যে জীবন আমাদের
এবারে অনেকদিন পরে অফিসে এল ব্যারি। শ্রেয়া নিজের ডেস্কে বসে আড়াচোখে একবার ব্যারিকে দেখে নিয়ে আন্দাজে হিসেবটা করে নিল। তা প্রায় মাস তিনেক হবে, এই রে ব্যারি এদিকেই আসছে।
‘হ্যালো শ্রেয়া’ বলে পাশের একটা চেয়ার হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এসে ব্যারি বসে গেল শ্রেয়ার পাশে। ‘হাউ আর ইউ?’
‘ভালো, কী খবর, এতদিন কোথায় ছিলে?’ শ্রেয়া জিগ্যেস করল।
‘…অ্যাঁ, কোথায়?…’ কোঁকড়োনো রুক্ষ চুলগুলোর মাথাটায় রোগা রোগা আঙুলগুলো বার কয়েক চালিয়ে নিয়ে ব্যারি বলল, ‘এই তো বাড়িতেই ছিলাম,’ বলেই গলা খুব নামিয়ে বলল, ‘একটা খুব ইমপর্টেন্ট কাজে বিজি ছিলাম, পরে বলব।’
শ্রেয়াও মুচকি হেসে এইরকম ফিসফিস করে বলল, ‘ঠিক আছে, পরে বোলো।’
‘না, না, ইয়ার্কি নয়। সিরিয়াস কেস, আমার লাইফ…’
‘আরে ব্যারি, কী খবর?’ অমরেশ শ্রেয়ার পাশ দিয়ে যেতে যেতে থমকে দাঁড়াল।
‘ওহ ডিয়ার, ফাইন।’
‘বেশ বেশ’, পিৎজায় কামড় দিয়ে অদ্ভুত উচ্চারণে বলতে বলতে চলে গেল অমরেশ।
‘শংকরদা আছেন চেম্বারে?’
‘হ্যাঁ, আছেন, যাও।’
উঠে দাঁড়াল ব্যারি। ঢলঢলে প্যান্টটা টানাটানি করে খানিকটা ওপরে তুলে নিয়ে বলল, ‘যাই তাহলে দেখা করে আসি। তুমি আছো তো? অনেক কথা আছে।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আছি।’ এই রে আজ তার মানে কপালে দু:খ আছে। বকবক করে মাথা খাবে ব্যারি।
ব্যারি হাঁটা লাগাল শংকরদার চেম্বারের দিকে। শংকর গুপ্তা শ্রেয়ার বস। ‘ওয়েক আপ’ ইংলিশ ডেইলির হেড ডিজাইনার। এখন বয়স প্রায় ষাট। কোনও অজ্ঞাত কারণে অবিবাহিত। খুব ভালোমানুষ। অফিসে নিবেদিত প্রাণ।
ব্যারির হেঁটে যাওয়ার দিকে তাকাল শ্রেয়া। এই ক’মাসে রোগা ব্যারি আরও টিংটিংয়ে হয়ে গেছে। সেই যথারীতি একটা রংচটা টি শার্ট ঢলঢলে জিনসের প্যান্ট। চেম্বারের কাছাকাছি চলে গিয়ে আবার ফিরে এল ও। ‘সরি, জিগ্যেস করতে ভুলেই গিয়েছিলাম, হাউ ইজ ইয়োর হাজব্যান্ড?’
‘হি ইজ ফাইন’ বলেই ভীষণ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল শ্রেয়া, এই প্রসঙ্গটা এলেই গোটা গায়ে চামড়ার ভেতর এত অসহ্য জ্বলতে শুরু করে!
‘ভেরি গুড ভেরি গুড, হ্যাপি ম্যারেড লাইফ…ভেরি গুড’, আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে আবার ফিরতি হাঁটা লাগাল ব্যারি। শ্রেয়া আবার মাথা তুলে তাকিয়ে থাকল আনস্মার্ট বেখেয়ালি হেঁটে যাওয়াটার দিকে।
ব্যারি দাসকে শ্রেয়া চেনে প্রায় বছর দুয়েক হয়ে গেল। এই কাগজের অফিসে ট্রেনি আর্টিস্ট হিসাবে জয়েন করার কয়েক দিন পরেই পরিচয় হয়েছিল ব্যারির সঙ্গে। এমন আধখ্যাপাটে অগোছালো মাঝবয়সি অ্যাংলো লোকটার সঙ্গে কথা বলে বেশ মজাই লেগেছিল শ্রেয়ার। চল্লিশ কী বেয়াল্লিশ বয়স। রোগা, লম্বা, রোদে পোড়া লালচে গায়ের রং, একমাথা কাঁচা-পাকা রুক্ষ ঝাঁকড়া চুল। সরু কাঁধ। কোমর খুব বেশি হলে আঠাশ। রুকুদার সঙ্গে কথা বলেছিল একমনে। হঠাৎ শ্রেয়ার দিকে আঙুল তুলে জিগ্যেস করেছিল, ‘হু ইজ শি?’
সিনিয়র আর্টিস্ট রুকুদা হেসে বলেছিল ‘ওহ…ও হল আমার এক মেয়েই বলতে পারো। ওর নাম শ্রেয়া। নতুন জয়েন করেছে।’
‘তোমাদের ডিপার্টমেন্টে?’
‘হ্যাঁ।’
‘ভেরি গুড, ভেরি গুড। হ্যালো শ্রেয়া। আয়্যাম ব্যারি।’
‘হ্যালো’ বলে প্রত্যুত্তর দিয়েছিল শ্রেয়া।
ব্যারি খুব ব্যস্তভাবে হাতের বিবর্ণ প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগটার ভেতর হাত চালিয়ে দুটো মিইয়ে আসা গাছের চারা বার করে শ্রেয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘গিফট ফর ইউ। আজই বাড়িতে টবে বসিয়ে দিও। আর শিকড়ে যে মাটি দিয়ে রেখেছি সেটা ছাড়ানোর দরকার নেই, কেমন?’
শ্রেয়া তো হতবাক, এ আবার কেমন অদ্ভুত গিফট!
রুকুদা হেসে বলেছিল, ‘নিয়ে নে, এই তো শুরু হল।’
ব্যারি চলে যাওয়ার পর রুকুদা বলেছিল, ‘ব্যারি অফিসে এলেই সবাইকে ফুলগাছের চারা উপহার দেয়। আগে রঙিন মাছও নিয়ে আসত প্লাস্টিকে জলে ভরে। এখন সেটা বন্ধ হয়েছে।’ রুকুদার কাছে আরও ডিটেল পেয়েছিল শ্রেয়া। সত্যিই বিচিত্র মানুষ এই ব্যারি। পুরোনা পার্ক স্ট্রিটের বহুদিনের বাসিন্দা। চাকরি করত সি ই এস সি-তে। বউ আর এক মেয়েকে নিয়ে দিব্যি চলছিল, হঠাৎ করে ব্যারি কোত্থেকে জোটাল গাঁজার নেশা। দিনরাত গাঁজা খাওয়া, অদ্ভুত সব বন্ধুবান্ধব, ঢিলেঢালা স্বভাবের ব্যারি খুব তাড়াতাড়ি ডুবে গিয়েছিল। বউয়ের হাজার বারণ, ঝামেলা কোনও কিছুতেই কান নেই, দিনের পর দিন অফিস না যাওয়া, নন পে, বাড়ি ফেরার ঠিক নেই। বাচ্চাটার খাবার জোটে কি জোটে না। ব্যারির নেপালি বউ পাসাং নিরুপায় হয়ে ব্যারিকে ছেড়ে দিয়ে উঠল ব্যারির দাদার বাড়িতে। দাদা অবিবাহিত। একটা বেকারিতে চাকরি করত। একাই থাকত রিপন স্ট্রিটে একটা ভাড়া ঘরে। শোনামাত্র ব্যারির মাথায় আগুন। দাদার বাড়িতে গিয়ে হুজ্জতি, শেষে ওপাড়ার লোকের কাছে চড়-থাপ্পড় শাসানি খেয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছিল। তারপর থেকে আরও বাউন্ডুলে অবস্থা। চাকরিটাও গেল শেষপর্যন্ত। এই কাগজের অফিসটায় বহুদিন থেকেই যাতায়াত ছিল ওর। ও সুস্থ থাকার সময় থেকেই শখে এখানে টুকটাক ইলাসট্রেশনের কাজ করত। শ্রেয়া দেখছে ব্যারির ফ্রি হ্যান্ড ড্রয়িং যথেষ্ট বোল্ড। কনসেপশনও ক্লিয়ার। তবে কম্পিউটারটা একেবারেই জানে না। শ্রেয়াকে প্রথম দিকে বার কতক রিকোয়েস্ট করেছিল। ‘আমাকে কম্পিউটারে ছবি আঁকা শিখিয়ে দাও না।’ শ্রেয়া শেখাতেও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দু-দিনে এও বুঝে গিয়েছিল গাঁজা খেয়ে খেয়ে ব্যারির মাথাটা একেবারে গেছে। কিচ্ছু মনে রাখতে পারে না, দু-মিনিটেই সব ভুলে যায়। হাল ছেড়ে দিয়েছিল ও। ব্যারিও। রুকুদা বলেছিল, ওর খ্যাপামোয় বেশি মাথা ঘামাস না। শোধরাবার নয়। দম দিয়ে দিয়ে মাথাটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে। তবে ছেলেটার মনটা একেবারে সাদা, জানিস, কষ্ট হয়। ব্যাটা এইটুকু বয়স থেকে প্রেম করে বিয়ে করল কিন্তু বউটাকে রাখতে পারল না। মেয়েটারও দোষ নেই। অনেক সহ্য করেছে। কপালই খারাপ।’
শংকরদার চেম্বার থেকে বের হল ব্যারি। মুখটা ঝুল। তার মানে মনখারাপ। ব্যারির যেকোনও এক্সপ্রেশনই খুব প্রকট। সরল মানুষদের যেমনটা হয়।
শ্রেয়ার পাশের চেয়ারে ঝপ করে বসে পড়ল ব্যারি।
শ্রেয়া ওকে দেখেও না দেখার ভান করে কাজে ব্যস্ত রইল।
কিছুক্ষণ চুপ করে ব্যারি বলল, ‘তুমি খুব বিজি?’
‘উঁ: বলো।’
‘একটু কথা ছিল।’
‘হ্যাঁ, শুনছি বলো।’
‘প্লিজ দু-মিনিট টাইম দেবে আমাকে?’
কম্পিউটার থেকে মুখ ফেরাল শ্রেয়া। ‘বলো কী বলবে।’
‘আমি খুব প্রবলেমে। আমাকে হেল্প করতে পারো?’
‘আমি।…কী হেল্প, বলো।’
‘আমাকে তোমাদের অফিসে একটা জবের ব্যবস্থা করে দিতে পারো?’
‘জব! আমি! কী বলছ ব্যারি, আমি কী করে…!’
‘আমি খুবই মানিটারি প্রবলেমে আমি, জানো। কিছু একটা কাজ খুব দরকার।’
‘তো শংকরদাকে বলো গিয়ে।’
‘বললাম তো, শংকরদার রিপ্লাই করল, হবে না। তোর মাথায় কিছু থাকে না। ইরেসপনসিবল।’
‘হুঁ।’ শ্রেয়া এবার বুঝল চেম্বার থেকে কেন ব্যারি মুখ ঝুলিয়ে বেরিয়েছিল।
‘তুমি প্লিজ আমার জন্য শংকরদাকে একটু রিকোয়েস্ট করো না।’
‘কী করে বলি বলো তো, শংকরদা নিজেই যখন নেগলেক্ট করছে।’
‘তুমি তো ভালো মেয়ে, সিনিসিয়র। প্লিজ একবার যদি…’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, বলে দেখব।’
‘ও ডিয়ার থ্যাঙ্কস…থ্যাঙ্কস।’
‘কী ব্যারি, কেমন আছ?’ রুকুদা শ্রেয়ার পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলল। ব্যারি উত্তরে হাসিহাসি মুখ করে কিছু একটা বলার আগেই রুকুদা একইসঙ্গে হালকা ধমক দিয়ে গেল, ‘মেয়েটাকে কাজ করতে দে, বকবক করে মাথা খাস না।’
চুপসে আবার এইটুকু হয়ে গেল ব্যারির মুখ।
‘আহা রে’, কষ্ট লাগল শ্রেয়ার।
‘সরি তোমার কাজে ডিসটার্ব করছি’ বলে ধড়মড় করে উঠে পড়ল ও। ‘বাই’ বলে দু-পা এগিয়ে আবার পিছিয়ে এসে ঘাড় ঝুঁকিয়ে ফিসফিস করে শ্রেয়াকে জিগ্যেস করল, ‘অনলি ওয়ান কোশ্চেন, ভালো বায়নাকুলার কোথায় পাওয়া যায়, জানো?’
‘অ্যাঁ?’ হঠাৎ এমন একটা প্রশ্নে চমকে উঠল শ্রেয়া, ‘না তো…জানি না তো?’
‘ওকে ওকে—নো প্রবলেম…আমি খুঁজে নেব…’
ব্যারি চলে যাওয়ার পরক্ষণেই শ্রেয়ার মোবাইল বেজে উঠল, স্ক্রিনে চোখ ফেলেই অবাক। শ্বশুরবাড়ির ল্যান্ড লাইন নাম্বার, শাশুড়ি ফোন করেছে, অবাক কাণ্ড!
‘হ্যালো।’
‘হ্যাঁ শ্রেয়া শোনো, আমি একটু বেরোচ্ছি, ফিরতে দেরি হতে পারে। চাবিটা অনন্যাদের ফ্ল্যাটে দিয়ে যাচ্ছি। বুবাই এলে বোলো ওর জিনিসটা ডিপ ফ্রিজে রাখা আছে’, শ্রেয়াকে হুঁ-হাঁ কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে স্রেফ নিজের ইনফরমেশনটুকু জানিয়ে দিয়ে শাশুড়ি কট করে কেটে দিলে লাইনটা। মোবাইলটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল ও। রাগটা দলা পাকাচ্ছে।
বুবাই নামে লোকটার সঙ্গে শ্রেয়ার তিন বছর হল বিয়ে হয়েছে। কিন্তু শ্রেয়ার ভাবতে ভালো লাগে ওদের বিবাহিত জীবন তিরিশ-চল্লিশ বছর পার করে গেছে, শ্রেয়ার বয়স এখন হিসাবেরও চেয়ে অনেক বেশি। যে-কোনওদিন মরে যাবে…উহ শান্তি! কিন্তু পরক্ষণেই রাগে গা চিড়বিড় করে ওঠে। কেন মরব আমি? কী দোষ করেছি? ভাবনাটায় থুতু ছিটোয় ও, গালাগাল দেয়। মাথার ভেতর থেকে দূর হয়ে যেতে বলে। বুবাই আর ওর মায়ের ওপর ভীষণ অকৃত্রিম ক্রোধ আসে। বিয়ের আগে মাস সাতেকের প্রেম। বুবাই চাকরি করত একটা বিদেশি সফটওয়্যার কোম্পানিতে। ফেসবুকে পরিচয় হয়েছিল দুজনের। বুবাইয়ের প্রাোফাইল ভালো লেগেছিল শ্রেয়ার। ওয়াল পোস্ট, মেসেজ থেকে অ্যাপো, তারপর সটান বিয়ের ডিসিশন। তখন কত বয়স শ্রেয়ার। পঁচিশ হবে। এই ডেইলিতেই ও তখন ট্রেনি আর্টিস্ট। শংকরদা বিয়ের কার্ড হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘খুব তাড়া বিয়ের? সব ঠিকঠাক দেখেশুনে নিয়েছিস তো বাবা?’ শ্রেয়া উত্তরে কী বলবে ভেবে না পেয়ে হেসে ঘাড় কাত করেছিল। ফুলশয্যার রাতে বিছানায় বুবাই বলল, ‘শোনো মা বলেছে আমাদের ইস্যু নিতে দেরি না করতে।’ বলেই ব্লাউজের প্রথম হুকে হাত।
হাতটা চেপে ধরে শ্রেয়া বলেছিল, ‘মা বলেছে মানে? এসব ব্যাপারে তো আমরা দুজনে ডিসিশন নেব, তাই না?’
‘না মানে…তোমারই বা অসুবিধাটা কোথায়?’
‘বাহ, অসুবিধা নেই! আমার কেরিয়ারটাই ভালো করে তৈরি হল না এখনও, এর মধ্যেই এসব…না।’
‘না’ শব্দটায় ধাতুতে ঠোকা খাবার মতন আওয়াজ হয়েছিল, সেদিন আর কথা বাড়ায়নি, বুবাই, কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতেই আবার সেই আবদার, তার পর আর একটু বেশি, জোরাজুরি-বাড়াবাড়ি…
‘কী ব্যাপার কী বুবাই, এত জোরাজুরি করছ কেন বুঝতে পারছি না। আমার কিন্তু এবার বিরক্ত লাগছে।’
‘বিরক্ত আমারও লাগছে। তোমারই বা অসুবিধাটা কোথায়? জানো যখন আমার মা হার্টের পেশেন্ট, বয়স্ক মানুষ, নাতি-নাতনির মুখ দেখতে চায় তাড়াতাড়ি। বাইচান্স কোনওদিন কিছু একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেলে তখন আপশোসের সীমা থাকবে না।’
‘কিছু মনে কোরো না বুবাই, অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার হলে কোনওদিন কেন, আজ বা কালকেও কিন্তু হয়ে যেতে পারে, তখন কী করবে? তোমার তাহলে উচিত ছিল কোনও বাচ্চাকাচ্চা সমেত মেয়েকে বিয়ে করে আনা। তাহলে প্রথম দিনেই তোমার মা-র শখ পূরণ হয়ে যেত।’
‘শ্রেয়া লিমিট ক্রস কোরো না। তোমার প্রবলেমটা একটু খোলসা করে বলো না শুনি।…ফিগার নষ্ট হয়ে গেলে প্রমোশনে অসুবিধা, না কি কনসিভ করার ক্যাপাসিটিই নেই?…উঁ?’
‘তোমার সঙ্গে কথা বলা বেকার বুবাই, আসলে আমারই ভুল আগে বুঝতে পারিনি, তুমি ঠিক মানুষের পর্যায়ে পড়ো না, তার থেকে দু-এক ধাপ নীচে আছো, আগে মানুষ হও তারপর না হয় কথা বলা যাবে।’ দাউদাউ জ্বলতে থাকা মাথাটাকে আপ্রাণ ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করতে করতে কথাগুলো বলেছিল শ্রেয়া। তার পরেও তিন তিনটে বছর প্রেমহীন অভ্যাস যাপন। অবশ্য তিন বছরে একই প্রতিজ্ঞায় থাকেনি ও। অফিসে চাকরিটা কনফার্ম হয়ে যাওয়ার পর একদিন রাত্রে ও নিজেই টেনে নিয়েছিল বুবাইকে। কিন্তু সত্যিই কি ভালোবাসা ছাড়া পৃথিবীতে কেউ আসতে চায় না, নাহলে একবারের জন্যও বীজ প্রাোথিত হল না। ডাক্তার, টেস্ট, পুজো-যজ্ঞ অমুক-তমুক, সবই তো ঠিক আছে শ্রেয়ার, তাহলে?
‘বুবাই তুমিও একবার টেস্ট করিয়ে নাও না।’
‘আমি! আমি কেন?’
‘প্রবলেম তোমারও তো থাকতে পারে, তাই না? ট্রিটমেন্ট করালে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।’
‘আমি পুরোপুরি ফিট আছি। আমাকে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। আমার শা-হ কপালটাই খারাপ।’
‘একবার কিন্তু করে দেখাতে পারতে। আমাকেও তো এত কিছু করালে, কোনওটায় না বলেছি?’
‘তুমি কি তার শোধ তুলতে চাইছ?’
‘বোকার মতো কথা বোলো না তো, শোধের কী আছে, আমি সব চেক করিয়েছি, কোনও প্রবলেম নেই, এবার তুমিও একবার করে দেখবে। সিম্পল ব্যাপার।’
‘আমি কনফার্ম আমি ঠিক আছি।’
‘তাই? এতটা কনফার্ম হচ্ছ কী করে জানতে পারি?’
‘মানে! কী বলতে চাইছ তুমি?’
‘আমি তো কিছু বলতে চাইছি না, তুমিই তো বলছ।’
‘সবাইকে নিজের মতো ভেব না শ্রেয়া!’
‘নিজের মতো!…মানে?’
‘মানে তুমিই জানো।’
অনেকবার ভেবেছে শ্রেয়া…এবার ডিভোর্সটা করেই ফেলবে। আর পারা যাচ্ছে না। ইচ্ছে করে সারাদিন সারারাতও অফিসে কাজ করে কাটিয়ে দিতে। শংকরদাকে বলেওছিল বার কয়েক ওকে নাইটে করে দেওয়ার জন্য। শংকরদা জিভ বার করে উত্তর দিয়েছে ‘পাগল না কি! তোর বিয়ে হয়েছে সবে বছর দুয়েক বোধহয়—এর মধ্যেই তোকে নাইটে পাঠিয়ে দিলে তোর বর এসে আমাকে ঠ্যাঙাবে।’
ডির্ভোসের কথা ভাবলেই হুড়মুড় করে কতকগুলো মুখ চোখের সামনে চলে আসে। বাবা-মা-বোন, অস্বস্তিকর পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন। সে কী, কেন? কী করে হল? ওরা নিজেরা বিয়ে করেছিল না?…সত্যি আজকালকার…শাশুড়িও কম যায় না। সামনাসামনি যুদ্ধে না দাঁড়ালেও ঠারেঠোরে অবজ্ঞার মিসাইল ছোঁড়ে। পাড়ায় কারও বাচ্চা হলে সেই আলোচনায় বাড়ি মাত করে রাখে ক’দিন, শ্রেয়া চুপ থাকে। কিন্তু আর কত দিন? ভাবতে গেলে তালগোল পাকিয়ে যায় সব। তবে একটা ব্যাপার ও খুব ভালো বোঝে, ওর প্রেসে চাকরিটার জন্য ছেলে আর মা সবটা খাপ খুলতে সাহস পায় না। বুবাই মাঝে দু-একবার বলেছিল, ‘তুমি বরং কাগজের চাকরিটা ছেড়ে দাও।’
‘কেন?’
‘কেন মানে…এমনিই।’
‘এমনিই হঠাৎ ছেড়ে দেব!’
‘বেটার কোথাও ট্রাই করো, এখানে তো মাইনেকড়ি খুব একটা দেয় না বলো।’
‘এনভয়রনমেন্টটা তো ভালো, টাকাটাই সব নয়।’
‘হুম।’
দুই
‘কিনেছি, এই দেখো।’ প্লাস্টিকের ব্যাগটা সামান্য ফাঁক করে দেখাল ব্যারি।
‘কী?’ বলে সামনে ঝুঁকল শ্রেয়া। প্লাস্টিকের ভেতরে একটা সস্তার বায়নাকুলার।
‘আস্তে কথা বলো, কেউ জানতে না পারে’ নিজের ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়াল ব্যারি।
‘আচ্ছা, কিন্তু কেন?’
‘এটার খুব দরকার ছিল আমার।’ ফিসফিস করে বলল ব্যারি। উফ আবার নতুন খ্যাপামো, ভাবল শ্রেয়া। ‘ও আচ্ছা, ভালো হয়েছে।’ বলে কম্পিউটার স্ক্রিনে চোখ ফেরাল। ব্যারিকে একবার প্রশ্রয় দিলেই এখন রামায়ণ খুলে বসবে।
‘তোমাকে একটা গিফট দেওয়ার আছে।’
শ্রেয়া জানে গিফটটা কী ঠিক তাই। প্লাস্টিকে মোড়া কয়েকটা গাছের চারা। হাতে নিয়ে শ্রেয়া বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ।’
‘এই অফিসে তুমিই সব থেকে ভালো। আমি আর কাউকে প্ল্যান্ট দেব না।’ আহত গলায় বলল ব্যারি।
‘কেন, কী হল?’
‘রুকুদাকে সেদিন প্ল্যান্টগুলো দিলাম। বাড়ি নিয়ে যায়নি। অফিসেই ফেলে গেছে। সবক’টা প্ল্যান্ট মরে গেছে জানো।’
‘ই-স।’
‘বলো, কষ্ট হয় না?’
‘হ্যাঁ! ঠিকই তো, আচ্ছা এবার থেকে তুমি শুধু আমাকেই প্ল্যান্ট দিও, কেমন!’
উত্তরে একগাল হাসল ব্যারি। ‘এগুলো চন্দ্রমল্লিকা, আজই বাড়িতে গিয়ে টবে বসিয়ে দিও। আমি ক’দিন পর এসে তোমাকে ফার্টিলাইজার দিয়ে যাব। দেখবে সিজনে কী ভালো ফুল হবে। এত্ত বড় বড়।’
‘আচ্ছা’, বলে হাসল শ্রেয়া। ব্যারির দেওয়া চারগাছাগুলো শ্রেয়া বাড়ির ব্যালকনিতে টবে বসায়। এখনও একটা গাছেও ফুল আসেনি। ধরবে কি না তাও জানা নেই, তবে গতবছর যে চন্দ্রমল্লিকার চারাগুলো দিয়েছিল সেগুলোতে সত্যিই খুব সুন্দর ফুল হয়েছিল। এগুলোর ধরবে কি না কে জানে, কোনও গ্যারান্টি নেই। তবু এত আন্তরিকভাবে দেয় লোকটা, ফেলে দিতে পারে না।
‘তোমাকে আরও একটা জিনিস দেওয়ার আছে।’
‘আরও! কী?’
ব্যারি এদিক-ওদিক তাকিয়ে পকেট থেকে খুব সাবধানে একটা খাম বার করে শ্রেয়ার হাতে দিয়ে বলল। ‘এক্ষুনি লুকিয়ে ফেলো। পরে পড়বে।’
‘আচ্ছা’, এতে আবার কী পাগলামো ভরা আছে কে জানে!
‘আমি চলি’, বলে হনহন করে চলে গেল ব্যারি।
শংকরদা টয়লেটে গিয়েছিল। বেরোবার সময় ব্যারিকে পিছন থেকে দেখে শ্রেয়াকে এসে জিগ্যেস করল, ‘পাগলটা এসেছিল?’
‘হুঁ।’
‘আবার কী বলে?’
‘কিস্যু না, ওই যেমন বকে যায়।’
‘আবার চারা! উফ!’
‘হ্যাঁ’, হেসে ফেলল শ্রেয়া।
‘ছেলেটাকে দেখলে কষ্ট হয়। কে যে খেল ওর মাথাটা, ব্যাটার কাজে যদি একটু সিনসিয়ারিটি থাকত না তাহলে ওকে ঢুকিয়ে নিতাম। কিন্তু…’
শ্রেয়া চুপ।
‘তবে তোকে কিন্তু ওর বেশ পছন্দ। অফিসে এলে যত গল্প সব তোরসঙ্গেই। দেখিস বাবা, ওর কিন্তু বউ পালিয়েছে।’
‘শংকরদা ইয়ার্কি মারবে না কিন্তু। ভালো হবে না।’
হাসতে হাসতে চলে গেল শংকরদা।
লাঞ্চ আওয়ারে নিজের ডেস্কে টিফিন খেতে খেতে হঠাৎ মনে পড়তে ড্রয়ার খুলে খামটা বার করল শ্রেয়া। দেখি তো কী আছে? ইংরেজিতে লেখা কিছু কাগজ। ব্যারির হাতের লেখাটা বেশ সুন্দর। আলগোছে চোখ বোলাতে থাকল ও। খানিকটা পড়েই বুঝতে পারল ব্যারির মতোই ভয়ংকর এলোমেলো অগোছালো লেখাটা। পড়ে পুরোটার মানে বুঝতে পারে কার সাধ্য। লেখাটা শুরু হয়েছে ‘ইট ইজ হিয়ার বাই নোটিফাইড টু…’ নোটিশের কায়দায়। ফুল পাগলা একটা। পুরোটার সারমর্ম মোটামুটি এইরকম, ব্যারি একটা বায়নাকুলার কিনে ওর দাদার বাড়ির আশেপাশে ক’দিন ধরে হানা দিচ্ছে এবং বায়নাকুলারটা দিয়ে রাস্তা থেকে দাদার ঘরের ভেতর দেখেছে যে দাদা এবং ওর বউ একই ঘরে থাকে। বাচ্চাটাও। ব্যারির দাদা এখন ব্যারির বউকে নিজের বউয়ের মতোই ভালোবাসে। আর বাচ্চাটাও দাদাকে এখন বাবা বলে ডাকে। সেটা অবশ্য বায়নাকুলারে ও কী করে শুনতে পেল তা ব্যারিই জানে। চিঠির শেষে লেখা ও শিগগির এ ব্যাপারে আরও গোপন তথ্য বার করবে এবং তাই নিয়ে আদালতে মামলা করবে, যাতে ওর বউ এবং মেয়েকে ব্যারির কাছেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এজন্য সকলের সহযোগিতা ও শুভেচ্ছা কাম্য। শেষ পাতায় একটা ড্রয়িং। একজন লোক রাস্তায় এই ফুটে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে অপর ফুটে একটা দোতলা বাড়ির ঘরে একজন পুরুষ এবং মহিলাকে বায়নাকুলার দিয়ে দেখছে।
‘ওহ গড!’ মুখ থেকে বেরিয়ে এবং শ্রেয়ার।
‘কী পড়ছ শ্রেয়াদি?’ তমাল জিগ্যেস করল, জুনিয়র সাব এডিটর।
‘ধুর কিছু না’ বলে কাগজগুলো আবার খামে ভরে ড্রয়ারে ঢুকিয়ে ফেলল শ্রেয়া।
সন্ধেবেলা আবার এসে হাজির ব্যারি। ‘পড়েছ?’
‘হুম।’
‘কী বুঝলে?’
‘যাহ বুঝলে না! আমি তো পুরো প্রুভ দিয়েছি যে দাদা আমার ওয়াইফ আর ডটারকে জোর করে নিয়ে গেছে। ওরা দুজনেই আমার কাছে ফিরে আসতে চায়। দাদা ফিরতে দিচ্ছে না।’
‘এসব কে বলল তোমাকে?’
‘আমি রিয়ালাইজ করেছি। আর ডিসাইডও করে ফেলেছি, এই রাইটিংটা লিফলেট করে আমি দাদার পাড়ার সবাইকে ডিসট্রিবিউট করব। তাহলে সবাই জানতে পারবে। তুমি যদি একটু…’
‘দেখো ব্যারি’, ঘুরে বসল শ্রেয়া। ‘এই সব তোমার ভুল ধারণা। তোমার ওয়াইফ চলে গেছে তার জন্য তুমি রেসপনসিবল। নিজেকে আগে ঠিক করো তাহলে হয়তো কখনও ফিরে আসলেও আসতে পারে।’
‘কেন, আমি কি খারাপ লোক?’
‘খারাপ তো বলছি না, কিন্তু তোমার এসব পাগলামো, কাজকম্ম না করে, নেশা ভাং, খাওয়াবে কী ওদের?’
‘আমাকে কেউ কাজ না দিলে আমি কী করব?’
‘সেটাও তোমার দোষে। তোমার কাজে কোনও সিনসিয়রিটি নেই। আসা-যাওয়ার রেগুলারিটি নেই। এগুলো যদি ঠিক পারো তাহলে তোমার এখানেই কিছু একটা…’
‘তুমি কি আমার জন্য শংকরদাকে বলেছিলে?’ চিকচিক করে উঠল ব্যারির চোখ।
‘বলে কী হবে? তুমি দু-দিন আসবে তারপর আবার দু-মাস আসবে না। তখন কী হবে?’ কথাগুলো একটু রুক্ষভাবেই বলল শ্রেয়া।
ব্যারি চুপসে গেল শ্রেয়ার আচমকা এমন কথায়। একটু দাঁড়িয়ে থেকে চুপচাপ মাথা নীচু করে চলে গেল।
খারাপ লাগছিল শ্রেয়ার এভাবে বলতে। আর ওরই বা দরকার কী পরের ব্যাপারে অত ভাবনাচিন্তার। নিজের জ্বালাতেই…ধুস! কাজে মন দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করল ও।…কিন্তু লোকটা আশ্চর্যভাবে নিজের বউকে এত ভালোবাসে! এত কিছুর পরেও!
‘ঘরভর্তি কাদামাটি লেপছে, এটা কি ভালো হচ্ছে?’ তোয়ালে পরে বেসিনে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাড়ি কামাতে কামাতে বলল বুবাই।
গতকাল রাতে কিনে আনা ব্যালকনিতে রাখা মাটির টবটায় মাটি বসাচ্ছিল শ্রেয়া। আজকেই ভোরবেলায় উঠে নীচ থেকে লোক দিয়ে খানিকটা মাটি কাটিয়ে ওপরে এসেছে। ঝুরঝুরে আধভেজা মাটি ঘাঁটতে এত ভালো লাগে! মাটি বসানো হয়ে গেলে ব্যারির দেওয়া চারা দুটো বসাতে হবে। তারপর সামান্য জল…ভাবনাগুলো পরপর সাজাতে সাজাতে অন্যমনস্ক ছিল শ্রেয়া। আচমকা বুবাইয়ের তেতো কণ্ঠস্বরে চটকা ভাঙল। ঘুরে তাকাল বুবাইয়ের দিকে। ‘কিছু বললে?’
‘হ্যাঁ, বলছি সাতসকালে ঘরদোরগুলোয় কাদামাটি না লেপলে চলছিল না?’
‘না গো। চলছিল না’, হেসে বলল শ্রেয়া। কাজে মন দিল আবার।
গম্ভীর হয়ে গেল বুবাই। একটু চুপ থেকে আবার বাঁকা সুরে বলল, ‘হঠাৎ গাছ-গাছড়ায় এত শখ দেখছি ক’দিন ধরে, আগে তো এসব দেখিনি।’
শ্রেয়া চুপ। চারা দুটো টবে বসাল। ঝিমিয়ে আছে। শ্রেয়া বিড়বিড় করে বলল, ‘এই তো বিকেলের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবি দুজনেই।’
‘তোমার কি কথার উত্তর দিতে কষ্ট হয়?’
‘কী হল আবার?’
‘কোনও কথা কেউ জিগ্যেস করলে তার উত্তর দিতে হয়, শেখোনি?’
‘বলো কী বলছ?’ শ্রেয়া পরম উপেক্ষায় বলল।
‘বলছি গাছগুলো কি নিজেই জোগাড় করছ না কেউ সাপ্লাই দিচ্ছে?’
‘দিচ্ছে’ নির্লিপ্ত গলায় বলল শ্রেয়া।
‘কে সে?’
‘তুমি চেনো না।’
‘তবু শুনি’, রেজার চালানো থামিয়ে ঘুরে দাঁড়াল বুবাই।
হাসি পেল শ্রেয়ার পুরুষমানুষদের চিরকালের স্বভাব দেখে। ‘যাকে চেন না আমি নাম বললেও চিনবে না, তাই না।’ বলে বুবাইয়ের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল ও। বুবাই খপ করে শ্রেয়ার হাতটা পিছন থেকে ধরল। শাশুড়ি বাথরুমে স্নানে গিয়েছিল। বেরিয়ে গতিক সুবিধার না দেখে অন্যমনস্কের ভান করে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। শ্রেয়া জানে একপেট আনন্দ নিয়েই ঘরে ঢুকলেন মহিলা।
‘তা পিসটি কে শুনি? ছেলে না মেয়ে?’ চিবিয়ে বলল বুবাই।
‘শুনে তোমার কী লাভ? হাতটা ছাড়ো। সকালবেলাতে বস্তির সিনটা না-ই বা করলে।’
‘বুঝেছি। পিরিত মারানো হচ্ছে। ভালো ভালো…তা হিরোকে একবার বোলো এসব নকল চারাগাছ আর না দিয়ে একটা আসল চারাগাছ যদি তোমার পেটে গিফট করতে পারে তালে বুঝব পিরিতের দম আছে।’
অদ্ভুত স্থিরভাবে বুবাইয়ের দিকে তাকাল শ্রেয়া। তারপর নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে সটান বাথরুমে ঢুকে মুখভর্তি জমে ওঠা ফ্যানা থুতুর দলাটাকে থক করে বেসিনে ফেলল। মাথার ভেতরটায় অসহ্য ঝিঁঝি পোকার শব্দ হচ্ছে। কান ফাটানো শব্দটা গোটা শরীরে ছড়াচ্ছে দ্রুত। শাওয়ার খুলে দিল ও। আপ্রাণ ভিজতে চেষ্টা করল।
তিন
‘চা খাননি ম্যাডাম?’ কাপ ফেরত নিতে এসে বলল বিমল।
‘উঁ…না খাব না, নিয়ে যাও।’
‘আরেক কাপ এনে দিই?’
‘না, না নিয়ে যাও’, গায়ে পাক দিয়ে উঠছে বার বার, সকালে বুবাইয়ের কথাগুলো মনে পড়লেই এমন একটা কিছু হচ্ছে গোটা শরীর আত্মা মন জুড়ে, অসম্ভব তীব্র জ্বালা জ্বালা, ভীষণ একটা কিছু এই মুহূর্তে করে ফেললে যেন এর যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। পরশুর সাপ্লিমেন্টের চারটে পেজ ছাড়তে হবে আজই, সারাটা দিন কম্পিউটারের সামনে স্রেফ বসে রইল শ্রেয়া। একটা পেজও কমপ্টি হয়নি অথচ তার জন্য একটুও টেনশন হচ্ছে না। কেমন যেন একটা ঘোর…। লাঞ্চও করল না। শংকরদা এসেছিল এদিকে একবার। ‘কী রে চুপচাপ বসে আছিস কেন? দেখ বাইরে কেমন মেঘ করেছে, বৃষ্টি হবে বোধহয়। আজকে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করিস হাজব্যান্ডের সঙ্গে।’
শ্রেয়া উত্তর দেয়নি। স্থির চুপ।
বিকেল চারটে নাগাদ হঠাৎ ব্যারি এল। চোখ-মুখ টকটকে লাল, চুল উসকোখুসকো। ঠোঁটের কোণে ফোলা রক্ত জমে রয়েছে। পুরোনো শার্টটার বুক পকেট আর দুটো বোতাম ছেঁড়া। রুকুদা দেখতে পেয়ে বলল, ‘হেই ব্যারি, হোয়াট হ্যাপেন্ড?’
‘নো, নাথিং সিরিয়াস’ বলে শ্রেয়ার পাশের চেয়ারটায় এলিয়ে বসে পড়ল। রুকুদা বলল, ‘ব্যারি, আজ কিন্তু শ্রেয়াকে ডিসটার্ব কোরো না। ওর শরীর ভালো নেই’, ব্যারি রুকুদার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল একটুক্ষণ, তারপর শ্রেয়ার দিকে তাকাল বোকার মতো। শ্রেয়া একদৃষ্টে স্ক্রিন সেভারের দিকে তাকিয়ে ছিল, হঠাৎ এক ঝটকায় ফিরে তাকাল ব্যারির দিকে। ‘আচ্ছা ব্যারি এই যে তুমি অফিসে আমার কাছে এতবার করে আস, কই আমাকে কখনও তোমার বাড়িতে এক কাপ কফি খাবার জন্য ডাকো না, কেন?’ আচমকা এমন একটা প্রশ্নে বেজায় ঘাবড়ে গেল ব্যারি। আমতা আমতা করতে থাকল।
‘কী হল বলো, কেন যেতে বলো না?’
‘না-না, মানে আমার ঘরে তো কেউ…ইয়ে…’
‘কেন, তুমি থাক না? তুমি পারো না চা বানাতে?’
‘হ্যাঁ, মানে…’
‘আমি আজকে ইভিনিংয়ে তোমার বাড়িতে যেতে চাই। নিয়ে যাবে কি না বলো?’
সপাটে পরিষ্কার গলায় জিগ্যেস করল শ্রেয়া, সারাটাদিন পর।
‘আ-জ…উঁ…আজই…এখন তো…’
‘হ্যাঁ আজ, বিকেল পাঁচটার পর, ইয়েস, অর নো। কি, নিয়ে যেতে চাও না, তাই তো?—এক গ্লাস জলও কি তোমার বাড়িতে খাওয়াতে পারবে না আমাকে?’
‘ওহ ডিয়ার প্লিজ চলো, আমি সেভাবে—আসলে আমি…মানে একা তো ঘরটা …কেউ তো নেই…’
‘ডাজ নট ম্যাটার, তোমার অ্যাড্রেসটা লিখে দিয়ে যাও। গিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করো। আমি সন্ধেবেলা যাচ্ছি। ভালো চা বানাতে হবে কিন্তু। উইথ নিমকি বিস্কিট, ওকে?’ নিজের বলে যাওয়া কথাগুলো নিজের ভেতরেই ঢুকছিল না শ্রেয়ার। শরীরের বাইরেই ধাক্কা খাচ্ছিল। ভোঁ ভোঁ আওয়াজ হচ্ছিল শব্দগুলোর আঘাতে। ব্যারি একটা কাগজে অ্যাড্রেসটা লিখে ‘প্লিজ কাম’ কথাটাও লিখে দিয়ে ‘বাই’ বলে উঠে চলে গেল হন্তদন্ত হয়ে। কিছুক্ষণ সময় পার করে শ্রেয়াও উঠল। মনিটর অফ করতে গিয়ে দেখল ডান হাতের বুড়ো আঙুলের নখের কোণে রক্ত জমে রয়েছে। বেখেয়ালে নখ কাটতে কাটতে চামড়াও খেয়ে ফেলেছে কখন। আশ্চর্য জ্বালা করছে না একটুও।
এসপ্ল্যানেডের মোড়ের কাছে শ্রেয়াদের অফিস থেকে ট্যাক্সিতে লেনিন সরণি হয়ে রয়েড স্ট্রিটে পৌঁছোতে বেশিক্ষণ লাগে না। সাড়ে পাঁচটা নাগাদ চোদ্দো নম্বর রয়েড স্ট্রিটের সামনে ট্যাক্সি ছেড়ে দিল শ্রেয়া। চারপাশটা স্বপ্নের মতো আলগা, ভারহীন, মাথার ভেতর যেন কিছুই স্পর্শ করছে না। শুধু এক আশ্চর্য জ্বালা ছাড়া। সে জ্বালার প্রকট অনুভূতি নেই, কিন্তু বোধ আছে।
জায়গাটা ঘিঞ্জি, মুসলিমদের ঘরদোরই বেশি। একটা চপের দোকানের পাশ দিয়ে সরু গলি। গলির মুখেই একটা ল্যাংটো বাচ্চা হামা টানছে। বাচ্চাটাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল ও। গলির শেষে বাঁদিকে একটা কাঠের দরজা। খোলা ছিল। ভেতরে ঢুকল, আবছা অন্ধকার ভেতরটায়। সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। প্রথম সিঁড়িতে পা দেওয়ার আগে একমুহূর্ত থামল। ওপর থেকে একটা ছেলে হুড়মুড় করে নেমে আসছে। শ্রেয়ার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আপাদমস্তক মেপে গেল ওকে বিচ্ছিরিভাবে।
দোতলায় উঠতেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল ব্যারি। ‘কাম-কাম, দিস ইজ দ্য রুম।’ ব্যারি একটা পরিষ্কার জামা-প্যান্ট পরেছে। ঘরটায় ঢুকল শ্রেয়া। কেরোসিন তেলের গন্ধে ঘরভর্তি। দেখলেই বোঝা যায় নোংরা ঘরকে খুব তাড়াতাড়ি পরিচ্ছন্ন করার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে। তক্তপোশে একটা সাদা চাদর পাতা, একটা দিক ঢাউস উঁচু। ওর নীচেই নিশ্চয়ই নোংরা বালিশ, চাদরগুলো ঢাকা দেওয়া আছে। ঘরের এক কোণে পাম্প স্টোভ, কেরোসিনের বোতল, কাপ-ডিশ, চা পাতা-চিনির কৌটো, আর পাশে ভাতের হাঁড়ি, জলের কুঁজো। শ্রেয়া বসল তক্তপোশে, ব্যারি কী করবে বুঝতে পারছি না। ‘অ্যাকচুয়্যালি একা থাকি তো, পুরোনো বাড়িটা তো ছেড়ে দিয়েছি, এখানে একাই থাকি। রেন্টেড। রুমটা ডার্টি, তোমার খারাপ লাগছে জানি…’
‘চুপ করে বসো তো, আমার খারাপ লাগছে না, একটু জল খাওয়াও আমাকে।’
‘ওহ শিওর।’ কুঁজো কাত করে গ্লাসে জল ঢালতে গিয়ে নার্ভাস ব্যারি খানিকটা জল মাটিতেও ফেলল। জল খেয়ে গ্লাসটা মাটিতে নামিয়ে রাখল শ্রেয়া। ঘরে একটাই ফ্রেমে বাঁধানো বহু পুরোনো যিশুখ্রিস্টের ফটো। শান্ত দৃষ্টিতে শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে। অন্য দিকে চোখ সরাল শ্রেয়া। ব্রিজের ওপর দিয়ে মাঝরাতে মেল ট্রেন অতি দ্রুত চলে যেতে থাকলে যেমন শব্দ হয় চরাচর জুড়ে তেমনি শব্দ হচ্ছিল শ্রেয়ার বুক জুড়ে। বড় বড় শ্বাস ছাড়তে থাকল ও। ‘উ-ফ!’
‘তোমার গরম লাগছে শ্রেয়া। আসলে ঘরের এই জানলাটা খোলা যাবে না। খুললেই খুব বাজে গলা আসবে নীচে থেকে।’
‘ঠিক আছে। তুমি বরং টেবিলফ্যানটার স্পিড আর একটু বাড়িয়ে দাও।’
‘সরি। ওটা আর বাড়ে না। আমি চা বানাই তাহলে?’
‘উঁ…’
‘বানাই চা?’
‘হ্যাঁ বানাও।’ আহ-হ এত শব্দ কেন শরীর জুড়ে! ব্যারির কথাগুলো যেন বহু দূর থেকে আসছে। ব্যারি মেঝেতে উবু হয়ে বসে স্টোভ জ্বালাল। শ্রেয়া তাকাল লোকটার দিকে, মাথাভর্তি কাঁচাপাকা চুল, এলোমেলো, সরল শিশুর মতো দুটো চোখ মেলে একমনে কাজে ব্যস্ত। ছুঁচলো চিবুকের কাছে কাঁচাপাকা দাড়ি। একদৃষ্টে তাকিয়েছিল আর নিজের অজান্তেই বিছানার চাদর খামচে ধরছিল একটু একটু করে। তোমার ঠোঁটের ওখানে কী হয়েছে ব্যারি?’
ব্যারি চুপ।
‘কী হয়েছে।’
ব্যারি চিকচিকে দু-চোখ তুলে বলল, ‘আমাকে মেরেছে।’
‘মেরেছে! কে? কেন মেরেছে?
‘দাদা। আরও কয়েকজন ছিল সঙ্গে।’
‘কেন, কী করেছিলে তুমি? এদিকে এসো আমার কাছে।’
ব্যারি উঠে এল।
‘বোসো আমার পাশে। কী হয়েছিল?’
‘আজ সকালে আমি বায়নাকুলারটা দিয়ে দাদার বাড়ির সামনে গিয়ে আমার ওয়াইফ আর ডটারকে ওয়াচ করছিলাম, দাদা দেখতে পেয়ে আমাকে এসে মারল, আরও অনেকে মারল জানো বাট…বাট…’
‘কীসের…কিন্তু?’
‘আমার ওয়াইফ কিন্তু এল না আমাকে সেভ করতে। ও জানলা থেকে দেখছিল আমায়—তারপর সরে গেল…’
‘ইশ ঠোঁটের পাশটায় তো কেটে গেছে ব্যারি। মেডিসিন কিছু লাগিয়েছ?’
‘না। তুমি আমাকে লাইক করো, তাই আমার উন্ড দেখতে পেলে। সারাদিন আর কেউ দেখেনি জানো।’
‘ইশ কতটা কেটে গেছে। ঘরে কোনও অ্যান্টিসেপটিক আছে?’
‘না।’
‘এখানে বোসো আমার পাশে।’ বলে হাতটা আস্তে আস্তে বাড়াল শ্রেয়া ব্যারির ঠোঁটের দিকে।…কিন্তু অনন্তকাল যেন কেটে যেতে থাকল সে হাত পৌঁছোতে। এত দেরি কেন? এত দূরে কেন? চারদিকে সব কিছু ঘন কুয়াশার মতো ঝাপসা। সামনের কিছুই যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। অবশ ঘোরের মধ্যে প্রাণপণে হাতটা বাড়াতেই থাকে শ্রেয়া। পৌঁছোয় না, কিছুতেই পৌঁছোতে পারে না আঙুলগুলো।
‘বাট-বাট-আই-স্টিল বিলিভ মাই ওয়াইফ লাভস মি। ইয়েস, আই নো—আমার ওয়াইফের খুব ইচ্ছে ছিল আমাকে সেভ করার, কিন্তু নিশ্চয়ই ঘরের দরজা দাদা বাইরে থেকে লক করে রেখেছিল বলে ও আসতে পারেনি। আমার জন্য কষ্ট পাচ্ছিল বলে ও জানলা থেকে সরে গিয়েছিল’ বকে চলেছিল ব্যারি আপনমনে শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে। বলতে বলতেই ‘ওফ শিট’ বলে উঠে দাঁড়িয়ে লাফিয়ে গেল, সসপ্যানে টগবগ করে ফুটে উপচে ওঠা জলটাকে শান্ত করতে।
আমার সময়
ডিসেম্বর ২০০৯