1 of 3

অনুগ্রহ

অনুগ্রহ

তাঁর কৃপা না থাকলে তাঁকে কি পাওয়া যায়? যায় না। মনই যাবে না। মন মেতে থাকবে বিষয়ে। কামিনী-কাঞ্চনে। মায়া জড়ানো এই পৃথিবী। পাঁচ ইন্দ্ৰিয় প্রবল। মানুষ কেন চাইবে তাঁকে। তিনি কে, সেই ধারণাটাই তো স্পষ্ট নয়। আর তাঁকে পেলেই বা কি হয়! মহা সংশয়ের মধ্যে বসবাস। মহাপ্রশ্ন মনে অঙ্কুরিত হতে হতেই গোরে যাবার সময় উপস্থিত। কি চেয়েছি, কি পেয়েছি, এই হিসেব মেলাবার ইচ্ছে যখন এল, তখন আর বেলা বেশি বাকি নেই। ছুটির ঘণ্টা বেজে গেছে। এখন চোখে আমার ছানি। রক্তে শর্করা। কণ্ঠে আমার বায়ু, পিত্ত, কফ। তখন শুধু ব্যাধির ভজনা। মনে এক বিষম হাহাকার—কবীরজীর দৌঁহায় যেমন আছে —

“কহা করউ কৈসে তরী ভব জলনিধি ভারী
রাখি রাখি মেরৈ বীঠুলা জনু সরণী তুমহারী।।”

–কি করব, ভয়ঙ্কর ভবসমুদ্র কি করে পার হব। হে আমার বিল, আমায় রক্ষা কর। আমি তোমার শরণাগত। শরণাগত হলে কি হবে, মনের বিকার তো ঘুচল না। সেই বিকার কি রকম? ঘর ছেড়ে বনে যাই, ফলমূল কুড়িয়ে খাই। তাতেই বা কি? পাপী মন। বিষয় বিষের বাসনা ছেড়েও ছাড়া যায় না। অনেক ভাবে আগলে রাখার চেষ্টা করি মনকে; কিন্তু মন বারেবারেই তাতে জড়িয়ে যায়। মূঢ় জীব। “অনিক জতন করি রাখি ঐ ফিরি ফিরি লপটাই। জীব অদিত জোবন গয়া কিছু কিয়া ন নীকা।।” ওরে যৌবন যে চলে গেল, ভাল তো কিছু করা হলো না। “যহু জিয়রা নিরমোলিকা কৌড়ি লগি বিকা।।” অমূল্য এই জীবন কড়িমূল্যে বিকিয়ে গেল। পরের দাসত্ব করে, পরিবারের ফাইফরমাস খেটে কর্তা চলে গেলেন ঘাটে।

কেন এমন হয়? কি ভুলিয়ে রাখে মানুষকে? কে সে? আছে, সে হলো আমার প্রারব্ধ। আমার সংস্কার। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলছেন : “দুরকম মাছি আছে—একরকম মধুমাছি, তারা মধু ভিন্ন আর কিছুই খায় না। আরেক রকম মাছি মধুতেও বসে, আর যদি পচা ঘা পায় তখনি মধু ফেলে পচা ঘায়ে গিয়ে বসে।”

মানুষ তাঁর কৃপা বলতে বোঝে নিজের বৈষয়িক উন্নতি! বাড়ি নেই, একটা বাড়ি চাই। ব্যবসায়ী হলে ব্যবসায়ে উন্নতি। চাকরি হলে তরতর প্রমোশন। নেতা হলে গদির স্বপ্ন। চাই ভার্যাং মনোরমাং। ছেলের প্রতিষ্ঠা, মেয়ের বিয়ে খুব ভাল ঘরে। বিলেত-ফেরত জামাই। নীরোগ শরীর। চিতায় ওঠার আগে পর্যন্ত ভোগের যন্ত্রপাতি যেন ঠিক থাকে। চোখ, কান, দাঁত, নাক। মাঝে মধ্যে অসুখ করুক ক্ষতি নেই, তাঁর কৃপায় যেন তিনদিনে চাঙ্গা হই। তিনি যেন বসে আছেন কোথাও, আমার ইচ্ছাপূরণের ঝুলি নিয়ে। যা চাইব তাই যেন পাই। পেলেই তিনি আছেন, না পেলে নেই। এমনকি লটারির টিকিট কেটে তিনবার কপালে ঠেকাই ‘মা, দশলাখ, মা, বিশলাখ।’ মা হাসেন—গাধা, আসল নকল চিনলি না! কোনটা সার, কোনটা অসার, কোনটা মায়া? এখন কেউ যদি বলেন—ও মশাই!

“যথা স্বপ্নে মুহূর্তে স্যাথ সংবৎসর শতভ্রমঃ।
তথা মায়া বিলাসোঽয়ং জায়তে জাগ্রতি ভ্ৰমঃ।।”

(যোগবাশিষ্ঠ) অমনি ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি। সংস্কৃতে কি ঝাড়ছ বাবা? কিছুই না মহাসাধকের উপলব্ধির সারাৎসার—এক মুহূর্ত কালের মধ্যে স্বপ্নে যেমন শতবৎসরের ভ্রম হয়, সেইরকম তুমি জেগে এই পৃথিবীকে যা দেখছ এই সংসার, সে আর কিছুই নয় মায়ার বিলাস, সব ঝুট হ্যায়। মিথ্যা ভ্ৰম। সঙ্গে সঙ্গে আমি সংসারের চাটনি চাটতে চাটতে বলব, ও বাবা ও তো বেদান্ত। সাধুসন্তের কারবার ওসবে আমার কি দরকার। আমি আমার ছেলে, বউ, চাকরি-বাকরি, প্যাজ-পয়জার নিয়ে বেড়ে আছি বাবা!

তখন যদি প্রশ্ন হয়, কি রকম বেড়ে আছ? এখন মনে হচ্ছে তো! এইবার বয়েসটা একটু বাড়তে দাও। কেমন তারপর বিশ্বরূপের মতো তুমি সংসারের আসল রূপ দেখবে। শতকরা নিরানব্বই জন যা দেখে।

“যাবদ্বিত্তোপাৰ্জনসক্তস্তাবন্নিজপরিবারোরক্তঃ।
পশ্চাদ্ধবতি জর্জরদেহে বার্তা পৃচ্ছতি কোঽপি ন গেহে।।” (শঙ্কর)

—যতদিন তোমার রোজগার, পরিবার পোষণের মতো ক্ষমতা, ততদিনই খাতির, বাবা। যেই তুমি জরদগব বৃদ্ধ হলে তখন একবার বাঁচার সুখটা দেখ! কেউ একবার ভুলেও তোমার খবর নিতে আসবে না। এমনকি তোমার প্রাণের স্ত্রীও নয়। পড়ে পড়ে কোঁত পাড়বে। পয়সাওলা ঘরের বুড়োদের আজকাল পাঠিয়ে দেয় বার্ধক্যাশ্রমে। খুব যখন ব্যামো, যখন মনে করবে বুড়ো এইবার টাসবে, ঠেলে দেবে নার্সিং হোমে। সেখান থেকে অবশ্য খুব ঘটা করে নিয়ে যাবে শ্মশানে। খুব ফুল চাপাবে। শ্রাদ্ধও করবে তেড়ে আবার কি? সে সম্ভাবনাও আছে, আমার সব করাই হয়তো ভস্মে ঘি ঢালা হলো। করেই গেলুম। উদয়াস্ত খেটেই মরলুম। সব সাজিয়ে গুছিয়ে সকলকে মৌতাতে রাখলুম, তারা কিন্তু আমাকে গ্রাহ্যই করলে না।

‘ওরা শুধু করে কোলাহল’ এই নিজেদের মধ্যে ঝগড়া খেয়োখেয়ি। অষ্টপ্রহর স্বার্থের সঙ্কীর্তন। শুধু দাও। চেও না কিছু। এমনকি শান্তিও না। বাবা, দিনান্তে ফিরেছি, একটু তিষ্ঠোতে দাও। না, তা হবে না। তোমার দেনা আমরা এইভাবেই শোধ করব। তুমি কি করেছ, না করেছ আমাদের দেখার দরকার নেই। কে-কাকে খাওয়ায়। ঈশ্বর আমাদের খাওয়াচ্ছেন। তখন ঈশ্বর। সংসার করেছ যখন এটা তো তোমার কর্তব্য।

তা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ একটি গল্প বলতেন। সংসারের স্বরূপ। মোহমুদ্গর গুরু শিষ্যকে কদিন ধরে খুব বোঝাচ্ছেন-দ্যাখ বাবা, ঈশ্বরই তোমার আপনার, আর কেউ তোমার আপনার নয়। শিষ্য অবুঝ, অবোধ। সে কেবলই বলে, আপনি কি বলছেন ঠাকুর! আজ্ঞে আমার মা, পরিবার এরা আমাকে কত যত্ন করেন। একদিন আমাকে দেখতে না পেলে চোখে অন্ধকার দেখেন। কত ভালবাসেন। গুরু বললেন, বাবা, ও তোমার মনের ভুল। আমি তোমায় দেখিয়ে দিচ্ছি। কেউ তোমার নয়। এই ঔষধের বড়ি কটা তোমার কাছে রেখে দাও। তুমি বাড়িতে গিয়ে খেয়ে শুয়ে থেকো। লোকে মনে করবে যে তোমার দেহত্যাগ হয়েছে কিন্তু তোমার সব বাহ্যজ্ঞান থাকবে। তুমি দেখতে, শুনতে সব পাবে; আমি সেইসময় গিয়ে পড়ব।

শিষ্য বাড়িতে এসে তাই করলে। বড়ি কটা খেয়ে ফেললে। খেয়ে অচৈতন্য হয়ে পড়ে রইল। মা, পরিবার, বাড়ির সকলে কান্নাকাটি শুরু করলে। এমন সময় গুরু এলেন কবিরাজের ছদ্মবেশে। মন দিয়ে সব শুনলেন। শুনে বললেন, আচ্ছা এর ঔষধ আছে। বেঁচে উঠবে আবার। তবে কথা আছে একটা। এই ওষুধটা আগে একজন আপনার লোককে খেতে হবে। তারপর ওকে দেওয়া যাবে। যে আপনার লোক এই বড়িটা খাবে, তার কিন্তু মৃত্যু হবে। তা এখানে তো ওঁর মা, পরিবার—সবাই রয়েছেন। একজন না একজন কেউ খাবেন নিশ্চয়। কেমন? এতে কোন সন্দেহ আছে। কবিরাজ সকলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

শিষ্য সব শুনছে। কবিরাজ মাকে ডাকলেন। মা আপনারই তো ছেলে, আপনি তাহলে ঔষধটা খান। মা তো ছেলের শোকে ধুলোয় গড়াগড়ি দিচ্ছেন। আর তেমনি কান্না। কবিরাজ বললেন, মা, আর তো কান্নার কিছু নেই। এই বড়িটা খেয়ে ফেলুন, ছেলে অমনি সঙ্গে সঙ্গে বেঁচে উঠবে। তবে আপনার এতে মৃত্যু হবে। মা ঔষুধের বড়িটি হাতে ধরে ভাবতে লাগলেন। অনেক ভেবেচিন্তে কেঁদে কেঁদে বললেন, বাবা, আমার যে আরো কয়েকটি ছেলেমেয়ে আছে। আমি চলে গেলে তাদের কি হবে। কে তাদের দেখবে, কে খাওয়াবে! আমার যে ওই একটাই অসুবিধে, বাবা।

তখন কবিরাজ ডাকলেন পরিবারকে। পরিবারও খুব কাঁদছে। কবিরাজ তার হাতে বড়িটি দিলেন। খেয়ে ফেল, মা। তুমি মরবে, তোমার স্বামী কিন্তু বেঁচে উঠবেন। পরিবার তখন কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ওগো, ওঁর যা হবার তা তো হয়েইছে গো—আমার অপোগণ্ডগুলোর এখন কি হবে, বল? কে ওদের বাঁচাবে? আমি কেমন করে এ ওষুধ খাই!

শিষ্যর তখন ওষুধের নেশা চলে গেছে। সে বুঝলে কেউ কারোর নয়। ধড়মড় করে উঠে গুরুর সঙ্গে চলে গেল। গুরু বললেন, এইবার বুঝলে তো, তোমার আপনার কেবল একজন—তিনি ঈশ্বর।

এই বোধটা কি করে আসবে। তাঁর কৃপায়। সে কৃপা আসবে গুরুর মাধ্যমে। তাহলে তো একটু এগোতে হয়। কষ্ট করে একটু সাধুসঙ্গ করতে হয়। যিনি হলফ করে বলতে পারেন—”তাঁকে দর্শন করা যায়। শুদ্ধ মন, শুদ্ধ বুদ্ধিতে দর্শন করা যায়। কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি থাকলে মন মলিন হয়।” তাহলে, এইবার বিচার। কামিনীতে কি আছে! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন : “লজ্জা হয় না। ছেলে হয়ে গেছে, আবার স্ত্রীসঙ্গ! ঘৃণা করে না—পশুদের মতো ব্যবহার! নাল, রক্ত, মল, মূত্র—এসব ঘৃণা করে না। যে ভগবানের পাদপদ্ম চিন্তা করে, তার পরমাসুন্দরী রমণী চিতার ভস্ম বোধ হয়। যে শরীর থাকবে না—যার ভিতর কৃমি, ক্লেদ, শ্লেষ্মা যত প্রকার অপবিত্র জিনিস, সেই শরীর নিয়ে আনন্দ! লজ্জা হয় না।” ঠাকুরের মহাপ্রয়াণের পর বরানগর মঠের গাছতলায় বসে স্বামীজী মাস্টারমশাইকে বলছেন : “নির্লিপ্ত সংসার বলুন আর যাই বলুন, কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ না করলে হবে না।” স্ত্রীসঙ্গে সহবাস করতে ঘৃণা করে না? যে স্থানে কৃমি, কফ, মেদ, দুর্গন্ধ—

“অমেব্যপূর্ণে কৃমিজাল সঙ্কুলে স্বভাব দুর্গন্ধ নিরন্তকান্তারে।
কলেবরে মূত্র পুরীষ ভাবিতে রমন্তি মূঢ়া বিরমন্তি পণ্ডিতাঃ।।”

যোগবাশিষ্ঠ তো সেই মানুষকে গর্দভই বলে দিলেন যে-

“বুধবাহপ্যত্যন্ত বৈরস্যং যঃ পদার্থেষু দুর্মতিঃ।
বধ্নাতি ভাবনাং ভুয়ো নরো নাসৌ স গর্দভঃ।।”

—বিষয় বিরস জেনেও যে দুর্মতি পুনরায় সেই বিষয়েতেই মজে, সে মানুষ নয়, সে একটা গাধা।

কামই মানুষকে সংসারে ফেলে কাঁঠালের আঠা মাখায়, আর কাম থেকেই কামিনী আর কামিনীর জন্যেই কাঞ্চন। ঠাকুর বলতেন, টাকায় কি হয়। চাল, ডাল, আটা, ময়দা, কাপড়, জামা, গাড়ি, বাড়ি। তারপর ভোগ বাড়ালেই ভোগ বাড়ে। টাকায় আসে অহঙ্কার। টাকার অহঙ্কার করতে নেই। যদি বল আমি ধনী, ধনীর আবার তারে বাড়া, তারে বাড়া আছে। সন্ধ্যার পর যখন জোনাকি পোকা ওঠে সে মনে করে আমি এই জগৎকে আলো দিচ্ছি; কিন্তু যেই নক্ষত্র উঠল, অমনি তার অভিমান চলে গেল। তখন নক্ষত্রেরা মনে করে আমরা জগৎকে আলো দিচ্ছি, কিন্তু পরে যখন চন্দ্র উঠল তখন নক্ষত্রেরা লজ্জায় মলিন হয়ে গেল। চন্দ্র মনে করলে আমার আলোয় জগৎ হাসছে। দেখতে দেখতে অরুণোদয় হলো তখন চন্দ্র মলিন হয়ে গেল। খানিক পরে আর দেখা গেল না। ধনীরা যদি এগুলি ভাবে, তাহলে আর তাদের ধনের অহঙ্কার থাকে না।

বরানগর মঠে বসে স্বামীজী মাস্টারমশাইকে বলছেন : “অনেক দুঃখকষ্ট পেয়ে তবে এই অবস্থা হয়েছে। মাস্টারমশাই আপনি দুঃখকষ্ট পাননি তাই— মানি দুঃখকষ্ট না পেলে রেসিগনেশন হয় না—অ্যাবসলিউট ডিপেন্ডেনস অন গড়।” আর শেষ কথাটি হলো—

“যাবন্নানুগ্রহ সাক্ষাজ্জয়তে পরমেশ্বরাৎ।
তাবন্ন সদগুরুং কশ্চিৎ সচ্ছাস্ত্রংবাপি নো লভেৎ।” (যোগবাশিষ্ঠ)

—যতদিন পর্যন্ত পরমেশ্বরের সাক্ষাৎ কৃপালাভ না হয় ততদিন সদ্‌গুরু বা সৎশাস্ত্রের আশ্রয় লাভ করা যায় না। অতঃপর শেষ কথা—সকলের ঠিক আসে না। আর না এলেই বা কী। সংসারে ঘোল খেয়ে—ফিরে চল আপন ঘরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

অনুগ্রহ

অনুগ্রহ

             এই-যে জগৎ হেরি আমি ,
             মহাশক্তি জগতের স্বামী ,
             এ কি হে তোমার অনুগ্রহ ?
             হে বিধাতা কহো মোরে কহো ।
     ওই - যে সমুখে সিন্ধু ,        এ কি অনুগ্রহবিন্দু ?
     ওই - যে আকাশে শোভে চন্দ্র সূর্য গ্রহ ,
               ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তব অনুগ্রহ ?
               ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্র একজন
               আমারে যে করেছ সৃজন ,
               এ কি শুধু অনুগ্রহ করে
               ঋণপাশে বাঁধিবারে মোরে ?
                করিতে করিতে যেন খেলা
                কটাক্ষে করিয়া অবহেলা ,
    হেসে ক্ষমতার হাসি অসীম ক্ষমতা হতে
                 ব্যয় কয়িয়াছ এক রতি
                 অনুগ্রহ করে মোর প্রতি ?
   শুভ্র শুভ্র জুঁই দুটি                ওই - যে রয়েছে ফুটি
   ও কি তব অতি শুভ্র ভালোবাসা নয় ?
            বলো মোরে , মহাশক্তিময় ,
ওই - যে জোছনা - হাসি    ওই - যে তারকারাশি ,
            আকাশে হাসিয়া ফুটে রয় ,
            ও কি তব ভালোবাসা নয় ?
            ও কি তব অনুগ্রহ - হাসি
    কঠোর পাষাণ লৌহময় ?
            তবে হে হৃদয়হীন দেব ,
            জগতের রাজ - অধিরাজ ,
            হানো তব হাসিময় বাজ ,
             মহা অনুগ্রহ হতে তব
            মুছে তুমি ফেলহ আমারে --
            চাহি না থাকিতে এ সংসারে ।
              ভালোবাসি আপনা ভুলিয়া ,
              গান গাহি হৃদয় খুলিয়া ,
              ভক্তি করি পৃথিবীর মতো ,
              স্নেহ করি আকাশের প্রায় ।
              আপনারে দিয়েছি ফেলিয়া
              আপনারে গিয়েছি ভুলিয়া
              যারে ভালোবাসি তার কাছে
              প্রাণ শুধু ভালোবাসা চায় । 

          সাক্ষী আছ তুমি অন্তর্যামী
          কতখানি ভালোবাসি আমি ,
   দেখি যবে তার মুখ       হৃদয়ে দারুণ সুখ
           ভেঙে ফেলে হৃদয়ের দ্বার ,
            বলে , “ এ কী ঘোর কারাগার !” 

             প্রাণ বলে , “ পারি নে সহিতে ,
             এ দুরন্ত সুখেরে বহিতে । ”
    আকাশে হেরিলে শশী আনন্দে উথলি উঠি
             দেয় যথা মহাপারাবার
             অসীম আনন্দ উপহার ,
       তেমনি সমুদ্র - ভরা আনন্দ তাহারে দিই
              হৃদয় যাহারে ভালোবাসে ,
       হৃদয়ের প্রতি ঢেউ উথলি গাহিয়া উঠে
             আকাশ পুরিয়া গীতোচ্ছ্বাসে ।
       ভেঙে ফেলি উপকূল    পৃথিবী ডুবাতে চাহে ,
             আকাশে উঠিতে চায় প্রাণ --
      আপনারে ভুলে গিয়ে হৃদয় হইতে চাহে
                 একটি জগতব্যাপী গান ।
                 তাহারে কবির অশ্রু হাসি
                দিয়েছি কত - না রাশি রাশি ,
                তাহারি কিরণে ফুটিতেছে
          হৃদয়ের আশা ও ভরসা
                  তাহারি হাসি ও অশ্রুজল
          এ প্রাণের বসন্ত বরষা । 

                  ভালোবাসি , আর গান গাই
                কবি হয়ে জন্মেছি ধরায়
        রাত্রি এত ভালো নাহি বাসে ,
        উষা এত গান নাহি গায় । 

                ভালোবাসা স্বাধীন মহান ,
        ভালোবাসা পর্বতসমান ।
        ভিক্ষাবৃত্তি করে না তপন
        পৃথিবীরে চাহে সে যখন --
        সে চাহে উজ্জ্বল করিবারে ,
        সে চাহে উর্বর করিবারে ,
        জীবন করিতে প্রবাহিত ,
                কুসুম করিতে বিকশিত ।
        চাহে সে বাসিতে শুধু ভালো
        চাহে সে করিতে শুধু আলো
        স্বপ্নেও কি ভাবে কভু ধরা ,
        তপনেরে অনুগ্রহ করা ?
        যবে আমি যাই তার কাছে
        সে কি মনে ভাবে গো তখন
                 অনুগ্রহ ভিক্ষা মাগিবারে
                 এসেছে ভিক্ষুক একজন ?
                 অনুগ্রহ পাষাণমমতা
         করুণার কঙ্কাল কেবল ,
         ভাবহীন বজ্রে গড়া হাসি --
                  স্ফটিককঠিন অশ্রু - জল ।
                   অনুগ্রহ বিলাসী গবিত ,
         অনুগ্রহ দয়ালু - কৃপণ --
          বহু কষ্টে অশ্রুবিন্দু দেয়
         কাছে যবে আসিবারে চায়
          প্রণয় বিলাপ করি উঠে --
          গীতগান ঘৃণায় পলায় । 

          হে দেবতা , অনুগ্রহ হতে
                  রক্ষা করো অভাগা কবিরে ,
         অপযশ অপমান দাও --
         দুঃখ জ্বালা বহিব এ শিরে ।
                 সম্পদের স্বর্ণকারাগারে ,
         গরবের অন্ধকার - মাঝ ,
         অনুগ্রহ রাজার মতন
         চিরকাল করুক বিরাজ ।
        সোনার শৃঙ্খল ঝংকারিয়া
         গরবের স্ফীত দেহ লয়ে
         অনুগ্রহ আসে নাকো যেন
         আমাদের স্বাধীন আলয়ে । 

         গান আসে ব ' লে গান গাই ,
                 ভালোবাসি ব ' লে ভালোবাসি ,
         কেহ , যেন মনে নাহি করে
         মোরা কারো কৃপার প্রয়াসী ।
         নাহয় শুনো না মোর গান ,
         ভালেবাসা ঢাকা রবে মনে ।
        অনুগ্রহ করে এই কোরো --
        অনুগ্রহ কোরো না এ জনে ।
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *