1 of 3

চাকা

চাকা

একটা চাকা। মাঝখানে একটা গোলাকার বেড়। সেখান থেকে চারপাশে ছড়িয়ে গেছে তিরিশটা স্পোক বা দণ্ড। কেন্দ্রের ঐ শূন্য গোলাকার অংশটাই কিন্তু সব। কিছুই নেই অথচ চাকার সমস্ত আকার, উৎস, শক্তির নির্ভরস্থল। ওটা না থাকলে চাকাটাই নেই। এইবার আসি মাটিতে। মাটি থেকে কুম্ভকার তৈরি করলেন বিশাল এক জালা। ভিতরটা শূন্য। কিছুই নেই। অথচ ঐ শূন্য স্থানটুকুই জালার সব—জালার প্রয়োজনীয় অংশ। ঐ শূন্যতাটুকুর জন্যেই জালার নির্মাণ। এখন একটা ঘর। তার একটা দরজা ও দুটো জানালা। শূন্যস্থান। অথচ ভয়ঙ্কর প্রয়োজনীয়। দরজা না থাকলে ঘরে ঢোকাও যাবে না, বেরনোও যাবে না। জানালা না থাকলে বাতাস আসবে না। ঘর হয়ে যাবে কফিন। লাও-ৎসির কথায়-

“Therefore profit comes from what is there;
Usefulness from what is not there.”

যা নেই সেইটাই সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। আমার লিভার আছে, পিলে আছে, ফুসফুস আছে, আছে হৃদয়। এদের দ্বারা আমি লাভবান। খাই-দাই, হজম করি, শ্বাস-প্রশ্বাস চলে অবিরত। আমি বাঁচি। কিন্তু আমার ভিতরে যে-শূন্যতা, সেই শূন্যতাই আমার প্রয়োজনীয় অংশ। সেখানেই বসে আছেন আমার ঠাকুর। সেখানেই ওঠে চিন্তার তরঙ্গ। এটাই আমার ধর্ম। আমার নিরাকার ঈশ্বর।

ঠাকুর বললেন : “আমি ঘট।” বাইরে পাতলা আস্তরণটি হলো মায়িক অহঙ্কার। তার একটা নাম আছে। নামরূপ। সামাজিক পরিচয় আছে। অমুকের বাবা, অমুকের ছেলে। অবস্থা-ভেদ আছে। বড় লোক, গরিব লোক। উপাধি আছে। ‘আমি ঘট’-এর এই হলো মৃত্তিকা-আবরণ। ‘আমি’র ভঙ্গুর আবরণ ভেঙে দাও। কি রইল? এই প্রশ্নই ঐ শূন্যতা। ঠাকুরই এই প্রশ্নের উত্তর দেবেন—অনন্ত এই প্রশ্নের। ঠাকুর নিজেই একদিন এই প্রশ্ন করেছিলেন। শ্রীম লিখছেন : “হঠাৎ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আপনাকে দেখাইয়া নিজের বুকে হাত দিয়া মণিকে বলিতেছেন, ‘আচ্ছা এতে কিছু আছে, তুমি কি বল?’ তিনি অবাক হইয়া ঠাকুরকে দেখিতেছেন। বুঝি ভাবিতেছেন, ঠাকুরের হৃদয়মধ্যে কি সাক্ষাৎ মা আছেন!” নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিচ্ছেন বড় করে, ব্যাপক করে, সর্বজীবোপযোগী করে—”যেমন অনন্ত জলরাশি, ওপরে নিচে, সম্মুখে, পিছনে, ডাইনে বামে জল পরিপূর্ণ! সেই জলের মধ্যে একটি জলপূর্ণ কুম্ভ আছে। ভিতরে বাহিরে জল; কিন্তু তবুও কুম্ভটি আছে। ‘আমি’রূপ কুম্ভ।” তারপর! “ব্রহ্ম যেন সমুদ্র—জলে জল। কুম্ভের ভিতরে বাহিরে জল। জলে জল। তবু কুম্ভ তো আছে। ঐটি ভক্তের ‘আমি’র স্বরূপ। যতক্ষণ কুম্ভ আছে, আমি তুমি আছে; তুমি ঠাকুর, আমি ভক্ত, তুমি প্রভু, আমি দাস; এও আছে।’

ঠাকুর অহঙ্কারী ‘আমি’-টাকে সরিয়ে নিয়ে ‘ভক্ত আমি’, ‘দাস আমি’কে বসালেন। তবেই না বোঝা যাবে, শূন্যতা শূন্যতা নয়। দেহ-যন্ত্রের ঊর্ধ্বে সেইটাই সব। এইবার ঠাকুর ঘটটিকে ভেঙে দিলেন। প্রথমে জাগালেন বোধ। আমি-তুমির বোধ। লীলা আস্বাদন। “সচ্চিদানন্দ সাগর। তার ভিতরে ‘আমি’ ঘট। যতক্ষণ ঘট ততক্ষণ যেন দুভাগ জল—ঘটের ভিতরে এক ভাগ, বাহিরে এক ভাগ। ঘট ভেঙে গেলে—এক জল—তাও বলবার জো নাই! কে বলবে?”

কেন এই প্রশ্ন? কারণ, ঠাকুর বলছেন, ‘আমি’ গেলে জীবের রইলটা কি? স্মৃতি-শ্রুতি-বোধ সবই তো চলে গেল। ঐ অনুভূতিটুকু নেবে কে! সমাধিস্থ হলে ‘আমি’ মুছে যায়। সাধারণ মানুষ সমাধি থেকে ফিরে আসতে পারে না। নেমে আসতে পারেন একমাত্র অবতার পুরুষ। ঠাকুরের সেই গল্প—খাড়া একটা পাঁচিল, ওপাশে কি আছে, সকলেরই ভীষণ কৌতূহল। পাঁচিল বেয়ে এক- একজন উঠছে আর হাহা করে হাসতে হাসতে ওপাশে লাফিয়ে পড়ছে। কেউই ফিরে এসে বলছে না, সে কি দেখেছে।

সংসার-প্রান্তরে আমাদের জীবনের চাকা গড়িয়ে চলুক। কেন্দ্ৰগত শূন্যস্থানটিই যে চাকার নির্ভরতা সেই বোধটুকু যেন থাকে! সেইটাই হলো বিশ্বাস, যা চোখে দেখা যায় না। আত্মগত এক অনুভূতি। এই যে গাড়ির টায়ার, ভিতরের বাতাসটুকুই তার শক্তি। ভালভ খুলে দিলেই তা ফুস করে বেরিয়ে যাবে। মিশে যাবে প্রকৃতিতে। টায়ার হয়ে যাবে ফ্ল্যাট। নেতিয়ে পড়বে। বিশ্বাস হলো জীবন-টায়ারের বাতাস। শক্তি। চালিকা শক্তি। মানুষকে ধরে রেখেছে। কিছুই নয়। কোন দামও নেই, অথচ সবকিছু। জীবনের চাকায় কর্মের স্পোক, কেন্দ্রে বৃত্তাকার শূন্যতা। সেইটাই হলো বিশ্বাসের পীঠস্থান। ভগবৎ বিশ্বাস। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণে বিশ্বাস। নিরাকার উপস্থিতি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *