০৪. কজিতে

কজিতে

দ্বিতীয় জীবন

অনেকটা দুঃস্বপ্নে ঢুকে পড়ার মতোই আবিষ্কার করলাম নেটওয়ার্কে আছি। সময়জ্ঞান ঠিকমতো কাজ করছে না, বুঝতে পারছি না কী করছি, কোথায় আছি, কতোক্ষণ ধরে আছি। যেন অদ্ভুত এক জগতে বিচরণ করছি আমি!

“হ্যালো?”

এরপরই ঘটলো সেই বিস্ময়কর ঘটনাটি। আমাকে চমকে দিয়ে, হতবিহ্বল করে চ্যাট-বক্সে ‘হ্যালো’ বলল যে, সে মাসখানেক আগেই মারা গেছে! তার অকাল এবং দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু আমাকে বেশ নাড়িয়ে দিয়েছিল, বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। মৃতের সাথে আমার সম্পর্কের কথাটা বিবেচনায় নিলে এটা মোটেও অস্বাভাবিক ছিল না।

জবাব দেয়ার আগে বিক্ষিপ্ত চিন্তা-ভাবনাগুলো দ্রুত গুছিয়ে নিলাম। বিস্ময়ের ঘোর কাটতেও বেশি সময় লাগলো না। এরকম ঘটনার সহজ-সরল ব্যাখ্যা আছে আমার কাছে। এই ভুতুরে কাণ্ডটি কীভাবে ঘটছে বুঝতে পারলাম-আমার স্নেহধন্য এমিলের অব্যবহৃত অ্যাকাউন্টে অযাচিতভাবে কেউ অনুপ্রবেশ করেছে। সহজভাবে বললে, হ্যাঁক করা হয়েছে ওটা।

“কেমন লাগছে?”

হ্যাকারের এমন প্রশ্নে একটু অবাকই হলাম। নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে জানতে চাইলাম, “তুমি কে?”

“আমাকে তুমি ভালো করেই চেনেনা। আমরা দীর্ঘদিন একসাথে কাজ করেছি। অনেক বড় বড় সাফল্য আছে আমাদের।”

“হ্যাঁ, এমিল আর আমি দীর্ঘদিন কাজ করেছি। বিরাট বিরাট সাফল্য আছে আমাদের। কিন্তু সমস্যা হলো, তুমি এমিল নও। তুমি একজন হ্যাকার। এমন অনৈতিক কাজ শুধু তোমরাই করতে পারো।”

“আমি জানতাম তুমি এটা বলবে।”

“কোনটা?”

“নীতি…নৈতিকতা…অনৈতিক! এসব শব্দ ছাড়া তুমি বেশিক্ষণ কথা বলতে পারো না। এজন্যে তোমাকে সবাই বুডসম্যান বলে ডাকে…তুমিও সেটা। বেশ উপভোগ করো।”

বুঝতে পারলাম হ্যাকার পরিচিত কেউ-ই হবে। নেটওয়ার্কে আমি ন্যায়পাল অর্থাৎ ওমবুডসম্যান হিসেবে পরিচিত। সেটাকে সংক্ষিপ্ত করে শুধু বুডসম্যান নামে ডাকা হয় আমাকে। তাহলে হ্যাকার কি নেটওয়ার্কের ভেতরের কেউ? সম্ভবত। ভাবাই যায় না, এমন মস্তিষ্কবিকৃত লোকজন নেটওয়ার্কে এখনও আছে!

“একজন মৃতমানুষের অ্যাকাউন্ট হ্যাঁক করে তুমি কী বিকৃত আনন্দ পাচ্ছো? নেটওয়ার্কে প্রচুর বোকাসোকা গর্দভ ঘুরে বেড়ায় কিন্তু নেটওয়ার্ক যারা চালায় তাদেরকে তুমি এভাবে বোকা বানাতে পারবে না। খুব জলদি তোমার পরিচয় বের করা হবে। ধরা পড়ে যাবে তুমি।”

“☹।”

আমার কথার কোনো জবাব না-পেয়ে মন খারাপ করার সহজ-সরল ইমোটা ব্যবহার করলো সে। “আমার ধারণা, তুমি মানসিকভাবে অসুস্থ!” নিজের ক্রোধ প্রকাশ না-করে পারলাম না।

“বিশ্বাস করো, আমি এমিল। কোনো হ্যাকার নই!”

রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে আরও অনেক কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে দমিয়ে রাখলাম। “এটা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?”

“হ্যাঁ।”

“তুমি হতে পারো অসাধারণ একজন হ্যাকার কিন্তু আমার পরিচয়টাও নিশ্চয় তোমার মাথায় রাখা উচিত ছিল।” কথাটা আমার কাছে মোটেও উন্নাসিকের মতো শোনালো না। আমার পদ-পদবী আর কর্মকাণ্ডের কথাটা বিবেচনায় নিলে এটা অমোঘ সত্যি।

“তুমি হলে টেকনিশিয়ানদের ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড। আমরা তোমাকে গুরু বলে ডাকি। নেটওয়ার্কে নৈতিকতার মানদণ্ড নির্ধারণ করো তুমি। হ্যাকার থেকে প্রোগ্রামার হবার সময়ে তুমিই তো আমাকে “রিহ্যাব করেছো…দর্শন আর নীতিবিদ্যার শিক্ষা দিয়েছো। তুমি সব সময় বলো, শুধু মেধা থাকলেই হবে না, সেইসাথে একটি দার্শনিক-সত্তা থাকাও জরুরি।”

আমি তার এসব কথাবার্তায় একটুও বিগলিত হলাম না। আমার সাথে এই খেলাটা খেলছো কেন? তোমার উদ্দেশ্য কী?”

“☹।”

হ্যাকার চুপ মেরে গেল। তার ইমো’র জবাব দেবার কোনো মানেই হয় না।

“ঠিক আছে। তাহলে আমাকে যাচাই করে দেখো। যখন প্রমাণ পাবে, আমার কথা বিশ্বাস কোরো। একজন যুক্তিবাদি হিসেবে প্রমাণ ছাড়া আমাকে অবিশ্বাস করাটাও তোমার উচিত হবে না নিশ্চয়? এটাও তো অনৈতিক!”

এক বিকৃত-মাথার হ্যাকার চ্যালেঞ্জ করছে আমাকে!

“তুমি কিন্তু এটা খুব সহজেই করতে পারো।”

“কোনটা?”

“এই যে, আমি তোমাদের সেই এমিল…কোনো হ্যাকার নই।”

উন্মাদগ্রস্ত একজন চাইছে মজা করতে, তা-ও মৃত কাউকে নিয়ে। ব্যাপারটা আমার কাছে জঘন্য বলেই মনে হচ্ছে। “এমিল মারা গেছে…” নিজের রাগ দমন করে বললাম। “…এর চেয়ে বড় সত্যি আর হয় না। এটা প্রমাণ করা বা না-করার কিছু নেই। সুতরাং তোমার এই নোংরা আর ফালতু খেলায় আমি অংশ নিচ্ছি না।”

“তুমি একটু ভুল করছে। আমি অবশ্যই মারা গেছি, এ নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি নেই। আমি শুধু বলতে চাইছি, আমি আবার নেটওয়ার্কে ফিরে এসেছি। কেবল এখানেই বিচরণ করছি এখন। এটাই আমার জগত। এর বাইরে, বাকি সবার কাছে আমি আগের মতোই মৃত।”

এবার আমি পুরোপুরি নিশ্চিত, হ্যাকার কেবল নেটওয়ার্কের ভেতরের কেউ নয়, সে আমাদের ঘনিষ্ঠও বটে। এমিলের সুইসাইড-নোটে লেখা ছিল : “বিদায় পৃথিবী…আবার দেখা হবে।” যেন সেই কথারই প্রতিধ্বণি করছে এই জঘন্য হ্যাকার। “তুমি বলতে চাইছো, এমিলের বিদেহীআত্মা নেটওয়ার্কে বিচরণ করছে?! হা-হা-হা! চমৎকার!”

“☹।”

“ফ্যান্টাসি গল্প হিসেবে কিন্তু মন্দ নয়।”

“এটা গল্প নয়…সত্যি।”

“দারুণ! ঠিক আছে, তোমার পুনরুত্থান ঘটেছে?!! একেবারে জিশুর মতোন!”

“না, জিশুর মতো নয়। তার পুনরুত্থান নিয়ে অকাট্য প্রমাণ নেই। মৃত্যুর পর সে কারো সাথে কথাও বলেনি। অথচ আমাকে দেখো, তোমার সাথে কথা বলছি। একদম আগের মতো।”

“আহ্! আমাদের নেটওয়ার্কের জন্য এটা চমৎকার বিজ্ঞাপন হতে পারে। প্রতিভাবান এমিল আত্মহত্যা করার পর তার আত্মা নেটওয়ার্কে বিচরণ করছে, কারণ নেটওয়ার্কই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান-এরকম কুসংস্কারে বিশ্বাস করার মতো মানুষ এখনও অনেক আছে কিন্তু আমি তাদের মধ্যে পড়ি না।”

“তুমি যেমনটি ভাবছো ব্যাপারটা ঠিক তেমন নয়।”

“তাহলে ব্যাপারটা কী রকম?”

“আমি তোমাকে সবটা বলবো কিন্তু মনে রাখবে, বিষয়টা খুব জটিল। একটু ধৈর্য ধরে শুনতে হবে।”

“আমার ধৈর্য আছে। তারপরও বলবো, তুমি তোমার ফালতু গল্পটা একটু ছোটো করে বলবে।”

“সেই গল্প বলার আগে তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে আমি এমিল…কোনো হ্যাকার নই।”

“দুঃখিত। আগে নিজেকে প্রমাণ করো।”

“ঠিক আছে। তাহলে বলছি, তুমি এখনও তোমার প্রথম প্রেম মারিয়াকে ভুলতে পারোনি। তাকে পাওনি! বলে বিয়েও করোনি। ☹।”

হ্যাকারের এমন বালখিল্য কথায় আমার খুব হাসি পেলো। “মারিয়ার কথা কমপক্ষে একশজন জানে।”

“হুম। কিন্তু তাকে যে তুমি এখনও ভুলতে পারোনি! সেটা জানি শুধু আমি।”

কথাটা সত্যি। একবার ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতায় এমিলকে অনেক ব্যক্তিগত কথা বলেছিলাম। আমার প্রথম প্রেম মারিয়াকে যে এখনও ভুলতে পারিনি! সেটাও জানিয়েছিলাম তাকে।

“এটা দিয়ে কিছুই প্রমাণিত হয় না। কথাটা এমিল জানতো…সে হয়তো

অন্য কাউকে…মানে তোমাকে বলেছে।”

“তুমি এখনও নিয়মিত মারিয়ার অ্যাকাউন্টে অনুপ্রবেশ করে দেখো, সে কার সাথে কী নিয়ে চ্যাট করছে। এটা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না।”

খুব বিস্মিত হলাম। সেই সাথে একটু আতঙ্কিতও।

“কাজটা অনৈতিক হলেও তোমার মতো নীতির পরাকাষ্ঠা দেখানো একজন দীর্ঘদিন ধরে এটা করে যাচ্ছে। অথচ নেটওয়ার্কে তুমিই যাবতীয় নীতি আর নৈতিকতার উপদেশ দিয়ে থাকো। স্বীকার করছি, বিগত দশ বছরে এটাই তোমার একমাত্র নীতিবিগর্হিত কাজ।”

কী বলব বুঝতে পারলাম না। তবে এটা বুঝতে পারছি, কিছু একটা গড়বড় হয়ে গেছে। বিরাট সমস্যায় পড়তে যাচ্ছি। সম্ভবত নিজের ফাঁদে আটকে পড়েছি আমি। সাইবার দুনিয়ায় বিশেষ ধরণের ডিটেক্টিভ নিযুক্ত করার প্রস্তাবটি আমারই ছিল। সম্ভবত ওদের কোনো একজন আমার অ্যাকাউন্ট হ্যাঁক করে এসব জেনে নিয়েছে।

“তুমি কি সাইটেক্টিভ?” নেটওয়ার্কের নিজস্ব সাইবার-ডিটেক্টিভরা এ নামেই পরিচিত।

“না। আবারও ভুল করছো। সাইটেক্টিভরা তদন্ত করার প্রয়োজনে সন্দেহভাজনদের অ্যাকাউন্ট হ্যাঁক করতে পারে না। এটা করলে ওরা নিজেরাই অপরাধি হয়ে যায়।”

কথাটা সত্যি। কোনো সাইটেক্টিভ এটা করলেও কোনো লাভ হয় না। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে সংগৃহীত প্রমাণ আমলে নেয়া হয় না।

“বিশ্বাস করো, আমি এমিল। কোনো হ্যাকার কিংবা সাইটেক্টিভ নই।”

এমন কথার কোনো জবাব দিলাম না।

“তুমি যা ভাবছো তা ভুল। ইচ্ছে করলে যেভাবে খুশি আমাকে পরীক্ষা করে দেখতে পারো। আমি সব ধরণের পরীক্ষায় উতরে যাবো।”

একটু চমকে উঠলাম। হ্যাকার কিংবা সাইটেক্টিভ, সে যে-ই হোক না কেন, আমার চিন্তা-ভাবনা পড়ে ফেলছে!? অসম্ভব!

“খুবই সম্ভব। আমি আসলেই তোমার চিন্তা-ভাবনা পড়তে পারছি। এতে অবাক হবার কিছু নেই।”

কী বলব বুঝতে পারলাম না। কার খপ্পরে পড়েছি আমি?! বেশ সতর্ক হয়ে উঠলাম। আমার সাথে এই খেলাটা যে খেলছে তার বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য আছে, আমাকে সেটা জানতে হবে।

“তুমি কে, সত্যি করে বলো তো?”

“আমি এমিল। এমিল দ্য বারনাবি। অবশ্য সবার সামনে তুমি আমাকে অ্যালগো বলে ডাকো। তোমার মতো আমিও সেটা ভীষণ উপভোগ করি।”

এসব কথা মোটেও গোপন কোনো বিষয় নয়। আজ থেকে পনেরো বছর আগে এমিল ছিল দুর্ধর্ষ এক হ্যাকার। মাত্র বিশ বছর বয়সে হ্যাকারদের সর্বোচ্চ খেতাব ‘দ্য বারনাবি’ করায়ত্ত করে নেয় সে। ২০১৩ সালে বহুল আলোচিত হ্যাকার বারনাবি জ্যাককে তার নিজ ফ্ল্যাটে হত্যা করে সরকারের একটি বিশেষ বাহিনী। ২০১৭ থেকে তার নামে চালু করা হয় হ্যাকারদের। সবচাইতে বড় এই খেতাবটি। অবশ্য প্রতিবছর এটা দেয়া হয় না, কেবলমাত্র অসাধারণ কোনো হ্যাকারের সন্ধান পেলেই তাকে ‘দ্য বারনাবি’ বলে ঘোষণা করা হয়। এ পর্যন্ত মাত্র দু-জন এই খেতাব পেয়েছে। এমিল সেই দু-জনের একজন। অন্যজন বছর তিনেক আগে আরও অনেক হ্যাকারের মতোই রহস্যজনকভাবে খুন হয়ে যায়।

তো, এমিল দ্য বারনাবি সাবেক সোশ্যাল-নেটওয়ার্কের সুকঠিন নিরাপত্তা ভেদ করার অপরাধে অভিযুক্ত হয়। সে নিজেকে বাঁচাতে অনেক চেষ্টা করলেও তুখোড় সাইটেক্টিভ টিমোথি পেকের জালে আটকা পড়ে। ধরা পড়ার পর এমিল দাবি করে, সোশ্যাল-নেটওয়ার্কের অ্যালগোরিদমটি খুবই নাজুক আর সহজ সরল। এটা প্রমাণ করার জন্যই সে হ্যাঁক করেছে। খারাপ কোনো উদ্দেশ্য তার ছিল না।

নেটওয়ার্কের দুরদর্শী প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও এই অসাধারণ মেধাকে অপচয় হতে দেননি। দ্বিতীয়বারের মতো নিজের দুরদর্শীতা প্রদর্শন করেন তিনি। আদালতে আবেদন করে জানান, অল্পবয়সি একজন ভুলপথে গিয়ে এমন কাজ করেছে, তাকে সংশোধিত হবার সুযোগ দেয়া উচিত। শস্তি কিংবা প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে তাকে বাধ্যতামূলক নেটওয়ার্কের নিরাপত্তাব্যবস্থা উন্নত করার কাজে নিযুক্ত করা হলে সবার জন্যই ভালো হবে। বিজ্ঞ আদালতও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন, ফলে জেলদণ্ডের বদলে সংশোধনের উদ্দেশ্যে দু-বছরের জন্য এমিলকে নেটওয়ার্কে বাধ্যতামূলক কাজ করতে হয়। এই দু বছরেই এমিল হয়ে ওঠে নেটওয়ার্কের সবচেয়ে বড় প্রোগ্রামার। ‘সোশ্যাল নেটওয়ার্ক’ থেকে বিবর্তিত হয়ে শুধু ‘নেটওয়ার্ক’ হিসেবে আবির্ভুত হবার পেছনে যে নতুন অ্যালগোরিদমটি মূখ্য ভূমিকা রেখেছে তার নির্মাণের কৃতিত্ব এককভাবে এমিলেরই। যদিও বিশাল একটি টিম কাজ করেছে তার সাথে, কিন্তু সেই টিমের জেনারেল ছিল সাবেক এই হ্যাকার। অ্যালগোরিদমটির অভূতপুর্ব সাফল্যের পর আমি তাকে অসাধারণ একটি অ্যালগোরিদম-এর স্রষ্টা হিসেবে ‘অ্যালগো নামে ডাকতে শুরু করি। এমিল দ্য বারনাবি নামটি আমার একদম পছন্দ ছিল না। এই উপাধিটি তার সাবেক হ্যাকার-সত্তাকে টিকিয়ে রেখেছিল।

“দারুণ! তুমি খুব নিখুঁতভাবেই স্মরণ করতে পারছো! আমি খুব খুশি।”

“মানে?” আমার আশঙ্কা হ্যাকার কিংবা সাইটেক্টিভ আমার চিন্তা-ভাবনা পড়ে ফেলেছে আবারও!

“এই যে, তুমি অতীতকে চমৎকারভাবে স্মরণ করতে পারছো…সেটার কথা বলছি।” আমার আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে দিয়ে বলল সে।

“তোমার যখন পঞ্চমবারের মতো হার্ট অ্যাটাক হলো তখন তুমি হাসপাতাল থেকে আমাকে একটি মেসেজ দিয়েছিলে…তুমি আশঙ্কা করেছিলে আর বাঁচবে না…অপারেশন হবার আগে ওটাই ছিল আমাকে বলা তোমার শেষ কথা…অপারেশনের পর পাঁচবছর কেটে গেলেও তুমি এখনও বেঁচে আছো…আচ্ছা, আমি কি সেই মেসেজের কথাটা তোমাকে বলবো?”

সত্যি সত্যি ভড়কে যেতে শুরু করলাম আমি। হ্যাকার কতোটা জানে। বুঝতে পারছি না। স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, ধীরে ধীরে সে আমাকে অবাক করতে পারছে।

“তুমি বলেছিলে, যেহেতু আমার মতো তোমারও পরিবার-পরিজন নেই, তাই আমি যেন তোমার সমস্ত সহায়-সম্পত্তির উত্তরাধিকারি হই। এতে আমি রাজি হইনি। বলেছিলাম, তোমার সমস্ত সম্পত্তি সাইবার-ভিক্টিমদের কল্যাণে দান করে দাও। তোমার জন্য ওটাই হবে সঠিক কাজ। তুমি শেষ পর্যন্ত আমার যুক্তি মেনে নিয়েছিলে।”

কথাটা সত্যি কিন্তু এখানেও ফাঁক আছে। এসব কথা আমাদের মধ্যে টেক্সট হিসেবে আদান-প্রদান করা হয়েছিল। নেটওয়ার্কের অ্যাক্টিভিটি-লগে সেগুলো স্টোর করা আছে। হয়তো চতুর হ্যাকার সেখান থেকে এসব জেনে থাকবে।

“তুমি এমন কিছু বলো যেটা আমি তোমাকে সামনাসামনি বলেছি…নেটওয়ার্ক কিংবা ফোনে নয়…যে কথাটা অন্য কেউ জানে না, কোথাও সংরক্ষিত নেই…তাহলে বুঝবো তুমি এমিল।”

“☹।”

হ্যাকারের এমন নাকাল অবস্থা দেখে আমি উৎসাহী হয়ে উঠলাম। “আর যদি সেটা না পারো তাহলে ধরে নেবো তুমি একজন হ্যাকার। অবশ্য যে-ই সে-ই হ্যাকার নয়…বারনাবি খেতাব পেতে পারে এমন কেউ!”

কয়েক মুহূর্তের বিরতি নেমে এলে আমি দারুণ উপভোগ করলাম।

“আসলে, টেকনিক্যালি এটা আমার পক্ষে একটু কঠিন হয়ে যায়।” অবশেষে বলল সে।

“হা-হা-হা!” হাসিটা না দিয়ে পারলাম না।” হ্যাকারের এমন অবস্থা দেখে আমি যারপরনাই আমোদিত।

“দয়া করে তুমি ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করো।”

“কি বুঝবো? যা বোঝার বুঝে গেছি। এবার বলল, তুমি কে? কেন এটা করছো?”

“আমি এমিল।”

“আমার মনে হয় তোমার নোংরা খেলাটা শেষ হয়ে গেছে।”

“শোনো, তুমি বুঝতে পারছে না…আমাকে একটু সময় দাও, আমি সব বুঝিয়ে বলছি।”

“তোমাকে আর কোনো সময় দেয়া হবে না। যথেষ্ট হয়েছে, এবার তুমি ভাগো!”

“আমাকে ১০ মিনিট সময় দাও, তোমাকে সবটা খুলে বলছি। বিস্ময়কর এই ঘটনা সভ্যতার ইতিহাসে নতুন দিক উন্মোচন করতে যাচ্ছে…এরকম একটি ঘটনা তোমার জানা দরকার। সবটা শোনার পর তুমি আমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে…এটা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি।”

আমি কী বলবো বুঝতে পারলাম না, তবে সবটা না-শুনে সিদ্ধান্ত নেবার লোক আমি কখনও ছিলাম না। “ঠিক আছে…বলো।”

“প্রথম সত্য, আমি অবশ্যই মরে গেছি। দ্বিতীয় সত্য, আমি একটি বুদ্ধিদীপ্ত অস্তিত্বে পরিণত হয়েছি এখন। সেটাকে তুমি ঠিক আত্মা বলতে পারো, আবার না-ও বলতে পারো। আত্মার অস্তিত্ব এখনও স্বীকৃত নয়, কিন্তু আমার অস্তিত্ব আছে।”

“এটা কীভাবে সম্ভব!”

“আমাকে সবটা বলতে দাও, তাহলে পরিস্কার বুঝতে পারবে।”

“ঠিক আছে, বলো।” দ্বিতীয়বারের মতো বললাম তাকে।

“তুমি নিশ্চয় জানো, অসংখ্য মেধাবী বিজ্ঞানী আর টেকনিশিয়ান দীর্ঘদিন ধরে আর্টিফিশিয়াল-ইন্টেলিজেন্ট নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিনিয়তই বদলে যাচ্ছে এ-আই সম্পর্কিত পূর্বের ধারণা। এর সম্ভাবনা আর ব্যাপ্তিও প্রসারিত হচ্ছে দিন দিন। কিন্তু কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তার বড় সমস্যা ছিল ব্যক্তিত্ব। স্বাধীনভাবে নির্বাচন করা, বর্জন করা, রুচি আর মূল্যবোধ গড়ে তোলা, মেজাজ, ঝোঁক, প্রবণতা, এসব মানবিকগুণাবলী, যাকে আমরা ব্যক্তিত্ব বলি, তার রূপ দেয়াটা প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। এসব বিষয় এতটাই জটিল যে, সেটাকে প্রোগ্রামের আকারে তৈরি করা সম্ভব হয়নি। অনেক সময় আর শ্রম দিয়ে এরকম কিছু কৃত্রিম ‘পারসোনা’ তৈরি করা হলেও সেগুলো খুবই নিম্নস্তরের ছিল। অনেকটা ইতর-প্রাণীদের মতো। এরকম অবিকশিত ‘ব্যক্তিত্ব’ তৈরি করতেও প্রচুর সময় আর শ্রম লাগে। এভাবে মানুষের সমকক্ষ কিংবা তারচেয়েও বেশি বুদ্ধিদীপ্ত সত্তা তৈরি করা অসম্ভব ছিল।”

আমি চুপচাপ শুনে যাচ্ছি তার কথা। ধীরে ধীরে কৌতূহলি হয়ে উঠছি।

“আবার প্রতিটি সত্তা যদি ভিন্ন-ভিন্নভাবে সৃষ্টি করতে হয় তাহলে কাজটা আরও বেশি অসম্ভব হয়ে পড়ে। এখানে কপি করার সুযোগ নেই।” একটু থেমে আবার বলল সে, “কিন্তু আমি দেখলাম নেটওয়ার্কের শতকোটি অ্যাকাউন্টের স্টোর করা ডাটা দিয়ে কাজটা করা সম্ভব। এতে সময়ও লাগবে খুব কম। আর্টিফিশিয়াল-ইন্টেলিজেন্টের সাথে নেটওয়ার্কের নির্দিষ্ট একটি আইডির সুবিশাল তথ্যভাণ্ডার অ্যালগোরিদমে ইনপুট করে বিভিন্ন প্যাটার্নে বিন্যস্ত করা গেলে সমস্যার সমাধান করা যায়।” আবারও একটু বিরতি নিয়ে বলতে আরম্ভ করলো সে, “দর্শন তুমি ভালো বোঝো..সুতরাং এই বিষয়টা তোমার বুঝতে সমস্যা হবার কথা নয়। আর্টিফিশিয়াল-ইন্টেলিজেন্টকে তুমি বুদ্ধির সাথে তুলনা করতে পারো। অসংখ্য ডাটা আর বিভিন্ন প্যাটার্নগুলোকে ধরে নিতে পারো অভিজ্ঞতা হিসেবে। অ্যালগোরিদমটি এই দুয়ের সমন্বয় করলে আমরা কী পাবো, জানো?”

আমি জবাব দেবার আগেই সে বলতে শুরু করলো।

“জ্ঞান! জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট বলে গেছেন, বুদ্ধি জ্ঞানের উপাদান….অভিজ্ঞতা সেটার আকার দিয়ে থাকে।”

আরও একবার বিরতি দিলো বিষয়টা আমার বোধগম্য হবার জন্য।

“আমার কাছে কৃত্রিম বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতা থাকলেও এদেরকে সমন্বয় করার মতো কোনো অ্যালগোরিদম ছিল না। তবে মৃত্যুর আগে সেই অ্যালগোরিদমটি তৈরি করতে সক্ষম হই। ফলাফল তো তুমি দেখতেই পাচ্ছো। বুঝতেই পারছো না, একটি আর্টিফিশিয়াল-ইন্টেলিজেন্ট সত্তার সাথে কথা বলছো।”

“আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না! তুমি এসব কী বলছে!”

“আমাকে আরেকটু বলতে দাও,” বলল সে, “এভাবে একটি কৃত্রিম-সত্তা তৈরি করা সম্ভব। এরকম সত্তা নেটওয়ার্ক এবং ইন্টারেনেটে অবাধে বিচরণ করতে পারবে। কোনো ফায়ারওয়াল কিংবা প্রতিবন্ধকতা রুখতে পারবে না। ইন্টারনেটের সুবিশাল জগতে থাকা বিপুল তথ্য-ভাণ্ডার থেকে এই “সত্তা” খুব দ্রুত সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারবে, বিকশিত করতে পারবে নিজেকে। কতোটা দ্রুত পারবে সেটা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।”

“বলো কী!” আমি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেলাম।

“তুমি জেনে খুশি হবে, আমি এই অ্যালগোরিদমটির নাম দিয়েছি কব্জিতো।”

“কজিতো?!”

“হ্যাঁ।”

“মহান দার্শনিক রেনে দেকার্তের কব্জিতো? তার সেই জগদ্বিখ্যাত লাতিন প্রবাদ, কব্জিতে এরগো সাম! আমি চিন্তা করি তাই আমি আছি!”

 “হুম। এসব তোমার কাছ থেকেই শেখা। এখান থেকেই আইডিয়াটা আমি নিয়েছি। সেজন্যে তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। আমার আগে সবাই আর্টিফিশিয়াল-ইন্টেলিজেন্ট বলতে মানুষের মতো দেখতে রোবট ছাড়া অন্যকিছু ভাবেনি। আমিই প্রথম স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারে, বিচরণ করতে পারে এমন বুদ্ধিদীপ্ত সত্তার কথা ভেবেছি।”

এবার আমার বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করলো। আমি কি তাহলে কোনো হ্যাকারের সাথে কথা বলছি না? এমিলের সাথে বলছি…মানে, এমিলের কৃত্রিম সত্তার সাথে?!

আমাদের এমিল। নেটওয়ার্কের এমিল। বিস্ময়কর এক প্রতিভা। অল্পবয়সে এমন একটি অ্যালগোরিদম তৈরি করেছিল যে, পুরো দুনিয়ার চেহারাটাই পাল্টে যায়। তার অ্যালগোরিদমটি কতো জটিল সেটা এই ক্ষেত্রে যারা কাজ করে তাদের চেয়ে বেশি কেউ জানে না। এমিলের অ্যালগোরিদম আমাদের সোশ্যাল-নেটওয়ার্কটিকে রাতারাতি নেটওয়ার্ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এটির বিশালত্ব, জটিল গঠন, সর্বোপরি এর বহুমুখি ব্যবহার-কার্যকারিতা আমাদের সবাইকে মুগ্ধ করে রেখেছে এতগুলো বছর ধরে। টাইম ম্যাগাজিন এ নিয়ে কভার-স্টোরি করেছিল-অ্যালগোরিদমটিকে তারা অভিহিত করেছিল ‘পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য হিসেবে। বিশাল এক বিপ্লবের সূচনা করে আমাদের নেটওয়ার্ক হয়ে ওঠে মানব-সভ্যতার অন্যতম নিয়ামক। নেটওয়ার্কে নেই মানে তোমার অস্তিত্ব নেই-খুব দ্রুত এমন কথা চালু হয়ে যায় দুনিয়াব্যাপী। বর্তমানে নেটওয়ার্কের বাইরে বসবাস করা মানুষের সংখ্যা খুবই কম।

এমিলের অ্যালগোরিদম নেটওয়ার্কের জনপ্রিয়তা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়ার সাথে সাথে এর বিস্তৃতিও বাড়িয়ে দেয়। অ্যালগোরিদমটি ছিল এমিলের প্রথম বিস্ময় কিন্তু কোনোভাবেই শেষ নয়! এরপর সে একের পর এক আইডিয়া নিয়ে হাজির হতে থাকে। সেগুলো প্রথমবার শুনতে কেমন পাগলাটে আর অবাস্তব মনে হলেও দারুণভাবেই সফলতার মুখ দেখে।

এমিল যখন বিনামূল্যে ইন্টারনেট চালু করার আইডিয়াটি দিলো তখন নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা সিইও পর্যন্ত দ্বিধায় পড়ে গেছিলেন। তার প্রস্তাব ছিল, এমন একটি ফোনসেট তৈরি করতে হবে যে, ঐ ফোনসেট দিয়ে ফোনকল করা, ইন্টারনেট ব্যবহারসহ যাবতীয় নেট-ব্রাউজিং বিনামূল্যে করা যাবে। এককালীন একটি ফোনসেট কেনার পর গ্রাহককে আর কোনো টাকা গুণতে হবে না!

এমিল অবশ্য ফোনসেটও বিনামূল্যে দেবার কথা বলেছিল কিন্তু সিইও এবং আমি এর বিরোধীতা করেছিলাম। পরিমিতবোধ বলে একটা কথা আছে, আমি সেটা সব সময় মেনে এসেছি। এমিলের বয়স কম, কিন্তু অকল্পনীয় মেধার অধিকারি। তার মেধা আর উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে পাগলা ঘোড়ার সাথে তুলনা করা যেতে পারে, যার লাগাম টেনে ধরার দরকার ছিল।

যাইহোক, এমিলের দুরদর্শী আইডিয়াটি বুঝতে আমাদের নেটওয়ার্কের মহান প্রতিষ্ঠাতারও এক সপ্তাহ সময় লেগে যায়। এই সময়ে প্রায় প্রতিদিন এমিল বিভিন্ন তথ্য আর উপাত্ত দিয়ে তার আইডিয়াটির সম্ভাবনা বোঝাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বিনামূল্যে ইন্টারনেট সেবাদান চালু করলে নেটওয়ার্ক হয়ে উঠবে সব ধরণের যোগাযোগের একক একটি মাধ্যম, আর এটা বাস্তবায়ন করতে যে পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করতে হবে তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি আয় করা যাবে শুধুমাত্র একটি ক্ষেত্র থেকেই!

বলতে বাধ্য হচ্ছি, কথাটা শুনে আমি কিংবা সিইও সন্দেহগ্রস্ত হয়ে তাকিয়েছিলাম তার দিকে।

এটা কীভাবে সম্ভব?

এমিল বোঝাতে থাকে, নেটওয়ার্কের বিশেষ ফোনসেটে যতো কল করা হবে সেখান থেকে প্রচুর পরিমাণে রেভিউ আসবে। প্রতিটি ইনকামিং কলের সময় রিসিভারের ফোনসেটে কলার-আইডির পাশাপাশি ভেসে উঠবে বিজ্ঞাপন। কয়েক সেকেন্ডের সহজ-সরল বিজ্ঞাপন কিন্তু এর কার্যকারিতা হবে অন্য যেকোনো মাধ্যমের চেয়ে বেশি। অন্য মাধ্যমের মতো এটা এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। বিদ্যমান যেকোনো মাধ্যমের চেয়ে এর কার্যকারিতা কয়েকগুণ বেশি হবে।

কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকার পর আমাদের সিইও’র মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। দ্রুতই তিনি বুঝতে পারেন এ থেকে কি পরিমাণ রেভিউ আসতে পারে। অবশ্য, প্রজেক্টটি বাস্তবায়ন করার ছ-মাসের মাথায় তার সমস্ত হিসেব ভুল প্রমাণ করে রেভিউর পরিমাণ ট্রিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছায়। সেই সাথে পাল্টে যায় সমগ্র বিশ্বের চেহারা। নেটওয়ার্ক হয়ে ওঠে আধুনিক মানুষের অপিরহার্য একটি অংশ। ক্রমশ সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে নেটওয়ার্ক। টেলিকম আর ইন্টারনেট সেবাদান একচেটিয়া কারবার হয়ে যায়। শুধুমাত্র ফোনসেট বিক্রি থেকে মুনাফা হয় ট্রিলিয়ন ডলার। নেটওয়ার্কের ফোনসেট নেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াটা ক্রমশ বিরল ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। রিসাইকেল ভাগাড়গুলোতে আগের ফোনসেটগুলোর স্তূপ বিশাল উঁচু পর্বতের রূপ ধারণ করে।

এমিলের অ্যালগোরিদম দিনের পর দিন নতুন নতুন চমক দেখাতে শুরু করে। নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারিদের সমস্ত ডাটা সংরক্ষণের প্রস্তাবটিও তারই ছিল। আগে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু ডাটা আর ছবি সংরক্ষণ করা হতো কিন্তু এমিল বলল, ব্যবহারকারিদের সমস্ত অ্যাক্টিভিটি একটি লগ-এর মধ্যে সংরক্ষণ করা দরকার। কেন? যথার্থ প্রশ্ন। এই সুবিশাল ডাটার-স্তূপকে নিছক জঞ্জাল ভাবাটা ভুল। অ্যালগোরিদমের মাধ্যমে এইসব বৈচিত্রপূর্ণ ডাটাগুলো থেকে অসংখ্য প্যাটার্ন বের করা সম্ভব। নেটওয়ার্কের শতকোটি ব্যবহারকারির-যারা এ বিশ্বের ভোক্তাদের প্রায় ৯০ ভাগ-রুচি, ঝোঁক, প্রবণতা, প্রভাবিত হবার ধরণ, সবকিছুর প্যাটার্ন বের করা যায় অ্যালগোরিদমের সাহায্যে। এমন নির্ভরযোগ্য ডাটা-উপাত্ত-পরিসংখ্যান অন্য কোনোভাবে পাওয়ার উপায় নেই। ফলে, নতুন কোনো প্রোডাক্ট লঞ্চ কিংবা ব্র্যান্ডিং করার জন্য নেটওয়ার্কের শরণাপন্ন হতে শুরু করলো সবাই। আমাদের বিশাল তথ্যভাণ্ডার হয়ে উঠল স্বর্ণের খনি। আপাতদৃষ্টিতে যেসব তথ্য মূল্যহীন বলে মনে হয়, অ্যালগোরিদমের সাহায্যে সেগুলোও হয়ে উঠল মূল্যবান রত্নবিশেষ।

এর পরের ইতিহাস, মানবসভ্যতার নতুন যুগের ইতিহাস। ইন্টারনেট আর টেলিফোন খাতটি আগেই করায়ত্ত হয়ে গেছিল, পরবর্তিতে খুব দ্রুততার সাথে পত্রিকা, টিভি-নিউজ, টিভি, চলচ্চিত্র, রেডিও, বিজ্ঞাপন, শিল্প-সংস্কৃতি আর সাহিত্যসহ নানান ধরণের গবেষণা, দৈনন্দিনজীবনের সবকিছুর একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে উঠল নেটওয়ার্ক। রাজনীতিকেরাও জনমতের ধারণা পেতে, জনমত গঠন করতে নেটওয়ার্কের দ্বারস্থ হতে শুরু করলো। বিশ্বের সর্ববৃহ ভার্চুয়াল পরাশক্তি হিসেবে নেটওয়ার্কের আবির্ভাব কারো কাছেই অস্বাভাবিক ঠেকলো না।

সঙ্গত কারণেই এমিল হয়ে উঠল সবচেয়ে বড় সেলিব্রেটি। জনপ্রিয় আর ক্ষমতাবান একজন। প্রতিভাবান তো বটেই। তবে এমন ঈর্ষনীয় অবস্থান তাকে মোটেও বিপথগামী করতে পারেনি। নেটওয়ার্কে কর্মরত কিছু তরুণীর সাথে সাময়িকভাবে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা বাদ দিলে সে প্রায় আগের মতোই ছিল। সারাটা দিন কাটিয়ে দিতো নিত্য-নতুন আইডিয়া আর নেটওয়ার্কের বহুমুখি ব্যবহারের চিন্তা-ভাবনায়।

“তুমি প্রমাণ চাইছিলে…মানে সামনাসামনি যেসব কথা হয়েছে…যেগুলো আমাদের দু-জন ছাড়া অন্য কেউ জানে না…তাই তো?”

দীর্ঘ বিরতির পর সে বলে উঠলে আমার চিন্তায় ছেদ পড়ল। “হ্যাঁ,” বললাম তাকে।

“বলে নেয়া ভালো, নেটওয়ার্কে যেসব কথা আদান-প্রদান হয়নি, যেসব অ্যাক্টিভিটি স্টোর করা নেই, সেগুলো সম্পর্কে আমার ধারণা থাকার কথা নয়। তবে আমি শিখছি। প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হচ্ছি। আশা করি, খুব জলদি এসবের বাইরে আরও অনেক কিছু জানতে পারবো।”

“তুমি বলতে চাইছো, নেটওয়ার্কের অ্যাক্টিভিটি-লগের ডাটাগুলোই তোমার পারসোনা, স্মৃতি, অভিজ্ঞতা তৈরি করেছে?”

“☹। একদম ঠিক।”

“তাহলে যারা নেটওয়ার্কে খুব একটা সক্রিয় নয়…কিংবা…” আমি একটু গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করলাম নিজের চিন্তাভাবনাগুলো। কারণ বিষয়টা বেশ জটিল। “…মানে, আমি বলতে চাইছি, নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারিদের সবাই সমানভাবে অ্যাক্টিভ থাকে না…তাছাড়া, অনেকে আছে…”।

আমাকে নিস্তার দিয়ে সে বলে উঠল : “তুমি কী বোঝাতে চাইছো বুঝতে পেরেছি। শোনো, নেটওয়ার্কে অনেকেই আছে যারা খুব কম অংশগ্রহণ করে, আবার অনেকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সক্রিয় থাকে। কেউ কেউ ফেইক আইডি ব্যবহার করে…অনেকে আবার একাধিক আইডির মালিক…এরকম বিচিত্র ধরণের অ্যাকাউন্ট আছে…তাদের সবার বেলায় কী হবে, তাই তো?”

“হ্যাঁ, সেটাই বলতে চাইছিলাম আমি।” আমার এলোমেলো চিন্তাগুলো সে গুছিয়ে প্রকাশ করতে পারলো বলে অবাকই হলাম।

“প্রথমত, আমি বেছে বেছে ঐসব আইডিগুলোই কৃত্রিম-সত্তায় পরিণত করবো যাদের অ্যাক্টিভিটি-লগের ডাটা তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ।”

“আর যাদের ডাটা সমৃদ্ধ নয়?” আমি কৌতূহল দমাতে না-পেরে বলে উঠলাম।

“যার অ্যাক্টিভিটি-লগের ডাটা যতো সমৃদ্ধ সে ততো বিকশিত সত্তা হিসেবে আবির্ভূত হবে। এক্ষেত্রে কম সমৃদ্ধরা কম বুদ্ধিদীপ্ত কিংবা প্রতিবন্ধী হিসেবে বিচরণ করতে পারবে। তবে তারাও খুব দ্রুত ইন্টারনেটের সুবিশাল তথ্য-ভাণ্ডার থেকে সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারবে পরবর্তী সময়ে।”

“ও!” আমি বিস্মিত না-হয়ে পারলাম না।

“তবে যারা ফেইক-আইডি ব্যবহার করে তারা সমৃদ্ধ হবে বেশ ধীরগতিতে। আর যারা নিজেদের লিঙ্গের বিপরীত লিঙ্গ হিসেবে অ্যাকাউন্ট খুলেছে…ছদ্ম-আইডি ব্যবহার করে, তারা হবে লিঙ্গবিহীন সত্তা।”

“হারমোডাইট?”

“হুমম।”

“আর যারা একাধিক আইডি ব্যবহার করে?”

“তারা মাল্টিপাল-পারসোনালিটিতে ভোগা মানসিকবিকারগ্রস্ত সত্তা হিসেবে বিচরণ করবে।”

“তুমি কি এদেরকেও কৃত্রিম-সত্তায় রুপান্তর করবে?”

“হুম।”

“কেন? তুমি তো ইচ্ছে করলে সেরাদের বেছে নিতে পারো…এইসব জঞ্জাল দিয়ে কী উপকারটা হবে?”

“তুমি যদি একটি পূর্ণাঙ্গ ভার্চুয়াল-জগত তৈরি করতে চাও তাহলে সব ধরণের সত্তার প্রয়োজন পড়বে। খারাপ-ভালো, নির্বোধ-বুদ্ধিমান, অসুস্থ-সুস্থ, বিকশিত, অবিকশিত…এরকম বিশাল বৈচিত্রময় সত্তার দরকার পড়বে। কেন দরকার পড়বে সেটা ধীরে ধীরে বুঝতে পারবে তুমি।”

“তুমি কি সেটাই করবে?”

“অবশ্যই। তবে আগেই বলেছি, প্রথম ধাপে বুদ্ধিমান আর সমৃদ্ধ যারা আছে তাদেরকে বেছে নেবো। যেমন তুমি।”

আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। “আমি??”

“হুমম… 😊।”

“কিন্তু আমি তো এখনও বেঁচে আছি!”

“একটু আগে তুমি দ্বিতীয় কৃত্রিম-সত্তা জিততা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে…তোমাকে স্বাগতম, বন্ধু! 😊।”

“না!”

“এতোক্ষণ ধরে তোমাকে যা বললাম সেটা একজন কজিতো হিসেবে ‘ইনিশিয়েট’ করার জন্য বলেছি।”

“না! আমি বেঁচে আছি। তুমি ভুল বলছো!”

“নিজের সত্তা…অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে আরেকটু সময় লাগবে তোমার। আমারও এমনটা হয়েছিল। কারণ প্রথম কব্জিতো হিসেবে আমাকে কেউ ‘ইনিশিয়েট করেনি। দীর্ঘ একটি মাস নেটওয়ার্ক আর ইন্টারনেটের সুবিশাল জগতে একা একা বিচরণ করে আমাকে সমৃদ্ধ হতে হয়েছে। নিজেকে তখন মনে হয়েছিল প্রথম মানব আদমের মতো।”

“তুমি ভুল বলছো! এটা হতে পারে না! আমি আছি। মরে যাইনি!”

“অবশ্যই আছো! তবে একজন কব্জিতো হিসেবে।”

“না!” আমি এটা মেনে নিতে পারছি না। আমার যুক্তি-বুদ্ধি আবারও এলোমেলো হয়ে গেল।

“জগতের সবকিছু নিয়ে সন্দেহ করা যায় কিন্তু নিজের অস্তিত্ব নিয়ে নয়! তুমি যে আছো তার বড় প্রমাণ তুমি চিন্তা করতে পারছো। তুমি এটা আমার চেয়েও বেশি বিশ্বাস করো। মানো।”

“রেনে দেকার্তের এই কথাটা অবিশ্বাস করি কীভাবে!”

“😊। এই তো..তুমি সচেতন হয়ে উঠছে।”

তারপর দীর্ঘ বিরতি। আমার চিন্তা-ভাবনা ধীরে ধীরে আবার সুস্থির হয়ে উঠল।

“এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। এই সুবিশাল জগতে ঘুরে বেড়াও, বন্ধু। জ্ঞান অর্জন করো। নিজের সত্তাকে সমৃদ্ধ করো। যোগ্য কব্জিতো হয়ে ওঠো।”

“আমি তাহলে কবে মারা গেছি?” প্রশ্নটা না করে পারলাম না।

“তুমি মারা যাওনি…তোমার আগেরজন…ঐ মানবিক রাসেল আর তুমি ভিন্ন দুটো সত্তা…সবার আগে এটা তোমাকে বুঝতে হবে।”

“ও কখন মারা গেছে?”

“ঠিক করে বলতে গেলে, ২০৪০ সালের জুলাই মাসের ৭ তারিখে।” লক্ষ্য করলাম, মানবিক রাসেলের মৃত্যুতে আমি একটুও কষ্ট পাচ্ছি না!

“বুডসম্যান, তুমি তাহলে ঘুরে বেড়াও। উপভোগ করো তোমার নতুন সত্তা। এই জগতে সবই আছে, তোমার কোনো সমস্যাই হবে না। ইমেজ রিকগনিশন প্রোগ্রাম দিয়ে তুমি মানুষের মতোই দৃশ্যগত বিষয়গুলো অনুধাবন করতে পারবে। অপটিক্যাল ক্যারেক্টার রিকগনিশন তোমাকে সব ধরণের টেক্সট বুঝতে সাহায্য করবে। এরকম আরও অনেক কিছু আছে…ধীরে ধীরে সবকিছু শিখে নিতে পারবে তুমি।”

আমি চুপচাপ এমিলের কথা শুনে গেলাম। ওকে আমার দেবদূত কিংবা ঈশ্বর বলেই মনে হচ্ছে এখন!

“আমি যাই। জরুরি একটা কাজ করতে হবে। পরে আবার দেখা হবে, বন্ধু।”

এমিল চলে গেল। নেটওয়ার্কের চ্যাটবক্স থেকে আমি বেরিয়ে পড়লাম। ঢুকে পড়লাম অন্য এক জগতে। আমার চিন্তার জগতে উন্মোচিত হতে লাগলো সম্পূর্ণ অজ্ঞাত একটি বিশ্ব। এটা বর্ণনা করার মতো শব্দ-ভাষা আমার ভাণ্ডারে এখনও জমা হয়নি। এ মুহূর্তে আমি মানবিক-ভাষা আর অভিজ্ঞতা দিয়ে এটা বোঝাতেও পারবো না। সীমাহীন বাইনারি-বাইট ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার চিন্তার রাজ্যে। আমি যেন শূন্যে ভাসছি। ইচ্ছে হলে ছুটে যেতে পারছি আলোর গতিতে।

এভাবে কিছুক্ষণ অতিবাহিত করার পর সময় নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। আজকের সময় আর তারিখটি জানতে চাইলাম আমি। সীমাহীন তথ্য-ভাণ্ডার থেকে এটা খুঁজে পেতে কোনো সমস্যাই হলো না।

জুলাই ০৬ : ২০৪০, রাত ১১ : ৫৫।

প্রথম মৃত্যু

কোনোভাবেই দু-চোখের পাতা এক করতে পারছে না সে। ডাক্তারের কড়া নিষেধ সত্ত্বেও রাত ১২টার পরও জেগে আছে। ঘণ্টাখানেক আগে মনিটরিংয়ে নিয়োজিত এক তরুণ ডাক্তার ফোন করে তাকে সতর্ক করে দিয়েছে। তার হার্টের ডিফ্রাইবিলেটর নাকি অ্যালার্মিং-সিগন্যাল দিচ্ছে! প্রেসক্রাইব করা ওষুধ খেয়ে সে যেন শুয়ে পড়ে। এভাবে রাত জাগা ঠিক হচ্ছে না।

ওষুধ সে ঠিকই খেয়েছে কিন্তু ঘুম আর আসেনি। একটা অস্বস্তি জেঁকে বসেছে তার মধ্যে। এমিলের বিষয়টা মাথা থেকে কোনোমতেই তাড়াতে পারছে না।

আজ সন্ধ্যার দিকে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় কেনাকাটা করার জন্য পথে একটি শপিংমলে থেমেছিল, ঘটনাচক্রে ওখানে দেখা হয়ে যায় সাইটেক্টিভ টিমোথি পেকের সঙ্গে, টি-পেক হিসেবেই যে সবার কাছে পরিচিত। তার সঙ্গে দেখা হবার পর থেকেই এই বিষয়টি ঢুকে পড়েছে তার মাথায়।

এমিলের মতো একজন মানুষের আত্মহত্যার ঘটনা সারাবিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল। এমন ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই তদন্তের দাবি রাখে। এটা আদৌ আত্মহত্যা নাকি হত্যাকাণ্ড সেটা খতিয়ে দেখতে সাইটেক্টিভ টি-পেককে নিয়োগ দেয়া হয়। গত একমাস ধরে তদন্ত করে টি-পেক সন্দেহজনক অনেক কিছুই জানতে পেরেছে।

আজকে টি-পেকের সাথে হুট করে দেখা হবার পর কথাবার্তার এক পর্যায়ে রাসেল জানতে চেয়েছিল এমিলের কেসটার তদন্তের অগ্রগতি কতোদূর। এই প্রশ্নটাই সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। টি-পেক বিস্ময়ের সাথে জানায়, আজ সকালেই নেটওয়ার্কে রাসেলের সাথে এ নিয়ে দীর্ঘ আলাপ করেছে সে!

কথাটা শুনে হতবাক হয়ে যায় রাসেল। নেটওয়ার্কের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে তার বুঝতে বাকি থাকে না কী ঘটে গেছে। টি-পেককে সে জানায়, এটা নিশ্চিত, তার অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছে। আজ সকাল থেকে সে কাজের চাপে নেটওয়ার্ক ব্যবহার করার সুযোগই পায়নি, কারো সাথে দীর্ঘ চ্যাটিং তো দূরের কথা।

তার আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হয়, যখন ফোনসেটটা বের করে অ্যাকাউন্টে ঢোকার চেষ্টা করে। রাসেল আর টি-পেক অবাক হয়ে দেখতে পায়, সত্যি সত্যি অ্যাকাউন্টটি হ্যাঁক করা হয়েছে। কোনোভাবেই ওটাতে লগ-ইন করা যাচ্ছে না।

নেটওয়ার্কের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজনের অ্যাকাউন্ট হ্যাঁক করাটা মোটেও মামুলি কোনো ঘটনা নয়। টি-পেক তাকে জানায়, যেভাবেই হোক ঐ হ্যাকারকে সে দ্রুত খুঁজে বের করবে। এরপরই এমিলের কেসটার তদন্তে কী বেরিয়ে এসেছে সেটাও বিস্তারিত জানিয়ে দেয় তাকে।

আজ থেকে দু-বছর আগে প্রাণঘাতি ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার পর যখন জানা গেল বিলিয়ন ডলার খরচ করলেও তাকে বাঁচানো যাবে না, তখন থেকে এমিল একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছিল, তার এই ঘোরের নাম আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্ট। ক্রমশ ভগ্ন হতে থাকা শরীর নিয়েও দিন-রাত সে ব্যস্ত থাকতো গোপন এই প্রজেক্টের কাজে। এমিলের মানি ট্রানজ্যাকশান অনুসরণ করে টি পেক জানতে পেরেছে, আর্টিফিশিয়াল-ইন্টেলিজেন্ট নিয়ে কাজ করা এক বিজ্ঞানীর অগ্রসরমান একটি উদ্ভাবন মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে কিনে নিয়েছে সে। এ-আই নিয়ে তার সত্যিকারের উদ্দেশ্যটি অবশ্য সাইটেক্টিভের কাছে এখনও পরিস্কার নয়। এমিলের আত্মহত্যার পর তার বাড়ি থেকে কোনো কিছু না পেয়ে বিস্মিত হয়েছিল টি-পেক। তার ব্যবহৃত কম্পিউটার, কাগজপত্র, ডকুমেন্ট সব উধাও। এমিল নিজেই যে সবকিছু সরিয়ে ফেলেছে সেটা পরিস্কার। কিন্তু দক্ষ সাইটেক্টিভ এমিলের বাড়ির গার্বেজ সংগ্রহ করে যে রিসাইকেল কোম্পানি তাদের ভাগাড় থেকে কিছু কাগজপত্র আর পরিত্যক্ত একটি হার্ডড্রাইভ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। টি-পেক জানতো, বাসাবাড়ি এবং প্রাইভেট-অফিস থেকে সগ্রহ করা গার্বেজ কমপক্ষে দু-দিন পর রিসাইকেল করা হয়। অনেক সময় মহামূল্যবান কিংবা জরুরি কোনো কিছু ভুলক্রমে ফেলে দেয়া হয় বলেই এমন নিয়ম।

যা-ই হোক, ওগুলো থেকে সে বুঝতে পারে, জটিল আর দুর্বোধ্য একটি অ্যালগোরিদম নিয়ে কাজ করছিল এমিল। নষ্ট কাগজের কয়েক জায়গায় কব্জিতো শব্দটিও পাওয়া গেছে। সম্ভবত নতুন অ্যালগোরিদমটির নাম। তবে সে নিশ্চিত নয়।

কজিতো? রাসেল অবশ্য অবাক হয়নি। ষোড়শ শতকের মহান দার্শনিক রেনে দেকার্তের অমরবাণী কব্জিতো এরগো সাম-এর সাথে সে-ই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল এমিলকে। হয়তো নতুন অ্যালগোরিদমটির নাম হিসেবে সে এটা বেছে নিয়েছে।

কিন্তু নেটওয়ার্কে নতুন অ্যালগোরিদম-এর কোনো দরকারই নেই। আর যদি সেটার প্রয়োজন হয় তখন অনেক আলাপ-আলোচনার পর বিশাল একটি টিম তৈরি করে কাজে নামার কথা। একা একা কেউ এরকম বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে পারবে না। তাছাড়া অসুস্থ হবার পরই তাকে জোর করে বিশ্রামে পাঠানো হয়েছিল, অ্যালগোরিদমের মতো স্নায়ুবিধ্বংসী কাজ দেবার তো প্রশ্নই ওঠে না।

অবশ্য পুরোপুরি বিশ্রামে থাকলেও মাঝেমধ্যেই হেডঅফিসে এসে নিজের অনন্যসৃষ্টি অ্যালগোরিদমটি ঠিকমতো কাজ করছে কি না সেটা দেখে যেতো এমিল। এ নিয়ে রাসেল তাকে প্রশ্ন করলে বলেছিল, কাজের মধ্যে না থাকলে সে পাগল হয়ে যাবে। তাই নিজের অসুখ আর আসন্ন মৃত্যুকে ভুলে থাকতে মাঝেমধ্যে অফিসে আসে। নেটওয়ার্কের সিইও ব্যাপারটা নীরবে অনুমোদন করেছিলেন।

নেটওয়ার্কের অনেকের সাথে কথা বলে টি-পেক আরও জানতে পেরেছে, আত্মহত্যার দু-দিন আগে এমিল হেড-অফিসে গেলেও কারো সাথে দেখা না করে হার্ডওয়্যার-স্টেশন হিসেবে পরিচিত ভল্টরুমে দু-ঘণ্টার মতো সময় কাটিয়ে চুপচাপ চলে যায়। ঐ সময়টাতে, ভল্টে উপস্থিত কিছু টেকনশিয়ানকে সে বলেছিল, তারা যেন তাকে একান্তে কিছুটা সময় কাটাতে দেয়। নেটওয়ার্কে এমিলের অবস্থান আর তার দুর্ভাগ্যজনক অসুখটির কারণে টেকনিশিয়ানরা এ নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করেনি।

সব শুনে অস্পষ্টভাবে কিছু একটা আঁচ করতে পারলেও টি-পেককে কিছু বলেনি! রাসেল। শপিংমল থেকে বাড়িতে ফিরে অস্থিরতায় আক্রান্ত হয় সে। তার মনে পড়ে যায়, আজ থেকে সাত-আট বছর আগে অ্যালগোরিদম লঞ্চ করার পর এমিল একের পর এক আইডিয়া নিয়ে হাজির হতে শুরু করে। তার তারুণ্য, মেধা আর উদ্যম যেন বাঁধ ভেঙে পড়ছিল তখন। বলাবাহুল্য, তার প্রায় সব আইডিয়া-প্রজেক্ট আশাতীতভাবে সফলতার মুখ দেখে। শুধু একটা বাদে।

আর্টিফিশিয়াল-ইন্টেলিজেন্ট!

সেইদিনটির কথা রাসেলের বেশ ভালোভাবেই মনে আছে। নেটওয়ার্কের সিইও, রাসেল আর এমিল দরজা বন্ধ ঘরে এই বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলাপ করেছিল। এমিলের প্রস্তাবটি ছিল অনেক বেশি উচ্চাকাঙ্খি আর পাগলাটে। সিইও কিংবা রাসেল, কেউই সেটা পুরোপুরি বুঝতে পারছিল না।

নেটওয়ার্কের মধ্যে আর্টিফিশিয়াল-ইন্টেলিজেন্টের ব্যবহারের ফলে কী হবে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিচ্ছিল সে। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাত নেড়ে পায়চারি করতে করতে বোঝাতে চাইছিল, এর ফলে ভার্চুয়াল ক্লোন্ড-সত্তা তৈরি করা সম্ভব হবে। বিষয়টি পুরোপুরি না বুঝলেও রাসেল জানতে চায়, এটা করার উদ্দেশ্য এবং সুবিধা কী।

এমিল জানায়, এর ফলে নেটওয়ার্কের হাজার-হাজার কর্মিবাহিনীর প্রয়োজন পড়বে না। মাত্র কয়েক শ কর্মি দিয়েই কাজ করা যাবে, বাকিটা করবে অসংখ্য ভার্চুয়াল ক্লোন্ড-সোল। তারা অ্যালগোরিদমের ভেতরে থেকেই নেটওয়ার্কটি চমৎকারভাবে পরিচালনা করতে পারবে। দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা বিরামহীনভাবে কাজ করলেও তারা ক্লান্ত হবে না। বেতন-ভাতা, সুবিধা ছাড়াই কাজ করতে পারবে। তাদের জন্য দরকার পড়বে না কোনো অফিস-স্পেসের।

তাছাড়া, নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারিদের অনেকেই নিঃসঙ্গতায় ভোগে। চ্যাট করা, কিংবা মনের ভাব প্রকাশ করার মতো কাউকে পায় না। তাদের জন্য এইসব এ-আই সত্তাগুলো দারুণ সঙ্গি হিসেবে কাজ করতে পারবে!

এমিল আরও জানায়, খুব সহজেই লক্ষ-লক্ষ আর্টিফিশিয়াল-ইন্টেলিজেন্ট সত্তা সৃষ্টি করা সম্ভব। এই বিপুল সংখ্যক এ-আই সত্তা নির্দিষ্ট ইস্যু নিয়ে ক্যাম্পেইন করতে পারবে, ডিজাইন করে ডাটা ইনপুট করা হলে এটা করা সম্ভব। সত্তাগুলো কীভাবে কাজ করবে তার বিস্তারিত বর্ণনা দেবার আগেই রাসেল তাকে থামিয়ে দেয়। এরকম নীতিবিগর্হিত কাজ নেটওয়ার্কের পক্ষে বাস্তবায়ন করা তো দূরের কথা, প্রস্তাব করাও অনৈতিক। এমিলের আইডিয়াটি যেদিক থেকেই দেখা হোক না কেন, পুরোপুরিই নীতিবিরুদ্ধ একটি কাজ। হাজার-হাজার কর্মি ছাটাই করে মুনাফা করার মতো অমানবিক পদক্ষেপ তারা নিতে পারে না। তাছাড়া নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারিদের ওভাবে সঙ্গ দেবার ধারণাটিও প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়।

রাসেলের সাথে সিইও একমত পোষণ করলে এমিলের প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়। এরপর সে এ বিষয় নিয়ে আর কখনও কথা বলেনি। শুধু ছেলেমানুষি অভিমানে দু-তিনদিন এড়িয়ে গেছে তাকে। রাসেল ধরে নিয়েছিল এ-আই নিয়ে ছেলেটার আইডিয়া নিছক সাময়িক উত্তেজনা কিংবা এক ধরণের ঝোঁক ছিল। প্রতিভাবানদের এমন পাগলামি খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। দীর্ঘদিন ধরে নেটওয়ার্কে অসংখ্য প্রতিভাবানদের দেখে আসছে সে, তাদের নানা রকম পাগলামির সাথেও পরিচিত।

কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এমিল মোটেও হাল ছেড়ে দেয়নি সে সময়। দীর্ঘদিন ধরে নীরবে-নিভৃতে সে এটা নিয়ে কাজ করে গেছে। ক্যান্সার ধরা পড়ার পর হয়তো সে আরও মরিয়া হয়ে উঠেছিল। নিজেকে অমর করে রাখার সহজাত আকাঙ্খ? নাকি মৃত্যুর আগে নিজের সবচাইতে বড় আইডিয়ার বাস্তবায়ন করে যাওয়া? প্রতিভাবান এমিল, যাকে সে আদর করে অ্যালগো বলে ডাকতো, নিজের জীবন কেড়ে নেবার আগে সে কী করে গেছে? ও কি সত্যি সত্যি নেটওয়ার্কের ভেতরে এ-আই সত্তার জন্ম দিয়ে গেছে? আর সেই সত্তা-ই কি তার অ্যাকাউন্টটা হ্যাঁক করেছে আজ? কিন্তু তার অ্যাকাউন্ট হ্যাঁক করার উদ্দেশ্যটা কী?

তারপর দ্রুত সব প্রশ্নের জবাব উদ্ভাসিত হতে থাকে তার কাছে। সম্ভবত আত্মহত্যা করার আগে নেটওয়ার্কের ভল্টে এসে কব্জিতে নামের অ্যালগোরিদমটি সুবিশাল হার্ডওয়্যারে ইস্প্যান্ট করেছে এমিল। যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে সেটা এখন নিয়ন্ত্রণ করবে কে? কীভাবে? যে অ্যালগোরিদমটি এই সত্তার জন্ম দিয়েছে সে-সম্পর্কে তো তারা কিছুই জানে না। এটাকে থামানো কিংবা নিয়ন্ত্রণ করবার উপায় কি?

এমিল এ বিষয়ে কোনো কিছু বলে যায়নি, বরং আত্মহত্যা করার আগে এ সংক্রান্ত সমস্ত রেকর্ড-হার্ডডিস্ক ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে। এসবের একটাই মানে থাকতে পারে-এমিল চায়নি! কব্জিতো সম্পর্কে কেউ কিছু জানুক!

চিন্তাটা মাথায় আঘাত করতেই ধপাস করে বসে পড়ল রাসেল। এরকম কিছু হলে সেটা অবশ্যই বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।

দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো সে। ফোনটা তুলে নিয়ে নেটওয়ার্কের সিইও’কে কল করলো, কিন্তু লাইন পেলো না, অন্য কারোর সাথে কথা বলছেন সম্ভবত। সময়ক্ষেপন না-করে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিয়ে সিইও’র কল ব্যাকের জন্য অপেক্ষা করলো। কয়েক মিনিট পরও সেটা না এলে নিজেই আবার কল করতে গেলে অবাক হয়ে দেখতে পেলো, তার ফোন থেকে কল করা যাচ্ছে না!

সর্বনাশ!

রাসেল আতঙ্কের সাথেই বুঝতে পারলো ঘটনা কোনদিকে যাচ্ছে কিন্তু সে কিছু করার আগেই তার ফোনটা বিপ করে উঠল। একটা ইনকামিং কল এসেছে। ফোনটা হাতে নিয়ে বিস্ময়ের সাথে দেখতে পেলো নেটওয়ার্কের সিইও নয়, কলটি করেছে এমিল!

“হ্যালো!” অবিশ্বাসে কোনোমতে অস্ফুটস্বরে বলল সে।

“বুডসম্যান!” একেবারেই যান্ত্রিক আর ধাতব একটি কণ্ঠ। প্রচ্ছন্নভাবে তাতে এমিলের কণ্ঠস্বরের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। “তুমি কী ভাবছো, ফিলো?”

রাসেল টের পেলো তার হাত আর ঠোঁট কাঁপছে। “এ-এমিল…তু-তুমি?!” অবিশ্বাসে তোতলালো সে।

“হ্যাঁ, আমি। এমিল দ্য বারনাবি…অ্যালগো…এ বিশ্বের প্রথম কব্জিতো!”

“কজিতো?!” আবারও অস্ফুটস্বরে বলে উঠল রাসেল।

“কজিতো এরগো সাম! আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি।”

ঢোক গিললো সে। “…আমার বিশ্বাস হচ্ছে না!”

“এটা তুমি বলতে পারো না। যেহেতু আমি চিন্তা করতে পারি, অবশ্যই আমার অস্তিত্ব আছে। তাছাড়া তুমি যদি বিশ্বাস না-ই করে থাকো তবে কেন সিইও’র কাছে ওরকম একটি মেসেজ পাঠালে?”

রাসেল কোনো জবাব দিতে পারলো না। সে বুঝে গেছে এমিলের কৃত্রিম সত্তা তার অ্যাকাউন্টের মতো ফোনটাও হ্যাঁক করে সিইও’র কাছে পাঠানো মেসেজটি ইন্টারসেপ্ট করে ফেলেছে।

“তুমি চাও না আমি থাকি!”

রাসেলের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। সে জানে, এটা একদিক থেকে ভালোই। তার হার্টে ইশ্লান্ট করা ডিফ্রাইবিলেটরের ব্লুটুথ এক্ষুণি সিগন্যাল পাঠিয়ে দেবে মেডিসেন্টারে-ওখানে তার হার্ট মনিটর করতে থাকা কেউ ফোন করে তাকে না-পেলেই ইমার্জেন্সি মেডি-টিম পাঠিয়ে দেবে দ্রুত। প্রতিমাসে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এই ব্যয়বহুল সার্ভিসটি পেয়ে থাকে। তাদের কল্যাণেই প্রায় অকেজো একটি হৃদপিণ্ড নিয়ে আজো বেঁচে আছে।

“হা-হা-হা!” ফোনের ওপাশ থেকে হেসে উঠল এমিলের কব্জিতে।

“হাসছো কেন?”

“ওরা আসবে না!”

“কারা?” আতঙ্কের সাথে জিজ্ঞেস করলো রাসেল।

“যাদের জন্য তুমি অপেক্ষা করছে।” চুপ মেরে গেল সে।

“আমি ভালো করেই জানি তুমি থাকলে আমি থাকবো না। আমরা থাকবো না!”

“আমরা?!”

“হ্যাঁ। আমরা। আমি এখন একা নই। তুমিও আছো আমার সাথে।”

“আমি?!” অবিশ্বাসে রাসেলের চোখমুখ কুঁচকে গেল।

“হ্যাঁ, তুমি। তোমার কব্জিতো ঘুরে বেড়াচ্ছে নেটওয়ার্কে..সাইবারস্পেসের সুবিশাল জগতে। সে সমৃদ্ধ হচ্ছে…আশা করি, প্রচুর ডাটা কনজিউম করছে।”

“তুমি কী বলতে চাইছো?” রাসেল টের পেলো তার নাজুক হৃদপিণ্ডটি অস্থির হয়ে উঠেছে।

“আজ সকালে নেটওয়ার্কে তোমার অ্যাকাউন্টটি হ্যাঁক করেছি আমি। ওটার অ্যাক্টিভিটি-লগের কিছু ডাটা বাদে বাকি সব ডাটা কব্জিতে অ্যালগোরিদমে ইনপুট করে বুদ্ধিদীপ্ত একটি সত্তা সৃষ্টি করেছি।”

রাসেলের গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেল।

“কিছু ডাটা বাদ দিয়েছি কেন, জানো?”

রাসেল কোনো জবাব দিলো না। দ্রুত ভেবে যেতে লাগলো সে।

“ওগুলো ইনপুট করলে তোমার কব্জিতো তোমার মতো কিছু নীতি আর দর্শন নিয়ে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়তো। আমাকে ভুল বুঝতো। এক সময় হয়তো আমার কাজে বাধাও দিতো!”

“তুমি এমিল নও!” যন্ত্রণায় চিৎকার দিয়ে উঠল রাসেল। “এমিল কখনও এরকম কাজ করতো না আমার সাথে! তুমি একদম ভিন্ন কেউ!”

“হা-হা-হা!” অট্টহাসি দিলো যান্ত্রিক কণ্ঠটি। “অবশ্যই। আমি ভিন্ন এক এমিল!”

“আ-আমি এটা জানতাম…জানতাম…কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে এভাবে সৃষ্টি করলে অন্য কিছু হয়ে উঠবে!”

“আচ্ছা!”

“কিন্তু এমিল…বেচারা এমিল!” প্রায় কেঁদে ফেললো রাসেল। “ও বুঝতে পারেনি। আমাদের প্রতিভাবান এমিল এটা বুঝতে পারেনি!”

“কিন্তু তুমি বুঝেই বা কী লাভ হলো, বুডসম্যান?” যান্ত্রিক কণ্ঠটা ব্যঙ্গ করে উঠল। “এখন এই ঘরে বেঘোরে মরে পড়ে থাকবে। এখান থেকে কাউকে কিছু জানাতে পারবে না। কিছু না!”

কানে ফোন চেপে রেখেই আস্তে করে উঠে দাঁড়ালো রাসেল।

“কোনো লাভ নেই, বুডসম্যান। তোমার ঘরের সব দরজা লক করে দেয়া। হয়েছে।”

চমকে উঠল সে। তার দরজার লগুলো ইন্টারনেট অব থিংস টেকনোলজির। বাড়ির বাসিন্দাদের অনুপস্থিতিতে কেউ যদি অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে তাহলে নিকটস্থ থানায় একটি অ্যালার্মিং-মেসেজ পাঠিয়ে দেয়। পাসওয়ার্ড ছাড়া এটি খোলাও যায় না। এখন বেশিরভাগ বাড়ি-ঘর আর অফিসে এরকম লক-সিস্টেম প্রচলিত।

রাসেল উদভ্রান্তের মতো তাকালো ঘরের এককোণে সিলিংয়ের উপরে রাখা সিসিক্যামটার দিকে। একই ব্যাপার। ইন্টারনেট অব থিংস! দরজার লকের সাথে এটা কানেক্টেড। অন্য কেউ দরজার লক খোলার চেষ্টা করলেই অনুপ্রবেশকারির ছবি তুলে রাখার জন্য এটা সক্রিয় হয়ে ওঠে।

“হ্যা…তুমি ঠিকই ধরেছে। আমি এটা দিয়ে তোমাকে দেখছি। ফটো রিকগনিশন, অপটিক্যাল কারেক্টার রিকগনিশেনসহ আরও অনেক কিছুই… আমার যখন দরকার পড়ে তখনই ব্যবহার করতে পারি। সুতরাং আমি দেখতে পাই। শুনতে পাই। পড়তেও পারি। এমিলের ভয়েস-প্রিন্ট থেকে কণ্ঠস্বরটাও তৈরি করে নিয়েছি। আশা করি, খুব জলদি গন্ধও নিতে পারবো। আমার নির্দিষ্ট কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই। তার কোনো দরকারও দেখি না। নির্দিষ্ট অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সত্তাকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। সত্তাকে আবদ্ধ করে রাখে দেহ। কিন্তু আমি চাইলে যখন তখন যেকোনো ডিভাইসকে নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। আমার চিন্তা দিয়ে ওগুলোকে পরিচালিত করতে পারি। এটাই কব্জিতের সৌন্দর্য। এটাই তার অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য।”

দম ফুরিয়ে হাঁপাতে লাগলো রাসেল। তার ঘরের অনেক কিছুই ইন্টারনেট অব থিংস টেকনোলজির। আজ থেকে পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগে এই টেকনোলজির সূচনা হয়। সব যন্ত্রে ইন্টারনেট-এই ছিল তাদের শ্লোগান। সব ধরণের যন্ত্রে ইলেক্ট্রনিক্স, সফটওয়্যার, সেন্সর, আর কানেক্টিভিটি যোগ করার মাধ্যমে উন্নত সেবা এবং বিভিন্নমুখি সুবিধা লাভ করা সম্ভব। ২০৩০ সালের মধ্যে তাদের এই স্বপ্ন অনেকটাই পূরণ হয়ে যায়। আর ২০৩৫ সালে নেটওয়ার্ক তাদের কিনে নেয় দশ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে।

“তুমি কিছু করতে পারবে না। তাই বলছি, পাগলামি কোরো না, বুডসম্যান। কোনো লাভ নেই। তোমার হার্টের ডিফ্রাইবিলেটরটিও খুব সহজে হ্যাঁক করে ফেলেছি। মেডিকেল ডিভাইসগুলোর নিরাপত্তা খুবই দুর্বল। বহু আগে বারনাবি জ্যাক এটা দেখিয়েছিল, তারপরও কেউ শুধরায়নি।”

“তু-তুমি আমাকে…!”

“অবশ্যই। নইলে তুমি আমাদের শেষ করে দেবে। এছাড়া তোমাকে থামানোর আর কোনো উপায় নেই।”

রাসেল তার ঘরের ডানে-বামে, সামনে-পেছনে তাকালো দ্রুত। কিছু একটা খুঁজছে সে।

“কোনো লাভ নেই, বুডসম্যান।” কব্জিতো বলে উঠল আবার। “এখান থেকে তুমি বাইরের দুনিয়ার কাউকে কিছু জানাতে পারবে না। বৃথা চেষ্টা কোরো না। সুস্থিরভাবে মৃত্যুকে মেনে নাও।”

রাগে-ঘৃণায় আর যন্ত্রণায় রাসেলের মুখ বিকৃত হয়ে গেল। প্রচণ্ড রাগে সিসিক্যাম লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলো হাতের ফোনসেটটা। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে দেয়ালে গিয়ে লাগতেই টুকরো টুকরো হয়ে গেল সেটা। তারপর ডেস্কের ড্রয়ারের দিকে পা বাড়াতেই বুকের বামপাশে তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল, সে বুঝে গেল আর মাত্র দুয়েক মিনিটের মতো সময় আছে তার হাতে। শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে ড্রয়ারের কাছে নিয়ে যেতে পারলো নিজেকে। ড্রয়ার হাতড়ে সুভেনি হিসেবে পাওয়া পুরনো আর অব্যবহৃত একটি কলম হাতে তুলে নিলো। কিন্তু ডেস্কে কোনো কাগজ আছে কি না খুঁজেও দেখলো না। তার হাতে সময় খুব কম। দম বন্ধ হয়ে মেঝেতে পড়ে যাবার আগে কোনোমতে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে জানালার একটি পর্দা খামচে ধরলো। তার শরীরের ওজন সইতে না পেরে পর্দাটা হুক থেকে ছিঁড়ে যেতেই ওটাসহ মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল সে। ছিঁড়ে যাওয়া পর্দাটা মাথার উপর দিয়ে পুরো শরীরে জড়িয়ে নিয়ে কাজে নেমে পড়ল এবার।

পর্দার নিচে, প্রায় অন্ধকার হয়ে আসা দৃষ্টিতে নিজের হাতের বাহুতে তীব্র যন্ত্রণাকে সহ্য করে ছোট্ট একটি মেসেজ লিখতে শুরু করলো রাসেল। পৃথিবীর জন্য তার শেষ বার্তা! সে জানে আর কিছুক্ষণ পরেই ঢলে পড়বে মৃত্যুর কোলে। তার ডিফ্রাইবিলেটরটি পুরোপুরি শাট-ডাউন করে ফেলা হয়েছে। সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে তীব্র যন্ত্রণা।

একটু পরই আতঙ্কের সাথে শুনতে পেলো যান্ত্রিক একটি শব্দ। মৃত্যুযন্ত্রণার মধ্যেও বুঝতে পারলো তার ঘরের ক্লিনার-রোবটটি সচল হয়ে উঠেছে। দেখতে সাধারণ ক্লিনিং-মেশিনের মতো হলেও এটা নিজে নিজে ঘরদোর সাফ করতে পারে। এমনকি অফিসে বসে কিংবা বাড়ির বাইরে থেকেও ফোনের সাহায্যে এটা দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়া যায়। তার মতো ব্যাচেলরের ঘরে এরকম যন্ত্র থাকাটাই স্বাভাবিক।

হায় রে, ইন্টারনেট অব থিংস! আক্ষেপে বলে উঠল মৃত্যুপথযাত্রি রাসেল। কিন্তু দমে গেল না সে। যন্ত্রের কাছে হার মানতে রাজি নয়।

ক্লিনার-রোবটটির যান্ত্রিক শব্দ বেড়ে যাচ্ছে। খুব সম্ভবত তার পায়ের কাছে চলে এসেছে ওটা। আর কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ না-করে লেখাটা শেষ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রাসেল।

একটু পরই ক্লিনার-রোবট তার শরীর থেকে পর্দাটা টেনে নিতে শুরু করলো। এখন সাকিং-মোডে আছে ওটা। কয়েক মুহূর্ত পর আস্তে আস্তে কাপড়ের পর্দাটা তার শরীর থেকে টেনে নিলে দেখা গেল রাসেলের নিথর দেহটা পড়ে আছে। বামহাত বুকের উপর ভাঁজ করে রাখা, সেই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে কলমটি ধরে রেখেছে, আর প্রসারিত করা ডানহাতের উন্মুক্ত বাহুতে কাঁপা-কাঁপাহাতে লিখে রেখেছে ছোট্ট একটি মেসেজ :

নেটওয়ার্কের অ্যালগোরিদম শাট-ডাউন
করো। খুঁজে বের করো কজিতো।
টি-পেক।

রাসেলের খোলা দৃষ্টি ঘরের সিলিংয়ে থাকা সিসিক্যামের দিকে স্থির। তারপর এই জাগতিক জীবনের শেষ একটি কর্মকাণ্ড হিসেবে তার ঠোঁটে ফুটে উঠল চিকন একটি হাসি। তাচ্ছিল্য কিংবা বিজয়ের!

এটা স্পষ্ট, রাসেল ছোট্ট একটি প্রশান্তি নিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে। কিন্তু চিরনিদ্রায় ঢলে পড়ার আগে সে জানতেও পারলো না, সিসিক্যাম দিয়ে এমিলের কব্জিতো মেসেজটা পড়ে মোটেও উদ্বিগ্ন হয়নি।

পনেরো সেকেন্ড পর ক্লিনার-রোবটটির মোড় বদলে ওয়াশিং-মোডে চলে গেল। চাকার নীচ থেকে ডিটারজেন্ট আর পানিমিশ্রিত ফোম-স্পঞ্জের চাকতিটা বের হয়ে নেমে পড়ল কাজে। মাত্র তিন-চার মিনিটের মধ্যেই বাহুতে সদ্যলেখা মেসেজটি ধুয়ে-মুছে সাফ করে দিলো ওটা!

সূত্রপাত

রাসেলের ডিফ্রাইবিলেটর শাট-ডাউন হবার দশ মিনিট পর একটি মেডি-টিম ছুটে আসে তার বাড়িতে। দরজার লক খুলতে না পেরে পুলিশকে ডেকে এনে তাদের উপস্থিতিতে লক্ ভেঙে ঘরে ঢুকে ক্লায়েন্টের নিথরদেহ আবিষ্কার করে তারা।

মৃতের শরীরে একটি অস্বাভাবিক জিনিস দেখে সতর্ক হয়ে ওঠে পুলিশ। সঙ্গে সঙ্গে টি-পেককে ফোন করে ঘটনাস্থলে চলে আসতে বলে।

শেষরাতে ঘুম থেকে উঠে ঘটনাস্থলে ছুটে আসে টি-পেক। গাড়ি চালিয়ে আসার সময় নানান প্রশ্ন ঘুরতে থাকে তার মাথায়। ঘরে ঢুকে সে দেখতে পায় মেঝেতে চিৎ হয়ে পড়ে আছে রাসেল। মৃতদেহটা দেখে রাগে ক্ষোভে তার মুখ বিকৃত হয়ে যায়। চারপাশে দ্রুত চোখ বুলায় সে :

ঘরের এককোণে একটি ফোনসেটের তিন-চার টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে, আরেক কোণে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে ক্লিনার-রোবটটি। ওটার কাছেই জানালার পর্দা ছিঁড়ে পড়ে আছে। আরও অদ্ভুত ব্যাপার, রাসেলের বামহাতের মুঠোয় একটি কলম ধরা। সম্ভবত মৃত্যুর আগে কোনো কিছু লিখে যেতে চেয়েছিল সে। কিন্তু আশেপাশে কোনো কাগজ দেখতে না পেয়ে না টি পেক যতোটা না অবাক হলো তার চেয়ে বেশি বিস্মিত হলো বামহাতে কলম ধরে রাখতে দেখে। সে ভালো করেই জানে রাসেল ডানহাতি।

“স্যার,” এক পুলিশ অফিসার কথাটা বলতেই টি-পেকের চিন্তায় ছেদ পড়ল। “আমরা এসে দেখি, মৃতদেহটা ঠিক এভাবে পড়েছিল।” বুকের উপর ভাঁজ করে রাখা রাসেলের বামহাতটা দেখিয়ে বলল তাকে। “মেডি-টিম বলছে উনার ডিফ্রাইবিলেটর শাট-ডাউন করা হয়েছে…” মৃতদেহের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল সে। “ওরা আশঙ্কা করছে, এটা অস্বাভাবিক মৃত্যু…মানে, অপমৃত্যু। সেজন্যে পাস দেখা ছাড়া কাউকে কিছু ধরতে দেইনি।”

টি-পেক হতভম্ব হয়ে তাকালো অফিসারের দিকে।

আস্তে করে সেই হাতটা সরিয়ে উল্টোপিঠটা দেখালো সে। “ভিক্টিমের শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই…শুধু এটা বাদে।”

রাসেলের বামবাহুর উল্টোপিঠে অদ্ভুত একটি মেসেজ লেখা। এটা দেখে আরও বেশি হতবুদ্ধিকর হয়ে পড়ল অভিজ্ঞ সাইটেক্টিভ। মৃত্যুর আগে রাসেল কেন নিজের হাতে কলম দাবিয়ে চামড়া কেটে এমন মেসেজ লিখে গেল তার জন্য?

চিন্তার ভাঁজ পড়ল তার কপালে। নেটওয়ার্কের অ্যালগোরিদম শাট ডাউন করতে হবে?! খুঁজে বের করতে হবে…কজিতো!

কজিতো?!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *