একটি দ্বীপে দু-চারজন
একটা বেডে, অন্তত আজ রাত্তিরটা আমাদের চারজনকে কাটাতেই হবে। কোনও উপায় নেই। আমরা মানে আমি, আমার বউ শিউলি, আমার ছোটবেলার বন্ধু জয়ন্ত আর ওর বউ কাজরী। আমরা যে একটামাত্র ঘর পেয়েছি তাতে একটাই খাট। যদিও যথেষ্ট বড় খাট, ছ-সাতজন লোক পাশাপাশি আরামে শুয়ে পরবে। সেখানে আমরা মাত্র চারজন। কিন্তু তবু মাত্র একটা। অস্বস্তি একটু লাগে। আমি, সঙ্গে বন্ধুর বউ, আবার বন্ধু এবং আমার বউ…। ঘরের মেঝেতে হাফ ইঞ্চি ধুলো। একটা টিনের জংধরা ছোট্ট বেডসাইড টেবিল আছে। সেও ধুলো মেখে ভূত। টেবিলে একটা উপুড় করা স্টিলের গ্লাসের ওপর গলে এই এক কর সাইজ হয়ে আসা একটা মোমবাতি বসানো। অ্যাটাচড বাথরুমটায় ঢুকতেই গা ঘুলিয়ে উঠেছিল আমার। কারণ আমিই একমাত্র দেখতে ঢুকেছিলাম এবং তারপর ওদের সবাইকে ওটা পরিষ্কার না করানো পর্যন্ত ঢুকতে বারণ করেছি। নাকের ডগা পর্যন্ত ঝুল, অসংখ্য ছোট-বড় মাকড়সা, আরশোলা, পায়খানার প্যানে অন্য কারও রেখে যাওয়া কবেকার বস্তু ভাসছে। তাকে জল ঢেলে ডোবানোর সাহস আমাদের কারও নেই। অফিসরুমে অনেকক্ষণ আগে খবর দিয়েছি ক্লিনারকে ফিনাইল সঙ্গে নিয়ে আসার জন্য। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে সে আসেনি। তবে অফিস থেকে আমাদের চারটে কাচা বালিশের ওয়াড়, একটা মশারি এবং সাদা বিছানার চাদর দিয়েছে। চাদরটা বিছানায় পেতে আমরা এখন চারজনেই খাটের মাঝখানে বাবু হয়ে গুম খেয়ে বসে আছি। কারও মুখে কথা নেই বেশ কিছুক্ষণ হল। আমরা প্রত্যেকেই অতিরিক্ত ক্লান্ত এবং অল্প বেশি বিরক্ত। গুমোট গরমে ঘর ভর্তি। তার মধ্যে শালা কারেন্ট নেই, ধুলো-ঝুলে বিধ্বস্ত ফ্যানটা গলায় দড়ি দিয়ে সিলিং থেকে ঝুলছে। আমাদের চারজনের মধ্যে শিউলির মুখটাই সবচেয়ে বেশি থমথমে। গরমে, ক্লান্তিতে এবং সম্ভবত অপ্রস্তুত বিব্রত হওয়ার জন্য ওর ফর্সা মুখ টকটকে লাল হয়ে উঠেছে।
জয়ন্তই গলা খাঁকরে শুরু করল, ‘থাকগে যা হওয়ার হয়ে গেছে। এমন তো হতেই পারে। ভেবে লাভ নেই। আমাদের কারও দোষ তো নেই এর জন্য।’ শিউলি মুখ তুলল। সত্যিই হয়তো দোষ নেই কারও। কিন্তু হিসেবমতো কিংবা বেহিসাবে যেটুকু দোষ তো শিউলির ঘাড়েই চাপে।
ব্যাপারটা হল পনেরোই আগস্ট এবছর শুক্রবার পড়েছিল। সুতরাং শুক্র-শনি-রবি তিনদিন কাছাকাছি কোথাও খুচরো ঘুরে আসার কথা ভাবছিলাম। স্টেশন প্ল্যাটফর্মে গত পরশু জয়ন্তর সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল। কথায় কথায় এই ছুটির তিনদিন কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবছি জানাতে ও বলল কাছাকাছি যাওয়ার প্ল্যান করছে। ভিড়ভাট্টা আমাদের কারও পছন্দ নয়। ও বলল একটা জায়গায় যাওয়া যেতে পারে, সারাবছর ভিড় প্রায় থাকেই না।
‘কোথায়?’
‘সাগরদ্বীপ।’
‘মানে গঙ্গাসাগর?’
‘হ্যাঁ, শুনেছি সি বিচটা না কি দারুণ আর ফাঁকা।’
‘ভালো আইডিয়া।’
‘একসঙ্গে যাবি তালে?’
‘চল, আমার অসুবিধা নেই।’
‘কিন্তু থাকার ব্যবস্থা?’
‘তুই খোঁজ নে আজ। আমিও দেখছি।’
‘ওকে।’
খুঁজতে হয়নি। অফিসে এসে শিউলিকে ফোনে ব্যাপারটা জানাতেই ও বেশ খুশি। সঙ্গে এও জানাল ঘর খোঁজার দরকার নেই। ওর কাকিমা তো জনসেবা সংঘের মেম্বার। গঙ্গাসাগরে সেবা সংঘের বিশাল মন্দির আছে। মেম্বার কারও চিঠি নিয়ে গেলে ভালো ঘর পাওয়া যায় ফ্রি-তে। খুব ভালো কথা। শিউলি সেদিনই তার কাকিমার কাছ থেকে চিঠি করিয়ে নিয়েছিল। কাকিমা সংঘে ফোন করেও জানিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের যাওয়ার কথা। চিঠিতে পরিষ্কার লেখা ছিল ‘ভালো দেখে দুটো ঘর দেবেন।’ আজ কোন ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসপ্ল্যানেড থেকে নামখানার বাসে উঠে হারউড পয়েন্ট। সেখান থেকে বিশাল লঞ্চে করে সীমাহীন গঙ্গা পার করে সাগরদ্বীপ। তারপর ট্রেকারে আবার তিরিশ কিলোমিটার উজিয়ে বিকেল তিনটে নাগাদ যখন আশ্রমের সামনে পৌঁছোলাম, দেখি আশ্রমের অফিস ঘরের সামনে শয়ে শয়ে লোকের ভিড়! এ আবার কী! একমাত্র সাগরমেলার টাইম ছাড়া এমন ভিড় তো এখানে এসময় হওয়ার কথা নয়! তাহলে? কারণটা জানা গেল। কাল রাখিপূর্ণিমা। এই দিনটাতেও পূণ্যস্নানের জন্য দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রচুর মানুষ আসে প্রতি বছর। অধিকাংশই অবাঙালি। তার মধ্যে রাজস্থানিদের সংখ্যা দেখলাম বেশি। বিশাল চেহারার মহারাজজি চিঠি পড়ে নির্বিকার গলায় বললেন, ‘একটার বেশি ঘর দেওয়া যাবে না।’
‘সে কী! আমরা চারজন যে!’
আমাদের সবার দিকে একঝলক দেখে নিয়ে বললেন, ‘একদিন কষ্ট করুন। বড় দেখে ঘর দিয়ে দিচ্ছি, সবাইকে তো দেখতে হবে। শুধু আপনাদেরই দেখব বাকিরা রাস্তায় পড়ে থাকবে তা তো হতে পারে না, কী-ই?’
এরপর আর কী-ই বা বলা যায়! নাম সই করে ঘরের চাবি-জিনিসপত্র নেওয়ার সময় জয়ন্ত বলল, ‘এই বেলা এখন আর উপায় নেই, চল ঢুকে তো পড়ি আপাতত। বিকেলে না হয় অন্য কোথাও খোঁজা যাবে।’
আশ্রম চত্বরটা বিশাল বড়। লন ধরে ঘরের দিকে হাঁটছিলাম। আমি আর জয়ন্ত এগিয়ে, ওরা দুজন একটু পিছনে, এর মধ্যেই কাজরী আর শিউলির মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে দেখি। শিউলি মেশার ব্যাপারে ভীষণ চুজি। আমি ভাবিনি কাজরীর সঙ্গে এত দ্রুত মিশ খেয়ে যাবে। আমি পিছিয়ে এসে আলতো কামড় লাগালাম শিউলিকে, ‘তোমার কাকিমার চিঠির তেমন জোর নেই।’ শিউলি কিছু বলার আগেই কাজরীর উত্তর। ‘ওকে ওরকম বোলো না শৈবালদা। শিউলির কাকিমারই বা কী দোষ? এখন এরকম হবে কে জানত বলো?’ আমি আর কী বলব ভেবে না পেয়ে একটু ক্যাবলার মতো হেসে আবার এগিয়ে গেলাম। বন্ধুর বউয়ের সঙ্গে তো আর তর্ক করা যায় না।
ক্লিনার এসে জলে ঢেলে দিয়ে গেছে শুধু প্যানে, আর কিছু করেনি। নোংরা বাথরুমটায় কোনওমতে সিঁটিয়ে চান করে সংঘের উলটোদিকের ছিটেবেড়ার হোটেলটায় দুটো ভাত মুখে দিয়ে আবার এসে ঘরটায় বসলাম চারজনে। প্রচণ্ড গরম লাগছে, ঘরে ফ্যান আছে, কিন্তু গোটা সাগরদ্বীপে কোনও ইলেকট্রিসিটি নেই। শুধু সন্ধে ছ’টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত জেনারেটারের আলো জ্বলে। টিমটিমে বালব এ খরবটাই জেনেছি এখানে আসার পর। একতলার একদম কোণের একটা ঘর আমাদের দেওয়া হয়েছে। ঘরের মুখোমুখি সংঘের গোয়াল। গোবরের গন্ধ আর অস্ট্রেলিয়ান গোরুর বিটকেল ডাকে পিলে চমকে উঠছে। শালা, এমন একটা ঘর দিল যে ভালোমতো হাওয়া পর্যন্ত ঢোকে না।
শিউলি বলল, ‘এখানে বসে থাকার থেকে বরং চলো সমুদ্রের ধারে যাই।’ কাজরী বলল, ‘দাঁড়া না একটু পরে যাব, কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে নিই।’ বাবাহ ওদের মধ্যে এই ফাঁকে তুই-তোকারি সম্পর্ক হয়ে গেছে কখন! অবাক লাগল আমার।
জয়ন্ত শান্ত হেসে বলল, ‘ঘরটায় যা গরম, মনে হয় সারারাত্তির সমুদ্রের ধারেই কাটাতে হবে।’
‘তাহলে তুই বরং গানই গা কাজরী।’ শিউলি হাসল।
‘গান! এই গরমে!’
‘কেন রবিঠাকুর গরমের গান লেখেননি?’ আমি হাসতে হাসতে জিগ্যেস করলাম।
‘হ্যাঁ লিখেছেন, তবে সে গান গোয়ালের সামনে বসে গাইতে বারণ করে গেছেন।’ কাজরীর চটপট উত্তর। হেসে উঠলাম সবাই। কথা বলতে বলতে আমি বেখেয়ালেই তাকিয়েছিলাম কাজরীর শীর্ণ দুই রঙা হাতদুটোর দিকে। আসলে ওর শুধু মুখটুকু বাদ দিয়ে গোটা শরীরে ছোপ ছোপ শ্বেতি। বছর দুয়েক আগে হঠাৎ ওর এই রোগটা ধরা পড়ে। প্রচুর ট্রিটমেন্ট করিয়েছিল ওর বাবা, কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। যার জন্য ও সবসময় ফুলস্লিভ সালোয়ার পরে। এখন হাফ হাতা নাইটি পরে রয়েছে বলে ওর সাদা-কালো হাতদুটো কটকট করে চোখে লাগল আমার। শিরশির করে উঠল গা। হঠাৎ খেয়াল হতে চোখ তুলতে দেখি জয়ন্ত আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। অস্বস্তি হল, তড়তড় করে বলে ফেললাম, ‘কখন বেরোবি রে? আর টিকতে পারছি না।’
কাজরী বলল, ‘আমি একটু শুই, পিঠে ব্যথা করছে।’
‘হ্যাঁ শোও না’, বলে একটা বালিশ টেনে খাটের ওই কোণে রেখে বলল জয়ন্ত। কাজরী খাটের এই প্রান্ত থেকে হামা টানতে টানতে ওপ্রান্তে গিয়ে ঝপ করে শুয়ে পড়ল। আমিও বারমুডা পরা অবস্থায় পায়ে পা তুলে শুয়ে পড়লাম। অন্য মেয়ের সামনে আমার রোমশ ঠ্যাং দুটো উদোম রাখতে একটুও লজ্জা করছে না। সেটা অবশ্য আমার নির্লজ্জতা নয় কাজরীর অক্ষমতা। ওই শুকনো মড়াকাঠ ফিগার আর স্কিন ডিজিজ—সত্যি কথা বলতে একটু গা শিরশিরানি আর মার্সি ছাড়া অন্য কোনও ফিলিংসই কাজ করছিল না আমার। শিউলির রি-অ্যাকশনটা ঠিক বুঝতে পারছি না। ও নিজে এত ফিগার কনসাস। পেডি থেকে ম্যানি টোটাল কিওর করা বডি, সপ্তাহে সাত দিনই কিছু না কিছু গায়ে মাথায় ঘষে চুপচাপ ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে। ও কী করে কাজরীর সঙ্গে এত সহজে মিশছে শালা কিছুতেই ঘটে ঢুকছে না আমার। মহিলা ভাগ্য চিরকালই আমার খুব খারাপ। এতদিন ধরে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করছি আজ পর্যন্ত কোনওদিন মিনিবাসে আমার পাশে কোনও সুন্দরী মহিলা বসেনি। আমি দেখতে খারাপ নয়, বেঁটে না, দাঁত উঁচু না, নাকের লোম বেরিয়ে থাকে না, চাকরিটাও সরকারি। তবে কেউ কোনওদিন প্রেমে পড়েনি। শিউলির সঙ্গে বিয়েটা হয়েছিল মোটামুটি সম্বন্ধ করেই। শ্রীরামপুরে শ্বশুরবাড়ি আমার। ওর বড়মামা আর আমার বাবা অফিস কলিগ ছিল। জয়ন্ত, কাজরী আর আমি অবশ্য একই এলাকার।
বিছানায় কিছুক্ষণ গড়াতে না গড়াতেই বিকেলে নেমে গেল। কাজরী বলল, ‘দেখেছ তোমরা, এই বিল্ডিংটার পিছনে সুন্দর একটা শানবাঁধানো পুকুর আছে।’
‘তাই নাকি! বাহ দেখব তো’! জয়ন্ত বলল।
‘তো চলো না, এখনি যাই, আর কতক্ষণ ঘরে বসে থাকব।’ শিউলি বলল।
‘বেশ ওঠ তালে’, আমি উঠে পড়লাম।
‘তোমরা দুজন বাইরে যাও, আমরা একটু চেঞ্জ করব।’ শিউলি বলল আমাকে। আমি সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে জয়ন্তর সঙ্গে বেরিয়ে এলাম। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল কাজরী।
‘চল পুকুরটা দেখে আসি।’
জয়ন্ত বলল, ‘চল।’
বিল্ডিংটার ঠিক পিছনেই। বেশ সুন্দর। টলটলে পরিষ্কার জল, ঘাটের দু-পাশে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো উঁচু বসার জায়গা দু-দিকে।
‘চল বসি।’
বসলাম আমরা। আমি বসেই সারাদিন ধরে জিভের ডগায় কুটকুট করতে থাকা কথাটা এবার করে ফেললাম। যতটা সম্ভব ক্যাজুয়ালি জিগ্যেস করলাম জয়ন্তকে, ‘হ্যাঁ রে, কাজরী হঠাৎ এতটা রোগা হয়ে গেল কী করে?’
জয়ন্ত ওর স্বভাবমতোই শান্তভাবে উত্তর দিল, ‘ঠিক বুঝতে পারছি না। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি জানিস, সব ডাক্তারই বলে সব ঠিক আছে। দুজনে আনন্দে থাকুন। কিন্তু তবু এত ওয়েট লস করছে কেন, কিছুতেই বুঝতে পারছি না। অথচ দেখ, বাকি সবকিছুই তো নর্মাল।’
মনে মনে ভাবলাম, কোথায় নর্মাল?
‘ওই বিয়ের পর থেকে শুধু যা একটু পেটের প্রবলেম শুরু হয়েছে। তার জন্য তো খুব সাবধানে রাখি। বাইরের কোনও ভুলভাল খাবার খেতে দিই না। বাড়িতেও একেবারে নামমাত্র তেল-মশলায় রান্না হয়। তবু কেন যে…’
‘তোরা সবাই, মানে তুই-কাকিমাও ওই তেল-ঝাল ছাড়াই খাস?’
‘হ্যাঁ, নইলে ওর জন্য আলাদা করে রান্না হলে খারাপ লাগে।’
‘তা ঠিক, ভালোই করিস।…একটা কথা জিগ্যেস করব তোকে? কিছু মনে করবি না?’
‘না, না, বল না।’ আমার দিকে সোজা তাকাল জয়ন্ত।
‘না মানে তেমন কিছু নয়…ইয়ে…মানে ওর অন্য কোনও ডিপ্রেশন নেই তো?’
‘দেখ, আচমকা চেহারাটা এত খারাপ হয়ে গেছে, তার ওপর স্কিনের ব্যাপারটা তো আছেই। লোকের মুখ আর কত আটকাব বল। সারাদিনই তো কারও না কারও প্রশ্ন, সহানুভূতি আর কৌতূহলের মুখে পড়ে থাকে। আমি সময় পেলেই বোঝাই, তোমার মনখারাপের কোনও ব্যাপারই নেই। লোকে যে যা বলুক, আমি তো জানি তুমি একইরকম আছ। আমার মা-র কাছেও…’ হুড়মুড় করে কথাগুলো বলে যেতে যেতে হিক্কা তুলল জয়ন্ত। আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম। অপ্রয়োজনীয় শুকনো চোখ।
আমি জয়ন্তর হাতে আলতো হাত রেখে বললাম, ‘বাদ দে সব। তুই নিজে সুখী তো? ব্যস তালেই যথেষ্ট।’
‘ঠিক জানি না রে’ ফ্যাসফ্যাসে গলায় কথাটা বলে ফেলেই জয়ন্ত বলল, ‘তোদের দুজনকে দেখলে ভালো লাগে। দুটোতে রয়েছিস বেশ!’
আমি মুখে কিছু বললাম না, ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে থুতু ফেলার মতো করে একটু হাসি বার করলাম আমি। ‘হ্যাঁ চলে যাচ্ছে আর কি।’
‘তোদের তো প্রায় চার বছর হয়ে গেল না?’
‘হ্যাঁ ওইরকম।’ যথাসম্ভব সংক্ষেপে উত্তর দিচ্ছি আমি। নিজের প্রসঙ্গ ভ্যাজাতে ভালো লাগে না। যত পারি অ্যাভয়েড করি।
‘তো এবার কিছু কর। আর ওয়েট করছিস কেন? কাকা-টাকা হই।’
‘হবে-হবে।’
‘ফালতু আর দেরি করিস না। এরপর প্রবলেম এসে যাবে।’
‘দেখি’, বলে আমি হাসলাম। পুকুরের জলে আমার কালো শরীরটা কাঁপছে।
‘চল ওঠা যাক’, বলেই উঠে পড়লাম আমি।
একটা ভ্যানরিকশায় চেপে চারজনে পুরো এলাকাটা চষে ফেললাম। নাহ কোথাও কোনও ঘর খালি নেই। কাল পর্যন্ত সব বুকড। মাথায় হাত আমাদের। দু-দিন এখানে কাটানোর প্ল্যান ছিল। সব চৌপাট। আজ রাত্তিরটা ওই ঘরটায় কোনওমতে কাটিয়ে কাল সক্কালেই কাট মারতে হবে। আমিই মনে মনে একটু বেশি বিরক্ত হয়ে পড়ছি। জয়ন্ত জানে না, বিয়ের পর আমি আর শিউলি দুজনের কেউই ওয়েট করতে চাইনি। ইস্যু চেয়েছিলাম, কিন্তু শালা এমন কপাল, রাতের পর রাত হাজার ঠোকাঠুকি করেও আগুন আর জ্বলে না দেখে গাইনির কাছে হত্যে দিয়ে পড়লাম। পরীক্ষায় শিউলি পাশ করে গেল, মাতৃত্বে কোনও অসুবিধা নেই। সব ঠিক আছে, তাহলে? তাহলে আমি শৈবাল চ্যাটার্জি, আমার স্পার্মে কোনও প্রাণ নেই। কেসটা জানার পর শিউলি এমন অদ্ভুতভাবে আমাকে অ্যাভয়েড করতে শুরু করল। অথচ দুজনের মিলতে তো কোনও প্রবলেম ছিল না। আমি প্রাণ সৃষ্টি হয়তো না করতে পারি কিন্তু প্রাণের খেলায় মাততে পারি পুরোপুরি। কিন্তু কে জানে শিউলির ওসব ফালতু মনে হত। একবার আমি কাছে যেতেই বলেই ফেলেছিল, ‘আর কী হবে এসব নাটকে?’
‘নাটক বলছে কেন? সন্তানের জন্ম দেওয়াই কি শেষ কথা, শরীরের নিজের কোনও চাওয়া নেই? আমি কি শালা মানুষ না? কী মনে হয় তোমার?’ সেদিন আর কোনও উত্তর দেয়নি শিউলি। নিজেকে দিয়েছিল। আমার খিদেটা মিটতেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম মোদ্দা কথায় শিউলি নিজের শরীরটা ভিক্ষে দিয়েছে আমায়। নিজেকে একটা ঘেয়ো কুকুর মনে হয়েছিল সেদিন। তারপর থেকে আমিও আর পারতপক্ষে ঘেঁষতাম না। ওই নামেই পাশাপাশি থাকা। কোনও বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়পরিজনের মধ্যে কারও বাচ্চা হচ্ছে না শুনলে হেভি আরাম লাগে আমার। কোনও বন্ধুর বিয়ের পর বছরখানেক পার করলেই আমি রিপিটেডলি তাকে জিগ্যেস করতে থাকি ইস্যু কেন নিচ্ছে না, কোনও প্রবলেম আছে কি? এমন প্রশ্নের জন্য বন্ধুদের কাছ থেকে দু-একবার কড়া জবাবও শুনেছি কিন্তু আমি আটকাতে পারি না নিজেকে, প্রশ্নটাকে। এই যে জয়ন্তকে এরমধ্যেই আমার বার দুয়েক জিগ্যেস করা হয়ে গেছে ছেলেমেয়ে কবে হবে? জয়ন্ত বেশ মনমরা ভাবেই উত্তর দিয়েছে, ‘এখন তো একেবারেই সম্ভব নয়। ওর শরীরের যা অবস্থা। এত ওয়েট কম…দেখি একটু ঠিক হোক ও…।’ আমি শুনেছি, হ্যাঁ, আরাম হয়েছে শুনে।
ঘর খুঁজতে খুঁজতে রাত্রি হয়ে গেল। ভ্যানওয়ালাকে সমুদ্রের ধারে নিয়ে যেতে বলায় সে বলল রাত্তিরে যাবেন না। খুব অন্ধকার। চুরি-ছিনতাইও হয়। সেই হোটেলে নেমে খেয়েদেখে আশ্রমে ঢুকলাম। মন্দিরের চাতালে-সিঁড়িতে অনেক মানুষ বসে রয়েছে। আকাশে ঝকঝকে চতুর্দশীর চাঁদ। আলোয় উপচে পড়ছে চারদিক। শিউলি বলল, ‘ঘরে ঢুকে কী হবে, এখন চাঁদের আলো! চলো পুকুরটার ধারে যাই।’
কাজরী বলল, ‘উঁহু, তার চেয়ে বরং মন্দিরের সিঁড়িটায় বসা যাক।’
‘কেন, পুকুর দেখব।’ শিউলির বায়না।
জয়ন্ত বলল, ‘আচ্ছা, বেশ বেশ, তুমি এক কাজ করো, শৈবালের সঙ্গে পুকুরধারে যাও, আমি বাচ্চাটাকে একটু মন্দিরে ঘুরিয়ে নিয়ে আসছি।’
‘কে বাচ্চা? আমি!’ ঠোঁট ফোলাল কাজরী।
আমি আর শিউলি হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের সামনে এসে বসলাম। স্থির জলে চাঁদ এসে চুপ করে বসে আছে। মাছেদের চলাফেরায় কেঁপে উঠছে কখনও।
‘খুব শান্ত, না, জায়গাটা?’ আমি বললাম।
‘হ্যাঁ।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর শিউলির।
‘তবে বেটাইমে চলে এসেছি।’
‘সে কী, এত সুন্দর রাত্তির পেয়েও…’
‘না, না, জ্যোৎস্নার কথা বলছি না। আমি বলছি ঘরটার কথা, ভাবো তো বেড়াতে এসেও…’
‘সে একটা রাত্তির সবাইকে অ্যাডজাস্ট করতে হবে। কী করা যাবে এখন।’
‘সেকথা বলছি না। বলছি যা গরম ঘরটায়। থাকব কী করে সারারাত, কিন্তু বাইরে কত ঠান্ডা হাওয়া দেখো।’
‘সে না হয় আজকে বাইরেই কাটিয়ে দেব সবাই।’
আমি আর হুঁ হাঁ কিছু করলাম না। কিছুক্ষণ নিজে নিজের মনে কথা বলে চুপ থাকার পর বললাম, ‘কাজরী কি রোগা হয়ে গেছে না? দেখলে এত কষ্ট লাগে। তোমার সঙ্গে তো দেখছি ভালো মিশে গেছে।’
‘হুঁ। তুমি আবার এই নিয়ে কিছু বলনি তো?’
‘ধ্যাস তাই আবার কেউ বলে। বেচারা জয়ন্তটার জন্য খারাপ লাগে।’
‘ভীষণ ভালো ছেলে জয়ন্তদা। এখনকার দিনে সত্যিই রেয়ার।’
কথাটা হয়তো সত্যি। জয়ন্ত যখন কাজরীকে পছন্দ করে বিয়ে করে ঠিক করে তখন কাজরীর শরীরে রোগটা ভালোমতোই ধরে গেছে। জয়ন্ত হুগলির একটা সরকারি স্কুলের লাইব্রেরিয়ান। সত্যি কথা বলতে ওকে দেখতে মোটেও ভালো নয়। ওপরের পাটির সব ক’টা দাঁত মাড়ি সমেত ঠোঁটের বাইরে বেরিয়ে থাকে সবসময়। পাতলা চুল, কুঁজো, কিন্তু দেখতে যেমনই হোক সব জেনেশুনে একটা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া মুখের কথা নয়। কাজরীও যখন বিয়ে করে জয়ন্তকে তখন ও রবীন্দ্রসংগীতে বেশ নাম করে ফেলেছে। সম্ভাবনাময় শিল্পী। এদিক-ওদিক থেকে প্রাোগ্রামের ডাকও আসে। কিন্তু রোগটা চেপে বসবার পর দুম করে গানটা পুরোপুরি ছেড়ে দিল। জয়ন্ত যে কাজরীকে ভালোবাসত আমরা বন্ধুরা সবাই জানতাম। কিন্তু ইনট্রোভার্ট আর দেখতে একটু খারাপ বলে কোনওদিই সাহস করেনি কাজরীকে সেকথা জানাতে। কাজরীর গানের ছিল ও অন্ধ ভক্ত। যেখানে ওর প্রাোগ্রাম সেখানেই জয়ন্ত হাজির হয়ে যেত। আমরা জয়ন্তকে বারবার বলতাম কাজরীকে জানাতে। ও বলত, ‘ধুস, পাত্তাই দেবে না আমায়।’ কিন্তু জয়ন্ত শেষপর্যন্ত যখন জানিয়েছিল তখন কাজরীর আর পাত্তা না দিয়ে উপায় ছিল না। গোটা গায়ে একটা দৃষ্টিকটু রোগ নিয়ে ডিপ্রেশনের শেষ কোনায় ঠেকে যাওয়া কাজরী রাজি হয়ে গিয়েছিল জয়ন্তকে বিয়ে করতে। অথচ সবাই জানে কাজরী পুরোপুরি সুস্থ থাকতে কোনওদিন ফিরে তাকায়ওনি জয়ন্তর দিকে।
আমার শুধু দুটো জিনিস জানতে খুব ইচ্ছে করে, বিছানায় কাজরীর সাদা-কালো ছোপ শরীরটা দেখে জয়ন্তর কী মনে হয়? আর কি ইচ্ছে আসে প্রেমের? জয়ন্ত কি পস্তায় মনে মনে? জানি দুটো প্রশ্নই করা আর উত্তর দেওয়া কঠিন, অন্যায়।
‘ওরা দুজনে বেশ ভালো আছে, না?’ পুকুরের জলের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কের মতো বলল শিউলি।
‘হয়তো আছে।’
‘হয়তো কেন বলছ, দেখে বোঝো না’, শিউলির গলায় ঝাঁঝ।
‘দেখে কি সব বোঝা যায়?’
‘দেখতে চাইলেই বোঝা যায়। তোমার তো সব কিছুতেই খুঁত খোঁজা স্বভাব।’
‘কী মুশকিল, তুমি এভাবে কথা বলছ কেন?’ বিরক্তি লাগল আমার।
‘কেন বলব না।’
‘না বলবে না।’ মাথা গরম হয়ে গেল আমার। ‘আমাদের তো বাইরে থেকে সবাই দেখে ভাবে খুব ভালো আছি দুজনে।’
‘তার জন্য কি আমি দায়ী?’ বলেই উঠে চলে গেল শিউলি। আমি চুপ করে বসে রইলাম।
হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত একটা খাটেই চারজনকে শুতে হল রাত্রে। গুমোট গরম, অথচ আশ্চর্যভাবে শোওয়ার একটু পরেই কাজরী ফুরফুর নাকে নাক ডাকতে শুরু করল। আমি আর জয়ন্ত শুয়ে আস্তে আস্তে গল্প করছিলাম, একটু পরে দুজনেই থেমে গেলাম। শিউলি তো সন্ধের পর থেকেই চুপ। আমার পাশে শুয়ে। আমি জানি ও ঘুমোয়নি। অসহ্য রাত সরতে সরতে শেষ কোণে ঠেকল যখন আমি ঘর ছেড়ে বাইরে উঠোনে এসে দাঁড়ালাম। অনেক দূর থেকে খুব হালকা সমুদ্রের শব্দ ভেসে আসছে। পৃথিবীর গায়ে মিহি ওড়না জড়ানো। অদ্ভুত চারদিক। অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। জয়ন্ত কখন এসে পাশে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি।
‘খুব গরম ঘরটায়, একটু ঘুম হল না।’
‘হুঁ।’
‘কাজরীর খুব শখ সানরাইজ দেখবে। ওটা দেখেই সকালে কলকাতার বাস ধরে নেব, কী বলিস?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ’, সংক্ষেপে উত্তর দিলাম আমি। তারপর বললাম, ‘রেস্ট হল না একটুও, শুধুই ছোটাছুটি।’
‘তোর হয়তো হয়নি। আমার কিন্তু রেস্ট হল আজ’, বলে ফিক করে হাসল জয়ন্ত। শেষরাতের চাঁদের আলোয় জয়ন্তর উঁচু এবড়ো-খেবড়ো দাঁতগুলো অতিরিক্ত অদ্ভুতভাবে জেগে উঠল একবার।
‘সে কী রে, রেস্ট হল মানে?’ জিগ্যেস করে আমি দায়সারা হাসলাম।
‘এই যে আজকে সবাই একসঙ্গে শুলাম বলে আমার একদিন হলিডে গেল। নইলে রোজ রাত্রে আমাকে দেবী পুজো করতেই হয়।’
‘বলিস কী! রোজ!’
‘হ্যাঁ, আর বলিস না। একদিন বাদ গেলেই অদ্ভুত টেনশনে পড়ে যায় ও।’
‘কেন?’
‘জানি না। একেকদিন যদি খুব টায়ার্ড থাকি, ইচ্ছে করে না। ঘুমিয়ে পড়ি। ব্যস ওর মুখ ভার হয়ে যায়। পরদিন সকাল থেকে প্রায় কথা বন্ধ। শুধু এক ডায়ালগ, আমি নাকি ওকে আর ভালোবাসি না। অ্যাভয়েড করি…কী জ্বালা বল তো?’
আমি শুনলাম, শুনে আমার দাঁত বের হল। চাঁদের আলোয় সেই দাঁত কেমন দেখতে জয়ন্ত জানল। বললাম, ‘ভালোই তো, এই বয়সে রেস্ট কী নিবি, চালিয়ে যা।’ বলেই আমি প্রসঙ্গ পালটালাম। ‘তবে কাজরী গান করাটা একেবারে ছেড়ে দিল কেন? এত সুন্দর গলা ছিল। কেরিয়ারটাও তৈরি হচ্ছিল…’
‘কী বলব বল, আমি তো কম বোঝাইনি। বিয়ের পর থেকে তো এক দিনের জন্যও রেওয়াজে বসাতে পারিনি। বলবে ধুস কী হবে ওসব করে, সব ফালতু, এত খারাপ লাগে…হয়তো আমার জন্যই না কি…’ আবার দুজনে চুপ।
‘ভোর হচ্ছে বুঝলি জয়ন্ত, তবে আকাশটা দেখেছিস? সূর্য উঠবে বলে মনে হয় না।’ জয়ন্ত উত্তর না দিয়ে ঠোঁট ওলটাল। ওর মুখটাও আকাশটার মতোই গুমোট হয়ে গেছে। ‘কাজরীকে ডাক জয়ন্ত, সানরাইজ দেখবে বলেছিল, চল বেরোনো যাক।’
‘উঁ…হ্যাঁ যাই।’ ঘরের দিকে যাচ্ছিল ও। আমি ডাকলাম ‘শোন।’
‘কী?’ আমার দিকে ফিরে তাকাল ও। আমি ওর হাত ধরে বললাম ‘মুড অফ করে দিলাম?’
‘না, না কিছু না, বাদ দে ওসব।’
‘সরি।’
‘হেরে যাচ্ছি শৈবাল, মনে হয় হেরে যাচ্ছি।’ আমার হাতের আঙুলগুলো প্রচণ্ড শক্ত করে জড়িয়ে ধরল জয়ন্ত…’এত কঠিন হবে বুঝিনি, এত কঠিন’! হাত ছেড়ে দিয়ে ও চলে গেল ঘরের ভেতর। আমি একা গেটের দিকে হাঁটতে থাকলাম। ওরা ঠিক ধরে নেবে আমাকে। বিচ্ছিরি ভোর। আলো নেই, হাওয়া নেই।
আশ্রম থেকে প্রায় মিনিট কুড়ি ধরে হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্রের ধারে পৌঁছোলাম। সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ পার করে হলুদ বালির সমুদ্রতীর। একেবারে অন্যরকম। আর এত সুন্দর সি বিচ আমি কোথাও আগে দেখেছি মনে পড়ে না। হু-হু ফাঁকা, আবছা আলোর ঘষা ঘষা মেঘলা আকাশ, হাওয়া দিচ্ছে, ঢেউ ছুটে এসে পড়ছে নির্জন বালিতে বার বার, ছোট্ট একটা ঘর থেকে আচমকা এমন এক অনন্তের সামনে এসে পড়ায় মনটা কেমন যেন হয়ে উঠল। কাজরী বলল ‘হাঁফিয়ে গেছি, একটু বসবে তোমরা?’ জয়ন্ত অদূরে একটি বালির ঢিবি দেখিয়ে বলল, ‘চলো ওখানে গিয়ে বসি।’ এদিকটায় চারদিকে ইতস্তত ফণীমনসার ঝোপ, অন্য চেনা-অচেনা ছোট ছোট গাছও আছে। ঢিবিটার একটু পিছনেই টলটলে ছোট একটা ঝিল।
আজ সকালে আমরা চারজনেই বড় চুপ। তিনজনে ঢিবিটার ওপর বসলাম। জয়ন্ত বসল না। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। জলের শব্দ, হাওয়া আমাদের শরীরে মিশছে। আকাশের কালো মেঘ জমছে সমুদ্রে।
‘বৃষ্টি হবে বোধহয়,’ আমি বললাম, ‘কেমন মেঘ জমছে দেখছিস?’
‘কী জানি,’ অন্যমনস্কের মতো উত্তর দিল জয়ন্ত।
‘কাজরী আমার একটা কথা রাখবি? স্রেফ আজকের জন্য’ শিউলি হঠাৎ বলল।
‘কী বল?’
‘শুধু আজ এই ভোরবেলাটার জন্য একটা গান গাইবি?’
চুপ থাকল কাজরী।
‘আমাদের জন্য নয়, তোর জন্যও নয়। ধর না, এই সমুদ্রটার জন্য, এই মেঘটার জন্য…’
‘কী হবে গেয়ে?’
‘কিছুই হবে না, কিছুই হবে না হয়তো। কিন্তু তবু যদি তোর কোনওদিন মনে হয় ইশ ওই সময়টায় কেন একটু গান গাইনি।’
আমি তাকালাম মেয়েদুটোর দিকে, ওরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে কী যেন পড়ছে। জয়ন্তও একবার তাকাল ওদের দিকে। তারপর আবার অন্য দিকে মুখ ফেরাল।
কাজরী খুব নীচু গলায় বলল, ‘হাঁফিয়ে পড়ব। অভ্যাস নেই।’
‘সেখানেই থেমে যাবি।’
‘আচ্ছা…’
কাজরীর ‘আচ্ছা’ শব্দটায় জয়ন্ত মুখ ফেরাল না এদিকে। শুধু ঢিবিতে বসল সমুদ্রের দিকে চোখ রেখেই।
‘কী গান শুনবি বল?’
‘তোর এক্ষুনি যা মনে আসছে।’
‘বেশ, পিঠ সোজা করে বসল কাজরী, দু-চোখ বন্ধ করল। আর ঠিক তক্ষুনি বৃষ্টির একটা ফোঁটা আকাশ থেকে নেমে পড়ল। কাজরী আচমকা শুরু করল ‘তরী সেই সাগরে ভাসায় যাহার কূল সে নাহি জানে।’
ছাঁৎ করে উঠল বুকের ভেতর। আমি দেখলাম শিউলিও চোখ বন্ধ করল। ‘…কেন ভোরের আকাশ ভরে দিলে এমন গানে গানে…’ আরও দু-এক ফোঁটা। জয়ন্ত স্থির হয়ে বসে। মৃত নারকেল গাছের মতো। কাজরী গাইছে, এতদিন পর, এতটা দিন পর গানে মিশে যাচ্ছে ও। ‘তবে ক্ষণে ক্ষণে কেন আমার হৃদয় পাগল হেন…’ আচমকা আকাশ ফেটে বৃষ্টি এল, কী তীক্ষ্ণ বৃষ্টির ফোঁটা; মেঘ বিদ্যুৎ সমুদ্রের গর্জন…কাজরীকে কেউ বললাম না ‘থামো’। উঠে দাঁড়াতেও পারলাম না, আবদ্ধ হয়ে গেছে কেমন গোটা শরীর। কাজরী গেয়েই যাচ্ছে বারবার ঘুরে ফিরে। বজ্রে-বৃষ্টিতে ওর গান শুনতে পাচ্ছি কি পাচ্ছি না। বৃষ্টির ধোঁয়ায় আমরা পরস্পরের কাছে ঝাপসা হয়ে আসছিলাম। হঠাৎ, কারণ জানি না কেন, এত কান্না পেল আমার, এমন অদ্ভুত সময়ে অকারণে! নির্বোধ সময়জ্ঞানহীন চোখের জলে অযথা ভেসে গেল আমার গাল-চিবুক-গলা-বুক এই মাটি। বৃষ্টির জলের জন্য আমাকে কাঁদতে ওরা দেখতে পারছে না। কিন্তু আমি এও জানি, আসলে আমরা চারজনেই কাঁদছি এখন। আর অবিশ্রান্ত কথা বলে চলেছি পরস্পরের অশ্রুর সঙ্গে।
উদিতা
সেপ্টেম্বর ২০০৯