স্বপ্নের বৃষ্টিমহল – ৪০

৪০

হৃদিদের বাসায় বেশ হৈ-হুল্লোড় পড়ে গেল। হৃদির শাশুড়ি এই প্রথমবারের মতো আসবেন। হৃদির মা চেয়েছিলেন ডিনারের আয়োজন করতে। কিন্তু জানা গেল সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে এয়ারপোর্টে হাজিরা দিতে হবে রোমেলাকে। কুটুম বাড়ির আত্মীয় বলে কথা। তাও আবার এত বড়লোকের বউ। কীভাবে, কী দিয়ে আপ্যায়ন করবেন সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে গেলেন হৃদির মা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তৈরি করে ফেললেন নানা পদের নাশতা। হৃদির বাবা বাইরে থেকে কিনে আনলেন হরেক রকম মুখরোচক স্ন্যাক্স। সেই সাথে আনলেন তাজা ফুল। ড্রয়িংরুম ভরে গেল ফুলের সুগন্ধে। জানালায় ধোয়া, ইস্ত্রি করা পর্দা টাঙানো হলো। বিছানায় দেয়া হলো সবচেয়ে ভালো আর দামি চাদর। বাবা মায়ের বাড়াবাড়িটা হৃদির খুব বেশি ভালো লাগছিল না। এমন গদ্গদ ভাব দেখাচ্ছে যেন মেয়ের শাশুড়ি না, অফিসের বস আসছে।

বিকেল পাঁচটায় সামি তার মা, খালাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি হাজির হলো। ড্রাইভার দশ কেজি মিষ্টি, একটা কেক এবং এক কার্টুন ফল পৌঁছে দিয়ে গেল ওপরে। রোমেলা এবং তার ছোটবোনের পরনে দামি শাড়ি, দামি অর্নামেন্টস এবং চোখ ধাঁধানো রুচিসম্মত সাজ। এমন সাজসজ্জা শুধু অভিজাত ঘরের লোকদের মাঝেই দেখা যায়। হৃদি শাশুড়ি এবং খালা শাশুড়িকে পা ছুঁয়ে সালাম করল। রোমেলা হৃদির সাথে খুব বেশি কথা বললেন না। হৃদির আব্বা আম্মাকে সালাম দিয়েই যেন দায়িত্ব পালনের পালা শেষ করলেন। দুই বোন খুব দ্রুত নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল হয়ে গেলেন। হৃদির আব্বা, আম্মা চুপচাপ বসে রইলেন। কথা বলার কোনো সুযোগ পেলেন না। রোমেলার চোখে মুখে চিকচিক করছে অহংবোধ। ঘরের আসবাবের দিকে তাকাচ্ছেন তাচ্ছিল্য নিয়ে। এই বাসার ড্রয়িংরুমে এসি নেই। ঘাম হচ্ছিল। তিনি ডান হাতটা মুখের কাছে হাতপাখার মতো নাড়তে নাড়তে বোনকে বললেন, ‘ইশ… বড্ড গরম!’

হৃদির বাবা ব্যতিব্যস্ত গলায় মেয়েকে বললেন, ‘তোমার শাশুড়িকে বেডরুমে নিয়ে যাও। এসিতে আরাম করে বসুক।’

রোমেলা হাত নেড়ে আপত্তি জানালেন, ‘না না। ভেতরে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা উঠব এখুনি।’ কথাটা বলেই বোনের সাথে গল্পে মশগুল হয়ে গেলেন আবার। যেন এই ঘরে শুধুমাত্র তার বোন ছাড়া অন্য একটি মানুষও উপস্থিত নেই। অপমানের ধোঁয়ায় হৃদির চোখ ঢেকে যাচ্ছিল। এতটা অভদ্র মানুষ কী করে হয়? হৃদির আম্মা নাশতার টেবিল রেডি করতে ছুটে গেলেন। আব্বা বসে রইলেন বোকা হয়ে। সামি মায়ের গতিবিধি তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করছিল। সংকোচ আর অস্বস্তিতে ভরে আছে তার বুক। সে নিজে শ্বশুরের পাশে এসে বসল। এটা সেটা বলে পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করল।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও খাবারের টেবিলে আসতে হলো রোমেলাকে। তিনি কিছুই খেলেন না। গ্লাসে সামান্য একটু কোক নিয়ে চুমুক দিলেন। প্লেটে খাবারগুলো সব পড়ে রইল। তিনি ছুঁয়েও দেখলেন না। হৃদির মা বেশ কয়েকবার অনুরোধ করলেন, ‘একটু খান বেয়াইন। কিছুই তো মুখে দিচ্ছেন না।’ রোমেলা খুব একটা পাত্তা দিলেন না কথাটা। অপ্রয়োজনীয় লোকে কত অপ্রয়োজনীয় কথাই তো বলে। এসব খুব বেশি আমলে নিতে হয় না। সামির খালা একটা চিকেন সমুচার আধখানা খেয়ে উঠে পড়লেন। হৃদির মুখ থমথম করছিল। মনে হচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে কেঁদে ফেলবে। রোমেলা চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ সামি বলে উঠল, ‘তুমি তো কিছু‍ই খেলে না মা।’

রোমেলা ছেলের কথায় সামান্য চমকে গেলেন।

‘হ্যাঁ?’

‘বললাম তুমি তো কিছুই খেলে না। আম্মা কষ্ট করে গরমের মধ্যে তোমার জন্য এত আয়োজন করল!’

রোমেলা ছেলের কাছ থেকে এমন মন্তব্য আশা করেননি। তার মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। কাটা কাটা গলায় বললেন, ‘আমি একটু আগে লাঞ্চ করেছি। তাছাড়া আমি ডায়েট করছি কদিন হলো। ভাজাপোড়া খাওয়া সম্ভব না।’

হৃদির আম্মা গদ্গদ হাসি হেসে বললেন, ‘তাহলে বেয়াইন একটু পায়েশ খান। আপনার জন্যই করেছি। গুড়ের পায়েশ।’

সামি তীব্র চোখে মায়ের দিকে চেয়ে ছিল। ছেলের দৃষ্টির তীব্রতার সামনে রোমেলা কিছু বলতে পারলেন না। বাধ্য হয়ে পায়েশের বাটিটা কাছে টেনে নিলেন।

রোমেলাকে এয়ারপোর্ট নামিয়ে দিয়ে একটু ঘুরল ওরা দুজনে। ডিনার করল গুলশানের একটা অথেনটিক চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। হাসি, ঠাট্টা, স্মৃতিচারণ, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, এই সমস্ত খুঁটিনাটি সঙ্গে নিয়ে চমৎকার সময় কাটল ওদের। ছবি তুলল বেশ কিছু। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হলো। পোর্চ পেরিয়ে গাড়িটা গ্যারেজের পথে এগিয়ে যাবার সময় লক্ষ্য করল হৃদি, স্টাডিরুমের বাতিটা জ্বলছে। গাড়ির শব্দ শুনে একটা ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়িয়েছে জানালায়। বাড়িতে ঢোকামাত্র সামিকে বলল, ‘বাবার সাথে একটু দেখা করে আসি।’ সামি আপত্তি করল না। চুপচাপ সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে গেলো। স্টাডিরুমের দরজাটা আধভেজা অবস্থায় ছিল। চৌকাঠে পা রাখতেই ভেতর থেকে ভেসে এল কণ্ঠস্বর।

‘এসেছ মা? ওয়েলকাম ব্যাক!’

হৃদি হাসিমুখে ঢুকল ভেতরে। শ্বশুরের পা ছুঁয়ে সালাম করল। রাশেদ দলিলপত্র খুলে বসেছিলেন। গ্রামের বেশ কিছু জমিজমা নিয়ে মামলা চলছে। শীঘ্রই একদিন সামিকে ডেকে সবকিছু বুঝিয়ে দিতে হবে।

‘তোমার বাবা মা কেমন আছেন?’

‘ভালো আছেন। আপনি কেমন আছেন বাবা?’

‘বেশ ভালো।’

‘অনেক রাত হয়ে গেছে। ঘুম আসছে না আপনার?’

রাশেদ স্নেহের চোখ মেলে চাইলেন হৃদির দিকে। ঘুম আসছে কী আসছে না, এমন আন্তরিক প্রশ্ন করার মতো মানুষ তার জীবনে আজকাল অত্যন্ত বিরল। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

‘বেশ কিছুদিন ধরেই এই কাজ নিয়ে বসব বলে ভাবছিলাম। সময় হচ্ছিল না। পরশুদিন বাড়ি যাচ্ছি কয়েকদিনের জন্য। এসে তোমাদেরকে দলিলপত্র বুঝিয়ে দেব। যা কিছু আছে সব তোমাদেরই। আমার একটা মাত্র ছেলে। সেই সব পাবে।’

হৃদির বুকটা মুচড়ে উঠল কষ্টে, ‘এসব কেন বলছেন বাবা? আপনি তো আছেনই। আমাদের অত বুঝে লাভ নেই। আপনি বুঝলেই হবে।’

রাশেদ স্মিত হেসে বললেন, ‘মানুষের জীবনের কোনো ভরসা নেই মা। বয়সও তো থেমে নেই। হঠাৎ যদি আমার কিছু হয়ে যায়…’

হৃদি ব্যাকুল হয়ে বলল, ‘এসব অশুভ চিন্তা একদম করবেন না বাবা। চলে যাবার মতো বয়স আপনার হয়নি। আরো অনেকদিন আমাদের মাঝে থাকতে হবে।’

রাশেদ চুপ করে গেলেন। মেয়েটি যা বলছে নিষ্কলুষ মায়া থেকেই বলছে। মাঝে মাঝে মায়া মমতার কাছে হার মেনে নিতে ভালো লাগে।

ঘরে ঢোকা মাত্রই সেলফোনটা বেজে উঠেছিল। অমৃতার নম্বর। সামি কিছুক্ষণ কুঞ্চিত ভ্রু নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত চোখে চেয়ে রইল নাম্বারটার দিকে। তারপর নিঃশব্দে ফোনের ‘ডিক্লাইন’ বাটনটা ছুঁয়ে দিল। সেকেন্ডের মাথায় টেক্সট এলো, ‘দোস্ত কেমন আছিস?’

সামি সিন করল ম্যাসেজটা। রিপ্লাই দিল না। একটু পর হৃদি ঘরে ফিরে এল ফোন কানে নিয়ে। চোখ মুখ হাসি হাসি। সামির দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘কথা বল। অমৃতা কথা বলতে চায়।’

সামির মুখটা নিভল। ফর্সা ত্বকে ঘনিয়ে এল কৃষ্ণবরণ মেঘ। গম্ভীর স্বরে বলল, ‘মাথাটা ধরছে। এখন কথা বলতে ইচ্ছা করতেছে না।’

অমৃতা সবটাই শুনল। হৃদিকে কিছু বলতে হলো না। একটু সময় নীরবতা পালন করে অমৃতা ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘থাক… পরে কথা বলব। তোরা রেস্ট নে।’

ফোনের লাইন কাটার পর হৃদি বলল, ‘সত্যিই মাথা ধরছে তোর? নাকি ইগ্নোর করলি?’

সামি শক্ত গলায় বলল, ‘ইগ্নোর করলাম।’

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘাড়টা একটু ঝুঁকিয়ে ভেজা চুলে আঙুল চালাচ্ছিল সামি। কয়েক নিমেষ চুপ থেকে আগের চাইতেও বেশি শক্ত গলায় সে বলল, ‘তোরও ইগ্নোর করা উচিত।’

হৃদি চমকে উঠল, ‘তাই?’

‘হ্যাঁ তাই।’ সামি আয়নার ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। চোখে রাখল হৃদির চোখে। স্পষ্ট গলায় বলল,

‘শোন, মা বলেছে অমৃতার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখা আমাদের উচিত না। আই ফুললি সাপোর্ট হার ডিসিশন।’

হৃদি অবাক চোখে তাকায়। কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পায় না। ‘জানি বিষয়টা তোর জন্য টাফ। কিন্তু কিছু করার নাই। আমি চাই না আমার মা আর একটুও কষ্ট পাক।’

‘তুই পারবি?’ সামির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে হৃদি।

‘কীসের কথা বলছিস?’

‘তুই পারবি অমৃতাকে ভুলে যেতে?’

সামি চোখ নামায়, ‘পারতে হবে।’ কথাটা ছুড়ে দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে যায় নিঃশব্দে। হৃদি থম ধরে বসে থাকে বিছানার ওপর। শাড়ি পাল্টানোর কথা ভুলে যায়। বুকের ভেতর ভাংচুর হয়। ভাংচুরের প্রকট, বীভৎস তাণ্ডবে থরথর করে কাঁপতে থাকে পৃথিবী। কতক্ষণ কাটে কে জানে! হৃদির দীঘল চোখে এক সময় জলের ছায়া পড়ে। দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকে রাখে সে। সামি সিগারেট শেষ করে ঘরে ফিরে আসে। হৃদি ওর দিকে চেয়ে কাঁপা গলায় বলে, ‘তোর মনে আছে সামি আমাদের একটা বৃষ্টিমহলের স্বপ্ন ছিল? বৃষ্টিমহলটা ভেঙে যাচ্ছে। শব্দ শুনতে পাচ্ছিস?’

৪১

সকাল নয়টার ক্লাস ধরতে হবে। ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছে বলে মুখে কিছু না দিয়েই তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যাচ্ছিল তারা। দরজার বাইরে এক পা এগিয়ে দেয়া মাত্র আকাশের ডাকটা ভেসে এলো।

‘তারা!’

‘জি ভাইয়া।’

‘একটু শুনে যাও।’

আকাশ ডাইনিং-এ বসে আছে। নাশতার টেবিলে। সেলফোনে হাত ছোঁয়াতে হয়নি, কাঁধ উঁচু করে যন্ত্রটা কানের সাথে ঠেকিয়ে রেখেছে। এক হাতে পাউরুটি, অন্য হাতে বাটার নাইফ। তারা ফিরে আসতেই সে জরুরি গলায় বলল, ‘রুদ্র বলছে ওর একটা ব্রেসলেট ফেলে গেছে। তুমি কি দেখেছ জিনিসটা?’

তারার মুখ থেকে রক্ত সরে গেল। হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল পিংপং বলের মতো। কয়েক সেকেন্ড সে কোনো কথা বলতে পারল না। কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামীর মতো মলিন বিবর্ণ মুখে দাঁড়িয়ে রইল। আকাশ পাউরুটিতে কামড় বসিয়ে বিরক্ত গলায় বলল, ‘কী হলো? স্ট্যাচু হয়ে গেলে কেন?’

তারা তটস্থভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। কী বলবে খুঁজে পায় না। নিজেকে কীটপতঙ্গের চাইতেও নিকৃষ্ট এবং ইতর বলে মনে হয়। কী করে বলবে জিনিসটা সে প্রথমদিনই খুঁজে পেয়েছিল এবং নিজের কাছে… অনেক কাছে অতি পরম যত্নে গচ্ছিত রেখেছে যক্ষের ধনের মতো!

‘তারা! আর ইউ ইভেন লিসেনিং টু মি?’ আকাশের খটমট প্রশ্ন তারাকে আরো দুর্বল করে দেয়। কোনো রকমে সামলে নিয়ে বলে, ‘কীসের কথা বলছিলেন ভাইয়া? সরি… আমার এক্সাম আছে তো… একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছে। খেয়াল করিনি আপনার কথা।’

আকাশের মুখে অপ্রসন্ন ভাব ফুটে ওঠে। সেলফোনটা এগিয়ে দেয় তারার দিকে, ‘নাও কথা বল। আমার সময় নাই। এখুনি বেরোতে হবে।’ বাক্যটা ছুড়ে দিয়ে আকাশ নাশতায় মনোযোগ দেয়। চায়ের কাপে চিনি গুলিয়ে নেয় চামচ দিয়ে। আড়চোখে তারাকে একবার দেখে। ফ্যাকাশে মুখে সেলফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু কাঁপছে মনে হয়। যেন ফোন নয়, আগ্নেয়াস্ত্র ধরিয়ে দেয়া হয়েছে তার হাতে।

তারার মনে হচ্ছিল মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। এত ভয় কোনোদিন লাগেনি। যেন কথা বললেই রুদ্রর কাছে তার গোপন পাপ ধরা পড়ে যাবে। মান-সম্মান বলতে তেমন কিছুই উদ্বৃত্ত নেই এই পরজীবী জীবনে। অল্পবিস্তর আত্মসম্মান লেগে আছে এখনো বুকের কোণে। ছেলেটার কাছে ধরা পড়ে গেলে সেই আত্মসম্মানটুকুও ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। এরপর কী নিয়ে বাঁচবে তারা? বেঁচে থাকার জন্য নিজের প্রতি অল্পবিস্তর সম্মানবোধ তো অন্তত থাকা চাই। তাই না?

‘হ্যালো!’ ফোনটা কানে ঠেকাতেই হলো। কারণ, আকাশ কড়া চোখে তাকে দেখছিল।

‘হেই তারা! কী খবর?’ কণ্ঠটা কতদিন পর শুনতে পেলো? কত শতাব্দী পরে? ঐ গলার স্বরে খুশির ঝুমঝুম বাজনা বাজে কেন সর্বক্ষণ? কেন শুনলেই মনের ওপর দিয়ে ফুরফুরে আমুদে হাওয়া বয়ে যায়?

‘এইতো!’ আকাশের দিকে চোরা চোখে তাকায় তারা। অস্বস্তি হয়।

‘ভালো আছ?’ প্রশ্ন করে রুদ্র।

‘হ্যাঁ…ভালো…। আপনি কেমন আছেন?’

‘আলহামদুলিল্লাহ।’

আকাশ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বেডরুমে চলে যায়। দশ মিনিটের মধ্যে বেরোতে হবে। সাড়ে নয়টায় ফ্যাকাল্টি মিটিং। ওর প্রস্থান তারাকে অনেকটা সহজ করে তুলল।

‘শোন তারা, সম্ভবত আমি একটা রিস্টব্যান্ড ফেলে এসেছি তোমাদের বাসায়। তুমি একটু খুঁজে দেখবে প্লিজ? ওটা হারিয়ে গেলে খুব সমস্যা হবে। হৃদি দিয়েছিল ফ্রেন্ডশিপ ডে’তে। সে যদি একবার জানতে পারে জিনিসটা আমি হারিয়ে ফেলেছি… তাহলে বুঝতেই পারছ।’

‘জি বুঝতে পারছি।’

‘খুঁজে পেলে আমাকে জানিও, কেমন?’

‘জি জানাব।’

এরপর কেন যেন কেউ কোনো কথা বলল না। নিস্তব্ধতার একটা বলয় তৈরি হলো দুজনের মাঝে। রুদ্র একতলার বারান্দার বেতের চেয়ারে বসে আছে। বাবার সাথে মর্নিংওয়াক করে বাড়ি ফিরল মাত্র। পরনে হাফপ্যান্ট, টি-শার্ট। পায়ে স্নিকারস। উঠোনের রুক্ষ বাদামি মাটিতে একফালি কমলা রঙের রোদ এসে পড়েছে। শ্বেতচন্দন গাছের সাদা ফুলের গায়ে রোদ ঝিকোচ্ছে চিকচিক করে। আমলকির ডালে বসে আছে একটা ছোট্ট টুনটুনি। টিউটিউ করে ডাকছে। একটা কালো ভোটকা বেড়াল বারান্দার রেলিং-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে চোরের মতো লোভী চোখে তাকিয়ে দেখছে রুদ্রকে। পরিকল্পনা করছে কীভাবে রুদ্রর চোখ ফাঁকি দিয়ে বাড়ির রান্নাঘরে ঢুকবে। রুদ্রর কানে ফোন। ওপাশে নিস্তব্ধতা। কেউ কথা বলছে না। আবার ফোনের লাইন কাটার কথাও মাথায় আসছে না। রুদ্রর মনে হচ্ছিল তারাকে একটা প্রশ্ন করার ছিল। প্রশ্নটা বেশ কদিন ধরেই ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্নটা এই মুহূর্তে কিছুতেই মনে পড়ছে না। রুদ্র মুখরা ছেলে। ফোন কানে নিয়ে চুপচাপ বসে আছে এমন ঘটনা তার জীবনে নজিরবিহীন। কথা বলার জন্য শব্দের তালাশ করতে হয় না তার। শব্দেরা অনায়াসে ধরা দেয়। কিন্তু আজকে বুঝি শব্দের ধর্মঘট লেগে গেছে। ওদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

‘তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, শুনলাম।’ রুদ্র বলল এক সময়।

‘জি।’

‘কবে হচ্ছে?’

‘সাতাশ তারিখ।’

‘এই মাসের?’

‘জি।’

‘কনগ্রেচুলেশনস!’

‘থ্যাংক ইউ।’

আবার নিস্তব্ধতা। তারার চোখে জল উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। মাথার ভেতরটা গোলমেলে। ভয় আর অস্বস্তিতে বুজে আসছিল গলার স্বর। একটু সাহস করে বলে ফেলল কথাটা, ‘আপনি কবে আসছেন?’

সেই মুহূর্তে আকাশ বেরিয়ে এল বেডরুম থেকে

‘কথা শেষ হয়নি?’

তারা চমকে উঠল। ফোনটা তড়িঘড়ি করে আকাশের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ… কথা তো শেষ!’ ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘুরে দাঁড়ালো তারা। ত্রস্ত পায়ে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। আকাশ দেখল রুদ্র তখনো লাইনে আছে। ফোন কানে ঠেকিয়ে বলল, ‘কী হইল? লাইন কাটিস না ক্যান?’

‘আমাদের কথা তো শেষ হয় নাই। তুই মাঝখানে আইলি কী করতে?’

‘তারা তো বলল কথা শেষ।’

‘তাই বলল?’

‘হুম।’

‘ও জানতে চাচ্ছিল আমি কবে ঢাকায় কবে আসব।’

‘তাই?’

‘হ্যাঁ…।’

‘কবে আসবি?’

‘এখনো ঠিক করি নাই।’

‘সাতাশ তারিখ তারার বিয়ে। দাওয়াত তো আলাদা করে দেয়ার কিছু নাই। তোরা নিজের মানুষ। চইলা আসিস।’

রুদ্র চুপ করে রইল। আকাশ সোফায় বসে জুতোর ফিতে বাঁধছিল। বাঁধা হয়ে গেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘রাখি দোস্ত। বের হচ্ছি।’

‘আকাশ শোন…একটা কথা বলার ছিল।’

‘বল।’

রুদ্র স্বভাববিরুদ্ধ গম্ভীর গলায় বলল, ‘মেয়েটাকে জোর করে বিয়ে দিস না।’

‘জোর করে বিয়ে দিব কেন? কী আশ্চর্য!’ ক্রোধ ঝরে পড়ে আকাশের কণ্ঠস্বর থেকে।

‘তুই ওকে আস্ক করছিস? সে কি রাজি আছে?’

‘তোর প্রব্লেম কী রুদ্র?’

‘আমার কোনো প্রব্লেম নাই। আমি জাস্ট ভাবতেছি ওর হয়ত এখনো বিয়ের বয়স হয় নাই। হয়ত ইচ্ছাও নাই। তোর ভয়ে কিছু বলতে পারতেছে না।’

আকাশ বড় একটা শ্বাস ফেলে বলল, ‘তুই জেনে খুশি হবি যে এই বিয়েতে সে অত্যন্ত আনন্দের সাথে রাজি হয়েছে। ওর বয়স তেইশ প্লাস। তেরো না।’

ফোনের লাইন কেটে দিল আকাশ। রুদ্র একা একা বারান্দায় আরো অনেকক্ষণ বসে রইল ঝুম হয়ে। কমলা রঙের উত্তপ্ত সকালটা ঝলসাতে লাগল চোখের সামনে। একথা সত্য তারা অবলা কিশোরী নয়। বিয়েতে মত না থাকলে সে নিশ্চয়ই স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিত। না জানালেও এ নিয়ে রুদ্রর মাথাব্যথার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত পরিবারের হাজার হাজার মেয়ে নিজের মতের বিরুদ্ধে বাপ মায়ের চাপে পড়ে বিয়ে করে। সময়ের সাথে সাথে সবকিছু ঠিক হয়ে যায়। বাঙালি মেয়েরা মানিয়ে নিতে জানে। বিভার সাথেও তো ঠিক এমনটাই হয়েছিল। সেই বিভা এখন তার বান্ধবীদের মধ্যে সবচেয়ে সুখী। ভাবতে ভাবতে রুদ্র চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। অস্থির পায়ে পায়চারি করে বারান্দার এক মাথা থেকে আরেক মাথায়। বুকে একটা অস্বস্তির কাঁটা খচখচ করে। আকাশ প্রশ্ন করেছিল ‘তোর প্রব্লেম কী রুদ্র?’ সত্যি বলতে রুদ্র নিজেও জানে না প্রব্লেমটা আসলে কোথায়। কিন্তু কিছু একটা সমস্যা যে আছে তা টের পাওয়া যায়। যেন একটা অনির্ণেয় গোপন ব্যাধি বাসা বেঁধেছে শরীরে। বুকে সারাক্ষণ চাপ চাপ যন্ত্রণা। গতকাল বাড়ি থেকে ফিরে এল শহরে। আত্মীয়স্বজনরা সবাই একে একে বিদায় সংবর্ধনা দিচ্ছে। আজকে এর বাসায় দাওয়াত তো কাল ওর বাসায়। একা লাগার অবকাশ নেই। তাহলে মন খারাপের ভূতটা তাড়া করে বেড়াচ্ছে কেন সর্বদা? কেন কিছুই আর ভালো লাগছে না আগের মতো করে? যেন একটা ছায়া সারাক্ষণ তার সাথে সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুটি প্রখর চোখ তীক্ষ্ণভাবে অবলোকন করছে সমস্ত গতিবিধি। একা হলেই সেই চোখ দুটি ঘন কুয়াশা ভেদ করে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে মনের পর্দায়। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকে!

৪২

রাশেদ!

সেদিন দেখলাম আপনাকে। আমার সিনিয়রের মেয়ের বিয়েতে। মন বলছিল আপনি আসবেন। কারণ, স্যারের সাথে আপনার বহুদিনের পরিচয়। আপনার পলিটিক্যাল পার্টির বেশ কিছু মামলা স্যারের আন্ডারে আছে। এর মাঝে দুটো কেস আমি নিজে ডিল করছিলাম। দুর্ঘটনার পর বিরতি চলে আসায় স্যার দায়িত্ব ট্রান্সফার করে দিয়েছেন অন্য জুনিয়রের কাছে।

কালো রঙের ফুলস্লিভ ফর্মাল শার্টে আপনাকে কী সুন্দর লাগছিল রাশেদ! যেন সিনেমার পর্দা থেকে উঠে আসা মানুষ। আমি ভিড়ের মাঝে মিশে গিয়ে দূর থেকে আপনাকে লক্ষ্য করছিলাম। দেখছিলাম আপনার হাত নেড়ে, ঠোঁট টিপে কথা বলার অসাধারণ ভঙ্গিটি। ভিড়ের মধ্য থেকে আরো অনেকেই দেখছিল আপনাকে। দেখবেই বা না কেন, এমন মানুষ সচরাচর চোখে পড়ে নাতো! ঐ একগাদা লোকের মাঝে আপনিই ছিলেন বিশেষ দ্রষ্টব্য।

আপনি কেমন আছেন? আমি ভালো নেই! আমার মনের অবস্থাও ঢাকা শহরের মতো ধুলোটে আর পিঙ্গল। এমন খরা কেন লাগল বলতে পারেন? কতদিন বৃষ্টি হয় না! আমার বুকটা বৃষ্টির জন্য খাঁ-খাঁ করে। রাস্তার মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকানো যায় না। অসুখী, দুঃখী চেহারা, ঘামে ভেজা শরীর, মাথায় প্রখর সূর্যের তাপ নিয়ে জীবিকার প্রয়োজনে ছুটে চলা… নিজের চাইতে ঐ মানুষগুলোর জন্যই বেশি কষ্ট হয় আজকাল। কোর্ট-কাচারিতে কত অসহায় লোক বিচারের আশায় ঘুরে বেড়াচ্ছে দিনের পর দিন। এদেরকে কেউ সঠিক পথ দেখাচ্ছে না। এরা নিজেদের আইনী অধিকার সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সচেতন নয়। দালালদের পেছনে ঘুরে ঘুরে অর্থ এবং সময় নষ্ট করছে। আদালত প্রাঙ্গণের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। ঘুষ দেয়া নেয়া এখানে প্রথায় পরিণত হয়েছে। বিনা দোষে জেল খাটছে কত মানুষ। অথচ সত্যিকারের অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে দিনের আলোর নিচে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কারাগারকে কেন্দ্র করেও গড়ে উঠছে ব্যবসা। কোনো স্বজন কারাবন্দির কাছে এক হাজার টাকা পাঠালে বন্দির হাতে যাবে হয়ত সাতশত কী আটশ’ টাকা। আমার আর ভালো লাগে না। প্রকৃতির খরা আমার বুকে লেগে গেছে। একটু বৃষ্টি হলে বাঁচতাম!

বাবা আমার জন্য একটা সাদা খোল নীল পাড়ের শাড়ি কিনে এনেছেন। তার ইচ্ছা আমি এখন থেকে শাড়ি সালওয়ার কামিজ পরব। বড় চুল রাখব। মেয়েদের মতো হাঁটব, চলব, নরম স্বরে কথা বলব। পৃথিবীর মানুষ মেয়েদের নরম, কোমল হিসেবেই কেন দেখতে চায় সর্বদা? মেয়ে হলেই শাড়ি পরতে হবে, লজ্জা পেতে হবে, বিয়ে করে সংসারী হতে হবে, বাচ্চার মা হতে হবে… এসব স্টেরিওটাইপ থেকে আমাদের সমাজের মানুষগুলো কবে বেরিয়ে আসবে? সমাজের মানুষ তো দূরের কথা আমার নিজের বাবা মা’ই এখনো আমাকে আমার মতো করে মেনে নিতে পারছে না। মায়ের খুব রাগ কেন আমি ছেলেদের মতো চলাফেরা করি। সেদিন সাগর-সৈকতে কী হয়েছিল আপনি তো জানেন। ঐ দলের ছেলেগুলো কব্জির জোরে আমার সাথে পারেনি। নাক ফাটিয়ে দিয়েছিলাম ঘুষি মেরে। বাড়ি ফিরে মাকে বলতেই মা ভীষণ রেগে গেল। কতটা বেহায়া হলে একটা মেয়ে ছেলেদের গায়ে হাত তুলতে পারে, লাজ-শরম কিছুই নাকি আমার নেই… ব্লা ব্লা ব্লা…! অথচ এসব কিছুই নতুন নয়। জীবনে বহুবার আমি বহু ছেলের সাথে মারপিট করেছি। আপনার লম্বা চওড়া ছেলেকেও পাঞ্জায় হারিয়েছি বহুবার। মেয়েদের মতো লুতুপুতু নরম-শরম হয়ে চলতে আমার কখনই ইচ্ছে করেনি। কিন্তু বাবার দেয়া নীল পাড়ের শাড়িটা পাবার পর মনে হয়েছে এটা পরে একবার আপনার সামনে যাই। আমার বন্ধুরা বলে শাড়ি পরলে আমাকে সুন্দর দেখায়। আপনার চোখে আমি সুন্দর কি না তা জানি না। খুব ইচ্ছে করে আপনার চোখে সুন্দর হতে। আমার ভেতরকার যে নারীত্বকে আজন্মকাল ধরে প্রত্যাখ্যান করে এসেছি সেই নারীত্বই আপনার জন্য প্রজাপতির ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে চায় হৃদয়পুরের নীলাভ আকাশে।

ঠিক করেছি হেমন্তের প্রথম বৃষ্টিতে সাদা খোল নীল পাড়ের শাড়িটা একবার পরব। বাবা খুশি হবে। আপনি কি একবার আসবেন রাশেদ? আমার ভাবতে ভীষণ ভালো লাগে যেদিন হেমন্তের হিমগন্ধী আকাশ ভেঙে প্রথম বৃষ্টি নামবে সেদিন আপনি আমার বাসার নিচে আসবেন সাদা পাঞ্জাবি পরে, হাতে বেগুনি রঙের একগুচ্ছ জ্যাকারান্ডা ফুল নিয়ে। আমি বাবার দেয়া নীল পাড়ের শাড়ি পরে বারান্দায় এসে দাঁড়াব। সোঁদাগন্ধভরা বৃষ্টি বৃষ্টি বাতাস আমার সর্বাঙ্গ ধুয়ে দিয়ে যাবে। আপনি জ্যাকারান্ডা হাতে আমার দিকে চেয়ে হাসবেন আপনার আশ্চর্য সুন্দর ধারালো হাসিটা। আমি বুঝব আপনার জীবনে আমিই একমাত্র আরাধ্য নারী! বৃষ্টিটা একবার নামুক। খরার পৃথিবী ডুবিয়ে দিয়ে যাক। আপনি আমাকে কথা দিন বৃষ্টি নামলে দেখতে আসবেন। আসবেন তো?

‘কী করছিস?’ হঠাৎ ছুটে আসা প্রশ্নটায় দারুণ চমকে ওঠে অমৃতা। মা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখের তারায় দপদপ করছে সন্দেহ। অমৃতা চমক লাগা হাতে ল্যাপটপের স্ক্রিন মিনিমাইজ করল। মা কিছু দেখেছে কি না কে জানে! অমৃতার বুক কাঁপছে। ভয়ের বিষ ছড়িয়ে পড়ছে রক্তের কণায় কণায়। টেবিলের ওপর ল্যাপটপ রাখা ছিল। মা কিছুক্ষণ সন্দিগ্ধ চোখে অমৃতার দিকে চেয়ে থেকে ঝড়ের গতিতে ল্যাপটপটা ছিনিয়ে নিল টেবিল থেকে। অমৃতার হাতজোড়া অজান্তেই এগিয়ে গেল। মায়ের সাথে ল্যাপটপ নিয়ে কাড়াকাড়ি করার কোনো অভিপ্রায় ছিল না। কিন্তু দৃশ্যটা প্রায় সেরকমই হয়ে গেল। এক সময় অমৃতা নিরস্ত হলো। লুকানোর চেষ্টা করলেই মা আরো বেশি সন্দিহান হয়ে উঠবে। ফলাফল হিতে বিপরীত হবে। অগত্যা অমৃতাকে হাত গুটিয়ে আনতে হলো। বিছানার ওপর অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা হেঁট করে বসে পড়ল সে। মা কী ভাববে এসব পড়ে? ছি! নিজেকে ভীষণ পাপিষ্ঠা বলে মনে হচ্ছে। ছয়তলার বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে পড়ে মরে যেতে পারলে সবচেয়ে ভালো হতো! মিনিট তিনেক সময় ধরে মা নির্বাক চেয়ে রইল ল্যাপটপের স্ক্রিনে। তারপর বিস্ফারিত দুটি চোখ কন্যার মুখের ওপর গেঁথে দিয়ে শঙ্কিত গলায় বলল, ‘তুই লোকটার সাথে এখনো কন্ট্যাক্ট করিস?’

অমৃতা কাঁপছিল ভয় এবং লজ্জায়। ফাঁপা গলায় বলল, ‘না।’

মা হুঙ্কার ছাড়ল, ‘তাহলে এসবের মানে কী?’

‘ইমেইল সেন্ড করা হয়নি। ড্রাফট করা হয়েছে শুধু। কখনো সেন্ড করা হবে না। তুমি চিন্তা করো না।’

মা লেখাটার ওপর আরেকবার চোখ রাখলেন। অমৃতা একটা ঝড়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল মনে মনে। এখুনি শুরু হবে কটূক্তির বর্ষণ। মা বলতে থাকবে কতটা নীচ, কতটা হীন হলে মানুষ এমন কাজ করতে পারে। এরকম মেয়ে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো ছিল। এই টেপ রেকর্ডার বাজবে টানা অনেকক্ষণ। অমৃতা কিছু বলবে না। বলার মতো উপায় নেই। চুপ করে মুখ বুজে সহ্য করবে সবটা। এক সময় বাবা মায়ের মুখে মুখে তর্ক করত। মানসিকতা পরিবর্তনের উপদেশ দিত। আজকাল কিছুই বলে না। শুধু চুপ করে থাকে। অপরাধীদের চুপ করে থাকতে হয়, এটাই নিয়ম।

অমৃতা মনে মনে প্রমাদ গুণছিল। এই বুঝি শুরু হলো সাইক্লোন। কিন্তু অবাক কাণ্ড… সাইক্লোনটা এল না। মা ধীরস্থিরভাবে ল্যাপটপ টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল। তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে এল অমৃতার কাছে। ওর মাথাটা বুকে চেপে ধরে ব্যাকুল গলায় বলল, ‘কেন নিজের এত বড় সর্বনাশ করলিরে মা? কেন করলি? এখনও সময় আছে। সঠিক পথে ফিরে আয়। লক্ষ্মী মা আমার। ভুলটা শুধরে নে!’

৪৩

তারার বিয়ের বাজারের জন্য ঝুমকির হাতে হাজার বিশেক টাকা তুলে দিয়েছিল আকাশ। মেয়েদের শাড়ি-কাপড়ের বাজার দর তার জানা নেই। এই সামান্য টাকায় আদৌ মানসম্মত কিছু কেনা সম্ভব হবে কি না কে জানে! ঝুমকি আনাড়ি এবং সেকেলে মানুষ। দোকানদাররা তাকে অনায়াসে ঠকায়। একা একা বিয়ের কেনাকাটা করা তার জন্য কঠিন ব্যাপার হবে। আকাশ ভেবেছিল বান্ধবীদের ডাকবে। হৃদি কিংবা বিভা কেউ একজন তারাকে শপিংমলে নিয়ে গেলেই হবে। ছুটির দিনের বিকেলে ওদের ফ্রি থাকার কথা। কিন্তু বান্ধবীদের আর ডাকার প্রয়োজন হলো না। তারার কাছ থেকে জানা গেল মনীষার সাথে প্ল্যান হয়েছে। একটু পরেই কেনাকাটার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়বে ওরা। মনীষা এল বিকেল তিনটায়। তারা আগে থেকেই তৈরি হয়ে ছিল। মনীষার জোর জবরদস্তির দরুন ঝুমকিকেও তৈরি হতে হলো। ঘরোয়া জামার ওপরে একটা বোরখা পরে নিল সে। আকাশ অমৃতাকে সাথে নিয়ে বিভার বাসায় যাবে। সামি হৃদি মহা ব্যস্ত। এই উইকেন্ডে ওরা মিট করতে পারবে না। বেরোবার মুখে মনীষার সাথে দেখা। ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে পা নাড়াচ্ছে আর গুনগুন করে গান গাইছে। মেজাজ বেশ ফুরফুরে।

‘কী স্যার? কোথায় যাচ্ছেন?’

‘ফ্রেন্ডের বাসায়।’

‘ওমা… আমাদের সাথে যাচ্ছ না?’ চোখ রগড়ে প্রশ্ন করে মনীষা।

‘যাবার কথা ছিল নাকি?’

‘একটা দিন অন্তত ফ্যামিলির জন্য রাখো। ফ্রেন্ডরা তো বছরের অন্যান্য সবগুলো দিন দখল আছে।’

‘ঠিক আছে…আপনি যেহেতু এত করে বলছেন…।’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে আকাশ।

মনীষা চোখ সরু করে তাকায়, ‘আমি বলেছি বলে নয়… যদি মনে কর ফ্যামিলিকে সময় দেয়াটা জরুরি, তবেই চলো।’

আকাশ মিটমিটে বঙ্কিম হাসি হাসে, ‘আমার তো মনে হচ্ছে আপনাকে সময় দেয়াটা জরুরি!’

মনীষা গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে, ‘আমাকে সময় দিতে হবে না। তুমি পাশে থাকলে তারার ভালো লাগবে। তাই যেতে বলেছি।’

আকাশ ঠোঁটে চাপা বঙ্কিম হাসিটা ধরে রেখেই চোখ নাচায়… ফিচেল গলায় বলে, ‘শুধু তারার ভালো লাগবে? কেন আমি পাশে থাকলে আপনার

ভালো লাগবে না?’

মনীষা সুন্দর ঠোঁটজোড়া উল্টে ধমকের সুরে বলে, ‘ফাজলামো হচ্ছে?’ আকাশ জিব কেটে বলল, ‘আপনার সাথে ফাজলামো করব? মাথা খারাপ!

‘তাহলে এটা কী ছিল?’

‘কিছুই না… আমি জাস্ট ভাবলাম… আমার সঙ্গ হয়ত আপনার ভালো লাগবে… দ্যাটস ইট! ‘

মনীষা মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, ‘এত ভাবতে বলেছে কে? যত্তসব পাকনামো!’

‘আজিব! এখানে পাকনামোর কী হলো? আপনি যে যখন তখন আমার বয়স নিয়ে খোঁটা দ্যান, এটা কিন্তু ঠিক না!’

‘খোঁটা দেয়ার কিছু নেই, তোমার বয়স কম এটা তো খুশির খবর। আমার কত ইচ্ছা করে তোমাদের বয়সে ফিরে যেতে! বুড়ি হতে কি কেউ চায় বলো?’

আকাশ চোখ সরু করে বলে, ‘আপনি বুড়ি?’

‘তা নয়ত কী?’

আকাশ কপট গাম্ভীর্যের সাথে বলল, ‘তা অবশ্য ঠিক। আপনার বয়স আরেকটু কম হলে…মানে আমার কাছাকাছি হলে… ‘বলতে বলতে আকাশ থেমে যায়।

‘কী হতো আমার বয়স কম হলে?’

আকাশ মনীষার সাগরের মতো গভীর দুটি চোখে নিবিড় চোখ রেখে আলতো গলায় বলে, ‘বলব না!’

‘কেন?’

‘আপনি রাগ করবেন। বুড়ি হয়ে যাচ্ছেন তো। যখন তখন রেগে যান!’ মনীষার মুখে একটু অন্ধকার ছায়া পড়ে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘ঠিকই বলেছ। বয়সের সাথে সাথে মেজাজ-মর্জিও বদলে যায়।’

মেজাজ-মর্জি বদলে যাচ্ছে কিন্তু চেহারা বদলাচ্ছে না কেন? ‘চেহারা পাল্টাচ্ছে না?’

আকাশ ঠোঁট উল্টে বলে, ‘নাহ। আপনি দিন দিন আরো সুন্দর হচ্ছেন। রহস্য কী?’

মনীষা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়, ‘ধ্যাৎ, তোমার সব কিছুতেই ফাজলামো।’ একটু থেমে আবার বলে, ‘তখন কী বলছিলে?’

‘বলছিলাম… আপনি অনেক সুন্দর!’

মনীষার মুখে লজ্জার আলতা রং ছোপ ফেলে যায়। চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে, ‘তার আগে কী বলতে চেয়েছিলে? ওইযে একটু বলে থেমে গেলে?’

‘আপনার বয়স কম হলে কী হতো?’

‘হ্যাঁ… কী হতো?’

‘বলা যাবে না!’ আকাশ হাসে। হাসে চোখ। সুন্দর দেখায়!

নিচে নেমে সিএনজি পাওয়া গেল না। দুটো রিকশা নিতে হলো। তারা চট করে ঝুমকির পাশে বসে পড়ল। অন্য রিকশায় আকাশ আর মনীষা রিকশাটা দুজনকে নিয়ে টুং টুং ঘণ্টা বাজিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। তারা হঠাৎ বলল, ‘ইশ… ওদেরকে পাশাপাশি কী দারুণ মানায়, তাই না খালা?’

ঝুমকির গায়ে যেন বিদ্যুৎ ঝংকার দিয়ে উঠল। বজ্রগম্ভীর গলায় বলল, ‘কী যা-তা বলছিস? ঐ মেয়ের বয়স কত জানিস? বয়স্ক একজন মহিলার সাথে আবার মানাবার কী আছে? আক্কেল বলতে কি কিছু নাই?’

তারা ধমক খেয়ে চুপসে গেল। কিন্তু ঝুমকির মাথা থেকে বিদ্যুতের ঝংকারটা অত সহজে নিষ্ক্রান্ত হলো না। বুকে একটা কাঁটার মতো খচখচে ভাব বিঁধে রইল। রিকশাটা পাশাপাশিই আছে, তবে একটু এগিয়ে। ঝুমকি তীব্র চোখে চেয়ে আছে রিকশাটার দিকে। তার মনে হচ্ছে আকাশকে মেয়েটার সাথে এক রিকশায় উঠতে দেয়া উচিত হয়নি। মেয়েটা আকাশের এত গা-ঘেঁষে বসেছে কেন? মনে মনে কোনো দুরভিসন্ধি নেই তো? তওবা… তওবা…কত বড় ছেলের মা! ছি! ছি!… ঝুমকি ঠিক করল মেয়েটাকে আজকের পর থেকে আর প্রশ্রয় দেবে না। যখন তখন বাড়িতে আসাটা বন্ধ করতে হবে।

৪৪

বেলা তিনটায় বিভার বাসায় এসে পৌঁছুল অমৃতা। লন্ডনে কদিন পর শুরু হতে যাচ্ছে দুর্দান্ত শীতকাল। অমৃতার কিছু শীতের জামা-কাপড় কেনা প্রয়োজন। সেই সাথে একটা স্নো-বুট। বিভা তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছিল। প্ল্যান ছিল অমৃতা আসার সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে পড়বে। কিন্তু বেরোবার ঠিক আগ মুহূর্তে রুদ্র ফোন দিয়ে শুরু করল ভ্যাজর ভ্যাজর। বিছানার ওপর দুই বান্ধবী পা ঝুলিয়ে বসেছে। বিভার আইপ্যাডে রুদ্রর হিজিবিজি দাড়িঅলা লম্বাটে মুখটা দেখা যাচ্ছে। ঘাড় পর্যন্ত গড়ানো চুলগুলো আজ অবিন্যস্ত নয়। জেল দিয়ে পরিপাটি করে আঁচড়ানো। বন্ধুরা রুদ্রর এই ভদ্র চেহারা দেখে অভ্যস্ত নয়। বিভা অবাক গলায় বলল, ‘কাহিনি কী? আজকে এত সাজছস ক্যান?’

রুদ্র একশ’ ভোল্টের হাসি হেসে বলল, ‘একটা নতুন গান লিখছি দোস্ত, বুঝছিস? এখন আমি সেই গানে সুর লাগায়ে গেয়ে শোনাবো। তোরা শুনে বলবি কেমন হইছে।’

অমৃতা কাঁচুমাচু মুখে বলল, ‘হায় আল্লাহ! এখন তোর লেখা গান শুনতে হবে?’

বিভা করুণভাবে যোগ করল, ‘দোস্ত তোর গানগুলার লিরিক্স খুবই উইয়ার্ড হয়। দিনটাই খারাপ হয়ে যাবে। তুই বরং অন্য কোনো গান গেয়ে শোনা। নিজের লেখা গান আমাদেরকে শুনাইস না। প্লিজ। পায়ে পড়ি।’

এসব কথায় রুদ্র একটুও অপমানিতবোধ করল না। তার মুখে ফকফকা হাসিটা অব্যাহত রইল। হাসতে হাসতে বলল, ‘আরে এমন করিস ক্যান? নিজের লেখা গান আমার সবার প্রথমে তোদেরকে না শুনাইলে ভালো লাগে না। বাকিরা সব কোথায়? আমি গ্রুপ কল দিলাম ওরা রিসিভ করল না।’

অমৃতা বলল, ‘হৃদি আর সামি কিছু একটা নিয়ে বিজি।’

‘কী নিয়া বিজি?’ রুদ্রর প্রশ্ন।

বিভা ঠোঁট উল্টে বলল, ‘কী জানি! হয়ত পারসোনাল কিছু। জিগাইলাম ঠিক মতো কিছু কয় না। ভাব নেয় শালারা। জাহান্নামে যাক… আমাদের কী?’

রুদ্র ইলেকট্রিক গিটার টিউন করতে করতে বলল, ‘আকাশ কই?’

‘খুব কানে লাগতেছে শব্দটা। বন্ধ কর তো এই বাজনা!’ বিভা খ্যাঁক দিয়ে উঠল। রুদ্রর প্রশ্নের উত্তরটা এল অমৃতার কাছ থেকে, ‘আকাশ গেছে তারার বিয়ের শপিং করতে।’

রুদ্রর হাত থামল। ভ্রু-কুঁচকে তাকাল ক্যামেরার দিকে, ‘কী করতে গেছে?’

‘তারার বিয়ের শপিং।’

মুখের হাসিটা যে ভস করে নিভে গেছে রুদ্র তা বুঝল না। টের পেল না ললাটে পড়েছে এক অনভিপ্রেত ভাঁজ। কিন্তু বন্ধুদের চোখে পড়ল সবটাই।

‘কী হইল তোর?’ অমৃতার জিজ্ঞাসা।

রুদ্র গিটারে হাতের আঙুল ফিরিয়ে নিয়ে বলল, ‘কিছু না।’ শব্দ দুটো উচ্চারণ করে থামল সে। তারপর একটু অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘তোরা আমাকে মিস করিস না একটুও… তাই না?’

ছেলেমানুষী প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলল দুই বান্ধবী। রুদ্রর কটা চোখের মণিতে রাগের আঁচ লাগল। ঝাঁজাল হলো কণ্ঠস্বর, ‘হাসতেছিস ক্যান?’

বিভা ঠোঁট টিপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করে বলল, ‘কে বলছে তোরে মিস করি না? অনেক মিস করি দোস্ত!’

‘তাহলে ঢাকায় আসতে বলিস না ক্যান?’ রুদ্রর ইনোসেন্ট প্ৰশ্ন।

অমৃতা আর বিভা হেলেদুলে হাসতে লাগল। সেই হাসিতে রুদ্রর রাগের মাত্রাও সমান তালে বাড়তে লাগল।

‘আচ্ছা ভাই… তোমরা হাসো। শপিং করো। মাস্তি করো… আমি রাখি।’

কথাটা বলে সত্যিই রুদ্র ফোনের লাইন কেটে দিল! এই স্বভাব-বিরুদ্ধ অদ্ভুত আচরণে দুই সখী এমনই হতভম্ব হলো যে কয়েক সেকেন্ড হাঁ করে একজন অপরজনের দিকে চেয়ে রইল শুধু। কিছু বলতে পারল না। একটা সময় অমৃতা বিস্ময়-ডুবি গলায় বলল, ‘দিস ইজ ইনসেইন!’

‘আসলেও… রুদ্র তো ওর চোদ্দ গুষ্টিরে পচাইলেও কখনো মাইন্ড করে না। ভ্যাকভ্যাক করে হাসতে থাকে। আজকে হঠাৎ কী হইল?’

অমৃতা চোখ ছোট করে সন্দিগ্ধ গলায় বলল, ‘কিছু একটা হইছে ওই শালার। হঠাৎ করে ঢাকায় আসার জন্য পাগল হয়ে গেছে ক্যান? গেলই তো মাত্র কয়দিন আগে!

বিভা আবারও রুদ্রর নম্বরে কল করল।

‘কীরে তোরা বের হস নাই এখনো?’ কল রিসিভ করেই সিরিয়াস ভঙ্গিতে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল রুদ্র।

বিভা অতি আহ্লাদি গলায় বলল, ‘তুমি এভাবে কান্না করলে কীভাবে বের হব বাবু? কেঁদো না প্লিজ। শপিং করে ফিরে আসার সময় তোমার জন্য চকলেট নিয়ে আসব।’

‘দ্যাখ মামা, যদি মজা নেওয়ার জন্য ফোন করে থাকিস তাইলে আগেই বইলা দেই আমার এখন মজা দেওনের মুড নাই। পরে ফোন দিস। ওকে?’

‘অ্যাই রুদ্র! তোর হঠাৎ কী হইল? একটু আগেই তো ভ্যাকভ্যাক করে হাসতেছিলি!’ অমৃতা বলল।

রুদ্র মাথা নিচু করে গিটারে আঙুল চালাচ্ছিল। মুখের একটা পাশ ঢেকে আছে চুলে। চোখের ভাষা পড়া যাচ্ছে না। বিভা অধৈর্য হয়ে বলল, ‘কথা বলিস না কেন?’

রুদ্র মুখ তুলে দেখল দুই বান্ধবীকে। ভ্রু-কুঁচকে ভাবল কিছু একটা। ইতস্তত করে বলল, ‘আই ডোন্ট নো হোয়াট ইট ইজ… বাট সামথিং ইজ হ্যাপেনিং টু মি।’

বিভা পানসে গলায় বলল, ‘প্লিজ এখন বলিস না তোরও হৃদির মতো একটা হালুলুকার সাথে ফ্রেন্ডশিপ হইছে।

অমৃতা বিভার ডান বাহুতে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘আহ… ফাইজলামি করিস নাতো। রুদ্র তুই বল। কী হইছে একজেক্টলি?’

‘জানি না দোস্ত!’ অসহায়ভাবে বলে রুদ্র। চুপ করে থাকে… ভাবে… আঙুল দিয়ে চুল ঠিক করে… দাড়িতে অস্থিরভাবে হাত বুলায়… বিষণ্ণ গলায় বলে, ‘একা একা লাগে… আগে কখনো এমন লাগত না!’

‘আসলে দোস্ত বিদেশে চলে যাবি তো ফ্যামিলি ছেড়ে… এইজন্যেই মন খারাপ লাগতেছে। আমারও এরকম লাগে বুঝছিস? ঘাবড়ানোর কিছু নাই। দেখবি ওইখানে যাওয়ার পর সব ঠিক হয়ে যাবে। আর শোন, আমরা তোকে অনেক মিস করতেছি। ঢাকায় আসতে বলতেছি না কারণ, আমার মনে হয় আংকেল আন্টির সাথে তোর কয়টা দিন থাকা উচিত।’ অমৃতা প্রবোধ দেয়। বিভা বলে, ‘কই তোর গানটা শুনাইলি না? গান শোনা।’

রুদ্র ফ্যাকাশে হাসে, ‘মাত্রই তো বললি শুনবি না।’

দুই বান্ধবী সমস্বরে বলে উঠল, ‘অফকোর্স শুনব। শুরু কর!’

রুদ্র খুশি হলো। একশ’ ভোল্টের ফকফকা হাসিটা ফিরল না, তবে চোখে আনন্দের একটা ঝিকিমিকি ঢেউ খেলে গেল। আবিষ্ট মনে গিটার বাজিয়ে গাইতে লাগল সে।

তোমার চোখের তারার মাঝে
একটি কথা লুকিয়ে ছিল
সেই কথাটি বুঝতে পেরেও
অবুঝ সেজে থাকতে হলো।
তোমার মুখের কোথায় যেন
বুক কাঁপানো মায়া ছিল
সেই মায়াটা রাত গভীরের
মন খারাপের কারণ হলো।

বিভা আর অমৃতা হাততালি দিয়ে উঠল। মুগ্ধ স্বরে বলল, ‘বাহ এই গান টা তো দারুণ। তুই এত রোমান্টিক গান লিখতে পারিস জানতাম না তো দোস্ত!’

‘আরেকটা শুনবি?’

‘নিশ্চয়ই শুনব। গেয়ে ফ্যাল।’

রুদ্র গাইল,

তুমি রোজ রাতে ঘুরতে আসো আমার গোপন মনের ঘরে আমি তোমার চুরি ধরে ফেলেছি, আমি জানি তুমি কে! ছদ্মবেশ টেনে ছিঁড়ে, তোমায় দেখেছি আমি চুপিসারে আমি তোমার চুরি ধরে ফেলেছি, আমি জানি তুমি কে!

গানটা শেষ হওয়ার পর দুই বান্ধবী কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। বিভা একসময় বলল,

‘সে কে দোস্ত? আমরা জানতে চাই।’

রুদ্র হাসল, ‘বাদ দে। যা তোরা শপিং কর। রাখি এখন।’

ফোনের লাইন কেটে যাবার পর অমৃতা রহস্যভরা গলায় বলল, ‘আমার মনে হয় আমি জানি সেই মেয়েটা কে!

বিভার মুখে একটা দ্বিধা খেলছে আলোছায়ার মতো। চোখে দুশ্চিন্তার প্রলেপ। চূড়ান্ত বিস্ময় নিয়ে সে বলল,

‘মাই গড! আমার বিশ্বাস হইতেছে না রুদ্র কারো ব্যাপারে এত সিরিয়াস হইতে পারে…ড্যাম!’

অমৃতা অস্থিরভাবে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে বলল, ‘আমি ওদের দুজনকে দেখেই বুঝতে পারছিলাম দেয়ার ইজ অ্যা ভাইব গোইং অন বিটউইন দেম।’

বিভা অবিশ্বাসঝরা কণ্ঠে বলে, ‘কিন্তু… দোস্ত… মেয়েটা একটু বেশি সিম্পল না? মানে…’

অমৃতা শ্রাগ করে, ‘শী ইজ প্রিটি!’

‘আই নো শী ইজ প্রিটি… বাট…রুদ্রর পাশে আমি আরেকটু কোয়ালিফাইড মেয়ে এক্সপেক্ট করছিলাম। রুদ্র আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো স্টুডেন্ট। ওর বউ নিয়ে কত আশা ছিল। তারাকে দেখলে তো মনে হয় আমার চেয়েও গাধা!’

‘ছি! বিভা। এত মিন কেন তুই?’

‘মিন হইতে চাই না। এসব কথা বলতেও চাই না। বাট… কাম অন! এর চেয়ে তো মনীষা ভালো আছিল। কী সুন্দর দেখতে!’

‘মনীষাকে রুদ্রর বাপ মা জীবনেও মেনে নিবে না। বয়সে বড় তো!’

‘আমাদের ভুলও তো হইতে পারে। হয়ত অন্য কেউ।’

অমৃতা মাথা নাড়ে, ‘উঁহু… এটা তারা। আমি শিওর।’

বিভা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘তাহলে কী করা যায়? কী হবে?’

‘গড! মাত্র কিছুদিন পর মেয়েটার বিয়ে!’

বিভা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘ধুর…রুদ্রর কিছু ঠিক নাই। দেখবি আমেরিকা গিয়ে সব ভুলে গেছে। এর চেয়ে মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাক। সংসার হোক। ভালো থাকুক।’

‘এটাও ঠিক…রুদ্রটা পাগল। তবে ওকে এত সিরিয়াস হতেও তো আগে কখনো দেখি নাই। তোর বিশ্বাস হয় রুদ্র এমন গম্ভীর গান লিখতেছে?’

বিভা চুপ করে থাকে। চুপ করে থাকে অমৃতাও। দুশ্চিন্তা খেলা করে চার চোখে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *