১৫. সুন্দরবনে যেভাবে শুয়োরের দল জায়গা করে নিলো

সুন্দরবনে যেভাবে শুয়োরের দল জায়গা করে নিলো

এক সময় নামের মতোই সুন্দর ছিল সুন্দরবন। সেই বনের পশু-পাখি খুব একটা চিন্তা-ভাবনা না করেই দিনাতিপাত করতো। বনের রাজা বাঘ মহাসুখে ঘুরে বেড়াতে নিজের রাজত্বে। সুন্দর সুন্দর হরিণের দল নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে দেখতে বনের সৌন্দর্য। খেলাধুলা করে তাদের দিন যে কীভাবে কেটে যেতো বুঝতেই পারতো না। বানর-হনুমান-উল্লুকের দল বাঁদরামি করতো মনের আনন্দে। বনগরুরা দল বেঁধে ঘুরে বেড়াতো এখানে সেখানে। গাছে গাছে হাজারো পাখি, কীট-পতঙ্গের মেলা, আর মৌমাছির দল ঝাঁক বেঁধে চাক তৈরি করতো এ-গাছে ও-গাছে। জলে কুমীর সাঁতার কাটতো, আর নাম জানা-নাজানা মাছেরা গিজগিজ করতো জলাশয়গুলোতে। বনটি পৃথিবীর সবচাইতে সেরা আর সুন্দর না হলেও এর অধিবাসীরা একে দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ বন বলেই মনে করতো। তাদের বিশ্বাস ছিল এ পৃথিবীর আর কোথাও এমন একটিও বন নেই!

তো, এই বনে সবার নিজস্ব জায়গা থাকলেও শূয়োরদের কোনো নির্দিষ্ট স্থান ছিল না। তারা এখানে ওখানে বিচ্ছিন্নভাবে ঘুরে বেড়াতো অনেকটা অনাহূত যাযাবরের মতো। তাদের সংখ্যাও ছিল বেশ কম, শক্তিতেও ছিল দুর্বল কিন্তু তার চাইতেও বড় কথা, বনের কেউ তাদেরকে পছন্দ করতো না।

একটা শূয়োর হয়তো আরাম করার জন্য চমৎকার একটি গাছের নিচে গিয়ে বিশ্রাম নিতে গেল সঙ্গে সঙ্গে সেই গাছের পাখ-পাখালি আর অন্য পশুরা তাদের তাড়িয়ে দিতো। মহাশক্তিশালী বাঘের ধারেকাছেও তারা ঘেষতে পারতো না। বনগরুরাও শিং উঁচিয়ে তেড়ে আসতো তাদের দেখামাত্র। এমনকি বনের সবচাইতে নিরীহ প্রাণী হরিণদের আবাসস্থলের কাছাকাছি স্বচ্ছ কোনো জলের হ্রদ দেখে তৃষ্ণা মেটাতে গেলেও হরিণের দল তাদের দুরদুর করে তাড়িয়ে দিতো সেখান থেকে। এমনই ছিল তাদের অবস্থা। নিজেদের কোনো আবাস নেই। দল বেঁধে কোথাও আস্তানা গাড়বে তারও কোনো উপায় নেই। সবার নিজস্ব ঠিকানা থাকলেও তাদের কোনো স্থান ছিল না সেই বনে। এই দেখে দেখে সুন্দর নামটার প্রতিই তাদের বিরাগ তৈরি হয়ে যায়।

এভাবেই চলছিল সবকিছু, কিন্তু একদিন সবচাইতে প্রবীণ এক শূয়োর, যাকে শূয়োররা সবাই বেশ সম্ভ্রম করে, শূয়োরদের মধ্যে যে অধিকতর শূয়োর, সেই বয়োবৃদ্ধ রতই শূয়োরদের একটি মহাসভার ডাক দিলো। বনের সব বিচ্ছিন্ন শূয়োর গোপনে নির্জন এক জায়গায় গিয়ে মিলিত হলো নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে। কালো-সাদা-বাদামি, দাঁতাল, বুনো আর নাদুস নুদুস, সব ধরণের শূয়োরই হাজির হলো সেই সভায়। রতইকে সবাই চেনে, জানে, মানে। তার বুদ্ধিমত্তার উপরে সবার আস্থা আছে।

রতই সময় মতো এসে হাজির হলো মহাসভায়। কোনো কালক্ষেপন না। করেই সে তার বক্তৃতা দিতে শুরু করলো।

“প্রিয় শূয়োর ভায়েরা, বোনেরা আমার,” মহাসভার দিকে ঝাপসা চোখে তাকালো রতই। তার ধারণার চেয়েও বেশি শূয়োর এসেছে। ঝুলে যাওয়া ঠোঁটে হাসির আভা দেখা গেল। “আপনারা সবাই জানেন এই সুন্দরবনে অনেক প্রাণীই আছে, তারা সবাই এখানে এমনভাবে বিচরণ করে যেন এটা তাদেরই বাড়ি! কিন্তু একমাত্র আমরা-এই শূয়োরেরা এখানে অনাহূত অতিথি। যেন আমরা এখানকার কেউ নই! আমাদের নিজেদের কোনো জায়গাও নাই!”

সমস্বরে শূয়োরের দল ঘোৎঘোৎ করে সায় দিলো। “নাই! নাই! নাই!”

“সবাই আমাদেরকে অচ্ছুৎ ভাবে। আমাদের ছায়া মারাতেও ঘেন্না করে। কোথাও আমাদের কোনো জায়গা হয় না। সবাই দুরদুর করে তাড়িয়ে দেয় আমাদের।”

“একদম ঠিক!” চিৎকার করে বলে উঠল এক দাঁতাল শূয়োের। সবাই তাকে ভয় পায়। শূয়োরদের মধ্যে মাস্তান সে।

“আমি একদিন আড়াল থেকে শুনেছি,” মিহি গলায় বলল এক শুকনো শূয়োর, তার কথা ভালোমতো শোনার জন্য সবাই চুপ মেরে গেল। কান খাড়া করতে হলো দূরে বসা শূয়োরদের। “চিত্রল হরিণদের নেতার কাছে এক হরিণ এসে বিচার দিচ্ছে তাকে নাকি অন্য একটা হরিণ ‘শূয়োরেরবাচ্চা’ বলে গালি দিয়েছে।”

রাগে ঘোৎ ঘোৎ করে উঠল শূয়োরের পাল।

“আমাদের নাম ধরে ওরা গালি দেয়!” হুঙ্কার দিয়ে বলল অন্য একটি শূয়োর।

“এটা কি নতুন কিছু?” দাঁত নেই এমন বৃদ্ধ এক শূয়োর বলল। “আমি তো জন্মের পর থেকেই এটা শুনে আসছি।”

“আমিও শুনেছি! আমিও শুনেছি! আমিও শুনেছি!” চারপাশে রীতিমতো হৈ হল্লা শুরু হয়ে গেল।

রতই হাত তুলে সবাইকে শান্ত হতে বলল। “আমরা সবাই এসব জানি। আমাদের উচিত, আসল প্রসঙ্গে ফিরে যাওয়া।”

“আসল প্রসঙ্গ?” এ নিয়ে আবারও ফিসফাস শুরু হয়ে গেল। অনেকে। জানেই না কেন তারা এখানে জড়ো হয়েছে।

যে শূয়োরটি রতই’র মহাসভার কথা শূয়োর থেকে শূয়োরদের মধ্যে। এলান করেছে সে উঠে দাঁড়ালো। “এই বনে সামান্য একটা বাবুই পাখিরও বাসা আছে, পিপড়াদেরও মাথা গোজার ঠাঁই হয়, ইঁদুর-বেড়ালেরও আস্তানা থাকে শুধু আমাদেরই এরকম কিছু নেই।”

“ঠিক-ঠিক-ঠিক!” চারপাশ থেকে রব উঠল।

মাথা নেড়ে সায় দিলো রতই। এটাই সে চেয়েছিল। আসল প্রসঙ্গে চলে আসতে হবে দ্রুত। আর শূয়োরদের সবাই যেন এ নিয়ে একইকণ্ঠে একই সুর তোলে-এখন সে যেটা প্রস্তাব করবে সেটা বাস্তবায়নের জন্য এই ঐক্যবদ্ধতার খুবই দরকার রয়েছে। এই অবস্থা জন্মের পর থেকেই আমি দেখে আসছি। আজ আমি বৃদ্ধ। কয় বছরই বাঁচবো বলেন!”

“জানি-জানি-জানি! বেশিদিন আর নেই!”

আবারও সমস্বরে বলে উঠল শূয়োরের দল। তবে এবারের ঐকতানটি রতইর খুব একটা মনোপুত হলো না। একটু রুষ্ট হলেও কাজের কথায় চলে এলো। “জীবনের এই শেষ সময়ে এসে আমি বুঝতে পেরেছি এতোদিন ধরে আমার পূর্বশূয়োরেরা ভুল করে গেছে। আমরাও সেই ভুল করে যাচ্ছি–”

“আমরা কী ভুল করছি?” দাঁতালটা আবারও চিৎকার করে বলে উঠল। কেউ কিছু বলছে না, শুধু সে-ই মাতব্বরি করছে এই মহাসভায়। “একটু খোলাসা করে বলেন, সর্বজন শ্রদ্ধেয় রতই।”

হাত তুলে দাঁতালকে আশ্বস্ত করলো মহাসভা আহ্বানকারি প্রবীণ শূয়োর। “এই যে সব পশু-পাখির নিজস্ব ঠিকানা থাকলেও এই সুন্দরবনে আমাদের কোনো ঠিকানা নেই…আমি সেটার কথা বলছি।”

“এখানে আমাদের কী ভুল আছে বুঝলাম না!” দাঁতাল আবারও চেঁচিয়ে উঠল। মহাসভার চারপাশে চোখ বুলালে কিছু ভীতু শূয়োর তার কথার সাথে তাল মিলিয়ে “ঠিক-ঠিক-ঠিক!” আওয়াজ তুললো একসাথে।

“বাঘের মতো আমাদের গায়ে অতো শক্তি নেই। ওরকম অদম্য সাহস আর রাজকীয় স্বভাবও নেই। হরিণদের মতো আমরা মিলেমিশে শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে একসাথে থাকার কথা চিন্তাও করতে পারি না। পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কথা বাদই দিলাম। বানরদের মতো গাছেগাছে ভাতৃত্ববোধ তৈরি করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। জলের কুমীর আর মাছেদের মতো আমরা কোনোকালেই একতাবদ্ধ ছিলাম না। পাখিদের মতো আমরা স্বাধীনও নই। পিপড়া, মৌমাছি আর ভীমরুলদের মতো পরিশ্রম করার স্বভাবও আমাদের নেই…”

দাঁতালের একনাগারে বলে যাওয়ার পরও রতই অধৈর্য হয়ে উঠল না, মনোযোগ দিয়ে চুপচাপ শুনে গেল।

“…আমরা সামান্য বাবুইপাখির মতো বাসা বানাতে জানি না। মাকড়ের মতো জাল বুনতে পারি না। বনগরুদের মতো সমাজও তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি। আপনি যদি এগুলোকে ভুল বলেন তাহলে আমি বলবো, এই ভুল শোধরানো সম্ভব নয়। এগুলোই আমাদের খাসলত। চৌদ্দশূয়োর ধরে এগুলো আমাদের রক্তে প্রবাহিত। আপনার এক ডাকে, এক সভায় এসব খাসলত বদলাবে না।”

“হ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যা!” আবারও রব উঠল চারপাশ থেকে। “বদলাবে না! বদলাবে না! বদলাবে না!”

দাঁতাল খুব খুশি হলো মহাসভার সকল শূয়োর তার কথার সাথে তাল মেলাচ্ছে দেখে। রতই হতে পারে শূয়োরদের মধ্যে সবচাইতে বড় শূয়োর, তার অনেক বয়স হতে পারে, অভিজ্ঞতা আর খচ্চরিপনায় সে হতে পারে সমৃদ্ধ কিন্তু দুঃসাহস আর হিংস্রতায় তার ধারেকাছেও না। সবাই তাকে সমঝে চলে। তার উদ্যত সাদা দাঁত দুটো দেখলে নিরীহ শূয়োরদের বুকে কাঁপন ধরে যায়।

“এক মহাসভা কেন, হাজারটা মহাসভা ডাকলেও লাভ হবে না।”

“ঠিক-ঠিক-ঠিক!” চারপাশ কেঁপে আওয়াজ তুললো শূয়োরের দল।

“আমি পনেরো মাইল দূর থেকে অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে এখানে এসেছি রতইর কথা শুনতে,” মিনমিনে গলায় এক শূয়োর বলল। সে বসে আছে দাঁতালের ঠিক পাশেই। “উনার উপর আমাদের আস্থা আছে।” দাঁতাল তার দিকে তাকালে মিনমিনে গলার শূয়োরটা বলে উঠল, “আপনার উপরেও আমার ভরসা আছে। মানে, আপনি যা বললেন তারও তো যুক্তি আছে!”

দাঁতাল বাঁকা হাসি হেসে রতইর দিকে তাকালো। সমীহ, ভীতি, আতঙ্ক দেখলেই তার ভালো লাগে।

“আমি তো আরেকটুর জন্যে প্রাণটাই খোয়াতাম,” দাঁতালের থেকে একটু দূরে বসে থাকা নাদুসনুদুস এক শূয়োর বলে উঠল। “ক্ষুধার্ত এক বাঘ আমাকে তাড়া করেছিল…ভাবুন একবার!”

“হুঁ!” দাঁতাল গজগজ করে বলল। “বনের রাজা বাঘ কখনও শূয়োর খায় নাকি! যত্তোসব ফালতু কথা।”

হাত তুলে সবাইকে শান্ত হতে বলল রতই। “আমি আমাদের শত বছরের স্বভাব বদলের কথা বলছি না,” হালকা অনুযোগের স্বরেই বলল সে। “আপনারা আগে আমার কথা শুনুন, তারপর এসব প্রশ্ন করবেন।”

“মহামান্য রতই আগে বলুন,” শূয়োরের দল বলে উঠল চারপাশ থেকে। “আমরা তার কথা শুনতে চাই।”

“আমি ভালো করেই জানি আমাদের শূয়োরস্বভাব এতো সহজে দূর হবে না।”

“হবে না! হবে না! হবে না! হতেই পারে না!” রতইর সাথে সায় দিয়ে আবারও রব উঠল মহাসভায়।

“স্বভাব বদলানো এতো সহজ না!” শেষ কথাটা চিৎকার করে বলল ভরাটকণ্ঠের এক শূয়োর। “আমরা বাঘ নই। বানরও নই। হরিণ হবার প্রশ্নই ওঠে না। আমরা যা আমরা তা-ই।”

“বেয়াদবি নেবেন না, মহামান্য রতই,” দাঁতাল আবারও মাথাচাড়া দিয়ে বলে উঠল। “স্বভাব না বদলালে আমরা আমাদের ভাগ্য বদলাবো কী করে?”

কয়েক মুহূর্তের জন্যে দুচোখ বন্ধ নিজের ভেতরের রাগটা প্রশমিত করলো প্রবীণ শূয়োর। অল্পবয়সিদের মতো মাথাগরম করলে তার চলবে না।

“আমরা আমাদের স্বভাবটাকে কাজে লাগিয়েই ভাগ্য বদলাবো,” গম্ভীর কণ্ঠে বলল সে।

চারপাশ থেকে ঘোঘোৎ করে উঠল কয়েকশ’ শূয়োর। দাঁতাল বুঝতে না পেরে বেকুবের মতো চেয়ে রইলো রতইর দিকে।

“আমি জানি আপনারা আমার কথা বুঝতে পারছেন না,” গলাটা একটু কেশে নিলো এবার। “মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনুন তাহলেই বুঝতে পারবেন আমি কী বলতে চাইছি।”

মহাসভার প্রায় সমস্ত শূয়োর একযোগে মাথা নেড়ে সায় দিলো।

“আমাদের যেমন শূয়োরস্বভাব তেমনি বনের অন্য পশু-পাখিদেরও রয়েছে নিজস্ব স্বভাব। বাঘের স্বভাব কিন্তু বানরের মতো নয়। হরিণের স্বভাব কাকের মতো হয় না। কুমীরের স্বভাব নিশ্চয় বাজপাখির সাথে মেলে না!”

“একদমই মেলে না,” এককোণ থেকে একটা মাঝবয়সি শূয়োর বলে উঠল। “প্রত্যেকেই প্রত্যেকের মতো। কেউ কারো মতো নয়।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো রতই। “ঠিক। আর এই কথাটিই আমি বলতে চাচ্ছি। আমারা আমাদের মতোই থাকবো। বরং বলতে পারেন, আমরা শূয়োরেরা আরও বেশি করে শূয়োর হয়ে উঠবো…তবেই কেবল আমাদের দুর্ভাগ্যের দিন শেষ হবে! এই সুন্দর বনে কায়েম হবে আমাদের রাজত্ব!”

কয়েকশ’ শূয়োর মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো এ সময়। রাজত্ব কায়েম?! এটা তারা স্বপ্নেও ভাবেনি।

“মহামান্য রতই, একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?” শূয়োরদের মধ্যে কেউ বলে উঠল।

“বলছি। আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন উপস্থিত সবাই।”

পিনপতন নীরবতা নেমে এলো মহাসভায়।

“এই সুন্দরবনে একটি ভালো এবং সুবিধাজক জায়গা খুঁজে বের করবো আমরা। আশা করি আমাদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা এরকম জায়গার খবর রাখে।”

“রাখি! রাখি! রাখি!”

প্রায় ত্রিশ-চল্লিশটি শূয়োর বলে উঠল দাঁত কেলিয়ে।

“ওরকম একটি জায়গায় গিয়ে আমরা সব শূয়োর জড়ো হবে। ওটাই হবে আমাদের স্থায়ি ঠিকানা।”

দাঁতাল শূয়োর অনেকক্ষণ ধরে চুপ মেরে ছিল, সে মাথা চাড়া দিলো। আবার। “এমন কোনো সুন্দর আর সুবিধাজনক জায়গা নেই যেটা বিরাণ। পড়ে আছে। হয় কোনো বাঘ, বনগরু, কিংবা হরিণের দল ওখানে থাকে। তারা কি আমাদের এতো সহজে জায়গা ছেড়ে দেবে? কোনোদিনও দেবে না। যদি দিতো তাহলে বহু আগেই আমরা এরকম একটা জায়গা দখল করে নিতে পারতাম।”

“ঠিক! ঠিক! ঠিক!”

আবারও রব উঠল সম্মিলিতভাবে।

“কেউ আমাদেরকে জায়গা ছেড়ে দেবে না। তাদেরকে আমরা বাধ্য করবো।”

রতইর কথা শুনে কয়েকশ’ শূয়োর মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো দ্বিতীয়বারের মতো।

“কিন্তু কীভাবে?” অন্য এক বয়স্ক শূয়োর বলে উঠল। “আমরা কি তাদের সাথে লড়াই করবো?”

লড়াইয়ের কথা শুনে দাঁতাল শূয়োর একটু বিব্রত হলো যেন। শূয়োরদের মধ্যে মাস্তানি করলেও বনের অন্যান্য পশুদের সাথে মারামারি করার কথা সে কল্পনাও করতে পারে না।

“শূয়োররা কি কোনোদিন লড়াই করে জিততে পারবে?” অন্য এক শূয়োর যোগ করলো।

“পারবে না! পারবে না! পারবে না!”

রতই হাত তুলে কোলাহল থামিয়ে দিলো। “আমি লড়াই করার কথা বলিনি। আগে আমার কথা ধৈর্য ধরে শুনুন…তারপর এসব প্রশ্ন করলে আমি খুশি হবো।”

“উনাকে আগে বলতে দিন! আমরা উনার কথা শুনতে এসেছি।” একপাশ থেকে একদল বলে উঠল।

কয়েক মুহূর্তেই আবারও নেমে এলো পিনপতন নীরবতা।

“আগেই বলেছি, চমৎকার একটি জায়গা নির্বাচন করে আমরা ওখানে আস্তানা গাড়বো। কিন্তু আমার শূয়োর ভায়েরা ঠিকই বলেছে, এরকম জায়গায় কেউ না কেউ আগে থেকেই দখল করে রেখেছে। কে না জানে, এই বনের সবচাইতে ভালো জায়গাগুলো ঐ বনের রাজা বাঘ, বনগরু আর হরিণসহ নামিদামি পশুদের করায়ত্তে আছে। এটাও ঠিক, আমরা ওদের সাথে কোনোভাবেই পেরে উঠবো না। তাহলে আমরা কী করবো? আমি অনেক ভেবেছি এ নিয়ে। আমার যৌবনের সমস্ত সময়টাই ব্যয় করেছি একটা উপায় খুঁজে বের করার জন্য। অবশেষে এই বৃদ্ধবয়সে এসে আমি এর জবাব পেয়েছি। এখন আমি আপনাদের সবাইকে সে-কথাই বলবো।” রতই একটু থামলো। পিনপতন নীরবতা বজায় আছে দেখে খুশিই হলো সে। “আমরা শূয়োরেরদল ঐ নির্বাচিত জায়গায় পৌঁছানোমাত্রই শুরু করে দেবো শূয়োরিক কাজকারবার!”

পলকহীন চোখে চেয়ে রইলো শূয়োরেরদল। তারা ভালো করেই জানে শূয়োরিক কাজকারবার জিনিসটা কী।

“প্রত্যেক শূয়োরকে বলছি, যার যেমন সাধ্যে কুলায় হাগা-মুতা করে জায়গাটা কিছুক্ষণের মধ্যেই একেবারে নাস্তানাবুদ করে ফেলবে। সেই হাগা-মুতার মধ্যে শূয়োরের দল যেন ইচ্ছেমতো গড়াগড়ি খায়, নিজেদের শরীর যতোটুকু সম্ভব নোংরা করে ফেলে! এমন নোংরা করতে হবে যেন বনের রাজা আমাদের দেখামাত্র একশ হাত দূর দিয়ে চলে যায় নাক-মুখ বন্ধ করে। ঘেন্নায় যেন তার শরীর কেঁপে ওঠে। মনে রাখবে, তার রাজকীয় স্বভাব আর হামবড়া ভাব রয়েছে। সে আমাদের ধারেকাছেও ঘেষবে না।”

শত শত শূয়োরের চোখ চকচক করে উঠল।

“একদম ঘেষবে না! ঘেষতে পারবে না! ঘেষা সম্ভবও না!” সুর তুললো অনেকেই।

“শূয়োরভাই ও বোনেরা, তোমরা শুধু জায়গাটা নোংরাই করবে না, সেইসাথে চিল্লাফাল্লা করে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে যেন নিরীহ আর শান্ত পশু হরিণের দল এক মাইল দূর থেকে আমাদের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকায়।”

“হরিণেরদল দশ মাইল দূর থেকেই পালাবে!” এক শূয়োর উল্লাসে বলে উঠল। হাসতে হাসতে অন্য শূয়োরের গায়ে ঢলে পড়ল সে।

“পালাবে! পালাবে! পালাবে!”

আবারও সুর উঠল মহাসভায়। “পালাতেই হবে!”

রতইয়ের মুখে হাসি ফুটে উঠল এ সময়। “শূয়োরেরদল এমন সব বিশৃঙ্খল কাজ করবে, এমন সব হট্টগোল আর নোংরামি করবে যে, বনের বাকি পশুদের আমাদের চৌহদ্দির মধ্যে আসার রুচি হবে না।”

কয়েকশ’ পোড়খাওয়া শূয়োর একে অন্যের দিকে হাসিহাসি মুখে তাকালো।

“আমরা যদি আমাদের শূয়োরস্বভাবটি সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রয়োগ করতে পারি তাহলেই সফল হবো। এরজন্যে লড়াই কিংবা সংগ্রামের কোনো দরকারই হবে না। বিনাযুদ্ধে আমরা পেয়ে যাবো সুবিশাল মেদিনী!”

“জয় রতই!” এক বলিষ্ঠ শূয়োর চিৎকার করে বলে উঠল।

“জয় রতই! জয় রতই! জয় রতই!”

প্রবীণ শূয়োর রতই তৃপ্তির হাসি দিলো। সে জানে তার উদ্দেশ্য পূরণ হবে খুব শীঘ্রই।

“তাহলে আমরা এখন কী করবো, মাননীয় রতই?” দাঁতাল বলে উঠল হাসিহাসি মুখে।

“কথা অনেক হয়েছে, এবার কাজের সময়।”

“এবার কাজের সময়!” চিৎকার করে বলল অন্য এক শূয়োর।

“এখান থেকে আধক্রোশ দূরে ছোট্ট যে নদীটা বয়ে গেছে, সেখানে বিশাল একটি খোলা প্রান্তর আছে। চারপাশে চমৎকার সব বৃক্ষরাজি। জায়গাটা আমি বহুদিন থেকে চিনি। ওখানে খাদ্যের কোনো সংকট হবে না। আমরা অনেক আরামে দিনাতিপাত করতে পারবো। ওটাই হবে আমাদের আখড়া।”

“ওখানে কারা থাকে, মহামান্য রতই?” ভয়ে ভয়ে মিনমিনে গলায় এক শূয়োর জানতে চাইলো।

“একপাল চিত্রল হরিণ!”

“হা-হা-হা!”

রব উঠল মহাসভায়।

কেউ একজন মাতালের মতো অন্য একটা শূয়োরের গায়ে হেলিয়ে পড়ে বলে উঠল, “সুন্দর আর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা বেকুব হরিণের দল!”

দাঁতালকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখে রতই ভর্ৎসনার সুরে বলে উঠল, “অপেক্ষা কিসের? যাও! শুরু করে দাও! দেখিয়ে দাও কে কতো বড় শূয়োর!”

শূয়োরেরদলটি মহাসভা থেকে সদলবলে রওনা দিলো নদীর পাড়ে চিত্রলহরিণদের সেই জায়গার উদ্দেশ্যে। রতইর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলো তারা। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জায়গাটাকে শূয়োরের খোয়াড় বানিয়ে তুললো।

চিত্রাহরিণের দল দূর থেকে নিজেদের জায়গাটাকে নোংরা নর্দমা হয়ে যেতে দেখে নাক সিঁটকে দূরে কোথাও সরে গেল। এরকম নোংরা জায়গায় থাকার কথা তারা চিন্তাও করতে পারে না।

বনের রাজা বাঘ খাবারের সন্ধানে ঐ এলাকার পাশ দিয়ে যাবার সময় দুর্গন্ধে নাক-মুখ বন্ধ করে দৌড়ে পালালো। এমন বাজে গন্ধ সে কোনোদিন পায়নি। চারপাশে যতো গাছ-গাছালি ছিল সেখানকার বানর-হনুমান-উল্লুক আর পাখিদের দল ছি-ছি করতে করতে পাড়ি দিলো অন্য কোথাও।

খুব দ্রুতই শূয়োরেরদল বুঝে গেল সুন্দরবনে নিজেদের জন্যে একটা স্থায়ি জায়গা পেয়ে গেছে তারা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *