লাল ক্ষত

লাল ক্ষত

সেন্ট যোসেফ, মিসৌরি, আমেরিকা। তরুণ সেলসম্যান তার হোটেল কামরায় বসে বসে কোম্পানির অর্ডার ফর্মগুলো পূরণ করছে। জানালা গলে সকালের উজ্জ্বল সূর্যালোক ভিতরে ঢুকছে। মনটা খুব ফুরফুরে তার আজ। তার জন্য সব দিক থেকেই চমৎকার এক দিন এটা। নতুন গ্রাহকদের তালিকা অফিসে পৌছার পর বস কতটা খুশি হয়ে উঠবে এটা ভেবে এখনই হাসি একান-ওকান হচ্ছে। একটা নতুন সিগার ধরিয়ে দোয়াত থেকে কলমটায় আবার কালি ভরে নিল। এসময়ই হঠাৎ আবিষ্কার করল কামরাটাতে এখন আর একা নেই সে।

ডান পাশের টেবিলটায় কেউ একজন বসে আছে। বিস্মিত হয়ে ঘুরে তাকাতেই বোন অ্যানির সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। তার দিকে উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে আছে।

খুশির চোটে ভয়ানক সেই স্মৃতিটাও বেমালুম ভুলে গেল। পুরো বিষয়টা এতটাই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে তার কাছে যে, লাফিয়ে উঠে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওহ, অ্যানি, বোন আমার।’ কিন্তু যখনই নাম ধরে ডাকল, সুবেশী, অপরূপা তরুণীটি অদৃশ্য হলো।

তখনই যেন বাস্তবে ফিরে এল তরুণ। অ্যানিকে তো দেখার কোন সুযোগই নেই তার। বোনকে যেখানটায় দেখেছিল সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কিন্তু তাকে পরিষ্কারভাবে দেখেছে সে। সে যেরকম সুন্দরী ছিল ঠিক তেমনটাই আছে। কিন্তু এখন ১৮৭৬, নয় বছর আগে ১৮৬৭ সালেই কলেরায় মারা গেছে অ্যানি। হোটেলের কামরাটায় একাকী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোটা বিষয়টা আরেকবার ভাবল। হঠাৎ মনে হলো বোনের মধ্যে একটা অস্বাভাবিকতা চোখে পড়েছে তার। পোশাক, চুলের কাট এমনকী চেহারার অভিব্যক্তি শেষবার যেমন দেখেছে ঠিক তেমনটিই। তবে চমৎকার গড়নের মুখে একটা অস্বাভাবিকতা চোখে পড়েছে, জীবত থাকা অবস্থায় যা দেখেনি। ডান চোখের ওপরে কপালে একটা গাঢ় লাল ক্ষতচিহ্ন।

‘বাবা, এটা পাগলের প্রলাপ মনে হতে পারে। কিন্তু সত্যি বোনকে দেখেছি। তুমি এখন যতটা দূরে আমার ঠিক ততটা দূরে বসে ছিল ও আমার থেকে। আমি নিশ্চিত চিলেকোঠায় ওর ট্রাঙ্ক খুঁজলে যে পোশাকটা আজ পরা ছিল সেটা খুঁজে বের করতে পারব। যতই অবিশ্বাস্য শোনাক সে এসেছিল।’

সেন্ট লুইসে বাবার বাড়ির পার্লারে বসে আছে তরুণ বিক্রয় প্রতিনিধি। সে এতটাই হতবাক হয়ে পড়েছে যে কাজ শেষ না করেই পরের ট্রেনে সেন্ট লুইসে চলে এসেছে বাবা মা এবং ভাইকে ঘটনাটা খুলে বলার জন্য। স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনা বিশ্বাস করার কোন কারণ খুঁজে পায়নি বাড়ির বাকি লোকজন।

‘শোনো, আমার মনে হয় তোমার মন তোমাকে ধোঁকা দিয়েছে,’ বললেন বাবা, ‘হয়তো কামরার কোন একটা কিছু, বাইরের পরিবেশ কিংবা মানসিক কোন একটা পরিবর্তন তোমাকে বোনের কথা মনে করিয়ে দেয়। এতেই তোমার মনে হয়েছে সত্যি সত্যি হাজির হয়েছে সে। মানুষের জীবনে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই পারে।’

‘বাবা, এটা মোটেই আমার স্মৃতি কিংবা কল্পনা নয়। অ্যানি আমার সঙ্গে ওই কামরাতেই ছিল।’ জোর গলায় বলার চেষ্টা করল তরুণ।

বাবা কেবল হেসে মাথা ঝাঁকালেন। তরুণ নিশ্চিত বাবা তার কথা বিশ্বাস করেননি মোটেই। সম্ভবত ঘটনাটা নিজের মনের মধ্যে চেপে রাখলেই ভাল হত। আসলে প্রিয় বোনকে এত বছর পর দেখে পরিবারের সবার সঙ্গে দেখা করে জানানোর লোভ সামলাতে পারেনি। সবাই-ই যে তাকে ব ভালবাসত। তাহলে সে কী দেখল? অন্যদের বিশ্বাসই বা করাবে কীভাবে?

‘আমি জানি তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করোনি, কিন্তু সে এসেছিল,’ আবারও জোর দিয়ে বলল সে, ‘শেষবার .যেমন সুন্দর ছিল এখনও ঠিক তা-ই আছে। শুধু কপালের ওই দাগটা ছাড়া।’

তরুণের মা সেলাই থামিয়ে মুখ তুলে বললেন, ‘মানে?’

‘হ্যাঁ, তোমাদের বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। ওর কপালে একটা দাগ ছিল। আসলে একটা ক্ষত বা আঁচড়ের মতই মনে হচ্ছিল, ওটার রং ছিল লাল। সুঁই বা কোন পিনের গুঁতো খেয়েছে যেন কেবলই।’

হঠাৎ ভদ্রমহিলা জোরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। তাঁর চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়াচ্ছে। ‘ওহ্, অ্যানি,’ বলে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। তারপর স্বামী ও ছেলেদের একটা গল্প বললেন, যা নয় বছর তাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন।

‘তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন সকালে এটা হয়,’ চোখের জল ফেলতে ফেলতে বললেন বুড়ো মহিলাটি, ‘বাক্সের মধ্যে শুইয়ে রাখা হয়েছে অ্যানিকে। কামরায় আমি একাই আছি। এতটাই সুন্দর লাগছিল, মনে হচ্ছিল এখনই মা বলে ডেকে উঠবে।’

এক মুহূর্ত কান্না বন্ধ করার জন্য অপেক্ষা করলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, ‘কিন্তু ওর চুল…সবসময় যখন চুল চূড়া করে বেঁধে রাখত দারুণ লাগত ওকে। আর এটাই ছিল আমার পছন্দ। চাচ্ছিলাম ওভাবেই সুন্দরভাবে কবরে যাক। অ্যানির চুলগুলো পিন দিয়ে সেভাবে আটকে দিতে চাইলাম। কিন্তু…হাতটা প্ৰচণ্ড কাঁপছিল। এসময় ওর কপালে ওটা দিয়ে খোঁচা দিয়ে ফেলি।’ চোখদুটো হাত দিয়ে ঢেকে ফেললেন ভদ্রমহিলা কাঁদতে কাঁদতে। ‘ওর সুন্দর মুখটাতে খুঁত তৈরি করে দিলাম আমি। তবে কেউ দেখতে পায়নি। পাউডার আর মেকআপ দিয়ে ওটা তাড়াতাড়ি ঢেকে দিই,’ বললেন তিনি। ‘কিন্তু অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পুরো সময়টা ঘটনাটা আমাকে যন্ত্রণা দিয়েছে। গত নয় বছরে বারবারই কথাটা মনে হয়েছে আমার। না দেখলে কোনভাবেই এই দাগের কথা বলতে পারতে না তুমি। সত্যি ভাইয়ের কাছে এসেছিল সে। ওহ্, আমার অ্যানি!’

তরুণ হাত দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল। তাঁর পাকা চুলে হাত বুলিয়ে দিল। তার জ্যাকেটের কলারে চোখ মুছলেন মহিলা। ‘ঠিক আছে,’ মার কাঁধের ওপর দিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল সে, ‘সব ঠিক আছে, মা। সে সুখে আছে। তার চোখ খুশিতে ঝিকমিক করতে দেখেছি। ওপারে ও সত্যি ভাল আছে।’

কয়েক হপ্তা পর তরুণের মা মারা গেলেন। শেষ কয়েকটা দিন ভাল ছিলেন না মোটেই। মেয়ের কথাই বলতেন শুধু। আর চোখের জল ফেলতেন। বোনকে দেখার অভিজ্ঞতাটা বর্ণনা করার আগে যদি মারা যেতেন তবে মেয়ের কপালে আঁচড়ের ঘটনাটা নিজের সঙ্গে কবরে নিয়ে যেতেন তিনি। পৃথিবীর কেউই বলতে পারত না কেন তরুণ ওই দাগটা দেখেছিল।

কিন্তু যখন ভদ্রমহিলা গোপন তথ্যটা ফাঁস করেন তখন এমনকী তাঁর অবিশ্বাসী স্বামীও মেনে নেন মেয়ের ভূত হাজির হয়েছিল ভাইয়ের সামনে। সেন্ট যোসেফের ওই হোটেল রুমে তরুণ কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও বোনের আত্মার মুখোমুখি হয় সেদিন।

আমেরিকান রিসার্চ ফর সাইকিক রিসার্চের ১৮৮৭ সালের সংখ্যায় এ ঘটনাটির বর্ণনা আছে। তাদের ফাইলে আত্মীয়ের প্রেতাত্মার দেখা পাওয়ার অনেক অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘটনাটাকে স্বপ্ন কিংবা হ্যালুসিনেশন হিসাবে ধরে নেয়া হয়। কিন্তু যখন বোনকে দেখে তখন ওই লাল ক্ষতের বিষয়টা তরুণের জানা না থাকায়, এই ঘটনাটা অন্যগুলোর থেকে অতিপ্রাকৃত-বিশেষজ্ঞদের কাছে আলাদা হয়ে রয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *