১৩. ছিট ফিরোজের বিবাহসক্রান্ত জটিলতার উপাখ্যান

ছিট ফিরোজের বিবাহসক্রান্ত জটিলতার উপাখ্যান

বালপ্রাপ্ত হবার পর দক্ষিণ মৈষণ্ডির ছেলেপেলেদের জন্য একটি অঘোষিত কর্মকাণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে ছিট ফিরোজকে বহুল চর্চিত সেই প্রশ্নটি করা। কিংবা বলা যেতে পারে, ছিট ফিরোজ নামে পঞ্চাশোর্ধ চিরকুমার লোকটিকে ঐ প্রশ্ন করার মধ্য দিয়ে এই মহল্লার ছেলেপেলেরা যেন জানান দিয়ে দেয় তারা বালপ্রাপ্ত হয়ে গেছে।

একটু আগে এ গলি থেকে ও গলিতে যাবার সময়ও দেখেছি সদ্য গোঁফ ওঠা ছেলেছোকরাদের তিন-চারজনের একটি দল ঘিরে আছে ছিট ফিরোজকে। ছেলেগুলো কী জানতে চাইছে সেটা শোনার জন্য আমাকে পকেট থেকে মোবাইলফোন বের করে কারোর সাথে কথা বলার ভান করতে হয়নি। কিংবা একটু দূর থেকে কান খাড়া করে তাদের কথোপকথনও শোনার দরকার পড়েনি। তারা কী বলবে আর ছিট ফিরোজ কী জবাব দেবে আমি জানি-এ কথা ও কথা বলার পর ছেলেদের মধ্য থেকে একজন ছিট ফিরোজকে কোন প্রশ্নটা করবে সেটা কল্পনা করতে আমার একটুও বেগ পেতে হয় না এখন :

“আচ্ছা আঙ্কেল, আপনে বিয়া করলেন না কেলা?”

ভালো করেই জানি, ফিরোজ ছেলেগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে এমন ভঙ্গি করবে যেন মনে মনে একটা কথাই আওড়াচ্ছে সে : হালারপো, তর বাপেরে আমি মামু কইয়া ডাকি! তবে চোখেমুখে আক্ষেপ নিয়ে সব সময়ই বলবে : “আরে মিয়া, কেমনে বিয়া করুম! এই মহল্লার লাইগ্যা আমার কপালে বিয়া জুটলো না!” এভাবেই শুরু করবে সে।

“কেলা, এই মহল্লায় কী করছে?”

ফিরোজকে ঘিরে থাকা ছেলেগুলোর মধ্য থেকে একজন এই প্রশ্নটা করবে, আর তখন প্রশ্নকারিসহ বাকিদের চোখেমুখে থাকবে মহল্লার অনুভূতিতে আঘাত লাগার স্পষ্ট অভিব্যক্তি।

“কী করে নাইক্কা তাই কও!” আরও আক্ষেপ ঝরিয়ে বলবে ফিরোজ।

“বিয়া করবেন আপনে…মহল্লার কী?” কোনো একজন জানতে চাইবে। বাকিরা নির্ঘাত মাথা নেড়ে সায় দেবে তখন। তাদের মধ্যে অন্য আরেকজন হয়তো বলবে : “সুন্দর-মুন্দর দেইখ্যা একটা মাইয়া পছন্দ কইরা বিয়া কইরা ফালাইতেন…কুন হালায় কী করতো?”

“ওই মিয়া, আমি কি তোমগো মতোন পেরেম-পিরিতি করনের পোলা?” ফিরোজ অনেকটা তেঁতে উঠে বলবে।

“পেরেম করা কি গুনাহূনি? কত্তো মানুষ করতাছে।” এ কথা বলার মতো একাধিক ছেলে সব সময়ই থাকবে ফিরোজের আশেপাশে।

“আহা, গুনাহ অইবো কেলা…মাগার আমি তো এইসব করার পোলা না। ছাদে গিয়া, স্কুলের সামনে খাড়াইয়া মাইয়াগো লগে টাঙ্কি মারছিনি জীবনে?”

এ কথার পর সবাই একযোগে মাথা নেড়ে জানাবে, আসলেই ছিট ফিরোজকে এসব কাজ করতে দেখেনি কেউ।

“শিক্ষিত্ পোলাপাইনের মতো ছেরিগো লগে পড়ালেখাও তো করি নাইক্কা।”

ছিট ফিরোজের স্কুলজীবন যে খুবই সংক্ষিপ্ত সেটা দক্ষিণ মৈষণ্ডি কেন, ধোলাইখাল থেকে শুরু করে নারিন্দার মানুষও জানে।

এরপর ফিরোজ কী বলে তা শোনার জন্য সবাই অপেক্ষা করবে।

“কুনো ছেরিরে চক্করে ফালানোর মতো পোলা কি আমি?” বুকে একটা চাপড় মেরে বলবে ফিরোজ। “পেরেম-পিরিতি করনের টাইম আছিলনি আমার?”

ছেলেছোকরারা তখন প্রতিবাদ করে উঠবে। “আরে, পেরেম ছাড়া কি কেউ বিয়া করে না?”

তখন অন্য একজন বলবে, “আপনের বাপে, আমার বাপে যেমনে করছে তেমনে করতেন?”

তারপর হয়তো এমন কথাও শোনা যাবে, “আপনের বাড়ির লোকজন ঘটক লাগায়া দিতো…কত্তো মাইয়ার খোঁজ দিতো ঐ হালায় ঘটক।”

“হ, আলী হোসেন ঘটক তো আপনের কিমুনজানি ফুপা অয়…” এ কথা যোগ করতেও কেউ ভুল করবে না। দক্ষিণ মৈষণ্ডির ঘটক মাইগা আলী হোসেন দীর্ঘদিন ধরেই বিয়েশাদি করিয়ে যাচ্ছে। “হেরে কামে লাগায়া দিতেন?”

“কী কও না কও…যেইটা জানো না ওইটা লইয়া কথা কইবা না। আমার বাড়ির লোকজন হোগার কাপড় মাথায় উঠায়া মাইয়া খুঁজছে! ওই মাইগা আলী হোসেনূরেভি কামে লাইগাইছিল…”

“তাইলে?” ছেলেছোকরাদের একজন বলবে তখন।

“আবার কী! আমার মায়েরা-বইনেরা সুন্দর, আদব-লেহাজ জানা ভালা বংশের কতো মাইয়া পসন্দ করছে…হাজার-হাজার মাইয়া দেখছে…দেখতে দেখতে ঢাকা খালি কইরা ফালাইছে…ঢাকার বাইরেভি দেখছে!”

কথা সত্য। মহল্লার সবাই তা জানে। তাকে ঘিরে থাকা ছেলেছোকরারাও জানে, যদিও তাদের অনেকের জন্মের আগের ঘটনা এটি। তাদের চোখেমুখে তখন চাপা হাসি থাকবে। কেউ কেউ মুখ টিপে হেসেও দিতে পারে। কারণ দক্ষিণ মৈষণ্ডি মহল্লায় একটি গল্প বেশ মুখে মুখে ফেরে : এই ছিট ফিরোজ মাত্র বাইশ বছর বয়সে পাত্রি দেখা শুরু করেছিল। তার বয়স যখন তেতাল্লিশ তখন নরসিংদীর এক গ্রামে মেয়ে দেখতে গিয়ে ফিরোজ আর তার পরিবারের লোকজন বিরাট এক লজ্জার মুখে পড়ে যায়। মেয়ের মা নাকি ফিরোজকে দেখামাত্রই কপালে চোখ তুলে বলেছিল-”হায়। আল্লাহ! এই ব্যাটা তো আমারেও দেখতে আসছিল!” এই ঘটনার পর লজ্জায় অপমানে মেয়ে দেখা বাদ দিয়ে দেয় ছিট ফিরোজ।

“এত মাইয়া দেখলেন…তাইলে বিয়া অইলো না ক্যান, আঙ্কেল?” এই ন্যায্য প্রশ্নটি যে-কেউ করবে তাকে।

“আরে, অইবো কেমতে! মাইয়া পাইছে আর গ্যাছে! কাহিনী ঐহানেই শ্যাষ!” চোখেমুখে তিক্ত ভাব এনে জানাবে ফিরোজ।

“বুঝলাম না?” কোনো একজন বলবে তখন।

“মনে করো, আমার মায়েরা-বইনেরা একটা আদব-লেহাজজানা সিজিল মাইয়া পসন্দ করলো, হের পর মাইয়ার বাপ-ভায়েরা কি জামাইর খোঁজ-খবর লইবো না? নাকি খুশিতে দাঁত বাইর কইরা পাছা খাওজ্যাইতে খাওজ্যাইতে কইবো, ‘হ, আমরা রাজি! এক্ষনই এক কাপড়ে মাইয়া লইয়া বাড়িত যানগিয়া! “।

“এইটা ক্যান কইবো! পোলার ব্যাপারে এটু খোঁজখবর নিবো তো।”

“হ, নিবো না? আজিব! আমার বইনের বিয়ার সম্বন্ধ আইলে আমিও ঐপোলার চৌদ্দগুষ্টির হিস্টোরি বাইর কইরা ফালাইতাম।” ফিরোজ বলবে তখন। “পোলায় কাগো লগে ওঠবস করে, কই যায় কী করে, কুনো খারাপ অভ্যাস আছে কিনা…সব জাইনা নিতাম।”

তাকে ঘিরে ছেলেছোকরার দল অবশ্যই মাথা নেড়ে আরও একবার সায় দেবে। কারণ এরকম সময় দক্ষিণ মৈষণ্ডির কেউ ছিট ফিরোজের কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করবে না।

“তো, মাইয়ার বাপে-ভায়েরাভি আমার ব্যাপারে একটু খোঁজ-খবর লওনের লাইগ্যা এই মহল্লায় আইছে…এরে ওরে জিগাইছে পোলা কিমুন…স্বভাব-চরিত্র ভালানি…আয়রোজগার কিমুন করে…এইসব তো জিগাইবোই, জিগাইবো না?”

“হ, জিগাইবো তো।”

আমি জানি, ছিট ফিরোজ তখন একটু বিরতি দেবে, তারপর বহু পুরনো আক্ষেপের সাথে, ঠিক একই রকম পুরনো ক্ষোভ মিশিয়ে চোখমুখ খিচে বলবে, “তহন এই মহল্লার চ্যাংড়া পোলাপান কী করছে জানো?” ‘জানো’ শব্দটার উপরে সে সমস্ত ক্রোধ জড়ো করে মুখ থেকে নিঃসৃত করবে।

“কী করছে?” ছেলেছোকরারা কখনও বলবে না, তারা এটা পিচ্চিকাল থেকেই জানে। বহুল চর্চিত গল্পটি তারা ফিরোজের মুখ থেকেই শুনতে চাইবে সব সময়।

ছিট ফিরোজের মুখে তিক্ততা উঠে আসবে। “বালপাকনা পোলাপান ঠোঁট উল্টায়া তহন কইছে : ‘কুন ফিরোজের কথা জিগাইতাছেন? হোগা ফিরোজ, মগা ফিরোজ নাকি ছিট ফিরোজ?’”

তাকে ঘিরে থাকা ছেলেছোকরারা এ কথা শুনে একটু মজা পাবেই পাবে। কেউ কেউ হেসেও ফেলবে। কারণ এই তিন জাতের ফিরোজের কথা শুনে মেয়েপক্ষের লোকজনের চেহারা কী রকম হতো সেটা তারা নিখুঁতভাবেই কল্পনা করে নিতে পারে। এদের মধ্যে কে যে কতো কম খারাপ, আর কাকে যে জামাই হিসেবে কোনোমতে মেনে নেয়া যায় সেটা নিয়ে মেয়ের বাপ-ভায়েরা নিশ্চয় কঠিন সঙ্কটে পড়ে যেত!

যাইহোক, ফিরোজ তখন বলবে, “বুঝে এইবার! হোগা ফিরোজ তো পোলাপানের হোগা মাইরা ফেমাস হইছে পাকিস্তান আমল থেইক্যাই! এহন তো মামদারপোয়ে হজ্ব কইরা হাজী অয়া গ্যাছে…দিন-রাইত মাথায় টুপি লাগায়া ঘোরে…টুপি ছাড়া হাগামুতাও করে না!” কথাটা বলে চারপাশে তাকিয়ে কণ্ঠটা নিচে নামিয়ে বলবে, “মাগার পুরানা খাইসলতটা কইলাম যায় নাইক্কা…আরও দশবার হজ্ব করলেও যাইবো না…” এরপর একদলা থুতু পাশের ড্রেনে নিক্ষেপ করে বলবে, “হালায় একটা খবিস, বুঝছো?”

ছেলেপেলেরা এ কথার সাথেও সায় দেবে। হোগা ফিরোজ নামের এক মুরুব্বি আছে এই মহল্লায়, দোলাইখালের চোরাই পার্টসের বড় ব্যবসায়ি। তার অধীনে আছে সত্তুর-আশিজনের মতো জাঁদরেল চোর। অল্পবয়সি ছেলেপেলেদের সাথে খারাপ কাজ করতে ওস্তাদ এই মুরুব্বি-কেতাবি ভাষায় যাকে পেডেরাস্ট বলে। দক্ষিণ মৈষণ্ডির অলিগলি থেকে শুরু করে দোলাইখালে একটা গল্প চড়ে বেড়ায়-এই ফিরোজ এখনও তার অধীনে থাকা পিচ্চি-পাচ্চাদের ফুসলিয়ে ‘আকাম-কুকাম করে। আড়ালে আবডালে সবাই তাকে হোগা ফিরোজ বলেই ডাকে।

“…আর মগা ফিরোজ তো পয়দাই হইছে ভ্যাবলা হইয়া…ওর কথা কী কমু!” এরপর ফিরোজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলবে এটা।

ডালপুরি-আলুপুরি বিক্রেতা শুক্কুর আলীর মানসিক প্রতিবন্ধি ছেলেকে দক্ষিণ মৈষণ্ডির সবাই মগা ফিরোজ বলে ডাকে। যখন তখন পাদ দেবার ব্যাপারটি বাদ দিলে তার মধ্যে আর কোনো গুণ নেই। সেই গুণও সব সময় তার ডাকে সাড়া দেয় না, সাড়া দিয়ে বসে প্রকৃতি! প্রায়শই জোর করে পাদ দিয়ে সবাইকে তাক লাগাতে গিয়ে ব্যর্থ হয় সে। এভাবে প্রায়শই প্যান্ট নষ্ট করে ফেলে।

ফিরোজ একটি দীর্ঘ বিরতি দেবে এ সময়। টান টান উত্তেজনায় সবাই চেয়ে থাকবে তার দিকে। কেউ কোনো জবাব দেবে না। এটা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, ভবিষ্যতেও দক্ষিণ মৈষণ্ডি মহল্লার ছেলেপেলেরা এমনটাই করবে।

তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখমুখ খিচে ফিরোজ বলবে, “কুনো বাপ ভাই যদি জানবার পারে পোলারে মহল্লার মাইষে ছিট কইয়া ডাকে তাইলে জিগাইবো না, ক্যান ছিট কয়?” ফিরোজের সপ্রশ্নমুখভঙ্গি তখন প্যান্টো মাইম করা শিল্পীর মতো হয়ে যাবে।

“হ আঙ্কেল, জিগাইবোই তো।” কাচুমাচু খেয়ে কোনো একজন বলবে। কিংবা সবাই সমস্বরেও বলতে পারে কথাটা।

তখন বামহাতটা কোমরের উপর রেখে ডানহাত শূন্যে নাচিয়ে মাথা একটু কাত করে নাটকীয় ভঙ্গি করবে ফিরোজ। “এইবার বুঝো তাইলে!” তারপর আবারও চোখেমুখে তিক্ততা এনে বলবে, “মহল্লার পোটা পোলাপাইনে রসাইয়া রসাইয়া কিস্সা হুনাইয়া দিছে তহন, আমি কতো বড় ছিট! ল্যাংটাকালে কী করছিলাম…চ্যাংড়া বয়সে কী করছি…” আক্ষেপে মাথা দোলাবে সে। “ঐ যে, খাব্বুশ শাহর লগে মারামারি করার সময় আমি যে ওর কান কামড়ায়া দিছিলাম…এইটা তো কইতো সবৃতের আগে।”

দক্ষিণ মৈষণ্ডির এককালেরর মাস্তান হাবলা কাদিরা-যার মৃত্যুর পর পর মসজিদের ঘোষণা শুনে মহল্লার বেশিরভাগ মানুষ জানতে পেরেছিল তার পিতৃপ্রদত্ত নাম আসলে খাশ শাহ্। তো এই খাব্বুশের সাথে ফিরোজের একবার কঠিন ঝগড়া বেঁধে গেছিল। কিন্তু তার সাথে পেরে না উঠে ছিট ফিরোজ তার কান কামড়ে ছিঁড়ে ফেলেছিল নরখাদকের মতো নারকীয় ভঙ্গিতে। এই কান কামড়ানোর ঘটনাটিই একমাত্র ঘটনা নয় যার কারণে তাকে স্থায়িভাবে ছিট উপাধি দিয়েছে মহল্লাবাসি।

সবচাইতে মুখরোচক গল্পটির জন্ম আটাত্তর সালের দিকে, দেশে তখন সামরিক শাসন চলছে। কৈশরোত্তীর্ণ ফিরোজ তার বড়ভায়ের মোটরসাইকেল নিয়ে একদিন মহা আনন্দে যাচ্ছিল ভজহরি সাহা স্ট্রিটের দিকে, তখন এক পুলিশ সার্জেন্ট তার মোটরবাইক থামিয়ে লাইসেন্স আর অন্যান্য কাগজপত্র আছে কি না জানতে চায়। ফিরোজ এসব কিছুই দেখাতে পারেনি। ভাইয়ের মোটরসাইকেল মাঝেমধ্যে চালায় সে। ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবে কোত্থেকে! আর কাগজপত্র তো সব তার ভাইয়ের কাছে! এ কথা শুনে সার্জেন্ট ধরে নিয়েছিল বাইকটা সম্ভবত চোরাই। যদিও অনেক অনুনয় বিনয় করে ফিরোজ আসল সত্যটা বার বার বলে গেছে, কিন্তু কঠিন হৃদয়ের পুলিশ তাতে গলেনি। বাইকটা সিজ করে থানায় নিয়ে যাবার জন্য উদ্যত হয় সে, আর ঠিক তখনই ফিরোজ নিজের প্যান্ট আর আন্ডারওয়্যার খুলে হাঁটুর নিচে নামিয়ে দিয়ে দিগম্বর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সার্জেন্টের সামনে। চোখে দ্রুত অশ্রু এনে কাঁদো কাঁদো হয়ে করজোরে মাফ চাইতে শুরু করে। সার্জেন্ট বেচারা এমন আকস্মিক কাণ্ডে পুরোপুরি ভড়কে গেছিল। হতভম্ব হয়ে গুলিস্তানের কামানের মতো স্থির দাঁড়িয়েছিল কয়েক মুহূর্ত। কিন্তু পুলিশ বেচারা সম্বিত ফিরে পাবার আগেই মিলিটারির একটি জিপ এসে থামে সেখানে।

ঘটনার পরে ফিরোজ বলেছে, দূর থেকে ঐ জিপটা আসতে দেখেই নাকি এমন কাণ্ড করার বুদ্ধি তার মাথায় এসেছিল।

যাইহোক, ঐ জিপ থেকে নেমে এসে এক মেজরসাহেব রেগেমেগে জানতে চায়, এসব কী হচ্ছে! সার্জেন্ট কিছু বলতে যাবার আগেই ছিট ফিরোজ অশ্রুসজল চোখে মেজরকে জানায়, তার বড়ভায়ের বাইকটা শখ করে একটু চালাচ্ছিল সে, আর এই হৃদয়হীন সার্জেন্ট এরকম সামান্য অপরাধের জন্য তাকে তার এলাকায় দিগম্বর করে দাঁড় করিয়ে শাস্তি দিচ্ছে। এখন তার কী হবে! তার তো মানসম্মান সব শেষ! এই জীবনে তার আর বিয়ে হবে না!

ফিরোজের অভিনয়ে মেজর এতটাই পটে গেছিল যে, সার্জেন্টকে উচিত শিক্ষা দিতে জিপে করে তুলে নিয়ে যায় তখনই, তবে তার আগে ফিরোজের কাছে মাফ চাইতে বাধ্য করে তাকে।

মেজরসাহেব চলে যাবার পর ছিট ফিরোজ বিজয়ির ভঙ্গিতে প্যান্ট আর আন্ডারওয়্যার পরে ফুরফুরে মেজাজে বাইকটা নিয়ে জয়কালী মন্দিরের দিকে চলে গেলে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কমপক্ষে দশ-বারোজন লোক হাসতে হাসতে একে অন্যের গায়ের উপরে গিয়ে পড়েছিল। তারাই পরবর্তি কালে ফিরোজের এই ‘ল্যাঙটা কাণ্ডের গল্পটি মহল্লায় রটিয়ে দেবার গুরু দায়িত্ব পালন করে।

এরকম আরও অসংখ্য ঘটনা আছে তাকে ঘিরে। পোঙটা পোলাপানরা কোন পাত্রিপক্ষের কার কাছে কোন ঘটনাটি বলেছে সেটা ফিরোজ কিংবা দক্ষিণ মৈষণ্ডির কেউ জানে না। তবে তারা নিচুকণ্ঠে সতর্কভাবে আশেপাশে তাকিয়ে সবচাইতে চমকপ্রদ ঘটনাগুলোই হয়তো রসিয়ে রসিয়ে বলেছে-এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

“আরও কতো কী যে কইছে ক্যাঠায় জানে!” আবারও একদলা ঘৃণার থুতু পাশের ড্রেনে ফেলে বলবে তখন ফিরোজ।

তাকে ঘিরে থাকা ছেলেপেলেরা মুখভার করে মাথা নেড়ে সায় দেবে। কারো কারো অভিনয় কাঁচা হলেও বেশিরভাগই দুর্দান্তভাবে অভিব্যক্তি দিতে পারবে একেবারে পাকা অভিনেতার মতো।

“এই কথা হুননের পর কুনো বাপ তার মাইয়ারে আমার লগে বিয়া দিবো?”

ফিরোজের এমন অগ্নিমূর্তি দেখে ছেলেছোকরারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে সায় দেবে। চেষ্টা করবে চোখেমুখে আফসোসের অভিব্যক্তি দিতে কিন্তু আমি জানি, সেটা তারা পুরোপুরি সফলভাবে করতে পারবে না। কারোর অভিনয় খুব কাঁচা হবে।

“এর লাইগ্যাই আমার বিয়া হইলো না!” একেবারে অকৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরোজ কথাটা বলবে। “এইবার যাও…নিজেগো কাম করো গিয়া। এইসব হুননের দরকার নাই।”

ছেলেছোকরারা তখন পৈশাচিক আনন্দ পেয়ে একে অন্যের দিকে চোখ টিপে হাসতে হাসতে চলে যাবে শুকুর আলীর ডালপুরির দোকানে কিংবা ইজরাইল মিয়ার ঢাকা হেয়ার কাটিং সেলুনের দিকে। কখনও কখনও অন্য কোথাও যেতে পারে। সেটা কোনো ব্যাপার না। আসল ব্যাপার হলো, তারা খুব আমুদে থাকবে পরবর্তি আধঘণ্টা।

আমি সব সময় ছিট ফিরোজকে এভাবেই বলতে দেখেছি। এখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে চাকরি করি; সেই ক্লাস সেভেনে যখন পড়ি তখন প্রথমবার তাকে এই আখ্যানটি বলতে শুনেছিলাম। গলির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে ফিরোজ, তাকে ঘিরে আছে কিছু বালপ্রাপ্ত ছেলেপেলে, চোখেমুখে মহাবিরক্তি থাকলেও প্রবল উৎসাহের সাথেই নিজের বিয়ে না হবার আখ্যানটি বলে যাচ্ছে সে। তার এই আখ্যানটি কখনও একনাগারে শুনিনি আমি। বার কয়েক শেষটুকু শুনেছি, কখনও শুনেছি মাঝখানের অংশ। প্রথম অংশটা হয়তো অনেক পরে শুনে থাকবো। তাতে অবশ্য বুঝতে একটুও বেগ পেতে হয়নি। দীর্ঘ সময় ধরে ছিট ফিরোজ ঠিক একই ভঙ্গিতে, একই কায়দায় এটা বলে যাচ্ছে। কোন শব্দে কতোটা জোর দেবে, কখন বিরতি দেবে, কিংবা কোন কথাটা বলার সময় তার শারীরিক ভাষা কেমন হবে সেটা যেন যুগ যুগ ধরে হ্যামলেট চরিত্রে অভিনয় করা দক্ষ মঞ্চাভিনেতার মতোই রপ্ত করে ফেলেছে সে। তাই সব সময় চলতি পথে যেতে যেতে একটু একটু করে শুনলেও পুরো আখ্যানটি বুঝে নিতে কোনো সমস্যা হয়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *