প্রতি রবিবার

প্রতি রবিবার

উঃ প্রথমটায় যা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, বাব্বাহ! আহা, আমার কী দোষ? জীবনে প্রথমবার প্লেনে চাপলে সবারই কমবেশি ভয় লাগে। লাগে না? আচমকা মাটি ছেড়ে সাঁই করে যখন ওপরে উঠল আমি তো ভয়েতে সিঁটিয়ে শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরেছিলাম। আমি জানলার ধারে বসেছিলাম নীচে দেখব বলে। ও তখন আমার হাতের ওপর আলতোভাবে হাত রাখতেই ভয় অনেকটা কেটে গিয়েছিল। ও মানে?

আমার বর, আবার কে? ও অবশ্য আমার মতো এই প্রথম বার প্লেনে চাপেনি। প্রত্যেক মাসে দু-তিনবার করে ফ্লাইটে আজ দিল্লি কাল বম্বে করে বেড়াতে হয় অফিসের কাজে। দুবার আমেরিকাও গেছে। আমি তো শুনে ঠিক করেই রেখেছি এরপর যখন আবার যাবে আমাকেও নিয়ে যেতে বলব। যেতেই হবে নিয়ে। ওই দেশটাকে দেখার শখ সেই ছোট্ট থেকে। ও ‘MNC’-তে উচ্চপদে কর্মরত 29/5’9” সুদর্শন ব্রাহ্মণ’। এত ফর্সা ছেলে আমি খুব কম দেখেছি। মাথা ভরতি ঘন কালো চুল। দাড়ি কামালে গালের রং হালকা সবুজ হয়ে যায়। এত সুন্দর লাগে তখন দেখতে। ওর গা থেকে সবসময় নরম সুন্দর একটা গন্ধ বের হয়। একটু পাশে থাকলে আমার গায়েও লেগে যায় গন্ধটা। কীসের গন্ধ কে জানে? আমিও তো পারফিউম মাখি, কিন্তু এমন সুন্দরভাবে গন্ধ বের হয় না তো! এখন দুজন যাচ্ছি বম্বে। সেখানে দু-দিন থেকে তারপর গোয়া যাব হনিমুনে। হি-হি! এই তো ক’দিন আগেই বিয়ে হয়েছে আমাদের। পরশু অষ্টমঙ্গলা সেরে আজই বেরিয়ে পড়েছি দুজনে। এরপর নইলে ও আবার ছুটি পাবে না। এত দূরে কোথাও বেড়াতে জীবনে প্রথম যাচ্ছি। আনন্দে-ভয়ে কেমন যেন করছে শরীরে। অস্থির অস্থির। মুম্বই পৌঁছেই মাকে ফোন করার কথা মনে রাখতে হবে—হবে—হবে। খুব চিন্তায় আছে আমার জন্য। সারাজীবনই চিন্তা আমাকে নিয়ে ছিল। প্লেনের ভেতরটা এত সুন্দর! খুব সুন্দর দেখতে একটা এয়ার হোস্টেস একটু আমাকে কফি দিয়ে গেল। মুখে সবসময় হাসি। আমার বরের দিকে একটু যেন বেশি ঝুঁকেই দিল কফির কাপটা। যাহ আমার যত রাজ্যের উলটোপালটা ভাবনা। আমি জানলা দিয়ে নীচে তাকালাম। ই-শ! নীচে সব গুঁড়িগুঁড়ি এইটুকুন হয়ে গেছে। এত্ত উঁচুতে উঠে গেছি!

রাস্তা-ঘাট-জমি-মানুষ-নদী-পাহাড়-সমুদ্র সব ছোট্ট-ছোট্ট…আমি ‘অনূর্ধ্বা তেইশ। পরমাসুন্দরী, কনভেন্ট এডুকেটেড’…ভাবতেই বুকের ভেতরটা থিরথির করে উঠল। আমি সঙ্গে সঙ্গে নীচে চোখ নামিয়ে ফেললাম।

আমার স্বামীর বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে বিশাল বড় গয়নার দোকান। দোকানের নাম বললেই সবাই চেনে। চারদিকে খুব অ্যাড দেন তো। সারাদিনে দোকানে সাদা হলুদ আলো কাচের দেওয়ালে ঝলমল করে। ও ’43/5’1”’, আমার থেকে একটু বেঁটে। সে হোক গে। গায়ের রংটাও…তা যাক গে। চেহারাটা বিশাল ইয়ে…মানে…ধুৎ, অত দেখলে চলে! গোটা দিন দোকানে টেবিলে ফ্যানের সামনে বসে (এখনও এসি লাগায়নি, খুব হিসেবি)। বিনবিন করে ঘামে। পাঞ্জাবির পিঠ, বগলের চারপাশ, ঘাড়ের খাঁজ ঘামে জ্যাবজ্যাব করে। কার্তিক ঠাকুরের মতো চুল। জুলফির পাশে কিছু পাকা। গলায় সোনার চেন—নাভি পর্যন্ত ঝোলানো। ডান হাতের আঙুলে চারটে আর বাঁহাতে দুটো মোটা মোটা পাথর বসানো সোনার আংটি। আমার গায়েও গয়না ভরতি। ‘উ: কলিতে নিজস্ব বাড়ি’ ওদের। যেমন বড় তেমনি পুরোনো। বাড়িটার ভেতরে পা রাখলেই কেমন একটু ঘুম ঘুম আলস্যমাখা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। দোতলায় যাওয়ার আবছা অন্ধকার সিঁড়ি। চৌখুপি উঠোনের এক পাশে কলতালায় ডাঁই করা থাকে এঁটো বাসন, অতবড় বাড়িটা গরমকালের দুপুরের মতো চুপচাপ সবসময়। শুধু কাজের মাসি এলে বাসনের শব্দে একটু জেগে ওঠে। এ-বাড়ির অনেক শরিক, অনেক ঘর কিন্তু এরা ছাড়া আর কেউই থাকে না এ বাড়িতে। দরজায় দরজায় তালা ঝোলে। এদের ফ্যামিলি খুব রক্ষণশীল। বাড়ির বউদের একা একা বাইরে বেরোনো নিষেধ। এখানে আমি টায় টায় তিরিশ। আমি ‘প: ব: স্বর্ণবণিক, প্রকৃত ফরসা সুন্দরী।’ বিয়েতে এদের ‘কোনও দাবি নেই’ থাকলেও বাবাকে ঢের দিতে হয়েছিল। আমার এই স্বামী সারাদিন ধরে নিক্তির ওজন আর নোট গুনতে গুনতে কেমন যেন ল্যাদাঠে মেরে গেছে। রসকষ নেই। রাত্তিরবেলা…যাকগে। আমার ‘ছবি সহ পত্রালাপ’ হয়েছিল। সেই সবুজ রঙের শাড়ি পরা পোস্টকার্ড সাইজ ফটোটা, যেটা সব জায়গায় পাঠাই, ওটাই পাঠিয়েছিলাম। ওদের পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। তারপর কথাবার্তা, বিয়ে, সব ঝটপট। ওরা জানে না আমি ডিভোর্সি। বিয়ের আগে বলাই হয়নি। জানতেও পারবে না কোনওদিন। আমার বিয়ে তো হয়েছে উত্তরপাড়ায় মামাবাড়ির থেকে। আমার নিজের বাড়ি দিয়ারার পাড়াপ্রতিবেশীরা জানেই না আমার এই বিয়ের কথা। কাজেই এরা জানবে কী করে? ওরা জানে আমি ফার্স্ট হ্যান্ড। কিন্তু আমার না লুকোতে ভয় লাগে। তবু চেপে থাকি।…কিন্তু আমার মেয়েটা? আমার ছয় বছরের মেয়ে?…নাহ, আমি আবার নীচে তাকাই।

আমার এই হাজব্যান্ডের ‘বাৎসরিক আয় ছ-লাখ’। ওর ‘পূর্বের স্ত্রী অ্যাকসিডেন্টে মৃত’। ‘কলিতে দুটি দ্বিতল বাড়ি’। একটা বাড়ি অবশ্য ভাড়া দেওয়া, বহুদিনের। ও ‘কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার 30/5’6”, ওর প্রথম বিয়ের দু-বছরের মধ্যেই প্রথম বউটা মারা গিয়েছিল। কীভাবে মারা গিয়েছিল এখনও জানি না। ইচ্ছেও নেই জানার। কী দরকার ওসব ঘাঁটিয়ে। এই তো বেশ আছি। ওরা ‘বিধবা নয় ডিভোর্সি কাম্য’ বলেছিল। ‘ঘরোয়া স্লিম ন্যূনতম গ্র্যাজুয়েট প্রকৃত সুন্দরী ফোনে যোগাযোগ সকাল 7-9।’ সঙ্গে সঙ্গে বাবাকে দিয়ে ফোন করিয়েছিলাম। আমার হাইট, ফিগার, গায়ের কালার, চুল, নখ, দাঁত, মাড়ি সবক’টা জিনিস ওদের পছন্দ হয়েছিল। এইবারে আমি কিন্তু গোপন করিনি যে আমি ডিভোর্সি। কেনই বা করব। ওরা তো চেয়েইছিল। আর আমার তো কোনও দোষ ছিল না। ভালোবেসে আজকাল কে না বিয়ে করে? আমাদের পাড়ারই ছিল ছেলেটা। বন্ধুরা আমায় খুব বোঝাত ছেলেটা খারাপ, অপদার্থ, ওর পাল্লায় পড়িস না। মরবি। ছেড়ে দে। আমি ছাড়তে পারিনি। লুকিয়ে বিয়ে করার বছর দেড়েকের মধ্যে মেয়েকে কোলে সমেত ও-ই আমাকে ছেড়ে দিয়েছিল। মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিতে নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করা ‘প্রকৃত ঘরোয়া’ মেয়ে লাথি খেয়ে বাপের বাড়িতে ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন হলে যেভাবে থাকে সেভাবেই ছিলাম। তবু তো মেয়েটা স্কুলে যেত। দুটো ভালোমন্দ খেত-পরত। বাবা-মাকে একটুও দোষ দিই না। তারাও একসময় দুজনে অনেক বুঝিয়েছিল আমাকে। শুনিনি, কিচ্ছু শুনিনি। ভালোবাসা শুধু কানা নয়, কালাও। বাড়ির সামনে বাবার ব্যাকডেটেড স্টেশনারি দোকানটা টিবি রুগির মতো হাঁফাতে হাঁফাতে পা ঘষটাতে ঘষটাতে চলে। ভাইটা এবছর সেকেন্ড ইয়ারে। এতগুলো পেট। এই দোকানের আর পোস্টাপিসের সামান্য ইন্টারেস্টে এ-যুগে কাঁহাতক পারা যায়?

কিচ্ছু গোপন করিনি। সব বলেছি আমার এই কর্তাকে। বিয়েতে এদেরও ‘কোনও দাবি নাই’ ছিল। সত্যি সত্যি কিচ্ছু নেয়ওনি। একদম শাঁখা-সিঁদুর আর একটা শাড়ি আর বাবার অনেক জোরাজুরিতে ও একটা আংটি নিতে রাজি হয়েছিল। বিয়ের ক’দিন আগেই একটা গাড়ি কিনেছে। স্যান্ট্রো। সিলভার কালার। দা-রু-ণ দেখতে। সিটের প্লাস্টিক কভারগুলো আমি খুলতে দিইনি। খুললেই তো ধুলো জমবে সিটে। যা ধুলো কলকাতায়, বাপরে! বউভাতের পরদিন রাত্রেই নতুন গাড়িটায় দুজনে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। ভিক্টোরিয়ার পাশ দিয়ে রেড রোডে উঠে শাঁ শাঁ করে যখন যাচ্ছিল না গাড়িটা উফ! কেমন যেন লাগছিল কী বলব! ও-ই ড্রাইভ করছিল। কার স্টিরিয়োতে স্যাক্সোফোন (এই নামটা ওর থেকে জেনেছি) আর হু-হু করে ছুটে যাওয়া, শিরশির করছিল আমার শরীর। অবশ্য দু-দিন পরেই বুঝেছি ও আমার দিকে খুব একটা ঘেঁষে-টেঁষে না। কে জানে কেন! অন্য কোনও প্রেমিকা-টেমিকা আছে বোধহয়। হয়তো কোনও চাপে পড়ে তাকে বাদ দিয়ে আমার মতো একজনকে বিয়ে করতে হয়েছে। না কি অন্য কোনও কারণ! যার জন্য আগের বউটা মরেছে কি না কে জানে?—মরুক গে। আমি মাথা ঘামাই না বাবা। এত দিনের মধ্যে কোনওদিনও রাত্রে আমায় একবার ছুঁয়েও দেখেনি ও। আমিও হ্যাংলামো করিনি কখনও। ওসব ইচ্ছে-টিচ্ছে আর আমার নেই। কবে হাপিস হয়ে গেছে। বাবার ঘাড়ের ওপর মেয়েকে নিয়ে চেপে বসে নেই এই-ই যথেষ্ট। আমাকে পছন্দ না অপছন্দ তা নিয়ে ভাবি-টাবি না। এরা ডিভোর্সি চেয়েছিল কিন্তু ‘নি:সন্তান নির্দায়’। আমার মেয়ে আমার দায় নয়। তাই বাধ্য হয়ে একেও ছেড়ে দিই।

ভাবতেই পারিনি জীবনে কখনও এই ভ্যাজভেজে WB ছেড়ে USA যাব। আমেরিকার যেখানে আমরা থাকি সে জায়গাটার নামটা এখনও অবশ্য জানা হয়নি। সে আর জানতে কতক্ষণ। আমি ‘স:/ অস: ডিভোর্সি সন্তানসহ’, কোনও কিছুতেই এদের ‘আপত্তি নাই’। আমি ‘বিদেশে থাকতে ইচ্ছুক’ ‘স্মার্ট অনূর্ধ্বা পঁয়ত্রিশ’ সুতরাং যোগাযোগের সঙ্গে সঙ্গে ‘রেজিস্ট্রি বিবাহ’। তারপরেই প্লেনে করে সোজা এইখানে। আমার কর্তার বয়সটা একটু যা বেশি। ছাপান্ন। খাঁটি আমেরিকান। ওর ঠাকুমা নাকি বাঙালি ছিল। এখন যদিও ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলি ওর সঙ্গে, তবে শিগগিরই বাংলাটা শিখিয়ে দেব। ইনি ‘প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী’। এরও আগে বিয়ে হয়েছিল। এক বছর পরেই ক্যাচাং হয়ে গেছে। আগের পক্ষের ছেলেটার বয়স আঠাশ। সে অবশ্য বাপের সঙ্গে থাকে না। আমিও একবারও দেখিনি তাকে। আমি কিন্তু আগেই বুঝতে পেরেছিলাম যে বুড়ো, বউ নয় একজন কাজ করবার বিশ্বস্ত আয়া খুঁজছে। আমার কোনও ব্যাপার নেই। মেয়েটাকে একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছি। কত সুন্দর সুন্দর বই, স্কুলের ইউনিফর্মটা দারুণ দেখতে। স্কুলে এই বয়স থেকেই কম্পিউটার শেখায়। এ দেশের ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা। ওর মুখে তো সব সময় শুধু কম্পিউটারে নতুন কী শিখল তার গল্প। রোজ একটা ঝকঝকে বাসে চেপে স্কুলে যায়। স্কুলেরই বাস। টিফিনে রোজ কেক, বিস্কুট, ক্যাডবেরি…ও খু-উ-ব খুশি। বাড়িতে ওর আবার নিজের ঘর রয়েছে। এইটুকুন মেয়ে তার আবার ঘর হি-হি…। এখনও অবশ্য লোকটাকে বাবা বলে মেনে নিতে পারেনি। সে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু এদেরকে ভালো করে চিনিই না। শুনেছি এদেশের সবাই না কি হাই তুলতে তুলতে বউ পালটায়। বুড়োর এ বয়সেও দারুণ রস। আমার বিচ্ছিরি লাগলেও উপায় নেই।…আচ্ছা, দু-দিন পর আমি পুরোনো হয়ে গেলে পর আমাকে মেয়ে সমেত খেদাবে না তো? হুট করে ছেড়ে দিলে মেয়েকে নিয়ে এই অচেনা বিদেশ বিভুঁইয়ে তখন যাব কোন চুলোয়?—দরকার নেই বাবা অত লোভ করে। তার থেকে নিজের দেশে থাকাই ভালো।

নাহ, এই এবারে আমি কিন্তু সত্যি সত্যিই খু-উ-ব সুখী। এমনিতে আমার বর বেশ সোজাসাপটা। কোনও সাতে-পাঁচে থাকে না। সারাদিন বইপত্তর, ছাত্রছাত্রী নিয়ে থাকে। ‘স: চা:’ স্কুল টিচার। স্কুল থেকে হাজার তিরিশ পায়। কম কী! জীবনে বিয়ে না কি করবেই না ঠিক করেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত বন্ধুদের আপ্রাণ চেষ্টায় বেয়াল্লিশ বছর বয়সে বাবুর বিয়েতে মতি হয়। সাংঘাতিক ‘ধার্মিক এবং আদর্শবান’। আমিও ‘সদ্বংশজাত ব্রাহ্মণ ভক্তিমতী নিরামিষাশী উদারমনস্কা অনূর্ধ্বা চৌত্রিশ, বিএ’। পাশটা অবশ্য করিনি, ব্যাক পেয়েছিলাম আর বসিনি তারপর। সে রেজাল্ট তো আর দেখতে চাইবে না। আমি ‘অমুক ঠাকুরের আশ্রিতা (অগ্রগণ্যা ছিল) মোটামুটি সুশ্রী’। ও ‘5’7” স: চা: সন্তানসহ ডিভোর্সি চলিবে’ বলে আমি ভীষণ সুখী হতে যাচ্ছিলাম কিন্তু…বক্স নং, আমি বক্স নম্বরে আর চিঠি পাঠাই না। এ পর্যন্ত অনেক টাকা স্ট্যাম্প আর ‘অফেরৎ যোগ্য পোস্টকার্ড সাইজ রঙিন ছবির’ জন্যে গেছে। একটারও উত্তর পাইনি কোনওদিন। এর থেকে ‘টেলি নং’ ভালো। চটপট ‘না চলবে না’ শোনা যায়। অপেক্ষায় শুকিয়ে বসে থাকতে হয় না। বাড়ির ঠিকানা দেওয়া থাকলে তবু মাঝেমধ্যে পাঠিয়ে ফেলি কখনও। তিনটে টিউশনি করি ছোট ক্লাসের। মাসে মোট সাড়ে পাঁচশোর মধ্যে মেয়ের স্কুলের মাইনে, ভ্যানভাড়া, খাতাপত্র, বই, পেনসিল, ওয়াটার বোতল, জুতো, আমার নিজের টুকটাক…এরপর কত আর ভগবানের উত্তর পাওয়ার আশায় স্বর্গে চিঠি পাঠাব। বাবার কাছে এসবের জন্য হাত পাততে লজ্জা লাগে।

রবিবারের গোটা দুপুরটা আমার এইভাবে কেটে যায় ‘পাত্রী চাই’-এর মধ্যে। আমার চোখ চেটে বেড়ায় টিক দেওয়া, টিক না দেওয়া, শেড দেওয়া প্রত্যেকটা শব্দকে। মা শুকনো মুখে একটু পরপর জিগ্যেস করে, ‘কি রে পেলি কিছু?’ আমি যত সম্ভব হালকাভাবে উত্তর দিই, ‘নাহ।

এবারে দেয়নি তেমন কিছু।’

দুপুর গড়াতে থাকে। আমিও হাঁফিয়ে পড়তে থাকি। চোখ ব্যথা করে। মাদুরের ওপর আমার পাশে শুয়ে থাকা ডটপেন শুকনো মুখে পড়ে থাকে। কোনও লাইনের ওপর দাগ কাটতে পারে না। আমি স:/অস:, প্রকৃত ঘরোয়া/ চাকুরিরতা, অনূর্ধ্ব তেইশ/ পঁয়ত্রিশ, অতীব ফর্সা/ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা, পরমাসুন্দরী/মোটামুটি সুশ্রী, পূ: ব:/প: ব:, ব্রাহ্মণ/ মুসলিম সুন্নি, গন্ধবণিক/নম:শূদ্র, যুক্তিবাদী/ভক্তিমতী, আমি কনভেন্ট এডুকেটেড/ন্যূনতম উ: মা:, আমি ফার্স্ট হ্যান্ড কিংবা বিধবা/ডিভোর্সি, আমি সকাল 8-10 টা ফোনে যোগাযোগ’ আমি ‘ছবি ছাড়া পত্রালাপ নিষ্প্রয়োজন’—স-ও-ব, সব কিছু। শুধু নির্দায় নই। আমার ছয় বছরের মেয়েটা। সবাই বলে কী হয়েছে তাতে। বোর্ডিংয়ে রেখে দিবি। আজকাল এমন তো হামেশাই হচ্ছে। আমি পারব না। আমি পারব না। আমি ওর একমাত্র…। আমাকে একমুহূর্ত চোখের আড়াল হতে দেয় না। সরকারি স্কুল থেকে আকাশি রঙের মোটা টেরিকটের ইউনিফর্ম পরে ঘামে চ্যাটপ্যাচে হয়ে বাড়ি ফিরে আমাকে খোঁজে। না পেলে ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। এত ভয় কেন কে জানে! যত বড় হচ্ছে তত যেন ভিতু হচ্ছে। আমি পারব না ওকে ছেড়ে…।

বিকেল হয়ে আসে। আমার মেয়ে ঘুম থেকে উঠেই বলে, ‘মা খেলতে যাচ্ছি।’ আমিও কাগজটাকে ভাঁজ করে রেখে উঠে পড়ি। আবার সামনের রবিবার।

সুখী গৃহকোণ

নভেম্বর ২০০৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *