০৬. ঈশ্বরকার

ঈশ্বরকার

ঠাডক তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে, মাথায় ঘুরছে নানান চিন্তা। দূর থেকে ভেসে আসা সুরধ্বণি তাকে আরো বেশি বিক্ষিপ্ত করে ফেলছে।

উঁচুনীচু প্রান্তরটি ঢেকে আছে সবুজ ঘাসে, সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিছু পোষ মানানো মেষ। ভালো করেই জানে, মেষগুলো ঘাসের প্রান্তরে ছেড়ে দিয়ে মেট্‌ঠক নামের রাখাল ছেলেটি গাছের নীচে বসে শিষ বাজাচ্ছে নিত্যদিনকার মতো।

মেট্‌ঠকের সুর অনবদ্য, যে কেউ দুদণ্ড দাঁড়িয়ে শুনতে বাধ্য। ঠাডকও তাই করে সব সময়, তবে আজকে সে বেশ খানিকটা দূরে চলে গেল, যেনো সুরের আওতা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছে! যদিও বিশাল খোলা প্রান্তরে ঠিকই ভেসে বেড়াচ্ছে সুরটা। এর থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে আরো দূরে যেতে হবে তাকে।

একটা পাহাড়ের গুহা আছে কাছেই। সেখানে যাবার জন্য পা বাড়ালো সে। একটু ঢালু হয়ে উপরে উঠে গেছে গুহার মুখটি। হাতের লাঠিটায় ভর দিয়ে দিয়ে সেখানে ঢুকে পড়তেই মেট্‌ঠকের সুরটা তিরোহিত হয়ে গেল পুরোপুরি!

এক ধরণের প্রশান্তি নেমে এলো তার ভেতরে। গুহার আরো ভেতরে ঢুকে পড়ল সে। সূর্য এখন মাথার উপরে, পূর্ণ তেজে রোদ ফেলছে। সে তুলনায় গুহার ভেতরটা বেশ শীতল। তিন মানুষ উঁচু গুহার এবড়োখেবড়ো ছাদের দিকে তাকালো সে। কিছু বাদুর ঝুলছে সেখানে। ঘুমিয়ে আছে ওগুলো। ইঠাবরের প্রায় সবগুলো গুহার ভেতরেই পাথরের বড় বড় চাতাল আছে, এই গুহাতেও সেরকম এক চাতালের উপর আয়েশ করে শুয়ে পড়ল ঠাডক। ভেতরের অস্বস্তিটা এখনও তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। বিগত কয়েক দিন ধরেই এই অস্বস্তি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে।

এই ইঠাবরে তার মতো আর কেউ নেই-এক ও অদ্বিতীয় সে! কথাটা মিথ্যে নয়। তার জানামতে, গত বছর শিকারের মওসুমে আঠক নামের একজন বুনো ষাড়ের আক্রমণে মারা গেলে সে-ই হয়ে ওঠে ইঠাবরে একমাত্র জীবিত ব্যক্তি যে লিখতে-পড়তে জানে!

কিন্তু তাতে কি? মেট্‌ঠককে নিয়ে সবাই কথা বলে। তার সুর কানে গেলেই কাজ ফেলে দাঁড়িয়ে পড়ে। প্রশংসায় ভাসায় সবাই। যদিও মেটঠকই একমাত্র ব্যক্তি নয় যে, সুর তুলতে পারে। তার মতো কমপক্ষে তিনজন আছে এই ইঠাবরে-তাদের সুরও যথেষ্ট ভালো। তাদেরও কদর আছে ইঠাবরে। কিন্তু ঠাডক দেখেছে, কোথাও তাকে নিয়ে কোনো মাতামাতি নেই, প্রশংসা তো দূরের কথা।

কিছু মানুষকে সে লেখা পড়তে শেখানোর চেষ্টা করলেও তারা মনোযোগি ছিল না। এসব শিখে তারা কী করবে?-এমন প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছিল লোকগুলো।

সত্যিই তো, লেখা পড়ে কী করা যায়? এটা তো শিকার করার কাজে লাগে না। অস্ত্র বানানোর কাজেও দরকার পড়ে না কখনও। দৈনন্দিন জীবনে এর কোনো ব্যবহারিক দিক আছে কি না ঠাডক নিজেও খুঁজে বের করতে পারেনি। সর্বজন শ্রদ্ধেয় এক শ’ বসন্ত দেখা রাঠাকের কাছ থেকে সে শুনেছে, এক সময় নাকি মানুষ কথা বলতে পারতো না। গাছের বানর আর জঙ্গলের পশুদের মতোই ঘোঘোৎ করে, চিঁচিঁ করতো তারা। বৃদ্ধ রাঠাক এসব কথা কোত্থেকে জেনেছে-সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করেছিল সে। ইঠাবরের প্রবীণ মানুষটি জানিয়েছে, এসবই তার দাদা-পরদাদাদের কাছ থেকে পাওয়া। তার বাবাও সেভাবেই এসব জেনে এসেছে। তার সন্তানেরাও নিজেদের সন্তানকে এসব গল্প বলবে। আর এভাবেই নাকি গল্পগুলো বেঁচে থাকবে অনন্তকাল।

মানুষের মুখে মুখে?!

ঠাডকের তাতে সন্দেহ আছে। সে-ও তার বাবা-মা আর দাদা-দাদির কাছ থেকে এরকম অনেক গল্প শুনেছে। কিন্তু যুদ্ধে কিংবা মহামারিতে পুরো গ্রাম শেষ হয়ে গেলে, এই গল্পগুলো কিভাবে বেঁচে থাকবে? মানুষই যদি না থাকে তার মুখের গল্প টিকে থাকবে কিভাবে?

বৃদ্ধ রাঠাক নিশ্চুপ ছিলেন এ কথা শুনে।

ঠাডক বুঝতে পেরেছিল, জ্ঞানী রাঠাকের কাছেও এ প্রশ্নের জবাব নেই। এই বিষয়টাই তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে অনেক দিন থেকে। তাতে যোগ হয়েছে, লিখতে জানার মধ্যে কী এমন গৌরব আছে-এই ভাবনাটি!

হঠাৎ করেই মেট্‌ঠকের সুরটা আবার শুনতে পেয়ে উঠে বসলো সে। তবে কি গুহার কাছে এসে শিষ বাজাচ্ছে রাখাল?

না।

মেট্‌ঠক কখনও এ কাজ করবে না। মেষগুলো রেখে এতো দূরে চলে আসার কথাও নয়। তাহলে?

সুরটা আবার মিলিয়ে গিয়ে পরক্ষণেই ফিরে আসতেই ঠাডক বুঝতে পারলো, এটা আনঠকের কারসাজি।

আনঠক সবখানেই আছে। তার ধারণা, সে ঘুরে বেড়ায় সর্বত্র। কিছুটা খামখেয়ালিও বটে। কখনও কখনও ভয়ঙ্কর রেগেও যায়। আবার মায়ের মতো মমতার পরশও বুলিয়ে দেয়। তবে কোনোদিনও তার বাবার মতো নিরুদ্দেশ হয় না! প্রতি মুহূর্তে নিশ্বাসের মধ্য দিয়ে আনঠক মানুষের ভেতরে প্রবেশ করে, নতুন জীবন দান করে। আনঠক না থাকলে মৃত্যু অবধারিত!

এই আনঠকই দূর থেকে মেটঠকের সুরটা বয়ে নিয়ে এসেছে।

চাতালের উপর থেকে উঠে গুহার আরো ভেতরে চলে গেল ঠাডক। হাঁটতে হাঁটতে ভেতরে যেতেই যখন বুঝলো সুরটা আর শোনা যাচ্ছে না তখন থেমে গেল। গুহার মাটি শীতল। নিজের গায়ে জড়িয়ে রাখা আস্ত ভেড়ার চামড়াটা খুলে পাশে রেখে দিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়ল সে। চিৎ হয়ে ভাবতে শুরু করলো আবার। নানান রকম চিন্তা করা ছাড়া দিনমান আর কিছু করারও’নেই তার।

যারা হাতিয়ার বানায় তারাও ইঠাবরে বেশ সম্মানিত। মেঠকের মতো সুর তোলে যারা তারাও আদরনীয়। সবারই কোনো না কোনো যোগ্যতা আছে যার জন্যে মানুষ তাদেরকে সম্মান করে, কিন্তু ঠাডকের সেরকম কিছু নেই! সে কেবল লিখতে জানে! আর এটা ইঠাবরে কোনো কাজেই আসে না। এমনকি নিঠকদের মতো যারা মুখে মুখে গল্প বলে, ইঠাবরের মানুষজনকে আনন্দ দেয়, তাদেরকেও বেশ খাতির করে লোকে। ঠাডক তার মতো করে গুছিয়ে গল্পও বলতে পারে না। তবে সে গল্প লিখতে পারে, কিন্তু ইঠাবরে সেই গল্প পড়ার মতো মানুষ কই?

লিখতে-পড়তে জানা শেখাটা বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। পাথরের গায়ে খোদাই করে লেখা অনেক পরিশ্রমেরও বটে। আবার চামড়ার উপরে কালি দিয়ে লেখাটাও সহজসাধ্য কিছু নয়। কালি বানাতে হয় কয়লা থেকে, বিশেষভাবে চামড়াও প্রস্তুত করাও লাগে। তাই বিপদে না পড়লে মানুষ লেখার কথা মাথায়ও আনে না। ঠাডক দেখেছে, বছরে মাত্র কয়েকবার তার দরকার পড়ে। বাকিটা সময় সে পুরোপুরি কর্মহীন একজন মানুষ। আর কর্ম নেই বলে তার কদরও নেই। ইঠাবরে সে অযাচিত একজন মানুষ!

ঠিক কততক্ষণ পর সে জানে না, সম্ভবত তিন হাজার নিশ্বাসের পর গুহার ভেতরে আলোর বন্যা ঢুকে পড়ল হঠাৎ করে!

কাঠকটা!

আকাশে যে আলোর গোলাটা আছে তাকে তারা এ নামেই ডাকে। যার আগমণে দিনের শুরু হয়, আর অনুপস্থিতিতে চলে আসে তাঠক।

আকাশে কাঠকটা হেলে পড়েছে এখন, আর তাতেই গুহার মুখ দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছে কাঠক। পুরো গুহাটা আলোয় ভরে উঠলে ঠাডকের চোখ গেল গুহার ডানদিকের দেয়ালের দিকে। মাটি থেকে চোখ সমান দূরত্বে গুহার দেয়ালটি ভরে আছে নানান রকম চিত্রে!

মানুষ শিকার করছে। খাবার খাচ্ছে। বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে আছে মা। ছোটো থেকে মানুষ বড় হয়ে নুয়ে পড়া বৃদ্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে। বৃষ্টির ছবি। খরার ভয়াবহ দৃশ্য। কতো কীই না আছে তাতে। এমনকি মেট্‌ঠকের মতো একজনকেও দেখতে পেলো। গাছের নীচে বসে শিষ বাজাচ্ছে। হাতিয়ার বানায় যে, সে-ও আছে।

কিন্তু ঠাডক নেই! তার মতো কেউই নেই!

থাকার তো কথাও নয়। ইঠাবরে তার মতো কারোর কদর কোনো কালেই কি ছিল? তাহলে গুহার দেয়ালে সে কেন স্থান পাবে?

ইঠাবরের প্রায় সবগুলো গুহাই এরকম চিত্রে পরিপূর্ণ। দিনরাত খেয়ে না খেয়ে মেরাঠকরা গুহার দেয়ালে ছবি আঁকে। এসব কী কাজে লাগে সে জানে না, তবে ইঠাবরের সবাই তাদেরকে সম্মান করে। গুহায় ঢুকে দলে দলে মানুষ ছবি দেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে। যেনো এই ইঠাবরে সবচেয়ে জরুরি কাজটা করে মেরাঠকেরাই! অথচ মেরাঠক মানে ‘নকলকারি!’ নকলেরও কদর আছে ইঠাবরে!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো ঠাডক, গুহা থেকে বের হয়ে গেল অনেকটা দৌড়েই। তীব্র ঈর্ষা নয়তো দুঃখবোধ তাকে গ্রাস করেছে। উদভ্রান্তের মতো সে ঘাসের প্রান্তর দিয়ে ছুটে যেতে লাগলো। যেনো ইঠাবর ছেড়ে চলে যাবে বহু দূরে! এভাবে কতোক্ষণ সে উদভ্রান্তের মতো হাটলো জানে না। এক সময় তার বুকটা লাফাতে শুরু করলো। সে জানে বুকের ভেতরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা রিঠক ক্ষেপে গেছে। একটু বিরতি দিলো সে। কিছুক্ষণ পর টের পেলো পা দুটো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

ইঠাবর থেকে বহু দূর এসে, বিকেলের দিকে থমকে দাঁড়ালো ঠাডক। নিজের প্রিয় আশ্রয়টা খুব কাছেই। আজকাল ওটাই তার নিজের ঘরের মতো হয়ে উঠেছে। গোপন এই ঘরের কথা ইঠাবরের কেউ জানে না!

আবার পা বাড়াতেই অবাক হয়ে পরিচিত একজন মানুষরে দেখা পেয়ে

গেল!

মুচকি হাসি ফুটে উঠল ঠাডকের ঠোঁটে।

তানঠক। সে যে ইঠাবরে সবচেয়ে বোকা ছেলে তা নিয়ে কারোর মধ্যে দ্বিমত নেই। আঙুলে করেও গুণতে জানে না ঠিকমতো। চারপাশের যে জগত আছে তার প্রতি কোনো কৌতূহল নেই তার। ইঠাবরের সবচেয়ে সুখি ছেলেও সে-ই। শিকারের পশুগুলোর চামড়া ছেলা ছাড়া এ জীবনে আর কোনো কাজ করতে পারে বলে মনে হয় না। প্রকৃতির অদ্ভুত হেয়ালি হলো, এই তানঠকের সাথেই সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তার-যার সব কিছুতেই কি না অপার আগ্রহ, সারাক্ষণ যার মাথায় অসংখ্য ভাবনা খেলে যায়।

তাকে দেখে ঠাডক অবাক হবার ভাণ করলো-এতো দূরে তুমি কী করতে এসেছো?

হাসিমুখে তানঠক জানালো, দিক ভুলে চলে এসেছে এখানে। ভাগ্য ভালো, ঠাডকের সাথে দেখা হয়ে গেল, নইলে যে তার কী হতো!

এই ছেলেটা দিকজ্ঞান সম্পর্কেও অজ্ঞ। তাকে যতোই শেখানো হোক না কেন, কাঠকডা যেখান দিয়ে ওঠে সেটা ওঠক। পেছনটা দিক। ডান দিকটা ইট্‌ঠক আর বাম দিকটা তিট্‌ঠক। সমস্যা হলো, সে ইট্‌ঠক আর তিট্‌ঠক গুলিয়ে ফেলে!

যাইহোক, তানঠক অবশ্য কোনো প্রশ্ন করলো না ঠককে-সে কেন এখানে? তার মতো সে-ও কি হারিয়ে গেছে কিনা-কিছুই জানতে চাইলো না। বন্ধুকে পেয়েই খুশিতে গদগদ সে।

কাঠকডা এখন ডুবি ডুবি করছে। রাতের আকাশে তারা দেখে ঠাডক দিক নির্ণয় করতে পারে, কিন্তু সূর্য ডোবা আর তারা ওঠার মাঝে কয়েক হাজার নিশ্বাস থাকে-এই সময়টুকুতে কিছু করার থাকে না। তারচেয়েও বড় কথা, তাদের দুজনের কাছে কোনো হাতিয়ার নেই-ঠাডকের হাতের লাঠিটা ছাড়া। ওটা বানানো হয়েছে গরুর পায়ের হাড় দিয়ে, হাতিয়ার হিসেবে বড্ড বেমানান, এ জিনিস দিয়ে একটা নেকড়েকেও তাড়ানো যাবে না-বাঘের কথা না-হয় বাদই দেয়া গেল। এছাড়াও এই এলাকায় আছে কতো না নাম না জানা জন্তু-জানোয়ার। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো ঠাডুকটা-যার নামের সাথে মিল রেখেই ঠাকডকের নাম রাখা হয়েছে!

বাঘের বাচ্চা!

এখন যদি তার নামজাত পিতা এসে হাজির হয় এখানে তাহলে দু জনের প্রাণই যাবে। ঠাডক নাম দেখে তো ঠাডুকটা রেহাই দেবে না। ঔঠুক নামের যুবককে কি গত বছর ঔঠুকটু রেহাই দিয়েছিল? ছেলেটাকে ছিঁড়ে খুবলে খেয়ে ফেলেছিল ওটা!

কাঠকডার কাঠক মিইয়ে এলে বন্ধুকে সে এ বলে বোঝাতে পারলো যে, এখানে থাকা নিরাপদ নয়। কাছেই একটা গুহা আছে, সেখানে ঢুকে পড়াই ভালো হবে। এখানকার গুহাগুলো বেশ নিরাপদ, যদি আগুন জ্বালিয়ে রাখা যায়। তানঠকের ভেড়ার চামড়ায় একটা কোটর আছে, তাতে রাখা আছে দুটো ছোট্ট কাঠের টুকরো। আর এটাই হলো আগুন জ্বালাবার উপযুক্ত হাতিয়ার।

গুহার ভেতরে ঢুকে কিছু শুকনো পাতা আর ডাল জড়ো করে কাঠি দুটো ঘষে ঘষে আগুন জ্বালিয়ে দিলো ঠাডক। আগুনটাকে সারা রাতের জন্য জ্বালাতে যে পরিমাণ কাঠ আর পাতার দরকার, সেগুলো কুড়িয়ে আনলো তারা দু-জনেই। তানঠকের কাছে খাবারের পোটলা থাকে সব সময়, আজো আছে-কিছু শুকনো মাংস আর তালের শাঁস। তবে পানি নিয়ে চিন্তার কিছু নেই-গুহার ভেতরে পানি পড়ার শব্দটা খুবই প্রকট।

রাত যখন গাঢ় হলো তখন ঠাডক আর তানঠক অল্প একটু শুকনো মাংস খেয়ে গল্প করতে শুরু করলো।

“এই যে চারপাশে এতো কিছু আছে, এ নিয়ে তোমার কোনো কৌতূহল নেই কেন, তানঠক?”।

বোকা ছেলেটা হাসিমুখে বলল, “কৌতূহল থাকবে কেন? সব তো ঠিকই আছে।”

আক্ষেপে মাথা দোলালো ঠাডক। “সব সময়ই কি সব কিছু ঠিকঠাক থাকে? কখনও কখনও এমন কিছু ঘটে না, যেটা তুমি কখনও দেখোনি?”

একটুও না ভেবে বলল তানঠক, “ঘটে তো। এই যে, আমি তুমি হারিয়ে গেলাম…এই গুহায় রাত কাটাতে চলে এলাম…এটা তো কখনও হয়নি আমার সাথে।”

“তুমি এ নিয়ে কৌতূহলী নও?”

“না। এটা তো মজার ব্যাপার। বড়দের কাছ থেকে শুনেছি, এরকম ঘটনা তাদের সাথেও ঘটেছে।”

মাথা দোলালো ঠাডক। “তোমার কি জানতে ইচ্ছে করে না আমরা সবাই কোত্থেকে এসেছি?”

হেসে ফেললো তানঠক। “এটা তো আমি জানিই! নতুন করে জানতে চাইবো কেন?”

“তুমি এটা জানো?!” ঠাডক অবাক হলো।

“হ্যাঁ। আট্‌ঠন্নি আমাকে বলেছে…আমরা সবাই এসেছি মায়ের পেট থেকে।”

আট্‌ঠন্নি হলো তানঠকের দাদি। তার মা-বাবা দু-জনেই মারা গেছে বহু আগে, যে-বার ইঠাবরে মহামারি লেগেছিল।

“আচ্ছা, আমরা তাহলে কোথায় যাবো?” পরের প্রশ্নটা করলো ঠাডক।

একটুও ভাবলো না তানঠক। “ইঠাবরে যাবো…আবার কোথায়!”

“আমি সেখানকার কথা বলছি না। আমি বলছি, আমরা মরে যাবার পর কোথায় যাবো?”

দাঁত বের করে হাসলো বোকা ছেলেটি। প্রশ্নটা তাকে ভীষণ অবাক করেছে। “তুমি এটা জানো না!”

ঠাডকের বিস্ময় কপালে গিয়ে ঠেকলো। তানঠক এটা জানে!

“আমরা সবাই হয় মাটির নীচে যাবো নইলে আগুনের খাদ্য হবো। আর যদি কারোর লাশ ফেলে রাখে, সে যাবে শেয়াল-শকুনের পেটে। না জানি কতো জন্তুর পেটে!”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো ঠাডক। তানঠক আসলেই বোকা। নাকি সহজ সরল? যাইহোক, তার সাথে কথা বলতে ভালোই লাগে-অন্তত বোকাদের চিন্তার জগত সম্পর্কে একটা ধারণা পায় সে। “আচ্ছা, মানুষের বয়স কেন বাড়ে? কেন বুড়ো হয়?”

আবারো দাঁত বের করে হাসলো তানঠক। “তুমি এটাও জানো না!” খুব মজা পাচ্ছে এখন।

ঠাডক অপেক্ষা করলো বোকাটা কী বলে শোনার জন্য।

“বয়স যদি না বাড়ে তাহলে তো বাকিরা সবাই তোমার চেয়ে অনেক বড় হয়ে যাবে, পিচ্চি হয়ে থাকতে হবে তোমাকে।”

হেসে ফেললো ঠাডক। “যদি সবার বয়স না বাড়ে, তাহলে…?”

এবার প্রশান্তির হাসি দিলো বোকা তানঠক। “তাহলে আর কী, কতোই না মজা হবে! আমরা সবাই একই রকম থাকবো। কোনো চিন্তাই থাকবে না। খাবো দাবো আর ঘুমাবো!”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো ঠাডক। “তুমি আবার চিন্তা করো নাকি যে চিন্তা না থাকার কথা বলছো!”

মাথা নেড়ে সায় দিলো তানঠক। “করি তো।”

“কী রকম?”

“এই যে, কবে আমি সঙ্গি পাবো…কবে আমি নিজের ঘর পাবো…এইসব।”

ইঠাবরে সাবালক হলে সঙ্গি পায় ছেলেরা-তবে কোনো মেয়ে নিজ থেকে যদি বেছে নেয় তবেই। আর মেয়েগুলোও খুব সেয়ানা, যাকে তাকে বেছে নেয় না। তাদের যাকে বেশি প্রয়োজন, যাকে দিয়ে বেশি বেশি কাজ করানো সম্ভব তাকেই বেছে নেয়। চাইলে যখন তখন পরিত্যাগও করতে পারে নিজের অধীনে থাকা ছেলেদেরকে। অবশ্য, কখনও কখনও মেয়েরা এক-দু দিনের জন্যেও বেছে নেয় কোনো ছেলেকে-আর সেটা ঠাডকের জীবনে দু-তিন বার ঘটেও গেছে এরইমধ্যে। কোনো মেয়ের সাথে যতোক্ষণ থাকা হয় ততোক্ষণ তার কাজ করে দিতে হবে-এটাই ইঠাবরের নিয়ম। ঠাডক দেখেছে, এই নিয়মের মধ্যে কিছু ফাঁক আছে। যেমন, এক মেয়ে গর্ভবতি হয়ে গেলে সে যার নাম বলবে তাকে তার অধীনে দাস হয়ে থাকতে হবে বাচ্চার বয়স তিন বসন্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত। কিন্তু প্রায়শই দেখা যায়, কোনো এক মেয়ে হয়তো গর্ভবতি হবার আগে একাধিক ছেলের সাথে থেকেছে, কার মাধ্যমে গর্ভবর্তি হয়েছে সেটা তখন নিশ্চিত করে জানা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে মেয়েটা যার কথা বলবে সে-ই হবে পরবর্তি তিন বসেন্তর জন্য তার অধীনস্ত দাস। এসব ক্ষেত্রে মেয়েরা তাকেই বেছে নেয় যাকে দিয়ে সবচেয়ে বেশি কাজ করানো যায়। আবার এমনও দেখা গেছে, যার মাধ্যমে সে গর্ভবতি হয়েছে সে মারা গেছে কিংবা দেশান্তরি হয়েছে, সুতরাং চতুর মেয়েটি বলশালি আর কর্মঠ একজনের নাম বলে দিলোতখন আর তার কোনো আপত্তি করার সুযোগই থাকে না। তাকে হয় মেনে নিতে হবে নয়তো চিরতরের জন্যে ছাড়তে হবে ইঠাবর। ভাগ্য ভালো, ঠাডকের সাথে এরকম ঘটনা ঘটেনি এখনও। কিন্তু যে কোনো সময় এটা ঘটতে পারে।

“আমার পেট ব্যথা করছে…একটু আসছি,” তানঠক বলে উঠল। একটা কাঠের ডালে আগুন ধরিয়ে সেটাকে মশাল বানিয়ে চলে গেল গুহার ভেতরে।

ঠাডক এটাই চেয়েছিল। নিশ্চিন্তে শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলো, কেন একেকজন মানুষ একেক রকম হয়? এতো পার্থক্য থাকে? পশুপাখি আর জন্তুদের মধ্যে তো এরকম পার্থক্য দেখা যায় না। তবে এক প্রাণী থেকে আরেক প্রাণীর পার্থক্য আছে। কিন্তু একটা পূর্ণবয়স্ক বাঘের সাথে আরেকটি পূর্ণবয়স্ক বাঘের কি কোনো পাথর্ক্য থাকে? দেখে কি তাদেরকে আলাদা করে চেনার উপায় থাকে?

এ প্রশ্নের জবাব তার কাছে নেই। পোকা-মাকড়ের বেলায়ও এ কথা খাটে। একই বয়সের একই জাতের পোকাগুলো দেখতে একই রকম হয়। কিন্তু মানুষের বেলায়ই কেবল ভিন্নতা দেখা যায়।

তানঠক ফিরে এলো এ সময়। “অ্যাই ঠাডক!” জোরে বলল সে। “গুহার ভেতরে কে যেনো কী সব লিখে রেখেছে! জলদি আসো!”

উঠে বসলো ঠাডক। “কী লিখেছে?”

“আরে, সেটা আমি কীভাবে বলবো! আমি কি লেখা পড়তে জানি?”

উঠে দাঁড়ালো সে। “চলো তো, দেখি!”

তানঠক তাকে নিয়ে গেল গুহার ভেতরে। জায়গাটা অপেক্ষাকৃত সঙ্কীর্ণ হয়ে একেবারে মনুষ্য চলাচলের অনুপযোগি হয়ে গেছে। সম্ভবত পশুপাখি ছাড়া ওখান দিয়ে আর কোথাও আসা-যাওয়া করতে পারে না। তানঠক তার হাতের মশালটি তুলে ধরলো গুহার দেয়ালের দিকে।

“দেখো!”

ঠাডক দেখতে পেলো গুহার দেয়ালে কোনো ছবি নেই, আছে অসংখ্য লেখা। ইঠাবরে যে ধরণের বর্ণ প্রচলিত আছে এগুলো সেরকমই।

“অ্যাই, তুমি জোরে জোরে পড়ো…আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!” তানঠক তাড়া দিলো।

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ঠাডক জোরে জোরে উচ্চারণ করলো দেয়ালের লেখাগুলো :

“হাজার বসন্ত আগে উনঠকনাকিরা আকাশ থেকে নেমে এসেছিল আগুনের তৈরি বিশাল একটি পাখির ভেতর থেকে। তাদের চোখ ছিল বড় বড়, হাতদুটো শক্তিশালি। তাদের গায়ে ছিল অদ্ভুত পোশাক। ইঠাবরের কেউ এমন পোশাক কখনও দেখেনি। তারা এমন এক ভাষায় কথা বলতো যেটা কেউ কোনো দিন শোনেনি। ইঠাবরের সুদর্শন যুবক গিলঠককে তারা আগুনের পাখিতে করে আকাশে নিয়ে গেছিল। এক বসন্ত পরও সে আর ফিরে আসেনি। কিন্তু দ্বিতীয় বসন্তের আগেই গিলঠক ফিরে আসে ইঠাবরে। তার গায়েও ছিল অদ্ভুত পোশাক। গিলঠক বলতে শুরু করে, ইঠাবরে আমরা সবাই ইরকের সন্তান।”

এরপর আর কিছু লেখা নেই। “মুছে গেছে,” বলল সে।

তানঠক হতাশ হলো।

“গুহার দেয়ালের নীচের দিকে থাকা এসব লেখা সম্ভবত বন্যার পানি ঢুকে মুছে দিয়েছে আরো অনেক কাল আগে।”

ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো ইঠাবরের বোকা ছেলেটি।

“আজ থেকে এক শ’ বসন্ত আগে প্লাবন হয়েছিল ইঠাবরে। অনেক মানুষ আর পশুপাখি মারা গেছিল তখন। সব কিছুই তলিয়ে গেছিল পানির নীচে।”

তানঠকও এসব গল্প বড়দের কাছ থেকে শুনে এসেছে ছোটোবেলা থেকেই। “তাহলে এই লেখাটা সেই প্লাবনেরও আগে!” বিস্ময়ে বলে উঠল সে।

“হুম।” আরেকটু ভেতরের দিকে গেল সে। তার পেছন পেছন বোকা বন্ধু। সরু হয়ে আসা গুহার ভেতরটায়, ডানদিকের নিচু ছাদের দেয়ালে আরো কিছু লেখা।

“এগুলোতে কী বলছে?”

তানঠকের দিকে তাকালো ইঠাবরের অক্ষরকার। মুচকি হাসি দিয়ে পড়তে শুরু করলো :

“শত-সহস্র দেবতা নয়, আমার সৃষ্ট প্রকৃতিও নয়…আমিই সব কিছুর স্রষ্টা। চারপাশে যা কিছু দেখো, সবই আমি সৃষ্টি করেছি। আমি ঈশ্বর!”

ঠাডক দেখলো তানঠক হাটু গেড়ে বসে পড়েছে। যেভাবে তারা কাঠকটা, রাতের আকাশে থাকা ডাটক, আগুন, গাভী আর পর্বতের পূজা করে, ঠিক সেভাবেই বোকা ছেলেটা মাথা নীচু করে দু-হাত মাথার উপরে তুলে রেখেছে।

“ঈশ্বর!” জোরে বলে উঠল সে।

“আমিই তোমাদের আহারের ব্যবস্থা করি! আমিই তোমাদের দেখেশুনে রাখি। তোমাদেরকে সুপথে আনার জন্য অক্ষরকার পাঠাই, যাতে করে তোমরা বিপথগামি না হও!”

তানঠক শ্রদ্ধামেশানো বিস্ময়ে তাকালো ঠাডকের দিকে। ইঠাবরের একমাত্র অক্ষরকার, একমাত্র পড়তে-লিখতে জানা মানুষটি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে দেয়ালের দিকে।

“বাকিটা পড়ো?” তাড়া দিলো তানঠক।

“আমি ঈশ্বর! আমার হয়ে অক্ষরকারই তোমাদের কাছে আমার বাণী পৌঁছে দেয়। সংরক্ষণ করে! ছড়িয়ে দেয়!”

তানঠকের বিস্ময় আরো বেড়ে গেল।

“ঠাডক! তোমার কথা বলছে!”

বন্ধুর দিকে ফিরেও তাকালো না সে।

“মহান ঠাডক, তুমি ঈশ্বরের মনোনীত প্রতিনিধি! তোমার কাছে আমার নিবেদন! আমার প্রার্থনা!”

“তুমি এসব কী বলছো?” অবাক হয়ে বলল ঠাডক।

“তুমিই না বললে, ঈশ্বর আমাদের সবার পিতা,” হাটু গেঁড়ে বসেই জবাব দিলো তানঠক। “আর অক্ষরকাররা ঈশ্বরের প্রতিনিধি!”

“আমি কই বললাম,” অবাক হলো ঠাডক। “আমি শুধু দেয়ালের লেখাগুলো পড়েছি। আর এটা কে লিখেছে সেটা আমি নিজেও জানি না।” একটু ঢোক গিলে আবার বলল, “লেখাগুলো সত্যি না মিথ্যা সেটাও তো তুমি নিশ্চিত করে জানো না।”

তানঠক অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। “এতো কষ্ট করে দেয়ালে যে লিখেছে সে মিথ্যে লিখবে কেন? তার এতে কী লাভ?”

বোকা ছেলেটার দিকে চেয়ে রইলো ঠাডক।

“মিথ্যে তো সেটাই যা নেই…যা ঘটেনি…তাই না?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ঠাডক। বোকা হলেও এ কথাটা ঠিকই বলেছে।

“তাহলে যা নেই তা বলে কার কী লাভ?”

অবাক হলো ইঠাবরের এক সময়কার শ্রদ্ধেয় লিপিকার ডাঠকপুত্র। তানঠক বোকা হলেও কথাটা ঠিক বলেছে। লেখা নিয়ে তার মধ্যে যতো আক্ষেপ আর হতাশাই থাকুক না কেন, মানুষ লিখিত কথা বিশ্বাস করে। লিখিত কোনো কথা নিয়ে কারোর মধ্যে কখনও সে সন্দেহ দেখেনি। বিনাপ্রশ্নে সবাই বিশ্বাস করে নেয়। কেউ যে মিথ্যে কিছু লিখতে পারে সেটা যেনো ইঠাবরের কারোর মাথায় কখনও ঢোকেনি। কিন্তু ঠাডক কোনো কিছুই বিনাপ্রশ্নে বিশ্বাস করে না। সব কিছুতে তার সন্দেহ। বিশ্বাস শব্দটাকে ইঠাবরের মানুষ ‘ব্রটঠক’ বলে ডাকে। ভরসা শব্দকেও ঐ একই নামে ডাকে তারা। তার মানে, বিশ্বাস আর ভরসার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই?

না, আছে। ঠাডক এ নিয়ে অনেক ভেবে দেখেছে। বিশ্বাসের পরে আসে ভরসা। আগে বিশ্বাস অর্জিত হবে, তারপর ভরসা। কিন্তু ভসরা করে বিশ্বাস করা? এটা তো বোকাদের কাজ। যার উপরে ভরসা করা হলো সে কতোটা বিশ্বাসের যোগ্য সেটা দেখতে হবে না?

যাইহোক, ইঠাবরে এমনটাই চলে আসছে। কতো বসন্ত ধরে ঠাডক জানে না। সম্ভবত হাজার বসন্ত ধরে। কিংবা কে জানে!

তানঠকের দিকে তাকালো। বোকা ছেলেটা এরইমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে দেখেছে, যে যতো বোকা সে ততো দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু ঠাডকের ঘুম আসে না সহজে। প্রায়শই রাতের বেশিরভাগ সময় জেগে কাটিয়ে দেয়। কতো কী যে ভাবে! এই যেমন এখন, এই গুহার ভেতরে, পাশে তার বন্ধু তানঠক শুয়ে আছে, কিন্তু ঠাডকের চোখে ঘুম নেই।

অনেক দিন ধরে সে ভেবেচিন্তে একটা সিদ্ধান্তে এসেছিল-এই যে, ইঠাবরে তার মতো লিখতে-পড়তে জানা মানুষের তেমন কোনো মূল্য নেই, এটা যেমন সত্য তার চেয়েও বড় সত্য, লেখার প্রতি মানুষের অগাধ বিশ্বাস। যা কিছু লেখা দেখবে, সেগুলোকেই সত্য বলে ধরে নেবে তারা। বিনাপ্রশ্নে। তাহলে লেখার একটা শক্তি আছে। অন্য রকম একটি ক্ষমতা আছে। এতোদিন এই চিন্তাটা তার মাথায় ঢোকেনি। চাইলে, সে লেখা দিয়ে সব কিছু বশ করে ফেলতে পারে। ইঠাবরে সম্মানিত একজন হয়ে উঠতে পারে। এমন কিছু সৃষ্টি করতে পারে যা রাজত্ব করবে সমগ্র ইঠাবর।

আর সেটা সম্ভব একমাত্র লেখা দিয়েই!

কিন্তু কী লিখবে সে?

সে যা ভাবে তা?

ঠাডক তো সারাক্ষণই ভাবে। তার ভাবনায় কোনো লাগাম নেই। বিক্ষিপ্ত এইসব ভাবনা কিভাবে লিখবে সে? আর এতো সব ভাবনা কি লেখা সম্ভব?

কিছু কিছু ভাবনা কখনও লেখা সম্ভব নয়। ওগুলো লোকে জেনে গেলে তাকে কী ভাববে তারা? ইঠাবরের প্রায় সব নিয়ম নিয়ে তার সন্দেহ আছে। সে কি তবে দেশান্তরি হতে চায়? এটা তো ইঠাবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার শামিল।

না। সে যা ভাবে তা লেখা সম্ভব নয়। অন্তত সব কিছু তো নয়ই।

তাহলে সে যা চায় সেসব নিয়ে লিখবে?

তার চাওয়ারও তো শেষ নেই। কত কিছুই না সে চায়। ইঠাবরের সম্মানিত একজন হতে চায়; সিয়াঠক নামের মেয়েটাকে নিজের করে পেতে চায়-যা ইঠাবরের রীতিবিরুদ্ধ। সত্যি বলতে, সে ত্রিঠককেও চায়। ঐ মেয়েটার সান্নিধ্য পাবার ইচ্ছেও জাগে তার মনে। এরকম অনেকের নাম বলতে পারবে সে, যাকে পাবার জন্য মনে মনে উতলা হয়ে থাকে। কিন্তু ইঠাবরের আজব নিয়ম-সব কিছু মেয়েদের ইচ্ছেয় চলে!

এ তো গেল নারী। আরো কতো কী যে আছে এই ইঠাবরে যার জন্যে সে লালায়িত। সবই তো সে চায়। তার চাওয়ার কি শেষ আছে? সিয়াঠক আর ত্ৰিঠকসহ সবকল কামনার নারীকে পাবার পরও তার মনে জেগে উঠবে আরো অনেককে পাবার লালসা।

ইঠাবরে কতো কী আছে! নারী। পশু। খাবার-দাবার। আরাম। ফুর্তি। প্রশান্তি। চমৎকার গৃহ। অফুরন্ত খাবার। সম্মান। সমীহ। শ্রদ্ধা। ইঠাবরের সমাজপতি!

চাওয়ার তো শেষ নেই।

ঠাডক জানতো এসব নিয়ে লিখতে পারবে না সে। লেখা সম্ভবও না। একজন মানুষের চিন্তা-ভাবনা, স্বপ্ন, ইচ্ছে, লালসা এসব কেন অন্যেরা জানতে চাইবে? আর জানলেই বরং বিপদ। তাকে নিয়ে হাসবে লোকে। তামাশা করবে। সমাজের শত্রু হিসেবেও দেখবে। সমাজের যে মজবুত কাঠামো সেটা ধ্বংস করার পায়তারা করছে মনে মনে-এটা কি গোপন থাকবে? যে প্রকৃতি থেকে নারীর জন্ম, যে নারী থেকে তাদের মতো ‘হটঠক’ জন্মে-তারাও কি তাকে সুনজরে দেখবে এসব জানার পর?

জবাবগুলো একটা ছোট্ট শব্দে মীমাংসিত হয়েছিল-না।

ঠাডক গভীর করে নিশ্বাস ফেলে তানঠকের দিকে তাকালো। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সে। বোকা তানঠকের মতো মানুষের সংখ্যাই ইঠাবরে বেশি। আর তারা লিখিত সব কিছুতে বিশ্বাস করে। কিন্তু প্রকৃতির স্রষ্টা বিপ্রঠকরা হুটহাট করে কোনো কিছুতে বিশ্বাস করে না, সেজন্যেই তো ইঠাবরের কর্তৃত্ব তাদের হাতে ন্যস্ত। পুরুষেরা দিনরাত কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, সব ধরণের কায়িক শ্রম তারাই করে। কিন্তু তাদেরকে পরিচালিত করে বিপ্রঠকরাই!

জননী। ভগ্নি। অন্নদাত্রি-এসব নামে ডাকা হয় তাদেরকে। বসন্তের শুরুতে তাদেরকে রীতিমতো পূজাও করা হয়!

ঠাডক পাশে জ্বলতে থাকা আগুনের দিকে তাকালো। ইঠাবরের প্রবীনেরা সব সময় এক গল্পই করে। আদিতে নাকি এই অগ্নি ছিল না। মানুষের মুখেও নাকি ছিল না ভাষা! এই যে রীতিনীতি-এসবেরও নাকি বালাই ছিল না। সবই করেছে বিপ্রঠকরা।

নারীগণ!

পুরুষ তো শিকার করা ছাড়া আর কোনো উপায়ে অন্ন সংস্থান করতে পারতো না। বিপ্রঠকরাই প্রথম খাদ্য উৎপন্ন করা শিখিয়েছে। সেই খাবার তুলে দিয়েছে নিজ সন্তানে মুখে। তারও হাজার হাজার বসন্ত আগে, তারাই সন্তানের মুখে ভাষার বোল ফুটিয়েছে! এরপর না জানি কতো বসন্ত পরে বোলকে প্রতাঁকে পরিণত করে তারা। সেই প্রতীক ব্যবহার করে লেখাটা ছিল দুরূহ কাজ। একে সহজ করে অক্ষরের জন্মও দিয়েছে বিপ্রঠকরা।

অবশ্য এসব গল্পে ঠাডকের পুরোপুরি বিশ্বাস নেই। তার ধারণা, বিপ্রঠকরা নিজেদের মহিমান্বিত করার জন্য সব কৃতিত্ব নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছে। এসব কথা সে মুখে কখনও বলতে পারবে না। বললে, তার উপর নেমে আসবে কঠিন শাস্তি-চিরতরের জন্য ইঠাবর ত্যাগ করা। সুতরাং সে এমন এক গল্প লিখবে, এমন এক চরিত্র সৃষ্টি করবে, যার মুখ দিয়ে বলিয়ে নেবে তার সব কথা! সব চাওয়া-পাওয়া!

সিদ্ধান্তটা নেবার পরই সে এই গুহাটা খুঁজে বের করে। কয়েক রাত ব্যয় করে লিখে ফেলে তার মনের সব কথা কিন্তু কল্পিত একজনের জবানে। সে জানে, তার সৃষ্ট এই চরিত্র খুব জলদিই রাজত্ব করবে সমগ্র ইঠাবর!

বোকা তানঠক যে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়ে হারিয়ে যায় সে কথা তার জানা ছিল। তাকেই বেছে নেয়। এখন তার পরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপ শুরু হবে। এই ধাপে সে কিছুই করবে না, শুধু অপেক্ষা করবে। বাকি কাজ করবে তানঠক নিজেই!

বোকাদেরকে বোকামি করতে দাও! ইঠাবরের রাজত্ব করবে বুদ্ধিমানেরা! বোকারা হবে সেই রাজ্যে দাস!

আর বিপ্রঠকরা?

তারা হবে সেবাদাসি! সমস্ত ক্ষমতা কেড়ে নিতে হবে তাদের কাছ থেকে। কিন্তু সেটা করবে অবয়বহীন একজন ঈশ্বর-ঠাডকের অবিনাশী সৃষ্টি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *