রহস্যের ব্যবচ্ছেদ অথবা হিরন্ময় নীরবতা
ঠিক তখনই আমি দৃশ্যটা দেখেছিলাম।
রাত আড়াইটা হবে হয়তো, আশেপাশের সবগুলো বাড়ি ঘুম দিয়েছে। জানালাগুলোও নির্মিলিত। যেগুলো খোলা আছে সেগুলোর ভেতরটাও অন্ধকারে পরিপূর্ণ। তবে টানা দু’ঘণ্টার লোডশেডিং শেষে কিছু কিছু বাড়ির খোলা অংশ, বারান্দা আর দরজার সামনে লালচে আলোর বাল্ব জ্বলে উঠেছিল। বিদ্যুৎ চলে যাবার পর থেকেই বড় জানালাটার সামনে বসে গিটার নিয়ে টুংটাং করে যাচ্ছিলাম আমি, ক্লান্তি আর ভ্যাপসা গরমে আনমনা হয়ে গেছিলাম হয়তো, দুচোখে একটু ঘুমও চলে এসেছিল সম্ভবত, তারপর আচমকা বিদ্যুৎ চলে এলে দৃশ্যটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল।
একেবারেই অচিন্তনীয়, লোমহর্ষক একটি দৃশ্য!
আমার শিক্ষা, বিশ্বাস আর সংস্কারহীন মনমানসিকতা মারাত্মকভাবে হোঁচট খেলো সঙ্গে সঙ্গে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে দমবন্ধ হয়ে গেছিল আমার, হয়তো চোখের পলকও থমকে গেছিল। টের পেয়েছিলাম গায়ের সমস্ত পশম দাঁড়িয়ে গেছে। ঐ মুহূর্তটি এখন পুরোপুরি বর্ণনা করা সম্ভব নয়। বিস্ফারিত দৃষ্টি নিয়ে আমি দেখছিলাম, আমার চোখের সামনে গলায় ফাঁস দেয়া এক তরুণীর নিথর দেহ ঝুলছে! মৃদু বাতাসে দুলছে সেটা! যদিও আমি নিশ্চিত ছিলাম, গ্রীষ্মের ঐ ভ্যাপসা গরমের রাতে কোনো বাতাস বইছিল না কিন্তু সমস্ত যুক্তিবুদ্ধি বিলোপ করে দেয়া সেই ঘটনা আমাকে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিলো।
ঐ দিন দুপুর বেলায় পাশের বাড়ির কিশোরী মেয়ে নুমার রহস্যজনক আত্মহত্যার ঘটনাটি যদি না ঘটতো, ঐ দৃশ্যটি আমাকে এতোটা বিপর্যস্ত করে তুলতো না। আমি কুসংস্কারহীন আর খুবই শক্ত মনের মানুষ। শৈশব থেকেই ভুত-প্রেতসহ যাবতীয় আজগুবি জিনিসে বিশ্বাস নেই আমার। পুরনো ঢাকার এক গলিতে থাকি, নিজেকে চিপাগলির পোলাপান হিসেবে পরিচয় দিতে একটুও কুণ্ঠিত নই। গ্রামে যদি গাছপালা আর ঝোঁপঝাঁড়ে ভুত-প্রেত থাকে তো, এখানকার চিপায়-চাপায় কুসংস্কার আর অশরীরীরা ঘুরে বেড়ায়। আর তাদের এই বিচরণের গল্প যুগযুগ ধরে মুরুব্বিদের মুখে মুখে বেঁচে থাকে। তাই প্রথমে ভেবেছিলাম দৃষ্টি বিভ্রমের শিকার হয়েছি, ভুরু কুঁচকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করতেই ভুল ভাঙলো আমার। তখনও আমার চোখে কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি, চশমা নামের কোনো বস্তু অযাচিতভাবে কান-নাক চেপে বসেনি। তাছাড়া দৃশ্যটি আমার জানালা থেকে মাত্র বিশ-পঁচিশ গজ দূরে থাকা এক দেয়ালে প্রক্ষেপিত হচ্ছিল, স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছিলাম সেটা!
ঐদিন সকালে আমার পাশের বাড়ির কিশোরী মেয়ে নুমার নিথর দেহ তার স্বামীর বাড়ির শোবার ঘরে কেউ একজন আবিষ্কার করে। আমি নিশ্চিত, আবিষ্কার করার মুহূর্তে গগনবিদারী চিৎকার দেয়া হয়েছিল তখন, সেটা ইচ্ছাকৃত কিংবা ভান করেই হোক না কেন। যে বাড়ির বৌদের দেহ সিলিং ফ্যান থেকে দড়ি দিয়ে ঝুলতে দেখা যায় তাদের পক্ষে এমন আচরন করাটাই স্বাভাবিক।
তো, দড়ি থেকে নামার নিথর দেহ নামানোর পর পুলিশে খবর দেয়া হয়, ময়নাতদন্তের জন্য লাশ নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। নুমা যখন লাশকাটা ঘরে পড়েছিল তখন হত্যা না আত্মহত্যা-এ নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে চলছিল তুমুল বাকবিতণ্ডা। ব্যাপারটা মারামারি আর নতুন কোনো খুনখারাবির দিকেও গড়াতে পারতো। নুমার পরিবারের অজস্র অভিযোগ আর প্রশ্নের জবাবে তার স্বামীর পরিবারের লোকজন তোতাপাখির মতো একটা কথাই শুধু বলে গেছে : অল্পবয়সি অভিমানী মেয়ে, স্বামীর সাথে ঝগড়া করে গলায় ফাঁস দিয়েছে।
এই সরল ব্যাখ্যায় খুব অল্প কিছু লোকজনই সন্তুষ্ট হয়েছিল অবশ্য। নুমার মহাক্ষমতাধর স্বামী আর তার পরিবারের লোকজন ‘পুলিশকে ম্যানেজ করে ফেলেছে’-এ রকম কথা মহল্লার মানুষ বলাবলি করতে শুরু করেছিল সকাল থেকেই। সবাই ধরে নিয়েছিল, মেয়েটাকে তার স্বামী খুন করে সিলিংফ্যানে লাশ ঝুলিয়ে দিয়েছে। এটা কোনো আত্মহত্যা হতেই পারে না।
নুমার মৃত্যুর সংবাদ মহল্লায় পৌঁছাতেই বাড়ির পাশে মসজিদ থেকে বার বার ঘোষণা দেয়া হতে থাকে, আব্দুল মালেকের ছোটো মেয়ে নুমা ইন্তেকাল করেছে…তার জানাজা হবে আগামীকাল আসর ওয়াক্তে।
ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত, বিছানায় শুয়ে রোগভোগ করে মারা যাক, নির্মাণাধীন ভবনের উপর থেকে আস্ত ইট পড়ে দুভার্গ্যক্রমে মরুক, গণপিটুনী খেয়ে, গুলি খেয়ে, বিষ খেয়ে কিংবা উষ্টা খেয়ে মরুক না কেন, মসজিদের মুয়াজ্জিন সেগুলোকে একটিমাত্র শব্দ ‘ইন্তেকাল’ বলে ঘোষনা করবে!
সত্যি বলতে, এভাবে মসজিদের মাইকে মহল্লাবাসীর মৃত্যুসংবাদ জারি করাটা সামাজিক রেওয়াজ হলেও সংবেদনশীল মানুষের কাছে এটা এক ধরণের মানসিক চাপ তৈরি করে। আমিও সেরকম চাপ নিয়ে ভোরের দিকে ক্লান্তিতে আসা ঘুম থেকে জেগে উঠেছিলাম। নুমাদের বাড়ি থেকে মসজিদের ইমাম আর মুয়াজ্জিনের খাবার পাঠানো হতো সপ্তাহে একবার-সম্ভবত সেজন্যেই কি না জানি না, আর সব মৃত্যুর চেয়ে কিশোরী নুমার হৃদয়বিদারক মৃত্যুসংবাদ একটু বেশি করেই প্রচার করা হলো মাইকে!
নুমার মৃত্যুসংবাদ শুনে আমি বেশ অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। মেয়েটাকে চোখের সামনে বেড়ে উঠতে দেখেছি যে!
মসজিদের মাইকে মৃত্যুর সংবাদ ঘোষণা দিলেই মহল্লার বয়োজ্যেষ্ঠ আর তুখোড় রসবোধসম্পন্ন বুড়ো টেনু বেপারি খুব সহজ ভঙ্গিতে বলে উঠতো : ‘মহল্লায় আজরাইল হান্দাইছে। এইবার ঢুকছে কুঞ্জবাবু লেইন দিয়া…কুন দিক দিয়া বের অয় ক্যাঠায় জানে! আজরাইল কইলাম দুই একটা লগে কইরা লইয়া যাইবো। মিয়ারা, বুগিচুগি ছাইড়া ভালা হইয়া যাও!’ তার কথা আর ভঙ্গিতে মৃত্যুর মতো হিমশীতল, ভয়ানক ব্যাপারটিও আমাদের কাছে চোর-পুলিশ খেলার মতো মনে হতো। অবশ্য নুমার মৃত্যুর অনেক আগেই বেচারা টেনু বেপারি আজরাইলের সঙ্গি হয়েছিল।
যাইহোক, ময়নাতদন্ত শেষে মেয়েটির লাশ ঐ দিন দুপুরেই চলে আসে তার জন্মস্থানে। আমাদের মহল্লা তো বটেই, আশেপাশের কয়েক মহল্লার নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশুর দল ছুটে আসে নুমার লাশ দেখতে। লাশ দেখার দলে আমিও যে কখন চুপিসারে ঢুকে পড়েছিলাম জানি না। আমার স্পষ্ট মনে আছে, লাইন ধরে ধরে এক এক করে নুমার ‘খাটোলা’র পাশে এসে যখন দাঁড়ালাম, দেখতে পেলাম নিষ্পাপ কিশোরী মেয়েটা অভিমানে গাল ফুলিয়ে ঘুমাচ্ছে। তার কানের পাশে কালচে দাগ। আমার কল্পনায় ভেসে উঠেছিল নুমার হিংস্র স্বামী সজোরে চড় থাপ্পর মারছে মেয়েটাকে। কয়েক সেকেন্ডের সেই দৃশ্য, তারপরই পেছন থেকে তাড়া, আমি আস্তে করে চলে আসি নুমাদের বাড়ি থেকে।
আমার চোখে বার বার ভেসে উঠতে থাকে নুমার নিষ্পাপ চেহারাটা। ঐদিন বাকি সময়টা আমার কেবলই নুমার কথা মনে হতে থাকে। এমন নয় যে, কিশোরী মেয়েটির সাথে আমার বেশ সখ্যতা ছিল, তবে পাশের বাড়ির বাসিন্দা হবার কারণে চোখের সামনেই ওকে বেড়ে উঠতে দেখেছি। দেখা হলে হয়তো ফিক করে নিষ্পাপ হাসি দিতো, আমাদের মতো বড়দের কার্যকলাপ দেখতো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। কখনও হয়তো আগ বাড়িয়ে এটা ওটা জিজ্ঞেসও করতো। পৌষ সংক্রান্তির ঘুড়ি উৎসবের দিন আকাশে ভেসে থাকা নানা রঙের লড়াকু সব ঘুড়ির দিকে চেয়ে থাকতো অপার বিস্ময় নিয়ে, তারপর মোক্ষম একটি প্রশ্ন করে বিব্রত করতো আমাকে : ‘আপনে সাকরাইনের ঘুড়ি উড়ান না ক্যালা?’
নুমার অর্বাচীন মা-বাবা যদি বড়লোক বাড়ির সাথে আত্মীয়তা করার মোহে আক্রান্ত না হতো, সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া ফুটফুটে মেয়েটিকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে না দিতো, তাহলে আরও কিছুটা সময় ওকে বেড়ে উঠতে দেখতাম চোখের সামনে। কিশোরী থেকে যুবতী হতো সে, হয়তো পাশের বাড়ির কোনো ছেলের সাথে লুকিয় লুকিয়ে প্রেমও করতো। তখন হয়তো তার গুণ্ডাপ্রকৃতির চাচারা, বড়ভায়েরা হম্বিতম্বি করে বলতো : ‘খানকিরপোলার অ্যাতো বড় কইলজা আমার বইনের লগে…!’ আরেকটি জম্পেশ ঘটনার অবতারণা হতো মহল্লায়। আর আমরা রসালো আড্ডায় চা-সিগারেট, ডালপুরি খেতে খেতে এ নিয়ে কতো আলাপেই না মশগুল হয়ে উঠতাম!
আবার এমনও হতে পারতো, নুমা বেড়ে উঠল শিক্ষিত-মার্জিত এক তরুণী হিসেবে। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে তাদের বংশের প্রথম মেয়ে হিসেবে পা রাখলো বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমাদেরই পরিচিত কোনো ছেলের প্রেমে পড়ে গেল সে। এ নিয়ে হয়তো আমাদের মধ্যে কেউ কেউ গোপন ঈর্ষায়ও পুড়তো।
কিন্তু সেরকম কিছু হয়নি।
সদ্য কৈশোরে পা দেয়া নুমা একদিন লাল টকটকে বেনারসি শাড়ি পরে শ্বশুড়বাড়ি চলে যায়। বেশ জমকালো বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল ওর। আকবর বাবুচির সুস্বাদু মোরগ পোলাও আর ঘন বোরহানির স্বাদ নিতে নিতে প্রায় সাত-আট শ লোকের সাথে আমিও দেখেছি নুমাকে তুলে দেয়া হচ্ছে এক ধনীর দুলালের হাতে। নুমার প্রাপ্তবয়স্ক স্বামীর চেহারাটা শেরওয়ানি আর পাগড়ির ফাঁকফোকর দিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে দেখতে পেয়েছিলাম। কেন জানি মনে হয়েছিল, একটা বেজির সামনে জ্যান্ত কোনো টাকি মাছ রেখে দেয়া হয়েছে!
নুমার বিয়ের পরদিন, যেদিন তার বৌভাতের অনুষ্ঠান হবার কথা, সেদিন খুব সকালে আমি আর আমার মহল্লার এক বন্ধু পাড়ার মাঠে ফুটবল খেলে ক্লান্ত হয়ে জিরোচ্ছিলাম কারোর বাড়ির সামনে বসে। মাঠাওয়ালা সুবল ঘোষ যথারীতি আমাদের দুজনের জন্য দু-গ্লাস মাঠা দিলে আমরা সত্যিকারের পৌরুষ জাহির করার জন্য এক ঢোকে পুরোটা গলাধঃকরণ করেছি মাত্র, তখনও আমাদের ঠোঁটে মাঠা লেগে রয়েছে, মোছার ফুরসতই পাইনি, দেখতে পেলাম অভাবনীয় একটি দৃশ্য : গতকাল যে নুমাকে বিশাল আয়োজন করে স্বামীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল, সেই কিশোরী বধূ সাতসকালে রিক্সায় করে একা একা চলে এসেছে মায়ের বাড়িতে! নববধূর চোখেমুখে বিপর্যস্ততার ছাপ প্রকট। হাতের লাল টকটকে মেহেদী খুব সুন্দর দেখালেও চোখের কাজল লেপ্টে একাকার। তার পরনে তখনও সেই বেনারসি শাড়ি, কিন্তু সেটা যেন অনিপুন হাতে পরা হয়েছে!
নুমার রিক্সাটা থামলো ঠিক আমাদের সামনেই কিন্তু আমাদের দিকে তাকানোর মতো অবস্থায় ছিল না সে। রিকশাওয়ালাকে ভাড়ার টাকা না দিয়েই ভয়ার্ত ইঁদুরের মতো এক দৌড়ে চলে গেল সে তার চিরচেনা গর্তে-যেখানে সে জন্মেছে, বেড়ে উঠেছে!
বেচারা রিকশাওয়ালা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে চেয়ে রইলো, কিন্তু আমাদের হতবুদ্ধিকর অবস্থা তারচেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। আমি আর আমার বন্ধু থ বনে গেলাম। ভুলে গেলাম মুখে লেগে থাকা সফেদ মাঠার কিছু অংশ মুছতে। মাঠাওয়ালা চলে গেলে কয়েক মুহূর্ত পর আমার বাকপটু সেই বন্ধু বিজ্ঞের মতো জানালো, নুমা বেজি দেখে ভয়
পেয়েছে। তার মতো কিশোরীর পক্ষে বাসরঘরের রোমাঞ্চ বোঝার কথা নয়, কিন্তু ওর প্রাপ্তবয়স্ক স্বামী হয়তো ওসবের আদ্যোপান্ত এক রাতেই বোঝানোর উদ্যোগ নিয়েছিল।
কিছুক্ষণ পরই নুমার বড়ভাই ঘুমঘুম চোখে বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে। আমাদের সমবয়সি ছিল সে, দেখা হলে দু-চারটা কথা হতো কিন্তু ঐ দিন যেন ইচ্ছে করেই আমাদের চোখের দিকে তাকালো না, পাছে আমরা কোনো অযাচিত প্রশ্ন করে বসি! রিকশাওয়ালাকে তার প্রাপ্য ভাড়া মিটিয়ে সোজা চলে গেল বাড়ির ভেতরে।
আমি আর আমার বন্ধু আরও কিছু সম্ভাব্য গালগল্প দাঁড় করিয়ে যার যার বাসায় চলে গেলাম। নিজের ঘরে এসে বুঝতে পারলাম, নুমাদের বাড়িতে ততোক্ষণে হৈচৈ শুরু হয়ে গেছে। সবাই চেষ্টা করছে চাপাকণ্ঠে কথার বলার কিন্তু অনভ্যাস আর অপ্রত্যাশিত ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সেটা সম্ভব হচ্ছে না। আমার ঘরের জানালার উল্টো দিকেই নুমাদের বাড়ি, নুমার সদ্য অধিকার হারানো ঘরটা একেবারেই আমার জানালা বরাবর, তাই জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কান পাততে হলো না-নুমার এক জাহাবাজ চাচীর গমগম করা কণ্ঠ মসজিদের মাইকের মতোই শোনাচ্ছিল তখন।
আমার দুর্মুখ বন্ধুর কথাই ঠিক, বেজি দেখে ভয় পেয়েছে নুমা!
মেয়েটার চাচীর কথা শুনে মনে হলো সে-ও বেজি দেখে ভয় পেয়েছিল বাসরঘরে। আরও বোঝা গেল, এরকম ভয় যুগ যুগ ধরে অসংখ্য মেয়ে পেয়ে আসছে। এটা একেবারেই স্বাভাবিক ঘটনা। মেয়েদের জন্য!
ঐদিন আমি যখন দুপুরবেলায় কলেজ থেকে ফিরছি তখন দেখি নুমাদের বাড়ির সামনে কালো রঙের একটি প্রাইভেটকার দাঁড়িয়ে আছে। নিজের বাড়ির দরজার সামনে আসতেই কিছু লোকের গুঞ্জন কানে গেল। থমকে দাঁড়ালাম। একটু পরই দেখতে পেলাম, নুমাদের বাড়ি থেকে দশ বারোজন লোক বেরিয়ে আসছে, বেশিরভাগই তার জ্ঞাতি ভাইবোন আর আত্মীয়স্বজন। দলটার সামনে নুমার সদ্যস্বামী হয়ে ওঠা লোকটি!-বেজীর মালিক কিংবা স্বয়ং বেজী! মাঝখানে নুমা লাল টকটকে বেনারসি পরে মাথা নীচু করে ভীরু পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে কালো গাড়িটার দিকে।
বুঝতে পারলাম, নুমার মা-চাচী-খালারা ইতিমধ্যেই মেয়েটাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে, বেজি দেখে ভয় পাবার কিছু নেই। তারাও প্রথম প্রথম বেজি দেখে ভয় পেয়েছিল। এটা একেবারেই স্বাভাবিক ব্যাপার। অল্পবয়সি মেয়ে, বেজি দেখলে তো ভয় পাবেই, তাই বলে বিয়ের পরদিন সাতসকালে শ্বশুড়বাড়ি থেকে এভাবে নিজের বাড়িতে চলে আসবে? যাকগে, তার বয়স কম, তাই ছেলেপক্ষ ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখেছে। ছেলেপক্ষের এমন উদারতায় নামার বাড়ির লোকজন কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে ফেললো যেন।
ঐ দিন দ্বিতীয়বারের মতো বেনারসি শাড়ি পরে নুমা চলে গেল স্বামীর বাড়িতে। তারপর নুমাকে আমি আর জীবিত অবস্থায় কখনও দেখিনি। হয়তো বিয়ের পর স্বামীর সাথে মায়ের বাড়িতে বেশ কয়েকবার বেড়াতে এসেছিল, দু-তিন দিন থেকেও গেছে কিন্তু সে-খবর আমার জানা ছিল না। নুমার ঘরটা ওর বিয়ের পর পরই বেদখল হয়ে যায়, সুতরাং সেই ঘরের জানালার সামনেও তাকে আর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখিনি। কিংবা কে জানে, জানালার সামনে দাঁড়ানোর অধিকার সে হারিয়ে ফেলেছিল হয়তো। আবার এমনও হতে পারে, জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার মতো ছেলেমানুষ আর ছিল না সে।
বিয়ের প্রায় ছয়মাস পর সেই ছোট্ট নুমাকে দেখলাম অভিমান করে শুয়ে আছে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে আকাশে ঘুড়ি দেখছে না, আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হাসছেও না। যেন তার অল্পবয়সি দেহমনের উপরে সংসার নামের বিরাট বোঝা চাপিয়ে দেয়ার জন্য খুব অভিমান করেছে, মুখ ফিরিয়ে রেখেছে সবার থেকে, চোখ বন্ধ করে রেখেছে আমাদের সাথে কথা বলবে না বলে। আমরা কেউই তার জীবনটাকে গুরুত্ব দেইনি, তার স্বপ্নের খোঁজ রাখিনি। সমাজ-সংস্কার আর বয়োজ্যেষ্ঠদের ইচ্ছে-অনিচ্ছেকে সে মাথা পেতে নিলেও এখন আর মেনে নিতে পারছে না, তাই ঠিক করেছে আমাদের সাথে থাকবে না। শীতল খাটোলায় করে চলে যাবে বহু দূরে!
নুমার ঘরের দক্ষিণ দিকের দেয়ালে ঝুলে থাকা এক তরুণীর ফাঁস লাগা অবয়বটি ঠিক কতোক্ষণ ধরে দেখেছিলাম জানি না। বিপরীত দিক থেকে একটি লালচে বাল্বের আলোয় ঝুলে থাকা দেহের ছায়াটি আমার চোখের সামনে অনেক ভীতি আর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। আমার কাছে না ছিল সেই সব প্রশ্নের জবাব, না ছিল ভীতি দূর করার মতো সাহস। তারপরও ভয়ার্ত আমি অনেকটা সময় নিয়ে ঝুলে থাকা ছায়াটি ভালো করে দেখেও বুঝতে পারলাম না, ওটা নুমার নাকি অন্য কারোর দেহ!
বলতে লজ্জা নেই, আমি জানালা থেকে সরে আসি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে। সে-রাতে আমার আর ঘুম আসেনি কিন্তু জানালা দিয়ে বাইরে তাকানোর সাহসও হয়নি আর। ভোরের আজানের পর ক্লান্তিতে আমার চোখে ঘুম চলে আসে। মায়ের তাড়া খেয়ে যখন ঘুম থেকে উঠলাম সকাল নয়টা বাজে। ‘সারা দুনিয়া উইঠ্যা গেছে আর নবাবসাহেব এহনও ঘুমাইতাছে!’-মায়ের এমন কথার জবাব সব সময়ই আমার ঠোঁটে লেগে থাকে : জননী আমার ভূ-গোলে একদমই কাঁচা। একই সাথে, একই সময়ে সারা দুনিয়ার মানুষ ঘুম থেকে ওঠে না। উঠতে পারে না। পৃথিবীর অর্ধেক যখন রাতে ডুবে থাকে তখন বাকি অর্ধেক দিনের আলোয় আলোকিত।
তবে ঐদিন সকালে এরকম কিছুই বলিনি। চুপচাপ জানালা দিয়ে নুমার ঘরের দক্ষিণ দিকের দেয়ালে তাকিয়েছিলাম শুধু।
কিন্তু ওখানে তখন কিছু নেই!
গতরাতে আমার মা বলেছিল, পাশের বাড়িতে এক অল্পবয়সি মেয়ে অপঘাতে মারা গেছে, আর এদিকে আমি সদ্য কলেজ পড়ুয়া ছেলে, দোতলার ঘরে একা থাকি। নুমার আত্মা রাতের বেলায় ঘুরে বেড়াবে তার বাড়ির আশেপাশে। অল্পবয়সি আত্মাদের ঝোঁক নাকি থাকে অল্পবয়সি ছেলেদের দিকেই! এরকম জরুরি জ্ঞান তারা উত্তরাধিকার সূত্রে শতশত বছর ধরে লালন করে আসছে। সুতরাং এরকম সময় আমার সাথে মা হিসেবে তার থাকা উচিত।
আমি অবশ্য ওরকম কিছু লালন করিনি কখনও। আমার মায়ের এই উদ্বেগকে নিছক কুংস্কার হিসেবে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। কাচুমাচু হয়ে আমার মা চলে গেছিল নীচতলায় নিজের ঘরে। কষ্ট পেয়েছিল নিশ্চয়। সন্তান যতো বড় হচ্ছে ততোই দুর্বোধ্য হয়ে যাচ্ছে-নিশ্চয়ই এমনটাই ভেবে থাকবে।
তাহলে কি আমার মায়ের কথাই ঠিক? প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবেই উঁকি দিতে শুরু করে আমার মধ্যে। কিন্তু এটা কী করে সম্ভব! আমি তো জানি, আত্মা-প্রেতাত্মা বলে কিছু নেই। সবটাই দুর্বল মানুষের বিশ্বাস। অন্ধবিশ্বাস।
কিন্তু নিজের চোখকে অবিশ্বাস করি কীভাবে? অন্যের বলা অতিপ্রাকৃত গল্প শুনে উড়িয়ে দেয়া সহজ, ওটাকে বানোয়াট আর দৃষ্টিবিভ্রম বলে ব্যাখ্যা করাও কঠিন কাজ নয়, কিন্তু গতরাতের দেখা ঐ দৃশ্যটাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছিল না আমার পক্ষে।
ভালো করেই জানতাম অমীমাংসিত ঘটনাই রহস্যের জন্ম দেয়। ঝিম। মেরে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। দাঁত ব্রাশ করে নাস্তা করতে হবে কিন্তু আমার মধ্যে সেরকম কোনো তাড়া নেই। অবশেষে অনেক ভেবে সেই রহস্যের সমাধান করার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। একটা আশঙ্কা জেঁকে বসেছিল আমার মধ্যে-গত রাতের রহস্যটি উন্মোচন করতে না পারলে কুসংস্কারগ্রস্তদের সুকঠিন খাঁচায় চিড়িয়া হিসেবে ঢুকে পড়বো!
নাস্তা না করেই হুট করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম আমি। ছোটোবেলায় হরহামেশা চলে যেতে পারতাম নুমাদের বাড়িতে, কিন্তু এখন প্রয়োজন ছাড়া যাওয়া হয় না। তাই খুব সঙ্কোচ হচ্ছিল তবে রহস্য ভেদ করার তীব্র ইচ্ছার কাছে সঙ্কোচের পরাজয় ঘটলো সেদিন।
আমার ভাগ্য ভালো, শোকে মুহ্যমান বাড়িটি তখনও ঘুমিয়ে আছে। পুরনো দিনের বিশাল বাড়ি ওদের। বাড়ির বাইরের দিকে একটা সিঁড়ি আছে। আমি সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলাম। টের পেলাম উত্তেজনায় টগবগ করছি। কী প্রত্যাশা করছি আমি? যৌক্তিক ব্যাখ্যা? নাকি অতিপ্রাকৃত কোনো কিছু?
নুমার ঘরের দক্ষিণ দিকের দেয়ালের উল্টো দিকে যে ছাদটা আছে সেখানে উঠে গেলাম। এটা তাদের বাড়ির বৈঠকখানার ছাদ। ছাদটা বেশ বড়সর, একপাশে ছোট্ট একটা ঘর আছে। নিজেকে যুক্তিবাদি হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করলেও মনের কোণে কেন জানি অতিপ্রাকৃত কিছু প্রত্যাশা করছিলাম আমি।
তাই ছাদে চোখ বুলিয়ে আমি একই সাথে হতাশ আর আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলাম।
কী দেখেছিলাম আমি?
ছাদে কাপড় শুকানোর জন্য দড়ি টানা ছিল আর তাতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল একটি প্লাস্টিকের কন্যা-পুতুল! সোনালি-বাদামি চুলের ওরকম অ্যাংলো পুতুল তখন প্রায় সব বাচ্চার খেলনা ছিল, ঘরে ঘরে মিলতো সেসব। সম্ভবত নুমার ছোটো চাচার পিচ্চি মেয়েটার পুতুল ময়লা হয়ে গেলে সেটা ধুয়ে দড়িতে শুকোতে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু একটা পুতুল দড়িতে কিভাবে ঝোলাবে-এই সমস্যার সমাধান কেউ করেছিল, পুতুলটার গলায় আরেকটা দড়ি পেচিয়ে সেটা দড়িতে গিট দেবার মাধ্যমে! আক্ষরিক অর্থে পুতুলটাকে নোংরা হবার জন্য ফাঁসি দেয়া হয়েছিল আর কি!
পুতুলটার উত্তর দিকে, খুব কাছে একটা ঘর ছিল, সেই ঘরের দরজার উপরে লালচে বাল্ব লাগানো। ব্যাপারটা আমার কাছে মুহূর্তে পরিস্কার হয়ে গেল। বাল্বের আলোয় পুতুলের ছায়া পড়েছে, একটু দূরে থাকা উত্তর দিকের দেয়ালে। অনেকটা সিনেমার প্রজেক্টরের মতোই কাজ করেছে সেটা! আর কাকতালিয়ভাবে, বাল্ব থেকে পুতুল, পুতুল থেকে উত্তর দিকের দেয়ালের দূরত্ব এমনই ছিল যে, ছোট্ট খেলনাটার ছায়া প্রায় একজন মানুষের আকৃতিতে পরিণত হয়েছিল।
রহস্যটা ভেদ করার কথা সবাইকে জানানোর আগেই আবিষ্কার করলাম, গত রাতে আমিই একমাত্র দর্শক ছিলাম না! আমার বাড়ির আশেপাশে আরও দুয়েকজন ওটা দেখেছে। যারা দেখেছে তারা সবাই কুসংস্কারগ্রস্ত-ভুত কিংবা অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাসী লোকজন। তারা বলাবলি করতে শুরু করলো, নুমার অতৃপ্ত আত্মা ফিরে এসেছে! ফাঁসিতে ঝুলছে-এরকম দৃশ্য দেখা গেছে। তাকে যে আসলে মারা হয়েছে, সে যে হত্যাকাণ্ডের শিকার-এটা তারই নিদর্শন। যতদিন খুনের বিচার না হবে, এভাবেই তার আত্মা ঘুরে বেড়াবে, তার ফাঁস দেয়া লাশ দেখা যাবে রাতের বেলায়।
এসব কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করার মতো মানুষ খুব বেশি ছিল না আমার মহল্লায়। থাকলেও তারা হয়তো চুপ মেরে থাকতো আমার মতো। হয়তো তারাও মনে করতো, রহস্যের ব্যবচ্ছেদ হওয়ার চেয়েও জরুরি হলো, নুমার গল্পটা এভাবেই ঘুরে ফিরুক মানুষের মুখে মুখে। মেয়েটার প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে সেটা টিকে থাকুক আধিভৌতিক গল্প হয়েই। সবাই জানুক, অপরাধ করলে অতৃপ্ত আত্মা তার কারিকুরি দেখানো শুরু করে, অপরাধিকে শাস্তি দিতে সে বদ্ধপরিকর।
তাই আমিও রহস্যের ব্যবচ্ছেদ করার পরও বেছে নিলাম নীরবতা।
এক হিরন্ময় নীরবতা!