1 of 3

“পাশবদ্ধ জীব পাশমুক্ত শিব”

“পাশবদ্ধ জীব পাশমুক্ত শিব”

“কে জানে কালী কেমন, ষড়দর্শনে না পায় দরশন।” মা কালীর এ কেমন গঠন? গৃহকর্ত্রী প্রশ্ন করছেন গুরুঠাকুরকে। মায়ের একি রূপ! মায়ের জিভ কেন বেরিয়ে আছে সামনে? মা কেন জিভ কেটেছেন? গুরুঠাকুর ব্যাখ্যা করছেন : “দেখ মা, এ আগমবাগীশের মত। আগমবাগীশের মনে হলো কিভাবে জীবের কল্যাণ বিধান করা যায়! এইকথা চিন্তা করতে করতে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বপ্ন দেখছেন। স্বপ্নে আদেশ হলো—’কাল ভোরে উঠে প্রথমেই তুমি যে-রমণীকে দেখবে, ও যে-রূপে দেখবে, সেই রূপই কালীর রূপ, মহামায়ার রূপ।’

বহুকালের প্রচলিত এই ব্যাখ্যা গ্রাম্য লৌকিক ব্যাখ্যা। আমার মাকে বোঝা অতই সহজ! জীব যদি শিব হন, তাহলে তাঁর হৃদয়গত বন্ধনমুক্তির ঘন আকুতিই হলেন মা কালী। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন : “বন্ধন আর মুক্তি— দুয়ের কর্তাই তিনি।” তিনি ছেদন ও বন্ধন দুয়েরই কর্ত্রী। “তাঁর মায়াতে সংসারী জীব কাম-কাঞ্চনে বদ্ধ, আবার তাঁর দয়া হলেই মুক্ত। তিনি ভববন্ধনের বন্ধন-হারিণী তারিণী।“

শ্রীম সাক্ষী। ঠাকুর কেশবচন্দ্রকে বোঝাচ্ছেন কালীতত্ত্ব। গন্ধর্বনিন্দিত কণ্ঠে ঠাকুর গাইছেনঃ “শ্যামা মা উড়াচ্ছে ঘুড়ি (ভবসংসার বাজার মাঝে)।” গান শেষ করে বলছেন : “তিনি লীলাময়ী! এ-সংসার তাঁর লীলা! তিনি ইচ্ছাময়ী, আনন্দময়ী! লক্ষের মধ্যে একজনকে মুক্তি দেন।” ঠাকুর বলতেন : “পাশবদ্ধ জীব এবং পাশমুক্ত শিব।” একই জীবের দুই অবস্থা। “কালী ও ব্রহ্ম অভেদ।” সেই অভেদ কখন? যখন আমি নামরূপের ঊর্ধ্বে আরোহণ করতে পেরেছি। আমার ‘আমি’কে নস্যাৎ করতে পেরেছি। আমি এবং আমার—এই হলো জীবের সংজ্ঞা। সংসার আমাকে পেড়ে ফেলেছে। অষ্টপাশের বন্ধনে আমার ত্ৰাহি-ত্রাহি অবস্থা। মা, মা চিৎকার। কেউ নেই আমার, দারা-পুত্র-পরিবার ঊর্ধ্ব-দৃষ্টিতে তাঁকে খুঁজছি আর কাতর কণ্ঠে ডাকছি, কৃপাময়ি! কৃপাদৃষ্টি কর মা। তখন তিনি তাঁর ডান হাত তুলে অভয় দিচ্ছেন : “বাবা, ভয় কি তোমার! এই যে আমি তোমার জননী।” আমি তাঁর কণ্ঠ শুনেছি। মনে হয়েছে, কেউ একজন আছেন আমার এই নির্বান্ধব, মরুভূমি-সম সংসারে; কিন্তু আমি যে তাঁকে আরো কাছে পেতে চাই, মা, আমি তো তোমার কোল পেতে চাই! সে কিরকম আকুতি? সেই ডাকের শক্তি কেমন হওয়া চাই? ঠাকুর যেভাবে ডাকতেন। মাটিতে পড়ে আছেন, অচৈতন্য। দুচোখের জলের ধারায় মাটি কর্দমাক্ত। দেহে প্রাণ আছে কি নেই। তখন তিনি তাঁর দ্বিতীয় দক্ষিণহস্ত তুলে শোনান-অভয়বাণী : “ভয় নেই, ভয় নেই। আমি থাকতে তোমার কিসের ভয়!” ভক্তের এতেও আশ মেটে না। বন্ধনের কি হবে! ভবভয়-বন্ধন। অজস্র বন্ধন। সম্পর্ক, কর্তব্য, জীবিকা, রোগ, শোক, জরা, ব্যাধি, সংসার, সমাজ, মান, সম্মান, অভ্যাস, ইন্দ্রিয়। মা, মুক্তি কোথায়? জীবের এই তৃতীয় আর্তনাদে মা বের করবেন তাঁর বামহস্ত। সেই হাতে ধরা আছে অসি। তিনি একে একে সব বন্ধন কর্তন করে জীবকে মুক্তি দেবেন। জীবরূপ মুণ্ডটি তাই মায়ের দ্বিতীয় বামহস্তে ধৃত। এই হলো মায়ের চারটি হাতের রহস্য। এখন জীবের জীবত্ব নাশ মানে মৃত্যু। এই অবস্থাই হলো জীবের শিব-অবস্থা। অর্থাৎ তখন তার আর কোন কর্ম থাকে না। জৈবভাবে কোন কাজই শুদ্ধ নয়। শিবত্ব প্রাপ্তিতে তার কাজ হয় মঙ্গলকর্ম। শিবের আরেক অর্থ শুভ, মঙ্গল। কিন্তু শিবত্ব-লাভেই তো শেষ হচ্ছে না। সে তো ব্রহ্মময়ীকে তখন চিনেছে। মায়ার আড়ালে সরে গেছে। জীবাত্মা তখন পরমাত্মায় লীন হতে চাইছে। জীবাত্মা যখন পরমাত্মায় মিলিত হলো, তখন সে শব। শিব যেই শবাকার হলো আনন্দময়ী স্বপ্রকাশিত হলেন হৃদয়ে। জীবের এই অবস্থার নাম সমাধি।

ঠাকুর বলছেন : “তাই ব্রহ্মকে ছেড়ে শক্তিকে, শক্তিকে ছেড়ে ব্ৰহ্মকে ভাবা যায় না। নিত্যকে ছেড়ে লীলা, লীলাকে ছেড়ে নিত্য ভাবা যায় না। দুধ কেমন? না, ধোব ধোব। দুধকে ছেড়ে দুধের ধবলত্ব ভাবা যায় না। আবার দুধের ধবলত্ব ছেড়ে দুধকে ভাবা যায় না। আদ্যাশক্তি লীলাময়ী; সৃষ্টি-স্থিতি- প্রলয় করছেন। তাঁরই নাম কালী। কালীই ব্রহ্ম, ব্রহ্মই কালী। একই বস্তু, যখন তিনি নিষ্ক্রিয়—সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় কোন কাজ করছেন না—এইকথা যখন ভাবি, তখন তাঁকে ব্রহ্ম বলে কই। যখন তিনি এইসব কার্য করেন তখন তাঁকে কালী বলি, শক্তি বলি। একই ব্যক্তি নাম-রূপভেদ।”

ঠাকুর প্রশ্ন করছেন : “কালী কি কালো?” নিজেই উত্তর দিচ্ছেন : “দূরে তাই কালো, জানতে পারলে কালো নয়। আকাশ দূর থেকে নীলবর্ণ। কাছে দেখ, কোন রঙ নেই। সমুদ্রের জল দূর থেকে নীল, কাছে গিয়ে হাতে তুলে দেখ, কোন রঙ নেই।”

রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণের অতীত একটা অবস্থাই হলো সত্য অবস্থা। সত্য কেন? গণিত দিয়ে বুঝতে হবে। আপেক্ষিক তত্ত্ব যেখানে নেই। আমি নেই, তুমি নেই। আলো নেই, অন্ধকারও নেই। রূপ, অরূপ কিছুই নেই। সেই অবস্থা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যও নয়। সাদাও নয়, কালোও নয়। তাই শিব শ্বেত শুভ্র, মা নিকষ কালো। দুই বিপরীত মেরুর সহ-অবস্থান। জীবন আর মৃত্যু। কর্ম আর নিষ্ক্রিয়তা, এক আর একের ওপর। ঠাকুর একটি গান গাইতেন : “ভাব কি ভেবে পরাণ গেল। যার নামে হরে কাল, পদে মহাকাল, তার কালো রূপ কেন হলো!” ঠাকুর ভক্তকে বলছেন : “যিনি নিরাকার, তিনিই সাকার সাকাররূপও মানতে হয়। কালীরূপ চিন্তা করতে করতে সাধক কালীরূপেই দর্শন পায়। তারপরে দেখতে পায় যে, সেই রূপ অখণ্ডে লীন হয়ে গেল। যিনিই অখণ্ড সচ্চিদানন্দ, তিনিই কালী!”

“তিনি অনন্ত পথও অনন্ত।” ঠাকুর সমন্বয়ের কথা বলছেন, জ্ঞানের কথা, ওপর থেকে দেখা, যার নাম দর্শন—”যে সমন্বয় করেছে, সেই-ই লোক। অনেকেই একঘেয়ে। আমি কিন্তু দেখি সব এক। শাক্ত, বৈষ্ণব, বেদান্ত মত সবই সেই এককে লয়ে। যিনিই নিরাকার, তিনিই সাকার, তাঁরই নানা রূপ। “নির্গুণ মেরা বাপ, সগুণ মাহতারি,/কাকো নিন্দো কাকো বন্দো, দোনো পাল্লা ভারী।”

“বেদে যাঁর কথা আছে, তন্ত্রে তাঁরই কথা, পুরাণেও তাঁরই কথা। সেই এক সচ্চিদানন্দের কথা। যাঁরই নিত্য, তাঁরই লীলা। বেদে বলেছে, “ওঁ সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম।’ তন্ত্রে বলেছে, “ওঁ সচ্চিদানন্দঃ শিবঃ। শিবঃ কেবলঃ কেবলঃ শিবঃ।’ পুরাণে বলেছে, “ওঁ সচ্চিদানন্দঃ কৃষ্ণঃ।’ সেই এক সচ্চিদানন্দের কথাই বেদ, পুরাণ, তন্ত্রে আছে। আর বৈষ্ণবশাস্ত্রেও আছে, কৃষ্ণই কালী হয়েছিলেন।

কতভাবে ঠাকুর ব্যাখ্যা করেছেন শক্তিরূপিণী কালীকে! “যিনি সৎ তাঁর একটি নাম ব্রহ্ম, আরেকটি নাম কাল (মহাকাল)। কালী যিনি কালের সহিত রমণ করেন। আদ্যাশক্তি। কাল ও কালী—ব্রহ্ম ও শক্তি অভেদ। স্থির জল ব্রহ্মের উপমা। জল হেলচে, দুলচে, শক্তি বা কালীর উপমা।”

ঠাকুর বলতেন, মায়া, মহামায়া। মহামায়ার এমনি লীলা, মানুষ জেগে ঘুমোয়। সাধু, সিদ্ধ মহাপুরুষ নিষ্কৃতি নেই কারো। তিনি প্রসন্ন হয়ে পথ না ছাড়লে সত্যলাভ অসম্ভব। বুদ্ধিকে বিমোহিত করতে তাঁর ক্ষণমাত্র সময় লাগবে না। মহাবিদ্যা ষোড়শী কে? সালঙ্কারা মা সারদা আসনে আসীন। ঘোর অমানিশা। পূজারী ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ। মায়ের পাদপদ্মে সাধনকালের সিদ্ধিপ্রদ জপমালা সমর্পণ করে দিলেন। “মা, সাধনাও তোমার, সিদ্ধিও তোমার।”

“তদর্পিতাখিলাচারঃ সনৃ কামক্রোধাভিমানাদিকং তস্মিন্নেব করণীয়ম্।।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *