শেষ থার্টিফার্স্ট
বেঁচে থাকতে হলে খুন করতে হয়। তাবৎ প্রাণীকূলের দিকে তাকালে এই সত্যটা আরও বেশি করে চোখে পড়ে।
নিজেকে আরও একবার আশ্বস্ত করলো আহাব। আর মাত্র একটি খুন তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে আরও এক শতাব্দী!
কোমরে হাত বুলিয়ে স্মার্ট-গ্নকটা আরও একবার টের পেলো সে। কখনও ভাবেনি এরকম জিনিস সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে। অথচ আজ তিনদিন ধরে জিনিসটা তার সার্বক্ষণিক সঙ্গি। প্রথম দিনেই প্রথম খুনটা করতে পেরেছিল-পরিত্যক্ত সংসদ ভবন এলাকায় এক ভবঘুরে ছিল লোকটা। ভেবেছিল বাকি দু-দিনে অনায়াসে খুঁজে পাবে আরেকজনকে, কিন্তু গতকাল থেকে আজ পর্যন্ত শত শত মানুষজনকে টার্গেট করলেও সবগুলোই বাতিল করা হয়েছে। হয় তারা ফাউন্ডেশনের ক্লায়েন্ট, নয়তো ক্লায়েন্টের পরিবার-পরিজন।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে। আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালো। রাতের কালো আকাশ ফ্যাকাশে করে দিয়েছে ঢাকা শহরের শতসহস্র হলোগ্রাফিক প্রজেকশন। তবে সে নিশ্চিত, আকাশজুড়ে তারার মেলা আছে। আরও আছে পুলিশের সার্ভিলেন্স ড্রোন। বহুকাল আগেই টহল পুলিশ উঠে গেছে। হাজার হাজার ড্রোন এখন পৃথিবীর শহরময় উড়ে বেড়ায়। তীক্ষ্ণ নজরদারি করে জনগণের উপর। পুব আকাশের বিশাল হলোগ্রাফিক ঘড়িটা রাতের আকাশে জ্বল জ্বল করে একটা সংখ্যা দেখাচ্ছে :
২০৯৯
আর মাত্র এক ঘণ্টা পরই সংখ্যাটি বদলে যাবে, পৃথিবী প্রবেশ করবে নতুন শতকে। সেই সাথে কি শেষ হয়ে যাবে তার দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার পাগলামিটাও?
আবারও হাঁটতে শুরু করলো আহাব। দুদিন ধরে তার চোখ টার্গেট খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তার সমবয়সি যার দিকেই ফোকাস করেছে কয়েক সেকেন্ড পর চোখের সামনে ভেসে উঠেছে একটি অসহ্যবাক্য : যোগ্য টার্গেট নয়।
ঠিক তার সমবয়সি আরেকজনকে খুঁজে বের করতে হবে। সমলিঙ্গেরও হতে হবে। থার্টিফাস্ট নাইটে শহরের এই প্রাণকেন্দ্রে জড়ো হওয়া প্রচুর মানুষজনের ভেতর থেকে এমন একজন মানুষ অনায়াসে বেছে নিতে পারবে সে-একটু আগে তাকে এমনটাই বলা হয়েছে ফাউন্ডেশন থেকে। ইদানিং এত মানুষ ফাউন্ডেশনের দ্বারস্থ হচ্ছে বলে অবাকই হলো সে। সারা দুনিয়ার কেউ বুঝি বাকি নেই। তাহলে গুজবটাই সত্যি। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ফাউন্ডেশন নীরবে কাজ করে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। মানুষের আয়ুষ্কাল তিনগুণ বাড়িয়ে দেবার কাজটি নাকি বেশ সফলভাবেই করতে পারে তারা। তবে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি পায় না বলে আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ করে।
নিজেদের ক্লায়েন্টের ব্যাপারে ফাউন্ডেশন বেশ দায়িত্বশীল। নানা রকম শর্ত জুড়ে দেয় তারা-শিশু, বিপরীতলিঙ্গ, ক্লায়েন্ট, ক্লায়েন্টর পোষ্য আর সমাজে অত্যধিক মেধাবি হিসেবে পরিচিত ব্লু-কার্ডধারীদের কোনোভাবেই টার্গেট করা যাবে না। এ কারণে চারপাশে অসংখ্য মানুষজন থাকলেও আহাবের পক্ষে হুট করে স্মার্ট-গ্লকটা ব্যবহার করা হয়ে উঠছে না। অথচ প্রথম যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ফাউন্ডেশনের সাথে যোগাযোগ করবে তখন ভাবতেও পারেনি কাজটা তার জন্যে কতোটা কঠিন হতে পারে।
ফাউন্ডেশনের কাজকারবার সম্পর্কে একটা গুঞ্জন অনেকদিন ধরেই শুনে আসছিল কিন্তু ওয়ার্ল্ড-ওয়াইড-ওয়েবে তাদের কোনো টিকিটাও খুঁজে পায়নি। অবশেষে তার বন্ধু সঞ্জয় জানায়, ফাউন্ডেশন যেহেতু বেআইনি একটি প্রতিষ্ঠান তাই সরকারের কোপানল থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য ডার্ক-ওয়েব ছাড়া আর কোথাও তাদেরকে পাওয়া যাবে না। তো ডার্কওয়েব জিনিসটাও তো গোপন কিছু নয়। দীর্ঘদিন ধরেই ওটা পৃথিবীর সবগুলো সরকারের কড়া নজরদারির মধ্যেও টিকে আছে। দিন দিন ভীষণ জনপ্রিয়ও হয়ে উঠছে। সব ধরণের বেআইনি জিনিস আর সেবা পাওয়া যায় ওখানে। সরকারগুলো ডার্ক-ওয়েবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও দিন দিন সেইসব পদক্ষেপ দুর্বল হয়ে পড়ছে। তারা এখন ব্যস্ত হলিয়েনদের নিয়ে। কিভাবে তাদেরকে চিহ্নিত করবে, বিতাড়িত করবে, সেটা মস্ত বড় এক প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। হলিয়েনরা নাকি ধীরে ধীরে সমগ্র পৃথিবী গ্রাস করে নেবার দুরভিসন্ধি করছে!
আহাব জানে, সারা বিশ্বের রাজনীতিকেরাই নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য এমন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব কপচায়, আর জনগণের বিরাট অংশ এটা বিশ্বাসও করে। অথচ আজ থেকে ষাটবছর আগে যখন মঙ্গলগ্রহে অনুজীবের উপস্থিতির প্রমাণ পেলো সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা তখন আনন্দে মেতে উঠেছিল। তারা ধারণা করেছিল, নিকট ভবিষ্যতে বৰ্হিজীবদের সাথে কন্ট্যাক্ট করতে সক্ষম হবে মানুষ, আর সেটাই হয়েছিল দশ বছর পর দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে পৃথিবীর মানুষ অপার্থিব জীবদের দেখা পায়। অবাক করা বিষয় হলো, শত বছরের হাজার হাজার কল্পকাহিনীতে বর্ণিত অদ্ভুত, কিম্ভুতকিমাকার কোন প্রাণী নয়, পৃথিবীতে পা রাখে মানুষসদৃশ বহির্জীবেরা। দেখতে হুবহু মানুষের মতো এইসব অপার্থিব প্রাণী বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু এরপরই তাদের পথ ধরে চলে এলো হলিয়েনরা। দেখতে মানুষের মতো হলে কী হবে, প্রচণ্ড শত্রুভাবাপন্ন এইসব বৰ্হিজীব শুরু থেকেই মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করতে ইচ্ছুক ছিল না। সেজন্যেই মানুষজন তাদেরকে ‘হস্টাইল-এলিয়েন’ নামে ডাকতে আরম্ভ করে। কালক্রমে সংক্ষিপ্ত হয়ে হলিয়েন শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে যায়। আজকাল মা বাবারা সন্তানদেরকে হলিয়েনের গল্প শুনিয়ে ভয় দেখায়, ঘুম পাড়ায়। প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় হলিয়েন ধরা পড়ে। তাদেরকে অবৈধভাবে পৃথিবীতে থাকার জন্য বিচারও করা হয়, কিন্তু ফৌজদারি কোন মামলায় জড়ানো যায় না। এর কারণ জন্মগতভাবে খুন করার মতো নার্ভ নিয়ে জন্মায় না হলিয়েনরা। মানুষের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমত্তা থাকলে কী হবে, এই একটা জায়গায় ভীষণ দুর্বল তারা। মানুষের সাথে কোনরকম যুদ্ধে না জড়িয়ে তারা মিশে যাবার চেষ্টা করে। আর মানুষের মতো দেখতে বলে খুব সহজে তাদেরকে চিহ্নিতও করা যায় না। এর ফলে সারা পৃথিবীতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে তারা। বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে পৃথিবীর সরকারগুলো তাদেরকে চিহ্নিত করার কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছে। মানুষের তৈরি অত্যাধুনিক রাডার ফাঁকি দিয়ে সবার অলক্ষ্যে প্রতিদিন শত শত হলিয়েন শিপ অবতরণ করে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। মানুষজন থেকে হলিয়েনদের খুঁজে বের করাটা তাই খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। গুজব আছে, সরকারের ভেতরেই নাকি ঘাপটি মেরে আছে অসংখ্য হলিয়েন! আর মিডিয়ার প্রায় পুরোটাই দখল করে নিয়েছে তারা।
যা হোক, এইসব অপার্থিব-মানবদের বিরুদ্ধে অভিযানে ব্যস্ত থাকলেও পৃথিবীর প্রগতি থেমে থাকেনি। বরং ধৃত হলিয়েনদের কাছ থেকে তাদের উন্নত প্রযুক্তি আর বিজ্ঞান ব্যবহার করে দিন দিন মানবসভ্যতা উন্নতির শিখরে উঠে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করে দেখেছে, একজন মানুষের সাথে আরেকজন মানুষের সর্বোচ্চ জেনেটিক্যালি প্রভেদ হচ্ছে ০.১%, আর মানুষের সাথে শিম্পাঞ্জির প্রভেদ মাত্র ১.২%। সেদিক থেকে দেখলে হলিয়েনরা বেশ এগিয়ে আছে। মানুষের চেয়ে তারা ২.৫৬% উন্নত। সংখ্যাটা সাধারণ মানুষের কাছে নেহায়েত কম মনে হলেও বিজ্ঞানীদের কাছে এটা রীতিমতো মাউন্ট এভারেস্টতুল্য পার্থক্য। ধৃত হলিয়েনদের ইন্টেরোগেট করে তাদের অগ্রসর চিন্তাভাবনা জেনে নেয় মানুষ। হলিয়েনদের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে বিরাট বড় বড় আবিষ্কারও করা হয়েছে। ক্যান্সার বলে কিছু নেই এখন। এইডস রোগ হয়ে গেছে সর্দি কাশির মতো সাময়িক ভোগান্তি। অঙ্গহানি নিয়ে মানুষের দুশ্চিন্তার দিন শেষ হয়েছে আরও দশ বছর আগেই। কেটে যাওয়া অঙ্গ ধীরে ধীরে গজাতে শুরু করে এখন। দৃষ্টিশক্তি হারানোর ভয় চলে গেলেও প্রচুর মানুষ চশমা নামক বস্তুটা আঁকড়ে আছে, কারণ স্মার্ট-গ্লাস জীবনযাত্রার অনেক কিছুই সহজ করে দিয়েছে।
এরকম উল্লম্ফন যখন চলছে তখন ‘ফাউন্ডেশন’ নামের একটি গুপ্তসংস্থার কথা শোনা যেতে শুরু করে। তারা নাকি হলিয়েনদের কাছ থেকে বহুল কাঙ্খিত অমৃতের সন্ধান পেয়ে গেছে। মানুষকে পুরোপুরি অমর করতে না পারলেও বেঁচে থাকার আয়ু প্রায় তিনগুন করার কাজটি সফলভাবে করতে সক্ষম এখন। তারা এমনও দাবি করছে, আজ যে মানুষটি তাদের অমৃতের স্বাদ নেবে সে তার জীবনকালের দুই তৃতীয়াংশ শেষ করার আগেই ফাউন্ডেশন তাদের দীর্ঘায়ুর প্রযুক্তির আরও উল্কর্ষ সাধন করতে সক্ষম হবে। তখন হয়তো দ্বিতীয়বারের মতো অমৃতের সেবা পেয়ে মানুষ আরও একবার নিজেদের আয়ুষ্কাল কয়েকগুন বাড়িয়ে নিতে পারবে। এভাবে চলতে থাকলে অমরত্বের দেখা পাওয়াটা অসম্ভব কিছু হবে না।
তো, অনেক কষ্টে ফাউন্ডেশনের সাথে যোগাযোগ করার পর আহাব খুব অবাক হয়ে গেছিল। কাজটা এত সহজে হয়ে যাবে ভাবতেও পারেনি। একদম বিনা-খরচে নির্বাচিত কিছু মানুষ এ সেবা পাবে যদি তারা ফাউন্ডেশনের অদ্ভুত আর যৌক্তিক শর্তটা মেনে নেয়।
তুমি তিনগুণ সময় বাঁচতে চাও, ভালো কথা, কিন্তু পৃথিবীর রিসোর্স খুবই সীমিত। লক্ষকোটি মানুষ তিন-চারগুণ আয়ু নিয়ে বেঁচে থাকলে সমগ্র পৃথিবীর রিসোর্সের উপরে বিরাট প্রভাব ফেলবে, সুতরাং তিনগুণ আয়ু চাইলে কমপক্ষে দু-জন মানুষকে সরিয়ে দিতে হবে দুনিয়া থেকে। আর কাজটা করতে হবে তোমাকেই।
সহজ সমাধান। একদম যৌক্তিক। অন্তত ফাউন্ডেশনের মোটিভেশন ক্লাস করার সময় তেমনটাই মনে হয়েছিল তার। কিন্তু দু-দুটো খন করা এখন আর সহজ কোন কাজ বলে মনে হচ্ছে না, বিশেষ করে ফাউন্ডেশনের ক্লায়েন্টের সংখ্যা যখন হু হু করে বেড়ে চলেছে। এই দুই দশকে তারা ঠিক
কী পরিমাণ মানুষকে এই সেবা দিয়েছে সেটা জানা না গেলেও আহাব এখন। বুঝতে পারছে, সংখ্যাটা গুজবের চেয়ে অনেক অনেক বেশিই হবে। এই বাংলাদেশেও যে তাদের এত ক্লায়েন্ট থাকতে পারে তার জানা ছিল না। তার নাকের উপরে চেপে বসা চশমাসদৃশ স্মার্ট-গ্লাস প্রতিটি টার্গেটের ফেসিয়াল রিকগনিশন করে ফাউন্ডেশনে পাঠিয়ে দিচ্ছে, আর সেখান থেকে তাকে অবিরাম জানানো হচ্ছে, টার্গেটকে ‘ইগনোর করার জন্য। এভাবে শত শত টার্গেট ইগনোর করা হয়েছে বিগত দু-দিনে। যোগ্য টার্গেট দেখা পাওয়ামাত্রই তার চোখে ভেসে উঠবে ‘গো’ লেখাটা। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাক্টিভেট হয়ে যাবে স্মার্ট-গ্লক। তারপর টার্গেটের দিকে সেটা তাক করে শুধু ট্রিগার চেপে দিলেই হবে-এমন ইস্ট্রাকশনই সবাইকে দেয়া হয়।
কিন্তু আহাব এখন বুঝতে পারছে, এই মিশনে ব্যর্থ হবে সে। দুনিয়া ভরে গেছে ফাউন্ডেশনের ক্লায়েন্ট আর তাদের পোষ্যদের দিয়ে।
এটা কীভাবে সম্ভব? এত ক্লায়েন্ট তো হবার কথা নয়। তাহলে পৃথিবীর সীমিত রিসোর্সের উপরে ভীষণ চাপ পড়বে না? মোটিভেশন ক্লাসের কথাগুলো মনে পড়ে গেল তার। ফাউন্ডেশনের কথা আর কাজে মিল পাচ্ছে না।
এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে উত্তরার পুরনো এয়ারপোর্টের কাছে চলে এলো। জায়গাটা এখন সুবিশাল একটি স্কয়ার। সেই স্কয়ারের চারপাশে তৈরি করা হয়েছে নতুন চারটি উপ-শহর। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছে স্কয়ারে। আর মাত্র কিছুক্ষণ পরই নতুন শতকের আগমণ উদযাপন করবে তারা।
এমন সময় তার মাথার ভেতরে একটা কণ্ঠস্বর বলে উঠল :
মনে হচ্ছে না তুমি সফল হবে। সময় কিন্তু ফুরিয়ে যাচ্ছে।
আহাব বুঝতে পারলো ফাউন্ডেশনের সেই লোকটি তাকে কল করেছে। তার নিউরো-ফোনে। মস্তিষ্কে ছোট্ট একটি চিপসের মাধ্যমে ইস্প্যান্ট করা এটি, মুখ ফুটে কিছু না বলেই কথাবার্তা চালিয়ে নেয়া যায়।
হুম। মনে হচ্ছে আমার কপাল খারাপ।
এখনও হাতে কিছুটা সময় আছে। তুমি চাইলে আমরা তোমাকে সাহায্য করতে পারি।
কিভাবে?
শর্তগুলো শিথিল করে দিতে পারি তোমার জন্য। আমরা চাই না আমাদের কোন ক্লায়েন্ট ব্যর্থ হোক। এখন যেকোন একজন হলেই হবে। লিঙ্গ-বয়সের কোন বাধা নেই।
একটু ভাবলো আহাব।
ভাবার মতো সময় নেই তোমার কাছে।
আহাব জানে, এর অর্থ নারী-শিশু কিংবা যেকোন বয়সি টার্গেট হলেই হবে। দ্বিধা এসে ভর করলেও সে রাজি হয়ে গেল। তাকে বাঁচতে হবে। অনেক বছর!
বুদ্ধিমানের মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এগিয়ে যাও তাহলে। সময় নষ্ট কোরো না।
কণ্ঠটা উধাও হয়ে গেল। আহাব কথামতোই এগিয়ে যেতে শুরু করলো স্কয়ারের দিকে, কিন্তু নতুন একটি দ্বিধা ভর করলো তার মধ্যে। ফাউন্ডেশন শর্ত শিথিল করে দিয়েছে-কিন্তু কেন? কোথায় গেল তাদের সেইসব নীতিবাক্য? মোটিভেশন!
স্মার্টগ্লাসের ভেতর দিয়ে এক যুবকের দিকে নজর দিতেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠল কাঙ্খিত সেই লেখাটি : যোগ্য টার্গেট!
তার সমবয়সি চশমা পরা এক যুবক পথের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে সামনের স্কয়ারটা দেখছে। সেই যুবকের পেছনে, কয়েক হাত দূরে এসেই থমকে গেল আহাব।
ফেশিয়াল রিকগনিশন ছাড়াই টার্গেট বেছে নেয়া হয়েছে!
শর্ত শিথিলের নমুনা? কিন্তু এটা কী করে সম্ভব? এই যুবক। ফাউন্ডেশনের ক্লায়েন্ট কি না সেটা তো নিশ্চিত হতে হবে, নাকি?
আহাব টের পেল তার কোমরে থাকা স্মার্ট-কটা অ্যাক্টিভেট হয়ে গেছে, কিন্তু সেটা হাতে তুলে নিলো না। ফাউন্ডেশনের উদ্দেশ্য নিয়ে তার মনে সংশয় তৈরি হয়েছে, তা-ও আবার শেষ মুহূর্তে এসে। সময় ঘনিয়ে আসছে। নতুন বছর, নতুন আয়ুষ্কাল। আর মাত্র এক ক্লিক দূরে!
হঠাৎ তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক ঘুরে দাঁড়ালো। স্মার্টগ্লাসের ভেতর দিয়ে তীক্ষ্ণচোখে তাকালো সে। আহাব কিছু বুঝে ওঠার আগেই কোমর থেকে একটা স্মার্ট-গ্লক বের করে নিলো যুবক।
“আমরা বিরাট বড় ভুল করে ফেলেছি,” আহাব বলল।
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো যুবক। তার গ্লকটা উঠে আসছে।
“ফাউন্ডেশন!…ওটা…” গলা ধরে এলো তার।
“ফাউন্ডেশন কি…?” যুবকের ভুরু কুঁচকে গেল।
“স-সব ভুল! ওরা আমাদের সবাইকে শেষ করে দেবে!”
“কাদের কথা বলছো?”
“মানুষ! ওরা একটা মানুষও রাখবে না।” আহাবের ভাবনা খুব দ্রুত খেলে যাচ্ছে এখন। সবটাই বুঝতে পারছে বিদ্যুৎগতিতে।
গ্লক ধরা যুবক বুঝতে না পেরে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত।
“ক্লায়েন্ট ক্লায়েন্টকে টার্গেট করতে পারে না! কিন্তু সেটাই হচ্ছে এখন! বুঝতে পারছো?”
যুবকের মধ্যে দ্বিধা দেখা গেল। “শর্ত শিথিল করা হয়েছে…যে কেউ হলেই-”
“হ্যা!” কথার মাঝখানেই বলল আহাব। “জানি! কিন্তু কেন? ক্লায়েন্ট যদি ক্লায়েন্টকে হত্যা করে তবে বেঁচে থাকবে কে?”
যুবক ধন্দে পড়ে গেল।
“ফাউন্ডেশনের কোন ক্লায়েন্টই নিরাপদ নয়! বুঝতে পারছো?” দাঁতে দাঁত পিষে বলল সে। “ওরা মানুষ না!”
“মানুষ না?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো আহাব। “ওরা হলিয়েন! আমি নিশ্চিত।”
“হলিয়েন?” যুবক যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না।
“ফাউন্ডেশন…অমরত্ব…আসলে সবটাই ভাওতাবাজি!”
যুবক দ্রুত ভেবে যাচ্ছে, ভাঁজ পড়ছে তার মসৃণ কপালে।
“আমরা সবাই ফাঁদে পড়ে গেছি। পৃথিবী ছেয়ে গেছে হলিয়েনে। খুব কম মানুষই আছে এখন!” উদভ্রান্তের মতো বলে গেল কথাগুলো।
“পাগল!” যুবক বলে উঠল। “তুমি আমার সাথে চালাকি করছো। কিন্তু কোন লাভ নেই। আমি এখনই তোমাকে”।
“আমি কীভাবে চালাকি করলাম! আমি তো আমার গ্লকটা হাতেই নেইনি। ইচ্ছে করলে তোমাকে পেছন থেকে খুব সহজেই শেষ করে দিতে পারতাম। পারতাম না?”
যুবক ঢোক গিলল।
“কিন্তু আমি সেটা করিনি। শেষ মুহূর্তে আমি ফাউন্ডেশনের শয়তানিটা ধরে ফেলেছি।”
“তুমি যা বলছে তার কী প্রমাণ আছে?”
“প্রমাণ! এই যে তুমি-আমি! আমরা দুজনেই ফাউন্ডেশনের ক্লায়েন্ট। আমরা দুজনেই আবার টার্গেট!”
যুবক নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো।
“আমার আর মাত্র একটা টার্গেট হলেই হয়ে যেত কিন্তু আমি বুঝে গেছি…আমি আর এর মধ্যে নেই।”
“আমারও একটা টার্গেট বাকি…তুমি হতে পারো আমার সেই দুর্লভ শিকার।”
“আর তোমরা হতে পারো আমার বাকি দুটো শিকার!”
নতুন একটা কণ্ঠ শুনে আহাব আর যুবক ফিরে তাকালো। তাদের থেকে কয়েক হাত দূরে, ডানদিকে গ্লুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে আরেক যুবক। কখন এসে দাঁড়িয়েছে টেরই পায়নি। সেই যুবকের মুখে বিজয়ির হাসি।
দু-জন গ্লকধারী যুবকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে আহাব। কিন্তু সে নিরস্ত্র। কোমর থেকে গ্লকটা তুলে নেবার কথা চিন্তাও করছে না এখন।
“ফাউন্ডেশন আমাদের সবাইকে ফাঁদে ফেলে দিয়েছে!” কেবল এটাই বলতে পারলো সে। একদম শান্ত ভঙ্গিতে। নতুন যুবককে বোঝানোর মতো সময় পাবে কি না জানে না। “অমরত্বের ফাঁদে!”
সঙ্গে সঙ্গে স্কয়ার থেকে হৈহট্টগোল শোনা গেল। তারা তিনজনেই ফিরে তাকালো সেদিকে। শত শত, হাজার হাজার মানুষ মুখ তুলে তাকিয়ে আছে পুব-আকাশের দিকে। বিশাল হলোগ্রাফিক ঘড়িটা কাউন্টডাউন শুরু করে দিয়েছে।
১০…
৯…
“ফাউন্ডেশন…আসলে ওটা হলিয়েনরা চালায়!” বেশ শান্তকণ্ঠে, পরাজিত সৈনিকের মতো কথাটা বলল আহাব। ভালো করেই জানে, দু-জন যুবকের মধ্যে সর্বোচ্চ একজন তার কথাটা বিশ্বাস করবে।
“হা-হা-হা!” অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল তৃতীয় যুবক। “মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়ে মানুষ কতোেরকমই না চালাকি করে!”
“মৃত্যুমুখে তো তুমিও দাঁড়িয়ে আছো!” প্রথম যুবক তার গ্লকটা নেড়ে বলল।
হাসি থেমে গেল সেই যুবকের। তার চোখে ভীষণ তাড়া। পুব আকাশের দিকে তাকালো চকিতে।
আহাব জানে, এখনই ক্লিক করে শব্দটা হবে। কমপক্ষে দুটো। কিংবা তারচেয়েও বেশি।
সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার পটকা আর আতসবাজির শব্দে প্রকম্পিত হলো পুরো স্কয়ারটি। আহাব বুঝতে পারলো না তার দু-পাশ থেকে ক্লিক করে কোন শব্দ হয়েছে কিনা। সে জানে, স্মার্ট-গ্লকে যে বুলেট ব্যবহার করা হয় সেটা কোন রকম মৃত্যুযন্ত্রনা দেয় না, আস্তে করে ঘুমে ঢলে পড়ে মানুষ।
ঢলে পড়ার আগে পুব আকাশের দিকে তাকালো সে।
সেখানে কিছু নেই। কালো। অন্ধকার। জান্তব উল্লাস, আতসবাজি আর পটকার শব্দ হচ্ছে।
তারপরই কয়েকটি হলোগ্রাফিক সংখ্যা ভেসে উঠল।
০০০০
নতুন যুগের সূচনা হলো এইমাত্র। কিন্তু সেটা মানুষের যুগ নয়!