শূন্যস্থান

শূন্যস্থান

সকালে বিছানা ছেড়ে মাটিতে পা রাখতে গিয়ে শিউরে উঠল বিজন। সঙ্গে সঙ্গে পা তুলে নিল। ভাবল মনের ভুল। আসলে এখনও হয়তো স্বপ্ন দেখছে। প্রকৃত ঘুম থেকে ওঠেনি। চোখদুটো চিপে বন্ধ করে আবার খুলল, ইচ্ছে করে কাশল দুবার। স্পষ্ট শুনতে পেল নিজের সর্দিবসা বুকের ঢংঢং কাশির শব্দ। তার মানে সত্যিই সে জেগেছে। আবার নিশ্চিন্তে পা ফেলতে গেল মেঝেতে। একই শিহরন!

পা দিয়ে জোরে চাপ দিতে চেষ্টা করল নীচের দিকে। কিছুতেই হচ্ছে না! হচ্ছেই না! মেঝেতে পা পৌঁছোচ্ছে না কিছুতেই। মাটি থেকে ঠিক ইঞ্চি কয়েক ওপরে গিয়ে আটকে যাচ্ছে। আর একটা পা নামিয়েও দেখল। একইরকম। নিজের শরীরটাও মনে হচ্ছে বিছানার ওপর আলগাভাবে বসানো। কোনও ভয় নেই। এটা কি গতরাতের টিচারসের খোয়ারি?…নাহ, হতেই পারে না, কাল রাতে অনীক ট্রিঙ্কাসে ট্রিট দিয়েছিল। আইটিও, যে মাসে অতিরিক্ত বাঁহাতি হয়ে যায়, সে মাসের শেষের দিকে যেকোনও একদিন কলকাতার এক একটা বারে বন্ধুদের ট্রিট দেয়। কাল রাতে ক’পেগ নিয়েছিল মনে করার চেষ্টা করল বিজন।…উঁহু, চারের বেশি নয়। এটুকু তরল বিজনের পাকস্থলী প্রায় গ্রাহ্যই করে না।

‘ধ্যাস শা-হ যা হয় হবে’ বলে দু-পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। হ্যাঁ দাঁড়াল, তবে মাটিতে নয়, মাটি থেকে ইঞ্চি কয়েক ওপরে বা শূন্যে। আচমকা মাথাটা ঘুরে গেল। বিছানায় বসে পড়ল বিজন। এসব কী! সামনের দিকে তাকালেই দেখল টিভিটা মিউট হয়ে চলছে। তার মানে সারারাত চলেছে। রাত্রে দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়ালই নেই। বালিশের পাশে রাখা রিমোটটা হাতে নিয়ে সুইচ অফ করতে গিয়েও কী খেয়াল হতে চ্যানেল সার্ফ করতে শুরু করল। এমনিই। একটা বাংলা নিউজ চ্যানেলে হঠাৎ চোখ আটকে গেল। গোটা শহর জুড়ে হুলস্থুল কাণ্ড! সমস্ত মানুষ বিজনের মতোই মাটি থেকে ওপরে ভাসছে। কারও পায়ের নীচে মাটি নেই। টিভিতে সাউন্ড দিল। লাইভ বলে নীচে লেখা। রিপোর্টার সাংঘাতিক উত্তেজিত, গলগল করে বলে যাচ্ছে, ‘…এ এক আশ্চর্যজনক ঘটনা, গোটা পৃথিবীজুড়ে মাধ্যাকর্ষণ বল কোনও অজ্ঞাত কারণে হঠাৎ অস্বাভাবিক মাত্রায় কমে গেছে। অবশ্য কমে গেছে বলা ভুল। সমস্ত জড় পদার্থ, উদ্ভিদ এবং অন্যান্য সকল প্রাণীর ক্ষেত্রে একইরকম রয়েছে, শুধু মানুষের ক্ষেত্রে আকর্ষণ প্রায় হারিয়ে ফেলেছে পৃথিবী। এখনও পর্যন্ত এর যথাযথ কারণ…’ টিভি অফ করে দিল বিজন। প্রথমে হাসি পেল তার পরেই তীব্র বিরক্তি। আজকের প্ল্যানটা তার মানে ভোগে! বিষণ্ণ হয়ে উঠল মনটা। ‘শাল্লা, হারামি, ম্যাজিক দেখানোর আর দিন পেলি না’ বলে মেঝেতে জোরে লাথি মারতে গেল। ছিটকে ওপরে উঠে গেল পা। কুঁচকিতে খিঁচ লাগল। কী করা উচিত বিছানা ছুঁয়ে বসে বা বসার মতো হয়ে ভাবল বেশ কিছুক্ষণ।

মাস কয়েক ধরে ফেলে রাখা টোপ যখন আজকের দিনে মাছ সবে গিলতে আসার কথা ছিল সেদিনই। আজ শনিবার, রোজি পাত্রর সঙ্গে গাদিয়াড়া যাওয়ার দিন। বিজন কর্মকার নামকরা এমএনসি-র সিনিয়র সেলস ম্যানেজার। বয়স চৌত্রিশ। গড়িয়াহাটে কোম্পানির দেওয়া বারোশো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে একা। ঠিক একা নয়, রবি নামে একজন কুক কাম সারভেন্ট এবং আলম নামে ড্রাইভার। রোজি পাত্র সেলস এক্সিকিউটিভ। মাস ছয়েক আগে চাকরিতে জয়েন করেছে। বিজনই ইন্টারভিউ নিয়েছিল। বয়স ছাব্বিশ (দেখতে আরও বছর দুয়েক কম মনে হয়), ফিগার, চামড়ার কালার, দাঁত, মাড়ি, হাত, বুক পেট, বগল সব কিছু ঠিকঠাক। রাজি হতে বড্ড বেশি সময় নিয়ে নিল মেয়েটা। এর আগেরজনেরা কেউই এত টাইম নেয়নি। বড়জোর মাস দুয়েক। বিছানায় শুধু একটাই প্রবলেম হয় বিজনের। সবক’টা মেয়েকেই মনে হয় এক। আর নিজেকে প্রত্যেকের সঙ্গে অন্য একজন। মানে এক-একটা মেয়ের সঙ্গে এক-একটা বিজন। এর ফলে একই বিজনের ভ্যারাইটি টেস্ট নেওয়ার অহংকারটা ঠিকমতো হয়ে ওঠে না। এর জন্যে একবার সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাবে ঠিক করেছিল। এখনও হয়ে ওঠেনি।

রোজি শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে। যেভাবে সকলে হয়। কিন্তু বিজনের ফ্ল্যাটে নয়। এ পাড়ায় নাকি ওর কোন রিলেটিভ থাকে। অন্য কোথাও রাজি। সকাল আটটায় রবীন্দ্রসদনের সামনে থেকে ওকে পিক আপ করার কথা। মোবাইলটা সুইচ অন করল বিজন। স্ক্রিনে দুটো হাত পরস্পরকে ছুঁয়ে চালু হল মোবাইল। নাম্বার ডায়াল করার আগে রিমোটে চ্যানেল পালটাল টিভির। একটা ইংলিশ চ্যানেলে দুজন বিশেষজ্ঞ আলোচনায় বসেছেন। ড: রবসন নামে নিগ্রো এক পরিবেশ-বিজ্ঞানী দু-হাত ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘আসলে দূষণ, দূষণ, আমরা বহুদিন ধরে সাবধান করে আসছি মানুষকে। কেউ শোনেনি। এতদিন ধলে জলে, হাওয়ায়, মাটিতে আকাশে বিষ ঢেলে ঢেলে পৃথিবীকে প্রত্যাখ্যান করেছি আমরা। ইট ইজ এ রিভেঞ্জ’। শেষ শব্দটা বেশ প্রিয় বিজনের। রিভেঞ্জ। কেন কে জানে, এমনিই।

ভূ-বিজ্ঞানী (নামের উচ্চারণটা মনে মনে করার আগেই স্ক্রিন থেকে লেখা উঠে গেল) পালটা প্রশ্ন করলেন, ‘রিভেঞ্জ বলছেন কেন। কোনও কারণে পৃথিবী তার মাধ্যাকর্ষণ অনেকটা হারিয়ে ফেলেছে। এটা একটা অ্যাকসিডেন্ট।’

‘বেশ, যদি তা-ই হয় তবে শুধু মানুষের ক্ষেত্রে কেন? গাছ-পশু-পাখি অন্য কোনও কিছুর থেকে তো এতটুকু আকর্ষণ যায়নি।’

‘সেটা হতে পারে মানুষের শারীরিক গঠনের কোনও বিশেষত্বের…’ কচকচি একদম ভালো লাগছে না। টিভি বন্ধ করে দিল বিজন। রোজির ফিগারটা একঝলক চোখের সামনে ভেসে উঠল। নাম্বার ডায়াল করল। কানে কিছুক্ষণ কিশোর কুমারের ‘রিম ঝিম গিরে সাওয়ান’ হওয়ার পর রোজির আরও সুরেলা ‘হ্যাঁ স্যার মর্নিং’।

‘হ্যাঁ মর্নিং, কী নিউজ তোমার?’

‘একইরকম অবস্থা স্যার, কী যে হচ্ছে কিছু মাথায় ঢুকছে না।’

‘যাবে আজকে?’

‘শিওর স্যার। আমার কোনও প্রবলেম নেই, মানে আমি বাড়িতে আজকের জন্য ম্যানেজও…’

‘ওকে ওকে, আমারও কোনও প্রবলেম নেই। দেন ডোন্ট বি লেট।’

‘আচ্ছা স্যার।’ শব্দদুটোয় দুখানা বড় নিশ্বাস ফেলে রাখা ছিল মনে হয় বিজনের। চটপট তৈরি হয়ে নিতে হবে। বাথরুমে ঢুকে কমোডে কিছুক্ষণ বৃথা নিষ্ফল সময় কাটিয়ে ভালো করে দাঁত ব্রাশ, তারপর শাওয়ারের নীচে। আপাদমস্তক অনেকক্ষণ নিজেকে ধুল বিজন। সময়ের পর সময় পার করে চান করতে কী-ই যে ভালো লাগে! মনে হয় কী সব যেন ধুয়ে ধুয়ে যায়। এটাও কি কোনও মনোবিকার? পাক্কা চল্লিশ মিনিট ধরে স্নান সেরে ড্রেস আপ। টেবিলে ব্রেকফাস্ট লাগিয়ে ঘরের কোণে শূন্যে দাঁড়িয়ে ছিল রবি। চোখে-মুখে আতঙ্ক। বিজন ভাসতে ভাসতে টেবিলের সামনে এসে রবিকে হেসে জিগ্যেস করল, ‘কী হল, এত ভয় করছে!’

‘ভগবানের অভিশাপ স্যার, এত পাপ চাদ্দিকে…’

‘আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। সব ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা নেই।’ রবি হাওয়ায় পা ঠেলতে ঠেলতে কিচেনে চলে গেল। স্যান্ডুইচ আর জুস খেয়ে টুকটাক কয়েকটা জিনিস কিটে ভরে নিয়ে নিজের স্যান্ট্রোয় করে পনেরো মিনিটের মধ্যে রবীন্দ্র সদন। আজ আলম নয়, বিজন নিজেই ড্রাইভ করছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা প্রায়। দোকানপাট বেশিরভাগই বন্ধ। সব মানুষ কি আতঙ্কে? মজা লাগল বিজনের। রাস্তায় যে ক’টা লোক দেখল সবাই মাটি থেকে প্রায়ই ইঞ্চি কয়েক উঁচুতে। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ হাঁটছে। ঠিক হাঁটা নয়, হাঁটার মতো করে শরীরটাকে কোনওমতে সামনে ঠেলে নিয়ে যাওয়া। একজন মাঝবয়সি লোক আজকের দিনেও সকালে কুকুরকে হাগাতে বেরিয়েছেন। কুকুরটা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে উপযুক্ত জায়গার জন্য এখান-ওখান গন্ধ শুঁকছে। চারটে পা-ই মাটিতে। মালিকের হাতে চেন। পা দুটো শূন্যে। কুকুরের টানে দমকে দমকে এগিয়ে চলেছেন। বিজনের মনে হল এখন মানুষ অবাক হয় অনেক কম। ভয় পায় বেশি। রবীন্দ্রসদনের সামনে এসি গাড়ি থামাল। সামনে একটা পাগল। মাটিতে বসে চুপচাপ। পাগল কি তাহলে মানুষ নয়, অন্য কিছু! প্রায় ন’টা নাগাদ হাঁপাতে হাঁপাতে রোজি এল। স্লিভলেস রয়্যাল ব্লু ব্লাউজ। ম্যাচিং শাড়ি। এসে বলল, ‘ভেরি সরি স্যার। খুব লেট হয়ে গেল। আসলে আজকে রাস্তার যা অবস্থা, বাস-ট্যাক্সি কিছু নেই।’

বিজন শুধু বলল, ‘লেটস গো।’ গাড়ির সামনের দরজা খুলে বিজনের পাশে এসে বসল রোজি। পরিচিত হালকা পারফিউমের গন্ধে ভরে গেল কাচতোলা স্যান্ট্রো। নীল শাড়ির ফাঁক দিয়ে ফরসা পেটের পাশে ভাঁজ দেখল বিজন। অল্প ঘাম জমে চিকচিক করছে। ওখানটায় একবার ছুঁয়ে আঙুল ভেজাতে ইচ্ছা করল। কিন্তু করল না, আরও জমুক ইচ্ছেটা। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বিজন বলল, ‘আজ অনেক লেট হয়ে গেছে, গাদিয়াড়া গিয়ে কাজ নেই, বরং চলো ডায়মন্ডহারবারটা ঘুরে আসি। কী বলো তুমি?’ রোজি নি:শব্দে ঘাড় নাড়ল। যেন বিজন নিজেকেই প্রশ্নটা করেছিল আর নিজেই রাজি হল। হু-হু চলছিল গাড়ি। গাড়ির ভেতর দুজন মানুষ সিটে আলতোভাবে বসে। রাস্তাঘাট প্রায় বনধের দিনের মতো। কয়েকজন বিক্ষিপ্ত মানুষ আর টুকটাক সামান্য কয়েকটা গাড়ি চলতে দেখল বিজন। একটা জিনিস এতক্ষণে ভালো করে খেয়াল করল ও, সকাল থেকে যে-ক’টা মানুষ দেখেছে কেউই কিন্তু মাটি থেকে সমান উচ্চতার শূন্যে নেই। কেউ একটু বেশি উঁচুতে, কেউ তার চেয়ে একটু কম। যেমন বিজনের চেয়ে রোজি ইঞ্চিখানেক বেশি মাটির কাছাকাছি। এমনটার কারণ বুঝতে পারল না বিজন। অবশ্য আজকের পুরো ঘটনাটার কারণটাই তো এখনও কোনও শালার ঘটে ঢোকেনি। রোজিকে বলল, ‘কী অদ্ভুত দিন না, স্বপ্নেও ভেবেছ কখনও?’

‘না স্যার ভাবিনি’ উত্তরটায় দায়সারা ভাব বেশি। কিন্তু লুকোনো।

‘ডোন্ট সে স্যার, টুডে উই আর পাটর্নার…ইয়ে ফ্রেন্ডস অনলি। ওকে?’

‘ওকে, স্য…’ থেমে গিয়ে অল্প হাসল রোজি। ওর চোখদুটো আজকে ঈষৎ ঘোলাটে, লাল। হেনা করা খোলা লম্বা চুল, মাখন রঙের কাঁধ, তেলতেলে নিটোল হাত দুটো সবই কেমন যেন ক্লান্ত, বিষণ্ণ আর অন্যমনস্ক মনে হয় বিজনের। রোজি বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

‘রোজি।’

খেয়াল করল না।

‘এই-ই’

‘অ্যাঁ-হ’

‘আরে এত স্টিফ হয়ে আছ কেন? রিল্যাক্স।’

‘না-না, আমি ঠিক আছি।’

‘অ্যান্ড হাউ ইজ ইয়োর চাইল্ড,…কী নাম যেন?’

‘শিবাঙ্গী।’

‘একেক বারে কতটা করে ব্লাড লাগে তোমার মেয়ের?’

‘তিন-চার ইউনিট। সামনের মাসে ডেট পড়েছে।’ কালেক্ট করা এত কঠিন, ব্ল্যাক ছাড়া পাওয়াই যায় না। তার ওপর নার্সিংহোম-মেডিসিন…এত খরচ…কী করে যে…’ গলগল করে বলে বিজনের দিকে তাকাল রোজি।

হাসল বিজন। বলল, ‘বিজন কর্মকার কিছু ভোলে না। ইয়োর অ্যাডভান্স উইল বি অ্যাট ইয়োর ডেস্ক ইন টাইম।…অ্যান্ড ইট মাইট বি নন রিফান্ডেব্যল’।

‘থ্যাঙ্ক উই স্যার, ওহ সরি ফর দ্য স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ। সো কাইন্ড অফ…’

হাত তুলে থামাল ওকে বিজন। ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ শব্দটায় তেতো ভাব ছিল, ভালো লাগল না। নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছিল। এই ফালতু প্রসঙ্গটা এখন না টানলেই হত। অবশ্য ফালতু নয়, বরং ওই কারণের জন্যই আজ রোজি পাত্রর মতো ‘সন্দরী ফরসা স্লিম প্রকৃত ঘরোয়া পাত্রী’ বিজন কর্মকারের সঙ্গে একই গাড়িতে ডায়মন্ডহারবার যাচ্ছে। রোজির দু-বছরের মেয়ের মেজর থ্যালাসিমিয়া। কয়েক মাস অন্তর ব্লাড চেঞ্জ করতে হয়। ওর হাজব্যান্ড কী এক লেদার কোম্পানির অ্যাকাউন্ট্যান্ট। শাললা এসব পাতি ফেকু লোকগুলোর আচমকা কী করে এমন সুন্দর বউ জুটে যায় কিছুতেই মাথায় ঢোকে না। এ এক অদ্ভুত রহস্য! রোজির কাছে শুনেছে লাভ ম্যারেজও নয়। ঢপ ঝেড়েছে কি না অবশ্য জানা নেই। মেয়ের ট্রিটমেন্টের খরচ আর একার রোজগারে কুলোচ্ছে না, সুতরাং ঘরের বউকে মার্কেটে চাকরি করতে পাঠিয়েছে। এবার মর শালা। রোজি এসেছিল মৃণালের রেফারেন্স নিয়ে। বিজনের বন্ধু, আবার ওদিকে রোজির বরেরও পরিচিত। বিজনকে ফোন করে বলেছিল, ‘পাঠাচ্ছি একটু দেখিস। এক্সপিরিয়েন্স নেই। তোর কাছে থাকলে অবশ্য…’ সেই এক্সপিরিয়েন্সই তো করাচ্ছে বিজন। কাজের, জীবনের। আর একবার রাগ হল রোজির বোগাস হ্যাজব্যান্ডটার জন্য। পকেটের উপযুক্ত ওজন না থাকলে কীভাবে দুটো একসঙ্গে থাকার মানুষ একা হয়ে যায়…অবশ্য সবাই যে এই কারণে তা তো নয়। সোনালির বর যে বিজন কর্মকার ছিল সে তো কম টাকা রোজগার করত না। এরকম পাঁচটা থ্যালাসেমিয়ার পেশেন্টের জন্য খরচ করলেও প্রতি মাসে ঝুড়ি উপচে থাকত। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ছিল সোনালি। অসম্ভব ওপরে ওঠার ইচ্ছে নিয়ে জন্মেছিল মেয়েটা। চাকরি করত। উঁচু চাকরি। বিজনের মতোই।

রূপ-মেধা কেউ কারও চেয়ে কম ছিল না ওর মধ্যে। বিয়ের বছর দুয়েক পরেও ইস্যু চায়নি কেউ। তারপর বিজনের ইচ্ছা হল। সোনালির সঙ্গে সঙ্গে উত্তর, ‘এখন! তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

‘তাহলে কবে? আমরা ইমপোটেন্ট হয়ে যাওয়ার পর?’

‘আগে কেরিয়ার ঠিক হোক। ওসব পরে ভাবা যাবে।’

জীবন আর কেরিয়ার যে বিপরীত শব্দ সেদিন বুঝেছিল বিজন। সোনালি পিল ইউজ করতে চাইত না। বিজনকে প্রাোটেকশন নিয়ে হত সব সময়। খাটে ম্যাট্রেসের নীচে রাখা থাকত প্যাকেট। এক রাতে ঠিক ওই মুহূর্তটায় ম্যাট্রেসের তলায় হাতড়ে বিজন বুঝল প্যাকেট খালি। প্রাোটেকশন নেওয়ার নিপুণ অভিনয় করে সেদিন সোনালিকে ঠকিয়ে দিয়েছিল ও। মাস কয়েক পরেই অ্যাবরশন।

‘ইউ চিট, লায়ার, ইরেসপনসিবল, তুমি ইচ্ছে করে।…আমি জানি, সব বুঝি।’

‘কিচ্ছু বোঝো না তুমি, নিজের কেরিয়ার ছাড়া।’

‘ওটাই সব।’

‘হ্যাঁ একদিন ওটাই তোমাকে শব বানাবে।’

এর পরেও মাঝেমধ্যে বিছানায় দেখা হত শরীরে শরীরে। সোনালি ওই অবস্থাতেও মাথা তুলে দেখে নিত সত্যি সত্যি গার্ড নিচ্ছে কি না। কাজ কাজ—অফিস ছাড়া আর কিছু জানত না মেয়েটা। অফিসে ঢুকলে রাত্রে বাড়ি ফেরার ঠিক থাকত না এক-একদিন। চড়চড় করে ওপরে উঠেছিল। একদিন আচমকা বলল, ‘গুগুলস সফটওয়্যার থেকে অফার পেয়েছি।’

‘ভালো, কোথায় অফিসটা?’

‘ক্যালিফোর্নিয়া’। এমনভাবে বলল যেন শ্যামবাজার।

‘ও, তা কী করবে?’

‘ভাবছি। অবশ্য এখানেও ব্রাঞ্চ অফিস রয়েছে, শুধু প্রথমে বছরখানেক ওখানে ট্রেনিংয়ে থাকতে হবে। যা প্যাকেজ না, শুনলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে।’ নিজের মনেই আনন্দে গড়গড় করে বলে যাচ্ছিল সোনালি। ভাবছি বলেছিল কিন্তু ভাবেনি, একদিন পরেই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছিল নিজের। এক বছর না। বেশ কয়েকটা বছর পার। হয়তো ওখানেই সেটল করে যাবে। ওখানে যেতে হলে কোন মহাসাগর যেন পার হতে হয়? প্রথমদিকে সপ্তাহে দিন দুয়েক করে ফোন, তারপর পনেরো দিনে…স্রেফ সৌজন্যমূলক… মাসে…আচ্ছা ও কি ওখানে এখনও একাই থাকে? মোটেই নয়। নিশ্চয় কোনও পার্টনার জুটে গেছে এতদিনে।…শা-হ-হ। ও-ও এখন ভাসছে নিশ্চয়। কতটা শূন্যে?…ধু-স এসব ভাবতে ভালো লাগছে না। পাশের মেয়েটা তো সিটে হেলান দিয়ে রাখা পাথরের মূর্তি। এফ এম চালাল বিজন, ‘আজ দেশের সমস্ত অফিস, স্কুল, কলেজ…’ চ্যানেল পালটে ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল…’ ধ্যাৎ শালা, কিছু ভালো লাগছে না। বন্ধ করে দিল। ভাঙুক চুরুক…সব চুরমার, তছনছ হয়ে যাক, কিস্যু এসে যায় না বিজনের। আজ শুধু রোজি পাত্রকে চাই। চাই-ই। ভীষণভাবে। গাড়ি অনেকক্ষণ ডায়মন্ডহারবার রোড ধরে নিয়েছে। কোন হোটেলে উঠবে মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে বিজন। ‘রূপসী বাংলা’য় আগেও একবার, কী যেন নাম মেয়েটার…ওহ শ্বেতা, কায়দা করে নাম বলত সোয়েতা, ওর সঙ্গে উঠেছিল ওখানে। ব্যবস্থা ভালোই। সেফ।

‘ব্রেকফাস্ট করেছ কি না জিগ্যেস করতে ভুলেই গেছি।’

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ।’

‘কী খেয়েছ?’

‘চা-বিস্কুট।’

‘এটা ব্রেকফাস্ট হল! এতক্ষণে তো খিদে পেয়ে যাওয়ার কথা, কিছু খাবে?’

‘উঁহু।’

‘জল?’

‘উহুঁ।’

মেয়েটা কি বিজনের কথা আদৌ মন দিয়ে শুনছে না। আন্দাজে ঠেকা দেওয়া উত্তর মেরে যাচ্ছে। কার কথা ভাবছে এখন? নিজের মেয়ে না মেয়ের বাপকে নিয়ে?

‘কী ভাবছ কী অত?’ মৃদু ধমক লাগল বিজন।

‘নাহ কিছু…কিছু না’ দাঁত বার করল রোজি। ওপরের পাটির ডান দিকে একটা গজদাঁত। হাসলে সুন্দর লাগে। ‘আসলে মেয়েটার পরশু থেকে জ্বরজ্বর মতো হয়েছে।’

‘ও’, বলে সোজা সামনের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল বিজন।

বিজনের মৃদু বিরক্তিটা বোধহয় রোজি ধরতে পেরে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘তেমন কিছু নয়। আসলে প্রত্যেকবারই ডেট এগিয়ে আসার ক’দিন আগে থেকে এইরকম হয়। ওর বাবা আছে। ঠিক সামলে নেবে।’

‘ডায়মন্ডহারবার গেছ কখনও আগে?’

‘না। শুনেছি খুব সুন্দর। সত্যি?’

‘চলো, আর একটু পরে নিজেই দেখতে পাবে।’

‘আপনি অনেক জায়গায় বেড়াতে গেছেন, না?’

বিজন সামান্য গর্বিত হেসে বলল, ‘কাজটাই তো এমন, যে আসমুদ্রহিমাচল পাক খেতে হয়। অফিসে দেখই তো, ক’দিনই বা চেয়ারে বসি। তুমিও সিনিয়র হলে ইন ফিউচার আমার মতোই করতে হবে।’

‘আপনি কিন্তু একটু বেশি প্রেশার নেন।’

‘ও ঠিক আছে। একা মানুষ। ঘরে কাজকম্ম তো কিছু নেই। অফিসই সব।’

উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল রোজি। বলল না, থেমে গেল। এক্সপ্রেশনটা খেয়াল করল বিজন। রাস্তার মোড়ে একটা রিকশাস্ট্যান্ড। সবক’টা রিকশা লাইন দিয়ে দাঁড় করানো। আজ রাস্তায় কোনও হাতেটানা রিকশা নেই। শূন্যে পা দিয়ে রিকশা টানা যায় না। রোজি থাকে পাইকপাড়ায়। বিজন জিগ্যেস করল, ‘বাড়ি থেকে ক’টায় বেরিয়েছিলে আজকে?’

রোজি প্রশ্নটা শুনে প্রথমে কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তারপর বেশ অপ্রস্তুতের মতো বলল, ‘আমিই…মানে আসলে ঠিক বাড়ি থেকে আসিনি এখন।’ ভুরুতে সামান্য প্রশ্ন রেখে ওর দিকে তাকাল।

‘…মানে…এত সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়াটা…কাল বিকেলে ভবানীপুরে আমার এক বন্ধুর বাড়ি চলে গেছিলাম। আজকে ওখান থেকেই…।’

বিজন বুঝল। বাড়ি থেকে এত সকালে বেরোতে হলে দুনিয়ার মিথ্যে, কৈফিয়ত, সন্দেহও হতে পারে। সুতরাং বন্ধুর বাড়ি এক দিনের জন্য বেড়াতে যাওয়া। মিথ্যে, বেশ কথা, বিজনও তো বন্ধু। বন্ধুই তো আদর করে, খাওয়ায়, গাড়ি করে ঘোরায়। ওর ক্যালানে বর এসব পারবে? কাজ হয়ে যাওয়ার পর রোজির হাতেও মেয়ের ট্রিটমেন্টের জন্য কিছু দিয়ে দেবে ভেবে রেখেছে বিজন। ডাইরেক্ট হয়তো নিতে চাইবে না। সেন্টুতে লাগতে পারে। বলতে হবে এটা কোম্পানির থেকে দেওয়া হচ্ছে। বিজনেস প্রমোশন এক্সপেনডিচার।

‘প্রায় এসে পড়েছি। আর কিছুক্ষণ।’ বলে রোজির দিকে তাকাল। নীল শাড়ির আঁচলটা আজকে যেন একটু বেশি করে বুকের সামনে জড়িয়ে রেখেছে মেয়েটা। কী লাভ? সেই তো…। মিনিট পনেরোর মধ্যে বিশাল…বিশাল চওড়া আদিগন্ত বিস্তৃত গঙ্গার ধারে ‘রূপসী বাংলা’র ভেতর ঢুকিয়ে দিল গাড়ি।

রোজি বলল, ‘গঙ্গা এত বড়, এত চওড়া। আমি ভাবতেই পারিনি।’ গলার বিস্ময়টা সত্যি কি না বোঝার জন্য বিজন জিগ্যেস করল, ‘ভালো?’

‘দারুণ।’ শুনেও সন্দেহটা পুরোপুরি গেল না। বিজন চাইছিল মেয়েটা মনেপ্রাণে তরতাজা টাটকা হয়ে উঠুক। মনে খিট থাকলে ওই সময়টায় ঠিক ততটা জমে না। এর আগে দু-একটা মেয়ে বিছানায় বার বার এত অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, ভীষণ বিরক্ত লাগে তখন। একজনকে তো পরে কী একটা কারণে স্যাক পর্যন্ত করে দিয়েছিল রাগে।

গাড়ির দরজা খুলে শূন্যে সাঁতরানোর ভঙ্গিতে হোটেলে উঠল দুজনে। রিসেপশনে লোক নেই। ডাকাডাকির পর এল। একই অবস্থা। আজ সমস্ত মানুষদের সাঁতার কাটার দিন। সুইমিং ডে। আর গোটা পৃথিবী শূন্যে ভরা সুইমিংপুল। রিসেপশনিস্ট লোকটা কয়েক মুহূর্ত হাঁ করে তাকিয়ে থাকল ওদের দিকে। আজকের দিনেও! ওরা ঠিক বুঝতে পারে কারা স্বামী-স্ত্রী আর কারা ইয়ে। রেজিস্টারে দুটো অদ্ভুত নাম আর হ্যাজব্যান্ড-ওয়াইফ বলে একটা অদ্ভুত রিলেশন লিখে দিয়ে দোতলার দুশো পাঁচ নম্বর রুম।

ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেই বিজনের একবার জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করল ভীষণ। আবার আটকাল নিজেকে। আর একটু, আর একটু সবুর। এখনও পর্যন্ত এতটা রাস্তায় অঙুলে আঙুল পর্যন্ত ঠেকায়নি। মেয়েছেলে, হল খবরের কাগজ। শালা, ছোঁওয়া মাত্র বাসি। বিজন বলল, ‘তুমি আগে টয়লেটে যাও। ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি ব্রেকফাস্ট বলে দিচ্ছি।’ বলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নয়তো শুধু একটু চা আর বিস্কিট বলি, বেলা হয়ে গেছে। একটু পরে লাঞ্চই বলে দেব, কী বলো?’

উত্তরে সেই একইরকম ঘাড় কাত করে নিজের ব্যাগ খুলে সালোয়ার বার করে টয়লেটে ঢুকে গেল রোজি। মাইরি এ মেয়ের সঙ্গে জমবে তো! যা রেটে লেতিয়ে রয়েছে, না ডোবায়। আজকের দিনটাই ফালতু। অফিসে তো মেয়েটা দিব্যি দিলখুশ থাকে। তবে হয়তো লাইফে প্রথম বার বলে ঘাবড়ে রয়েছে। সেই কেস হলে টেনশনের কিছু নেই। রাত্রে দু-পেগ গলায় ঢেলে দিলে সব ফিট হয়ে যাবে। সাদা ধবধবে চাদর পাতা বিছানায় বসল বিজন। সিগারেট ধরাল। শরীরটা হালকা হয়ে রয়েছে বলে বিছানার গদিটা কত নরম বুঝতে পারল না। সোনালি কতটা উঁচুতে ভাসছে? বিজনের চেয়েও ওপরে কি?…ভাসুক। ভাসতে ভাসতে ফানুসের মতো আকাশে উড়ে যাক। ওপরে উঠতেই তো চেয়েছিল সে। সবচেয়ে ওপরে…। একটা খিস্তি দিল। তারপর বেডসাইড টেবিলের ওপর রাখা রিমোটটা হাতে নিয়ে অন্যমনস্কের মতো টিভিটা চালাল।

বাংলা সিরিয়াল হচ্ছে। একা মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি থেকে কী কারণে দূর করে দেওয়া হয়েছে বলে উৎকট নেকু নেকু ভাবে কাঁদছে সে। চ্যানেল পালটাল। নিউজ। আর ভালো লাগছে না, সকাল থেকে শুধু এক গল্প। এক-একটা চ্যানেল এক-এক স্টাইলে স্টোরি কভার করছে। কোথাও লাইভ টেলিকাস্ট। বড়বাজারে মুটেদের ইন্টারভিউ। একটা মুটে বলছে, ‘অগর কাল ভি অ্যায়সা চলা তো ভুখা মর যায়েঙ্গে হামলোগ। জমিন পর প্যায়ের ন রাখ সকে তো মাল ক্যায়সে টানেঙ্গে।’ মাঝখানে অ্যাডভারটাইজ। সাবান, টুথপেস্ট, মোটরবাইক। আর একটা চ্যানেল। সেখানেও মিটিং গোছের। পালটাতে গিয়ে কী একটা শব্দ শুনতে পেয়ে গিয়ে থমকে গেল বিজন। একজন লোকের ইন্টারভিউ নেওয়া হচ্ছে। স্টুডিয়োতে। কোনও বিশেষজ্ঞ হবেন বোধহয়। প্রশ্নকর্তা তাকে বললেন, ‘যেখানে চাঁদে মাধ্যাকর্ষণ বা g-এর মান ছয়ভাগের একভাগ, মানুষ ওখানে গেলে মাটিতে মিনিমাম নিজের পা-টুকু রাখাতে বা ছোঁওয়াতে পারে, সেখানে খোদ পৃথিবীতেই দুর্ভাগ্যবশত শুধু মানুষের ওপরে g-এর মান কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় কুড়ি ভাগের এক ভাগ মাত্র। মানুষ শূন্যে ভাসছে। এর পিছনে বিভিন্ন সম্ভাব্য কারণের কথা তবু আমরা শুনছি। কিন্তু আপনি আমাকে বলুন এই যে একজন মানুষ আরেকটা মানুষকে কিছুতেই ছুঁতে পারছে না, স্পর্শ করতে গেলেই দুটো চুম্বকের সমমেরুর মতো পরস্পরের তীব্র বিকর্ষণ ঘটছে এর কী কারণ থাকতে পারে বলে আপনার মনে হয়?’ বিশেষজ্ঞ কিছুক্ষণ মুখ বেঁকিয়ে নিজের দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে উত্তরটা ঠিক করে নিলেন, তারপর বললেন, ‘দেখুন, প্রথম ঘটনাটাই এমন অদ্ভুত, এবং একই সঙ্গে আকস্মিক যে তার আসল কারণ কী সেটা এখনও পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারা যায়নি। আমার যেটা ধারণা যে, পৃথিবীর কেন্দ্রের কোনও অজ্ঞাত গোলযোগের কারণেই তার গ্র্যাভিটি মানুষের ওপর প্রায় কাজ করছে না এবং এর ফলেই আমার মনে হচ্ছে মানুষের নিজস্ব আকর্ষণ ক্ষমতাও ডি-অ্যাকটিভেট হয়ে গেছে। আফটার অল…অ্যা…পৃথিবীই তো সব কিছু। মানে এমন অবস্থা, মানুষের বর্জ্য পর্যন্ত মাটিতে পড়ছে না। এ সত্যিই এক বিস্ময়!’ নিজের উত্তরে বেশ খুশি বিশেষজ্ঞ।

‘হ্যাঁ, সেকথা বুঝলাম। কিন্তু মানুষে মানুষে আকর্ষণ না থাক। ছুঁতে গেলে এত তীব্র বিকর্ষণ কেন। এ তো বিপরীত বল কাজ করছে। এই যে আমি আপনাকে ছুঁতে যাচ্ছি।’ বলতে বলতে প্রশ্নকর্তা ডেমো দেওয়ার ভঙ্গিতে ওই ভদ্রলোকের হাতের দিকে নিজের হাতটা বাড়াল। ঠিক ইঞ্চিখানেক আগেই ছিটকে সরে গেল ওর হাতটা। যেন ইলেকট্রিক শক খেয়েছে। ‘কেন এমনটি হচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?’

লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে স্টুডিয়োতে। উত্তরদাতাকে বাঁচিয়ে দিয়ে তক্ষুনি একটা ফোন এল ‘হ্যালো আমি সিউড়ি থেকে কোঁ…ওঁ…ওঁ…’

‘আপনি টিভির ভল্যুমটা…’

শুনে শিউরে উঠল বিজন। টিভি অফ করে দিল। মানে! কপালের দু-পাশের রগ দপদপ করছে। কোনওমতে বাথরুমের কাছে গিয়ে দরজায় দমাদম ধাক্কা দিতে থাকল। ‘রোজি-রোজি’। ভেতরে কল থেকে জল পড়ছিল। জলের শব্দ বন্ধ হল। ‘কী হয়েছে?’ ভেতর থেকে জিগ্যেস করল রোজি।

‘দরজা খোলো এক্ষুনি…তাড়াতাড়ি…’

‘জাস্ট এ মিনিট’, মিনিটখানেকের মধ্যেই দরজা খুলল রোজি। গোটা শরীর সপসপে ভিজে। গায়ে শাড়িটা কোনওমতে জড়ানো। বিজন আচমকা প্রচণ্ডভাবে জড়িয়ে ধরতে গেল রোজিকে। আর তক্ষুনি ফুটখানেক দূরে ছিটকে সরে গেল। অবাক হয়ে গেছে রোজিও।

‘এ কী হচ্ছে এসব?’ আহত বাঘের মতো তীব্র আক্রোশে বিজন বার বার ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করছিল মেয়েটার শরীরের ওপর আর কে যেন প্রতি বারেই ঠিক ইঞ্চিখানেক দূর থেকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিচ্ছিল ওকে। রোজিও হাত বাড়িয়ে ধরতে গেল বিজনকে। পিছলে সরে গেল হাত। আবার…আবার। দাঁতে দাঁত ঘষছিল বিজন। মুখে ফেনা জমে উঠছিল। থু: করে একদলা থুতু ফেলল। থুতুটা মাটিতে পড়ল না। বিচ্ছিরি নোংরা সুতোর মতো সরু হয়ে ভাসতে থাকল শূন্যে…

‘হা-রা-ম-জাদি তুই—তুই জানতিস না? বল জানতিস না?’ রোজির দিকে আঙুল তুলে গর্জে উঠল বিজন।

‘বিশ্বাস করুন…আমি…আমি সত্যি কিছু জানি না…আমি’ হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল রোজি।

‘আ-আ-হ-হ’, বিকৃত জান্তব চিৎকার করে উঠল বিজন। টলতে টলতে ভাসতে ভাসতে বিছানার কাছে গেল। নিজের ব্যাগটা খুলে ভদকার বোতল বার করে কোত কোত করে তিন-চার ঢোক খেয়ে ‘ধ্যাস শা-হ’ বলে ছুঁড়ে মারল বোতলটা মেঝেতে। ভেঙে চুরমার হয়ে কাচের টুকরো ছড়িয়ে পড়ল ঘরময়। টয়লেটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থিরথির করে আতঙ্কে কাঁপছে রোজি। অনেক—অনেকক্ষণ দু-হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে ঘাড় ঝুঁকিয়ে বসে রইল বিজন। গোটা শরীর তেল উপচে ওঠা জ্বলন্ত আগুনটা। মাথা তুলে তাকাল রোজির দিকে। মেয়েটা এখনও ভিজে কাপড় গায়ে জড়িয়ে বিস্ফারিত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দু-চোখে ভরতি অদ্ভুত এক ভয়। আরাম লাগল দেখে। বিমর্ষ হয়ে উঠল বিজন।

বলল, ‘ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার কী হয়েছে, এখানে বসো।…এসো।’ মেঝেতে ছড়ানো কাচের টুকরোর একটু ওপর দিয়ে নিজেকে ঠেলতে ঠেলতে বিজনের এক ফুট দূরে বিছানায় এসে জড়সড় হয়ে বসল। এখনও ফোঁপাচ্ছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে শুধু শাড়িতে ঢাকা বাঁধনছাড়া দুটো বুক। ‘ডোন্ট ক্রাই। ফর গড সেক প্লিজ ডোন্ট ক্রাই। জাস্ট টেল মি এ সিঙ্গল ট্রুথ। তুই কি সত্যি জানতে না?’ কথাগুলো দাঁতের অল্প ফাঁক দিয়ে চিপে চিপে বলল বিজন। মাথা নীচু করে ফেলল রোজি। কোনও উত্তর দিল না, শুধু বুকের ওঠানামা বেড়ে গেল। আবার মাথাটা গরম হয়ে গেল বিজনের। ‘স্পিক আউট…কেন বলনি আমায়…কি ভেবেছ এক দিনে পার পেয়ে যাবে? ইউ চিট, লায়ার।…’ শব্দ দুটো ঠিক এভাবেই বলেছিল না সোনালি, হঠাৎ মনে এল বিজনের। ওর চিৎকারে চমকে উঠল মেয়েটা।

‘বিশ্বাস করুন আমি চাইনি…আমি আসলে…আমি আবার আসব যেদিন খুশি যেখানে আপনি বলবেন;’

‘আহ জাস্ট শাট আপ।’ বলে পায়ের কাছে পড়ে থাকা ভাঙা বোতলের একটুকরো কাচ হাতে তুলে টুকরোটা প্রাণপণে শক্ত করে চেপে ধরে সামনের দেওয়ালে প্রচণ্ডভাবে ছুঁড়ে মারল বিজন; তারপর বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে নিজের দু-হাত পিছনে রেখে পিঠ হেলিয়ে বসে থাকল।

‘ও কী?’ আচমকা চিৎকার করে উঠল রোজি।

‘কীই!’ ভুরু কুঁচকে তাকাল বিজন।

রোজির প্রায় বেরিয়ে আসা চোখদুটো বিজনের হাতের দিকে। ‘কী হয়েছে’ বলে নিজের হাতের দিকে তাকাল বিজন। কাচের টুকরো ছোঁড়া, হাতটার তালু কেটে গিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। যন্ত্রণা বোধ হচ্ছে না।

‘কী হবে…ওমা আমি কী করব…কী করব’ হঠাৎ যেন পাগলের মতো হয়ে উঠল মেয়েটা।

‘আরে বাবা অত বাড়াবাড়ির কিছু নেই, রিসেপশনে ফোন করে কিছু একটা যাস্ট এইড পাঠিয়ে দিতে বলো’ সামান্য বিরক্তি রেখেই কথাটা বলল বিজন। তার পর বলল ‘আমার পেইন হচ্ছে না।’

‘না—না—ইশ…নষ্ট হচ্ছে…সব পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কী হবে…কী হবে এখন।’

হাত বাড়িয়ে—বিজনের কেটে যাওয়া তালুটা ধরতে গেল রোজি। তার আগেই হাত সরিয়ে নিল বিজন। ‘আরে বলছি তেমন কিছু নয়, তোমাকে যেটা করতে বললাম করো।’ আঙুল চুঁইয়ে টপটপ করে রক্ত ঝরে ভেসে যাচ্ছে সাদা চাদরের বিছানা।

‘আমি—আমি’ কোনও কথাই কানে ঢুকছিল না রোজির।…’স্যার প্লিজ স্যার নষ্ট করবেন না…ভীষণ দাম…স্যার ব্ল্যাক ছাড়া…এই ইউনিট…’ উন্মাদের মতো এলোমেলোভাবে বকে যাচ্ছিল মেয়েটা। ‘একটা কিছুতে…একটা’ বলতে বলতে হঠাৎ সাইড টেবিলে রাখা জলের জাগটার সব জল উপুড় করে মেঝেতে ঢেলে দিয়ে জাগটা বিছানার ওপর রেখে বলল, ‘এর ভেতরে হাতটা রাখুন…রাখুন, ইস…সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, রাখুন।’ ঘরের মধ্যে এলোপাথাড়ি ছুটোছুটি করছিল, অবাক হয়ে তাকিয়েছিল বিজন রোজির দিকে। বুকের আঁচল মাটিতে লুটোচ্ছে। ফর্সা ফুলোফুলো এতদিনের কাঙ্খিত খোলা বুকদুটোর দিকে কেন কে জানে একটুও তাকাতে ইচ্ছে করছিল না বিজনের। এমনিই। রোজি ফোনের রিসিভারটা তুলে নিয়ে ‘কত নম্বর অ্যাঁ কত’ বলেই ওটা ফেলে নিয়ে নিজের ছোট ব্যাগটা খুলে উপুড় করে সব কিছু ঢেলে দিল বিছানায়। কিছু একটা খুঁজে পাওয়ার পরে মেঝেতে খাবলে ঘাঁটতে থাকল জিনিসগুলো। হঠাৎ আবার সেই সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে মেঝেতে পা ফেলতে যাওয়ার সময়ের মতো শিউরে উঠল বিজন। রোজির পা-দুটো প্রায় মাটিতে ছুঁয়েছে। তাতে একটুও খেয়াল নেই ওর।

‘কী হচ্ছে কী, পাগলামো, থামো’ মৃদু ধমক দিল বিজন। থমকে গেল মেয়েটা। ‘এদিকে এসে চুপ করে বসো আমার কাছে। ঠিক করো শাড়িটা। দেখছি।’ বলে নিজের পকেট থেকে রুমাল বার করে তালুতে জড়িয়ে উঠে দাঁড়াল।

বিজনের সামনে বসে রোজি ঘোরের মধ্যে রক্তে ভিজে ওঠা লাল বিছানাটার দিকে তাকিয়ে নিজের মনে বিড়বিড় করতে থাকল ‘সব নষ্ট, ইস…এতটা…জাগটার এতটা ভর্তি…? ভর্তি! এক ইউনিট?…’

বিজন বেশ কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল রোজির দিকে। তাকিয়ে থাকল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘ডোন্ট বি টেনস। এই তো ব্লিডিং বন্ধ হয়ে এসেছে।’ বলে একটু থেমে নিয়ে বলল, ‘খুব খিদে পেয়ে গেছে, এখানে লাঞ্চটা সেরেই যদি বেরিয়ে পড়া যায় তাহলে সন্ধের মধ্যে পাইকপাড়া পৌঁছে যাবে। তোমার হাজব্যান্ড একবেলার জন্য মেয়েকে আই মিন শিবাঙ্গীকে সামলে নিতে পারবে তো, না কি?’ বলতে বলতে বেখেয়ালেই হাতটা বাড়িয়ে দিল রোজির দিকে। আর কী আশ্চর্য, লাল হয়ে ভিজে ওঠা উষ্ণ হাতটা বড় সহজে শান্তভাবে ছুঁয়ে ফেলল রোজির কাঁধ। ‘যাও যাও ফ্রেশ হয়ে নাও’ বলতে বলতেই বিজন বুঝতে পারছিল ও একটু একটু করে শূন্য থেকে মেঝের দিকে নামছে। মাটি ছোঁওয়া পর্যন্ত।

উদিতা

অক্টোবর ২০০৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *