1 of 3

“মন-মত্তকরী”

“মন-মত্তকরী”

সবাই বসে আছেন। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের তখন সাধন-জগতের এক উচ্চ মণ্ডলে অবস্থান। তিনি সমাধিস্থ। বসে আছেন রাখাল, পরবর্তী কালের স্বামী ব্রহ্মানন্দ। রাখাল হঠাৎ বললেন : “মন-মত্তকরী।”

অবশ্যই। কোন সন্দেহ নেই। ভিতরে নড়ছে-চড়ছে আর দেহ তার খিদমত খাটছে। রামপ্রসাদ দুঃখ করছেন : “মন-গরিবের কি দোষ আছে!” ঠাকুর রামপ্রসাদকে বড় ভালবাসতেন। প্রায়ই উল্লেখ করতেন তাঁর জীবনদর্শনের।

রামপ্রসাদ লিখছেন :

“মন তুমি কি রঙ্গে আছ।
(ও মন রঙ্গে আছ রঙ্গে আছ)
তোমার ক্ষণে ক্ষণে ফেরা ঘোরা,
দুঃখে রোদন সুখে নাচ।।
রঙের বেলা রাঙে কড়ি,
সোনার দরে তা কিনেছ।
ও মন, দুঃখের বেলা রতন মানিক,
মাটির দরে তা বেচেছ।।
সুখের ঘরে রূপের বাসা,
সেই রূপে মন মজায়েছ।
যখন সে রূপে বিরূপ হবে,
সে রূপের কিরূপ ভেবেছ।।”

“তোমার ক্ষণে ক্ষণে ফেরা ঘোরা, দুঃখে রোদন সুখে নাচ।” দুঃখে রোদন সুখে নাচাটা তবু সহ্য হয়। ঠিক আছে, ঐটাই যুগ যুগ ধরে জীবের স্বভাব-ধর্ম; কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে এই ফেরা ঘোরা? এ যে মহাযন্ত্রণা! মন-মাছি ভন ভন, ফন ফন করে উড়ছে। ঠাকুর আমাদের মনের স্বরূপ আমাদের কাছেই উদ্ঘাটন করে দিচ্ছেন। মন কেমন? (১) মনটি যেন মাটি-মাখানো লোহার ছুঁচ, (২) সংসার-হাওয়া মনরূপ দীপকে সর্বদা চঞ্চল করছে। (৩) বজ্জাৎ ‘আমি’। সেটা কে? যে ‘আমি’ বলে, ‘আমায়’ জানে না? আমার এত টাকা, আমার চেয়ে কে বড়লোক আছে? যদি চোরে দশ টাকা চুরি করে থাকে, প্রথমে টাকা কেড়ে লয়, তারপর চোরকে খুব মারে; তাতেও ছাড়ে না, পাহারাওয়ালা ডেকে পুলিশে দেয় ও ম্যাদ (মেয়াদ) খাটায়, ‘বজ্জাৎ আমি’ বলে জানে না—আমার দশ টাকা নিয়েছে! এত বড় আস্পর্ধা! (৪) মন যেন সাধারণ মাছি, সন্দেশেও বসে আর পচা ঘায়েও বসে, বিষ্ঠাতেও বসে। (৫) মন কাম-কাঞ্চনে। (৬) কত রকমের ‘আমি’ কাঁচা আমি, বজ্জাত আমি, পাকা আমি। ‘পাকা আমি’ কেমন— (ক) বালকের আমি, (খ) ঈশ্বরের দাস আমি, (গ) বিদ্যার আমি। (৭) আমি— সে কেমন? (ক) অবিদ্যার আমি, (খ) কাঁচা আমি। তার স্বরূপ? একটা মোটা লাঠির ন্যায়। সচ্চিদানন্দ সাগরের জলে ঐ লাঠি। জলকে দু-ভাগ করেছে। আর ‘ঈশ্বরের দাস আমি’, ‘বালকের আমি’, ‘বিদ্যার আমি’ জলের ওপরে রেখার ন্যায়। জল এক, বেশ দেখা যাচ্ছে—শুধু মাঝখানে একটি রেখা, যেন দুভাগ জল। বস্তুত এক জল দেখা যাচ্ছে। (৮) মন নিয়ে কথা। মন ধোপা ঘরের কাপড়, যে রঙে ছোপাবে, সেই রঙ হবে। মনেতেই জ্ঞান, মনেতেই অজ্ঞান। অমুক লোক খারাপ হয়ে গেছে অর্থাৎ অমুক লোকের মনে খারাপ রঙ ধরেছে। (৯) মন নিজের কাছে নাই। নিজের কাছে মন থাকলে তবে তো ভগবানকে দেবে। মন বন্ধক দিয়েছ; কাম-কাঞ্চনে বন্ধক! তাই সর্বদা সাধুসঙ্গ দরকার।

মনস্তাত্ত্বিক ঠাকুর আমাদের মন চুরমার করে দিয়ে গেছেন। ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন বিচার। হুঁশ ‘ইনজেক্ট’ করে দিয়েছেন। বেতালা পা পড়লেই ভিতরটা হায় হায় করে ওঠে। একালের মিছিলে স্লোগান দেয়—’চলছে না, চলবে না।’ সেইরকম মন মনকে দেখে বলে ওঠে—হচ্ছে না, হবে না। ওভাবে হবে না। বন্ধ ঘরে চড়াই পাখির মতো ফরফর করে মন উড়ছে। ধরে বসানো যাচ্ছে না। কোথায় বসানো? ত্যাগের পিঁড়িতে। বাইরে ত্যাগ নয়, ভিতরে ত্যাগ। চাই না, সত্যিই কিছু চাই না। বিষয়ের জন্য, ভোগের জন্য, ক্ষমতার জন্য, যশ-খাতির জন্য অন্তরে দগ্ধ হই না। রবারের থলেতে দামাল হুলোর মতো, এদিকে চেপে ধরলে ওদিকে ঠেলে ওঠে না!

সম্রাটের মতো মন বসে আছে মনের আসনে। তৈলধারার মতো গড়িয়ে চলেছে ইষ্টপদের দিকে। অচল, অটল। মন নিয়ে মহা লাঠালাঠি। অবোধ, নির্বোধ বালকের মতো, চেনে বাঁধা বাঁদরের মতো তিড়িং বিড়িং। এমন মন তো কোন সত্যের ধারণা করতে পারবে না।

রামপ্রসাদ বলছেন :

“বাসনাতে দাও আগুন জ্বেলে
স্বভাব হবে পরিপাটি।
কর মনকে ধোলাই, আপদ বালাই
মনের ময়লা ফেল কাটি।
কালীদহের কূলে চল,
সে জলে ধোপ হবে ভাল।
পাপ কাষ্ঠের আগুন জ্বাল,
চাপায়ে চৈতন্যের ভাঁটি।।”

চৈতন্যের ভাঁটি, চৈতন্যের আগুন জ্বেলে সব পাপ পুড়িয়ে ফেল, আর চল, নিজেকে নিয়ে বসাই কালীদহের কূলে।

তুলসীদাস বলছেন :

“যো পরবিত্ত হরে সদা,
সো কহু দান কিয়া ন কিয়া।
যো পরদার করে সদা,
সো কহু তীর্থ গয়া ন গয়া।।
যো পর আশ করে সদা,
সো বহু দিন জিয়া ন জিয়া।
যো মুহুমে পরচুকলি ওগারত,
সো মুহুমে হরিনাম লিয়া ন লিয়া।।”

—নিরন্তর যে পরস্বহারী সে দান করল কি না করল, দুই-ই সমান। নিরন্তর পরদারগামী, তার তীর্থে যাওয়া আর না যাওয়া। পরপ্রত্যাশীর মরা বাঁচায় কিছু যায় আসে না। আর পরনিন্দাকারীর হরিনাম করাও যা না করাও তাই। সবই ভস্মে ঘি ঢালা।

নলখাগড়ার বন, ঘোলা জল, সরীসৃপের বিচরণ, ব্যাঙাচির লাফ, তারই মধ্য দিয়ে যেতে হবে সাবধানে। একটু একটু করে সরিয়ে সরিয়ে, প্রখর দৃষ্টি, সজাগ মন। ছুঁচে সুতো পরাবার সময়ের তীক্ষ্ণ মন। একমুখী মন। কাম-কাঞ্চনে বন্ধক মন নিয়ে কি করা দরকার? ঠাকুরের নির্দেশ :

“সর্বদা সাধুসঙ্গ দরকার। মন নিজের কাছে এলে তবে সাধন-ভজন হবে। সর্বদাই গুরুর সঙ্গ, গুরুসেবা, সাধুসঙ্গ প্রয়োজন। হয় নির্জনে রাতদিন তাঁর চিন্তা, নয় সাধুসঙ্গ। মন একলা থাকলে ক্রমে শুষ্ক হয়ে যায়। এক ভাঁড় জল যদি আলাদা রেখে দাও, ক্রমে শুকিয়ে যাবে! কিন্তু গঙ্গাজলের ভিতর যদি ঐ ভাঁড় ডুবিয়ে রাখ তাহলে শুকোবে না। কামারশালার লোহা আগুনে বেশ লাল হয়ে গেল। আবার আলাদা করে রাখ, যেমন কালো লোহা, তেমনি কালো। তাই লোহাকে মধ্যে মধ্যে হাপরে দিতে হয়। আমি কর্তা, আমি করছি তবে সংসার চলছে; আমার গৃহ পরিজন-এসকল অজ্ঞান! আমি তাঁর দাস, তাঁর ভক্ত, তাঁর সন্তান—এ খুব ভাল। একেবারে ‘আমি’ যায় না। এই বিচার করে উড়িয়ে দিচ্ছ, আবার কাটা ছাগল যেমন একটু ভ্যা ভ্যা করে হাত-পা নাড়ে, সেইরকম কোথা থেকে ‘আমি’ এসে পড়ে। তাঁকে দর্শন করবার পর, তিনি যে ‘আমি’ রেখে দেন, তাকে বলে ‘পাকা আমি’। যেমন তরবার পরশমণি ছুঁয়েছে, সোনা হয়ে গিয়েছে! তার দ্বারা আর হিংসার কাজ হয় না!” আবার সতর্ক করছেন ঠাকুর এইভাবে—”হাতির বাহিরের দাঁত আছে আবার ভিতরের দাঁতও আছে। বাহিরের দাঁতে শোভা, কিন্তু ভিতরের দাঁতে খায়। তেমনি ভিতরে ভোগ করলে ভক্তির হানি হয়।” ঠাকুর বলছেন : “শকুনি উপরে ওঠে কিন্তু ভাগাড়ের দিকে নজর। হাওয়াই হুস করে প্রথমে আকাশে উঠে যায় কিন্তু পরক্ষণেই মাটিতে পড়ে যায়!” বাইরে থেকে মন দেখা যায় না। বসে আছে অন্দরমহলে। সেখানে হাসছে, সেখানে কাঁদছে, বসে বসে কালনেমির লঙ্কা ভাগ করছে। ভাঙছে চুরছে। কতকাল আগে মজার একটি কবিতা লিখেছেন ই. এ. রবিনসন-

RICHARD CORY

(উদ্ধৃত করার লোভ সম্বরণ করা গেল না)
“Whenever Richard Cory went downtown,
We people on the pavement looked at him:
He was a gentleman from sole to crown,
Clean favoured, and imprially slim.

And he was always quitely arrayed,
And he was always human when he talked;
But still he fluttered pulses when he said
‘Good Morning’ and he glittered when he walked.

And he was rich-yes, richer than a king
And admirably schooled in every grace:
In fine, we thought that he was everything
To make us wish that we were in his place.

So on we worked and waited for the light,
And went without the meat, and cursed the bread;
And Richard Cory, one calm summer night
Went home and put a bullet through his head.”

এই ‘isolation’-এর কথাই ঠাকুর বলছেন তাঁর অনবদ্য অসাধারণ ভাঁড়ের উপমায়। চিত্ত নামক জল শুকিয়ে যায়। কত কি? তবু ‘প্রাণ কেন কাঁদে রে’। রিচার্ড কোরির মতো অবশেষে একটি বুলেট কপালে। ঠাকুর আমার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনস্তত্ত্ববিদ। বলছেন, শোন, ঐ নরেন (স্বামীজী) গাইছে :

“সাধু-সঙ্গ নামে আছে পান্থ-ধাম
শ্রান্ত হলে তথায় করিও বিশ্রাম,
পথভ্রান্ত হলে শুধাইও পথ,
সে পান্থ-নিবাসীজনে।।”

“দি বুক অফ ফাইভ রিংস’-এ আছে—”হেইহো কোকোরো মোচি নো কোতো।” “হেইহো’ জাপানী সাধনধারা, বুদ্ধ প্রভাবিত। মনই যেখানে মানুষের তরবার। ঠাকুর যে-তরবারে পরশমণি ছোঁয়াতে বলেছেন, সেই মনের সাধনা ‘হেইহো’। পরিষ্কার নির্দেশ—”Keep your mind on the centre and do not waver. Calm your mind, and do not cease the firmness for even a second. Always maintain a fluid and flexible, free and open mind. Even when the body is at rest, do not relax your concentration. “

তাহলে চলে আসি আবার প্রথমে। রাখাল (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) বলছেন : “মন- মত্তকরী!”

ঠাকুর বলছেন : “ঈশ্বরীয় রূপ মানতে হয়! জগদ্ধাত্রীরূপের মানে জান? যিনি জগৎকে ধারণ করে আছেন। তিনি না ধরলে, তিনি না পালন করলে জগৎ পড়ে যায়, নষ্ট হয়ে যায়। মনকরীকে যে বশ করতে পারে, তারই হৃদয়ে জগদ্ধাত্রী উদয় হন।”

আর ঐ সিংহ! ঐ তো প্রহরী, “পরম যতনে রাখ রে প্রহরী শম দম দুই জনে।” ঠাকুর বলছেন : “সিংহবাহিনীর সিংহ তাই হাতিকে জব্দ করে রয়েছে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *