চক্ষুদান

চক্ষুদান

‘কী? কীরকম?’

‘দা-রুণ…ওহ…খক খক… ওহ!’ ‘দারুণ’ শব্দটা শেষ করার আগেই গলায় থুতু আটকে খাবি-টাবি খেয়ে একশা হল শতাব্দী। ওর মাথায়-পিঠে থাবড়া মেরে-টেরে মোটামুটি পজিশনে নিয়ে আসতেই, বহুদিন পর বরুণকে ঝপাত করে ওর পেডি থেমে ম্যানি, টোটাল কিওর করা বডি নিয়ে জাপটে ধরল শতাব্দী। খুব সুন্দর হালকা একটা গন্ধ বেরোচ্ছে বরুণের সাঁইত্রিশ বছরের বউ শতাব্দীর শরীর থেকে। দুটো বেডরুম, কিচেন, টয়লেট সব ঘুরে-টুরে প্যারিস করা মসৃণ দেওয়ালে বার বার হাত বুলিয়ে আবার দৌড়ে এসে বরুণকে আস্ত একটা চুমু খেয়ে ফেলল শতাব্দী। এখন বোধহয় বরুণের মুখে গন্ধ নেই। তারপর রুমালে নিজের ঠোঁট মুছে জিগ্যেস করল, ‘কেমন অ্যাডভান্স পড়ল?’

‘ওটা তোমার জিগ্যেস করা বারণ।’ আদুরে গলায় বলল বরুণ।

পাক্কা পঞ্চাশ হাজার টাকা অ্যাডভান্স দিয়েছে দমদম মেট্রো স্টেশনের ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিতে। পাঁচতলা ফ্ল্যাট। বরুণ নিয়েছে চারতলায়। বেডরুমে দক্ষিণ-পশ্চিমে বড় বড় জানলা, ছোট ব্যালকনি। মোট সাড়ে ছ-শো স্কোয়ার ফুট। অফিস কলিগ সঞ্জয় খোঁজ দিয়েছিল ফ্ল্যাটটার। ফ্ল্যাটের মালিক ওর চেনাশোনা। শতাব্দীকে কিছু না জানিয়ে প্রায় মাস খানেক ধরে সত্তর হাজার অ্যাডভান্স আর তিন হাজার টাকা ভাড়ার ফ্ল্যাটের মালিককে অনেক ঝুলোঝুলি করে পঞ্চাশ আর আড়াইতে নামিয়েছে বরুণ। অবশ্য এর কিছু কৃতিত্ব সঞ্জয়ের প্রাপ্য। বরুণ নিশ্চিত ছিল শতাব্দীর ফ্ল্যাটটা পছন্দ হবেই। একে তো হাঁটাপথে মেট্রো স্টেশন। মেট্রোয় এসপ্ল্যানেডে নেমে ওর স্কুল হাঁটাপথে, বড়জোর পাঁচ-সাত মিনিট। বরুণকে অবশ্য এক্সাইডে নেমে বাস ধরে মিন্টো পার্ক যেতে হবে। সেও তো একটুখানিই।

বরুণ একটি অটোমোবাইল কোম্পানির অ্যাকাউনট্যান্ট। শতাব্দী কলকাতার নাম করা একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের হিস্ট্রি টিচার। বরুণের চেয়ে মাসে হাজার চারেক বেশি পায়। বরুণ বাড়িতে সময় পেলে টিভি দেখে। ওই একটা মাত্র নেশা এযাবৎ টিকে আছে। শতাব্দীর নেশা বইয়ের। দর্শন, উপন্যাস, কবিতা থেকে শুরু করে চিত্রকলা, মনস্তত্বের বইয়ে বাড়ি ঠাসা। একটা মানুষ এত বই কী করে পড়ে ভাবলে অবাক হয়ে যায় বরুণ। অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ হয়েছিল দুজনের। তখন শতাব্দীর চেয়ে বরুণের মাইনে ছিল বেশি।

‘সামনেই একটা পার্ক আছে, নীলের অসুবিধা হবে না।’

‘খেলার সময় পায় কোথায়?’ গলায় একগাদা চিন্তা ঢেলে শতাব্দী বলল, ‘কিন্তু হ্যাঁ-গো, ওর স্কুল, টিউশন?’

‘স-ব ঠিক আছে।’ বরুণ বরাভয়ের ভঙ্গি নিল, ‘বি টি রোড দিয়ে ওদের স্কুলের বাস যায়। আমি খোঁজ নিয়েছি।’

‘বাব্বা, তুমি হঠাৎ…।’ চোখেমুখে একরাশ মুগ্ধতা ঝাঁপিয়ে পড়ল শতাব্দী। বিয়ের প্রথম দিকে বছর খানেক যেমন ছিল। বরুণ ভাবল আর একটা চুমু জুটবে, হল না। ওর কাঁধে হাত রেখে নিজের জুতো খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল শতাব্দী।

নীল বরুণ-শতাব্দীর একমাত্র ছেলে। ভালো নাম অগ্নিদেব। বয়স ছয় বছর। শ্রীরামপুরে একটা ভালো স্কুলে ক্লাস থ্রি-তে পড়ে। বরুণের পুরো নাম বরুণদেব। ‘দেব’টা ব্যবহার করে না, লেখে বরুণ চ্যাটার্জি। ওর বাবার নাম ছিল বাসুদেব। এমন নয় যে ওদের নিজের বাড়ি নেই, অন্য কোথাও ভাড়া থাকে। রিষড়ার বাগপাড়ায় আট কাঠা জমির ওপর বরুণের পৈতৃক ভিটে। সিক্সটি ফোরে বাবা বানিয়েছিলেন। বাড়ি থেকে আরও খানিক পিছনে গেলেই ধানখেত। ছোটবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে ধানখেত পার হতে গিয়ে বহুবার সবুজের মধ্যে হারিয়ে গেছে বরুণ। লোকে রাত্তিরে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছে। মায়ের ঠ্যাঙানি তার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। কৈশোরেও বন্ধুদের সঙ্গে খেতের আলে লুকিয়ে বিড়ি খেয়েছে, আড্ডা মেরেছে। তারপর ধীরে ধীরে যেমনটা হয়। চাকরি-বিয়ে-ছেলে-স্কুল। কয়েকটা জিনিস অবশ্য পালটায়নি। এখনও সে বাড়ি থেকে রোজ সাইকেল চালিয়ে রিষড়া স্টেশনে আসে। দোকানে সাইকেল রেখে লোকাল ট্রেনে হাওড়া, তারপর বাস। পনেরো বছর ধরে এই চলছে। বরুণ বের হয় সকাল ন’টা নাগাদ। শতাব্দী আটটায়, কখনও সাড়ে আটটায়। কখনও রিকশা ধরে, কখনও অটো, যেদিন যা জোটে। বরুণের তো আরও দুর্ভোগ। ভিড় ট্রেনে উঠে কোনওদিন ভাগ্যে বসার সিটের একেবারে ধারে ছ-ইঞ্চি জায়গা জুটে গেলে ‘ও দাদা আর একটু চেপে বসুন না…আপনাকে বলছি…ও দাদা…’ এইভাবেই জীবনটা স্রেফ অ্যাডজাস্টমেন্টে চলে গেল।

চাকরিজীবনের প্রথম দিকে রোজ ইস্ত্রি করা জামা, পালিশ করা জুতো পরত বরুণ। ক’দিন পরেই বুঝে গেছিল এসবের ভ্যালু নেই। ট্রেন-বাস উজিয়ে যখন অফিস টয়লেটে ঢুকে নিজেকে আয়নায় দেখত, তখন বেশ কিছুক্ষণ সময় লেগে যেত নিজেকে চিনতে। অন্যের গায়ের ঘামে-কাদায় মাখা কোঁচকানো জামা, মাড়িয়ে দেওয়া জুতো। শতাব্দীর অবস্থাও প্রায় তাই। তুলনামূলক ফাঁকা লেডিজ কম্পার্টমেন্টের দিকে তাকিয়ে বরুণ আগে ভাবত মহিলা হওয়া সবচেয়ে সুখের। কী ফুরফুরে আরামে তেনারা আসেন-যান। বিয়ের পর শতাব্দীর কাছে শুনে বুঝেছে ওখানের অবস্থাও প্রায় একই।

‘জানো, সালোয়ারের ওড়নাটা যদি কারও গায়ে একটু লেগে থাকে, এমনভাবে খ্যাঁক খ্যাঁক করে সরিয়ে নিতে বলে, যেন আমার ঘর মোছার ভিজে ন্যাতাটা ওর গায়ে ঠেকিয়েছি!’ ঝগড়ার যে কত বিচিত্র বিষয় হতে পারে, তার কয়েকটা উদাহরণ শুনেই হাঁ হয়ে গিয়েছিল বরুণ।

হেদিয়ে পড়ছিল দুজনেই। প্রথম দিকে দুজনেরই রোজগার কম ছিল। সঙ্গে বয়সটাও কম ছিল বলে চালিয়ে গেছে। এখন শতাব্দী একটু ভারী হয়েছে। বরুণও প্যান্টের হুক তলপেটে আটকায়। আর পোষাচ্ছিল না এই ভাতে মরা রৌদ্রে পোড়া জীবন। কলকাতায় থাকার প্ল্যানটা মাস ছয়েক আগে শতাব্দীই একদিন দিয়েছিল। বরুণ প্রথমটায় আঁতকে উঠেছিল শুনে। ওদের বাড়িটা বিশাল। ইংরেজি এল শেপের। ঘরের লাগোয়া লাল সিমেন্টের বারান্দা। বাড়ির সামনে তুলসীমঞ্চে ন্যাড়া শুকনো তুলসীগাছ। মোট ন-টা বড় বড় ঘর। সবক’টা একেবারে তৈরি হয়নি। বরুণের জন্মের আগে পাঁচটা ছিল, চারটে ঘর বরুণ নিজের চোখে হতে দেখেছে। বাবা আগে থাকত পাইকপাড়ায়, ভাড়াবাড়িতে। মায়ের কাছে শুনেছে বাবার ভীষণ স্বপ্ন ছিল নিজের, একেবারে নিজের একখানা বাড়ির। রোজগার কম ছিল বলে কলকাতার দরে কুলোয়নি। তাই এই রিষড়ার বাগপাড়ার জমি কিনে পেল্লায় একখানা বাড়ি বানিয়ে বরুণকে দিয়ে গেছেন। বরুণের এখনও মনে পড়ে প্রতিবছর শীতকালে বাড়ির সামনে লরি থেকে ইট নামত, বালি পড়ত। সিমেন্টের ভ্যান আসত পরপর। বাবা দিনের পর দিন অফিস কামাই করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। নতুন ঘর উঠছে, কিংবা মস্ত মেরামত হচ্ছে। অনেক সময় নিজেই মিস্ত্রিদের সঙ্গে কাজে লেগে পড়তেন। বাবার অত্যন্ত প্রিয় ছিল এই বাড়ি। দেওয়ালের প্রতিটি ইট কেমন সব মুখস্থ ছিল বাবার। এই পাড়াটার জমি নীচু। বর্ষায় একহাঁটু জল জমে যায়। যার ফলে বছর বছর জমিতে মাটি ফেলেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি বাবা। বাড়ির ভিত বসে যাচ্ছিল। লিংটেলে লম্বা ফাটা দাগ। কোনও রিপেয়ারিং বেশি দিন টিকত না। আজীবনের রোজগারের সিংহভাগ স্রেফ বাড়িটাকে খাইয়ে গেছেন বাবা। ইটে নোনা। চুন খসে পড়ে। ফাঁপা প্লাস্টার।

‘ঘর হচ্ছে লক্ষ্মী, বুঝলি। এর জন্যে খরচ করলে সঞ্চয় কখনও কমে না, বাড়ে।’ মারা যাওয়ার কিছুদিন আগেও বিছানায় শুয়ে বরুণকে বুঝিয়েছিলেন বাবা। তখন রোগটা গোটা শরীর বিষিয়ে তুলেছে। হাড়ের ক্যানসার। সেই খরচের চাপেই বরুণ আর শতাব্দী জেরবার। তার মধ্যেই বাবা ডেকে বললেন, ‘সামনের দিকে সবচেয়ে পুরোনো সুরকির গাঁথনিওলা ঘরটায় নোনা ধরে সিলিং, দেওয়াল থেকে প্লাস্টারের চাঙড় খসে পড়েছে। পুরো চটিয়ে আবার প্লাস্টার করতে হবে।’ বরুণ বোঝাল কোনও লাভ নেই। এই পুরোনো বাড়ি, বছর ঘুরতে ঘুরতে আবার হবে। বাবা শিশুর মতো অভিমানী গলায় বলেছিলেন, ‘লাভ নেই বললে হয়! তোরা তো জামাকাপড় কিনিস, পরিস, তো একটু সেলাই খুলে গেলে কি ফেলে দিস জামাটা, না সেলাই করে নিস?’ বল?’ বরুণ আর কথা বাড়ায়নি। রিপোয়ারিংও করেনি। কয়েক দিন পর মা বলতে এসেছিল বাবার হয়ে। ‘হ্যাঁরে মানুষটা এতবার করে বলছে, একবার দে না করে। আর ক’টা দিনই বা…’

‘দেখো মা, এই ভাঙা বাড়িতে টাকা ঢালার মতো ফালতু খরচ আর আমি করতে পরব না। এমনিতেই এত খরচ…’ কথাটা শেষ করেনি বরুণ। মা-ও বুঝে চুপ করে গেছিল। বাবাও চুপ হয়ে গেছিলেন একেবারে। তার পর থেকে বরুণের সঙ্গে আর প্রায় কথাই বলতেন না। মাস কয়েক পর চুপ থাকতে থাকতেই একদিন চলে গেলেন বাবা—যাঁর কাছ থেকে বরুণ শিখেছিল জলছাদ কাকে বলে, ছাদ ঢালাইয়ের দিন কেন মিস্ত্রিদের মিষ্টি খাওয়াতে হয়, নতুন মেঝে হওয়ার পরের দিন কেন দরজায় মাটির বেড় দিয়ে ঘরে গোড়ালি-জল করে রাখতে হয়। আরও অনেক কিছু।

‘মা জানে?’

‘উঁহু।’

‘বলোনি?’

‘বলব, সময় হলে। চলো এবার।’

‘আর একটু থাকি না?’ আদুরে গলায় বলল শতাব্দী।

‘আর ক’দিন পর থেকে পুরোটাই থাকতে হবে ম্যাডাম,’ গর্বিত গলায় বলল বরুণ, ‘চলো, চলো, আরও দেরি হলে নীল আবার চটে যাবে।’

আজ নবমী। নীলকে ঠাকুর দেখতে নিয়ে যেতে হবে। দুপুরে দুজনে মা আর নীলকে ‘একটা কাজ আছে’ বলে বেরিয়েছিল। নীলকে ইচ্ছে করে নেয়নি বরুণ। ও ব্যাটা বাড়ি ফিরে ঠামকে ঠিক বলে দেবে সব। মা শুনলেই তুমুল আপত্তি, কান্নাকাটি শুরু করবে। পুজোর এই ক’টা দিন ছুটির মধ্যে ফালতু অশান্তি পোহাতে ভালো লাগে না।

‘ঘরটা যা সাজাব না! দেখবে হাঁ করে।’

‘বেশ, দেখব।’ হাসতে হাসতে বলল বরুণ।

‘তোমাদের বাড়িটা সত্যিই বাইরে থেকে দেখলেই মনে হয় হরপ্পার সঙ্গে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে।’

‘তোমাদের বাড়ি’। বিয়ের পনেরো বছর পরেও এই শব্দটা ব্যবহার করে শতাব্দী। কেন, কে জানে! প্রত্যেক বারই ঝিনঝিন করে ওঠে বরুণের কান দুটো।

দুই

আজ একাদশী। অনেক বেলায় ঘুম থেকে উঠল। মাথাটা ভার হয়ে আছে। কাল দশমীর রাতে পাড়ার বন্ধুরা মিলে ক্লাবে চুটিয়ে আড্ডা মেরেছে। শ্যামল দুটো সেভেন ফিফটির ব্লু লেবেল এনেছিল। ছ’জন মিলে মটন চাপ দিয়ে মেরে অনভ্যাসের টাল খেতে খেতে অনেক রাত্রে কোনওমতে বাড়ি ফিরেই বিছানায় ঝপাস। মাঝরাতে বমি করে বিছানা, ঘর ভাসিয়েছে বরুণ।

‘অভ্যেস নেই যখন কী দরকার ওসব ছাইভস্ম খাওয়ার।’ স্রেফ এইটুকু বলে শতাব্দী নিজে হাতে বমি সাফ করেছে। বরুণ জানে এর বেশি শতাব্দী এখন কিছুই বলবে না। বরুণের বহু দোষ হাসিমুখে বরণ করবে। নইলে ওই বমি বরুণকেই ন্যাতা-বালতি নিয়ে মুছতে হত। আজকে যদিও বরুণের অফিস খুলে গেছে, তবে ও যাবে না প্ল্যান করেই রেখেছিল। চার দিন টানা ছুটির পর যে একটা ছুটির রেশ জন্মায় সেটা কাটাতে আর একটা ছুটি লাগে।

‘উঠেছ?’ চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, শতাব্দী, ‘ওদিকে শোনও তোমার ছেলের কথা।’

‘কী হল সাতসকালে?’

‘বাবু এবাড়ি ছেড়ে এক পাও অন্য কোথাও নড়বেন না বলেছেন। এখানকার বন্ধুরা না কি খুব ভালো। তারপর উত্তর মাঠটায় না কি পার্ক তৈরি হচ্ছে। আমি শিওর তোমার মা এসব শিখিয়ে দিয়েছে নীলকে।’

মাথা গরম হয়ে গেল বরুণের, ‘তোমারই বা কী দরকার ছিল সক্কালেই ওদের এসব বলার! যা বলার আমিই বলতাম।’

‘তুমি বলতে! তাহলেই হয়েছে। বছর গড়িয়ে যেত তোমার বলতে। মা চোখ পাকালে এখনও তো ফ্যাক করে কেঁদে ফেলবে।’

‘ফালতু কথা বোলো না তো! নীলকে ডাকো।’

শতাব্দী বেরিয়ে গেল। একথা অবশ্য ঠিক, বাবা ছিল বরুণের বন্ধুর মতন। জীবনে মারধর তো দূরের কথা, কোনওদিন বকাঝকাও করেননি। পিটুনি, শাসানি সব মায়ের কাছ থেকে। সংসার চালানোর পুরো দায়িত্ব ছিল মায়ের। বাবা শুধু মাইনের টাকাটা মা-র হাতে তুলে দিয়েই খালাস। যার ফলে এই সংসারের ওপর মায়ের একটা অদৃশ্য কর্তৃত্ব চলে এসেছিল বরাবর। বরুণের বিয়ের পরপরও সেটা ছিল। শতাব্দী চাকরি করা আপডেটেড মেয়ে বলে এসব নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায়নি। এমনিতে শাশুড়ি-বউতে যেমন টক-ঝাল-মিষ্টি সম্পর্ক হয় তেমনই ছিল। ‘তোমার মায়ের খুব বড্ড বেশি’ কিংবা ‘ভদ্রমহিলা নিজেকে যে কী ভাবেন?’ এমন টুকটাক মন্তব্য ছাড়া বরুণকে বিশেষ আর কিছু পোহাতে হয়নি। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর কী এক অদ্ভুত কারণে মা ক্রমশ গুটিয়ে নিয়েছিল নিজেকে। নীল ছাড়া বরুণ আর শতাব্দীর সঙ্গে খুব বেশি একটা কথাবার্তা বলত না। ঠাকুরঘর আর নিজের ঘর নিয়েই ব্যস্ত থাকে সারাদিন। বরুণ রান্নার লোক রেখে দিয়েছিল বলে রান্নাঘরের দায়িত্বটা অনেকদিন আগেই মায়ের কাছ থেকে ছেড়ে গিয়েছিল।

নীল হুড়মুড় করে ঢুকেই ঘোষণা করল, ‘আমি যাব না। কোথাও যাব না।’ ক্লাস থ্রি-তে পড়া ছেলের আপ্রাণ বিদ্রোহ। বরুণও ওর বাবার মতো চেষ্টা করে ছেলেকে বকাঝকা ছাড়া মানুষ করতে। শাসকের ভূমিকাটা শতাব্দীর। অবশ্য নীল এক কথায় ভালো ছেলে। শুধু একটু একগুঁয়ে, আজকালকার ছেলেমেয়েদের মতো।

‘এদিকে আয়, আমার পাশে বোস’, বলে নীলকে দু-হাতে তুলে নিজের পাশে বসাল বরুণ।

নীল হাঁ করে বরুণের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, ‘কাল রাত্তিরে তোমার ভমিটিং হয়েছিল?’

একটু চমকাল বরুণ, ‘কে বলল? মা?’

‘না, আমি দেখেছি।’

‘সে কী রে, উঠে গেছিলি!’

‘হুঁ। এখন আর করবে না তো?’

‘না-না।’ হেসে ফেলল বরুণ।

‘জানো, বিড্ডুর বাবা রোজ রাত্তিরে তোমার মতো ভমিট করে।’

‘অ্যাঁ, কে বলল?’

‘বিড্ডুই বলেছে।’

নীলের বন্ধু বিড্ডুর বাবা অয়ন মুখার্জি, সিটিও। বউটা ব্যাপক দেখতে। লোকটা ঘুষখোর তা জানা, কিন্তু মালখোর জানা ছিল না। জেনে অদ্ভুত ভালো লাগল বরুণের।

‘আর কিছু বলেছে?’ জিগ্যেস করেই বরুণের মনে হল, ছি-ছি নিজের এইটুকু ছেলেকে এসব কী জিগ্যেস করছে!

‘তোকে কী বলেছে মা?’

‘আমরা এখান থেকে চলে যাব কলকাতায়। কিন্তু আমি যাব না বাবা, আমার বন্ধুরা সব এখানে। আমি যাবই না। তারপর উত্তর মাঠে…’

‘শোন শোন, আমরা যেখানটায় যাব, সেখানে আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি ওখানে তোর প্রচুর বন্ধু হবে। সবাই খুব ভালো। আমি নিজে কথা বলেছি। আর ফ্ল্যাটটায়, মানে আমাদের নতুন বাড়িটার একদম সামনেই দারুণ একটা পার্ক। ছ-খানা বড় বড় দোলনা আছে, সুইমিং পুল আছে।’

নিজের ছয় বছরের ছেলেকে সাতসকালে বেমালুম ঢপ মেরে আড়চোখে তাকাল বরুণ। সোজাসুজি তাকাতে অস্বস্তি হচ্ছিল। বেগতিক পরিস্থিতি দেখলেই বরুণ চিরকাল এভাবেই ফেস করে এসেছে। শতাব্দী রেগে গেলে বলে ‘এসকেপিস্ট’, অবশ্য এখন বেশ কিছু দিন বলবে না।

‘কিন্তু আমাদের আমগাছ আর পেয়ারাগাছ দুটো?’

‘ওগুলো অবশ্য…’ থেমে গেল বরুণ। হিমসাগর আর পেয়ারাগাছ দুটো বাবার বসানো। সবক’টা গাছেরই ফলন বেশ ভালো, পেয়ারাগুলোর ভেতরটা লাল। বাবা লাগিয়েছিলেন। তখন বরুণ কলেজে পড়ে।

‘তবে আমরা তো আর পুরোটা চলে যাচ্ছি না।’

‘তবে?’

‘এ মা! মা তোকে সবটা বলেনি?’

‘না তো, কী?’ ছেলের চোখে চিকচিক করে ওঠা আশা মাখানো কৌতূহল।

সেটাকে আরও চাগিয়ে দিয়ে বরুণ আয়েশ করে বলল, ‘আমরা তো এই বাড়িটা পুরোপুরি ছেড়ে দিচ্ছি না। এভরি উইকএন্ডে এখানে এসে থাকব।’

‘সত্যি!’

‘হ্যাঁ। তাহলে তোর পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গেও দেখা হবে।’

‘কিন্তু বাবা…’

‘কী কিন্তু?’

‘ঠাম কাঁদছে।’ বিরক্ত লাগল বরুণের।

‘কেন, কাঁদার কী হল?’

‘আমরা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব শুনে।’

‘যা গিয়ে বল তালে সবটা।’ শুনেই বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে নেমে দৌড়ে চলে যাচ্ছিল নীল, ‘এই শোন, শোন।’

‘কী?’

‘এখনই বলিস না, একটু পরে বলিস।’

‘কেন?’

‘এমনি…আচ্ছা যা।’

বিছানার পাশে রাখা ঠান্ডা চায়ের কাপটা সুড়ৎ করে মেরে দিয়ে উঠল বরুণ। আজকে নীচের দিকে কোনও বেগ আসছে না। এমনিতেই কনস্টিপেশনের ধাত। তার ওপর কাল রাতে পেটে ওই জিনিস পড়ে বমি-ফমি হয়েছে। সুতরাং আজ হওয়ার নো চান্স। ভেবে বিষণ্ণ হয়ে উঠল মনটা। তবু নিয়মরক্ষার জন্য বসল গিয়ে।

বাজারে আজকে মটন কিনবে ভেবেছিল বরুণ। কিনল না। চিকেন কিনল। পেটের ভেতর ক্রমাগত ভুটভাট করছে। বাড়ি ফিরে বাজার রেখে নিজের ঘরে ঢুকতেই নীল দৌড়ে এল। আজ রান্নার মাসি আসেনি। শতাব্দী রান্না শুরু করে দিয়েছে। খুব উৎসাহ নিয়ে করছে। এখন মায়ের জন্য নিরামিষ পদ হচ্ছে। এরপর ওদেরটা। মা ছোঁয়াছুয়িতে অত কঠোর নয়, হয়তো বাধ্য হয়েই। ঠিক জানা নেই।

‘ও বাবা ঠাম না গেলে আমিও যাব না।’

ভালো লাগছে না সকাল থেকে এক প্রসঙ্গ। বিরক্তিটা চেপে রেখে বরুণ বললে, ‘কেন, কী হল?’

‘ঠাম যাবে না বলেছে।’

‘কেন যাবে না?’

বরুণ মনে মনে বলল, বড় হয়ে ন-দশ ঘণ্টা অফিসে গাধার খাটুনির পর রোজ রোজ স্ট্র্যান্ড রোডে এক ঘণ্টা ধরে বালতি বালতি কালো ধোঁয়া গিয়ে যখন এই ভাঙা বাড়িতে ফিরবে তখন আর এই কথা বলবে না চাঁদ।

‘যা ঠামকে ডাক। আচ্ছা থাক, আমি যাচ্ছি। তুই যা নিজের ঘরে।’

‘কী করব?’

‘ছবি আঁক গিয়ে।’

‘ওয়াল পেন্টিং করব!’

একটু থেমে বরুণ বলল, ‘বেশ কর গিয়ে।’ ছেলেটার অদ্ভুত শখ। কাগজে ছবি আঁকতেই চায় না। হয় মেঝেতে, না হয় দেওয়ালে বড় বড় ছবি আঁকবে। ওর নিজের ঘরের দেওয়ালটা তো প্যাস্টেল ঘষে প্রায় ভরিয়ে ফেলেছে। অন্যন্য ঘর-বারান্দাও রং পেনসিলের হাত থেকে খুব একটা রেহাই পাইনি। বাবা থাকতে বকা দিত খুব। এখন বকা দেওয়ার মতন তেমন কেউ নেই। শতাব্দী বলে নীল নাকি গতজন্মে ম্যুরালিস্ট ছিল। ম্যুরাল পেন্টিং করত। আঁকার স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে বরুণ। এখন বেশ ভালোই আঁকে। কিন্তু যত প্র্যাকটিস ওই দেওয়ালেই। চুনবালি-খসা এবড়োখেবড়ো দেওয়ালে মানুষ, পাহাড়, গাছ, নদী।

গুটিগুটি পায়ে মায়ের ঘরে ঢুকল বরুণ। মা ঘরের ঝুল ঝাড়ছিল।

‘মা।’

থমকে দাঁড়াল মা। মুখটা ক্লান্ত, ভার। চোখ লাল। তাকাল বরুণের দিকে। ডান হাতে ঝুলঝাড়ু।

গলা খাঁকরে নিয়ে বরুণ বলল, ‘কী ব্যাপার, নীল বলছে তুমি কান্নাকাটি করছ?’ যতটা সম্ভব ক্যাজুয়ালি বলল বরুণ।

‘নাহ কিছু হয়নি তো!’ বলে আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল মা।

‘শোনও, শোনও, আমি তোমাকে সব বলতামই। এই জাস্ট দু-দিন হল ঠিক করেছি। এখনও ফাইনাল কিছুই হয়নি। মানে…’

মা নির্লিপ্ত গলায় বলল, ‘কবে যাচ্ছিস তোরা?’

‘তোরা মানে! তুমিও তো যাবে।’

‘নাহ।’ অনেকদিন পর মায়ের গলায় সেই পুরোনো ঝাঁঝ, ‘আমাকে ছেড়ে দে।’

‘ছেড়ে দে বললেই হবে! এই বড় বাড়িতে তুমি একা একা কী করবে? তাছাড়া…’

‘তাছাড়া কী?’ চমকে উঠল মা, ‘বিক্রি করে দিয়েছিস বাড়িটা?’

‘ধুস, তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল না কি! খামোখা বিক্রি করতে যাব কেন?’ একটা কথা অবশ্য কারও জানা নেই, বিক্রির চেষ্টা বরুণ করেছিল। প্রাোমোটার এসে বাইরে থেকে দেখেও গেছিল বরুণের দাঁত খিঁচানো বাড়ি। দেখেশুনে যা দর দিয়েছিল তাতে বরুণ আর শতাব্দীর এক বছরের যাতায়াতের ভাড়াও উঠবে না।

‘দাদা, এমনিতেই তো আপনার বাড়ি স্টেশন থেকে এত দূরে যে ফ্ল্যাট বানানো যাবে না। দু-নম্বর এবাড়ির যা হাল কোনও ভ্যালু নেই। আছে শুধু জমিটুকু। এখানে আর জমির দাম কত বলুন না? আমি তো ঠিক দামই বলেছি। ভেবে দেখুন।’ দাঁত বার করে বলে গিয়েছিল প্রাোমোটার।

বরুণ আশা করেছিল বাড়িটা ঠিকঠাক দামে বিক্রি হলে বাকি হোম লোন নিয়ে একটা ফ্ল্যাট কেনার ব্যবস্থা করবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। এসব অবশ্য শতাব্দীও জানে না। শুনলেই বলবে, ‘দেখেছ তো, আমি বললে শুনতে খারাপ লাগে। যা ধ্যাড়ধেড়ে জায়গায় বাড়ি বানিয়েছিল তোমার বাবা।’ এসব কথা বরুণ নিজে ভাবলেও অন্যের মুখ থেকে শুনতে খারাপ লাগে। যেখানেই হোক, যেমনই হোক, তবু একটা কিছু সম্পূর্ণ নিজের বানিয়েছিল মানুষটা। আপ্রাণ ভালোবেসে, নিজের স্বপ্নটুকু সফল করতে পারা কি কম বিস্ময়ের। ক’জন পারে?

‘শোনো, শোনো, আমার কথাটা শোনো,’ বলতে বলতে এগিয়ে গেল বরুণ, ‘এদিকে তাকাও, আমার দিকে’, মা-র ফেরানো চিবুকে হাত রেখে বরুণ নিজের দিকে ফেরাতেই ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল মা। অনেক, অ-নে-ক দিন পর। বাবা মারা যাওয়ার দু-দিন পরে আলমারি থেকে বাবার ধুতি-পাঞ্জাবিগুলো বের করতে গিয়ে এভাবে কেঁদেছিল মা।

ভালো লাগছিল। অদ্ভুত ভালো লাগছিল বরুণের। মা-র মাথায় হাত রেখে বলল, ‘মা, আমার, শতাব্দীর প্রবলেমটাও একটু বোঝো প্লিজ। সারাটা জীবন এই নৃশংস ডেলি প্যাসেঞ্জারি, ষাট বছরও টিকব না এভাবে চললে।’

‘তোর বাবাও তো করেছে।’

‘সেদিন আর এদিন এক হল। তখন পপুলেশন এত ছিল না। এখন লোকাল ট্রেনে ওঠা যায় না। অফিস টাইমে হাওড়া স্টেশনে দু-তিনটে লোকাল একসঙ্গে ঢুকলে সাবওয়ে পর্যন্ত পৌঁছোতে আধঘণ্টা লেগে যায়। লোকের চাপে বুকের খাঁচা ভেঙে যাওয়ার অবস্থা হয়। বছরের পর বছর এভাবে আর পারা যায়, বলো? তারপর ঠাকুরের ইচ্ছায় আমাদের দুজনের রোজগার সব মিলিয়ে খারাপ নয়। একটু তো শখ হয় নিজেদের, বলো! মানে ঘরগুলো…একটা বাড়ি একটু মনের মতো সুন্দর করে সাজাই।’

বরুণ জানে একথার পরেই মা বলবে, কেন, এই বাড়িটা কি সাজাতে পারিস না? সেজন্য সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘এ বাড়িটার যা অবস্থা, দেখেছ তো, বছর বছর সারিয়েও কোনও লাভ হচ্ছে না। এত বড় বাড়ির অ্যানুয়াল মেনটেনেন্স যা তাতে…এই তো তোমার ঘরটাই দেখো। দেওয়ালের, ছাদের প্লাস্টার ফেঁপে গেছে, দুটো জোরে টোকা মারলে চাঙড় খসে পড়বে। সিলিংয়ের রডে জল ঢুকে ঝরঝরে হয়ে আছে, বিমটা লম্বা হয়ে দু-ভাগ। এমন সব ঘরে একটা ভালো ফার্নিচার পর্যন্ত শখ হলে কিনে সাজাতে পারি না। ভালো লাগে, বলো?’

মা চুপ করে অসহায়ের মতো শুধু তাকাল বরুণের দিকে, ফোঁপাচ্ছিল। কেঁপে কেঁপে উঠছিল থিরথির করে। বরুণ বুঝতে পারছিল নীল এতক্ষণ ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চুপচাপ দেখছিল এদেরকে। এইমাত্র সরে গেল। ওর নিজের ঘরের অরণ্যদেব আঁকা দরজা বন্ধ হল আলতো শব্দে। ও-ও কি কাঁদবে এখন?

‘আর তাছাড়া প্রত্যেক শনি আর রবিবার তো আমরা এবাড়িতে এসেই থাকব।’ মা জানে, বরুণও ভালোভাবে জানে এই প্ল্যানটায় আয়ু ক’দিনের।

‘কবে যাবি?’

‘দেখি, লক্ষ্মীপুজোটা যাক। ঠাকুরমশাইকে জিগ্যেস করে একটা ভালো দিন জেনে রেখো তো! আর কিন্তু কান্নাকাটি করবে না। ঠিক আছে?’

মাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বরুণ নিজের ঘরের দিকে যাওয়ার সময় শতাব্দী রান্নাঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে জিগ্যেস করল, ‘রাজি হল?’

উত্তর দিল না বরুণ।

বরুণ ছোট থেকে দেখে আসছে ওদের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো হয় খুব ঘটা করে। বাবা বাজারে গিয়ে প্রায় তিন-চার ঘণ্টা ধরে খুঁজে সবচেয়ে সুন্দর দেখতে ঠাকুরটা নিয়ে আসতেন। বরুণও সঙ্গে যেত। অধৈর্য হয়ে উঠত শেষের দিকটায়। ঠাকুর কেনার পর শুরু হত পুজোর জিনিসপত্র, সবজি বাজার। একটু বড় হওয়ার পর বরুণ বুঝেছে বাবা খরচের দিক দিয়ে অন্যান্য সব ব্যাপারে খুব হিসেবি হলেও, এই পুজোটায় কোনও হিসেব করতেন না। দু-হাতে দেদার খরচ করতেন। নিজেই পুজোয় বসতেন বাবা। সেদিন বরুণদের বাড়িটা টুনি লাইটের চেন দিয়ে সাজানো হত। বাবা বলতেন লক্ষ্মী ঠাকুর অন্ধকার একদম পছন্দ করেন না। তিনি আলোয় আসেন। বরুণ ছোটবেলায় একবার নিজের কানে শুনেছে বাবা পুজোর আগের দিন রাত্রে বিছানায় শুয়ে মাকে বলেছিলেন, ‘আমার এই গৃহে সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মী আছেন। আমি বুঝতে পারি।’

বরুণ পারে না। অনেক চেষ্টা করেও পারে না। চোখ মেলে ভাঙাচোরা বাড়িটার দিকে তাকালেই কেমন শ্রীহীন মনে হয়। বাবা চলে যাওয়ার বছরটায় অশৌচের জন্য পুজো বন্ধ ছিল। তার পরের বছর বরুণও বাবার মতোই সুন্দর করে গুছিয়ে পুজো করার চেষ্টা করেছে। ঠাকুর কেনা থেকে শুরু করে বাজার করা, দশকর্মা, লাইট দিয়ে বাড়ি সাজানো, সব। ছোটবেলায় বরুণ আলপনা দিত। বারান্দা থেকে লক্ষ্মীঠাকুরের হেঁটে আসা পায়ে চিহ্ন ঠাকুরঘরে পাতা আসন পর্যন্ত আঁকত। এখন নীল আঁকে। বরুণের চেয়ে ভালোই আঁকে।

পুজো কাল। আজকে অফিস থেকে একটু বিকেল বিকেল বেরিয়ে পড়েছিল বরুণ। স্টেশন বাজার ঘুরে অনেক ঘেঁটেঘুঁটে একটা মূর্তি কিনল। ভালোই দেখতে, বেশ বড় সাইজ। এ বাড়িতে এবছরই শেষ পুজো। দু-ব্যাগ ভর্তি সবজি বাজার, ফল, মিষ্টি, দশকর্মা, গামছা অমুক-তমুক সব কিনে রিকশায় চেপে রাত্রে বাড়ির সামনে এসে থামতেই চমকে উঠল বরুণ। বৃদ্ধ, বুকের পাঁজর বার করা শীর্ণ বাড়িটার গায়ে ঝলমলে আলোর চাদর ঢাকা দেওয়া। ইলেকট্রিশিয়ান টুনি বালবের চেন লাগিয়ে দিয়ে গেছে। মারা যাওয়ার ঠিক ক’দিন আগে, বাবা যখন প্রায় সংজ্ঞাহীন, হঠাৎ একদিন বরুণের ইচ্ছে হয়েছিল বাবাকে নিজে হাতে সাজাতে। আলমারি খুলে বাবার সবচেয়ে প্রিয় গরদের পাঞ্জাবি আর ধাক্কাপাড় ধুতিটা বার করে বাবাকে শোয়ানো অবস্থাতেই পরিয়ে দিয়েছিল। বিছানায় প্রায় মিশে যাওয়া স্রেফ চামড়ায় মোড়া কঙ্কাল শরীরটায় ঝকঝকে ধুতি-পাঞ্জাবিতে বাবাকে সেদিন ঠিক এই বাড়িটার মতোই দেখতে লাগছিল!

‘ভাড়াটা দেবেন?’

‘রিকশাওলার ডাকে সংবিৎ ফিরল বরুণের। ভাড়া মিটিয়ে মালপত্র নিয়ে ঠাকুরঘরে ঢুকল। নীল আর মা দুজন মিলে ঠাকুরের সিংহাসনে রাখা সব ছোট ছোট ঠাকুর-দেবতার ফটোগুলো জল-ন্যাকড়া দিয়ে পরিষ্কার করছে। বরুণদের বাড়িতে কোনও দেওয়ালে বাবার ফটো ঝোলানো নেই। শুধু একটাই ছোট্ট ফটো ঠাকুরের আসনে রাখা। বাবা নিজেই, তখনও রোগটা অত জেঁকে বসেনি, একদিন বলেছিলন, ‘আমি যদি চলে যাই, দেওয়াল লটকে রাখিস না যেন। ওতে আমারও কষ্ট, দেওয়ালেরও কষ্ট।’ বাবার এই ফটোতে কপালে রোজ পুজোর সময়ে চন্দনের টিপ দেয় মা। শতাব্দী ঘরদোর গুচোচ্ছে। মালপত্রগুলো ব্যাগ থেকে বের করতে করতে মাকে জিগ্যেস করল, ‘মূর্তি কেমন হয়েছে মা?’

‘ভালো। বেদিতে বসিয়ে দে। দাঁড়া শাঁখটা নিই।’

কাঠের জলচৌকির ওপর লাল আসন পাতা বেদিতে মূর্তি বসানোর পরেই আবার কেঁদে ফেলল মা।

‘কী হল আবার? আরে, কাঁদছ কেন?’

‘ও ঠাম…ঠাম…’ নীলের গলাতেও সঙ্গে সঙ্গে…

‘না, এমনি’, চোখ মুছতে মুছতে বলল মা।

‘না, বলো কেন কাঁদছ?’ এগিয়ে গেল বরুণ, ‘অ্যাই নীল, ঘরে যা তো!’

‘আজকে ওই মানুষটা বেঁচে থাকলে তুই এই বাড়ি ছাড়তে পারতি?’ চিবুক কাঁপিয়ে প্রশ্ন করল মা।

‘আহ মা, থাক না এসব কথা। তোমাকে আর কতবার বোঝাব বলো তো? বাড়ি কি আমি বেচে দিয়েছি? আমাদেরই তো থাকবে।’

আজ সারাদিন ধরে সবাই পুজোর জোগাড়ে ব্যস্ত। মা ঠাকুরঘরে। শতাব্দী রান্নায়। নীল পিটুলিগোলা আর তুলো নিয়ে এন্তার যেখানে পারছে আলপনা দিচ্ছে। আর বরুণের প্র্যাকটিকালি কোনও কাজই নেই। শুধু বার বার এঘর ওঘর করছে। দুবার মুদির দোকানে গেছে। কাজ না থাকলেও ব্যস্ত থাকার ভীষণ চেষ্টা করছে। এই বাড়িটায় এটাই শেষ লক্ষ্মীপুজো। পুজোটা যেন খুব সুন্দর আর সুষ্ঠভাবে হয়, তার জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিল বরুণ। বার কয়েক মায়ের ঘরে গেল। বাড়ির সবচেয়ে পুরোনো ঘর দুটোয় একটায় একটা কালো কাঠের উঁচু খাটটাতেই ছোটবেলায় বরুণ বাবা-মা-র মাঝখানে শুত, এখন মা একা শোয়। টানটান চাদর পাতা। চারটে দেওয়ালেই নোনা। সেজন্য অনেকদিন হল আর রং করা হয় না ঘরটায়। পুরোনো চুন খসে প্লাস্টার বেরিয়ে গিয়ে কোথাও রবীন্দ্রনাথ, কোথাও কেশরওয়ালা সিংহের ছবি। মা একা থাকলেও এ ঘরটায় এখনও বড্ড বেশি বাবা বাবা গন্ধ। বরুণ বাইরে বেরিয়ে এল। অস্থির লাগছে শরীরটা। উপোসের জন্য কি না কে জানে। খালি পেটে থাকা খুব কঠিন। ঠাকুরঘরের তাক থেকে পুরোহিত দর্পণ খুলে লক্ষ্মীপুজোটায় বেশ কয়েকবার চোখ বোলাল, টিভি দেখল। দুপুরে অল্প সাবু খেয়ে খানিকটা ঘুমোল।

সন্ধে হল। পুজো করার জন্য বাবার এক সেট গরদের ধুতি আর উত্তরীয় ছিল। ওই ধুতিটা পরে উত্তরীয় গায়ে দিয়ে ঠাকুরঘরে পাতা পুজোর আসনে গিয়ে বসল বরুণ। শতাব্দী রান্না সেরে গা ধুয়ে সুন্দর একটা শাড়ি পরে এসে বসেছে। ভালো লাগছে ওকে দেখতে। নীল ঠামের গা ঘেঁষে চুপ করে বসে। দেখে বেশ অবাক হল বরুণ। কোনওবার পুজোর সময়টায় ওকে ঠাকুরঘরে বসে থাকতে দেখা যায় না তো! পুরোহিত দর্পণটা বাঁ-থাইয়ের ওপর খুলে রেখে পুজো শুরু করল বরুণ। আচমন, জলশুদ্ধি, আসনশুদ্ধি পরপর এগোতে এগোতে পঞ্চদেবতা, পঞ্চপোচারে। শতাব্দী সময়মতো শাঁখ বাজাচ্ছে। এবাড়ি ওবাড়ি থেকেও শাঁখের শব্দ আসছে। মা স্থানুর মতো বসে।…’ইহ গচ্ছ ইহ গচ্ছ ইহ তিষ্ঠ ইহ তিষ্ঠ’ প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর চক্ষুদান। নীল এই প্রথম পুজো দেখছে। ‘এটা কী, ওটা কেন?’ জিগ্যেস করে শতাব্দীর মাথা খাচ্ছিল।

বরুণ বলে উঠল, ‘পুজোর সময় কথা বলতে নেই। এখন দেখে রাখো, পরে জিগ্যেস করবে।’

দেবীর চক্ষুদানের জন্য বেলপাতায় ঘি মাখিয়ে প্রদীপের শিখার ওপর ধরে রেখে কাজল বানাতে হয়। ধৈর্য নিয়ে ধরে রাখতে হয় বেশ কিছুক্ষণ। ছোট্ট থেকে বরুণ দেখেছে এই কাজটা মা-ই করে এসেছে। বরুণও মা-র দিকে বেলপাতা বাড়িয়ে দিয়ে ইশারায় ঘিরের শিশিটা দেখাল। পুজো করতে করতে বরুণ একবারের জন্যও বাবার ফটোটার দিকে তাকায়নি। প্রচণ্ড অস্তস্বি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল তাকালেই…ঠিক কী যে মনে হচ্ছিল। পুজোতে যতটা মন দেবে ভেবেছিল সারাদিনে, তার সিকি আনাও মন লাগছিল না। খালি মনে হচ্ছে কতক্ষণে শেষ হবে, আর ঠাকুরঘর ছেড়ে উঠে পালাবে। অন্য দিকে তাকিয়েও মনে হচ্ছিল বাবা যেন ওর দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন একদৃষ্টে। মায়ের ধরে রাখা প্রদীপের শিসের ওপর ঘি মাখানো বেলপাতায় কাজল জমে উঠেছে। ওই কাজলেই বেলপাতার বোঁটা ঠেকিয়ে দেবীর বীজমন্ত্র বলে প্রথমে বাম চক্ষু তারপর ডান চক্ষু স্পর্শ করিয়ে চক্ষুদান করতে হবে। কাজল জমে উঠতে মা বোঁটা আর পাতাটা দু-হাতে এমনভাবে বরুণের চোখের সামনে এগিয়ে দিতে থাকল যেন…।

‘অত উঁচু করে বাড়াচ্ছ কেন?’ আচমকা প্রায় অকারণে মাকে আলতো ধমকে উঠল বরুণ। তার পরেই কষ্ট করে হেসে বলল, ‘আমার চোখে ঠেকাবে না কি?’ প্রকাণ্ড ফাঁকা জায়গায় চিৎকার করে বলে ওঠা কথাটা যেন গমগম করে উঠল এমনি এমনিই।

শরীরটা ভালো লাগছিল না। সোফাতে গা এলিয়ে জোরে টিভি চালিয়ে মনটা হালকা করার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল বরুণ। শতাব্দী এসে সোফাতে বসল।

‘ওহ, এত জোরে টিভি চালিয়েছ কেন? আস্তে করো।’ বলে রিমোটটা নিয়ে নিজেই মিউট করে দিল।

‘বাবা বাবা, ঠাম বেলপাতা পুড়িয়ে কী করল?’ নীল দৌড়ে ঘরে ঢুকেই জিগ্যেস করল। বরুণ অসহায়ের মতো শতাব্দীর দিকে তাকাল।

‘বেলপাতার কালি দিয়ে মা লক্ষ্মীকে চোখ দেওয়া হয় বাবা।’ বলেই শতাব্দী বরুণের দিকে বেশ উৎসাহ নিয়ে ঘুরে বলল, ‘জান, এক ধরনের সাঁওতাল পট আছে সেগুলোর নাম চক্ষুদান পট।’

‘সাঁওতাল পট কী মা?’ নীলের চটপট প্রশ্ন।

‘সাঁওতালরা এক রকমের ছবি আঁকে যেগুলোকে সাঁওতাল পট বলে।’ নীলকে স্কুল টিচারের কায়দায় বুঝিয়ে শতাব্দী আবার বরুণকে নিয়ে পড়ল, ‘জানো, এই চক্ষুদান ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং। লোকচিত্রের ওপর একটা বইতে পড়ছিলাম। শুনছ?…বাব্বা, আমিও তো সারাদিন খেটেছি, তোমার মতো এত এলিয়ে যাইনি তো!’

‘না-না, শুনছি, বলো না।’

‘সাঁওতালদের ফ্যামিলিতে যদি কেউ মারা যায় তখন তাদের পটুয়া, মানে পট আঁকিয়েরা সেই মৃত মানুষটার একটা ছবি আঁকে। হুবহু দেখতে হয় না, প্রতীকী আর কি। পুরো ফিগারটা আঁকে। শুধু মানুষটার চোখের তারা দুটো আঁকে না। তারপর সেই ছবি নিয়ে তারা সটান হাজির হয় মৃত লোকটার বাড়িতে। ওখানে গিয়ে তার আত্মীয়স্বজনকে বলে ওই মৃত ব্যক্তি দৃষ্টিহীন অবস্থায় পরলোকে ঘুরে ঘুরে খুব কষ্ট পাচ্ছে। এখন তারা কিছু ভুজ্জি পেয়ে ওই ছবিতে চোখের মণি দুটো এঁকে দিলে তবে মৃত ব্যক্তি দৃষ্টি পাবে। এই বলে বেশ টু-পাইস কামিয়ে নিয়ে চোখের তারা দুটো এঁকে দেয়। ভাবো রোজগারের কী বিচিত্র ধরন!’ বলে হাসল শতাব্দী।

বরুণ বলল, ‘হুঁ।’

নীল পুরোটা শুনল হাঁ হয়ে। তারপর সাঁই করে ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।

রাত্রে খাওয়াদাওয়া করে বিছানায় শুয়েছিল বরুণ। দুনিয়ার যত হাবিজাবি চিন্তা মাথায় গিজগিজ করছিল। শতাব্দী বাথরুমে গেছে।

‘বাবা, ও বাবা।’ ঘরে ঢুকল নীল।

‘কী?’

‘একবার এসো আমার ঘরে।’

‘কেন?’

‘এসো না!’

‘এখন না, কালকে যাব।’

‘না, এখনই চলো।’

জেদটা আরও বাড়বে। অগত্যা উঠল বরুণ। নীলের ঘুরে ঢুকে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখে সদ্য আঁকা একটা মানুষের ছবি। পাশে তিরচিহ্ন দিয়ে লেখা দাদান। চোখ দুটোয় তারা নেই।

‘ও বাবা, দাদান কিন্তু স্বর্গে খুব কষ্ট পাচ্ছে। কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছে না। আমি যা চাইব যদি দাও, তাহলে চোখ এঁকে দেব।’

মাথাটা চড়াৎ করে গরম হয়ে গেল বরুণের। ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘এসব হাবিজাবি কী করছ এখন? চুপচাপ শোও।’

‘তুমি এবাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না বলো…ও বাবা, তাহলে দাদানের চোখ এঁকে দেব। বলো যাবে না? দিই চোখ এঁকে?

‘হা-রা-ম-জা-দা, কী ভেবেছিস শালা! সবাই মিলে আমাকে…’ থমকে গেল বরুণ।

বরুণের ছ’বছরের জেদি ছেলে পেনসিল ধরা হাতটা দেওয়ালে আঁকা বাবার ছবির চোখের দিকে এগোতেই বরুণ গুটিয়ে কেন্নোর মতো হয়ে গেল।

‘আঁকিস না…চোখ দিস না…নীল প্লিজ…আমি পারব না…আমি পারব না…পারব না…’ বলতে বলতে ঘর ছেড়ে টলমল করতে করতে ছিটকে বারান্দায় বেরিয়ে এল বরুণ। গোটা পৃথিবীতে কোজাগরী আলো উপছে পড়ছে। বারান্দার মেঝেতে চোখ পড়ল। নীলের আঁকা আলপনায় মা লক্ষ্মীর পায়ের চিহ্ন জ্যোৎন্সার আলোয় আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠে বারান্দা থেকে এই ভাঙা বাড়িটার ভেতর চলে গেছে।

দেশ মার্চ

২০০৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *