1 of 3

“চাঁদামামা সকলের মামা”

“চাঁদামামা সকলের মামা”

যেকোন মুহূর্তে যেকোন অবস্থায় তাঁর কাছে যাওয়া যায়। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের আসর সাঙ্গ হয়নি। দৃশ্য থেকে অদৃশ্যে কালের চিরপ্রবাহে ভাসমান। হাঁটাচলারও প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই যানবাহনে গুঁতোগুঁতির। শুধু মনটাকে একটু ঠেলে দেওয়া—এঘর থেকে ওঘরে। ভোগের ঘর থেকে ভাবের ঘরে। নিমেষে সেই পূতসঙ্গ। ভক্তজন পরিবৃত শ্রীরামকৃষ্ণ। নরেন্দ্রনাথের কোলে তানপুরা। তিনি সুর বাঁধছেন। ঠাকুর হাসতে হাসতে বলছেন : “এমনি ইচ্ছে হচ্ছে যে তানপুরাটা ভেঙে ফেলি। কি টংটং—আবার তানা নানা নেরে নুম্ হবে।” সেই বিনোদ, বিনোদবিহারী সোম, মাস্টারমশাইয়ের ছাত্র, যাঁর আরেক নাম ছিল পদ্মবিনোদ, তিনিও বসে আছেন। রসিকতা করে বলছেন : “বাঁধা আজ হবে, গান আরেক দিন হবে।” দেখছি একপাশে বসে আছেন ভবনাথ। তিনি বলছেন : “যাত্রার গোড়ায় অমনি বিরক্তি হয়।” নরেন্দ্রনাথ তানপুরাটি কাঁধে তুলছেন। আঙুলে সুর ছাড়তে ছাড়তে। খরজের জোয়ারি এদিক-ওদিক করতে করতে গম্ভীর মুখে বলছেন : “সে না বুঝলেই হয়।” ঠাকুরের মুখে সেই স্নেহের হাসি। একটি হাত তুলে বলছেন : “ওই আমাদের সব উড়িয়ে দিলে।”

সেদিনের আসরে আমি ছিলাম না। আজ আমি আছি। এখন আমার নিয়ন্ত্রণে ঠাকুরের লীলা। আমি যখন খুশি যেখানে খুশি ঢুকে পড়তে পারি। একপাশে বসে পড়তে পারি আসন পেতে।

গিরিশ বলছেন : “আপনার কথা আর কি বলব। আপনি কি সাধু?”

ঠাকুর প্রসন্ন মুখে বলছেন : “সাধু-টাধু নয়। আমার সত্যই তো সাধুবোধ নেই।“

গিরিশ বলছেন : “ফচকিমিতেও আপনাকে পারলাম না।”

আমার মুখেও হাসি ফুটবে। আমার ঠাকুর সাধু হতে যাবেন কেন? তিনি যে অবতার। অবতার-বরিষ্ঠ। ঠাকুর কি বলছেন শুনি। তিনি গিরিশচন্দ্রকে সমর্থন করছেন। ফচকিমির রাজা আমি। আমি তো সবাইকে নিয়ে আনন্দের হাটবাজার বসাতে এসেছিলাম। শুনবে তাহলে কেমন ফচকে—”আমি লালপেড়ে কাপড় পরে জয়গোপাল সেনের বাগানে গিছলাম। কেশব সেন সেখানে ছিল। কেশব লালপেড়ে কাপড় দেখে বললে, ‘আজ বড় যে রঙ, লালপাড়ের বাহার।’ আমি বললুম, ‘কেশবের মন ভুলাতে হবে, তাই বাহার দিয়ে এসেছি। ‘

খুব জমে গেছে আজ। একটু আগে বাইরের বারান্দায় নরেন্দ্রনাথ আর গিরিশচন্দ্রের আলাপ-আলোচনা হচ্ছিল। আমার ঠাকুরের তো আবার শিশুর মতো কৌতূহল। জানতে চাইলেন : “কি কথা হচ্ছিল?”

নরেন্দ্রনাথ বললেন : “আপনার কথা। আপনি লেখাপড়া জানেন না, আমরা সব পণ্ডিত, এইসব কথা হচ্ছিল।”

ঠাকুর শিশুর মতো মুখের ভাব করে বললেন : “সত্য বলছি, আমি বেদান্ত আদি শাস্ত্র পড়ি নাই বলে একটু দুঃখ হয় না। আমি জানি বেদান্তের সার, ‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’। আবার গীতার সার কি? গীতা দশবার বললে যা হয় ‘ত্যাগী ত্যাগী’।”

আমি তো ঠাকুরের মুখে এই সারকথাটি শুনব বলেই বসেছিলাম। শাস্ত্রের অভাব নেই। অভাব নেই তর্ক-বিতর্কের। ন্যায়, শ্রুতি, স্মৃতি, সাংখ্য, বেদ, বেদান্ত। যুগ যুগ ধরে কত পণ্ডিতের কত চুলচেরা বিশ্লেষণ। তিনি কোথায় আছেন, কিভাবে আছেন। তিনি এক না দুই। তিনি পুরুষ না প্রকৃতি। তিনি সাকার না নিরাকার। শ্বাস কোন্ নাসায় টানতে হবে, ছাড়তে হবে কোন্ পথে, ধরে রাখতে হবে কতক্ষণ ইত্যাদি বহুতর পন্থা ও পদ্ধতি সমন্বিত শাস্ত্রের পাহাড় জমে গেছে। এক জীবনে পড়ে শেষ করা যাবে না। আর পড়তে পড়তেই যদি জীবন শেষ হয়ে গেল তাহলে তাঁকে আর কাছে পাব কিভাবে! আমবাগানে ঢুকে যদি ডালে ডালে আমের হিসাব নিয়েই মেতে থাকি তাহলে আস্বাদন হবে কখন! সেই অনুভূতিতে পৌঁছাতে চাই। কোন অভিনয় নয়, কোন ভণ্ডামি নয়। ব্ৰহ্মই সত্য, জগৎ মিথ্যা। এই মিথ্যাকে, এই স্বপ্নকে আশ্রয় করে যেভাবে থাকা উচিত সেইভাবে থাকব। ঠাকুরকে ধরে ঠাকুরের লীলায় থাকব।

শুনি, এইবার ঠাকুর গিরিশচন্দ্রকে কি বলছেন? ঈশ্বরকে কিভাবে পাওয়া যায়? ঠাকুর এই মুহূর্তে তরল থেকে গভীর ভাবে চলে গেছেন। ঠাকুর বলছেন : “সরল হলে শীঘ্র ঈশ্বরলাভ হয়।” আর কাদের হয় না, কিছুতেই হয় না—সেকথাও বলছেন তিনি : “প্রথম যার বাঁকা মন, সরল নয়; দ্বিতীয় যার শুচিবাই; তৃতীয় যারা সংশয়াত্মা।

নিজের ভিতরের দিকে তাকাই। বেদ-বেদান্ত কি করবে? ভড়ং দেখিয়ে কয়েক দিনের জন্যে কয়েকজনকে ধোঁকা দেওয়া যায়। আগে নিজের স্বরূপ খুঁজি। আমি কি সরল? না আমি কুচুটে! আমার কি উকিলে বুদ্ধি? আমি কি বিষয়ী, কৃপণ? রক্তপরীক্ষার মতো আত্মবিশ্লেষণ করি। যদি পরীক্ষায় দেখা যায় আমি কুটিল তাহলে আমাকে সরল হতে হবে। তা নাহলে ঠাকুর আমাকে এই আসর থেকে দূর করে দেবেন। বলবেন—যাও, তুমি তোমার জগৎ নিয়ে মেতে থাক। এই আসরকে কলঙ্কিত করো না। তোমার এলাকা ভিন্ন! ঠাকুর শুচিবাই বললেন কেন? ওটা মনের বিকার। বিকারগ্রস্ত মন ঈশ্বরের কি ধারণা করবে? তার জীবন তো শুচি-অশুচির বিচারে হারিয়ে গেছে। ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না করে সে তো নিজেই অচ্ছুৎ। আর সংশয়াত্মা! যার সবেতেই সংশয়, সে তো কারোর কথা বিশ্বাস করবে না। সে শুধু বিচার করবে। সংশয়ের জালে বিষয়ভুক মাকড়সার মতো বসে থাকবে। তার সঙ্গে ঠাকুরের কি সম্পর্ক! একপাশে বসে বসে ভাবছি—আমি হব। আমি সরল হব। সমস্ত সংশয় ঝেড়ে ফেলব।

ঠাকুর নরেন্দ্রকে বলছেন, আমি শুনছি—”আরেকটি কথা।” কি কথা? “জ্ঞান-অজ্ঞানের পার হও। অনেকে বলে অমুক বড় জ্ঞানী, বস্তুত তা নয়। বশিষ্ঠ এত বড় জ্ঞানী, পুত্রশোকে অস্থির হয়েছিল। তখন লক্ষণ বললেন, ‘রাম, একি আশ্চর্য! ইনিও এত শোকার্ত!’ রাম বললেন, ‘ভাই, যার জ্ঞান আছে, তার অজ্ঞানও আছে; যার আলোবোধ আছে, তার অন্ধকারবোধও আছে, যার ভালবোধ আছে, তার মন্দবোধও আছে; যার সুখবোধ আছে, তার দুঃখবোধও আছে। ভাই, তুমি দুই-এর পারে যাও, সুখ-দুঃখের পারে যাও, জ্ঞান-অজ্ঞানের পারে যাও।’ তাই বলছি, জ্ঞান-অজ্ঞানের পার হও।” ঠাকুর নরেন্দ্রনাথকে বলছেন। আমি শুনছি! যাঁকে বলছেন, আমি তাঁর পদনখের যোগ্য নই; কিন্তু আমি উচ্চাকাঙ্ক্ষী। হয়তো পারব না, ব্যর্থ হব, তবু চেষ্টা করব।

ঠাকুর আমার মনের কথা শুনতে পেলেন। গিরিশচন্দ্র যেই বললেন : “আপনার কৃপা হলেই সব হয়। আমি কি ছিলাম কি হয়েছি।” ঠাকুর অমনি বলছেন : “ওগো তোমার সংস্কার ছিল তাই হচ্ছে। সময় না হলে হয় না। যখন রোগ ভাল হয়ে এল, তখন কবিরাজ বললে, ‘এই পাতাটি মরিচ দিয়ে বেটে খাও।’ তারপর রোগ ভাল হলো। তা মরিচ দিয়ে ঔষধ খেয়ে ভাল হলো, না আপনি ভাল হলো, কে বলবে?”

ঠাকুর উদাহরণ দিচ্ছেন—”লক্ষ্মণ লব-কুশকে বললেন, ‘তোরা ছেলেমানুষ, তোরা রামচন্দ্রকে জানিস না। তাঁর পাদস্পর্শে অহল্যা পাষাণী মানবী হয়ে গেল।’ লব-কুশ বললে, ‘ঠাকুর সব জানি, সব শুনেছি। পাষাণী যে মানবী হলো সে যে মুনিবাক্য ছিল। গৌতম মুনি বলেছিলেন যে, ত্রেতাযুগে রামচন্দ্র ঐ আশ্রমের কাছ দিয়ে যাবেন; তাঁর পাদস্পর্শে তুমি আবার মানবী হবে। তা এখন রামের গুণে না মুনিবাক্যে কে বলবে বল!’

ঠাকুর আরেকটু যোগ করলেন—”সবই ঈশ্বরের ইচ্ছায় হচ্ছে। এখানে যদি তোমার চৈতন্য হয় আমাকে জানবে হেতুমাত্র। চাঁদামামা সকলের মামা। ঈশ্বর ইচ্ছায় সব হচ্ছে।”

সঙ্গে সঙ্গে গিরিশচন্দ্র হাসতে হাসতে ঠাকুরকে প্যাঁচে ফেলে দিলেন : “ঈশ্বরের ইচ্ছায় তো। আমিও তো তাই বলছি।” সকলে হো হো করে হেসে উঠলেন। পাশ কাটাতে চেয়েছিলেন ঠাকুর। গিরিশ ধরে ফেলেছেন, ঠাকুরই তো ঈশ্বর।

অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি বিখ্যাত নটের দিকে। মনে মনে বললুম, আমিও আপনার মতো সংশয়শূন্য হব। বিশ্বাস, পরিপূর্ণ বিশ্বাস। বিশ্বাস থেকে টলব না। সংস্কার আছে কিনা জানি না। না থাকে এবারে সংস্কার তৈরি হবে। পরের বারে হবে। না হয় তারও পরের বার। আশা ছাড়ছি না।

ঠাকুর বলছেন : “শাস্ত্রের সার গুরুমুখে জেনে নিতে হয়। তারপর সাধন- ভজন। একজন চিঠি লিখেছিল। চিঠিখানি পড়া হয় নাই, হারিয়ে গেল। তখন সকলে মিলে খুঁজতে লাগল। যখন চিঠিখানি পাওয়া গেল, পড়ে দেখলে পাঁচসের সন্দেশ পাঠাবে আর একখানা কাপড় পাঠাবে। তখন চিঠিটা ফেলে দিলে, আর পাঁচসের সন্দেশ আর একখানা কাপড়ের যোগাড় করতে লাগল। তেমনি শাস্ত্রের সার জেনে নিয়ে আর বই পড়বার কি দরকার? এখন সাধন- ভজন।”

আপনিই তো গুরু। আপনার মুখেই তো শুনছি। সুরেন্দ্রকে বলছেন। সিমুলিয়ার সুরেন্দ্রনাথ মিত্র। ডস্ট কোম্পানির মুৎসুদ্দি। প্রথম জীবনে ঘোর নাস্তিক। বন্ধু রামচন্দ্র দত্ত ও মনোমোহন মিত্রের সঙ্গে ঠাকুরকে দেখতে এসেছিলেন দক্ষিণেশ্বরে, অত্যন্ত অবিশ্বাসী মন নিয়ে। আর তো ফেরা হলো না অবিশ্বাসে। আটকে গেলেন অমৃতরসে। সেই মিত্রমশাই বসে আছেন ঠাকুরের পাশটিতে। ঠাকুর তাঁকে বলছেন : “সন্ন্যাসীর পক্ষে কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ; তোমাদের পক্ষে তা নয়। তোমরা মাঝে মাঝে নির্জনে যাবে আর তাঁকে ব্যাকুল হয়ে ডাকবে। তোমরা মনে ত্যাগ করবে।”

এই তো আমার পথ! আমি তো সন্ন্যাসী নই। গৃহী। গৃহীর পথ তো ঠাকুর বলে দিলেন। একটু নির্জনতা খুঁজে নেব। কোথাও না পাই, নিজের মনে পাব। সেইখানেই সরে গিয়ে আকুল হয়ে ডাকব ঠাকুরকে। আর বিষয় থেকে মন তুলে নেব। তাহলেই তো ত্যাগ হলো। মনে ত্যাগ

ঠাকুর আবার সুরেন্দ্রকে বলছেন : “মাঝে মাঝে এস। ন্যাংটা বলত।” ‘ন্যাংটা’ হলেন সেই তোতাপুরী, ঠাকুরের অদ্বৈত বেদান্ত সাধনার গুরু, পাঞ্জাবের লুধিয়ানা মঠের পুরীনামা দশনামী সম্প্রদায়ভুক্ত অদ্বৈতবাদী নাগা সন্ন্যাসী। ঠাকুর বলছেন : “ন্যাংটা বলত, ঘটি রোজ মাজতে হয়; তা নাহলে কলঙ্ক পড়বে। সাধুসঙ্গ সর্বদাই দরকার।”

মাঝে মাঝে কেন? সর্বসময়েই যদি আমি ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে থাকি! তাহলে! মনের একটি দরজা, ভাবের দরজা খুললেই তো দেখতে পাব, তিনি বসে আছেন সপার্ষদ। শেষ তো হয়নি। ক্ষণকাল থেকে মহাকালে চলে গেছেন। ঘর থেকে গেছেন ভাবের ঘরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *