ডানাকাটা পরি
আমি পরি নামাতে পারি। মন্ত্র আছে আমার কাছে। রোজ রাত্রে আমার ডাকে পরি আসে। যাকে চাই সেই-ই আসে। মন্ত্রটা অসংখ্য লাল-নীল কাগজে লেখা। কাগজগুলো সবসময় আমার সঙ্গে রাখি। এক এক পরির এক এক মন্ত্র। যে পরি আসে সে সারারাত আমার কাছে থেকে তার মন্ত্রলেখা কাগজ নিয়ে চলে যায়। তাতে আমার মন্ত্রভাণ্ডার এতটুকু কম পড়ে না। আমার কাছে অমন অজস্র আছে। নিযুত কোটি…আমি ঠিক নিজেও জানি না কত। আমার ঘরে বসে রাত্রে আমি মন্ত্রোচ্চারণ করি আর তারা এসে যায়। তারা এই শহরেব ওপর দিয়ে উড়তে উড়তে কেউ জানালা দিয়ে আমার ঘরে ঢোকে, কেউ বা দরজা দিয়ে। তাদের এক এক জনের এক এক মাপের ডানা। কারও বড়, কারও মাঝারি, কারও বা ছোট। কেউ কাছাকাছি থাকে, কেউ বা আসে বেশ দূর থেকে। তারা প্রত্যেকে আমায় শ্রদ্ধা করে, ভয় পায়। আমি সব পারি এই মন্ত্রের জোরে। যা চাই স-ও-ব।
ওদের কেউ গান গায়, কেউ নাচ দেখায়, আবার কেউ বাঁশি বাজিয়ে শোনায় আমাকে। আমি জানি ওরা সবাই ভালোবাসার ভান করে শিখে নিতে চায় আমার মন্ত্র জানার উপায়। উঁহু সেটি হচ্ছে না! সে ব্যাপারে আমি সাংঘাতিক সেয়ানা। ওদের মধ্যে অনেককেই আমার বেশ ভালোই লাগে, তবে একসময় প্রিয় পরি ছিল লিলি। এটাও ওর আসল নাম কি না জানি না। তবে এই নামটা ভালো লাগত বলে ওকে এ নামেই ডাকতাম। কোনও এক দেবতার সভায় রোজ সন্ধেয় নাচ-গান করে আনন্দ দিত। তো আমি মাঝেমধ্যেই লিলিকে ডাকতাম। যদিও এক পরি আমার দ্বিতীয় বার পছন্দ নয়, তবু কেন যে ওকে বার বার ডাকতাম! লিলির গায়ের চামড়া থেকে অদ্ভুত একটা ঘাস ঘাস গন্ধ বের হত। শীতের বিকেলের মস্ত মাঠে একা চুপচাপ দাঁড়ালে হিমে ভেজা মাঠের থেকে যেমন একটা গন্ধ পাওয়া যায় ঠিক সেইরকম গন্ধ। তবে লিলির জিভে মাখানো লালাতে অন্যান্য পরির মতোই একইরকম স্বাদ ছিল। এই কারণটা আমি বুঝি না, সব পরির কী একইরকম লালা নি:সৃত হয় জিভে? সবসময়ই কি আমার মতো দেবতাদের সান্নিধ্যে থাকার সময়? ওর বাড়ি ছিল…নাহ জায়গার নামটা আর মনে নেই। তবে মফসসল। আমি সবুজ ডিম লাইট জ্বালিয়ে সুরাপাত্রে চুমুক দিতাম আলস্যে। আর ও আমার চোদ্দোশো স্কোয়ার ফিটের একাকী ফ্ল্যাটে ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে গান গাইত। আমি আনন্দ পেলে মন্ত্র ছেটাতাম ওর গোটা শরীরে। ও আবেগে শিউরে শিউরে উঠত সেই মন্ত্র-স্পর্শে। সপাটে জড়িয়ে ধরত আমাকে। ওর ঘাসের গন্ধ মাখা, চামড়া ঢাকা শরীর দিয়ে। আমার তখন ওই গন্ধে আরও ঘন নেশা হয়ে যেত।
অন্য সব পরির ডানার রং ছিল সোনালি, রুপোলি, লাল-নীল-গোলাপি। একমাত্র লিলির ডানা ছিল ঘন সবুজ রঙের। এর কারণ ওকে জিগ্যেস করলে ও হেসে উত্তর দিত, ‘জানি না। আমার জঙ্গল ভালো লাগে।’ ডানা ঝাপটে যখন বসত আমার পাশে তখন দু-একটা পালক খসে পড়লে আমি দেখেছি ওগুলো অবিকল গাছের পাতার মতো। অবশ্য পরিরা যখন ফিরে যায় কিচ্ছু ফেলে যায় না। একটা পালকও নয়। এটাই ওদের দস্তুর। ঘন সবুজ রং আমার সব চেয়ে প্রিয়, সেই ছোটবেলা থেকে। ছেলেবেলার স্মৃতি যদিও আমার কাছে অনেকটা ঝাপসা। তবু টুকরো ছবির মতো মনে পড়ে গ্রামের কথা। গ্রামের শেষ মাথায় আমার খড়চালার বাড়ির কথা। বাড়ির পিছনে দাঁড়ালেই হু-হু সবুজ মাঠ, ধানখেত। হাওয়া বইলে ধানগাছের ঝিনঝিন শব্দ। হাওয়ার রংও যে সবুজ হয়, গন্ধও যে সবুজ রঙা হতে পারে সেই ছোটবেলায় দেখতে পেরেছিলাম, বুঝতে পেরেছিলাম আমি। বাবা-মা-দিদি-আমি-আমার শৈশব-কৈশোরের বন্ধুরা…সবাই যেন সবুজ সবুজ রঙের দেখতে ছিল। ইশকুলের মাস্টারমশাই আমার ছবি আঁকার খাতা টেনে নিয়ে হো হো করে হেসে বলত, ‘গাছও সবুজ, গরুও সবুজ, আকাশও সবুজ! করেছিস কী?’ কিন্তু কী করব, আমি যে ওই রংই দেখতে পেলাম সব কিছুতে। সত্যি কথা বলতে মাস্টার মশাইয়ের হো হো হাসিটাও তখন সবুজ রঙের দেখতে লাগত। পড়াশোনায় খুব মাথা ছিল আমার। ইশকুলে বরাবর ভালো রেজাল্ট। স্কুল পাশের পর কলেজে ভর্তি হয়ে কলকাতায় মেসে থাকতে শুরু করলাম। আমার নতুন জীবনের প্রসূতি ঘর ওই মেসে। চোখের সবুজ রং একটু একটু করে ঘষটাতে শুরু করল তখন থেকে। কলেজের মেসের বন্ধুদের সঙ্গে সিদ্ধ-নিষিদ্ধ অনেক জায়গায় যেতে যেতে ঘুরতে ঘুরতে চোখের রং পালটাতে শুরু করে দিল দ্রুত। গ্রামের আলো নিজেকে দেখায় না, দেখতে দেয় সব কিছুকে। শহরের আলো শুধু নিজেকেই দেখায়। তীব্রতা মন কাড়ে তাড়াতাড়ি। নিজের গ্রামের বাড়িতে আর ফিরতে ইচ্ছে করত না। টান কমছিল। তবে এত কিছুতেও পড়াশোনা থেকে মন সরাইনি কিছুতেই। একটা জিনিস খুব ভালো করে শিখিয়ে দিয়েছিলাম নিজেকে, এশহরে একদিন আমি শুধু টিকে থাকব না, দাপিয়ে বেড়াব, তার জন্যে ভিত চাই, ভিত। কলেজেও ভালোভাবে পাশ করে আর ঘরে ফিরে যাইনি। দু-চার জায়গায় কিছুদিন টুকটাক চাকরি করতে করতে বড় একটা জায়গায় লেগে গেল। তারপর নিজের এই দুই মুঠি আর মাথাটাকে প্রাণপণ খাটিয়ে চড়চড় করে ওপরে উঠতে উঠতে একেবারে শহরের দক্ষিণে একটা বারোতলা ফ্ল্যাটের সবচেয়ে টপ ফ্লোরের চোদ্দোশো স্কোয়্যার ফিট পুরো আমার। ব্যালকনি থেকে নীচে তাকালে অনেক দূরের কোনও গ্রহের দিকে তাকিয়েছি মনে হয়। মানুষগুলোকে সুড়সুড়ি পিঁপড়ের মতো দেখতে লাগে। দারুণ মজা হয়!
আমার ইতিহাস আমাকে খুব বেশি দূর তাড়া করতে পারেনি। এত দ্রুত গতি আমার। সে কিছু দূর পর্যন্ত আমার পিছনে দৌড়ে হাঁপিয়ে পিছিয়ে পড়েছে। আমি তাকে ফেলে অনেক অ-নে-ক এগিয়ে গেছি। পিছনে তাকালে কাউকে দেখতে পাই না। ভাগ্যিস!
আমার আসলে মনে হত লিলির সঙ্গে আমার কোথাও খানিকটা মিল আছে। ভালোবাসার অন্যতম ছুতোই হল মিল খোঁজা। সেজন্যই কি? লিলিও কি মিল খুঁজত? ঠিক জানি না, বুঝি না। লিলিকে আমি কখনও আহ্লাদে জিগ্যেস করে ফেলেছি ওর পুরোনো ফেলে আসা কথা। আর প্রতিবারই ও এক এক রকমের ইতিহাস বলেছে নিজেকে, যার কোনওটার সঙ্গে আগেরটার মিল নেই। সবটাই বানানো এবং সুখের। আমি ধরে ফেলতাম মনে মনে। কিন্তু বলতে বাধা দিতাম না ওকে। কেমন ঘোরের মধ্যে ও বলে যেত, ওর শৈশব-কৈশোর-ভিটে…জন্মদাগ…তবে প্রতিটি গল্পে ওর পুরোনো বাড়ির জায়গার নাম, ভাই-বোনের সংখ্যা পালটে গেলেও বাড়ির পাশে একটা মস্ত জঙ্গল ঠিক থাকত। সেটা হয়তো সত্যিই। ‘আমার বাড়ির ঠিক পাশেই একটা বি-শা-ল জঙ্গল ছিল’ দু-হাত টান করে ছড়িয়ে চোখ বড় করে আপ্রাণ বিশালত্ব বোঝাতে চাইত লিলি। তা হলে শুধু একমাত্র জঙ্গল ছাড়া বাকি সব কথা কি ওর স্রেফ মিথ্যে? হয়তো ঠিক মিথ্যে নয়, ওগুলো ওর স্বপ্ন-কথা। স্বপ্ন কি মিথ্যে না সত্যি? মানুষ যা পেয়েছে সেটাই কি একমাত্র সত্যি আর যা আজীবন চেয়েছে সেটা কি সত্যি নয়?
যাই হোক লিলির ইতিহাস জানার থেকে ওর ভূগোলের প্রতিই স্বাভাবিকভাবে আমার আকর্ষণ ছিল অনেক বেশি। এভাবেই চলতে চলতে জানি না কীভাবে কখন প্রেমে পড়ে গেলাম। ওর গন্ধটা…কিংবা ডানার রং…না কি সেই মিথ্যে গল্পের জন্যে…কে জানে? প্রেমই বলব অবশ্য। নইলে রোজ রোজ হরেক কিসিমের পরি নামানোর মন্ত্র জানা সত্বেও আমি কী করে একদিন পানপাত্রে একটি চুমুকও না দিয়ে ওর হাতের আঙুলে আঙুল রেখে বলে ফেলেছিলাম ‘থাকবে?’
লিলি ওই শব্দ শোনা মাত্র দুই ডানা মেলে উড়ে গিয়েছিল। তারপর আমি অনেক এই সভা, ওই সভায় খোঁজ করেছি ওর, পাইনি। সারারাত ধরে প্রচণ্ড জেদে, ক্রোধে আমার সমস্ত মন্ত্র ঢেলে ডেকেছি ওকে। কাজ হয়নি মন্ত্রে। অবাক হয়েছি নিজের পরমপ্রিয় মন্ত্রের অক্ষমতায়। কোথাও কি আনন্দও পেয়েছি মন্ত্রের অসহায়তা দেখে?…মনে পড়ে না।
অনেক সময় পার হয়ে গেছে তার পর। অন্য সব পরিদের কাছে ভাসাভাসা খবর পেয়েছি লিলির। আমার সঙ্গে না থাকলেও লিলি থাকে। অন্য একজনের সঙ্গে। বিয়ে হয়েছে লিলির। ঠিক দু:খ কিংবা রাগ অথবা বিস্ময় কিছুই হয়নি সেকথা শুনে। লিলিকে ছাড়াই পার করছিলাম আমার জীবন। তারপর হঠাৎই একদিন ওকে দেখতে পেয়ে গেলাম গড়িয়াহাটে একটা জুতোর দোকানে। বাচ্চাদের জুতো পছন্দ করছিল। ওর কোলে ছোট্ট একটা শিশু। আর সঙ্গে রোগাটে, লম্পাপানা টিপিক্যাল ছাপোষা প্যাটার্নের কালচে রঙের বছর পঁয়ত্রিশের এক যুবক। বুঝে গিয়েছিলাম লিলির সঙ্গে ও কে। আর আবাক হয়ে গিয়েছিলাম লিলির পিঠের সেই সবুজ ডানা দুটো নেই দেখে। একটুও নেই। কেটে ফেলেছে, নাকি খসে গেছে? একেবারে মেয়েদের মতো তেল চকচকে চাঁছাপোঁছা পিঠ। আমি ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি বুঝতে পেরে লিলি একবারের জন্যে স্রেফ আলগোছে আমার দিকে দৃষ্টি ফেলেছিল। চিনতে পারেনি। আমি বুঝেছিলাম ও সত্যি সত্যিই চিনতে পারেনি। কিন্তু ওকে আরও অনেক বেশি সুন্দর লাগছিল আগের থেকে। কোলের বাচ্চাটা যখন এমনি এমনি হঠাৎ হেসে উঠছিল তখন অদ্ভুত এক আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল লিলির শরীর থেকে। সুন্দর! ডানাকাটা পরি…উঁ…ডানাকাটা বউ পরি…নাহ মা পরি…ধ্যাস!
আমার অন্যান্য সব পরি জানিয়েছিল লিলির বর আর্টিস্ট, ছবি আঁকে। তবে রোজগারপাতি তেমন কিছু নয়। কোনওমতে চলে আর কি। লিলির পুরোনো পরি-জীবন কি সে লোক জানে? তার উত্তরে পরিরা বলেছিল, তাদের সেকথা জানা নেই। কিন্তু আগের সেই সুখের, প্রাচুর্যের জীবন ছেড়ে কীসের জোরে ওই চ্যাটচ্যাটে একঘেয়ে জীবনে চলে গেল লিলি? লোকটাকে দেখলেই মনে হয় গায়ে সবসময়ে ঘামের দুর্গন্ধ, নির্লোম শরীর, হাত-পায়ের নখে কালো ময়লা, ফাটা গোড়ালি, সস্তায় জাঙ্গিয়া পরে। দু-এক জায়গায় ছেঁড়া এবং সেটা নিজে কখনওই কাচে না। লিলিকে কাচতে হয়। এসব ভেবে আমি আরও অবাক হয়ে গিয়েছিলাম—’কেন-ও?’ স্রেফ এই উত্তরটা জানার জন্যে লিলিকে আমি তারপর আবার বহুবার মন্ত্রে ডেকেছি এবং সে একবারও আসেনি। অনেক দিন আগে আমি একবার ওকে জিগ্যেস করেছিলাম, ‘তুমি খুব ভালো আছো তাই না? ডানায় ভর করে যেখানে ইচ্ছে খুশি ঘুরে বেড়াও। কোথাও ফিরে আসার দায় নেই।’ শুনে হেসেছিল ও। আমার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলেছিল, ‘জানি না ভালো আছি কি খারাপ আছি। তবে একদিন নিশ্চয়ই নিজের মতো থাকব। আর ফেরার দায়ের কথা বলছ, ফিরে আসার দায় যে কত সুখের, যাদের ফেরার কোথাও নেই তারা বোঝে।’
বড় অদ্ভুত ঠেকেছিল ওর কথাগুলো। ভালোও নয়, খারাপও নয় নিজের মতো থাকা। সেটা কেমন ধরনের? কতটা সুখের? কথাটাকে ভুলে যাওয়ার জন্যে একা রেখে দিয়ে আমি রোজ আরও আরও পরি নামাতাম। আমার ভালো থাকার একক জগতে ফিরে গিয়েছিলাম। অজস্র ডানাওয়ালা পরি ভিড় করত আমার কাছে। কিন্তু তাদের শরীরে সব নকল ফুলের গন্ধ। ওদের খোলা গায়ে প্রাণপণে নাক ঘষে আমি এতটুকু ঘাসের গন্ধ পেতাম না। ক্রোধে দূর করে দিতাম ওদের। আবার ডাকতাম, আবার তাড়িয়ে দিতাম ঘৃণায়।
আর এর মধ্যেই চুপিসারে বয়েস কখন হুড়মুড় করে ঝুঁকতে শুরু করেছিল আমার দিকে। আমার মন্ত্রের ভাণ্ডার আরও ফুলেফেঁপে উঠতে থাকলেও মন্ত্র উচ্চারণ করতে গেলে জিভ জড়িয়ে যেত, আলস্য আর অচেনা ভয় জড়িয়ে থাকতে শুরু করল আমাকে। সেই ভয়টাও আমার মতোই একা। আমার মতোই ভিতু, কোণঠাসা। কিচ্ছু ভালো লাগত না আমার। ভুঁড়ি, চোখের কোল, দৃষ্টি, হাঁটাচলা স-ও-ব ঢিলে আর নতমুখী হয়ে উঠছিল। চোদ্দোশো স্কোয়্যার ফিটের পুরোটা আর আগের মতো ‘আমি’-তে ভর্তি হচ্ছিল না। গুটিয়ে ছোট হয়ে যাচ্ছিলাম। মেঝেতে সারারাত পা ঠুকে ঠুকে দুমদুম শব্দ করে হাঁটতাম। ‘আমি আছি’ এই প্রমাণ করার জন্যে। লোকের সঙ্গে গায়ে পড়ে ঝগড়া করতাম, ‘আমি রয়েছি’ জানানোর জন্যে। মানুষের আসল ভয়টা হল মৃত্যুভয়। আমার মধ্যে কেঁচোর মতো নি:শব্দে গর্ত খুঁড়ে ঢুকতে শুরু করেছিল সে। কোঁকড়ানো কেন্নোর মতো হয়ে উঠেছিল আমার আত্মা। চোখের সামনে সবকিছুর রং ফ্যাকাশে আর একইরকম মনে হত। ঘুম হত না কোনওদিনই। কড়া ঘুমের ওষুধ খেতাম। আচমকা একদিন স্বপ্নে দেখলাম একটা বিস্তৃত সবুজ আকাশের মধ্যে দিয়ে উড়ছি। শোঁ-ও শোঁ-ও শব্দ হচ্ছে আমার উড়ানে। উড়তে উড়তে পাশে তাকিয়ে দেখি একটি মেয়েও আমার সঙ্গে সঙ্গে উড়ছে। মুখটা দেখতে পেতাম না। অস্পষ্ট ঘষা ঘষা। বার বার চিনতে, ভালো করে দেখতে চেষ্টা করেছিলাম, কিছুতেই পারছিলাম না। উদ্বেগে ঘুম ভেঙে উঠে বসতেই এতদিন পর হঠাৎ লিলির কথা মনে এল। আবার খুব ইচ্ছে হল ওর সঙ্গে কথা বলতে। আর ওর গায়ের সেই গন্ধটা…সেই অদ্ভুত গন্ধটা একবারের জন্যে প্রাণপণে নিতে। আমি আমার সর্বস্ব ঢেলে দিনরাত এক করে ডাকতে থাকলাম ওকে। জানতাম ও আসবে না। তবু ডাকতে ডাকতে আমার গলা বসে গেল। এল না। খুব আনন্দ হচ্ছিল আমার। কেন কে জানে! কিন্তু আমি থামতেই আচমকা ও এল। আমাকে অবাক করে দিয়ে, নিরাশ করে দিয়ে ছাদের কার্নিশ ধরে বুক ঘষটে কোনও মতে হিঁচড়ে ঘরে ঢুকল আমার, বহুকাল পরে। অপুষ্টির আলগা থলথলে চেহারা, অনেক দিনের অনভ্যস্ত রং মাখা দুই গাল, ঠোঁটে কড়া লাল লিপস্টিক, ঝলমলে বেমানান শাড়ি আর ব্লাউজের ভিতর ঢিলে দুই বুক নিয়ে আমার ঘরে এসে এমনভাবে হাঁ করে হাঁফাতে থাকল যেন পৃথিবীর সব অক্সিজেন এই মুহূর্তে ওর চাই। বললাম ‘বসো।’ ও বসল সোফাতে, টেবিলের জলের বোতল তুলে অনেকটা জল খেয়ে চোখ বুজে বসে রইল কিছুক্ষণ। ডিম লাইটে ওর আঁচল সরে যাওয়া খোলা স্ফীত পেটটা দেখে ক্লান্ত ব্যাঙের মতো মনে হচ্ছিল। সরাসরি জিগ্যেস করলাম ‘এলে যে?’
‘তুমিই তো ডাকলে।’ হাসল লিলি। কালচে ছোপ পড়া দাঁত, পান খায় এখন!
‘আবার আসছ তাহলে আজকাল?’ গলায় ঘৃণা মিশিয়ে বললাম আমি।
‘হ্যাঁ-এ-হ্যাঁ-হ’ হাই তুলল ও। ঠোঁট চেটে হেসে বলল, ‘আমি তো ভাবলাম তুমি বুঝি ভুলেই গেছ আমাকে।’
ভুলতে পারলে খুব ভালো হত বিশ্বাস করো। না বলে চুপ থাকলাম। জানতে ইচ্ছে করছিল, তোমার গায়ের সেই গন্ধটা আছে এখনও?
বললাম, ‘তোমাকে একেবারে লোমওঠা ধ্যাসড়ানো সস্তার পরিদের মতো দেখতে লাগছে।’
শুনে গায়ে না মাথা আলস্যের হাসি হাসল লিলি। ‘তাই বুঝি?…অ্যাই তোমার তো প্রচুর চেনাশোনা, আমাকে দাও না একটা সভায় ঢুকিয়ে। আমি এখনও নিশ্চয়ই সব ভুলিনি বলো?’
‘সেটা আমি কী করে জানব? যাক গে তোমার হাজব্যান্ডের খবর কী?’
‘ও থাকে না আমার সঙ্গে, অ-নে-ক দিন!’
‘তাই-ই!’
‘হ্যাঁ।’ একই ক্লান্তি ওর গলায়।
‘তাহলে তোমার বাচ্চাটা?’
‘ও কোথায় যাবে, আমার কাছেই আছে।’
‘কত বয়েস এখন?’
‘এবছর ক্লাস থ্রি হল। পড়াশোনায় খুব মাথা।’ জিতে যাওয়ার সামান্য আলো পড়ল ওর চোখ-মুখে। ‘তবে ভীষণ দুরন্ত।’
আমি ওর মুখোমুখি এসে বসলাম। ‘তোমাদের অনেক দিন আগে একবার একটা জুতোর দোকানে দেখতে পেয়েছিলাম। সেদিন তোমার পিঠে ডানা ছিল না। আবার কি নতুন করে গজাল না কি?’ তাচ্ছিল্য নিয়ে হেসে বললাম আমি। সঙ্গে সঙ্গে দু-হাতে নিজের মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল লিলি। সামনে ঝুঁকে কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকল। আর আমি কষ্ট পেতে পেতে দেখতে থাকলাম ওর পিঠে জোর করে ফুটিয়ে গোঁজা দুটো নকল ছোট ডানা, যা ওর নিজের নয়। পিঠে হাত রেখে একটানে ডানা দুটো উপড়ে ফেলে দিলাম আমি। পিঠ থেকে খানিকটা বদরক্ত বেরিয়ে এল। ওর ঘাড়ের কাছে মুখ রাখলাম। লিলির কানের লতির কাছ থেকে ফিকে…খু-উ-ব হালকা ঘাসের গন্ধ আসছে। অনেক দূর থেকে যেন। একবুক গুড়গুড় শব্দ নিয়ে আমি ওর কানে ফিসফিস করে বললাম—’আমিও আর মন্ত্র পরি নামাতে পারি না। তুমি আজ এমনিই এসেছিলে!’
সানন্দা
জুন ২০০৯