।’

‘সামি প্লিজ! দরজা বন্ধ কর!’

৩৩

পরদিন সকাল সকাল বন্ধুরা ঢাকার পথে যাত্রা শুরু করল। আকাশ বসল ড্রাইভারের পাশের গদিতে। মাঝের সারিতে সামি আর হৃদি। পেছনে বিভা, অমৃতা। সারাটা পথ হৃদি সামির বুকের সাথে ঘেঁষে বসে রইল। সামির বুকের হৃৎপিণ্ডের প্রতিটি স্পন্দন কান পেতে শুনল। তার সহজ-সরল মায়াবী মুখে ভীষণ একটা খুশির ঝিকিমিকি আঁকা। সামি সেই ঝিকিমিকি মন ভরে দেখছিল। বাতাসে হৃদির চুল উড়ছে। উড়ন্ত কেশের ঝাপটা এসে লাগছে সামির চোখে মুখে। বাতাস ভরে গেছে মিষ্টি সুগন্ধে। ভালো লাগছে। অনেকদিন পর মনটা পাখির মতো হালকা হয়ে উঠেছে। যেন একটা পাষাণ ভার নেমে গেছে বুকের ওপর থেকে। হঠাৎ অমৃতার কানের কাছে মুখ নামিয়ে বিভা ফিসফিস করে বলল, ‘উড়ো চিঠির প্ল্যানটা কেমন ছিল দোস্ত?’ অমৃতা অবাক। চোখ দুটি ছানাবড়া করে বলল, ‘এটা তোর কাজ ছিল?’ বিভা চুপ করে রহস্যময় হাসি হাসতে লাগল।

‘কিন্তু তোর হ্যান্ডরাইটিং তো এটা না।’

বিভা এক চোখ টিপল, ‘সেই রহস্য অজানাই থাক!’

৩৪

রুদ্রর দাদার মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষ্যে মেজবান হবে গ্রামের বাড়িতে। বন্ধুদের প্রস্থানের ঘণ্টা খানেকের মাঝে ওরাও বেরিয়ে পড়ল সপরিবারে। আজকের দিনটা ছায়া ছায়া। রোদ নেই। তবুও ভ্যাপসা গরম কাটে না। ডিপ্রেশন চলে প্রকৃতিতে। বেলা তিনটার আগেই বাঁশখালী পৌঁছুল ওরা। আজ রাতে গরু জবাই হবে। বাড়ির পেছন দিকের খোলা মাঠে টাঙ্গানো হবে শামিয়ানা। সারা রাত ধরে চলবে মাংস কাটার পালা। কাল খুব ভোরে বাবুর্চিরা চলে আসবে। গরুর মাংস, চনার ডাল, নলার ঝোল, সবজি আর সাদা ভাত রান্না হবে। দুপুরে দলে দলে লোক আসবে মেজবান খেতে। আশেপাশের গ্রাম থেকেও আসবে। চেনা-অচেনা অজস্র লোকে ভরে যাবে চারপাশ। বহুদিন পর রুদ্রর গ্রামে আসা হল। অনেক আত্মীয়স্বজনের নাম ধাম চেহারাও ভুলে গেছে। বাড়িঘর কিছুই আর আগের মতো নেই। উঠোনের ওপর পাকা দালান উঠেছে। আগে এখানে টিনের ঘর ছিল। ছোট বেলায় বড় আব্বার মেজবান খাওয়ার জন্য দল বেঁধে শহর থেকে আসত ওরা গ্রামে। সেইসময় মেজবান হতো শীতকালে। দাদাজান বেঁচে ছিলেন। একতলা টিনের বাড়ির দাওয়ায় বেতের চেয়ার পেতে কুঁজো হয়ে বসে থাকতেন লম্বা মানুষটা। চারপাশ থেকে শীত কুয়াশা ছেঁকে ধরত।

রুদ্র নিস্তেজ চোখে বাড়ি ঘর দেখছিল… স্মৃতিচারণ করছিল… আর বুকের ভেতর টের পাচ্ছিল একটা বিজবিজে বিষণ্নতা! বিষণ্নতায় তাকে খুব একটা পায় না। সে যেখানেই যায়… নিজে হাসে…লোকজনকেও হাসায়। নাচ, গান, কৌতুক তামাশায় মাতিয়ে রাখে চারপাশ। কিন্তু আজকে মানুষের ভিড় তাকে টানছে না। একটা দুটা কথা বলেই হাঁপিয়ে উঠছে। খেই হারিয়ে ফেলছে। কথার মাঝে থেমে যাচ্ছে হঠাৎ। কী বিষয়ে কথা বলছিল ভুলে যাচ্ছে বেমালুম। একটা অনর্থক শূন্যতা দীর্ঘশ্বাস হয়ে অসহায় ফেরারি পাখির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে মনের বিরান চত্বরে। একটু নির্জনতার জন্য বুকটা ছটফট করছে। কিন্তু নির্জনতা কোথাও নেই! বাড়িভর্তি মানুষ!

রুদ্র কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়ল। একটু বাদেই সূর্য ডুববে। আকাশে আবীর রং। মেঠো পথ ঢেকে আছে গোধূলির অপার্থিব আলোয়। ধূলোটে গাছের সবুজ পাতায় পাতায় সেই আলোটা ভারী মায়াবী একটা বিভ্রম সৃষ্টি করেছে। সুমধুর স্বরে মাগরিবের আজান পড়ছে মসজিদে। রাস্তায় খেলতে থাকা বাচ্চা ছেলেরা হৈ-হৈ করে ফিরে যাচ্ছে বাড়ি। বাড়ি ফিরছে পাখিরাও! রুদ্রর পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। গায়ে সাদা রঙের ফতুয়া আর কালো প্যান্ট। ঘাড় পর্যন্ত গড়ানো বাবরি চুল আউলা বাতাসে এলোমেলো। চোখ মুখ উদ্ভ্রান্ত! ফেলে আসা জীবনের নানা টুকরো টুকরো দৃশ্যে তার মস্তিষ্কের আনাচ-কানাচ ভরে উঠছে। স্মৃতির সুগন্ধে স্নিগ্ধ হয়ে উঠছে বাতাস। তার জীবনে কোনো অপূর্ণতা নেই, অপ্রাপ্তি নেই! সবকিছু সুন্দর করে সাজানো। তবুও এক দুরূহ অবিচল বিষণ্ণতা আজ তার বুক খামচে ধরে আছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

পাহাড়ের ওপর পাগলা বাবার বাড়িটা এখনো আগের মতোই আছে। শুধু লোকজনের ভিড় নেই। একলা বাড়িটা গোধূলির মন কেমন করা আলোয় দাঁড়িয়ে থেকে রুদ্রর মতোই দুয়ে কোনো বিষণ্নতার রোগে ভুগছে হয়ত। পাগলা বাবার ইয়া লম্বা লম্বা নখ ছিল। ছিল কোমর পর্যন্ত জটাবাঁধা লালচে চুল। চৌকির ওপর লুঙ্গি পরে উদাম গায়ে বসে থাকত পাগলা বাবা। নখের লহর গড়িয়ে পড়ত মেঝেতে। এত রুগ্ন ছিল যে শরীরের হাড় গোনা যেত খালি চোখে। গভীর রাত পর্যন্ত তার বাড়িতে ভক্তদের আনাগোনা চলত। মাইজভাণ্ডারি গান হতো। রুদ্র তখন খুব ছোট। একবার পাগলা বাবা নোংরা নখঅলা হাত ওর মাথায় রেখে দাদিজানকে বলেছিল, ‘বিরাট মানুষ হবে তোমার নাতি! বিরাট মানুষ!’ দাদিজানের ফোকলা মুখ পূর্ণিমার চাঁদের মতো ঝলমল করে উঠেছিল এ কথা শুনে। রুদ্র জানে না বিরাট মানুষ কাকে বলে। সে কখনো বিরাট মানুষ হতে চায়নি। সাধারণ মানুষের মতো হেসে খেলে জীবনটা কাটিয়ে দিতে চেয়েছে। ইচ্ছে মতোই কাটছে জীবন। কোথাও কোনো ছন্দপতন নেই। কিন্তু আজকের এই রহস্যময় সন্ধ্যায় কোনো এক অদেখা, অচেনা বস্তুর জন্য ভেতরটা উচাটন হয়ে আছে। কী যেন মনে পড়ি পড়ি করেও মনে পড়ছে না। পাগলা বাবার ঘরে তালা ঝুলছে। ঘরের পাশেই বেড়া দিয়ে ঘেরাও করা আছে তার কবর। কবরের পাশে একটা রাধাচূড়া গাছ। বাতাসে ফুলের পাপড়ি উড়ে উড়ে ঝরে পড়ছে কবরের বুকের ওপর। রুদ্র কিছুক্ষণ পাগলা বাবার তালাবদ্ধ ঘরের সামনের সিঁড়িতে বসে রইল। কাছেই কোনো এক হিন্দু বাড়িতে ধূপ জ্বালিয়েছে। ধূপের শীতল গন্ধে ছেয়ে আছে চারপাশ। উলুধ্বনি ভেসে আসছে। আকাশে লাল, বেগুনী আর গোলাপি রঙের ছড়াছড়ি। দূরে সরিষা খেতের আইল ধরে মনু মামার গানের দল হেঁটে যাচ্ছে। মামার পরনে গেরুয়া পাঞ্জাবি। কোলে হারমোনিয়াম। দলের অন্য ছেলেদের হাতে ঢোল, তবলা, খঞ্জনি। রুদ্রর হঠাৎ বন্ধুদের কথা মনে পড়ল। মনে হলো ওরা কাছে থাকলে এতটা একা একা লাগত না। কিন্তু আগেও কতবার বন্ধুদের ছেড়ে বাড়িতে এসেছে। মাসের পর মাস কাটিয়েছে পরিবারের মানুষদের সাথে। কই… এমন গহন বিষণ্নতায় তো কোনোদিন পায়নি তাকে! অমৃতার নম্বরে ডায়াল করল রুদ্র। দ্বিতীয়বার রিং পড়তেই ফোন রিসিভ করল অমৃতা।

‘পৌঁছে গেছিস ঢাকায়?’ রুদ্রর প্রশ্ন।

‘হ্যাঁরে। এইত ঘণ্টাখানেক আগে আসলাম। তুই কই?’

‘আমি তো বাড়ি আসছি।’

‘বাড়ি কখন গেলি আবার?’

‘আজ দুপুরে।’

‘ভালো করছিস। আমিও ভাবতেছি দেশ ছাড়ার আগে একবার গ্রাম থেকে ঘুরে আসব।’

একটু থেমে অমৃতা আবার বলল, ‘তোর গলা এরকম শোনাচ্ছে কেন? সব ঠিক আছে তো?’

রুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা দিয়ে বলল, ‘বুঝতে পারতেছি না ঠিক।’

‘মানে কী?’

‘কেমন জানি অদ্ভুত একটা ফিলিংস হচ্ছে বুঝছিস? মনে হচ্ছে কী যেন একটা মিসিং! লাইফে এর আগে কখনো এমন পিকিউলিয়ার ফিলিংস হয় নাই।’

অমৃতা কপট সন্দেহের গলায় বলল, ‘কাকে মিস করতেছিস তুই রুদ্র? রুদ্র হাসে, ‘তুই তো জানিস ছোটবেলায় তোর উপর আমার ক্রাশ ছিল।’

অমৃতা একটু থমকায়। বিস্মিত গলায় বলে, ‘এই কথা কেন হঠাৎ?’

‘না মানে… তোকে ভালো লাগত… কিন্তু কখনো মিস করি নাই তোকে। এমনকি মনীষাকেও কখনো সেভাবে মিস করি নাই। কিন্তু আজকে তোরা চলে যাওয়ার পর থেকেই না দোস্ত, কেমন যেন অস্থির লাগতেছে। লাইফে ফার্স্ট টাইম এতটা একা একা ফিল হচ্ছে।’

অমৃতা হতাশার শ্বাস ফেলল, ‘দেশ ছেড়ে অনেক দূরে যাবি তো। এইজন্যেই এমন লাগতেছে। অন্য কিছুই না।’

‘এটাই হবে।’

‘হুম এটাই। তুই বরং আংকেল আন্টিকে একটু বেশি বেশি সময় দে। ভালো লাগবে।’

‘হুম… বাকিদের কী অবস্থা?’

‘সামি তো হৃদিকে বাসায় নিয়ে যেতে চাইছিল। হৃদি বলছে এভাবে যাবে না।

‘কীভাবে যাবে তাইলে? হেলিকপ্টার পাঠানো লাগবে?’

‘হিহি… ঠিকই বলছিস। হেলিকপ্টার লাগবে মনে হয়। আমরা আকাশের বাসায় নামছিলাম একটু। কিছুক্ষণ বসলাম। ঝুমকি আন্টি মজার একটা পিঠা বানাইছিল। পিঠার নামটা ভুলে গেছি। তারা চা বানায় দিল। ছাদের ওপর বসে মনীষা আপার গান শুনলাম আর তারার হাতে বানানো চা খাইলাম।

আত্মা কাঁপানো শিহরনটা ঠিক সেই সময় অনুভব করল রুদ্র। জীবনে প্রথমবারের মতো! অমৃতার বলা শেষ বাক্যটায় কিছু একটা ছিল! সেই ক্ষুদ্র ‘কিছু’ টাকেই এতক্ষণ ধরে ওর বিবাগী মন ভুল পথে খুঁজে খুঁজে মাথা ঠুকে মরছিল। হঠাৎ গা শিউরানো ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল রোমকূপ। বুক কেঁপে উঠল। ফোনের লাইন কেটে দিয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ল সে। সন্ধ্যার বাদামি আবছায়ায় আঁকাবাঁকা মেঠো পথ ধরে দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগল ভূতগ্রস্তের মতো। যেন রাতের অন্ধকার নামার আগেই তাকে পালিয়ে যেতে হবে। কোথায় পালাবে রুদ্র? কার কাছ থেকে পালাবে? নিজের কাছ থেকে? আশ্চর্য! নিজের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানোর অদ্ভুত ইচ্ছাও যে কখনো ঘাড়ে চেপে বসতে পারে, রুদ্র তা জীবনে প্রথম জানল!

বাড়ি ফিরে ভিড়ের মাঝে মিশে যাবার চেষ্টা করল। বোনের বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আদর করল অনেক। উঠোনে মাদুর বিছিয়ে কার্ড খেলতে বসল কাজিনদের সাথে। গরু জবাই করার সময় হাত লাগাল। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর পাশের বাড়িতে মনু মামার গানের দল ভাণ্ডারী গানের আসর বসিয়েছিল। গ্রামে গরমের প্রকোপ কম। সন্ধ্যার পর শরতের আকাশ মৃদুমন্দ হাওয়া দেয়। মনু মামার গানের আসরে একটা তবলা হাতে নিয়ে বসে পড়ে রুদ্র। মাথা ঝাঁকিয়ে গানের তালে তালে তবলা বাজায়।

‘স্কুল খুইলাছে রে মাওলা, স্কুল খুইলাছে
স্কুল খুইলাছে রে মাওলা, স্কুল খুইলাছে
গাউছুল আজম মাইজ ভাণ্ডারী স্কুল খুইলাছে’

উঠোনের সুপারি, নারকেল আর আম গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে বাতাস বয়ে যায় শনশন করে। ঝিঁঝিঁ ডাকতে থাকে। রাত বাড়ে। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে রুদ্রর। হাতের তবলার তাল থেমে যায়। বারান্দায় পেতে রাখা শক্ত মাদুরে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে সে। গানের সুর কানে এসে লাগে। তন্দ্রার ভাব হয়। ঝিরিঝিরি মসৃণ হাওয়া চোখ, মুখ ছুঁয়ে দেয়। বুকে চেপে থাকা দুরূহ বিষণ্ণতা পাখি হয়ে উড়ে যায় দূরের আকাশে। তারপর শরতের সেই অন্ধকার আকাশের কালো পর্দা ভেদ করে হঠাৎ একটি শ্যামবরণ মেয়ের নিষ্পাপ মুখশ্রী মায়াজাদুর মতো ভেসে ওঠে চোখের সামনে। ঢেউ খেলানো এক ঝাঁক চুলের মাঝখানে লম্বাটে গড়নের সাধারণ মুখ, মোটা চশমার আড়ালে দুটি বিষাদমাখা চোখ, সরু নাক, গোলাপি ওষ্ঠাধর। ওই মুখে এত শান্তি… এত আরাম… এত স্নিগ্ধতা! মেয়েটি চোখ মেলে রুদ্রর দিকে তাকায়। রুদ্র একটুও অবাক হয় না। তার মনে হয় যেন জনম জনম ধরে মেয়েটি ওর দিকে এমন নির্নিমেষ চক্ষে চেয়ে আছে। রুদ্রর ঠোঁটে এক টুকরো মায়া মায়া হাসি আলগোছে খেলা করে। মেয়েটা আসমানের জানালা থেকে উঁকি দিয়ে নিবিড় দৃষ্টিতে রুদ্রকে দেখে। দেখে রুদ্রও! চোখে চোখ লেগে থাকে। অচেনা সুন্দর একটা মিষ্টি মিষ্টি গন্ধে ভরে থাকে চারপাশ। শিউলি ফুলের বৃষ্টির মতো গুচ্ছ গুচ্ছ ভালোলাগা ঝরে পড়তে থাকে আত্মার পরতে পরতে। এত ভালো এর আগে কোনোদিন লাগেনি! কী আশ্চর্য!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *