মানুষীর কথা

মানুষীর কথা

প্রথম দিকে অতটা কেউ খেয়াল করেনি। মণিই প্রথম দেখাল। ‘দেখ দেখ, ঢলানি দুটোকে দেখ একবার।’ সঙ্গে সঙ্গে তাস ফেলে চার দু-গুণে আট আর মণির নিজের দুটো মিলিয়ে মোট দশটা চোখ ঘুরে গেলে ছেলে-মেয়ে দুটোর দিকে। ছেলেটা বছর ত্রিশ-বত্রিশের। একটা লালচে হয়ে আসা শার্ট আর খয়েরি রঙের ফুলপ্যান্ট পরে পা তুলে সিটের ওপর বসে। ফুলপ্যান্টটা আবার হাঁটু পর্যন্ত গোটানো। লিকলিকে, কালচে বাঁ পায়ের গোড়ালিতে ইয়াব্বড় গোল কালো রঙের একটা গুঁফো। মাথার চুল রক্ষ। তোবড়ানো গাল নিপুণভাবে সেভ করা। লালচে সরু গোঁফ। মেয়েটা কত হবে, খুব জোর চব্বিশ-পঁচিশ। তেল চকচকে শ্যামলা গায়ের রং। পরনে একটা টকটকে লাল রঙের ব্লাউজ আর লাল-সাদায় একটা শাড়ি। শাড়িটা বেশ নতুন নতুন। মেয়েটাও সিটের ওপর উবু হয়ে বসে। শাড়ির নীচ দিয়ে সায়ার খানিকটা বেরিয়ে রয়েছে। মুখটা বেশ।

ছেলেটা ওর শিরা ওঠা হাত দুটো বাড়িয়ে মেয়েটার ডান হাতের তালু থেকে ব্লাউজের হাতার প্রান্ত পর্যন্ত সুড়সুড়ি দিতে দিতে একবার উঠছে আর নামছে। বেড়ালচুরি খেলছে বোধহয়। মেয়েটা সুড়সুড়ির চোটে ওর ডান কাঁধ উঁচিয়ে ঘাড় কাত করে খিলখিল করে হাসছে। কিন্তু হাত সরাচ্ছে না।

দুজনের নিখুঁত বর্ণনাটা গোগ্রাসে গিলে নেওয়ার পর ইলা বলল, ‘ওভাবে দেখিস না, দেখছি বুঝলে আরও বাড়বে।’

অনু ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ‘আদিখ্যেতা।’

চোখ সরিয়ে নিয়ে আবার ফিস খেলায় মন দিল ওরা।

এই দলটার নাম পঞ্চপাণ্ডবী। বয়সটা বছর খানেক বেশি বলে প্রথম পাণ্ডবী লক্ষ্মী। বাকিরা সব পঞ্চান্নর কোঠায়। পরিচিতদের দেওয়া এই খেতাবটার জন্য দলের পাঁচজনেরই বেশ একটা অহংকার রয়েছে মনে। অনু আর ইলা এক পাড়ার বন্ধু। বাকিদের সঙ্গে পরিচয় কলেজে আসার পর। লক্ষ্মী তখন বেথুন কলেজে জি এস। কলেজ সোশ্যালে দুর্গার অসাধারণ টপ্পা, অনুর ডেকরেশন, মণির আবৃত্তি আর ইলার হইহই স্বভাব পাঁচটা মাথাকে এক করে দিয়েছিল। তারপর কলেজ পালিয়ে এদিক-ওদিক যেতে-যেতে একেবার বাড়ির সঙ্গে প্রায় লড়াই করেই বসন্ত উৎসবে শান্তিনিকেতন। অনুর মামা বিশ্বভারতীতে চাকরি করতেন। তিনিই গেস্ট হাউসের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেই প্রথম এক অচেনা স্বাদ। তারপর থেকে প্রত্যেক বছরে দু-একবার করে দীঘা, শান্তিনিকেতন, পুরী, ডুয়ার্স। কলেজ শেষ হবার পর প্রথম লক্ষ্মীর বিয়ে। সেই-ই শিলিগুড়ি। তারপর সবার একে একে বিয়ে হয়ে এদিক-ওদিক ছিটকে গেল। বছর কয়েক শুধু ফোনে, ‘কী রে কেমন আছিস?’ একদিন লক্ষ্মীর পাঠানো ওর দ্বিতীয় ছেলের অর্ণবের অন্নপ্রাশনের নিমন্ত্রণ কার্ড। সঙ্গে একটা ছোট্ট হুমকি। ‘এবারে যদি কেউ না আসিস তাহলে জন্মের মতো…’

বাকি চারজন পরামর্শ করে ঠিক করল এবার যেতেই হবে। দুর্গা স্কুল টিচারি করে। ছুটি পাবে কি না সেই নিয়ে একটু চিন্তা ছিল। মঞ্জুর হয়ে যাওয়ার পর শ্বশুরবাড়িতে কোনওমতে রাজি করিয়েই দে ছুট। তারপর দু-তিনটে দিন হই-হুল্লোড়, পুরোনো সেই দিনের কথা। সিদ্ধান্ত হয়ে গেল, আর নয়। এবার থেকে আবার বেরোতে হবে। অন্তত বছরে একবার। সেবছরেই ঠিক হল গ্যাংটক।

তার পর কেদারনাথ, তারপর…তারপর করতে করতে প্রায় কুড়ি-পঁচিশ বছরে গোটা ভারতটাকেই চষে ফেলেছে দলটা। তারমধ্যে কয়েক বার যে-যার পতি পুত্র-কন্যা নিয়েও একসঙ্গে যাওয়া হয়েছে। মাঝেমধ্যে কয়েকটা বছর শুধু বাদ গেছে এর অসুখ কিংবা ওর মেয়ের পরীক্ষা অথবা তার ছেলের বিয়ে ইত্যাদি কারণে। শত্তুরের মুখে ছাই দিতেই যেন দলটা দিনে দিনে আরও মজবুত, আরও অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছে।

ধীরে ধীরে বয়স বেড়েছে। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। লক্ষ্মীর এক মেয়ে আর ইলার দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। দুর্গার স্বামী মারা গেছে। বড় ছেলে চাকরি নিয়ে স্টেটসে চলে গেছে। ছোট ছেলের কাছে থাকে। মণির কোনও ইস্যু হয়নি। অনুর মেয়ে জেবিটি ট্রেনিং নিচ্ছে।

এই এতগুলো বছরে পাঁচটা থালাবাটি-গ্লাসে কখনও ঠোকাঠুকি লাগেনি তা নয়। কিন্তু তা কখনওই সম্পর্কের অস্তিত্বে টান মারতে পারেনি।

এবছর ওদের গন্তব্য পুরী। বয়স হয়ে গেছে বলে বাড়ির কেউ ছাড়তে চাইছিল না। বহু কষ্টে এবারেই শেষ বার ইত্যাদি বুঝিয়ে রাজি করিয়েছে। পুরীতে আগেও বার দুয়েক এসেছে ওরা। কিন্তু সমুদ্রের টান…।

‘কী রে খেয়ে নিবি না কি? সাড়ে আটটা বাজে’, মণি বলল।

‘দাঁড়া তো, ট্রেনে উঠলেই খালি খাই খাই,’ ইলা ধমক দিল।

লক্ষ্মী বলল, ‘হ্যাঁ রে আমরা শেষবার পুরী এসেছিলাম তখন কি এটাতেই গেছিলাম?’

মণি মাথা নেড়ে বলল, ‘উঁহু, পুরী এক্সপ্রেসে।’

দুর্গা মন দিয়ে বনফুল পড়ছিল। অনু বলল, ‘এই যে দিদিমণি, বই পড়ার নাম করে ওদের খুব টেরিয়ে দেখছিস না?’

‘যাহ খালি ইয়ার্কি!

‘হি-হি।’

দুর্গা বই বন্ধ করে জানলার বাইরে তাকাল। বাইরেটায় চোখে অস্বস্তি ধরিয়ে দেওয়া নিকষ অন্ধকার। মাঝেমধ্যে একটা-দুটো আলো নিমেষে জানলার সামনে ছুটে এসে পরক্ষণেই মিলিয়ে যাচ্ছে। তাস রেখে ট্রেনের দুলুনির সঙ্গে দুলতে দুলতে গল্প শুরু করল ওরা।

জগন্নাথ এক্সপ্রেসের এস-ফাইভ কামরার সতেরো থেকে একুশ নম্বর স্লিপার ওদের। ওদের উলটোদিকের জানলার ধারে তেইশ-চব্বিশ নম্বর স্লিপারে ছেলেমেয়ে দুটো। লাগেজ বলতে একটা বিগ শপার, একটা জাফরিওলা বাকেট আর একটা ছোট সাইড ব্যাগ। ব্যাগটা ছেলেটার। ছেলেটা এখন খইনি বানাচ্ছে।

মণি নাক টিপে বলল, ‘অসহ্য! এক্ষুনি থপথপ করে ঝাড়বে আর ডাস্টগুলো এদিকে আসবে।’

মেয়েটা এবার বিগ শপার থেকে খাবার বার করল। এক পাউন্ড পাউরুটি গোটা কয়েক মর্তমান কলা আর একটা পুঁচকে সন্দেশের বাক্স।

লক্ষ্মী ফিসফিস করে বলল, ‘রাত্রিবেলা কাঁচা পাউরুটি আর কলা! আমার তো দেখেই অম্বল হয়ে যাচ্ছে রে।’

মণি বলল, ‘আমারও তালে বার করি।’

অনু বলল, ‘হ্যাঁ বাবা কর, গতজন্মে না খেয়ে মরেছিলি না কি?’

সাদা রুটি, পেঁয়াজ ছাড়া বাঁধাকপির তরকারি আর দুটো করে কালাকাঁদ কাগজের প্লেটে খেতে খেতে ইলা ছেলেমেয়ে দুটোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সদ্য বিয়ে করেছে, বুঝলি, হনিমুনে যাচ্ছে বোধহয়।’

মণি বলল, ‘কী করে বুঝলি?’

‘কপালে সিঁদুরটা দেখ, আনতাবড়ি লাগানো। শাঁখা-পলাটাও নতুন।’

আবার সবাই তাকাল ওদিকে। মেয়েটার কালো হাতে শাঁখা ঝকমক করছে।

অনু বলল, ‘সত্যিই! ব্যোমকেশের স্ত্রীলিঙ্গ কী হবে রে?’

দুর্গা বলল, ‘ব্যোমকেশী।’

‘হি হি হি।’

হাসির শব্দে ছেলেমেয়ে দুটো ওদের দিকে তাকাল একবার। তার পর আবার খেতে খেতে নিজের মধ্যে গল্প শুরু করল।

খাবার পর প্লাস্টিকের বোতল খুলে ঢকঢক করে জল খেল ছেলেটা। মেয়েটাও খেল।

লক্ষ্মী আবার আঁতকে উঠল, ‘কাঁচা পাউরুটির পর জল! মরবে।’

‘আরে দুর, থাম তো! ওদের কিছু হয় না।’

খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর প্লেট গুলো জানলা দিয়ে ফেলে হাত-টাত ধুয়ে বাথরুম সেরে আবার একপ্রস্থ তাস। তারপর শুয়ে পড়ল ওরা।

ছেলেমেয়ে দুটো তখনও গল্প করছে। টিউব লাইট নেভানো। শুধু নীলরঙের ডিম লাইটটা জ্বলছে। আবছা অন্ধকারে মাঝেমধ্যে মেয়েটার—’অ্যাই ধ্যাত…হি-হি’, শোনা যাচ্ছে। কী বেলেল্লাপনা করছে কে জানে!…ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল ওরা।

লক্ষ্মী আর দুর্গা লোয়ার বার্থে শুয়েছিল। অনেক রাত। হঠাৎ ‘ও মাসি, ও মাসি, উঠুন না।’

আচমকা ঠেলা খেয়ে ‘কে কে’ বলে ধড়মড় করে উঠে বসল লক্ষ্মী। দুর্গাও জেগে উঠে টিউব জ্বালাল।

মেয়েটা সামনে দাঁড়িয়ে। চোখে-মুখে প্রচণ্ড ভয়।

কাঁচা ঘুম ভেঙে গেছে বলে লক্ষ্মী বেশ বিরক্তির সঙ্গে বলল, ‘কী হল কী?’

‘ও মাসি, ও উঠল না তো।’

দুর্গা জিগ্যেস করল, ‘কে উঠল না?’

মেয়েটা একটু ঢোঁক গিলে বলল, ‘দুলাল, আমার বর।’

ট্রেনটা বোধহয় কোনও স্টেশনে থেমেছিল। আবার গতি নিচ্ছে। দুর্গা বলল, ‘এত রাতে হঠাৎ নামতে গেল কেন?’

‘বলল যে খাবার জল নিয়ে আসছি।’

‘অ। তাহলে দেখ নিশ্চয়ই অন্য কোনও কামরায় উঠে পড়েছে।’

‘যদি না উঠতে পারে!’ ভেউ ভেউ করে বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেলল মেয়েটা।

লক্ষ্মী বলল, ‘আরে কী মুশকিল, জোয়ান ছেলে উঠতে পারবে না কেন? তুমিও যাও বসো গিয়ে। দেখবে একটু পরেই চলে এসেছে।’

মেয়েটাকে তাও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লাইট নিভিয়ে দিল দুর্গা। নীল রঙের আবছা আলোয় মেয়েটাকে ভূতের মতো লাগছে।

লক্ষ্মী বলল, ‘আরে চিন্তার কিছু নেই। তুমি যাও না, বসো গিয়ে।’

মেয়েটা চুপচাপ নিজের বার্থে গিয়ে বসল।

দুর্গা খানিক বাদেই ঘুমিয়ে পড়ল। লক্ষ্মী শুয়ে কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করতে করতে মেয়েটার ফোঁপানো শুনতে পেল। আচ্ছা জ্বালাতন তো! আবার উঠে বসল লক্ষ্মী। পায়ে চটি গলিয়ে মেয়েটার কাছে গেল।

‘কী হল, আসেনি এখনও?’ বলে কী ভেবে মেয়েটার মাথায় হাত রাখল। মেয়েটা ডুকরে উঠল।

লক্ষ্মী বসল মেয়েটার পাশে। ‘দুর বোকা, কাঁদার কী আছে? আমাদেরই কত বার এমন ঘটনা হয়েছে। ভয়ের কিছু নেই।’

চোখের জল মোছা ভেজা হাতটা লক্ষ্মীর হাতের ওপর রাখল মেয়েটা, অনেক দূরের কোনও নিয়ন আলো জানলার শার্সিতে পড়ল। লক্ষ্মী মেয়েটার মুখ দেখতে পেল একঝলক। অন্যরকম সে মুখ। লক্ষ্মী বলল, ‘দাঁড়াও, ওদের তুলি।’

টিউবটা আবার জ্বালিয়ে লক্ষ্মী ঠেলা মেরে তুলল অন্যদের। সবাইকে বলল ঘটনাটা। হাঁ হয়ে শুনল সকলে। সন্ধেবেলার বিরক্তি কারও মনে নেই।

অনু বলল, ‘কী হবে তালে?’

মণি বলল, ‘তাই তো বুঝতে পারছি না। উঠে থাকলে এতক্ষণে তো চলে আসা উচিত। এক যদি না জেনারেলে ওঠে।’

ইলা মেয়েটাকে জিগ্যেস করল। ‘তোমরা যাচ্ছ কোথায়, পুরী?’

‘হুঁ’, কান্না চেপে গলা ভেঙে গেছে মেয়েটার।

‘তোমার নাম কী?’

‘সন্ধ্যা।’

তারপর কথা চলল প্রায় সারারাত। খুব পরিচিত একটা গল্প। সন্ধ্যার বাড়ি বাগনানের কাছারিপাড়ায়। দুলালের বাড়ি মেচেদায়। দুজনেই জগন্নাথ ঘাটে এসে ফুল বেচত। পাশাপাশি বসার সুবাদে একদিন পরিচয় থেকে প্রেম। দুলালদের অবস্থা সন্ধ্যার থেকে ভালো। নিজেদের কিছু জমিজায়গা, একটা ফুলের বাগান আছে, জাতে গোপ। সেদিক থেকে সন্ধ্যা জাতে ছোট। অবস্থাও ভালো নয়। সুতরাং দুলালদের বাড়ির বিয়েতে অমত। বাপের সম্পত্তি হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে দুলালও কেঁচিয়ে দিতে চেয়েছিল। শেষে সন্ধ্যার অজস্র চোখের জলের বিনিময়ে রাজি হয়েছে। পরশু রাতে দুজনে পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে গ্রাম ছেড়ে ধাঁ। সোজা কলকাতায় এসে উপস্থিত। মেছুয়াপট্টিতে দুলালের এক বন্ধুর বাড়িতে রাতটা কাটিয়ে সকালে কালীঘাটে বিয়ে সেরে এখন পুরীতে হনিমুনে যাচ্ছিল।

সন্ধ্যার গল্প শুনতে শুনতে ব্যোমকেশী ইলাই প্রথম সন্দেহ করে অনুর কানে কানে বলল, ‘হ্যাঁ রে ছেলেটা আবার পালায়নি তো? আজকাল এসব তো আকছার।’

দুই

সকাল দশটায় স্বর্গদ্বারের সামনে সিন্ধু লজের দোতলার ঘাটে বসে লক্ষ্মী আর অনু খরচের হিসাব করছে। মণি দেওয়ালে টাঙানো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সারা গায়ে ক্রিম মাখছে। দুর্গা চেয়ারে বসে গল্পের বই পড়ছে। ইলা খাটের ওপর শুয়ে।

গতকাল পুরী স্টেশনে নেমে প্ল্যাটফর্মে এদিক-ওদিক দুলালকে খুঁজেছিল ওরা। না পেয়ে ওখানে থেকে সোজা থানায় গেছিল। বড়বাবু ওদের লজের ঠিকানা নিয়ে আশ্বাস দিয়েছেন কোনও খবর পেলেই জানাবেন।

সন্ধ্যা বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এসে বলল, ‘চলো চলো আমার হয়ে গেছে।’

দুর্গা বই নামিয়ে রেখে বলল, ‘এর মধ্যেই চান হয়ে গেল? এই তো ঢুকলি।’

‘ভিজে চুল এক পাশে এলিয়ে ভিজে গামছা দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে সন্ধ্যা বলল, ‘হ্যাঁ, হয়ে গেল তো।’

‘সাবান মেখেছিলি?’

‘নাহ।’

‘হতচ্ছাড়া মেয়ে, নোংরা কোথাকার।’ বলে দুর্গা চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে সন্ধ্যার গলায়, ঘাড়ে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘এই দেখ, কত ময়লা জমে, চল সাবান মাখবি, নইলে আজ থেকে মাটিতে শুবি।’

সন্ধ্যা ঠোঁট উলটে আবার বাথরুমে ঢুকল, পিছনে দুর্গা। বাথরুমের মেঝেতে উবু হয়ে বসল সন্ধ্যা। দুর্গা চৌকাঠে বসে সন্ধ্যার পিঠের কাপড় সরিয়ে বলল, ‘এই চান হয়েছে। দুনিয়ার নোংরা জমে, আদ্দেক জায়গায় ভালো করে জল পড়েনি। দে সাবান দে।’ সন্ধ্যা সাবান আর ছোবাটা পিছনে হাত বাড়িয়ে দুর্গাকে দিল, দুর্গা মগের জলে ছোবা ভিজিয়ে সাবান মাখিয়ে সন্ধ্যার পিঠে ঘষতে শুরু করল, কালচে ফেনা।

দুর্গা বলল, ‘কদ্দিন সাবান মাখিস না বল তো?’

‘মেখেছি তো।’

‘কোন সালে?’

হেসে উঠল সবাই। শুধু মণি গম্ভীর।

ছোবা দিয়ে ভালো করে ঘষার পর দু-মগ জল ঢালতেই সন্ধ্যার শ্যামলা যুবতী পিঠ জানলা দিয়ে গলে আসা রোদ্দুরে ইলিশ মাছের মতো চিকচিক করে উঠল। কোমরের দু-পাশে আদুরের চর্বির ভাঁজ। দুর্গা একমুহূর্তের জন্য কোথায় যেন একটু হারিয়ে গেল। তার পরেই ওর চোখ পড়ল সন্ধ্যার ঘাড়ের পাশে নখের আঁচড়ের লাল কয়েকটা দাগ। দুর্গা বুঝল দুলালের সঙ্গে এক রাত্তির থাকার চিহ্ন। আলতোভাবে দুর্গা হাত রাখল সেখানে। তারপর মুখ টিপে হেসে ইশারায় মণিকে ডাকল। মণি এল। দুর্গা মণিকে নি:শব্দে সন্ধ্যার ঘাড়ের দাগগুলোকে দেখাল। মণি দেখতে পেল না। ও চেয়ে রইল সন্ধ্যার টানটান চামড়ার পিঠের দিকে। গোলগাল নরম দুটো হাত…একমাথা চুল…। সন্ধ্যা দু-হাঁটুর মাঝখানে মাথা গুঁজে রয়েছে।

মণি ঠোঁট বেঁকিয়ে একটু হাসল শুধু। হাসিটা তাচ্ছিল্যের। কোনও প্রাণ নেই।

‘কী-ই গো মাসি, হল?’

‘দাঁড়া তো বাপু’, বলে দুর্গা সন্ধ্যার মাথায় শ্যাম্পু ঢালল। মণি সরে এসে আয়নাটার সামনে আবার দাঁড়াল। চোখের পাশে ভাঁজ, হাতের চামড়া ঢিলে হয়ে এসেছে। শাড়ি পরবার সময়ে নাভির চারপাশে দলাপাকানো কুঁচকে যোওয়া চর্বিটাকে দেখে ভিতরটা কেমন তীব্র বিস্বাদ হয়ে উঠল মণির।

বাথরুমের দরজা বন্ধ। ভেতরে সন্ধ্যা আবার স্নান করছে। দুর্গা ঘরে এক কোণে বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বলল, ‘বুঝলি লক্ষ্মী, ছেলেটা আসলে পালিয়েছে।’

ইলা বলল, ‘আমারও তাই মনে হয়।’

অনু বলল, ‘যাক গে, দুটো দিন আমাদের সঙ্গে যেমন রয়েছে থাকুক। তারপরে তো…’

এই এক দিনের মধ্যেই মেয়েটা পাঁচটা প্রৌঢ়ার কাছে অনেক সহজ হয়ে উঠেছে। সবাই মিলে ওকে বুঝিয়েছে দুলাল নিশ্চয়ই উঠতে পারেনি। তাই বাড়ি ফিরে গেছে। দু-দিন পর ফিরলেই আবার দেখা হবে। সরল মেয়েটা বিশ্বাসও করে নিয়েছে ওদের মিথ্যে আশ্বাস।

মণি হঠাৎ বলে উঠল, ‘যাই বলিস, তোরা কিন্তু একটু বাড়াবাড়ি শুরু করেছিস মেয়েটাকে নিয়ে।’

অনু বলল, ‘বাড়াবাড়ি আবার কোথায় দেখলি?’

‘নয়তো কী? সাবান মাখানো, পাশে নিয়ে শোয়া। লক্ষ্মী তো ওকে একেবারে নিজের মেয়ে বানিয়ে নিয়েছে।’

মণির বাঁকা কথাগুলো শুনে লক্ষ্মী বলে ফেলল, ‘ওভাবে বলিস না মণি। নিজের একটা থাকলে বুঝতি।’

মুহূর্তে মণির মুখটা কালো হয়ে উঠল। পরিবেশটা থমথমে, কারও মুখে কথা নেই। সেই সময় সন্ধ্যা বেরিয়ে এসে ঝপাং করে বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে বলল, ‘এবারে কিন্তু আমার সত্যি-সত্যি হয়ে গেছে।’

গৌরবাটশাহী ধরে জগন্নাথ মন্দিরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছে সকলে। ইলা, দুর্গা, অনু আর সন্ধ্যা একটু এগিয়ে হাঁটছে। দিদিমণি দুর্গা নীলাচলের পৌরাণিক কাহিনি শোনাচ্ছে ওদের।

মণি আর লক্ষ্মী ওদের কয়েক পা পিছনে। দুর্গার গল্প কানে আসছে মাঝেমধ্যে। দুজনে চুপচাপ পাশাপাশি চলতে চলতে লক্ষ্মী হঠাৎ মণির হাতটা ধরে বলল, ‘মণি, কিছু মনে নিসনি তো? আমি ওভাবে বলতে চাইনি রে কথাটা।’

মণি লক্ষ্মীর দিকে তাকাল। সামান্য হেসে বলল, ‘ভুলটাই বা কী বলেছিস?’

‘প্লিজ মণি, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রে। মাথাটা তখন হুট করে কেমন যেন হয়ে গেছিল। আসলে এই এক দিনেই এমন মায়া পড়ে গেছে মেয়েটার ওপর।’

মণি এবার লক্ষ্মীর হাতের মুঠোয় আলতো চাপ দিয়ে আঙুলগুলো ধরল।

লক্ষ্মী হেসে ফেলল। মণিও।

ওদিকে দুর্গা বলে চলেছে, ‘বুঝলি তো এই জগন্নাথ হল আসলে নীলমাধবের অঙ্গচ্যুত রোম…।’

সবাই মন দিয়ে দুর্গার গল্প শুনছিল। সন্ধ্যা হাঁ করে দুর্গার মুখের দিকে তাকিয়ে হাঁটার জন্য রাস্তায় বারবার হোঁচট খাচ্ছিল। মন্দিরের সিংহদ্বারের অরুণস্তম্ভের সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। সেখানে একটু জিরিয়ে নিয়ে তারপর মন্দিরের ভেতর ঢুকল। সন্ধ্যা তিন বিগ্রহের সামনে দাঁড়িয়ে দু-হাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে চলল।

গর্ভমন্দির থেকে বেরিয়ে ওরা মন্দির পরিক্রমা শুরু করল।

অক্ষয়বটের সামনে এসে দুর্গা সন্ধ্যাকে বলল, ‘এই দেখ, একে বলে কল্পতরু, ভগবান অনন্তদেবের গাছরূপী শরীর। সবাই এর কাছে তার মনের প্রার্থনা জানায়।’ ঈশ্বরের কাছে মানুষের অসংখ্য কামনা বটের ঝুরির মতো, সুতোয় বাঁধা ঢিল হয়ে ঝুলছে।

সন্ধ্যা একদৌড়ে গেল সেখানে। তারপর অন্যদের দেখাদেখি গাছে মাথা ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ ঠোঁট নাড়িয়ে ফিরে এল।

মণি বলল, ‘সব জায়গায় কী এত বর চাইছিস বল তো?’

সন্ধ্যা এই প্রথম একটু লজ্জা পেয়েই বলল, ‘কী আর বর চাইব!’

‘কেন দুলালকেই আবার চাইতি। বরকে বর হিসাবেই বেশ চাওয়া হত।’ হেসে উঠল সবাই।

সন্ধ্যা ফিকে হেসে বলল, ‘তাই তো চাইলাম। মানুষটা ভালোয় ভালোয় বাড়ি পৌঁছোলেই বাঁচি।’

ইলা ধমক দিল। ‘খুব হয়েছে। আর পাকামো করতে হবে না। ভালোমতো না পৌঁছোনোর কী আছে শুনি!’

পরিক্রমা শেষ করে পশ্চিম দিকে খাজাদ্বারের সামনে এসে বসে পড়ল সবাই। লক্ষ্মী বলল, ‘ওরে বাবা, আর আর পারছি না, অনেক হাঁটা হয়ে গেছে।’ সন্ধ্যা বসেনি। ও এদিক-ওদিক ঘুরছে দেখে অনু হাঁক পেড়ে বলল, ‘এই দেখিস, বেশি দূর যাস না। শেষে তুইও আবার না হারাস।’

গল্প শুরু হয়ে গেল আবার। কেউ খেয়ালই করেনি গল্পের ফাঁকে ইলা কখন উঠে গিয়ে খাজাদ্বারের এক কোণে কী যেন খুঁজছে।

অনু প্রথম দেখতে পেল। ‘এই ইলা, কী করছিস ওখানে?’

ইলা এল।

‘কী খুঁজছিলি?’

‘ওখানেই কোথায় একটা ছিল জানিস।’

‘কী?’

‘ওর সঙ্গে বিয়ের বছর দুয়েক পর যখন এসেছিলাম, তখন ও চাবির রিং দিয়ে এই জায়গাতেই দাগ দিয়েছিল। খুঁজেই পাচ্ছি না।’ সবাই অবাক! ইলা বিশ বছর আগের স্মৃতি খুঁজছে!

লক্ষ্মী বলল, ‘দুর পাগলি, এতদিন পরে দাগ থাকে নাকি!’

লজে ফেরার সময় চুপচাপ হাঁটতে থাকে ইলাকে কাছে টেনে নিয়ে মণি বলল, ‘কী রে ইলা, অরুণের সঙ্গে আবার আসবি না কি?’

ইলা তাকাল মণির দিকে, তারপর হাসবার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, ‘ধু-র।’

তিন

আরও দুটো দিন এই মঠ, সেই মন্দির, সমুদ্র দেখতে দেখতে কেটে গেল হু-হু করে। যাওয়ার আগের দিন দুপুর থেকেই আকাশের মুখ কালো।

বেলা দেড়টা নাগাদ হোটেলে খেতে বেরোবার সময় মণি বলল, ‘বাপ রে—কী কালো হয়ে এসেছে। মনে হয় খুব ঢালবে।’

অনু আনন্দে ডগমগ হয়ে বলল, ‘হলে দারুণ হবে। বৃষ্টিতে সমুদ্র দেখার কত্তদিনের শখ।’

ঠিক তাই। বিকেলের দিকে আকাশ কুচকুচে কালো। তারপর সন্ধে হতে না হতেই নামল বৃষ্টি। ওদের লজটা সমুদ্রের খুব কাছে। ব্যালকনিতে দাঁড়ালে দেখা যায়। ইলা, মণি আর দুর্গা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিল। সমুদ্রের কী অসম্ভব গর্জন। মনে হচ্ছে যেন হাজার হাজার বাঘ এক সঙ্গে হুংকার দিচ্ছে। সামনের নিকষ অন্ধকার চিরে নেমে আসা বিদ্যুৎ মুহূর্তের জন্য ভয়ংকর সুন্দরকে মূর্ত করে তুলছে। পাহাড়ের মতো বিশাল এক-একটা ঢেউ আছড়ে পড়ছে বালিতে। মনে হচ্ছে আজই যেন প্রলয়ের দিন। বুকের ভেতর একটা প্রচণ্ড ভয় মেশানো আনন্দ। এমন একটা অনুভূতি ওদের স্থান-কাল-পাত্র সব ভুলিয়ে দিচ্ছে।

‘কী রে সব বাইরে কেন? ভেতরে আয় না।’

লক্ষ্মীর ডাকে সংবিত ফিরল ওদের। ঘরে এল, চোখে-মুখে তখনও ঘোর।

অনু বলল, ‘বস না সবাই একসঙ্গে।’

এমন একটা পরিবেশে সন্ধ্যা আনন্দের চোটে চড়ুই পাখির মতো ছটফট করছে।

লক্ষ্মী বলল, ‘হ্যাঁ রে দুর্গা, একটা গান কর না। কতদিন শুনিনি।’

দুর্গা প্রায় আঁতকে উঠে বলল, ‘না-না, আর পারি না কি!’

‘ঢং করিস না বাপু। না পারায় কী আছে?’

‘ও মাসি করো না, করো না গো।’ দুর্গার হাত চেপে ধরল সন্ধ্যা।

সবার চাপাচাপিতে দুর্গা বলল, ‘ঠিক আছে করছি। কিন্তু হাসলে পরে ধরে ঠ্যাঙাবে বলে রাখলাম।’

‘আচ্ছা বেশ, কর এখন।’

দুর্গা শুরু করল, প্রথমে রামকুমারের স্টাইলে ‘বিধি দিল যদি বিচ্ছেদ যাতনা,’ তারপর ‘কিশোরীর কী শরীর হল।’

চড়ায় ওঠার সময় বার কয়েক হোঁচট খেল দুর্গা। কেউ কিছু বলল না।

ইলা বলল, ‘সত্যি কী সুন্দর গলা তোর!’

মণি বলল, ‘ওই গানটা একবার কর না। ওই যে—যে রাতে মোর।’

‘সবটা মনে নেই বোধহয়।’

‘ঠিক আছে, শুরু কর, আমি ধরিয়ে দেব।’

দুর্গা শুরু করল—’সব যে হয়ে গেল কালো’ থেকে।

বাইরের প্রবল হাওয়া জানলা দিয়ে ঢুকে বেডকভার, ওদের মাঝবয়সের কাঁচাপাকা চুল, আঁচল এলোমেলো করে দিচ্ছে। সবাই চুপ। ধ্যানস্থ যেন। ‘…অন্ধকারে রইনু পড়ে স্বপন মানি’ পর্যন্ত এসে থেমে পড়ল দুর্গা। ‘আর পারছি না রে।’

দুর্গার চোখ-মুখ লাল। হাঁফাচ্ছে।

‘ঠিক আছে থাক, থাক।’

এমন সময় সন্ধ্যা বলল, ‘মাসি, আমি একটা গাইব?’

‘তুই?—কী গান?’

‘রবীন্দ্রনাথের।’

‘অ্যাঁ, কোত্থেকে শিখলি?’

‘ইস্কুলে, প্রার্থনার সময় গাইতাম।’

‘বেশ, কর।’

সন্ধ্যা তক্ষুনি চোখ বুজে শুরু করে দিল, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে…’

‘বা রে, বেশ সুন্দর গলা তো মেয়েটার!’

সন্ধ্যা গেয়ে চলল ‘…ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্বপানে…’ হঠাৎ উঠে পড়ল দুর্গা। ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল, অনুও এল ওর পেছনে।

‘কী রে দুর্গা উঠে এলি?’

‘এমনি।’

‘এখনও গলাটা কী সুন্দর রেখেছিস। গানটা ছেড়ে দিলি কেন?’

দুর্গা একবার তাকাল অনুর দিকে। তারপর সমুদ্রের দিকে চোখ ফিরিয়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, ‘আমি আর ছাড়লাম কোথায়? সবাই তো আমাকেই ছেড়ে চলে গেল।’

ব্যালকনির রেলিংয়ের ওপর রাখা দুর্গার পঞ্চান্ন বছরে পুরোনো হাতের ওপর সমবয়সি আর একটা হাত এসে আলতোভাব ছুঁল। বন্ধুর হাত। বাইরে প্রবল বৃষ্টি। হাওয়া।

চার

আজ রাতে ফেরার ট্রেন। বেলা এগারোটায় সমুদ্রের ধারে বালির ওপর বসেছিল পাঁচজনে। সন্ধ্যা সমুদ্রে চান করছে। মাঝেমধ্যে ছুটে এসে ওদের সঙ্গে গল্পে যোগ দিচ্ছে। আবার ছুটে যাচ্ছে সমুদ্রে। আজকের সকালটাও একটু মেঘলা।

ইলা বলল, ‘এ বছরই তো শেষ, এর পরে যোগাযোগ রাখবি তো সবাই, না কি?’

অনু বলল, ‘মেয়েটা কত সরল না রে, অথচ কপালটা দেখ।’

দুর্গা বলল, ‘সত্যিই খুব কষ্ট লাগছে। ছেলেটা যদি ওকে না নেয়, কী যে হবে! সরল মেয়েটা।’

ইলা আশ্বাস দিয়ে বলল, ‘যদি নাও নেয়, কিচ্ছু হবে না দেখিস। আর অমন হতচ্ছাড়া ছেলের কাছে না গেলেই ভালো। অল্প বয়স তো, ঠিক ভুলে যাবে এক সময়। দেখ না, এরই মধ্যে কেমন গেছোদের মতো হইহই শুরু করেছে।’

লক্ষ্মী যেন ইলার কথায় বেশ আশ্বস্ত হয়েই একগাল হেসে বলল, ‘ওই বয়েসে তুইও কি কম হুল্লোড়বাজ ছিলি না কি।’

সন্ধ্যা আবার দৌড়ে এল ওদের কাছে। হাঁফাতে-হাঁফাতে বালির ওপর ঝপাস করে বসে পড়ল। ভিজে শাড়ি ওর গোটা শরীরে লেপটে রয়েছে। আঁচল সরে যাওয়া ভারী বুক ওঠানামা করছে।

একটু দূরে বসে থাকা কয়েকটা মেয়েকে সন্ধ্যার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মণি বলল, ‘লজ্জাশরমের মাথা খেয়েছিস না কি। ঠিক করে জড়া আঁচলটাকে।’

সন্ধ্যা আঁচলটাকে টেনে ভালো করে গাছকোমর করল।

দুর্গা বলল, ‘কী রে সন্ধ্যা, বরের সঙ্গে আবার এখানে আসবি তো?’

‘না-না।’

‘সে কী রে, কেন?’

‘আবার যদি হারিয়ে যায়।’ বলে হি-হি করে হেসে সন্ধ্যা আবার ছুট লাগাল স্নান করতে।

ইলা বলল, ‘সন্ধ্যার গড়নটা ঠিক অল্প বয়সে অনুর মতো, না রে লক্ষ্মী?’

অনু বলল, ‘কেন তুই-ই বা কম কী ছিলি?

‘অ্যাই থাম তো!’

আবার হাসি।

হাসতে হাসতে সমুদ্রের দিকে তাকাল ওরা। তাকিয়ে রইল। সন্ধ্যা স্নান করছে। ঢেউয়ের সঙ্গে লাফাচ্ছে, কখনও ডুবে যাচ্ছে। আবার উঠছে। সকলে অদ্ভুত চুপ। এক সময় মণি যেন নিজের খেয়ালেই বলে উঠল—’আমরা বুড়ি হয়ে গেলাম না রে।’

উত্তর দিল না কেউ। শুধু তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্ষয়াটে আলোয় একসময় ওরা যেন স্পষ্ট দেখতে পেল সন্ধ্যা নয়, অন্য একটি অল্পবয়েসি মেয়েকে। কবেকার পুরোনো অথচ বড় চেনা সেই মেয়ে সমুদ্রে স্নান করছে হইহই করে।

দেশ

মার্চ ২০০৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *