1 of 3

দু-ফোঁটা চোখের জল

দু-ফোঁটা চোখের জল

ঠাকুরকে আমি চোখের সামনে দেখতে পাই। তাঁর চলা, বসা, কথাবলা। শুনতে পাই তাঁর কণ্ঠস্বর। স্পষ্ট, কাটা কাটা, তীক্ষ্ণ আবার স্নেহমাখা। কখনো আবিষ্ট, কখনো স্পষ্ট। দেখতে পাই, তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন অপলকে। মানুষের কর্মটাই আমরা দেখতে পাই, তার চিন্তা-ভাবনা আমাদের নজরে পড়ে না। অবতার পুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ আমার চিন্তা, আমার ভাবনার নড়াচড়া দেখতে পান। আমি যখন টলে যাই, তখন তিনি আমার হাত ধরে বলেন :

“কালীর চরণ করেছে যে স্থূল
সহজে হয়েছে বিষয়েতে ভুল
ভবার্ণবে পাবে সে কূল
মূল হারাবে সে কেমনে!”

মন বহুরূপী ক্ষণে ক্ষণে রঙ পালটাতে পারে; কিন্তু আমার যে নির্দেশ ছিল সাত্ত্বিক রঙে চুবিয়ে নাও মনকে। সেখানে রজোগুণের ছটফটানি কেন? কেন তামসিকতার কালো মেঘ ছেয়ে আসে? সতের অহঙ্কার দিয়ে দূর কর তাকে। বিচারের ফুঁ মেরে উড়িয়ে দাও। জ্ঞানের আগুন জ্বালো। বিষয় থেকে অবিষয়ে চলে যাও। বল, ‘ভবে সেই সে পরমানন্দ যে-জন পরমানন্দময়ীরে জানে।’ তুমি ধরতে দিলেই, তোমার হাত আমি ধরব। আমি যে ধরে আছি, সেই বিশ্বাসটা কিন্তু তোমার থাকা চাই!

আমি তোমার কাছে একটা জিনিসই চাইব, সেটা হলো বিশ্বাস, জ্বলন্ত বিশ্বাস। তার মানে সমৰ্পণ। মনে আছে, আমি তোমাকে বলেছিলুম, ছেলে যদি বাপকে ধরে আলের ওপর দিয়ে চলে, তাহলে বরং খানায় পড়তে পারে। কিন্তু বাপ যদি ছেলের হাত ধরে, সে ছেলে কখনো পড়ে না।

এখন বল, আমি যে তোমার হাত ধরব, তার জন্যে তুমি কি করেছ? তুমি আমার দিকে কতটা এগিয়েছ? আমি বলেছিলাম, তুমি যদি তাঁর দিকে এক পা এগোও, তিনি তোমার দিকে এগিয়ে আসবেন একশো পা। শোন, আমি মায়ের কাছে শুদ্ধাভক্তি চেয়েছিলাম। মাকে বলেছিলাম—এই লও তোমার ধর্ম, এই লও তোমার অধর্ম, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও। এই লও তোমার শুচি, এই লও তোমার অশুচি, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও। মা, এই লও তোমার পাপ, এই লও তোমার পুণ্য, আমায় শুদ্ধভক্তি দাও।

এখন বল, তুমি কি আমার তেমন ভক্ত হতে পেরেছ? স্মরণ-মনন সকালের দাঁত মাজা নয়। মননহীন ঘণ্টা নাড়া নয়। ব্লটিং পেপার যেভাবে জল শুষে নেয়, সেইভাবে তোমার মন কি ভক্তি শুষে নিতে পেরেছে? নিত্য আর অনিত্যের বোধ কি তোমার হয়েছে? তোমার কি একবারও মনে হয়েছে, সেই দিনই দুর্দিন, যেদিন হরিকথা হলো না? তোমার চরিত্র কি সেইরকম দৃঢ় হয়েছে যে, কোন প্রলোভনই তোমাকে বিচলিত করতে পারবে না! নিষ্ঠা বলতে আমি কি বোঝাতে চেয়েছিলুম, আশা করি, স্মরণে আছে—সব মতকে নমস্কার করবে, তবে একটি আছে নিষ্ঠাভক্তি। সবাইকে প্রণাম করবে বটে, কিন্তু একটির উপরে প্রাণ-ঢালা ভালবাসার নাম নিষ্ঠা। রামরূপ বই আর কোন রূপ হনুমানের ভাল লাগত না। গোপীদের এত নিষ্ঠা যে, তারা দ্বারকার পাগড়িবাঁধা শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে চাইল না।

ঠাকুর, ভয় হয়, সেই নিষ্ঠা কি আমার হয়েছে! ধর্মের অ্যাডভেঞ্চার করছি না তো! সেই অশিক্ষিত মানুষটির মতো আমার ভিতরে কি ভক্তিরস দানা বেঁধেছে, যে একখানি গীতা হাতে নিয়ে অঝোরে কাঁদছে? কৌতূহলীর প্রশ্ন, ‘তুই গীতার কিছু বুঝিস? কি লেখা আছে পড়তে পারিস?’ ‘না, পারি না; কিন্তু আমি জানি, এতে আমার প্রভুর কথা লেখা আছে।’ ঠাকুরের মতো ঠাকুরকেই কি বলতে পারব—’বেদান্ত জানি না ঠাকুর! জানতে চাই না। ওসব জ্ঞানীরা জানুন। আপনাকে পেলে বেদ-বেদান্ত কত নিচে পড়ে থাকে! আমি কোনদিন আপনার মতো বলতে পারব কি—”কৃষ্ণ রে! তোরে বলব, খা রে নে রে বাপ! কৃষ্ণ রে! বলব, তুই আমার জন্য দেহধারণ করে এসেছিস বাপ!” আর ঠাকুর, আমার চোখে জল আসবে, অন্তত দু-ফোঁটা। আপনি বলতেন, তাঁর কথায় যখন চোখে জল আসবে, তখন বুঝবে, তোমার ভিতরে রঙ ধরেছে। যখন দেখবে বিষয় কথা ভাল লাগছে না, তখন বুঝবে তিনি উদিত হচ্ছেন তোমার ভিতরে। তখনি একটা রোখ আসবে মনে, ঝিঁকি মারবে, দেখবে তোমার অভ্যাস, তোমার সংস্কার ঝুরঝুর করে ঝরে গেছে। তৈরি হবে নতুন সংস্কার। তোমার মুখে ঝিলিক মারবে আধ্যাত্মিক হাসি। ‘ভয় হতে তব অভয় মাঝারে’ নতুন জন্ম হবে।

ওসব কথায় কান দিও না, যারা বলে, “ধর্ম হলো অক্ষমের আফিম।” ধর্ম অবশ্যই আফিম, সে কেমন? যেমনটি বলেছেন আমার ঠাকুর। একটা পাখি, তাকে একবার সকাল আটটার সময় এক গুলি আফিম খাওয়ানো হয়েছিল। সে ঐ রোজ সকাল আটটায় যেখানেই থাকুক ঠিক উড়ে চলে আসত আফিম-এর লোভে। ধর্ম ঐ আফিম, একবার ধরলে আর ছাড়ে না। এমন নেশা! ধর্মের ব্যবসা আর ধর্মের নেশা—দুটো আলাদা জিনিস।

ঠাকুর আধার বুঝতেন। চালাকি করলেই ধরতে পারতেন। অলস মানুষকে ধমকাতেন। বলতেন : “সংসার করেছ, ছেলেপুলে হয়েছে। আগে কর্তব্য কর, ভরণপোষণের ব্যবস্থা কর, তারপর ধর্ম করবে। তোমার সংসার অন্য লোকে সামলাবে, চালাকি পেয়েছ!” পেটকাওয়াস্তে সাধুদের তিনি গ্রাহ্য করতেন না। বলতেন : “যে-সাধুর বগলে পুঁটলি দেখবে, বুঝবে তারা ঠিক ঠিক সাধু নয়। তাদের আলোচনার বিষয় হলো, কোন্ বাবু কেমন খাইয়েছে, কোথায় কত বড় ভাণ্ডারা হয়েছে!” ঠাকুর গেরুয়ার অপমান সহ্য করতে পারতেন না। তিনি বলতেন : “সন্ন্যাসী তো ঈশ্বরচিন্তা করবেই। সে আর নতুন কথা কি! কিন্তু গৃহী! আমার আসল কথা তো গৃহীকে নিয়েই।”

তাই তো একটু ভরসা পাই।

“সে কি, সংসারে থাকবে না তো কোথায় যাবে?”

“কিভাবে থাকব?”

“বিষয়ীদের পূজা, জপ, তপ, যখনকার তখন। যারা ভগবান বই জানে না তারা নিঃশ্বাসের সঙ্গে তাঁর নাম করে। কেউ মনে মনে সর্বদাই ‘রাম’ ‘ওঁ রাম’ জপ করে। জ্ঞানপথের লোকেরাও ‘সোহহম্’ জপ করে। কারো কারো সর্বদাই জিহ্বা নড়ে।”

“সর্বদাই স্মরণ-মনন থাকা উচিত।”

শ্রীরামকৃষ্ণ-স্মরণ-মনন কি আমার ঠিক হচ্ছে? যদি হয়, তাহলে আমার হবেই। ঠাকুর বলছেন : “সকলেরই মুক্তি হবে।”

মুক্তি মানে কি? তাড়াতাড়ি মৃত্যু। মুক্তিরও তো একটা ব্যাখ্যা আছে! সংসারী মানুষের মুক্তি হলো সংসার-বন্ধন থেকে মুক্তি। কামনা-বাসনা-ভয় থেকে মুক্তি। অনিশ্চয়তা থেকে অদ্ভুত এক নির্ভরতায় মুক্তি। অপূর্ণতা থেকে পূর্ণতায় মুক্তি। রোগ জানুক আর দেহ জানুক, মন তুমি আনন্দে থাক। আনন্দের জোয়ারই হলো মুক্তি।

ঠাকুর বলছেন : “মুক্তি হবে, তবে গুরুর উপদেশ অনুসারে চলতে হয়।”

আমার গুরু, ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ কি বলছেন আমাকে, “ঈশ্বরকে মাথায় রেখে কাজ করবে, নর্তকী যেমন মাথায় বাসন রেখে নাচে। আর পশ্চিমের মেয়েদের দেখ নাই? মাথায় জলের ঘড়া, হাসতে হাসতে, কথা কইতে কইতে যাচ্ছে?”

আর বলছেন : “জ্ঞানের সাধনা কর। জান কি, জ্ঞান কাকে বলে, আর আমি কে?”

“ঈশ্বরই কর্তা আর সব অকর্তা—এর নাম জ্ঞান। আমি অকর্তা। তাঁর হাতের যন্ত্র। তাই আমি বলি, মা, তুমি যন্ত্রী, আমি যন্ত্র, তুমি ঘরণী, আমি ঘর, আমি গাড়ি, তুমি ইঞ্জিনিয়ার। যেমন চালাও, তেমনি চলি, যেমন করাও, তেমনি করি, যেমন বলাও তেমনি বলি। ‘নাহং নাহং তুঁহু তুঁহু।’”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *