1 of 3

“আপনাতে আপনি থেকো মন”

“আপনাতে আপনি থেকো মন”

“আর কোন মিঞার কাছে যাইব না।”

স্বামীজী প্রমদাবাবুকে লিখছেন (৩ মার্চ ১৮৯০)। পরিব্রাজক বিবেকানন্দের ঠিকানা তখন গাজীপুর। মহাযোগী পওহারীজীর কাছ থেকে স্বামীজী কিছু আধ্যাত্মিক সম্পদ লাভ করার চেষ্টা করেছিলেন। ভেবেছিলেন, এমন কিছু পাবেন, যা তিনি ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে পাননি। এমন ইচ্ছা হওয়ার কারণটা কি! নিজেই বলছেন ঐ চিঠিতে : “কঠোর বৈদান্তিক মত সত্ত্বেও আমি অত্যন্ত নরম প্রকৃতির লোক। উহাই আমার সর্বনাশ করিতেছে। একটুকুতেই এলাইয়া যাই।” প্রথম আবেগে ভেবেছিলেন এক। হলো আরেক। কেন গাজীপুরে এলেন! একটি চিঠিতে লিখছেন : “কিন্তু যেজন্য আসিয়াছি—অর্থাৎ বাবাজীকে দেখা—তাহা এখনো হয় নাই।” (২৪ জানুয়ারি ১৮৯০) কয়েকদিন পরেই তিনি সেই যোগীবরের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। তাঁর বাড়ি দেখা হলো, কিন্তু তাঁর সঙ্গে দেখা হলো না। “পওহারী বাবার বাড়ি দেখিয়া আসিয়াছি। চারিদিকে উচ্চ প্রাচীর, ইংরেজী বাংলার মতন, ভিতরে বাগান আছে, বড় বড় ঘর, Chimney & c। কাহাকেও ঢুকিতে দেন না, ইচ্ছা হইলে দ্বারদেশে আসিয়া ভিতর থেকে কথা কন মাত্র। একদিন যাইয়া বসিয়া বসিয়া হিম খাইয়া ফিরিয়া আসিয়াছি।” (৩০ জানুয়ারি ১৮৯০)

এর পরদিনই স্বামীজী লিখছেন : “বাবাজীর সহিত দেখা হওয়া বড় মুশকিল, তিনি বাড়ির বাহিরে আসেন না, ইচ্ছা হইলে দ্বারে আসিয়া ভিতর হইতে কথা কন। অতি উচ্চ প্রাচীরবেষ্টিত উদ্যান-সমন্বিত . এবং চিমনিদ্বয়শোভিত তাঁহার বাটী দেখিয়া আসিয়াছি, ভিতরে প্রবেশের ইচ্ছা নাই। লোকে বলে, ভিতরে গুফা অর্থাৎ তয়খানা গোছের ঘর আছে, তিনি তন্মধ্যে থাকেন; কি করেন তিনিই জানেন, কেহ কখনো দেখে নাই। একদিন যাইয়া, অনেক হিম খাইয়া বসিয়া বসিয়া চলিয়া আসিয়াছি, আরো চেষ্টা দেখিব।… এখানকার বাবুরা ছাড়িতেছেন না, নহিলে বাবাজী দেখিবার সখ আমার গুটাইয়াছে।” (৩১ জানুয়ারি ১৮৯০)

দুটো মনের লড়াই চলেছে, এক মন ঠাকুরে নিবেদিত। তিনিই তো সব, আবার কেন! কিন্তু আরেক মনে চির-অনুসন্ধিৎসা, দেখাই যাক না, নতুন কি পাওয়া যায়! একটা শূন্যতার বোধও ভিতরে রয়েছে, শ্রীরামকৃষ্ণ নরশরীর সম্বরণ করেছেন। ‘নরেন’ বলে স্নেহ-সম্বোধন আর শোনা যাবে না। সর্বোপরি স্বামীজী হলেন এক উদার অধ্যাত্মবিজ্ঞানী। সব মত, সব পথ দেখতে চান। অন্তরালে ঠাকুর হাসছেন। রাশ একটু আলগা করে রেখেছেন। নরেন কারো নির্দেশে চলার পাত্র নয়। সে দেখবে, সে সিদ্ধান্তে আসবে। নিজের পথ নিজেই তৈরি করে নেবে। সেই কারণে পওহারীপর্ব আরো কিছুদূর এগোল! স্বামীজী তাঁর দর্শন পেলেন। স্বামীজীর উচ্ছ্বাস প্রকাশ পেল পরবর্তী পত্রে : “ইনি অতি মহাপুরুষ—বিচিত্র ব্যাপার, এবং এই নাস্তিকতার দিনে ভক্ত এবং যোগের অত্যাশ্চর্য ক্ষমতার অদ্ভুত নিদর্শন। আমি ইঁহার শরণাগত হইয়াছি, আমাকে আশ্বাসও দিয়াছেন, সকলের ভাগ্যে ঘটে না। বাবাজীর ইচ্ছা—কয়েক দিবস এই স্থানে থাকি, তিনি উপকার করিবেন। অতএব এই মহাপুরুষের আজ্ঞানুসারে দিনকয়েক এস্থানে থাকিব।” (৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৯০)

এইবার বলরামবাবুকে স্বামীজী লিখছেন : “অতি আশ্চর্য মহাত্মা! বিনয় ভক্তি এবং যোগমূর্তি। আচারী বৈষ্ণব কিন্তু দ্বেষবুদ্ধিরহিত। মহাপ্রভুতে বড় ভক্তি। পরমহংস মহাশয়কে বলেন, ‘এক অবতার থে।’ আমাকে বড় ভালবাসিয়াছেন। তাঁহার অনুরোধে কিছুদিন এস্থানে আছি। ইনি ২/৬ মাস একাদিক্রমে সমাধিস্থ থাকেন। বাঙ্গলা পড়িতে পারেন। পরমহংস মশায়ের ফটোগ্রাফ রাখিয়াছেন। সাক্ষাৎ এখন হয় না। দ্বারের আড়াল থেকে কথা কহেন। এমন মিষ্ট কথা কখনো শুনি নাই।… ইঁহার জন্য একখানি চৈতন্যভাগবত পত্রপাঠ যেথায় পাও পাঠাইবে।… এরও একজন হৃদে (অর্থাৎ বড় ভাই) কাছে আছে—সেও বাটীতে ঢুকিতে পায় না। তবে হৃদের মতো… নহে। চৈতন্যমঙ্গল যদি ছাপা হইয়া থাকে তাহাও পাঠাইও। ইনি গ্রহণ করিলে তোমার পরম ভাগ্য জানিবে। ইনি কাহারও কিছু লয়েন না। কি খান, কি করেন কেহই জানে না। আমি এস্থানে আছি কাহাকেও বলিও না ও আমাকেও কাহারও খবর দিবে না। আমি বড় কাজে বড় ব্যস্ত।” (৬ ফেব্রুয়ারি ১৮৯০)

স্বামীজী একটা ঘোরে আছেন। নিজের শরীর ভাল নয়। লাম্বাগোয় (Lumbago) কষ্ট পাচ্ছেন। ম্যালেরিয়ার বিষ তো শরীরে রয়েছেই; কিন্তু পওহারীবাবার স্পেল কাজ করছে। প্রমদাবাবুকে লিখছেন : “আগুন বাহির হয়—এমন অদ্ভুত তিতিক্ষা এবং বিনয় কখনো দেখি নাই। কোন মাল যদি পাই, আপনার তাহাতে ভাগ আছে নিশ্চিত জানিবেন।” (১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৯০)

এই পর্যায় পর্যন্ত আসার পরই ঠাকুর তাঁর অদৃশ্য খেলা খেললেন। রাশ টেনে ধরলেন। ঘটনাচক্র ঘুরে গেল, প্রমদাবাবুকে স্বামীজী লিখছেন : “কিন্তু এখন দেখিতেছি—উলটা সমঝুলি রাম! কোথায় আমি তাঁহার দ্বারে ভিখারি, তিনি আমার কাছে শিখিতে চাহেন! বোধহয়—ইনি এখনো পূর্ণ হয়েন নাই, কর্ম, এবং ব্রত এবং আচার অত্যন্ত, এবং বড় গুপ্তভাব। সমুদ্র পূর্ণ হইলে কখনো বেলাবদ্ধ থাকিতে পারে না, নিশ্চিত।” অবশেষে উপলব্ধি

“আর কোন মিঞার কাছে যাইব না—

“আপনাতে আপনি থেকো মন, যেও নাকো কারু ঘরে,
যা চাবি তাই বসে পাবি, খোঁজ নিজ অন্তঃপুরে।
পরম ধন ঐ পরশমণি, যা চাবি তাই দিতে পারে
এমন কত মণি পড়ে আছে চিন্তামণির নাচদুয়ারে।।”

ঠাকুর তাঁর প্রিয় সন্তানকে ভারত-পরিক্রমায় ঠেলে বের করেছিলেন দুটি কারণে—অভিজ্ঞতা সঞ্চয় আর বিশ্বাস দৃঢ় করার জন্য। সব ঠাঁই ঘুরে এসে এক ঠাঁয়ে পাকা। ঘুঁটি পাকা করার কারণে। স্বামীজীর অবশেষ সিদ্ধান্ত—

“রামকৃষ্ণের জুড়ি আর নাই, সে অপূর্ব সিদ্ধি, আর সে অপূর্ব অহেতুকী দয়া, সে intense sympathy বদ্ধজীবনের জন্য—এ-জগতে আর নাই। হয়, তিনি অবতার—যেমন তিনি নিজে বলিতেন, অথবা বেদান্তদর্শনে যাঁহাকে নিত্যসিদ্ধ মহাপুরুষ—’লোকহিতায় মুক্তোঽপি শরীরগ্রহণকারী’ বলা হইয়াছে, নিশ্চিত নিশ্চিত ইতি মে মতিঃ, এবং তাঁহার উপাসনাই পাতঞ্জলোক্ত ‘মহাপুরুষ- প্ৰণিধানাদ্বা’।

“তাঁহার জীবদ্দশায় তিনি কখনো আমার প্রার্থনা গরমঞ্জুর করেন নাই— আমার লক্ষ অপরাধ ক্ষমা করিয়াছেন, এত ভালবাসা আমার পিতামাতায় কখনো বাসেন নাই। ইহা কবিত্ব নহে, অতিরঞ্জিত নহে, ইহা কঠোর সত্য এবং তাঁহার শিষ্যমাত্রেই জানে। বিপদে প্রলোভনে ‘ভগবান রক্ষা কর’ বলিয়া কাঁদিয়া সারা হইয়াছি—কেহই উত্তর দেয় নাই—কিন্তু এই অদ্ভুত মহাপুরুষ বা অবতার বা যাই হউন, নিজ অন্তর্যামিত্বগুণে আমার সকল বেদনা জানিয়া নিজে ডাকিয়া জোর করিয়া সকল অপহৃত করিয়াছেন। যদি আত্মা অবিনাশী হয়—যদি এখনো তিনি থাকেন, আমি বারংবার প্রার্থনা করি—হে অপারদয়ানিধে, হে মমৈকশরণদাতা রামকৃষ্ণ ভগবান, কৃপা করিয়া…” ইত্যাদি।

ঠাকুর চাইতেন—নিজের বিচার, চাইতেন পরীক্ষা। তাঁর নিজের ভাষায়— আঁট। বলতেন, আঁট থাকা চাই। বলতেন, টল থেকে অটলে যাও। তিনি পছন্দ করতেন—সার্চ। খোঁজ। উচ্ছ্বাসের ধারায় খুলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সেই কারণে, সমঝে ধর। ধাক্কা খেতে খেতে এস। বড় সুন্দর উপমা, একজনকে খোঁজা হচ্ছে। মালিককে। তিনি বসে আছেন অন্ধকার ঘরে। অন্ধকারে খুঁজছেন। এক-একটা জিনিস স্পর্শ করছেন—চেয়ার, টেবিল, টুল, খাটের বাজু। না, এ নয়, এ নয়। হঠাৎ হাত গিয়ে পড়ল হাঁটুতে—এই তো বাবু, বসে আছেন চেয়ারে।

স্বামীজীর সেই অন্বেষণই শেষ হলো পরম উপলব্ধিতে—

“রামকৃষ্ণের জুড়ি আর নাই!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *