১৪. যে কারণে লাশ ভেসে উঠতে পারে

যে কারণে লাশ ভেসে উঠতে পারে

প্রশ্নকর্তার দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে আছে বুদ্ধ ডোম। একটু আগে তাকে কলোনির ঝুপড়ি ঘর থেকে ডেকে এনে এই মাইক্রোবাসে তোলার পর থেকেই ভয়ার্ত এক অভিব্যক্তি ম্যুরালের মতো স্থির হয়ে আছে তার চোখেমুখে। বিশ বছরের পেশাদারি জীবনে অসংখ্যবার সরকারি লোকজনদের মুখোমুখি হয়েছে, তাদের বেয়াক্কেল প্রশ্ন শুনে মনে মনে হেসেছে, গালিও দিয়েছে কিন্তু এমন প্রশ্ন কখনও শোনেনি।

তার সামনে বসে আছে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের এক লোক। তবে পুলিশের মতো তার সাথে যা-তা ব্যবহার করছে না। শুরু থেকেই এই লোকের ব্যবহারের মধ্যে ভদ্রগোছের কিছু একটা আছে, শুধু তুই-তোকারিটা বাদে।

“সব লাশই পানিতে ভাসে, স্যার,” খুব আস্তে করে বললেও গাড়ির ভেতরে কথাটা জোরেই শোনালো। রাত প্রায় দেড়টা বাজে, মানুষজন তো দূরের কথা পথে নেড়িকুকুরও দেখা যাচ্ছে না।

সরকারি লোকটি এমন বালখিল্য জবাব শুনে রেগে গেল না। গাড়িতে তোলার পর থেকেই এই ডোম ঘাবড়ে গেছে। বার বার বলেছে, সজ্ঞানে সে কোনো অপরাধ করেনি এই জীবনে। লাশ কাটাছেঁড়া করে জীবিকা অর্জন করে। খুবই তুচ্ছ একটি কাজ। অজান্তে যদি কোনো অপরাধ সে করেও থাকে তবে তার জন্য দায়ি হতে পারে তার কর্তারা। সে তো নিছক হুকুমের গোলাম।

“তোর ভয়ের কিছু নেই,” প্রশ্নকর্তা অভয় দিলো বুদ্ধকে। “তুই খামোখা ভয় পাচ্ছিস। একটা বিপদে পড়ে তোর সাহায্য চাইছি…বুঝলি?” শেষ কথাটা ইচ্ছে করেই বলল। ডোমের মতো নগন্য লোকের কাছে একজন সরকারি তোক সাহায্য চাইছে-এটা শোনার পর এই ডোম কিছুটা স্বাভাবিক হবে। মানুষ যখন নিজের গুরুত্ব বুঝতে পারে তখন সে কিছুটা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে।

কিন্তু বুদ্ধ ডোমের ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি অপরিবর্তিত রইলো। অজানা এক আশংকা ঘাপটি মেরেছে তার ভেতরে।

“উফ,” বিরক্ত হয়ে বলল সরকারি লোকটি। “এই গাড়িতে বসে থাকলে সিদ্ধ হয়ে যাবো।”

“স্যার,” এই প্রথম গাড়ির ড্রাইভার কথা বলল পেছন ফিরে। “পার্কের ভিতরে গিয়া বসতে পারেন…ওইখানে বসার ব্যবস্থা আছে। আমি গাড়িটা ওইখানে নিয়া যাই?”

গাড়িটা এখন দোয়েল চত্বরের কাছে তিন নেতার মাজারের সামনে।

“এতো রাতে পার্কের গেট খোলা থাকেবে?”

“পার্কের ভিতর যে মন্দিরটা আছে ওইটার মেইনগেট সারা রাইতই খোলা থাকে। আজেবাজে পোলাপান ওইখানে আকাম-কুকাম করে…আমাগো দেখলেই সব ফুটবো।”

“ওকে, যাও,” হুকুম দিলো সরকারি লোকটি।

কয়েক মুহূর্ত পরই পার্কের খোলা গেট দিয়ে ঢুকে পড়ল গাড়িটা। গেটের বেশ ভেতরে মন্দিরের সামনে কিছু ছেলেপেলে চেয়ারে বসে আড্ডা দিচ্ছে। প্রথমে ঘাড় উঁচু করে গাড়িটা ঢুকতে দেখলো তারপর যে যেদিকে পারলো দৌড়ে পালালো।

“নাম্‌,” সরকারি লোকটি বলল। গাড়ি থেকে নেমে এইমাত্র পরিত্যক্ত হওয়া খালি চেয়ারগুলোর একটিতে বসে পড়ল সে।

ছয়-সাতটি লাল রঙের প্লাস্টিকের চেয়ার। একটা চেয়ারের উপরে এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট আর লাইটার। মাটিতে পড়ে আছে দুটো কেরু অ্যান্ড কেরু’র ভদকার বোতল, একটা পুরোপুরি খালি। আরও আছে মিনারেল ওয়াটারের এক লিটারের বোতল আর দুটো গ্লাস। একটা মাটিতে পড়ে ভেঙে গেছে এইমাত্র। ইশারা করে বুদ্ধকে চেয়ারে বসতে বলল সে।

কিছু না বলে চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে পড়ল বুদ্ধ।

“সিগারেট খাবি?”

স্থিরচোখে চেয়ে রইলো ডোম। বিড়ি, সিগারেট, মদ-গাঁজা, ভাং কী না খায় সে। কিন্তু খুব কষ্টে মাথা দুলিয়ে না করলো। এই লোকের সামনে এটা খাওয়ার কথা ভাবতেও পারছে না।

একটা সিগারেট ধরালো সরকারি লোকটি। লম্বা করে টান দিয়ে তাকালো বহু দূরের আলোকিত বিজয় স্তম্ভের দিকে। রাতের এ সময়টাতে আলোকিত গ্লাস-টাওয়ারকে অশরীরি কিছু মনে হচ্ছে।

“তুইও একটা ধরা, মাথাটা পরিস্কার হবে…” আদেশের সুরে বলল সরকারি লোকটি।

বুদ্ধ একটা সিগারেট নিয়ে লাইটার দিয়ে ধরালো।’

“তুই ঠিকই বলেছিস, সব লাশই পানিতে ভাসে,” আরেকটা লম্বা টান দিয়ে বলল। “প্রেমের মরা জলে ডোবে না-ফালতু একটা কথা। আসলে কোনো মরাই জলে ডোবে না।”

বুদ্ধ চুপচাপ সিগারেট টেনে যেতে লাগলো। “যে লাশের গায়ে ইটের বস্তা পেঁচিয়ে ফেলা হয় সেই লাশও ডোবে না।”

ডোম সিগারেট টানা থামিয়ে চেয়ে রইলো সরকারি লোকটির দিকে।

“একটা নয় দুটো নয়…দশ-পনেরোটি ইট…তারপরও কীভাবে পানিতে ভেসে উঠলরে?”

“লাশ পানিতে বেশিক্ষণ থাকলে ভিজা ফুইলা ওঠে, স্যার,” নরম গলায় বলল বুদ্ধ। “নাক, মুখ আর কান দিয়া পানি ঢুইকা বুক-প্যাট এমন ফুইলা যাইবো যে, দশ-পন্ডোটা ইটা থাকলেও ভাইসা উঠবো।”

সরকারি লোকটি চেয়ে রইলো অশিক্ষিত ডোমের দিকে। “লাশগুলোর পেট যদি কেটে দেয়া থাকে, তাহলেও?”

বুদ্ধের চোখে বিস্ময়। “কয়টা লাশ, স্যার?”

সরকারি লোকটি সামান্য ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। “লাশ কয়টা সেটা কথা নয়, কথা হলো পেট কেটে দেয়ার পরও লাশগুলো কীভাবে ভেসে উঠল।”

সিগারেটটা বুদ্ধের আঙুলে আটকে আছে। “স্যার, লাশ খুবই আজব জিনিস। লাশের মইদ্যে অনেক আজব ব্যাপার থাকে। আপনি বিশ্বাস করবেন না, ভাববেন এইগুলা আমাগো মতোন মূর্খ লোকজনের ফালতু কথা।”

“কী রকম আজব ব্যাপার থাকে?” শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো সারকারি লোকটি।

“কখনও কখনও এমন লাশও পইছি যেটা দুইদিন পরও পচে নাই। আবার এমনও দেখছি, লাশের শরীর থেইকা খুশবু বাইর হইতাছে। কোনো দুগন্ধ নাই। হালকা একটা খুশবু।”

“তুই মদ খেয়ে লাশ কাটিস তাই মাঝেমধ্যে তোর হেলুসিনেশান হয়। অডিও-ভিজুয়াল, এমনকি গন্ধেরও হেলুসিনেশান হতে পারে।”

বুদ্ধ কোনো প্রতিবাদ করলো না। “গত বছর আমি একটা লাশ পাইছিলাম, স্যার। ছয়টা গুলি খায়া মরছে। মরার ছয়ঘণ্টা পর লাশটা কাটছিলাম, প্যাঁচপ্যাঁচ কইরা টাটকা রক্ত বাইর হইলো।”

সরকারি লোকটি ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো ডোমের দিকে।

“আমাগো ডাক্তারসাব তো মদ খায় না, হে কিন্তু লাশটা দেইখা চুপ মাইরা গেছিল।”

“তোর ঐ ডাক্তার এর কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি?”

“উনি খালি কইলেন, আল্লাহর দুনিয়ায় অনেক কিছুই হয়…সব বোঝার ক্ষমতা মানুষের নাই। “

সরকারি লোকটি চুপ থেকে বলল, “তুই জীবনে কতো লাশ কেটেছিস, বুদ্ধ?”

একটু ভেবে নিলো ডোম। “ধরেন বারোশ’?”

“কী বলিস?!” চোখ বড় বড় করে বলল প্রশ্নকর্তা। “পানিতে ভেজা লাশ কতোগুলো পেয়েছিস?”

“ধরেন এক-দেড়শ’?”

“মাইগড! আমি তাহলে যোগ্য লোকের কাছেই এসেছি।”

এই প্রথম ঊনচল্লিশ বছরের বুদ্ধ ডোমের মুখে এক চিলতে হাসি দেখা গেল।

“এতো লাশ কেটেছিস…তোর খারাপ লাগেনি?”

“প্রথমদিকে লাগতো এখন আর লাগে না।”

“কেন লাগে না?”

“আমি তো লাশ কাটি…মরা মানুষের লাশ। জিন্দামানুষ হইলে না-হয় কথা আছিল।”

আল্‌তো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো লোকটি।

“লাশের চায়া অসহায় আর কিছু নাই, স্যার। হেরা কোনো বাধা দিতে পারে না। মুখ ফুইটা কিছু কইতে পারে না। কান্না কান্না চোখে তাকাইতেও পারে না। খালি ইলিশ মাছের মতো তব্দা খাইয়া পইড়া থাকে।”

“বাহ্, দারুণ কথা বললি তো,” সরকারি লোকটি বলল। “লাশের চেয়ে অসহায় আর কিছু নেই!”

বুদ্ধ ডোম চুপ মেরে রইলো।

“বুঝলি, ঐ লাশগুলোর আচরণ খুবই রহস্যজনক ছিল। মনে হয় তারা জীবন্ত মানুষের মতো সাঁতরে নদীতীরে এসে শুয়ে আছে!”

“লাশগুলা নদীতে ফেলছে?”

“হুম। বিরাট বড় এক নদীর মাঝখানে…তারপরও ভেসে উঠল!”

“ফালানোর আগে কি হেরা পানির ঠাঁই মাইপা নিছিল?”

সরকারি লোকটি স্থিরচোখে চেয়ে রইলো অশিক্ষিত ডোমের দিকে। “মনে হয় না।”

“নদীর পানি একেক সময় একেক রকম থাকে। বর্ষাকালে বেশি, শীতকালে কম।”

“এখন কি বর্ষাকাল?”

“এইটা বৈশাখ মাস…বর্ষা এখনও আসে নাই।”

“এই সময়ে নদীতে কেমন পানি থাকে?”

“মোটামুটি।”

“তাহলে মোটামুটি পানিতে ফেললেও কি লাশগুলো ভেসে উঠবে?”

“মনে হয় কম পানির মইদ্যে ফালাইছে। নদীর মাঝখানেও অনেক সময় একহাত পানি থাকবার পারে। সেই পানিতে নৌকা চলবার পারে, স্যার। দিনের বেলায় হইলেও বুঝার কুনো উপায় থাকবো না। পানি যদি আয়নার মতো ফকফকা থাকে তাইলে বুঝা যায় ঠাঁই কতোটুকু।”

“কাজটা হয়েছে গভীর রাতে। আর ওখানকার পানি খুবই নোংরা,” একটু থেমে আবার বলল, “ওরা নৌকা ব্যবহার করেনি…স্পিডবোট ব্যবহার করেছিল।”

বুদ্ধ কিছু বলল না।

“ধরে নিলাম একহাত পানিতেই ফেলে দেয়া হয়েছে, কিন্তু সাত-সাতটি লাশ নদীর মাঝখানে অগভীর জায়গায় ফেলে দিলেও কি তীরে এসে পড়বে? মনে রাখবি, প্রতিটি লাশের শরীরে দশ-পনেরোটি ইটভরা বস্তা বাঁধা ছিল।”

ঠোঁট ওল্টালো ডোম। “তাইলে তো পাড়ের দিকে চইলা আসার কথা না। মনে হয় ইটের বস্তাগুলা খুইলা গেছিল।”

“একটাও খোলেনি। যে গিট দিয়েছিল, খোলার কথাও নয়। সবগুলোই লাশের শরীরের সাথে বাঁধা ছিল।”

“ও,” বুদ্ধ ডোম আর কথা খুঁজে পেলো না।

সরকারি লোকটি আকাশের দিকে মুখ করে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। “তোর কী মনে হয়?”

“আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকতাছে না,” আমতা আমতা করে বলল বিশ বছরের অভিজ্ঞ ডোম।

“ওটা একটু খা, মাথাটা খুলবে।”

মাটিতে পড়ে থাকা কেরুর বোতলের দিকে তাকালো বুদ্ধ। আনমনেই ঢোক গিললো সে।

“আমি কিছু মনে করবো না,” আকাশের দিকে চেয়েই বলল। “কালকের দুপুরের আগে স্যারকে রিপোর্টটা দিতে হবে। লাশ কেন পানিতে ভেসে উঠল এটা নিয়ে খুব কথা হচ্ছে। এটার পেছনে নাকি বিরাট রহস্য আছে।”

মদের বোতলটি তুলে নিয়ে কয়েক ঢোক পান করে ফেললো বুদ্ধ। “ভগবান চাইলে কীই না হয়, স্যার?”

মাথা দোলালো সরকারি লোকটি। “এইসব আধ্যাত্মিক কথা বিশ্বাস করা যায় কিন্তু রিপোর্টে লেখা যায় না। এখন বল, অন্য কোনো কারণে কি লাশগুলো এভাবে মাঝনদী থেকে ভেসে পাড়ে চলে আসতে পারে?”

“স্যার, আমি লাশকাটা লোক, লাশ কেমনে ভাইসা উঠে কইবার পারুম না। তয় আমার মনে হয় একভাবে এইটা সম্ভব।”

“কিভাবে?” নড়েচড়ে বসলো সরকারি লোকটি।

“ধরেন, লাশগুলা যখন নদীতে ফালাইতেছিল তখন নদীর পাড় থেইকা কেউ এইটা দেখছে?”

“অতো রাতে কে দেখবে? জায়গাটা একেবারেই নির্জন। আর লাশগুলো ফেলা হয়েছে রাত দুটোর পর।”

“যতো নির্জনই থাকুক, রাইত যতোই হোউক, কেউ না কেউ থাকবারই পারে। নদীর কুন্ পাড়ে কে বইসা বইসা মাছ ধরতেছিল, বিড়ি ফুঁকতেছিল কে জানবো, স্যার?”

“তোর মাথায় এটা কেন এলো? মানে, কেউ লাশগুলো ফেলতে দেখেছে?” সরকারি লোকটি ভুরু কুঁচকে ফেললো।

“আমার বয়স যখন বারো-তেরো বছর তখন এইরকম একটা ঘটনা ঘটছিল আমাগো গেরামে।”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো প্রশ্নকর্তা।

“বাবায় আমারে মাছ ধরতে দিতো না। আমি করলাম কি, একদিন মাজরাইতে উইঠা আমার দোস্ত হানিরে লইয়া নদীর ধারে গেলাম। আগেই ঠিক করছিলাম দুইজনে মিলা সারা রাইত ছিপ দিয়া মাছ ধরুম। হানিফ কইছিল রাইতে নাকি বড় বড় মাছ পাওয়া যায়। তো, আমরা দুইজনে ছিপ নিয়া বইসা আছি, এমন সময় দেখি নদীতে একটা নৌকা… ছয়-সাতজন লোক…তারা ধরাধরি কইরা বস্তার মতো কিছু নদীতে ফালাইতাছে,” বুদ্ধ ডোম একটু থামলো। “ওইগুলা আসলে লাশ ছিল।”

“ইন্টারেস্টিং।”

“আবার হইতে পারে, খুব ভোরে কেউ মাছ ধরণের লাইগা জাল ফালাইলো, তার জালে লাশগুলান ধরা পড়ল…আমাগো গেরামের মথু জাউলার জালে এইরকম লাশ পাওয়া গেছিল।”

“বুদ্ধ, তোর মাথা তো খুব পরিস্কার। মদ পেটে যেতে না যেতেই মাথা খুলে গেছে।”

অশিক্ষিত ডোম মলিন হাসি দিলো।

“ঠিক আছে। একজন নিশাচর দেখে ফেললো লাশগুলো ফেলা হচ্ছে, কিংবা কেউ মাছ ধরতে গিয়ে লাশগুলো খুঁজে পেয়েছে…তাহলে ওরা পুলিশে খবর না দিয়ে নিজেরা কেন লাশগুলো নদীর পাড়ে এনে রেখে দেবে?”

বুদ্ধ ডোমের মুখে দেখা গেল বাঁকাহাসি। “স্যার, পাবলিক পুলিশূরে ডরায়। ওরা মনে করছে পুলিশে খবর দিলে ঝামেলা হইবো, বিরাট ভেজালের মইদ্যে পড়তে হইবো।”

“হুম,” সরকারি লোকটি বলল। “তুই আর তোর বন্ধুও কি ঐ লাশগুলো নদী থেকে টেনে পাড়ে এনে রেখেছিলি?”

“না, স্যার। আমাগো বয়স তখন খুব কম, আমরা এইটা কেমনে করুম?”

“তাহলে তোরা গ্রামের সবাইকে বলে দিলি পরদিন?”

“সবাইরে না, খালি একজনরে কইছি।”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো সরকারি লোকটি। “কাকে?”

“মরণচাঁন নামের এক কানা বুইড়া আছিল আমাগো গেরামে। বুইড়া কান পাইতা সবার কথা শুনতো আর বাড়ায়া বাড়ায়া গপ করতো মানুষের কাছে। গল্ করা তার বাতিক আছিল।”

সরকারি লোকটি বেশ মনোযোগ দিয়ে অশিক্ষিত ডোমের গল্প শুনে যাচ্ছে।

“পরদিন খুব সকালে হানিফ ওই বুইড়ার সামনে গিয়া আমারে জোরে জোরে কইতে লাগলো, ‘নদীতে কাইল রাইতে তিনটা লাশ ফালাইতে দেখলাম। ঐ যে, হারুনের কারেন্ট জালটা পাতা আছে না…ঐটার ঠিক পঞ্চাশ হাত দূরে…’” বুদ্ধ ডোম একটু থামলো। “বুইড়া তো কান খাড়া কইরা সব শুইনা ফালাইলো, তারপর দুপুরের আগেই পুরা গেরাম জাইনা গেল, পাশের দশ গেরামও জাইনা গেল নদীর কুন জায়গায় তিনটা লাশ ফালাইছে।”

ঠোঁট ওল্টালো সরকারি লোকটি। “ইন্টারেস্টিং ঘটনা।”

“হ, স্যার। কিন্তু একদম সত্যি।”

“তারপর কি লাশগুলো পাওয়া গেছিল?”

“বিকালের আগেই সবগুলা পাওয়া গেছিল, স্যার।”

“হুম,” মাথা নেড়ে সায় দিয়ে উদাস হয়ে গেল সরকারি লোকটি।

“ভগবান চাইলে যতোই চেষ্টা করেন না ক্যান কাম হইবো না। লাশ ঠিকই ভাইসা উঠবো।”

“ভগবান?” কপালে ভাঁজ পড়ে গেল সরকারি লোকটির। “ধুর!” হাত নেড়ে বাতিল করে দিলো কথাটা। “তোদের ভগবান যদি এতোই দয়ালু হতো তাহলে খুনগুলোই হতে দিতো না। লাশ ভাসিয়ে খুনিদের ফাঁসানোর চেয়ে আরও ভালো কিছু করতো।”

“আমার বাপে কইছে ভগবান বাইরে থাকে না…মানুষের মইদ্যেই থাকে। আবার অসূরও থাকে মানুষের মইদ্যে। অসূর খুন করছে আর ভগবান সেইটা জানায়া দিছে।”

“যা-ই হোক, ওটাই হয়েছে, আই অ্যাম কোয়াইট শিওর।”

“কুনটা, স্যার?”

“লাশগুলো ফেলে দেবার সময় কেউ দেখে ফেলেছে…কিংবা ভোরের দিকে কেউ মাছ ধরতে গিয়ে জালে পেয়েছে। এটাই সবথেকে ভালো এক্সপ্লানেশন। আমার ধারণা, সাতটা লাশ নদী থেকে টেনে পাড়ে এনে রাখতে কমপক্ষে তিন-চারজন লোকের দরকার পড়েছিল। আর ঐ লোকগুলো অবশ্যই আশেপাশের গ্রামে থাকে। কাল আমি সবকিছু বিস্তারিত

জানাবো স্যারকে।”

“আপনার স্যার?” নির্দোষভাবে প্রশ্নটা করলো বুদ্ধ।

“ঠিক আমার স্যার না। আমার স্যারেরও স্যার…মানে, সব স্যারের স্যার…উনি অস্থির হয়ে উঠেছেন এই প্রশ্নটার জবাব খুঁজে পেতে।”

সরকারি লোকটি আবারও আকাশের দিকে তাকলো। সাত-সাতটি লাশ কেন এতো প্রচেষ্টার পরও এভাবে ভেসে উঠল সেটা যেমন তার কাছে তেমনি উপর মহলের কাছেও বিরাট একটি রহস্য। এই রহস্য উন্মোচন করার জন্যই সারাটা দিন ব্যস্ত ছিল সে, কোনো কূল কিনারা করতে পারেনি। এখন এই অশিক্ষিত ডোমের সাথে কথা বলে মনে হচ্ছে কূল আর কিনারের সব কিছুই পরিস্কার।

“চল, তোকে তোর বাসায় নামিয়ে দেই।”

“আমি হাইটা যাইতে পারুম স্যার। এইহান থেইকা আমার কোয়ার্টার বেশি দূরে না।”

একটু ভেবে মাথা নেড়ে সায় দিলো সরকারি লোকটি। “তাহলে কোয়ার্টারে ফিরে যা, তোকে ছেড়ে দিলাম।”

বুদ্ধ ডোম পা বাড়ালো পার্কের গেটের দিকে। কিছুটা এগিয়ে যেতেই ঘুরে দাঁড়ালো সে।

“স্যার, আপনেরে আমি একটা কথা ভুল কইছি।”

সরকারি লোকটি ভুরু কপালে তুললো। “কী ভুল বলেছিস?”

বুদ্ধ আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “লাশের চায়াও অসহায় আছে।”

স্থিরচোখে চেয়ে রইলো সরকারি লোকটি।

“কিছু মানুষ! তারা লাশের চায়াও অসহায়।”

বুদ্ধ ডোম আবার ঘুরে সামনের দিকে পা বাড়ালো। তার পেছনে পড়ে রইলো লাশের মতো ফাঁকা দৃষ্টির একজন মানুষ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *