একটু জীবনের বর্ণনা
খাটে শোয়ানো মাকে কাঁধে নিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেটের কাছে দাঁড় করানো ম্যাটাডোরে তোলবার সময় রমিত একঝলক মেয়েটাকে দেখতে পেল। আত্মীয়-প্রতিবেশীদের মতোই মুখটা তার থমথমে হলেও চোখ দেখে কাঁদেনি বোঝা গেল।
বুবাই বলল, ‘ডেথ সার্টিফিকেটটা নিয়েছিস তো?’
রমিত বলল, ‘মামার কাছে আছে।’
‘কই মামা? ওটাকে কয়েক কপি জেরক্স করে নিতে হবে’, বলে বুবাই মামাকে খুঁজতে চলে গেল।
রমিত ম্যাটাডোরে উঠতেই জামাইবাবু বললেন, ‘মা-র মাথার কাছটায় বসে হাতটা ছুঁয়ে থাক।’
আজকে সবাই কেমন যেন রমিতকে একটা বিশেষ খাতির করছে। মা মারা গেলে মানুষ কি হিরো হয়ে যায়? অটোগ্রাফ চায়? সকালের প্রথম দিকটায় সবার কাছ থেকে এমন একটা এক্সট্রা কেয়ার বেশ অস্বস্তি লাগছিল রমিতের। এখন অনেকটা সয়ে গেছে। বুকের ভেতর দু:খের গুমগুম শব্দটার ফাঁকে-ফোঁকরে পরিজনদের এই আলাদা নজরটায় একটা অদ্ভুত নরম নরম ভালো লাগছে। তিরিশ বছর বয়সেও যে ছেলে পাঁচ-ছ’টা টিউশনি ছাড়া কোনও চাকরি-বাকরি জোটাতে পারে না, তার যে অন্য কারও কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশা করতে নেই, রমিত সেটা জানে। করেও না। দুটো সেলসম্যানের চাকরি করেছিল কিছুদিন। প্রথমটা ছিল নাইলনের ঝাঁটা আর ফিনাইল বিক্রি। মাসিক বারোশো। এক মাস ধরে ডোর-টু-ডোর পাবলিকের খিস্তি শোনার পর মজুরিটা খুব কম মনে হতে ছেড়ে দিয়েছিল। দ্বিতীয়টা আঠেরোশো। ওয়াটার পিউরিফায়ার। শৌচাগার নি:সৃত জলও মিনারেল ওয়াটার বানিয়ে দেওয়ার গ্যারান্টিযুক্ত। জ্যৈষ্ঠ মাসে পাঁচ দিন দুপুরবেলা কলকাতা চাটবার পর পঞ্চাশ দিন জন্ডিস আঁকড়ে শুয়েছিল। আর যায়নি।
‘হ্যাঁ রে, কাকু কেমন আছেন?’ দীপু জিগ্যেস করল।
‘আছে। দিদি আর ছোটকাকু রয়েছে কাছে।’
বাবা যে ঠিক কেমন আছে সেটা বোঝার ক্ষমতা একমাত্র ডাক্তারেরই রয়েছে। গত বছর ব্যাঙ্ক থেকে পেনশন তুলে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় হঠাৎ স্ট্রোক হয়ে পড়ে গিয়ে প্যারালাইসিস। কথা বলার শক্তিটা পর্যন্ত নষ্ট হয়ে গেছে। বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে শুধু তাকিয়ে থাকতে পারে। দৃষ্টিটাও কেমন যেন অসার, শূন্য। বাবা বুঝছে হয়তো সবই। শুধু প্রকাশের ক্ষমতা নেই। মানুষ কি ভেতরে ভেতরে চোখের জল ফেলে কাঁদতে পারে? পারলে ভালো হয়। অন্তত বাবার মতো মানুষের।…আবার মেয়েটা। ম্যাটাডোরে মাকে ছুঁয়ে থেকে দেখতে পেল রমিত। মেয়েটা একবার রমিতের দিকে তাকাল। তারপর অদূরে দাঁড়ানো নীল রঙের মারুতি ভ্যানটায় উঠে বসল। তার মানে শ্মশানে যাবে। আশ্চর্য, কথাটা ভেবে ভালো লাগছে কেন রমিতের? গাড়িটা বড়কাকুর। তা হলে কাকুর কেউ হবে কি? মুখটা আগে কখনও দেখেছে কি না একবার মনে করবার চেষ্টা করলও। না, মনে পড়ছে না। ধু-স-স এখন এইসব…। তবে বড়কাকুর কেউ নাও হতে পারে। এই সময় তো সবাই সবার খুব আপন হয়ে যায়। ওই যে জামাইবাবু, সকাল ন’টা থেকে এন্তার ভলান্টারি সার্ভিস দিয়ে চলেছেন, নইলে অন্য সময় এইরকম ফ্রিতে নিজের বউকে ভালোবাসেন কি না সন্দেহ। বড়লোক ঘরে বিয়ে হয়ে দিদিও এই বছর দুয়েকের মধ্যে কেমন যেন কাগজের ফুল হয়ে উঠেছে। রূপে অমর কিন্তু গন্ধ নেই। একটা হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি আর ব্লাউজ পরে এসেছে। কেন এসেছে? শোকের বাড়িতে এরকম হালকা রং মানায় বলে! এসব কথা এখন মাথায় আনতে ভালো লাগছে না। মা-র মুখে একটা মাছি বসেছে। হাত দিয়ে উড়িয়ে দিল রমিত। কটকটে রোদ্দুরটাও সটান মা-র মুখের ওপর। একটা ছাতা চাইবে কি না ভাবল ও। গাড়ি স্টার্ট নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুরা চটপট উঠে পড়ল। পরপর দুটো গাড়ি চলতে শুরু করল। মা বোধহয় কনভয় মানে জানত না। জানলে ভালো লাগত। খাটের পাশে গোঁজা একগোছা ধূপ জ্বলছে। ধোঁয়ায় চোখ-মুখ জ্বালা করছে। রমিত মারুতির দিকে তাকাল। মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটা কি দেখছে রমিতকে?…
‘যাহ, কাকিমার পায়ের ছাপটা নেওয়া হল না তো,’ অয়ন বলল।
রমিত সামান্য ভুরু কুঁচকে বলল, ‘উঁহু, এসবের দরকার নেই।’
জামাইবাবু ল্যাজ জুড়লেন, ‘না-না ওসব আজকাল আর কেউ করে না।’ আরও বোধহয় কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তখনই ওঁর বুকপকেটের মোবাইলটা বেজে উঠল। ওটাকে কানে তুলে—’হ্যালো…হুঁ…সাতটায়…ওকে’ বলে রেখে দিলেন।
রমিত বুঝল জামাইবাবু সাতটার আগে কাট মারবেন। নিশ্চয়ই অফিসের মিটিং আছে। একজিকিউটিভ বলে কথা! নিজের এক্সপায়ারি ডেটের পরেও মিটিং অ্যাটেন্ড করতে পারে লোকটা। কথাটা ভেবেই ওর মুখটা মনে পড়ল। দুর, এসব কী হাবিজাবি ভাবছে ও! সুজয় খই ছিটোচ্ছে। খইয়ের মধ্যে খুচরো পয়সা মেশানো। একটু আগে বাড়ির পিছনে কয়েকটা বাচ্চা দৌড়োচ্ছিল। পয়সাগুলো তুলছিল। বেশিক্ষণ দমে কুলোয়নি, গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারে কখনও? রাস্তার ধারে একটা টিভির দোকানের সামনে একগাদা লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে। গাড়িটা ট্র্যাফিক সিগনাল না পেয়ে দোকানটার পাশে দাঁড়াতেই হঠাৎ ‘আ-আ-উ-উ-ট’ বলে ভয়ংকর চিৎকার করে গাড়ির সামনেই ছেলে-বুড়োগুলো আনন্দে নাচতে শুরু করল। ওহ হো আজকে তো ইন্ডিয়া-অস্ট্রেলিয়ার ওয়ান ডে ছিল। নিশ্চয়ই অস্ট্রেলিয়ার কেউ আউট হয়েছে। রাস্তার রাস্তায় ইন্ডিয়ান ফ্ল্যাগ। পনেরোই অগাস্টেও এত ঝোলে না। বন্ধুরা সবাই ম্যাটাডোর থেকেই যতটা সম্ভব ঘাড় নীচু করে দোকানের টিভিটার দিকে একবার তাকাতে চেষ্টা করল কে আউট হয়েছে জানার জন্যে।
সত্যিই বন্ধুগুলোকে খেলা দেখা ছেড়ে রমিতের সঙ্গে একপ্রকার বাধ্য হয়েই যেতে হচ্ছে। খেলার দিনে মানুষের মারা যাওয়াটা যথেষ্ট অন্যায়ের।
নিমতলার গলিতে গাড়ি দুটো ঢুকতেই এতটা রাস্তার পরিবেশ যেন ঝুপ করে পালটে গেল। এই জায়গাটা ভারি অদ্ভুত! মানুষগুলো বোধহয় আজীবন দু-বেলা মৃত্যু দেখতে দেখতে হেদিয়ে গেছে। আর মনে দাগ কাটে না। ওদের গাড়ি দুটো শ্মশানের সামনে এসে দাঁড়ানোর পরেও আশেপাশের মানুষগুলো নির্বিকার। একবার ফিরেও তাকাল না। দিব্যি খালি গায়ে বসে মাটিতে গামছা পেতে তাস খেলছে। হ্যা হ্যা করে হাসছে। কালো কালো বাচ্চাগুলো হইহই করে ছুটোছুটি করছে। জামাইবাবু তাড়া লাগলেন, ‘বুবাই তুমি আমার সঙ্গে কাগজগুলো নিয়ে অফিসে এসো। আর তোমরা বডি নামাও।’
বডি! গত পরশু দিনও জামাইবাবু মাকে ‘মা কেমন আছেন?’ জিগ্যেস করেছিলেন। ম্যাটাডোর থেকে লাফ দিয়ে নামার সময়ে জামাইবাবু একটু হড়কে গেলেন। পায়ে লেগেছে বোধহয়। চোখ-মুখ কুঁচকে অল্প খোঁড়াতে খোঁড়াতে বুবাইয়ের সঙ্গে অফিসের দিকে গেলেন। ওরা সবাই মাকে গাড়ি থেকে নামনোর সময় রমিত একবার আড়চোখে মারুতির দিকে তাকাল। মাসি, বড়কাকু, কাকিমা গাড়ি থেকে নামলেন। মেয়েটা…আসেনি। তবে যে…নাহ ওই তো নামছে। মাকে অফিসঘরটার সামনে রাখা হল। জামাইবাবু ততক্ষণে নিজের কাজ শেষ করে ফেলেছেন। উনি রমিতের কাছে এসে বললেন, ‘এদিককার কাজ সব কমপ্টি বুঝলি। এখন বাকি রইল কাজের জন্য চাল-কলা ওইসব আর তোর ধড়া।’ বলে উনি সুজয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সুজয় তুমি পুরুতের কাছ থেকে কী কী লাগবে জেনে নিয়ে ওগুলো কিনে ফেলো। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। অনেক টাইম আছে, চুল্লিতে একটা বডি রয়েছে এখন। ওটার পর আমাদের। এই টাকাটা রাখো’, বলে উনি দুটো একশোর নোট বার করে দিলেন। সুজয় টাকাটা নিয়ে অয়ন আর দীপুকে নিয়ে চলে গেল।
জামাইবাবুও পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে ‘তুই এখানে থাক আমি আসছি একটু’ বলে চলে গেলেন। রমিতেরও সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মা-র মাছে কেউ নেই। এই সময় বড়কাকুরা এলেন। সঙ্গে মেয়েটা।
‘কী রে একা দাঁড়িয়ে আছিস? ওরা সব কোথায়?’ মাসি জিগ্যেস করলেন।
‘ওই জিনিসপত্রগুলো কিনতে গেল।’
মেয়েটা রমিতের থেকে মাত্র ফুট চারেক দূরে দাঁড়িয়ে। এতক্ষণে মেয়েটাকে কাছ থেকে ভালো করে দেখতে পেল ও। মাঝারি হাইট, ছিপছিপে চেহারা, একটা হলুদ রঙের সালোয়ার পরেছে। সাদা ওড়না। গায়ের রংটা বেশ ফরসা, চুলটা লালচে, মনে হয় হেনা করা। গরমে মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। সত্যি আজকে গরমটাও পড়েছে সাংঘাতিক।…কিন্তু মুখের গড়নটা যেন…ধুসস, আসলে আজকে সারাদিন ধরে মা-র মুখটা মনে আসছে বলে বোধহয় সবাইকে…। সত্যি, সামনে শুয়ে থাকা চোখে তুলসীপাতা নাকে তুলো গোঁজা মা-র ফ্যাকাশে মুখটা ভুলে থাকতে চাইছে রমিত। সেই ছোট্টবেলার নরম নরম মা…বুকের ভেতরটায় ঝং করে শব্দ হল। নাহ, এখন ওসব ভাববে না ও। কান্না-টান্না পেয়ে গেলে বিচ্ছিরি ব্যাপার। মেয়েটা মাঝেমধ্যে ওর দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। কেন? কে ও? এখন জিগ্যেস করে জানার উপায়ও নেই। অথচ কাকু, মাসি ওরা যেন টেরই পাচ্ছেন না মেয়েটা ওঁদের সঙ্গে রয়েছে। আদৌ আছে তো সত্যি সত্যি?…ধ্যার, ভুলভাল ভাবতে শুরু করেছে ও। একটু ঘুরে আসতে হবে।
‘কাকু তোমরা একটু মা-র কাছে থাকো। আমি আসছি এখুনি’ বলে মেয়েটার দিকে একবার তাকিয়ে রমিত আস্তে আস্তে চুল্লির ঘরটার দিকে গেল। কেমন শিরশিরে শান্ত ঘরটা। একটা অদ্ভুত ওম ছড়িয়ে রয়েছে। ওখান থেকে সরে এল রমিত। গঙ্গার ঘাটের সিঁড়ির প্রথম ধাপটার এক কোণে দুজন মাঝবয়সি লোক বসে দার্শনিক কথা আলোচনা করছেন, ‘বুঝলে হে কেন যে মানুষ শ্মশানে দাহ করতে নিয়ে আসে! সংসারে প্রতিটি মানুষই তো আজীবন ধরে শুধু পোড়ে। আবার যে কেন নতুনভাবে আয়োজন করে…।’ যে ভদ্রলোক শুনছেন সম্ভবত তাঁরই বাবা কিংবা মা এখন চুল্লির ভিতরে রয়েছেন। ভদ্রলোক বেশ স্বাভাবিকভাবেই অল্প অল্প মাথা নেড়ে সায় দিয়ে যাচ্ছেন। চোখে-মুখে তেমন কোনও শোকের ছাপ নেই। এই বয়সে বাপ-মা মারা গেলে তেমন দু:খ কেন লাগে না কে জানে! ভদ্রলোকের মাথা জোড়া টাক। ঘাটকাজে আর নতুন করে নেড়া হতে হবে না। রমিত গঙ্গার দিকে তাকাল। এখন গঙ্গাটা কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে, শান্ত, গরিব বৃদ্ধদের বাইফোকাল চশমার মতো ঘোলাটে। ভালো লাগছে না। মা-র কাছে ফিরে এল ও।
জামাইবাবু আর বন্ধুরা এসে গেছে। এর মধ্যে আর একটা শরীরও এসেছে। এও মহিলা। দুটো শরীর পাশাপাশি রাখা। প্রায় একইরকম লাগছে দুজনকে। ওদের একটা মেয়ে একঘেয়ে সুরে কেঁদে চলেছে। চোখে জল নেই। ফুরিয়ে গেছে বোধহয়।
জামাইবাবু বললেন, ‘খাটটাকে ধরো, এবার আমাদের নম্বর।’ ‘আমাদের নম্বর’ কথাটা বিচ্ছিরি শোনাল। জামাইবাবু নিজেই এবার খাটের এক প্রান্ত ধরে কাঁধে নিলেন। কাকু-কাকিমার সামনে ওঁর ব্যস্ত ভাবটা যেন একটু বেশি বলে মনে হল। সবাই মিলে খাট তোলার সময় বুকের ভেতরটা আবার অসম্ভব থমথমে হয়ে উঠল রমিতের। মা চলে যাবে! একেবারে! মৃত এই শরীরটাকে ও আর জীবনে কক্ষনো দেখার ভীষণ ইচ্ছে হলেও দেখতে পাবে না। মাকে চুল্লির ঘরটার সামনে এনে ফুলমালাগুলো তুলে বাখারির মাচায় শোয়ানো হল। মাচার গাঁটগুলো উঁচু-নীচু ছুঁচলো। পুরুতমশাই রমিতকে পাশে বসালেন, তারপর আচমন করিয়ে মাটির খুরিতে খানিকটা কালো তিল, চাল আর কাঁঠালি কলা দিয়ে বললেন, ‘এটাকে মাখো ভালো করে।’
রমিত আর মাকে সবাই গোল করে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। হাতটা অল্প অল্প কাঁপছে রমিতের। মেয়েটা রমিতের প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।
‘নাও এবার এটাকে ছোট পিণ্ড বানাও। আর একটা পিণ্ড হাতে নিয়ে আমার সঙ্গে মন্ত্র বলতে বলতে ডান হাতের তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলির মাঝখান দিয়ে এমনি করে…।’
পুরুতমশাইয়ের কথা আর কানে আসছে না রমিতের। মা চলে যাবে। সম্পূর্ণ চলে যাবে! একটুও থাকবে না! কাছের বলে আর কেউ…। এতক্ষণ পাঁজরের ভেতর আটকে থাকা কালবৈশাখী প্রচণ্ডভাবে আছড়ে পড়ছে রমিতের গোটা শরীরে। সমস্ত শিরা-উপশিরা-তন্তু যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে…গুঁড়িয়ে যাচ্ছে মাথা…হাড়…পাঁজর, তবু আশ্চর্য, জল আসছে না চোখে! সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ চোখ। তখনই এক ফোঁটা জল রমিতের ডান হাতের ওপর পড়ল। জল! তবে কি…মেয়েটা কাঁদছে! কাঁদুক, আপ্রাণ কাঁদুক। পিছনে তাকাল না রমিত, যদি মেয়েটা না কাঁদে?…যদি অন্য কোনও জল হয়?…তাহলে…।
তা না হলেও মা-র গলার ওপর চাল-তিল-কলার পিণ্ড, তা না হলেও মা-র হাতে-পায়ে-মুখে জবজবে ঘি। তারপরেও মা-র গায়ে একটুকরো সাদা থান, মা-কোমর থেকে লাল সুতোর বাঁধা মাদুলি খুলে নেওয়া। তারপরেও পাটকাঠির মুখে আগুন নিয়ে মাকে প্রদক্ষিণ করতে করতে মা-র মুখের দিকে একবার তাকাল রমিত। কী ভয়ংকর হয়ে উঠেছে মুখটা! চেনা যাচ্ছে না। মানুষ মারা যাওয়ার পরেও অত অসহায় হয়ে ওঠে! আগুনটা মা-র মুখে ছোঁয়ানোর সময় চোখ দুটোকে প্রচণ্ডভাবে বন্ধ করে ফেলল রমিত। তারপর…আর নয়, লোহার চাকাগাড়ি করে মা গড়গড় করে চলে গেল হাঁ-করা আগুনমুখের দিকে। রমিত শেষ একবার, একবার শেষ তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই মা-র থানটায় আগুন ধরে গেছে। বন্ধ হয়ে গেল দরজা। কী প্রচণ্ড ক্লান্তি লাগছে। পা দুটো থিরথির করে কাঁপছে। জামাইবাবু, বন্ধুরা সবাই রমিতকে ধরে বাইরে নিয়ে এল। গঙ্গার ঘাটের সামনে এসে জামাইবাবু বললেন, ‘এখানে বোস। শরীর খারাপ করছে? চা খাবি?’
রমিত বলল, ‘আমি ঠিক আছি। এখন কিছু খাব না। বরং বন্ধুদের কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। ওরা সেই সকাল থেকে না খেয়ে রয়েছে।’
সুজয় আর অয়ন সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘আমাদের জন্য ভাবতে হবে না তোকে।’
জামাইবাবু ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘না, না, সেই সকাল থেকে খাটছ তোমরা। ছি-ছি, আমারও খেয়াল নেই। ভেরি সরি। এখানে ভালো রেস্টুরেন্ট কোথায় আছে জানো কেউ?’
দীপু বলল, ‘আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না। আমরা কিছু খাব না এখন। আর তো ঘণ্টাখানেকের ব্যাপার।’
কিন্তু ভয়ংকর লজ্জিত জামাইবাবু আরও পীড়াপীড়ি শুরু করাতে বুবাই বলল, ‘ঠিক আছে, বরং একটু চা খাওয়া যাক।’
রমিতের কানের সামনে ‘আর তো ঘন্টাখানেকের ব্যাপার’ কথাটা ভনভন করছে। ছাপ্পান্ন বছরের জীবনটা মাত্র ঘণ্টাখানেকের ব্যাপার!
অয়ন বলল, ‘তোরা যা, আমি রমিতের কাছে থাকছি।’
রমিত বলল, ‘যা না, কিছু হবে না, আমি ঠিক আছি।’
‘বেশি দূরে যাস না কিন্তু কোথাও এখন’ বলে জামাইবাবু ওদের চা খাওয়াতে নিয়ে গেলেন। অদূরে কাকু-কাকিমা, মাসি বসে মা-র জীবনের সব খুচরো ঘটনা নিয়ে গল্প করছেন। সবক’টা গল্পেই মা-র মাহাত্ম্য মেশানো। বেশ হালকা মেজাজ এখন ওদের। গঙ্গাতেও সেই ন্যাতানো ঝিমোনো ভাবটা কেটে গিয়ে ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ আগে ঘাটে বসে থাকা সেই বয়স্ক দুজনকে দেখতে পেল না রমিত। ওই দার্শনিক কথার ভদ্রলোক এখন থাকলে কি বন্ধুকে বলতেন, ‘বুঝলে হে, মানুষের মৃত্যু শোক তৈরি করে না। পরিবেশ শোক তৈরি করে।’ আসলে মৃত্যুতে শোক পাওয়া একটা ভদ্রতা, একটা সামাজিকতা। যার দায় শেষ হলে মানুষ…শুধু মানুষ কেন সবাই স্বস্তি পায়।…কিন্তু মেয়েটা? তাই তো, মা চুল্লিতে চলে চলে যাওয়ার পর আর দেখা যাচ্ছে না কেন মেয়েটাকে? এতক্ষণে মনে পড়ল রমিতের। কোথায় গেল? আশ্চর্য! তবে কি…নাহ ওই তো, ঘাটের সিঁড়ির একেবার ওপ্রান্তে দাঁড়িয়ে রমিতকে দেখছে। গঙ্গার হাওয়ায় হলুদ সালোয়ারটা ওর শরীরটাকে আরও জড়িয়ে ধরেছে। চোখ সরিয়ে নিল রমিত। এখন এসব ভালো লাগছে না। তবু একবার যদি মেয়েটা ওর কাছে আসত। যদি দুটো-একটা অতি সাধারণ সান্ত্বনার কথা…দুর! ভাববে না মেয়েটাকে। বরং বিচ্ছিরি হয়ে থাকা মনটাকে অন্য কিছু ভাবানো যেতে পারে।…উঁহু কোনও ভাবনাই জমাট বাঁধছে না। বাধ্য হয়ে আবার ঘাড় ফেরাল রমিত। যাহ, আবার নেই।
জামাইবাবু, বন্ধুরা চা খেয়ে চলে এসেছে। কাকুদের জন্যও এনেছে। বুবাই একটা ভাঁড় নিয়ে রমিতের কাছে এসে ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘খেয়ে নে চা-টা। ভালো লাগবে। বিস্কুট খাবি?’ রমিত মাথা নাড়িয়ে না বলে ভাঁড়টা নিল। ঠান্ডা হয়ে এসেছে।
দু-চুমুকে শেষ ভাঁড়টা গঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলতে গিয়েও ফেলল না। পাশের বটগাছটার নীচে তাকাল ও। সেখানেও চুল ওঠা রং ধোওয়া শনিঠাকুর দাঁড়িয়ে আছে। ভাঁড়টাকে নিজের পাশে রেখে দিল। বুবাই ঘড়ি দেখে বলল, ‘আর বেশিক্ষণ নেই। সময় হয়ে এসেছে। তুই বোস আমি একটু খবরটা নিয়ে আসছি।’ বুবাই উঠে গেল।
আরও বেশ কিছুক্ষণ সময়। তারপর জামাইবাবু ডাকলেন, ‘রমিত চলে আয়। হয়ে গেছে।’
রমিত উঠে এল। গরম চুল্লির গা ঘেঁষে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে মাটির কলসিতে করে লাল টকটকে নাভিকুণ্ডর ওপর জল ঢালার সময় বুকের ভেতরটা ভসস করে উঠল রমিতের। সবাই একে একে জল দিল। তারপর পিছনে না তাকিয়ে কলসি ভেঙে দিয়ে গঙ্গামাটি চাপানো মালসার ওপর মা-র ‘অস্থি’ নিয়ে উঠে এল রমিত। এই সেই ‘অস্থি’ অর্থাৎ নাভিকুণ্ড। জীবনের যোগসূত্রটা কি এতই শক্ত যে ছ-হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসও তাকে পোড়াতে পারে না? তাহলে গোটা মানুষটা কেন থেকে যেতে পারে না আজীবন?
গঙ্গায় মালসাটা ভাসিয়ে দেওয়ার সময় রমিতের মনে হল আরও কত অযুত-নিযুত ‘অস্তি’ রাখা আছে এই গঙ্গার নীচে। মা-র সঙ্গে তাদের পরিচয় হবে। হয়তো ওদের সঙ্গে শুরু হবে মা-র নতুন জলজীবন। সেখানে সম্পর্কের কোনও নাম নেই। শুধু পরিচিতি।
‘আর নামিস না। তিনটে ডুব দিয়ে উঠে আয়’, কাকিমা বললেন। রমিতের ডুব দেওয়ার অভ্যাস নেই। ডুব দিতে গিয়ে বারে বারে জল ওকে ঠেলে ওপরে তুলে দিচ্ছিল। নাক আঙুল দিয়ে চেপে কোনওমতে তিনটে ডুব দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে এল ও। ভিজে সাদা ধুতির ভেতরে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আড়চোখে দেখে নিয়ে কোমরে বাঁধা গামছাটা ভালো করে জড়িয়ে নিলে রমিত। জামাইবাবু প্যাকেট থেকে থান বার করতে করতে বললেন, ‘গামছাটা দিয়ে মাথাটা ভালো করে মুছে নে। নইলে অবেলায় চান করেছিস, ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।’
রমিত বলল, ‘কাপড়টা পরে নিয়ে মুছছি।’
কাছা দিয়ে কাপড় পরার কায়দাটা খুব কঠিন। শেষে কাকুই পরিয়ে দিলেন। রমিত এই ফাঁকে চারদিক দেখে নিল। সবাই আছে মেয়েটা নেই। ভালো হয়েছে এখন নেই। না হলে অস্বস্তিতে পড়তে হত। ওদের সামনে দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রমিত ভিজে ধুতিটা ছাড়তেই ‘কাকু কাপড়টা নেব?’ বলে বাচ্চা দুটো হাত বাড়াল। জামাইবাবু ধমক লাগালেন। কাকু বললেন, ‘যাক গে নিক, ফেলেই তো দিতে হবে।’
ওরা দুজনে কাপড় নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে করতে ছুট। ধড়া নেওয়া হয়ে যাওয়ার পর জামাইবাবু ঘড়ি দেখে বললেন, ‘এবারে সব যাওয়া যাক তাহলে।’
রমিতের এই গ্রীষ্মের বিকেলেও বেশ শীত শীত করছে। মাথাটা ভালো করে মোছা হয়নি। কপালে সামনের চুল থেকে টুপটুপ করে জল ঝরছে। ম্যাটাডোরে ওঠার সময় গাড়িটা কেমন খালি খালি লাগল। সবাই আছে শুধু মাঝখানে রাখা সেই খাটটা নেই। রমিত কাকুদের মারুতির দিকে তাকাল। মেয়েটা উঠেছে নিশ্চয়ই। হাওয়া লেগে মাথাটা টিপটিপ করে ব্যথা করছে।
জামাইবাবু বললেন, ‘বাড়ি গিয়ে রাত্তিরে মা-র একটা ভালো দেখে সিঙ্গল ফাটো বার করে রাখবি। কালকেই বাঁধাতে দিয়ে দেব।’
ফ্ল্যাটে ফেরার পর কাটারি ছুঁয়ে নিমপাতা দাঁতে কেটে আর একটা করে রসগোল্লা খেয়ে বন্ধুরা বাড়ি চলে গেল। ঘর ভরতি ফ্ল্যাটের লোকজন। রমিত প্রথমেই বাবার ঘরে ঢুকল। বাবা একইভাবে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। বাবার মুখের কাছে ঝুঁকে তাকাল রমিত। ভাবলেশহীন চোখ দুটোর কোণে কোনও জল জমে রয়েছে কি না দেখল ও। তারপর নিজের ঘরে গেল।
দুই
রাত্তির প্রায় সাড়ে এগারোটা। সারা দিনের ধকলের পর সবাই শুয়ে পড়েছে। আজকে কোনও ঘরে টিউব নেভেনি। আলো জ্বালিয়েই শুয়েছে সবাই। কেন! ভয়েতে? শ্মশানের পুরোহিত মন্ত্রোচ্চারণের সময় ‘প্রেত’ শব্দটা বার কয়েক উচ্চারণ করেছিলেন। কানে হুল ফোটাচ্ছিল শব্দটা। ছোট থাকলে রমিত ঠিক বলে দিত—’আমার মা প্রেত নয়।’… কিন্তু বাড়ি ফিরে মেয়েটাকে আর একবারও দেখা গেল না কেন? কাকিমা বা মাসিকেও জিগ্যেস করার উপায় নেই। জিগ্যেস করলেই হয়তো বলবে ‘সত্যিই তোর এই সময়ও মেয়ের খোঁজ!’ অথচ ওরা নিজেরাও একবার মেয়েটার কথা বলল না। কেন?—ধ্যাত্তেরি, হাবিজাবি চিন্তায় ঘুম আসছে না। ওহ হো, মা-র ছবিটাই তো বার করা হয়নি। কাল সকালে বাঁধাতে দেওয়া হবে। অ্যালবাম বাবার ঘরের আলমারিতে। রমিত বাবার ঘরে গেল। শিশুর মতো ঘুমোচ্ছে মানুষটা। রমিত আলমারি খুলে অ্যালবামটা বার করে মেঝের ওপর বসল। বেশিরভাগই দিদির বিয়ের ছবি। মা-র কোনও সিঙ্গল ছবি নেই। সবই গ্রুপের মধ্যে। আর কয়েকটা নৈনিতাল বেড়াতে যাওয়া হয়েছিল যেবার, তখন তোলা। সেখান থেকে একটা মাত্র মা-র একার ফটো পাওয়া গেল। কিন্তু সস্তার ক্যামেরায় তোলা ছবিতে মা-র মুখটা খুব ছোট। মৃত মানুষের শুধু মুখটুকু প্রয়োজন। যেটা মনে আসে। মনে থাকে। শরীরের আর দরকার নেই।
আচ্ছা আর একটা অনেক পুরোনো অ্যালবাম ছিল না? কোথায় সেটা? আলমারির ভেতর মা-র শাড়ি, বাবার ধুতি-পাঞ্জাবি ঘেঁটেঘুঁটেও পেল না রমিত। শেষে কী মনে করে লকার খুলে দেখতে পাওয়া গেল ওটাকে, লকারে অ্যালবাম, কত দামি!
অ্যালবামটা মোটকা, কালো রঙের। কেমন একটা পুরোনো পুরোনো গন্ধ মেশানো। শেষ এটাকে কবে দেখেছে মনে পড়ল না রমিতের। অনেক ছোটবেলায় দেখে থাকবে হয়তো। পাতা ওলটাতে শুরু করলও। সবই ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট। ঠিক হোয়াইট আর নেই। ফিকে হলুদ হয়ে গেছে। পাতায় পাতায় বাবা-মা-র বিয়ের ছবি। অনেক অচেনা মুখও দেখতে পেল ও। হনিমুনে পুরী যাওয়ার ছবিগুলো পাতা উলটে দেখতে দেখতে একটা পাতার বাঁ-দিকের পৃষ্ঠায় একটা ফটো দেখে যেন মগজে হঠাৎ চাবুক খেয়ে ভীষণভাবে চমকে উঠল ও। এ কে! এ যে…এ যে সেই মেয়ে যাকে আজ সারাদিন ধরে রমিত দেখে এসেছে। সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে তোলা। হয়তো বাবাই তুলেছিল। সমুদ্রের হাওয়ায় সালোয়ারটা শরীরটাকে আরও জাপটে ধরে বুক আর…। ঠিক সেই মেয়েটা যখন গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে রমিতকে দেখছিল তেমনিভাবে। হাত-পা কাঁপছে রমিতের। ও আস্তে আস্তে কালো পাতা থেকে ফটোটাকে খুলে আনল। ছবিটার গা ছোঁওয়া মাত্র হাতটা কেমন শিরশির করে উঠল রমিতের। ফটোর পিছনে কী যেন লেখা। পড়ল রমিত। ‘আমার মিষ্টি সোনা তপু’। বাবার হাতে লেখা। নীচে লেখা ‘ইস, মিষ্টি সোনা, না ছাই’। মা-র হাতের লেখাটা কোনওদিনই ভালো ছিল না। মিষ্টি বানানটাও ভুল লিখেছে। বাবার দিকে তাকাল রমিত। এই সেই লোক। ফ্যানের হাওয়ায় সাদা চুলগুলো উড়ছে। চোখের পাশে চামড়ার ভাঁজ। ঠোঁটের কোণে লালা জমে উঠেছে ঘুমের মধ্যে। এই সেই বিছানা, হয়তো এমনই কোনও রাত্রে মা আর বাবা বিছানায় শুয়ে এই ছবি নিয়ে খেলতে খেলতে লিখেছিল। ফটোটাকে অ্যালবামে আটকাতে গিয়ে পরের পাতার প্রথম পৃষ্ঠায় তাকাল রমিত। ওর নিজের খুব ছোটবেলার ছবি। চোখে মোটা কাজল, মাথায় ঝুঁটি বাঁধা, হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে হেঁটে এগিয়ে আসছে। মা-র আর ওর ছবি দুটো মুখোমুখি। অ্যালবামটা বন্ধ করতে করতে রমিত দেখতে পেল মা নয় সেই মেয়েটা রমিতের বাড়ানো হাত দুটোর মাঝখানে চলে আসছে।
দেশ
জুন-২০০৩