1 of 3

সেই আবেগে

সেই আবেগে

কি করে কি হয়। ঠাকুর বলছেন : “প্রথমটা একটু উঠে পড়ে লাগতে হয়। তারপর আর বেশি পরিশ্রম করতে হবে না।” এই উঠেপড়ে লাগাটা কি রকম! ঠাকুরই দিয়েছেন পথের নির্দেশ। তার মতে, কাম-কাঞ্চনের ঝড়-তুফানগুলো কাটিয়ে গেলে তখন শান্তি। কাম-কাঞ্চনই যোগের ব্যাঘাত। কিসের সঙ্গে যোগ? তাঁর সঙ্গে যোগ। তিনি কে? তাঁর বিশেষণ আমরা জানি। তাঁকে আমরা জানি না। বিশেষণ হলো—সৎ-চিৎ-আনন্দ। তিনি সচ্চিদানন্দ। সেই যোগে মানুষ সৎ হবে। নিজের সঙ্গে নিজের যোগ হবে। চিৎকে, চৈতন্যকে সে খুঁজে পাবে। স্বরূপের দর্শন পাবে। ফলে সে আনন্দের সন্ধান পাবে। মানুষের সমস্ত নিরানন্দের কারণ আসক্তি। আসক্তি তার ভয়ঙ্কর দুটি বস্তুতে—কাম আর কাঞ্চন। দুটি বস্তু গাঁট ছড়ায় বাঁধা। কামের জন্য প্রয়োজন কাঞ্চনের। আবার কাঞ্চন এলে আসবে কাম। এই দুই বস্তু মানুষের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। অস্বীকার করার উপায় নেই। এ আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। উঠেপড়ে লাগা মানে, কাম-কাঞ্চনের মোহ থেকে দূরে থাকা। দূরে থাকা মানে মন থেকে দূর করা। মন থেকে তাড়াতে না পারলে মন ছোঁক ছোঁক করবে। ঠাকুর বলছেন : “মনই সব জানবে। জ্ঞানই বলো আর অজ্ঞানই বলো, সবই মনের অবস্থা। মানুষ মনেই বদ্ধ ও মনেই মুক্ত, মনেই সাধু এবং মনেই অসাধু, মনেই পাপী ও মনেই পুণ্যবান। তার মানে পথ হলো সুদৃঢ় ইচ্ছা, বাহন হলো মন।” মাঝি গোপীদের বলেছিলেন—এক মন না হলে আমি যমুনা পার করি না। গোপীরা ভাবলেন, মাঝি বুঝি ওজনের কথা বলছে। না, ওজন নয়, মাঝি বলছেন মনের কথা। এক মন, এক কৃষ্ণ। মনে কৃষ্ণ ভিন্ন আর কেউ ঢুকে থাকলে কৃষ্ণ পাওয়া যায় না। এক কৃষ্ণ, এক রাধা। মনকে রাধা করতে না পারলে, কৃষ্ণ-সাধা হবে না। ভড়ং হবে, ভণ্ডামি হবে আর মনে বজবজ করবে দুই ‘ক’-এর আসক্তি। পথ বড় কঠিন। উপনিষদ্ বলছেন :

“ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া
দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি।।”

—যাঁরা জানেন, যাঁরা বিবেকবান তাঁরা বলেন, ক্ষুরের তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ যেমন দুরতিক্রমণীয়, আত্মজ্ঞান লাভের পথও সেইরকম দুর্গম। তাহলে কি হবে? উপনিষদ্ বলছেন :

“উত্তিষ্ঠত জাগ্ৰত প্ৰাপ্য বরান্ নিবোধত।”

–তোমরা ওঠো। আত্মজ্ঞানের সন্ধান কর। সন্ধান পাবে কোথায়? শ্রেষ্ঠ আচার্যের সঙ্গ কর। তিনি তোমাকে আত্মজ্ঞানের সন্ধান দেবেন। তিনি বলবেন, বাসনার লেশমাত্র থাকতে ভগবান লাভ হয় না। যেমন সুতোতে একটু ফেঁসো বেরিয়ে থাকলে ছুঁচের ভিতর যায় না। মন যখন বাসনা-রহিত হয়ে শুদ্ধ হয়, তখনই সচ্চিদানন্দ লাভ হয়।

এই বাসনাহীন মন কেমন? ঠাকুর বলছেন : “যেন শুকনো দেশলাই— একবার ঘসলে দপ করে জ্বলে ওঠে। আর ভিজে হলে ঘসতে ঘসতে কাঠি ভেঙে গেলেও জ্বলে না। সেই মতো সরল, সত্যনিষ্ঠ, নির্মল-স্বভাব লোককে একবার উপদেশ দিলেই ঈশ্বরানুরাগের উদয় হয়। বিষয়াসক্ত ব্যক্তিকে শত শতবার উপদেশ করলেও কিছু হয় না। “

পথের নির্দেশ তাহলে পাওয়া গেল ঠাকুরের কথায়—প্রথম সাধুসঙ্গ। সদ্গুরু চাই জীবনে। গুরুকে চাইবার আগে নিজের মানসিক প্রস্তুতি চাই। যেমন, আমরা স্নান করি দেহশুদ্ধির জন্যে, সেইরকম মানস-শুদ্ধির জন্যে প্রয়োজন সঙ্কল্প-স্নানের। সেই স্নানে মন হবে সরল, হবে সত্য-নিষ্ঠ, হবে নির্মল। এই তিন গুণ নিয়ে যেতে হবে গুরুর কাছে। কারণ এমন আকাঙ্ক্ষীকেই একবার উপদেশ দিলেই ঈশ্বরানুরাগের উদয় হয়। অনুরাগের উদয় হলো, তবু বাকি রয়ে গেল অনেক পথ। অনুরাগ মানে রুচি। নামে রুচি। অন্য কথা, বিষয়কথা ভাল লাগছে না। কেবলই মনে হচ্ছে, মনে বনে কোণে নির্জনে কিছু ভাবি। সংসারের সব কাজই করছি বড় লোকের দাসীর মতো। আমার আমার করছি বটে; কিন্তু বেশ একটা বোধ ক্রমেই জন্মাচ্ছে, এর কিছুই আমার নয়। অনুরাগ থেকে আসবে বিরাগ—বৈরাগ্য। বড়লোকের দাসীর মন পড়ে থাকে নিজের বাড়ির দিকে। সেই নিজের বাড়ি হলো, নিজের ভিতর। আলোকিত, মোহমুক্ত, নির্ভার এক অবস্থা। বাইরে থেকে ভিতরে আসতে হলে চাই অনাসক্তি। তুলসীদাসজীর কথা : “সব ছোড়য়ে সব পাওয়ে।” বৈরাগ্য থেকে আসবে অভাববোধ। তৃপ্তি নেই কোন কিছুতেই। শঙ্কর যেমন বলেছেন : “ন যোগে, ন ভোগে, ন বাজিমেধে।” ভোগ, যোগ, বিষয়কর্ম, কোন কিছুই আর ভাল লাগছে না। ভীষণ এক শূন্যতা। এই অবস্থা হলো বিরহের অবস্থা। সর্ব শরীর জ্বলে যাচ্ছে। শ্রীমতীর অবস্থা। কৃষ্ণ-বিরহে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। শীতল শিলায় শয়ন করলে পাথর পুড়ে যাচ্ছে। মহাপ্রভুর অবস্থা। ঠাকুর বলছেন—পাওয়া যায় তাঁকে; কিন্তু সেই আকুতি চাই—কি রকম? গুরু শিষ্যকে জলে চুবিয়ে ধরলেন। কিছুক্ষণ রেখেই ছেড়ে দিলেন। শিষ্য বাতাসের আশায় ছটফটিয়ে মাথা জলের ওপর তুললো। গুরু বললেনঃ “কি বুঝলে? যা বুঝলে সেই বোঝা লাগাও ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্যে। ঠিক ওই রকমটি হলে তবেই তাঁকে পাওয়া যায়।”

এইবার আমার প্রশ্ন আমার কাছে—পারবে ওই ছটফটানি আনতে? অ্যামেচার সাধক, সারা জীবন ‘সেয়ান পাগল কুঁচকি বগল’ হয়েই কাটবে নাকি? কৃপা করুন, কৃপাময়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *