ডানা
‘গত জানুয়ারিতে এবারের থেকে আরও বেশি ঠান্ডা ছিল, না?’ জিগ্যেস করল অনুষ্কা। নিজের হাতের তালুদুটো খুব করে ঘষে নিয়ে কৃষ্ণেন্দু সিগারেট বার করে ঠোঁটে নিল। দেশলাই জ্বালাতে গিয়ে দু-তিনবার ফসকাল। ঠান্ডায় ওর আঙুলগুলো কাঁপছে তিরতির করে। চোয়ালের অবস্থাও তাই। সিগারেটে আগুন দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘কী বলছ গো! আমার তো আগের বারের চেয়ে এবার আরও বেশি ঠান্ডা মনে হচ্ছে। হ্যান্ড গ্ল্যাভস দুটো কেন যে আনলাম না।’
‘ধুস! গতবার মনে আছে প্রায় হাঁটু অব্দি বরফ হয়ে গিয়েছিল হোটেলের সামনে। সারারাত স্নো ফল হল মনে নেই? এবার তো বরফই নেই।’
‘আরে ম্যাডাম বরফ পড়লে ঠান্ডা একটু কম হয় জানো না? বরং এই হাড়ে খটখটি লাগিয়ে দেওয়া হাওয়াটাই অবস্থা টাইট করে দেয়।’ গায়ে চাপানো দুটো সোয়েটারের ওপর লেদার জ্যাকেট, কানঢাকা ক্যাপ, গলায় প্যাঁচানো মাফলার—এসব কিছুর পরেও ঠকঠক করে কাঁপছে কৃষ্ণেন্দু।
‘তুমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছ।’ বলে হি হি করে হাসল অনুষ্কা! মুখ থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ভোর হচ্ছে সান্দাকফুতে। ওরা দুজন সূর্যোদয়ের জন্য দাঁড়িয়ে। ওদের মতো আরও বেশি কিছু উৎসাহী চোখ পুবের আকাশে মেলে রাখা। প্রথমে পাহাড়ের কোলে জমে থাকা সারারাত ধরে ঘুমোনো মেঘ জেগে উঠে ওপরে আসতে থাকল একটু একটু করে। উঁকি দেওয়া মাত্র সূর্যের আলোর ঝলমল করে উঠল সেই মেঘ। রামধনুর রং খেলতে শুরু করল চোখের সামনে। তারপর যত একটু একটু করে সূর্য জাগল, আলোর পাগলামো চলল বেড়ে। এত রূপ! এত রং! মুগ্ধ হয়ে গেল দুজন। অনুষ্কার গলায় ঝোলানো ক্যামেরা গলাতেই ঝুলে থাকল। কৃষ্ণেন্দু ফিসফিস করে বলে উঠল ‘স্রেফ এই মুহূর্তটুকুর পর আমি মরে যেতেও রাজি।’ সামনে আকাশজোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা। তারপর কুম্ভকর্ণ, থ্রি সিস্টার থেকে খুব ছোট এভারেস্ট পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। পাশ থেকে একজন বলে উঠল, ‘উহ, কী কপাল আজকে!’
‘নিজেকে দেবতা মনে হয় এখন। না?’ কৃষ্ণেন্দু জিগ্যেস করল।
অনুষ্কা অস্ফুটে বলল, ‘হুঁ।’ ঝকঝকে রোদ্দুরের সকাল হওয়া অব্দি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল ওরা। তারপর কৃষ্ণেন্দু বলল, ‘চলো ফিরি।’
‘তোমার যে কোনটা প্রিয় আজও কিন্তু বললে না অনুষ্কা।’ সি বিচে বালিতে পা ছড়িয়ে বসে সন্ধেবেলা জিগ্যেস করল কৃষ্ণেন্দু।
‘কোনটা মানে?’
‘মানে সমুদ্র না পাহাড়?’
‘তোমার?’
‘উঁ…উঁ পরে বলছি, আগে তুমি বলো।’
‘পারব না বলতে।’
‘কেন?’
‘সমুদ্র আমার হৃদয়।’
‘আর পাহাড় তোমার হৃদয়ের ওপরে অবস্থিত।’
‘এই, অসভ্যতা হচ্ছে।’ কপট রাগ দেখাল অনুষ্কা। তারপর সমুদ্রে চোখ ভাসিয়ে দিয়ে বলল, ‘হয়তো কথাটা ঠিকই বলেছ। পাহাড় আমার বুক…আর তোমার কে বেশি প্রিয় বলো?’
‘আমার তো সমুদ্র হল মন আর পাহাড় প্রাণ।’
আলতো হাসল দুজনে। নোনা জলে ভেজা বালিতে রাখা হাতে হাত ছুঁল।
‘শূন্যতা তোমার খুব ভালো লাগে কৃষ্ণেন্দু?’
‘কোন শূন্যতার কথা বলছ?’
‘মানে, শূন্যতা আবার ক’রকমের হয়?’
‘শূন্যই তো পূর্ণ।’
‘বাব্বাহ, তুমি আবার এত ভারী ভারী কথা শিখলে কবে?’
‘আমার কথা নয়, উপনিষদের।’
‘আজকাল ওসব চর্চাও চলছে না কি?’
‘না-নাহ।’
‘এর আগের বার যখন মরুভূমিতে এসেছিলাম কীরকম ঝড়ের মুখে পড়তে হয়েছিল মনে পড়ে?’
‘পড়ে না আবার! বাপরে! এমন শান্ত হঠাৎ যে ওইরকম ভয়ংকর হয়ে উঠবে ভাবাই যায় না।’ বলতে বলতে অনুষ্কা তাকাল কৃষ্ণেন্দুর মুখের দিকে। পড়ন্ত বিকেলের আলো কৃষ্ণেন্দুর গোটা শরীর জুড়ে ছড়িয়ে। কী সুন্দর দেখতে লাগছে ওকে। সোনার জলে স্নান করছে গোটা পৃথিবী। কৃষ্ণেন্দু বলল, ‘প্রকৃতির প্রত্যেকটা রূপের একেকরকম সুর আছে, না? এই ধরো যখন পাহাড়ে যাই কিংবা কোনও ঝরনার পাশে, স্পষ্ট সন্তুর শুনতে পাই আমি, জঙ্গলে অদ্ভুত এক দ্রিমদ্রিম মাদল।’
‘এখন কী শুনতে পাচ্ছ?’
‘সারেঙ্গি। সুলতান খান বাজাচ্ছেন। চোখ বুজে শোনো একবার।’
চোখ বুজে থাকল দুজনেই। আদিগন্ত বিস্তৃত আঁচড়কাটা বালির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দের মধ্যে সত্যি সত্যি যেন সারেঙ্গির ছড় টানার শব্দ। বুকে আঁচড়কাটা সুর ভেসে আসছে। দুজনে অনেকক্ষণ চোখ বুজে শোনার পর অনুষ্কা বলল ‘আজ পূর্ণিমা।’
‘মরুভূমিতে পূর্ণিমা আজ প্রথম দেখব। আবার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। সহ্য করতে পারব তো কৃষ্ণেন্দু?’ কথা বলতে বলতে সূর্য ঢলছিল। অন্ধকার চুঁইয়ে নামছিল। একটু একটু করে। ‘…পারব তো কৃষ্ণেন্দু; এত সুন্দরকে সহ্য করতে?…পারব তো?’ কৃষ্ণেন্দুর হাত শক্ত করে চেপে ধরল অনুষ্কা।
আচমকা ঘন অন্ধকার গোটা অফিস ফ্লোরে। লোডশেডিং। সামনে কম্পিউটারে স্ক্রিন সেভারের স্লাইড শোয়ে একটার পর একটা ভেসে ওঠা অ্যামেজিং নেচারস-এর সিনগুলো ডুবে গেল অন্ধকারে। সেই সঙ্গে রোজ সকাল ন’টা থেকে রাত ন’টা-দশটা পর্যন্ত সল্টলেকে একটা নামকরা এমএনসির ব্রাঞ্চ অফিসে খুব ভালো পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মুখ থুবড়ে কাজ করা ছেলেমেয়ে দুটো রোজ আধ ঘণ্টার লাঞ্চ আওয়ারে একসঙ্গে স্বপ্ন-ঘোরাটুকুও তলিয়ে গেল এক অদ্ভুত শূন্য অন্ধকারের ভেতর।
‘বাহ, গেল!’ কৃষ্ণেন্দু বলল, অনুষ্কা তখনও চুপ। ঘোরের মধ্যে।
‘তোমাকে এখনও নতুন ইউপিএস দিয়ে যায়নি?’ অনুষ্কা উত্তর দিল না। গোটা ফ্লোর জুড়ে পিঁক পিঁক শব্দ।
ওদের দুজনের এই খেলাটা প্রায় রোজই হয় লাঞ্চের সময়। কৃষ্ণেন্দুই শিখিয়েছিল একদিন। শিখিয়ে দিয়ে বলেছিল ‘দেখবে ক’দিন পর নেশা লেগে যাবে।’ প্রথম দিকে ভালো লাগত না অনুষ্কার। এ আবার কেমন ছেলেমানুষি অসম্ভবের খেলা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটানা কাজ। তারপর অফিসের গাড়িতে গা এলিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে এসে যাহোক কিছু একটা মুখে গুঁজে ঘুম। শনি-রবি দু-দিন ছুটি। এই ছিল সপ্তাহের রুটিন। কৃষ্ণেন্দু বলত ‘চলো না কাছাকাছি কোথাও ঘুরে আসা যায় দু-দিনে। বকখালি কিংবা গাদিয়াড়া।’ ইচ্ছে করত না অনুষ্কার। পাঁচ দিনের অক্লান্ত কাজের ক্লান্তি কাটানো আর আগামী সপ্তাহের পাঁচ দিনের কাজের এনার্জি সঞ্চয়ের জন্য এই দুটো দিন ধরে স্রেফ শুয়ে ঘুমিয়ে, টিভি দেখে, ম্যাগাজিনের পাতা উলটে কাটিয়ে দিত। কখনও বা শুধুই এলোমেলো ভাবনায়। কনভেন্ট স্কুলে এইচ এস। তারপর শ্রীরামপুর থেকে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে প্রেসিডেন্সিতে বি এস সিতে অনার্স। পার্ট টু-র রেজাল্ট বেরোবার আগের দিন বাবা মারা গেল। স্ট্রোক। পেনশন হাফ। দাদা সদ্য বিয়ে করেছে। কিছুদিন পরেই বউদির প্লাক করা সুন্দর দুই ভুরুর মাঝখানে সামান্য ভাঁজ। চুপচাপ চাকরির চেষ্টায়। সেই সময়টা ভীষণ টাফ গেছে। ইন্টারভিউ ‘এক্সপিরিয়েন্স নেই?’ ‘কোনও কোর্স করেননি?’—’না-না-না’—ভেঙে যাচ্ছিল অনুষ্কা। তখন এক বন্ধু জানাল এই এমএনসিতে ফ্রেশার নিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাপ্লাই। স্মার্টনেস, ফ্লুয়েন্ট ইংলিশ, লেগে গেল চাকরিটা। প্রথম মাস কয়েক অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে প্রায়ই লাস্ট ট্রেন। স্টেশনে নেমে বাড়ি ফেরার রিকশা পাওয়া যেত না। যাও বা কোনওদিন জুটত, রিকশাওয়ালা মদে চুর। খুব রিস্ক। ভয় করত ভীষণ। অফিসে আর পাঁচজনের সঙ্গে পরিচয়ের মতোই আলাপ হয়েছিল কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে। প্রায় ছ’ফিটের মতো লম্বা। রোগাটে গড়ন। শ্যামলা রং। টিকালো নাক, ঘন চুল ব্যাক ব্র্যাশ করা। চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে কথা বলা যেত না। গা ঝিমঝিম করত কেমন যেন! হাতের আঙুলগুলো খুব লম্বা। পরিচয়ের ক’দিন পরেই মনে হয়েছিল বড় অদ্ভুত ছেলেটা! মুখে সবসময় ছেলেমানুষের হাসি জড়িয়ে। কথাও বলে খুব মজার মজার। ইংলিশ অ্যাকসেন্ট পিওর অক্সফোর্ড। কিন্তু শুধু প্রয়োজন ছাড়া স্রেফ বাংলা। অনুষ্কার জয়েনিংয়ের দ্বিতীয় দিনে নিজেই এসে পরিচয় করেছিল কৃষ্ণেন্দু। অনুষ্কা বারবারই ইনট্রোভার্ট। যত কথা শুধু ওর নিজের সঙ্গে। ছেলেটা কখন যে অনুষ্কার অলক্ষ্যেই ওর জড়তার জালগুলো একে একে ছিঁড়ে ফেলছিল টেরই পাইনি ও। কৃষ্ণেন্দু কাছে এলেই বুকের ভেতর গুমগুম শব্দে কান বন্ধ হয়ে যেত। কোনও কথাই শুনতে পেত না তখন। ছেলেটার প্রাণখোলা হাসিটাই তখন ঝুড়মুড় করে বৃষ্টি ঝরিয়ে ভিজিয়ে দিত বুক। যত ইচ্ছে করত কথা বলতে ততই মুখ আটকে যেত। খুব কঠিন বিষয়ে নিয়েও কৃষ্ণেন্দু মাঝেমধ্যে এমন সহজভাবে গল্পচ্ছলে আলোচনা করত যে মুগ্ধ হয়ে শুনত অনুষ্কা। আর শুনত ওর বেড়ানোর গল্প। স্রেফ একা একা এই বয়সেই প্রায় গোটা ভারত চষে ফেলেছে ছেলেটা। কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা এক এক জায়গায়। একদিন তো অনুষ্কা জিগ্যেসই করে ফেলল, ‘এভাবে একা একা অচেনা জায়গায় চলে যান, ভয় করে না?’
‘ভয়? হ্যাঁ, করে তো। আবার এই যানজট, ভিড়ে, দশ-বারো ঘণ্টা ননস্টপ ডিউটিতে ফিরে আসতে ভয় করে।’
‘ফেরেন কেন তা হলে?’ বোকার মতো প্রশ্নটা করে ফেলেই ওর মনে পড়ে গিয়েছিল কৃষ্ণেন্দুর রিটায়ার্ড বাবা, আলসারের মা আর অবিবাহিতা বোনের কথা।
‘সময় আসুক, একদিন আর ফিরব না, ঠিক ফিরব না,’ বলে অদ্ভুত হেসেছিল কৃষ্ণেন্দু।
সঙ্গে সঙ্গে হা-হা করে হাসি আর একটা লাইন ‘জানি বন্ধু জানি তোমার আছে গো হাতখানি।’ তীব্র মনস্তাপেও হঠাৎ চমকে উঠেছিল অনুষ্কা। এক অচেনা অনুভূতিতে। হাত! আমার হাত! চুপ করে গিয়েছিল। আর পারেনি সেদিন কথা বলতে। কৃষ্ণেন্দু কিন্তু সেকথা বলার পরেও একইরকম স্বচ্ছন্দ। ওই একদিন বলল, ‘অনুষ্কা এভাবে রিস্ক নিয়ে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি পারবে না। এদিকেই কোনও লেডিস হোস্টেল বা বাড়ি ভাড়া-টাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা দেখো।’ হোস্টেলে সবার সঙ্গে অসম্ভব। কোম্পানির স্কেল বেশ ভালোই হওয়ায় উলটোডাঙায় একটা সিঙ্গল বেডরুমের ফ্ল্যাট কৃষ্ণেন্দুর চেষ্টায়। ধন্যবাদ দেওয়ার আর দরকার ছিল না। কেননা দুজনের সম্পর্কটা আর ততদিনে সহকর্মীর প্রতি সৌজন্যমূলক নেই। তবু মাঝেমধ্যে আচমকা বড্ড একা মনে হয় অনুষ্কার। মা কখনও-সখনও এসে থেকে যায় কয়েকদিন। অনুষ্কার ইচ্ছে ছিল মাকে ওর নিজের কাছেই নিয়ে এসে রাখবে। মা-ও মোটামুটি রাজি ছিল। কিন্তু দাদার অনিচ্ছায় হয়ে ওঠেনি। একা একা মাঝেমধ্যে বড় ভয় লাগে। শরীর জুড়ে অস্বস্তি। কৃষ্ণেন্দু ওকে বোঝে। বলে, ‘ক’দিন বাড়ি গিয়ে রেস্ট নাও।’
‘না, না!’
‘তাহলে এমনিই ছুটি নিয়ে থাকো ক’দিন। ইদানীং প্রচুর লোড নিয়ে ফেলছ।’
ভালো পারফরম্যান্সের জন্য অফিসে অনুষ্কার এরমধ্যেই যথেষ্ট সুনাম।
‘ওই দুটো ঘরের মধ্যে সারাদিন একা একা—অসম্ভব!’ প্রায় আঁতকে উঠেছিল অনুষ্কা।
‘তাহলে আমি গিয়ে থাকব তোমার সঙ্গে?’
‘যাবে?’
‘আপত্তি নেই।’ স্মার্ট উত্তর কৃষ্ণেন্দুর।
একাকীত্ব কি এতটাই ভয়ের যে বাকি সমস্ত ভয় ভুলিয়ে দিতে পারে?’
‘শুধু অফিস আর বাড়ি, বাড়ি আর অফিস কী করে পারো বলো তো?’
‘উপায় নেই!’
‘উপায় নেই, না কি ইচ্ছে নেই?’
‘অনেক সময় উপায়ই তো ইচ্ছে তৈরি করে।’ কিন্তু কৃষ্ণেন্দুর শেখানো এই খেলাটা…এই অদ্ভুত খেলাটা খেলতে খেলতে ইদানীং কী যে হয়েছে! সবুজ জঙ্গল, পাহাড়, আকাশ সব যেন গুলিয়ে দেয়। তালগোল পাকিয়ে যায় কাজে। অনুষ্কা রোজ ভাবে আজ কৃষ্ণেন্দুকে কঠোরভাবে বলবে এ খেলা আজ থেকে বন্ধ। কিন্তু পারে না শেষ পর্যন্ত। কাজের প্রেশার বাড়তে থাকে দিনে দিনে। খেলার ইচ্ছেটাও।
‘একবার এদিকে এসো, এই যে ম্যাডাম, হ্যালো, আপনাকে বলছি।’ অনুষ্কা খেয়াল করেনি কৃষ্ণেন্দু ডাকছে। অনুষ্কা এখন প্রমোশন পেয়ে টিম লিডার। কয়েকজন ছেলেমেয়ে ওর আন্ডারে কাজ করে। নিজের কম্পিউটারের স্ক্রিনে চোখ রেখে কয়েকটা ডেটা নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিল। দ্বিতীয় ডাকে শুনতে পেল। ‘উঁ—ডাকছ?’
‘বহুযুগ ধরে। একবার চট করে শুনে যাও। তাড়াতাড়ি।’
‘এখুনি আসতে হবে?’
‘আসলে ভালো হয়।’
অনুষ্কা উঠে এল। কৃষ্ণেন্দুর স্ক্রিন সেভারে একটা পাখি। সাদা রং, সরু লম্বা ঠোঁট। নীল রঙের জলের ওপর ঝাঁপিয়ে এসে পড়েছে ভাসবে বলে। ছড়ানো বিশাল ডানা দুটো ভাঁজ করেনি। এখনও।
‘কী বলছ?’
‘এটা দেখাতে ডাকলাম।’
‘ভালো।’
‘কী নাম বলো তো এর?’
‘জানি না।’
‘এর নাম আর্কটিক টার্ন। পরিযায়ী পাখি। এরা গোটা পৃথিবী উড়ে বেড়ায়। উত্তর থেকে দক্ষিণ। ভাবতে পারো শুধু এই ডানা দুটো দিয়ে। একবার তাকাও ভালো করে। দেখে মনে হয় না বরফ-বালি-ধুলো-জঙ্গল-সমুদ্র সব কিছুর গুঁড়ো-গন্ধ লেগে রয়েছে?…ইচ্ছে করে আমিও এরকম হয়ে যাই।’
অনুষ্কা ভালো করে দেখল, তারপর হেসে ফেলে বলল ‘তোমার কবি হলে ভালো হত।’
‘কেন হঠাৎ কবি কেন?’
‘না, কবিরা শুনেছি সব কিছুই মানে ওই মনে মনে পাখি-টাখি হয়ে যেতে পারে।’
‘ভুল-ভুল। শুধু কবি নয়। ডানা আমাদের সবার আছে। শুধু মেলতে শিখতে হয়। শিখবে?’
‘আবার শুরু হল!’ বলে হেসে নিজের চেয়ারে চলে এল অনুষ্কা। একেবারে পাগল ছেলে! ভালো লাগে খ্যাপামোগুলো। এমনভাবে বলে কথাগুলো!…ই-ই-স অনেক কাজ রয়েছে, মাথা থেকে এখন বাদ—বাদ—বাদ।
লাঞ্চ আওয়ারে কৃষ্ণেন্দু নিজের টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে অনুষ্কার ডেস্কে চলে আসে রোজ। আজকে আসার সঙ্গে সঙ্গেই অনুষ্কা বলল, ‘আজ কিন্তু কোনও খেলা হবে না।’
‘বেশ।’ কারণ জানতে চেয়েই আগে নিজের স্বভাবমতো রাজি হয়ে গেল কৃষ্ণেন্দু। তারপর একটু চুপ করে বেশ অনুরোধের সুরে বলল, ‘ঠিক একটা কারণের জন্য মাত্র দশ মিনিটের জন্যও খেলা যায় না আজ?’
‘কারণটা আগে শুনি।’ হাসি চেপে চোখ-মুখ স্বাভাবিক রেখে জানতে চাইল অনুষ্কা।
‘কারণ আজ শুক্রবার। কাল-পরশু ছুটি এবং সোমবার থেকে আগামী দশ-বারো দিনের জন্য আমি রোজ এ সময়ে তোমাকে বিরক্ত করতে পারব না।’
‘কেন?’
‘ডানা মেলব।’
‘কোথায়?’
‘খুব বেশি দূর নয়। লাভা। বছর কয়েক আগে একবার গিয়েছিলাম। তখন ওয়েদার খুব খারাপ ছিল। এবার আশাকরি…’
‘একাই?’
‘কেন তুমি যাবে সঙ্গে?’
‘আমি চাইলেই কি তুমি নেবে তোমার ডানায়?’
‘আমার ডানা অনেক বড় আর খুব শক্তি আছে। শক্ত করে যদি ধরে থাকতে পারো পুরো দুনিয়া ঘুরিয়ে আনব।’
‘দরকার নেই উড়ে। আমার বাসাই ভালো।’
‘তাহলে খেলা কি বন্ধ আজকে?’
‘আচ্ছা হোক। কিন্তু ঠিক দশ মিনিট।’
মাউসে হাত দিয়ে গিয়েও থেমে গেল কৃষ্ণেন্দু। ‘আচ্ছা অনুষ্কা, সত্যিই কি অফিস আর বাড়ি এই-ই তোমার ভালো লাগে?’
‘দেখো কৃষ্ণেন্দু। আমি অনেক কষ্টে আজকে এটুকু জায়গায় পৌঁছেছি, একটা সময় গেছে যখন আমার পাশে, পায়ের নীচে মাটি কিচ্ছু ছিল না। ওই বিপদের সময়েই চিনে নিয়েছি সবাইকে, কেউ এতটুকু হেল্প করেনি আমাকে। আজ যেটুকু প্ল্যাটফর্ম বাঁচবার জন্য পেয়েছি সেটুকু কোনওমতেই হারাতে চাই না।’
কৃষ্ণেন্দু খুব মন দিয়ে শুনল কথাগুলো। তারপর বলল, ‘তোমার কথার সবটায় সম্মত হতে পারলাম না।’
ভুরুতে প্রশ্ন রেখে তাকাল অনুষ্কা।
‘ওই যে বললে না বিপদের দিনের সবাইকে চিনতে পেরেছ। আসলে কী জানো, বিপদের সময় অন্য কাউকে নয়, নিজেকে চেনা যায়। তোমার কি মনে হয় তুমি নিজেকে পুরোটা চিনেছ?’
‘বোধহয়…হয়তো ঠিক জানি না। বাদ দাও এসব কঠিন কথা।’
‘বেশ বাদ দিলাম।…আচ্ছা গতবার যখন লাভা গিয়েছিলাম তখনকার ছবিগুলো তোমাকে দেখিয়েছি?’
‘উ…উ…মনে পড়ছে না।’
‘দাঁড়াও’ বলে দৌড়ে নিজের ডেস্কে গিয়ে একটা ফোল্ডার শেয়ার করে ফিরে এল কৃষ্ণেন্দু। অনুষ্কার পাশের চেয়ারে বসে ফোল্ডারটা খুলল। একটার পর একটা ছবি। বেশিরভাগই ধোঁয়াটে, অস্পষ্ট ঘন জঙ্গল। দু-ধারে লম্বা গাছে ঢাকা বৃষ্টিভেজা বেঁকে যাওয়া রাস্তা, মনাস্ট্রি। একটা ছোট্ট মিউজিয়াম। আবার একটা জঙ্গল। কুয়াশায় ঝাপসা। কৃষ্ণেন্দু পাশে বসে ফিসফিস করে বলে যাচ্ছিল—এটা লোলেগাঁওয়ের জঙ্গল। বৃষ্টি পড়ছিল টিপটিপ করে। প্রচণ্ড নিস্তব্ধতার মধ্যে শুধু গাছের পাতার ওপর বৃষ্টির ফোঁটার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। চারদিক কুয়াশায় অস্পষ্ট। অস্পষ্টতার রহস্যের যে কী সৌন্দর্য সেদিন প্রথম অনুভব করেছিলাম। দূর থেকে বরফে ঢাকা পাহাড় কিংবা ঝকমকে সবুজ আর ওপরে নীল অনেক দেখেছি। মুগ্ধ হয়েছি বার বার। কিন্তু একটু দূরের কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না, তারপরে কী আছে জানা নেই, এর যে একটা শিরশিরে অনুভূতি…আগে কখনও পাইনি। পাহাড়ের কিনারে খাদের একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল আকাশে দাঁড়িয়ে আছি। সামনে-নীচে ওপরে শুধু মেঘ আর মেঘ…’
পরপর ছবি আর কথায় আবার ঘোর লেগে যাচ্ছিল অনুষ্কার। চুপ করে শুনছিল। ছবি-কথা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও কথা বলছিল না ও।
‘কেমন ঘুরলেন আজকে? দশ মিনিটে লাভা-লোলেগাঁওয়ের ট্যুর। ফুডিং ফ্রি।’ বলে সহজে হেসে নিজের ক্যারিয়ার খুলে একটা পরোটা আর খানিকটা আলুর দম তুলে প্লেটে রেখে অনুষ্কার দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘এ যে…এবার ফিরুন।’
‘তুমি তাহলে যাচ্ছ?’ খুব আস্তে আস্তে প্রশ্নটা করল অনুষ্কা।
‘সেরকমই তো কথা।’
‘তুমি খুব বাজে। আমার মাথাটা খাচ্ছ দিনে দিনে।’
‘কোথায় আর খেতে পারলাম। এতদিনে ডানাই মেলাতে পারলাম না তোমার। ছবিগুলোর ফোল্ডারটা সেভ করে নাও। আমি যে ক’দিন না থাকি সেই ক’দিন একটু কষ্ট করে একা একাই দেখো।’
‘মোটেও না। একটুও দেখব না। কিছুতেই না। আমার মাথা খারাপ না কি তোমার মতো।’ বলে প্রবলভাবে মাথা নাড়তে থাকল অনুষ্কা।
‘সে কী! নয়, আমার মতো?…আমি তো জানতাম…’
‘মার লাগাব কিন্তু এবার!’
ছ’দিন-সাতদিন-আটদিন, সত্যিই আর ভালো লাগছে না অনুষ্কার। কৃষ্ণেন্দু নেই। ওখানে পৌঁছে একবার মাত্র ফোন করেছিল, ব্যস, তারপর আর কোনও যোগাযোগ করেনি। এমন ছেলে! কজের ফাঁকে, লাঞ্চের সময়, একা বাড়িতে মনে পড়ে ওর কথা। সঙ্গে একজন থাকা আর তার না থাকার পার্থক্যটা এত ভীষণ রকম! আচ্ছা, সত্যিই কি ডানা থাকে মানুষের? কেমন করে মেলতে হয়?…ধুৎ, যত পাগলের কথা! কিন্তু পাগলটা যে ওর মাথাটাকেও খেয়ে বসেছে। ক’দিন ধরে কাজেও মন দিতে পারছে না। কৃষ্ণেন্দু বোধহয় ঠিকই বলে, সারাদিনের মধ্যে খানিকটা অকাজ না করতে পারলে কাজটাও ঠিকঠাক হয় না। এবার ফিরুক, খুব করে ঝগড়া করতে হবে। এমনি এমনিই।
আঠাশে ফেব্রুয়ারি অনুষ্কার জন্মদিন। কৃষ্ণেন্দুর কি মনে আছে সেকথা? আর দু-দিন বাকি। হয়তো ভুলেই গেছে। আজ কম্পিউটারে কাজ করতে করতে কেমন বেখেয়ালেই কৃষ্ণেন্দুর দেওয়া একটা ছবির ফোল্ডার খুলে ফেলল অনুষ্কা। একটার পর একটা ছবি। কৃষ্ণেন্দু যেমনভাবে ছবি দেখতে দেখতে বলে যায় ঘোর লাগানো ফিসফিস করে, ছবিগুলো নিজেই যেন সেভাবে বলে যাচ্ছিল নিজেদের…এই দেখো আমি সবুজ, লুকোবে? আমার নাম আকাশ, ভাসবে আমার মধ্যে দিয়ে? আমি জল, ডুববে আমার ভেতর?…নাহ? মাথাটা সত্যি সত্যি এবার পুরোটা যাবে! ফোল্ডার বন্ধ করে দিল ও। পাগলটাকে ছাড়া আরও একটুও থাকা যাচ্ছে না, যাচ্ছে না…উহ!
তারপর আরও অসহ্য কয়েকটা দিন পার করে সাতাশ তারিখে অফিসে এল কৃষ্ণেন্দু। ওকে দেখেই কাজে খুব মন দিল অনুষ্কা। কৃষ্ণেন্দু কাছে এসে বলল, ‘এসে গেছি।’
যতটা পারা যায় উদাসীনভাবে উত্তর দিল অনুষ্কা। ‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি।’
‘এক দিন আগেই চলে এসেছি কিন্তু।’
‘কীসের এক দিন?’
‘বা রে! কাল আমার নেমন্তন্ন আছে না তোমার জন্মদিনে।’
‘মনে আছে?’
‘সে কী, থাকবে না!’
‘কিন্তু আমি তো নেমন্তন্ন করিনি তোমায়।’
‘তো কী আছে! বরং ঘটা করে বললে যেতাম কিনা সন্দেহ।’
আর অভিমান ধরে রাখতে পারল না অনষ্কা, খিলখিল করে হেসে ফেলে বলল, ‘আচ্ছা, সত্যি সত্যি আসবে না কি?’
‘কেন, আপত্তি আছে?’
‘বেশ দেখা যাক কেমন আস।’
‘প্রচুর ছবি তুলছি। কাল দেখাব। এবারেরগুলো একেবারে অন্যরকম।’
সকালে ঘুম থেকে উঠতেই অনুষ্কা বুঝতে পারল মনভর্তি আনন্দ টলটল করছে। সারারাত ধরে খেজুরের রসের মতো ফোঁটায় ফোঁটায় ভরে উঠেছে কলস। আজ ওর জন্মদিন। কৃষ্ণেন্দু আসবে বলেছে। কিন্তু সত্যি কি আসবে? এই ফ্ল্যাটটা ঠিক করে দেওয়ার পর থেকে কোনওদিনও আসেনি। অনুষ্কা দু-একদিন গোড়ার দিকে ওকে বলেওছিল আসার জন্য। উত্তর পেয়েছিল, ‘যাব, যাব। ঠিক দিনে ঠিক সময়ে যাব।’ আজ কি সেই দিন, সেই সময়? হয়তো এমনিই বলেছে যাব, আসলে আসবে না। তবু…। বিছানা ছেড়ে উঠে মোবাইল অন করল। তিনটে মিসড কলের মেসেজ। দাদা ফোন করেছিল। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর সৌজন্য। ভাবল একবার রিং ব্যাক করবে। তারপর মনে হল যেচে উইশ নেওয়াটা কেমন বোকাবোকা। ওর ছোটবেলায় মা পায়েস বানাত আজকে। একঝলক মনে পড়ল কথাটা। আজ অফিস অফ করবে ঠিকই করে রাখা ছিল। রান্নার মাসি আসবে একটু দেরি করে। কী কী রান্না করতে বলবে? কৃষ্ণেন্দু কী খেতে ভালোবাসে? মনে পড়ল না। আসলে খাওয়াদাওয়ার দিকে তেমন নজরই নেই ছেলেটার। খালি টো টো করতেই ভালোবাসে। ফ্রাইড রাইস আর চিকেনই যথেষ্ট। সারাদিন ধরে এঘর-ওঘর টুকটাক কাজ, রান্নার খবর নেওয়া, ঘড়ি দেখার ফাঁকে প্রতীক্ষার বুক ঢিবঢিব।…অস্থিরতা। আসবে?…সত্যি! বিকেল-সন্ধে সাতটা-আটটা-ন’টা। নিজের ওপর রাগ হতে শুরু করল অনুষ্কার। ফালতু অফিস কামাই করে সারাটা দিন নষ্ট হল। কত কাজ পেন্ডিং রয়েছে। রাত্রি প্রায় দশটা নাগাদ আচমকা কলিংবেল। এখন আবার কে? দরজা খুলতেই সেই হাসিমুখ।
‘এখন!’
‘বা রে! জন্মক্ষণ তো শুনেছিলাম রাত্রি এগারোটা পনেরো। বরং অনেক আগে এসে গেছি বলে একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য আমার।’
‘অত রাত্তির অব্দি থাকবে বুঝি?’
‘যদি রাখতে চাও।’
বুকের ভেতর একদম অচেনা, অন্যরকম শিরশির করে উঠল অনুষ্কার।
কৃষ্ণেন্দু ঘরে ঢুকতেই বলল, ‘বাহ, সুন্দর সাজিয়েছ ঘরটা।’
‘কী খাবে বলো এখন?’
‘স্রেফ চা।’
‘দু-মিনিট।’ ডাইনিং টেবিলে ফ্লাস্কে চা বানিয়ে রাখাই ছিল। কাপে ঢেলে ট্রে-তে করে নিয়ে এল। চা খেতে খেতে কৃষ্ণেন্দু কবজিতে ঘড়ি দেখে নিয়ে বলল, ‘আর ঘণ্টাখানেক পরেই তুমি জন্ম নেবে।’
অনুষ্কা হুঁ বলেই বলল, ‘বেশ অনেকটা রোগা হয়ে গেছ। খুব অনিয়ম করে গেছ না একদিন?’
‘না-নাহ-ধুস…বাদ দাও ওসব, এবার বলো আমাকে ছাড়া কেমন কাটালে?’
‘দারুণ!’ ঠোঁট উলটে বলল অনুষ্কা।
‘সত্যি!’
‘তো মিথ্যে না কি? কেউ ডিসটার্ব করার ছিল না। স্রেফ কাজ করে গেছি।’
‘আর ছবিগুলো… দেখনি?’
‘ছবি…কীসের ছবি?’ নিপুণ অভিনয়ের চেষ্টা করল অনুষ্কা। কিন্তু মুখের অভিব্যক্তিতে সেই অভিনয় ছিল না। ধরা পড়ে গেল। কৃষ্ণেন্দু হেসে ফেলে বলল, ‘ভূতের।’
কথায় কথায় রাত, অনুষ্কা মনে মনে অবাক হচ্ছিল কৃষ্ণেন্দু সত্যি সত্যিই বাড়ি ফেরার নাম করছে না। নিশ্চয়ই সারারাত থাকবে না।…তাহলে কত রাতে ফিরবে? ফিরবে কীভাবে? সুখ মেশানো এক অচেনা ভয় ভয় অনুভূতি।
‘এই, এগারোটা পাঁচ বেজে গেছে। চলো কেক রেডি করো।’
‘কেক…সে কোথায় পাব!’ অনুষ্কা অবাক।
‘ওহ হো, বার করতে ভুলেই গেছি।’ বলে সোফায় রাখা নিজের লেদার ব্যাগটা খুলে সুন্দর দেখতে একটা ক্যাথলিনের বাক্স অনুষ্কার হাতে দিয়ে বলল, ‘ক্যান্ডেল ক’টা কিনব…মানে তোমার বয়সটা বেয়াল্লিশ বা পঁযতাল্লিশ ঠিক খেয়াল পড়ছিল না, সেজন্য একটাই কিনেছি।’ বলে একটা নীল রঙের মোম বাড়িয়ে দিল। হাত বাড়িয়ে জিনিস দুটো নিতে গিয়ে অনুষ্কা ঠোঁট টিপে বলল, ‘সে কী, আমার এবার ঊনসত্তরে পা পড়বে ভুলে গেছ?’
দুজনেই হেসে ওঠার পর কৃষ্ণেন্দু তাড়া লাগাল ‘কুইক, একটা প্লেট আর ছুরি নিয়ে এসো।’ অনুষ্কা প্রায় দৌড়ে কিচেনে গিয়ে ছুরি, প্লেট নিয়ে এসে টেবিলে রেখে প্লেটের ওপর কেকটা বসাল, আনন্দে বুকের ভেতরটায় ঠিক কেমন যে করছে! কৃষ্ণেন্দু মোমবাতি জ্বালিয়ে কেকের সামনে রেখে বলল, ‘এবার হাতে ছুরিটা নিয়ে চোখ বন্ধ করে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকো, আমি যখন বলত তখনই খুলবে।’
কয়েক মুহূর্ত পরেই কৃষ্ণেন্দু, ‘নাও এবার আঁখিপল্লব মেলে কেক কাটো।’
‘তুমি এসো আমার সঙ্গে, দুজনে মিলে…’
‘কিন্তু আমার যে জন্মক্ষণ নয় এখন।’
‘হ্যাঁ তোমারও। আমাদের জন্ম একসঙ্গে’ তীব্র আনন্দে হাতের আঙুল কাঁপছিল অনুষ্কার।
‘বেশ।’ দুজনে একসঙ্গে আঙুল ছুঁয়ে কেক কাটল। হাততালি দেওয়া, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ বলার কেউ ছিল না ঘরে, তবু যেন অনুষ্কা শুনতে পেল হাজার হাজার মানুষ উল্লাসে হাততালি দিচ্ছে, খুশিতে গান গাইছে, উইশ করছে…।
কেক খেয়ে কৃষ্ণেন্দু বলল, ‘দাঁড়াও এবার তোমার গিফটটা দিই।’
‘আরও উপহার বাকি?’
‘হ্যাঁ, ব্যাগ থেকে সেলোফেন পেপারে মোড়া ছোট্ট একটা প্যাকেট অনুষ্কার হাতে দিয়ে বলল, ‘দেখো।’
প্যাকেট খুলতে ছোট্ট একটা কাগজে লেখা ‘ডানা মেলার অপেক্ষার দিনে তোমায়।’ নাম নেই, তারিখ নেই, আর সঙ্গে একটা ব্ল্যাঙ্ক সিডি। এমন উপহার আশাই করেনি অনুষ্কা। ‘এটা কী? ব্ল্যাঙ্ক সিডি?’
‘দেখা যাক, তোমার কম্পিউটারটা কই?’
‘আগে ডিনার করে নাও।’
‘পরে হবে। আগে বলো কোথায় রয়েছে?’
বেডরুমের এক কোণে অনুষ্কার পি সি রাখা। কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে ওই ঘরে ঢুকতে গিয়ে একবার গা ছমছম করে উঠল অনুষ্কার। পি সি অন করে সিডিটা ঢোকাল। কৃষ্ণেন্দু বলল, ‘তুমি চেয়ারে বসো আমি পাশে দাঁড়াচ্ছি।’ ফোল্ডারটা খুলতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল ঘন সবুজ পাহাড়, টুকরো টুকরো ভেসে যাওয়া মেঘ, তিস্তার উচ্ছলতা, গভীর জঙ্গল, সূর্যাস্ত, পাহাড়ি মেয়ের সহজ মুখ…কাঞ্চনজঙ্ঘা…পরপর দেখে যাচ্ছিল অনুষ্কা।
‘আমার শ্রেষ্ঠ মুহূর্তগুলো তোমাকে দিলাম,’ বলতে বলতে মাউসে রাখা অনুষ্কার হাতের ওপর আলতো করে হাত রাখল কৃষ্ণেন্দু। তিরতির করে কেঁপে উঠল অনুষ্কা। কিন্তু স্ক্রিন থেকে চোখ সরাল না। ‘এই ছবিগুলো সব কালিম্পঙের। এটা ডিলো পার্ক, এটা সুইসাইড পয়েন্ট।’ অনুষ্কা তাকিয়ে থাকল ছবিটার দিকে। খাদের একেবারে কিনার থেকে ওপাশের ছবি। মাঝে গভীর অতল। অসাধারণ ছবিটা। এত সুন্দর জায়গাটার এমন খারাপ নাম কেন?
‘এখান থেকে এই অঞ্চলের দুটি ছেলেমেয়ে সুইসাইড করেছিল। বিয়ে করবে ঠিক করেছিল ওরা। কিন্তু জাতের ভিন্নতা ছিল বলে বিয়েতে মত ছিল না দুই বাড়িরই। পালানোর উপায়ও ছিল না। সুতরাং…’
‘ইশস।’ হাতের আঙুলগুলো আবার কেঁপে উঠল অনুষ্কার।
‘ভাবো তো একবার সেই মুহূর্তটা, দুজনে পরস্পরের হাত চেপে ধরে যখন হু-হু করে শয়ে শয়ে ফুট নীচে নেমে যাচ্ছে।’
‘তখনও কি ওরা ভাবছিল পরস্পরের কথা? ওইটুকু সময়েও?’ অবশভাবে জিগ্যেস করল অনুষ্কা।
‘হয়তো…জানি না। আমি শুধু এইটুকু জানি আমরা যখন শূন্যে ঝাঁপাব তখন নীচে নামব না। দুজনে ডানা মেলে উড়ে বেড়াব আকাশে।’
‘আমার ভয় করে কৃষ্ণেন্দু,’ এই প্রথম কথাটা বলল অনুষ্কা। ‘যদি সব হারিয়ে ফেলি উড়তে গিয়ে…’
‘কী আছে তোমার যে হারাবে? আর সত্যিই যদি মানুষ কিছু পায় তাকে হারাতে পারে না। হারাতে চাইলেও নয়। সত্যি বলো তো এই যে তোমার…’
‘চু-উ-প!’ কৃষ্ণেন্দুর ঠোঁটে আঙুল দিয়ে থামিয়ে দিল অনুষ্কা। আঙুলগুলোয় মনে হল…ঠিক কী যে মনে হল…তার আগেই নিজের দু-হাত দিয়ে পিছন থেকে অনুষ্কার দু-হাত আলতোভাবে জড়িয়ে ধরেছে কৃষ্ণেন্দু। তারপর…তারপর…
এ মাসে ডেট মিস হওয়াতে শরীরে অস্বস্তি হচ্ছিল অনুষ্কার। অনেকদিন পর এরকমটা হল। তলপেটে চাপ ব্যথা। কাজে মন বসতে চায় না। হঠাৎ কেন হল এরকম? সেই রাতের পর থেকে কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে কথা বলতে জড়তা লাগে। ও কিন্তু একইরকম রয়েছে। লাঞ্চ আওয়ারে ইচ্ছে করে আরও ব্যস্ত হয়ে পড়ে অনুষ্কা যাতে একসঙ্গে বসতে না হয়। কেমন একটা ঘোর সব সময় মাথার মধ্যে। মাঝেমধ্যে হঠাৎ নিজেকে অচেনা মনে হয়। ভালো লাগে না, কিচ্ছু ভাল্লাগে না, কাল এইচ ও ডি ডেকেছিলেন ওকে। সংক্ষেপে ভদ্রভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ইদানীং অনুষ্কার পারফরম্যান্স ভীষণভাবে ফল করছে। এটা তার কেরিয়ার এবং প্রমোশনের পক্ষে যথেষ্ট প্রতিবন্ধক। মোদ্দা কথায় হয় ঠিক করে কাজ করো নয়তো…। ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠেছিল অনুষ্কা। ও নিজেও ভালো করে জানে এইসব জায়গায় কাজটাই প্রথম এবং শেষ কথা। করো অথবা ছাড়ো। ‘সরি স্যার’ বলে চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসে চোয়াল শক্ত করে নিয়েছিল ও। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বার বার নিজেকে বুঝিয়েছিল—কাজ কাজ, বাকি সব কিছু চুলোয় যাক। তার আর কোনও ইচ্ছে নেই, কোনও বন্ধু নেই, কেউ নেই, কিছু নেই, নেই-নেই নেই।
‘তোমার কী হয়েছে বলো তো অনুষ্কা?’
‘কিছু না তো।’
‘তাহলে আমার সঙ্গে কথা বলছ না কেন ভালো করে?’
‘কাজের প্রেশার।’
‘শুধু কি সেজন্যই?’
‘হ্যাঁ’, বলে আচমকা কৃষ্ণেন্দুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠেছিল ‘চাকরিটা চলে গেলে আমাকে কেউ দেখার নেই কৃষ্ণেন্দু, কেউ নেই।’ কথাগুলোর ইঙ্গিত স্পষ্ট ছিল, মাথা নীচু করে চলে গিয়েছিল কৃষ্ণেন্দু। তারপর থেকে আর ধারেকাছে আসে না। কথাগুলো বলে খুব খারাপ লেগেছিল অনুষ্কার। কিন্তু ওই পাগলকে এভাবে ছাড়া আর অন্য কোনও উপায়ে বোঝানোর উপায় ছিল না। ক’দিন ধরেই পেটের ভেতর একটা অদ্ভুত অস্বস্তি হচ্ছে সারাদিন ধরে। সকালে অফিস এসে সারাক্ষণ কাজে প্রাণপণ ডুবে যাওয়ার মাঝেমধ্যেও অস্বস্তিটা টের পায়। ভাবে খাওয়াদাওয়ার অনিয়ম। অতিরিক্ত কাজের চাপ। মানসিক অস্থিরতা…কিন্তু নিজের সাজানো যুক্তিগুলো নিজের অজান্তেই ছিঁড়ে ফেলে। রাত্রের বিছানায় শোওয়ার পর অস্বস্তিটা আরও বেড়ে যায়। ঘুম আসতে চায় না। একদিন রাত্রে কী খেয়াল হতে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে নিজেকে সম্পূর্ণ উন্মক্ত করে দাঁড়াল অনুষ্কা। এপাশ-অপাশ ফিরে ভালো করে আয়নায় নিজের পেটটা দেখল। ঈষৎ উঁচু! চোখের ভুল? একটু উঁচু! সত্যিই! কেঁপে উঠল থরথর করে। তবে কী! কিন্তু সে রাত্রে কী ঘটেছিল কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে? তেমন কিছু কি…? চোখ বুজে মনে করবার চেষ্টা করতে থাকে আপ্রাণ। পড়ছে না…কিছুতেই মনে পড়ছে না। কেমন যে পড়ছে না? এত অবশ বিহ্বল হয়ে পড়েছিল সেদিন যে কিছু মনে নেই, শুধু এক সংজ্ঞাহীন অনুভূতি ছাড়া। কৃষ্ণেন্দুকে জিগ্যেস করার প্রশ্নই আসে না। ওষুধের দোকান থেকে প্রেগটেস্ট কিনে নিয়ে এসে দেখে নেগেটিভ। তাহলে? তবু নিশ্চিন্ত হতে পারে না। এর রেজাল্টও তো সবসময় সত্যি হয় না শুনেছে। আর পেটটাও যে দিনে দিনে ফুলে উঠছে। স্পষ্ট বুঝতে পারে ও। কিন্তু সত্যি যদি কিছু হয়েও থাকে তাহলেও এত দ্রুত কী করে হচ্ছে মাথায় আসে না! গুলিয়ে তালগোল পাকিয়ে যায় সব। ডাক্তারের কাছে যেতেও লজ্জা লাগে। সম্ভাব্য প্রশ্নগুলোর সামনে দাঁড়াতে হবে ভাবলে লজ্জায় সিঁটিয়ে যায়। কুর্তা আর জিনসের প্যান্ট পরা ছেড়ে দিয়ে ঢিলেঢালা সালোয়ার পড়তে শুরু করে ও। অফিসে, পরিচিতরা সবাই অবাক। চোখের নীচে কালো ছোপ বাড়তে দেখে কলিগরা ওকে ছুটি নিয়ে বাড়িতে রেস্ট নিতে বলে। শুধু কৃষ্ণেন্দু চুপ। কিচ্ছু বলে না, শুধু দূর থেকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। অনুষ্কাও চুপ। সালোয়ারের ওড়না দিয়ে দিয়ে বার বার পেটের কাছটা ঢাকা দেওয়াটা মুদ্রাদোষের মতো হয়ে ওঠে। সবসময় মনে হয় রাস্তাঘাটে, অফিসে-দোকানে সব মানুষ ওর পেটের দিকে জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়ে। কেউ যদি একদিন সত্যিই কিছু জিগ্যেস করে বসে…কী করবে তখন? বুঝতে পারে না। অ্যাবরশন?—অস্থির হয়ে ওঠে ও। প্রচণ্ড অস্থির। সবসময় শরীর ভারী লাগে। নড়তে-চড়তে কষ্ট, মাঝেমধ্যে গা গুলোয়, বমি পায়, পেটের খাবার হড়হড় করে বাইরে বেরিয়ে আসে। স্পষ্ট বুঝতে পারে পেটের ভেতর কিছু একটা নড়াচড়া করছে। দিনে দিনে ফুলে উঠছে পেটটা। অবিশ্বাস্য দ্রুতভাবে। এরকম হয়! বিশ্বাস করতে না চাইলেও, এখন জোব্বার মতো ঢিলে সালোয়ার পড়লেও ওপর দিয়ে পরিষ্কার বোঝা যায় স্ফীত পেট।—না। আর নয়। বাড়ি থেকে সিক লিভের অ্যাপ্লিকেশন বসকে মেল করে দেয় ও। কৃষ্ণেন্দুকে কিছুই জানাবে না। সব পুরুষরাই কি তাহলে একইরকম? সব অনুভূতিই শেষে শুধু মাংসের খিদে? আগামী কালকেই যেতে হবে। লোকাল নয়, ইচ্ছে করে একটু দূরে নার্সিংহোম বুক করে নেয় ফোনে।
আজ সারাদিন ধরে পেটের মধ্যে অস্বস্তিটা যেন বড় বেশি। অল্প অল্প ব্যথাও হচ্ছে। সকালে রান্নার মাসি কাজ করে চলে যাওয়ার পর সারাদিন ধরে একা। ইদানীং দিনের মধ্যে দশ-বারো বার কিংবা তারও বেশি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পেটের স্ফীতির হার খেয়াল করাটা প্র্যাকটিসের মতো হয়ে গেছে। আজ আর দাঁড়াল না। কালকের মধ্যেই তো সব ধুয়েমুছে সাফ। কথাটা মনে আসতেই পরম নিশ্চিন্তির সঙ্গে সঙ্গে আরও কী একটা খোঁচা দিয়ে ওঠে। কাজটা হয়ে যাওয়ার পর আর এই অফিস নয়। অন্য কোথাও ট্রাই করতে হবে। ওই ছেলেটার সামনে যেন আর না দাঁড়াতে হয় কোনওদিন। এতটুকু খিদে নেই আজ। খেলও না। ঘুমও আসছে না। চাপা ব্যথাটা বিকেলের পর থেকে একটু একটু করে বাড়ছে যেন। সন্ধের পর সামান্য কিছু খেতেই সব বমি হয়ে গেল। ব্যথাটা বাড়ছে ক্রমাগত। ঘরের সব জানলা বন্ধ করে টিউব নিভিয়ে শুধু নাইট ল্যাম্প জ্বেলে বিছানায় বালিশ আঁকড়ে চুপচাপ শুয়ে থাকল। পেটের ভেতর থেকে কী যেন একটা ঠেলে বেরিয়ে আসছে আজকেই। তাকে বার করে দেওয়ার আগে নিজেই কি বেরিয়ে আসতে চাইছে সে? এত দ্রুত? সর্বনাশ! তাহলে কী হবে? কিন্তু কী করে সম্ভব এত কম দিনে…? যুক্তি আর ভয় একসঙ্গে মাখামাখি হয়ে যায়। আবার একবার মনে করতে চেষ্টা করে, সত্যিই কি এতটা বাড়াবাড়ি হয়েছিল সেদিন?…ওহ…কেন যে মনে পড়ে না। নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগে গুঙিয়ে ওঠে অনুষ্কা।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে যন্ত্রণা। ব্যথার সঙ্গে যুঝতে যুঝতে চিৎ হয়ে শুয়ে অনুষ্কা নিজের দু-পা ভাঁজ করে ফেলে। ড্রয়িংরুমে দেয়াল ঘড়িটা বেশ কিছুক্ষণ ধরে টুংটুং শব্দে কত রাত্রের জানান দিল খেয়াল নেই। ‘আঁ-আঁ-আঁ’ ব্যথায় প্রাণপণে বিছানা খামচে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরল। অসম্ভব এক অচেনা যন্ত্রণায় শরীর বেঁকিয়ে গোঙাতে থাকে ও। মুখ থেকে ফেনা বেরিয়ে আসে। ‘আঁ-আঁ-মাহ’ বুঝতে পারছিল জল ভেঙে গেছে, ভেসে যাচ্ছে বিছানা। একটু একটু করে অন্য এক অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসছে একটা কিছু। আসছে এই পৃথিবীতে। অনুষ্কার একান্ত শরীর থেকে।…এল সে। অনাস্বাদিত অসামান্য এক ক্লান্ত আরামে দু-চোখ বুজে অনেকক্ষণ একভাবে শুয়ে রইল। তারপর একটু একটু করে দু-হাতের কনুইতে ভর দিয়ে সামান্য মাথা উঁচু করে নিজের দু-পায়ের মাঝে তাকাল…এ কী! এ কী অদ্ভুত প্রাণ জন্ম নিয়েছে? শরীরটা পাখির মতো…কী যেন সেই পাখিটা? জলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল বিশাল দুই ডানা মেলে। পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে উড়ে বেড়ায়। কী যেন নামটা! কিন্তু চোখদুটো মানুষের মতো অবিকল! চেনা, বড় চেনা চোখ দুটো! সদ্য জন্মানো প্রাণটা এরমধ্যেই বেশ কয়েকবার অনুষ্কার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট ডানাদুটো ঝাপটাচ্ছে ওড়ার চেষ্টায়। অল্প অল্প সাদা পালক গোটা শরীরে। সে একবার নিজের চেষ্টা থামিয়ে স্থিরভাবে অনুষ্কার দিকে তাকাল। চেনা তাকানো…হ্যাঁ চেনা, মনে পড়ল অনুষ্কার। ভয় নয়, ঠিক কীরকম একটা অনুভূতি হচ্ছিল যেন। দমকে দমকে কাঁপুনি আসছিল। বার বার নিজের ডানাদুটো মেলে উড়ে যাওয়ার নিরলস চেষ্টা করছিল সে। আর পড়ে পড়ে যাচ্ছিল। সুতোর মতো নাড়ি দাঁত দিয়ে কেটে দিল অনুষ্কা। তার পর পরম সাবধানে আলতো করে দু-হাতের মুঠোয় তুলে ধরল নিজের আত্মজকে। ফিসফিস করে কানের কাছে মুখ ঠেকিয়ে বলল। ‘আমি চিনি তোকে।’ তারপর আরও কথা, আরও অনেক কথা বলতে বলতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল কখন…।
সকালে ঘুম ভাঙল কলিংবেলের শব্দে। ঘরের ভেতর তখনও আবছা অন্ধকার। ঘুম ভেঙেই বুঝল কলিংবেলটা অধৈর্যভাবে অনেকক্ষণ থেকে বাজছে, শরীর জোড়া ক্লান্তি। কিন্তু কী অদ্ভুত এক আনন্দ কিংবা একটা কিছু। মনে হচ্ছে মাথার ভেতর থেকে সব কিছু ধুয়ে সাফ হয়ে গেছে। কোনও ভার নেই, অতীত নেই, ভবিষ্যৎ নেই তার। বেলটা বাজছে। অনুষ্কা তাকাল তার জন্ম দেওয়া প্রাণের দিকে। সে এখন বন্ধ জানলার ধারে বসে। এক রাতেই বেশ খানিকটা বড় হয়ে উঠেছে। সারা গায়ে সাদা পালক। ডানা দুটোও এখন তার বেশ বড়, ঝাপটিয়ে জানলা দিল সে। ওড়ার জন্য সে অধৈর্য। অনুষ্কাকে জাগতে দেখে ঘরের এদিক থেকে ওদিক এক পাক উঠল। তারপর এসে বসল অনুষ্কার হাতের ওপর। ঠোঁট ছোঁয়াল আঙুলে। তারপর আবার উড়ে গিয়ে বসল বন্ধ জানলার শার্সির পাশে। যেন শুধু পাল্লা দুটো খুলে দেওয়ার অপেক্ষায় সে। অফুরন্ত উড়ানের আশা শরীর জুড়ে। অনুষ্কা হেসে বলল, ‘দেব, একটু দাঁড়া। আমি জানি কে এসেছে আজ। তাকে একটি বার দেখিয়ে নিই তোকে।’ উঠে গিয়ে দরজা খুলল, বাইরে কৃষ্ণেন্দু, অনুষ্কার দিকে তাকিয়ে।
‘ভেতরে এসো।’
‘আমি শুধু একটা কথা বলার জন্যই এসেছি, তোমাকে বিরক্ত….’
‘তুমি ভেতরে এসো।’ ক্লান্ত গলায় বলল অনুষ্কা।
‘কেমন আছ তুমি?’ থিরথিরে গলায় জিগ্যেস করল কৃষ্ণেন্দু।
ঠোঁটে আঙুল রেখে ওকে চুপ করতে ইশারা করল অনুষ্কা। তারপর বলল, ‘আমার সঙ্গে এসো এদিকে। শুধু তোমাকে একবার দেখাব বলেই এতক্ষণ তাকে আটকে রেখেছি।’
‘কাকে?’
‘এসো দেখবে।’ বলে কৃষ্ণেন্দুর হাত ধরে নিজের বেডরুমের দিকে নিয়ে গেল ও। বন্ধ দরজা খুলে অন্ধকার ঘরের ভেতর ঢুকল দুজনে। আঙুল তুলে জানলার দিকে দেখিয়ে বলল…’ওই দেখো…তোমার…কাল জন্ম নিয়েছে সে।’
দুজনেই চুপ। অনেকক্ষণ…শুধু অন্ধকার, নৈ:শব্দ্য। কৃষ্ণেন্দু আবছা অন্ধকারে কী দেখল জানা নেই, শুধু সেই আগের মতো ফিসফিস করে বলে উঠল—’এবার জানলাটা খুলে দাও।’
আমার সময়
মে ২০০৯