1 of 3

ধর্মকর্ম

ধর্মকর্ম

আমরা বলি, এইবার একটু ধর্মকর্ম কর, বয়স তো হচ্ছে।

‘ধর্মকর্ম কর’–এই বাক্যটিই লক্ষণীয়। কর—শুধু ভাবলে হবে না, শুধু পড়লেও হবে না। ধর্ম করার জিনিস। আমি একটা মানুষ। আমার স্বভাব- চরিত্র-ভাব-অনুভূতি আমাকে তেমন তৃপ্তি দিতে পারছে না। মানুষের যে- আদর্শ এই পৃথিবীতে তৈরি হয়ে আছে, আমি তার ধারেকাছে পৌঁছাতে পারছি না। আদর্শের কাছে আমি পরাজিত। মানুষ হয়েও আমি ‘মানুষ’ হতে পারিনি।

এই আদর্শ-মানুষের ধারণাটা এল কোথা থেকে? আদর্শটা তৈরি করে দিল কে! মানুষই তৈরি করেছে মানুষের আদর্শ। যুগ যুগ ধরে মানুষের বেঁচে থাকাই তৈরি করেছে সে-আদর্শ। একদিকে প্রকৃতি, অন্যদিকে মানুষ। এই দুই শক্তির সঙ্গে লড়াই করতে করতে মানুষ খুঁজে পেয়েছে তার সীমাবদ্ধতা। দেহের শক্তির তুলনামূলক দুর্বলতা। নিজের বোধ ও বুদ্ধির চঞ্চলতা। মানুষ দেখেছে— তার সসীম দেহের কোথায় যেন আরেকটা মানুষ বসে আছে। যার বোধ-বুদ্ধি- জ্ঞান-বিচার অনেক বেশি। স্থির, স্থিতধী, জ্ঞানী, বিবেচক। সে যেন পিতার মতো, অভিভাবকের মতো, শিক্ষকের মতো, বন্ধুর মতো, মাতার মতো। সেই সত্তাটি বড় উজ্জ্বল। মানুষ যখন বিচারে ভুল করে, ইন্দ্রিয়ের দাস হয়ে নিজের পতন, পরাজয়, সর্বনাশ ডেকে আনে তখন তার অন্তঃসত্তা নিরপেক্ষ বিচারকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে ভুলটা ধরিয়ে দিতে চান, দুর্বলতার প্রতি ইঙ্গিত করেন, উচিত-অনুচিতের বিভাজন করেন।

ঈশ্বর কোথায়! বাইরে কোথাও নেই। বসে আছেন মানুষের ভিতরে। ঐ সমুজ্জ্বল অন্তঃসত্তাই ঈশ্বর। আমাদের আত্মশক্তি। আমরা প্রশ্ন করতে পারি— যদি আমাদের ভিতরেই আছেন, তাহলে তিনি আমাদের স্বভাবকে নিয়ন্ত্রণে আনেন না কেন, যে-কাজ করা উচিত নয়, সে-কাজ করি কেন? কামনা- বাসনা-অহঙ্কার প্রভৃতি তমোগুণে কেন ডেকে আনি ভয়, সংশয়, যাবতীয় গ্লানি। নিজের জীবন কেন নিজের হাতছাড়া হয়ে যায়!

এরই নাম আত্মবিস্মৃতি। ঈশ্বর কোন অলৌকিক চরিত্র নন। তাঁর আলাদা কোন স্বর্গীয় বাসস্থান নেই। আমাদের মনেই তাঁর অবস্থান। তিনি আমাদের আত্মপুরুষ। সেই আত্মার সঙ্গে যুক্ত হওয়াই যোগ, আর সেই যোগই হলো সাধনা। শ্বেতাশ্বতরোপনিষদে সুন্দর একটি উপমা আছে—

“দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া
সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে।
তয়োরন্যঃ পিপ্পলং স্বাদ্বত্ত্য-
নগ্নন্নন্যোঽভিচাকশীতি।।”

–ধরা যাক, এই দেহ একটি বৃক্ষ। সেই দেহবৃক্ষে আশ্রয় নিয়ে আছে দুটি পাখি। তারা বসে আছে একই শাখায়, পাশাপাশি, গায়ে গা লাগিয়ে। এই দুটি পাখি কিসের উপমা! একটি পাখি জীবাত্মা, অন্যটি পরমাত্মা। জীবাত্মা কি করছে? সে ঐ গাছের ফল পরমানন্দে ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে। সে-ফল আবার কি ফল? পূর্বজন্মের কর্মফল! সেইসব ফলের স্বাদও বিচিত্র। পরমাত্মারূপী পাখিটি কিন্তু কিছুই করছে না। তার কোন ভোগ নেই। সে সাক্ষিস্বরূপ। সে কেবল দেখছে। সে খাও বলছে না, আবার খেও না-ও বলছে না। পরমাত্মার এইটিই স্বভাব।

উপনিষদ্ এইবার জীবের কি করণীয় সেই উপদেশ করছেন। বলছেন :

“সমানে বৃক্ষে পুরুষো নিমগ্নোহ-
নীশয়া শোচতি মুহ্যমানঃ
জুষ্টং যদা পশ্যত্যন্যমীশম
অস্য মহিমানমিতি বীতশোকঃ।।”

একই দেহবৃক্ষে জীব পরমাত্মাকে নিয়েই বাস করছেন। পরস্পর সংযুক্ত। কিন্তু জীবাত্মা শক্তিহীন। শক্তির উৎসটিকে চিনতেও পারছেন না, ধরতেও পারছেন না। শক্তির অভাবে শোকে কাতর হয়ে দুঃখভোগ করছেন। পরিত্রাণের উপায়—পরমাত্মার উপাসনা, তাঁর সেবা, তাঁর মহিমাদর্শন। তাহলেই রোগ-শোক-দুঃখ-জরার ঊর্ধ্বে উত্তীর্ণ হওয়া যায়। লাভ করা যায় আনন্দ। এরই নাম যোগ। পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার যোগ। গীতায় ভগবান বলছেন :

“যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়।
সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে।।”

শ্রীভগবান জীবনের কুরুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে অর্জুনকে উপদেশ দিচ্ছেন। কুরুক্ষেত্র সমরাঙ্গনে নয়। ‘কুরুক্ষেত্র’ শব্দটি কৃ-ধাতু সম্পন্ন। ‘কৃ’ মানে করা। জীবের কর্মক্ষেত্র, বিচরণক্ষেত্রই কুরুক্ষেত্র। সংগ্রাম কুরুবংশীয়দের সঙ্গে। যারা জীবকে টেনে আনে হীনকর্মে। দুর্যোধন, দুঃশাসন প্রমুখ আমাদের ইন্দ্রিয়—কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্যাদি ষড়রিপু মানুষকে আচ্ছন্ন করে। পরমাত্মা থেকে জীবাত্মাকে সরিয়ে আনে। অসীমকে সসীম করে। তুচ্ছকে বিশাল করে দেখে, বিশালকে তুচ্ছ। নিত্যকে অনিত্য করে, অনিত্যকে নিত্য। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন : “জীবের অহঙ্কারই মায়া। এই অহঙ্কার সব আবরণ করে রেখেছে। ‘আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল!’ যদি ঈশ্বরের কৃপায় ‘আমি অকর্তা’ এই বোধ হয়ে গেল, তাহলে সে-ব্যক্তি তো জীবন্মুক্ত হয়ে গেল। তার আর ভয় নেই।”

এখানে একটি কথা আছে—ঈশ্বরের কৃপা। সেই কৃপা কদাচিৎ কারো জীবনে অযাচিত এলেও আমাদের ধর্তব্যের বাইরে। জীবের পুরুষকারের এলাকার বাইরে—একান্তই ভাগ্যনির্ভর। কৃষ্ণরূপী ভগবান জীবরূপী বীর অর্জুনকে সংসার-কুরুক্ষেত্রে দাঁড় করিয়ে ভাগ্যনির্ভর, দৈবনির্ভর হতে বলেননি। অর্জুন বলতে পারতেন, আপনি যার সারথি, তাকে আবার কষ্ট করে যুদ্ধ করতে হবে কেন? এইখানেই লুকিয়ে আছে সারকথা—বীর অর্জুন, আমি তোমার অভীষ্ট ইষ্ট নই। আমি তোমার চালক। হয়তো আমিই তোমার পরমাত্মা; কিন্তু তোমার জীবাত্মার শৌর্য ও বীর্যের অহঙ্কার দিয়ে তোমাকে আগেই বলিয়ে নিয়েছি—”সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে রথং স্থাপয় মেহচ্যুত।”–হে অচ্যুত! হে কৃষ্ণ! উভয় সেনার মধ্যে আমার রথ স্থাপন কর। তুমি দেখবে, বিশাল সমরাঙ্গনে কারা সমবেত হয়েছেন। আমি নয়, তুমি নিরীক্ষণ করবে। কারণ এখনো তুমি আমার সঙ্গে যুক্ত হওনি। যোগের পথ উত্তীর্ণ হয়ে এখনো তুমি লীন হওনি আমাতে। আমাকে চিনতে পারনি তোমার পরমাত্মারূপে। এখনো তুমি বলনি—”করিয্যে বচনং তব।” জীবের ‘আমি’র মায়া-আঁচল এখনো দুলছে তোমার চোখের সামনে। এখনো তোমাকে বলার সময় আসেনি—

“যৎ করোষি ষদশাসি যজ্জুহোসি দদাসি যৎ‍।
যৎ তপস্যসি কৌন্তেয় তৎ কুরুত্ব মদর্পণম্।।
শুভাশুভফলৈরেবং মোক্ষ্যসে কর্মবন্ধনৈঃ।
সন্ন্যাসযোগযুক্তাত্মা বিমুক্তো মামুপৈষ্যসি।।

সব আমাতে অর্পণ করার কথা আমাকে বলতে হবে না। তুমি যোগের পথে নিজেই আসবে সেই বোধে। সেই কৃপাটুকু তোমাকে করে পেতে হবে। করে পাওয়ার নামই কৃপা। স্বামী বিশুদ্ধানন্দ বলতেন : “ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, ‘এই মায়া বা অহং যেন মেঘের স্বরূপ। সামান্য মেঘের জন্য সূর্যকে দেখা যায় না—মেঘ সরে গেলেই সূর্যকে দেখা যায়। যদি গুরুর কৃপায় একবার অহংবুদ্ধি যায় তাহলে ঈশ্বরদর্শন হয়।’

“এই মায়া সরবে বিচারে, সরবে নিয়ত যুক্ত থাকার চেষ্টায়, গুরুর কৃপায়। শ্রীরামকৃষ্ণ উদাহরণ দিচ্ছেন—’আড়াই হাত দূরে শ্রীরামচন্দ্র, যিনি সাক্ষাৎ ঈশ্বর, মধ্যে সীতারূপিণী মায়ার ব্যবধান আছে বলে লক্ষ্মণরূপ জীব সেই ঈশ্বরকে দেখতে পান নাই।”

আমাদের অন্তরস্থ পরমাত্মাকে আমরা দেখতে পাই না কেন? জীবাত্মা আর পরমাত্মার মধ্যে এই মায়ার ব্যবধান। জীবাত্মার দেহকোষের অহংধূমে সব আচ্ছন্ন। আমি, আমি করে ‘ক্ষুদ্র আমি’ শৃগালের মতো মনোরণ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই ‘কাঁচা আমি’ না গেলে ‘পাকা আমি’র দেখা মিলবে না। আবার মজাটা এই—এই ‘কাঁচা আমি’ই খুঁজতে খুঁজতে সেই ‘পাকা আমি’র দরবারে গিয়ে হাজির হবে। শুধু অনুসন্ধানের ধারাটা পালটাতে হবে। বাইরের ওপর নির্ভর করলে হবে না। ইচ্ছাটা ভিতর থেকে আসা চাই। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, আমি কে, এইটি খুঁজতে গেলে তাঁকেই পাওয়া যায়। আমি কি মাংস, না হাড়, না মজ্জা, না মন, না বুদ্ধি? শেষে বিচারে দেখা যায় যে, আমি এসব কিছুই নই। ‘নেতি’, ‘নেতি’। আত্মাকে ধরবার ছোঁবার জো নাই। তিনি নির্গুণ নিরুপাধি।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বিশ্বরূপ দর্শন করালেন। করিয়ে বললেন, শোন সখা!

“ন বেদযজ্ঞাধ্যয়নৈৰ্ন দানৈ-
র্ন চ ক্রিয়াভিন তপোভিরুগ্রৈঃ
এবংরূপঃ শক্য অহং নৃলোকে
দ্রষ্টুং তদন্যেন কুরুপ্রবীর।।”

বিশ্বরূপ সংবরণ করে ভগবান অর্জুনকে বলছেন—হে কুরুশ্রেষ্ঠ! পৃথিবীতে মানুষ অনেক কাণ্ড করতে পারে। যেমন, চতুর্বেদ, অধ্যয়ন, যাগযজ্ঞ, যজ্ঞবিজ্ঞান নাড়াচাড়া, দানধ্যান, হোম প্রভৃতি শ্রৌতকর্ম বা চান্দ্রায়ণাদি কঠোর তপস্যা; কিন্তু এই বিশ্বরূপদর্শন সম্ভব হবে না। একমাত্র তুমিই দেখলে।

প্রশ্ন হলো—কেন অর্জুন একা দেখবেন? তাহলে আমরা কি হতাশ হব! কৃপা ছাড়া যদি দর্শন সম্ভব না হয় তাহলে যাগযজ্ঞ, সাধন-ভজনের কি প্রয়োজন! বিশ্বরূপ মানেটা কি? কি দেখলেন অর্জুন! সেই সত্যকে, যা দেখতে চেয়েছিলেন উপনিষদের ঋষি তাঁর বিনীত প্ৰাৰ্থনায়—

“হিরণ্ময়েণ পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম্।
তৎ ত্বং পূষপাবৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে।।”

আমি সাধক। আমার দর্শনকে আরো গভীরে নিয়ে যেতে চাই। হে জগৎকারণ সূর্য, জীবমাত্রেই তোমার কিরণস্পর্শে উদ্ভাসিত। তোমার কাছে সাতিশয় ঋণী। তোমার উদ্ভাসটুকুই তারা দেখে, তোমার তেজকে সমীহ করে। তাতে তাদের স্বভাব পালটায় না। তুমি তোমার মতো, দূর আকাশে দীপ্ত বলয়। আর আমরা আমাদের মতো—তোমার সৃষ্টিতে বিচরণশীল। কেউ জাগে হিংসা নিয়ে, কেউ জাগে প্রেম নিয়ে, কেউ জাগে ভীরুতা, নীচতা নিয়ে, কেউ জাগে জ্ঞান-বিজ্ঞান-ত্যাগ-তিতিক্ষা নিয়ে। স্ব স্ব ভাবে জাগরিত হয় তোমার উদার কিরণে। বাইরে তোমার প্রকাশ একটিমাত্র সত্যে-সে হলো উত্তাপ, জ্যোতি, দীপ্তি। যারা তোমার কাছে আসতে চায় তোমার দেওয়া শরীর নিয়ে তারা মুহূর্তে দগ্ধ হয়ে যাবে। এ কেমন পিতা! বহু যোজন দূর থেকে সৃষ্টিকে পালন করছেন। জ্যোতির্বলয়ে নিজের মুখ আচ্ছাদন করে রেখেছেন। সে-মুখ হলো এক মহাসত্যের মুখ। সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের অধিকর্তার মুখ। বিশ্বরূপ। আমি সাধক। অন্তরে তোমার প্রকাশ দেখতে চাই। বাইরে তোমার জ্যোতি তো দেখছিই, অন্তরে দেখতে চাই জ্ঞানপদ্মের উন্মেষ। দেহে তোমাকে ধারণ করা যাবে না। নামরূপ নিয়ে তোমার সত্যসদনে পৌঁছানো যাবে না। তুমি আসলে একটি স্নিগ্ধ পদ্ম। তুমি জীবন, তুমিই মরণ।

ভগবান যখন বলছেন—বিশ্বরূপ একমাত্র তুমিই দেখলে—তখন সেই দর্শন রূপান্তরিত হলো জ্ঞানে। জ্ঞান তখনি হয় যখন সত্য-দর্শন একটি পাত্রে ধৃত হয়। আধার চাই। যেকোন একজন মানবকে ধরতে হবে। ধারণ করতে হবে। অর্জুন হলেন সেই রিপোজিটারি অফ ট্রুথ। আমরা অর্জুন না হয় নাই হলাম। বিশ্বাসী হতে তো ক্ষতি নেই।

উপনিষদের ঋষি যখন বলছেন, নিজের মুখমণ্ডল থেকে তোমার জ্যোতির্বলয় সরাও, আমি তোমার সত্য মুখচ্ছবি দর্শন করতে চাই। সেই প্ৰাৰ্থনা নিজের উন্মোচনের প্রার্থনা। অহং-এর সীমাবদ্ধতা থেকে আমাকে মুক্তি দাও— তত্ত্ব, তথ্য, সত্য, জ্ঞানে। উপাধি থেকে নিরুপাধিতে।

ঠাকুর বলছেন : “একটা সুন্দর দেশ আছে। কেউ সেখানে গেছে, কেউ সেখানে যায়নি। এইবার যে গেছে সে বর্ণনা দিচ্ছে। সেই শোনাতেই আরেক জনের যাওয়া হয়ে যাচ্ছে। শর্ত একটাই। বিশ্বাস। অবিশ্বাসী হলে হবে না। তার্কিক হলে হবে না। তর্ক হলো তমো। নারদ যাচ্ছেন। একজন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি তো ভগবানের কাছ থেকে আসছেন, তিনি এখন কি করছেন দেখে এলেন।’ নারদ বললেন, ‘দেখে এলাম, তিনি ছুঁচের ফুটোর মধ্য দিয়ে হাতি গলাচ্ছেন।’ অবিশ্বাসী বললে, ‘যাঃ! তা কি করে সম্ভব।’ বিশ্বাসীর চোখে জল এসে গেল। বললে, ‘তা তো হতেই পারে। তাঁর পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়।’”

বিশ্বাস আর অনুভূতি যোগশরীরের দুটি পা। অনুভূতি কি রকম। মনের সুর সেই সুরে বাঁধা হয়েছে। কবীর দাস বলছেন :

“সাধো ইহ তনঠাঠ তম্বুরে কা
পাঁচ তত্ত্ব কা বনা তম্বুরা
তার লগা নব তুরে কা।
পেঁতে তার মরোরত খুঁটি
নিকসত রাগ হুজুরে কা।”

এই দেহের কাঠামো তম্বুরার মতো। পঞ্চ তত্ত্বে তৈরি তম্বুরায় নতুন তার লাগানো হয়। খুঁটির সঙ্গে সেই তার পেঁচিয়ে খুশিমত রাগ তৈরি করা যায়। ‘নিকসত রাগ হুজুরে কা।’ মন তৈরিই হলো সাধনের প্রধান শর্ত। সাধন করবে দেহ নয় মন। মনের ধারক দেহ, সেই কারণেই হঠযোগ। সুস্থ, নির্মল দেহে অনুভূতিপ্রবণ মন। কেমন অনুভূতি? ভক্তমালে আছে রতিবন্ত বাই-এর কথা। “রতিবন্ত নামে এক বাই পুরুষোত্তমে। বাল্যভাবে শ্রীকৃষ্ণচরণে মতি রমে।।” গ্রামে শ্রীভাগবত পাঠ হয়। রতিবন্তর ছেলে রোজ শুনতে যায়। আর যা শোনে তাই এসে মাকে শোনায়। একদিন উদুখলবন্ধন-আখ্যান শুনে এসে মাকে বলছে। মা যশোদা চঞ্চল শ্রীকৃষ্ণকে উদুখলের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধেছেন। রতিবন্ত শুনছেন। দুচোখে জল। “হা হা হেম সুকুমার কমলনয়ানে।/কেমনে বান্ধিল রানী দয়া নৈল মনে।/ইহা কহি অচেতন হইয়া পড়িলা।/পড়িতেই অইমনি প্রাণ ছুটি গেলা।।” রতিবন্তর এমনই সূক্ষ্ম অনুভূতি, বালক কৃষ্ণের বন্ধনদশার যন্ত্রণা তিনি সহ্য করতে পারলেন না। প্রাণত্যাগ করলেন।

কেমন অনুভূতি! ঠাকুর বলছেন : “চৈতন্যদেব যখন দক্ষিণে তীর্থভ্রমণ করছিলেন, দেখলেন, একজন গীতা পড়ছে। আরেক জন একটু দূরে বসে শুনছে, আর কাঁদছে—কেঁদে চোখ ভেসে যাচ্ছে। চৈতন্যদেব জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি এসব বুঝতে পারছ?’ সে বললে, ‘ঠাকুর! আমি এসব শ্লোক কিছু বুঝতে পারছি না।’ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তবে কেন কাঁদছ?’ ভক্তটি বললে, ‘আমি দেখছি অর্জুনের রথ, আর তার সামনে ঠাকুর আর অর্জুন কথা কচ্ছেন। তাই দেখে আমি কাঁদছি। ‘

অহঙ্কার থেকে অবিশ্বাস। ‘কুজা তোমায় কু বোঝায়। রাইপক্ষে বুঝায় এমন কেউ নাই।’ ‘নীচ আমি’ সদা সর্বদাই বোঝাতে চায়, তোমার বোঝাটাই ঠিক। এই ‘আমি’টাকে তাড়াতে হবে। কিভাবে? ঠাকুর বলছেন : “আমি তো যাবার নয়। তবে থাক শালা ‘দাস আমি’ হয়ে। সেব্য-সেবক ভাবই ভাল।” সে কেমন? ঠাকুর বলছেন : “রাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হনুমান, তুমি আমায় কিভাবে দেখ?’ হনুমান বললে, ‘রাম! যখন ‘আমি’ বলে আমার বোধ থাকে, তখন দেখি, তুমি পূর্ণ, আমি অংশ; তুমি প্রভু, আমি দাস। আর রাম! যখন তত্ত্বজ্ঞান হয়, তখন দেখি, তুমিই আমি, আমিই তুমি।’”

বিশ্বরূপ এইটাই—স্রষ্টার সঙ্গে মিশে আছি আমি। অর্জুন ভগবানেই রয়েছেন। বিশ্বরূপের এক রূপ। ঠাকুরের অসাধারণ উপমায়—”জল স্থির থাকলেও জল, তরঙ্গ হলেও জল। সাপ চুপ করে কুণ্ডলি পাকিয়ে থাকলেও সাপ—আবার তির্যগগতি হয়ে এঁকেবেঁকে চললেও সাপ। বাবু যখন চুপ করে আছে তখনো যে-ব্যক্তি—যখন কাজ করছে তখনো সেই ব্যক্তি। জীবজগৎকে বাদ দেবে কেমন করে! তাহলে যে ওজনে কম পড়ে। বেলের বিচি, খোলা বাদ দিলে সমস্ত বেলের ওজন পাওয়া যায় না।”

বেল আর বেলের বিচি, বড় সুন্দর উপমা। স্রষ্টার গর্ভেই সৃষ্টির লীলা। বিচির অহঙ্কারই ‘আমি’। আমি বিচি; কিন্তু জড়িয়ে আছি বেলের গর্ভে। যে- মুহূর্তে চেতনা এল দেখা গেল—

“নাহি সূর্য, নাহি জ্যোতিঃ, নাহি শশাঙ্ক সুন্দর,
ভাসে ব্যোমে ছায়াসম ছবি বিশ্ব-চরাচর।
অস্ফুট মন-আকাশে জগৎ সংসার ভাসে,
ওঠে ভাসে ডোবে পুনঃ ‘অহং’ স্রোতে নিরন্তর
ধীরে ধীরে ছায়াদল মহালয়ে প্রবেশিল
বহে মাত্র ‘আমি আমি’ এই ধারা অনুক্ষণ
সে ধারাও বন্ধ হলো শূন্যে শূন্য মিলাইল,
‘অবাঙ্মনসগোচরম্’ বোঝে প্রাণ বোঝে যার।।”

এই অনুভূতি স্বামীজীর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *