1 of 3

আপনি আর আমি

আপনি আর আমি

ঠাকুর! যত আমাকে কষ্ট দেবেন ততই আমার সুখ; কারণ, ততই আমি আপনাকে ডাকব, ‘ত্রাহি ত্রাহি’। ভোগ আমার ‘আমি-রোগ’ বাড়িয়ে তুলবে। আমার ‘হাম্বা হাম্বা রবে সবাই অতিষ্ঠ হবে। ঘোর তামসিকতায় আমি আকণ্ঠ নিমজ্জিত হব। বিস্মৃত হব আপনাকে। মাঝে মাঝে আমার ভয় আসবে, এই বুঝি আমার ভোগের কাঠামো ভেঙে পড়ল। তাগা, তাবিজ পরব, মন্দিরে গিয়ে পুজো চড়াব সকাম প্রার্থনায়—’আমাকে আরো দাও, আরো দাও।’ আমি হিসেবী হব, কৃপণ হব, নীচ হব, স্বার্থপর হব। মানুষকে ঘৃণা করতে শিখব। ঘৃণার বিনিময়ে আমি ঘৃণাই পাব। একদল স্বার্থান্বেষী স্তাবক আমাকে ঘিরে থাকবে। আমি তোষামোদ প্রিয় হব। অহঙ্কারে লঘু-গুরু জ্ঞান হারাব। ক্রমশই আমি আপনার সান্নিধ্য থেকে দূরে, আরো দূরে সরে যাব। জীবনের প্রহরে প্রহরে নিঃসঙ্গ শৃগালের মতো চিৎকার করব—হুক্কা হুয়া, কেয়া হুয়া। আপনি হাসতে হাসতে বলবেন, ‘কুছ নেহি হুয়া বেটা, ভবরোগের শিকার হয়েছ। সত্ত্বগুণ হারিয়েছ। তোমাকে তমো-শৃগালে ধরেছে। তুমি পালে ঢুকেছ। প্রহরে প্রহরে চিৎকার করতে করতে একদিন দেখবে জীবন ভোর হয়ে গেছে। তখন আর তুমি নেই। পড়ে আছে তোমার শেষ মুহূর্তের আক্ষেপ।’ মায়ামৃগের পিছনে ছুটেছি। ধরতে পারিনি। ক্লান্ত, ক্ষত-বিক্ষত হয়ে চলে গেছি জন্মচক্রে। আবার ফিরতে হবে, কোথায়, কোনখানে, কি অবস্থায় তা তো জানি না। অতৃপ্তি নিয়ে গেছি, ফিরতে হবে অতৃপ্ত আত্মা নিয়ে।

আপনি আমাকে যত রিক্ত করবেন, ততই আমি আপনার কণ্ঠস্বর স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর শুনতে পাব। শুনতে পাব করুণামাখা কণ্ঠে আপনি আমাকে বলছেন : “ঈশ্বরের নিয়ম যে, পাপ করলে তার ফল পেতে হবে। লঙ্কা খেলে, তার ঝাল লাগবে না? সেজবাবু (মথুরবাবু) বয়সকালে অনেক রকম করেছিল, তাই মৃত্যুর সময় নানারকম অসুখ হলো। কম বয়সে এত টের পাওয়া যায় না। কালীবাড়িতে ভোগ রাঁধবার অনেক সুঁদরী কাঠ থাকে। ভিজে কাঠ প্রথমটা বেশ জ্বলে যায়, তখন ভিতরে যে জল আছে, টের পাওয়া যায় না। কাঠটা পোড়া শেষ হলে যত জল পিছনে ঠেলে আসে ও ফ্যাচফ্যাচ করে উনুন নিভিয়ে দেয়। তাই কাম, ক্রোধ, লোভ—এসব থেকে সাবধান হতে হয়। দেখ না, হনুমান ক্রোধ করে লঙ্কা দগ্ধ করেছিল, শেষে মনে পড়ল অশোকবনে সীতা আছেন, তখন ছটফট করতে লাগল, পাছে সীতার কিছু হয়।

আমি অমনি সচেতন হব। প্রথম বয়সের অনাচার ডেকে আনবে শেষ জীবনের যন্ত্রণাদায়ক যতেক ব্যাধি। কাম, ক্রোধ, লোভ যৌবনকে যেন সিক্ত কাষ্ঠখণ্ডে পরিণত না করে। তখন আমি ফুরফুর করে জ্বলব ঠিকই, আর শেষ জীবনে দেখব, নিবু নিবু উনুনের চোখ জ্বালানো ধোঁয়া। যত বিত্ত, যত প্ৰতিপত্তি ততই কাম, ক্রোধ, লোভের বাড়াবাড়ি। তার চেয়ে বিত্ত যাক, সত্ত্ব থাক। আমার সদসৎ বিচার থাক। সৎ—নিত্য পদার্থ অর্থাৎ ঈশ্বর। অসৎ অর্থাৎ অনিত্য। অসৎ পথে মন গেলেই বিচার করতে হয়। হাতি পরের কলাগাছ খেতে শুঁড় বাড়ালে সেইসময় মাহুত ডাঙশ মারে। সেই মাহুতরূপী বিচার যেন সদা জাগ্রত থাকে। ভোগে থাকলে বিচার শুয়ে পড়ে।

ঠাকুর! আমি কাঁদতে চাই। কেন জানেন? আপনি বলেছেন : “তাঁর কাছে কাঁদতে হয়।” দেহ, পরিবেশ, পরিস্থিতি যত আমাকে চাবকাবে আমি তখন সেই সীমাহীন শূন্যতায় কেবলই কাঁদব। নিত্যকে ধরার জন্যে আকুলি-বিকুলি করব। তখন আমার জীবনে হয়তো ফলতে পারে আপনার কথা—”তাঁর কাছে কাঁদতে হয়। মনের ময়লাগুলো ধুয়ে গেলে তাঁর দর্শন হয়। মনটি যেন মাটি- মাখানো লোহার ছুঁচ, ঈশ্বর চুম্বক-পাথর, মাটি না গেলে চুম্বক-পাথরের সঙ্গে যোগ হয় না। কাঁদতে কাঁদতে ছুঁচের মাটি ধুয়ে যায়। ছুঁচের মাটি অর্থাৎ‍ কাম, ক্রোধ, লোভ, পাপবুদ্ধি, বিষয়বুদ্ধি। মাটি ধুয়ে গেলেই চুঁচকে চুম্বক-পাথরে টেনে লবে—অর্থাৎ ঈশ্বরদর্শন হবে। চিত্তশুদ্ধি হলে তবে তাঁকে লাভ হয়। জ্বর হয়েছে, দেহেতে রস অনেক রয়েছে তাতে কুইনাইনে কি কাজ হবে।”

এই চিত্তশুদ্ধির জন্যেই আমি জ্বালা-যন্ত্রণায় থাকতে চাই। মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে চাই—আপনি ছাড়া আমার কেউ নেই। আর তখনি আমার সেই চেতনা জাগবে—”বদ্ধ জীবেরা সংসারে বদ্ধ হয়েছে, হাত-পা বাঁধা। আবার মনে করে যে, সংসারে ঐতেই সুখ হবে, আর নির্ভয়ে থাকবে। জানে না যে, ওতেই মৃত্যু হবে। বদ্ধজীব যখন মরে তার পরিবার বলে, তুমি তো চললে, আমার কি করে গেলে? আবার এমনি মায়া যে, প্রদীপটাতে বেশি সলতে জ্বললে বদ্ধজীব বলে, তেল পুড়ে যাবে সলতে কমিয়ে দাও। এদিকে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে রয়েছে!”

এই হাত-পা বাঁধা অবস্থা থেকে আমি বেরিয়ে আসতে চাই। আমি জীবমুক্তির প্রয়াসী। আমার যেন সম্যক সেই বোধ হয়—”জীব যেন ডাল, জাঁতার ভিতর পড়েছে; পিষে যাবে।” নিষ্কৃতির পথ? আপনিই তো বলে দিয়েছেন—”তবে যেকটি ডাল খুঁটি ধরে থাকে, তারা পিষে যায় না। তাই খুঁটি অর্থাৎ ঈশ্বরের শরণাগত হতে হয়। তাঁকে ডাক, তাঁর নাম কর তবে মুক্তি। তা নাহলে কালরূপ জাঁতায় পিষে যাবে।” আপনিই আমার সেই খুঁটি। মনের সেই অবস্থায় পৌঁছাতে চাই, যে-অবস্থায় মন মুক্তির অনুগামী হবে। সেটা কি? সেও তো আপনি বলেছেন, “ঈশ্বরের কৃপায় তীব্র বৈরাগ্য হলে, আসক্তি থেকে নিস্তার হতে পারে।” সে-বৈরাগ্য কেমন? “তীব্র বৈরাগ্য কাকে বলে? হচ্ছে হবে, ঈশ্বরের নাম করা যাক—এসব মন্দ বৈরাগ্য। যার তীব্র বৈরাগ্য, তার প্রাণ ভগবানের জন্য ব্যাকুল। মায়ের প্রাণ যেমন পেটের ছেলের জন্য ব্যাকুল, যার তীব্র বৈরাগ্য, সে ভগবান ভিন্ন আর কিছু চায় না।“

সে সংসারকে কি দেখে ঠাকুর?

“সংসারকে পাতকুয়া দেখে; তার মনে হয়, বুঝি ডুবে গেলুম। আত্মীয়দের কালসাপ দেখে, তাদের কাছ থেকে পালাতে ইচ্ছা হয়; আর পালায়ও। বাড়ির বন্দোবস্ত করি, তারপর ঈশ্বরচিন্তা করব—একথা ভাবেই না। ভিতরে খুব রোখ।”

সংসার যদি আদর-আপ্যায়ন করে আচারের মতো করে রাখে তাহলেই তো আমার সর্বনাশ! সংসার আমাকে যত ভাবে পারে চাবকাক। উঠতে কোস্তা, বসতে কোস্তা। আমার সব মোহ ঘুচে যাক। তীব্র ব্যাকুলতায় আমি যেন ছটফট করি। কিরকম? “কর্ম গেলে কেরানির যেমন ব্যাকুলতা হয়। সে যেমন রোজ অফিসে অফিসে ঘোরে, আর জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁগা কোন কর্মখালি হয়েছে? ব্যাকুলতা হলে ছটফট করে—কিসে ঈশ্বরকে পাব!”

“গোঁপে চাড়া, পায়ের উপর পা দিয়ে বসে আছেন, পান চিবুচ্ছেন, কোন ভাবনা নেই—এরূপ অবস্থা হলে ঈশ্বরলাভ হয় না।”

ঠাকুর, আপনি আমার আপাতসুখের কেল্লা ভেঙে চুরমার করে দিন। আপনার হাত ধরে বেরিয়ে পড়ি। ধন নয়, জন নয়, শুধু আপনি আর আমি। নির্জন, নিঃসীম প্রান্তরে দুই পথিক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *