1 of 3

মূর্ত মহেশ্বর

মূর্ত মহেশ্বর

“হে প্রভু, আমার ভ্রাতৃগণের ভয়ঙ্কর যাতনা আমি দেখেছি, যন্ত্রণামুক্তির পথ আমি খুঁজেছি এবং পেয়েছি—প্রতিকারের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক, প্রভু!” স্বামীজী বস্টন থেকে মে ১৮৯৪ খ্রীস্টাব্দে অধ্যাপক জে. এইচ. রাইটকে কথাগুলি লিখেছিলেন। স্বামীজী বলছেন : “আমি দেখেছি।” এই দেখার ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে স্বামীজীর জীবনদর্শন, ধর্ম ও কর্মকাণ্ড। তিনি ছিলেন এক অর্থে সমাজবিজ্ঞানী। গোটা ভারতটা ঘুরে দেখে নিলেন সবার আগে। এই আমার কর্মভূমি। কার বিরুদ্ধে সংগ্রাম! সংগ্রাম নিরক্ষরতা, কুসংস্কার, দারিদ্র্য, বর্ণবৈষম্য, নারীশক্তির অবমাননার বিরুদ্ধে। সংগ্রাম ভারতবাসীর উদাসীনতার বিরুদ্ধে। যাদের আছে, যারা কিছু করতে পারে অথচ করে না, তাদের নিরেট স্বার্থপরতার বিরুদ্ধে।

খেতড়ির পণ্ডিত শঙ্করলালকে পরিব্রাজক স্বামীজী বোম্বাই থেকে ২০ সেপ্টেম্বর ১৮৯২ তারিখে লিখছেন : “আমাদিগকে ভ্রমণ করিতেই হইবে, আমাদিগকে বিদেশে যাইতেই হইবে। আমাদিগকে দেখিতেই হইবে, অন্যান্য দেশে সমাজ-যন্ত্র কিরূপে পরিচালিত হইতেছে। আর যদি আমাদিগকে যথার্থই পুনরায় একটি জাতিরূপে গঠিত হইতে হয়, তবে অপর জাতির চিন্তার সহিত আমাদের অবাধ সংস্রব রাখিতে হইবে। সর্বোপরি আমাদিগকে দরিদ্রের উপর অত্যাচার বন্ধ করিতে হইবে।”

স্বামীজীর কী ভয়ঙ্কর দর্শন-ক্ষমতা, অবজারভেশন, কস্টিক রিমার্ক! একজন ভাঙ্গির জীবন সম্পর্কে ঐ-চিঠিতে স্বামীজী লিখছেন, সমাজের হিংস্রতম অশ্রদ্ধার বোঝা বইছে। সর্বত্রই চিৎকার—’তফাত যাও’! যেন সংক্রামক ব্যাধি। ‘ছুঁস না, ছুঁস না!’ এইবার যদি কোন পাদ্রী সাহেব তার মাথায় জল ছিটিয়ে মন্ত্র পড়ে খ্রীস্টান করে দেয়, সঙ্গে সঙ্গে সে জাতে উঠে গেল। গোঁড়া বর্ণহিন্দুরাও তাকে আদর করে বসার চেয়ার এগিয়ে দেবে। করবে সপ্রেম করমর্দন।

এই হলো তখনকার ভারত! এই হলো তখনকার উচ্চবর্ণের মানসিকতা! দক্ষিণ ভারতে আরেক খেলা। সেখানে স্বামীজী দেখলেন, লক্ষ লক্ষ ব্রাত্য মানুষকে খ্রীস্টান করা হচ্ছে। উচ্চবর্ণের অনাদরই এর জন্য দায়ী। গভীর বেদনা ও ক্ষোভের সঙ্গে স্বামীজী পণ্ডিত শঙ্করলালকে লিখলেন : “পৌরোহিত্যের অত্যাচার ভারতের সর্বাপেক্ষা যেখানে বেশি, সেই ত্রিবাঙ্কুরে, যেখানে ব্রাহ্মণগণ সমুদয় ভূমির স্বামী, এবং স্ত্রীলোকেরা—এমনকি রাজবংশীয় মহিলাগণ পর্যন্ত— ব্রাহ্মণগণের উপপত্নীরূপে বাস করা খুব সম্মানের বিষয় জ্ঞান করিয়া থাকে, তথাকার সিকিভাগ খ্রীস্টান হইয়া গিয়াছে।”

এই ভারতচিত্রে ক্ষুব্ধ স্বামীজী হিন্দুধর্মের মর্মোদ্ধারে আগ্রহী। ধর্মের গভীরে কি কোন সত্যই নেই? স্বামীজী বললেন, হিন্দুধর্মের মতো কোন ধর্মই এত উচ্চতানে মানবাত্মার মহিমা প্রচার করে না, অথচ আচরণে সেই ধর্ম কি পৈশাচিক! গরিব আর পতিতের গলায় পা তুলে দেয়। জগতের আর কোন ধর্ম তো এমন করে না। তাহলে হিন্দুধর্মের গর্বের আর রইল কি। না, এতে ধর্মের কোন দোষ নেই। ধর্ম ঠিকই আছে, আকাশের মতো উদার। আমেরিকা থেকে ২০ আগস্ট ১৮৯৩ তারিখে আলাসিঙ্গাকে স্বামীজী লিখছেন : “তবে হিন্দুধর্মের অন্তর্গত আত্মাভিমানী কতকগুলি ভণ্ড ‘পারমার্থিক’ ও ‘ব্যবহারিক’ নামক মত দ্বারা সর্বপ্রকার অত্যাচারের আসুরিক যন্ত্র ক্রমাগত আবিষ্কার করিতেছে।”

স্বামীজীর সংগ্রাম ছিল একক সংগ্রাম। একাই লড়াই করে গেছেন যত বিরূপ শক্তির সঙ্গে। বিশ্বগোলকটিকে দুহাতে ধরে এমন নাড়া দিয়ে গেছেন, যে-আন্দোলন আজও স্থির হয়নি। অন্ধকারের শক্তি, বিষাক্ত শৈবাল কিছু ঝরে গেলেও, ক্লেদ এখনো আছে। ধর্ম সমদর্শী হলেও ধর্মের ধারকরা কেউই আদর্শ নয়। স্বামীজীকেও যারা জোচ্চোর, বদমাইস বলেছে, উপহাস করেছে, ঘৃণা করেছে তাদের সম্পর্কে স্বামীজীর একটিই কথা : “আমি এসমস্তই সহ্য করিয়াছি তাহাদেরই জন্য, যাহারা আমাকে উপহাস ও ঘৃণা করিয়াছে।”[১] বলছেন, ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন। তোমাদের আঘাত যত প্রবল হবে, আমার শক্তি তত দুর্বার হবে। এই মানুষই একদা পরিত্রাতা যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করেছিল। দিস ইজ দ্য ফেট অফ ম্যানকাইন্ড। বৎস! এ-জগৎ দুঃখের আগার। অবশ্যই। কিন্তু এ যে আবার মহাপুরুষগণের শিক্ষালয়স্বরূপ। মানুষের আঘাতেই কোন কোন মানুষের শক্তির উৎস-মুখ বিদীর্ণ হয়। অর্জুন ভূমিতে একটি তীর নিক্ষেপ করলেন অমনি শতধারায় জল উৎক্ষিপ্ত হয়ে পিতামহ ভীষ্মের তৃষ্ণা তৃপ্ত করল। তোমরা পেটাও আমি তরোয়াল হই। তোমরা বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে যাও, আমার স্টীল টেম্পার্ড হোক। যারা আমাকে ভণ্ড বলছে, তাদের জন্যে আমার দুঃখ হয়। তাদের কোন দোষ নেই। তারা শিশু, অতি শিশু, যদিও সমাজে তারা মহা গণ্যমান্যের আসনে প্রতিষ্ঠিত। নিজেদের ক্ষুদ্র দৃষ্টিসীমার বাইরে তারা আর কিছু দেখতে পায় না। তাদের নিয়মিত কাজ হলো আহার, পান, অর্থোপার্জন আর বংশবৃদ্ধি। অঙ্কের নিয়মে পরপর করে চলেছে। এর অতিরিক্ত তাদের মাথায় আসে না। তারা যথেষ্ট সুখী। তাদের ঘুমের ব্যাঘাত কিছুতেই হয় না। স্বামীজী যেন তাঁর রক্ত দিয়ে লিখলেন কথাগুলি : “শত শত শতাব্দীর পাশব অত্যাচারের ফলে সমুখিত শোক, তাপ, দৈন্য ও পাপের যে কাতরধ্বনিতে ভারতাকাশ সমাকুল হইয়াছে, তাহাতেও তাহাদের জীবন সম্বন্ধে দিবাস্বপ্নের ব্যাঘাত হয় না। সেই শত শত যুগব্যাপী মানসিক, নৈতিক ও দৈহিক অত্যাচারের কথা যাহাতে ভগবানের প্রতিমাস্বরূপ মানুষকে ভারবাহী গর্দভে এবং ভগবতীর প্রতিমারূপা নারীকে সন্তান ধারণ করিবার দাসীস্বরূপা করিয়া ফেলিয়াছে এবং জীবন বিষময় করিয়া তুলিয়াছে, একথা তাহাদের স্বপ্নেও মনে উদিত হয় না!” আমার ভারত এই ভোগী, স্বার্থপর, পরদ্বেষী, আত্মপর, পরনিন্দুক ব্যবহারিকদের নিয়ে নয়। আছে, মানুষ আছে। তাঁরা প্রাণে প্রাণে বুঝছেন, হৃদয়ের রক্তময় অশ্রুবিসর্জন করছেন। তাঁরা মনে করেন, এর প্রতিকার আছে। শুধু প্রতিকার আছে নয়, প্রাণ পর্যন্ত পণ করে এর প্রতিকারে প্রস্তুত আছেন। স্বামীজী বললেন : “ইহাদিগকে লইয়াই স্বর্গরাজ্য বিরচিত। ইহা কি স্বাভাবিক নহে যে, উচ্চস্তরে অবস্থিত এইসকল মহাপুরুষের—ঐ বিষোদ্গিরণকারী ঘৃণ্য কীটগণের প্রলাপবাক্য শুনিবার মোটেই অবকাশ নাই?”

[১. দ্রঃ আলাসিঙ্গাকে লেখা পূর্বোক্ত পত্র]

স্বামীজীর কোনকালেই এদের ওপর ভরসা ছিল না। ঐ যারা গণ্যমান্য, উচ্চপদস্থ অথবা ধনী, জীবনীশক্তিহীন একদল স্বার্থপর—তারা মৃতকল্প। নিজেদের জগতে তারা ভোগের বেহালা বাজাচ্ছে। ভরসা তাহলে কাদের ওপর? দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আলাসিঙ্গাকে তিনি লিখলেন : “ভরসা তোমাদের উপর—পদমর্যাদাহীন, দরিদ্র, কিন্তু বিশ্বাসী—তোমাদের উপর।” ওদের ভারত নয়, তোমাদের ভারত। সংগ্রামের একটিই হাতিয়ার। বিশ্বাস! বললেন : “ভগবানে বিশ্বাস রাখ। কোন চালাকির প্রয়োজন নাই; চালাকির দ্বারা কিছুই হয় না।”

অনুভব কর। “দুঃখীদের ব্যথা অনুভব কর।” আর সাহায্য চাও ভগবানের কাছে। সাহায্য আসবেই আসবে! বারোটা বছর আমি এই ভার নিয়ে, ধনীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। বেরিয়ে এস ভোগের লেপের তলা থেকে। ভারত গড়। তারা আমাকে জোচ্চোর ভেবেছে। এই গরিব, অজ্ঞ, অত্যাচার-পীড়িত ভারতের দায় আমি তোমাদের সমর্পণ করছি। জাগো, যুবশক্তি জাগো। অপূর্ব ভাষায় স্বামীজী বলছেন : “যাও, এই মুহূর্তে সেই পার্থসারথির মন্দিরে যিনি গোকুলের দীনদরিদ্র গোপগণের সখা ছিলেন, যিনি গুহক চণ্ডালকে আলিঙ্গন করিতে সঙ্কুচিত হন নাই, যিনি তাঁহার বুদ্ধ-অবতারে রাজপুরুষগণের আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করিয়া এক বেশ্যার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়া তাহাকে উদ্ধার করিয়াছিলেন; যাও, তাঁহার নিকট গিয়া সাষ্টাঙ্গে পড়িয়া যাও, এবং তাঁহার নিকট এক মহাবলি প্রদান কর; বলি—জীবনবলি তাহাদের জন্য, যাহাদের জন্য তিনি যুগে যুগে অবতীর্ণ হইয়া থাকেন, যাহাদের তিনি সর্বাপেক্ষা ভালবাসেন, সেই দীনদরিদ্র পতিত উৎপীড়িতদের জন্য। তোমরা সারা জীবন এই ত্রিশকোটি ভারতবাসীর উদ্ধারের জন্য ব্রত গ্রহণ কর, যাহারা দিন দিন ডুবিতেছে।”

অধ্যাপক রাইটকে ৪ সেপ্টেম্বর ১৮৯৩ সালেম থেকে স্বামীজী লিখছেন :

পাহাড়ে, পর্বতে উপত্যকায়,
গির্জায়, মন্দিরে, মসজিদে-
বেদ বাইবেল আর কোরানে
তোমাকে খুঁজেছি আমি ব্যর্থ ক্রন্দনে।
মহারণ্যে পথভ্রান্ত বালকের মতো
কেঁদে কেঁদে ফিরেছি নিঃসঙ্গ,
তুমি কোথায়—কোথায়
আমার প্রাণ, ওগো ভগবান?
নাই, প্রতিধ্বনি শুধু বলে, নাই।
দিন, রাত্রি, মাস, বর্ষ কেটে যায়,
আগুন জ্বলতে থাকে শিরে,
কিভাবে দিন রাত্রি হয় জানি না,
হৃদয় ভেঙে যায় দুভাগ হয়ে।
গঙ্গার তীরে লুটিয়ে পড়ি বেদনায়,
রোদে পুড়ি, বৃষ্টিতে ভিজি,
ধূলিকে সিক্ত করে তপ্ত অশ্রু,
হাহাকার মিশে যায় জনকলরবে;
সকল দেশের সকল মতের মহাজনদের
নাম নিয়ে ডেকে উঠি অধীর হয়ে,
বলি, আমাকে পথ দেখাও, দয়া কর,
ওগো, তোমরা যারা পৌঁছেছ পথের প্রান্তে।

এই মহা অন্বেষণের উত্তর ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ দিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিনের ঘটনা। ঠাকুর বসে আছেন ভক্তসঙ্গে। আছেন নরেন্দ্রনাথ। ঠাকুর বলছেন, ভক্ত ও ভগবান, কৃষ্ণ ও বৈষ্ণব অভেদ জ্ঞান করে সর্বদা সাধু-ভক্তদের শ্রদ্ধা, পূজা আর বন্দনা করবে, আর কৃষ্ণেরই জগৎ-সংসার একথা হৃদয়ে ধারণ করে সর্বজীবে দয়া করবে। ‘সর্বজীবে দয়া’ পর্যন্ত বলে ঠাকুর সমাধিস্থ। কিছুক্ষণ পরে অর্ধবাহ্যদশায় বললেন : “জীবে দয়া—জীবে দয়া? দূর শালা; কীটানুকীট তুই জীবকে দয়া করবি? দয়া করবার তুই কে? না, না, জীবে দয়া নয়— শিবজ্ঞানে জীবের সেবা!”

ঠাকুরের ভাবভঙ্গের পর নরেন্দ্রনাথ ঘরের বাইরে এসে বললেন, কি অদ্ভুত আলোকই আজ ঠাকুরের কথায় দেখতে পেলুম! শুষ্ক, কঠোর, নির্মম বেদান্তজ্ঞানকে ভক্তির সঙ্গে মিলিয়ে কি সহজ, সরল ও মধুর আলোকই প্রদর্শন করলেন! সর্বভূতে যতদিন না ঈশ্বরকে দেখতে পাওয়া যায়, ততদিন যথার্থ ভক্তি বা পরাভক্তি লাভ সাধকের পক্ষে সুদূরপরাহত। ভগবান যদি কখনো দিন দেন তো আজ যা শুনলুম এই অদ্ভুত সত্য সংসারে সর্বত্র প্রচার করব—পণ্ডিত, মূর্খ, ধনী-দরিদ্র, ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল—সকলকে শুনিয়ে মোহিত করব।

পর্যটক স্বামী বিবেকানন্দ যত দেখছেন ততই জ্বলে উঠছেন, যেন এক অগ্নিগোলক। আমেরিকার পথে জাপানের ইয়োকোহামা থেকে ১০ জুলাই ১৮৯৩ লিখছেন নিজের শিক্ষিত দেশবাসীকে তিরস্কার করে : “তোমরা কি করছ? সারাজীবন কেবল বাজে বকছ। এস, এদের দেখে যাও, তারপর যাও— গিয়ে লজ্জায় মুখ লুকোও গে। ভারতের যেন জরাজীর্ণ অবস্থা হয়ে ভীমরতি ধরেছে! তোমরা—দেশ ছেড়ে বাইরে গেলে তোমাদের জাত যায়!! এই হাজার বছরের ক্রমবর্ধমান জমাট কুসংস্কারের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে বসে আছ? হাজার বছর ধরে খাদ্যখাদ্যের শুদ্ধাশুদ্ধতা বিচার করে শক্তিক্ষয় করছ। পৌরোহিত্যরূপ আহাম্মকির গভীর ঘূর্ণিতে ঘুরপাক খাচ্ছ! শত শত যুগের অবিরাম সামাজিক অত্যাচারে তোমাদের সব মনুষ্যত্বটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে!… তোমরা বই হাতে করে সমুদ্রের ধারে পায়চারি করছ! ইউরোপীয় মস্তিষ্কপ্রসূত কোন তত্ত্বের এক কণামাত্র—তাও খাঁটি জিনিস নয়—সেই চিন্তার বদহজম খানিকটা ক্রমাগত আওড়াচ্ছ, আর তোমাদের প্রাণমন সেই ৩০ টাকার কেরানিগিরির দিকে পড়ে রয়েছে; নাহয় খুব জোর একটা দুষ্ট উকিল হবার মতলব করছ। এই হলো ভারতীয় যুবকগণের সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষা। প্রত্যেকের আশেপাশে একপাল ছেলে—তাঁর বংশধরগণ—’বাবা খাবার দাও, খাবার দাও’ বলে মহা চিৎকার তুলেছে!! বলি, সমুদ্রে কি জলের অভাব হয়েছে যে, তোমাদের বই, গাউন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমা প্রভৃতি সমেত তোমাদের ডুবিয়ে ফেলতে পারে না?”

স্বামীজীর উদাত্ত আহ্বান—”এস, মানুষ হও। প্রথমে দুষ্ট পুরুতগুলোকে দূর করে দাও। কারণ এই মস্তিষ্কহীন লোকগুলো কখনো শুধরোবে না। তাদের হৃদয়ের কখনো প্রসার হবে না।” বলছেন, নিজেদের সঙ্কীর্ণ গর্ত থেকে বেরিয়ে এস। পৃথিবীর দিকে তাকাও—সি দ্য প্রগেস। দেশকে যদি ভালবাস তাহলে উন্নত হবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা কর। বলছেন : “পেছনে চেও না, অতি প্রিয় আত্মীয়স্বজন কাঁদুক; পেছনে চেও না, সামনে এগিয়ে যাও। ভারতমাতা অন্ততঃ সহস্র যুবক বলি চান। মনে রেখো-মানুষ চাই, পশু নয়। রাখো তোমাদের ঘণ্টা নাড়া। রাখো তোমাদের সেই ছেঁড়াছেঁড়ি তর্ক, শ্রীরামকৃষ্ণ মানব না অবতার! আমার প্রভু গুরু হতে চাননি, তাঁর গেরুয়ার বাণী—সেবা। তাঁর শেষ কথা— ‘তোমাদের চৈতন্য হোক।’ মহা হুঙ্কারে ভারত গঠনের কাজ আরম্ভ করে দাও। ভয় কি? কার সাধ্য বাধা দেয়।”

স্বামীজী লিখছেন গুরুভাইদের (নিউ ইয়র্ক ২৫ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪) :

“কুর্মস্তারকচর্বণং ত্রিভুবনমুৎপাটয়ামো বলাৎ।
কিং ভো ন বিজানাস্যস্নান—রামকৃষ্ণদাসা বয়ম্।”

“ডর? কার ডর? কাদের ডর?

“আমরা তারকা চর্বণ করব, ত্রিভুবন সবলে উৎপাটন করব, আমরা কে জান না? আমরা রামকৃষ্ণ-দাস!”

দেহকে যারা আত্মা বলে জানে তারা ক্ষীণ, দীন, তারাই নাস্তিক। আমরা যখন অভয়পদে আশ্রিত, তখন আমরা ভয়শূন্য বীর। এইটাই আস্তিক্য। “রামকৃষ্ণদাসা বয়ম্!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *