মায়া হায়েনা

মায়া হায়েনা

মায়ানেকড়ের সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় আছে। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন বাস্তবেও এদের অস্তিত্ব আছে। নাইজেরিয়ায় নেকড়ে নেই। তাই সেখানে মায়ানেকড়ে বা ওয়্যারউলফের কাহিনীও ডালপালা মেলতে পারেনি। তবে হায়েনা আছে বিস্তর। তেমনি আছে মায়া হায়েনা নিয়ে নানা কাহিনী। নাইজেরিয়ার উত্তর অংশ জুড়ে পর্বতের সারি। এ এলাকায় নানান গোত্রের লোকের বাস। এখানকার অধিবাসীরা বিশ্বাস করে, কিছু লোক জাদুমন্ত্রবলে রাত হলেই হায়েনার রূপ ধারণ করে। আর ঘটায় নানান অনিষ্ট। আজ থেকে শ’খানেক বছর আগে সেখানে অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা হয় এক ইংরেজ সরকারি কর্মকর্তার। স্টুয়ার্ট স্মিথ নামের ওই ভদ্রলোক সেখানে চাকরিসূত্রে নিয়োগ পান। ছোট্ট একটা পুলিস বাহিনীর সহায়তায় জায়গাটিতে শান্তি বজায় রাখা ছিল তাঁর দায়িত্ব। আসলে নাইজেরিয়ায় তখন একের পর এক টিনের খনির খোঁজ মিলছে। নানান জায়গা থেকে ভিড় জমাচ্ছে ইঞ্জিনিয়ার, কুলি ও শ্রমিকরা। বানানো হচ্ছে রাস্তাঘাট। কুলি- মজুরদের জন্য গড়ে উঠছে একটার পর একটা বস্তি, ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য কোয়ার্টার।

এই এলাকাটির অবস্থান বাউচি মালভূমিতে। নিচ থেকে হঠাৎ তাকালে মনে হবে এটা বুঝি বা গ্রানেট পাথরের পাহাড়। কোন লোকবসতি নেই। তবে ওপরে উঠলেই বুঝবেন কতটা ভুল করেছিলেন। সবুজ ঘাসে ছাওয়া মাঠ, মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রাম। দিনে প্রচণ্ড গরম, রাতে আবার কনকনে ঠাণ্ডা। বাউচি মালভূমি এলাকায় চিল, বাজ, শকুনসহ ছোট-বড় নানা ধরনের পাখির কোন লেখাজোখা নেই। সে তুলনায় বন্য জানোয়ারের সংখ্যা বেশ কম। খরগোশ, বিশাল সব ধাড়ি ইঁদুর আছে বেশ। বড় প্রাণীর মধ্যে পাহাড় ও পাহাড় পাদদেশের এলাকাগুলোয় চিতা বাঘ। তবে হায়েনা আছে অনেক। সন্ধ্যা হলেই বেরিয়ে পড়ে শিকারে। বাগে পেলে নিঃসঙ্গ পথচারীদেরও ছাড়ে না। এদের রক্ত জল করা চিৎকার অতি দুঃসাহসীদেরও বুক কাঁপিয়ে দেয়। এখানে প্রসঙ্গক্রমে এই এলাকার আদিবাসীদের একটু বর্ণনা দেয়া উপযুক্ত মনে করছি। এদের শরীরে পোশাকের খুব একটা বালাই নেই। একটা সময় শ্বেতাঙ্গদের এই এলাকায় প্রবেশ ছিল নিষেধ। বিষাক্ত তীর-ধনুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত অনুপ্রবেশকারীদের উপর। তবে শ্বেতাঙ্গদের আগ্নেয়াস্ত্রের কাছে বশ মেনেছে ইদানীং।

যা হোক, স্টুয়ার্ট স্মিথের অধীনে আছে বারোজন কনস্টেবল এবং একজন কর্পোরাল। স্টুয়ার্টের সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছে এখানে কাজ করতে আসা মাইনিং কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার অস্টারস্টকের। এক নদীর তীরে টিনের সন্ধানে খনন কাজ চালাচ্ছেন অস্টারস্টক। বিকাল হলেই দেখা যায় অস্টারস্টক হাজির হয়েছেন স্মিথের বাংলোয়। তারপর দু’জনে মেতে উঠতেন গল্প-গুজবে। এরকমই একদিন আলাপের সময় স্মিথ বললেন, ‘এখানে আসার পর একটা অদ্ভুত গুজব শুনলাম স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে। সন্ধ্যা নামলে অন্ধকারে বেরোতে সতর্ক করে দিল তারা। বলল বেরোলেই সমূহ বিপদ। সাধারণ হায়েনার পাশাপাশি শিকারে বের হয় হায়েনা-মানবেরা। গ্রামেরই কয়েকজন লোক জাদুমন্ত্রবলে হায়েনায় রূপান্তরিত হয়। তারপরই একটা ঘটনা ঘটল। একটা কাজে বের হয়েছি। বেলা শেষ হয়ে আসায় গাঁয়ের কাছেই তাঁবু ফেলার নির্দেশ দিলাম ভৃত্যদের। রাত্রে খাওয়া শেষে শুতে যাওয়ার পরেই দুটো হায়েনা হাজির হলো তাঁবুর কাছে। ওদের চিৎকারে কান ঝালাপালা হবার জোগাড়। আমরা ঘুমালেই হামলা করার ফন্দি-ফিকির করছে মনে হয়। তাই বের হয়ে এসে দুই গুলিতে দুটোকেই মেরে ফেললাম।

‘ভোরে ঘুম ভাঙল এলাকাবাসীর চেঁচামেচিতে। রাতের ঘটনা তারা জানতে পেরেছে। লোকগুলোর ধারণা এই হায়েনাদুটো আসলে হায়েনা-মানব। তারা তাদের গাঁয়েরই লোক। আমি হেসে উড়িয়ে দিলাম লোকগুলোর কথা। কিন্তু

মানল না। এবার বোঝানোর চেষ্টা করলাম। তাতেও কাজা হলো না। সকালবেলা যখন সবার ঘুম ভাঙল গাঁয়ের লোকেরা মাথা গুনে আবিষ্কার করল সবাই আছে। এবার কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো। তবে গোঁ ধরল হায়েনাদুটো কাছের অপর কোন গ্রামের লোক।’

স্মিথ ভেবেছিলেন তাঁর কথা শুনে অস্টারস্টকের পিলে চমকে উঠবে। তাঁকে অবাক করে দিয়ে ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু বিষয়টা খুব স্বাভাবিকভাবে নিলেন। ‘আরে, এতে আশ্চর্য হবার কী আছে? এসব এলাকায় এমন অনেক ঘটনা ঘটে যার কোন ব্যাখ্যা নেই। তুমি কি নেকড়েমানবের কথা শোনোনি? চোখ-কান খোলা রাখো, আরও অনেক কিছুই জানতে পারবে।’ এই বলে বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিলেন অস্টারস্টক। তিনি এই এলাকায় আছেন বেশ ক’বছর ধরে। অনেক কিছুই তাঁর নজরে পড়েছে। স্থানীয় আদিবাসীদের কথাও তাই হেসে উড়িয়ে দিতে পারেননি।

এরপর মাস দুয়েক তেমন কোন ঘটনা ঘটল না। তারপরই একদিন স্মিথ তাঁবু ফেললেন কুরগ্রাম নামের একটি গাঁয়ের ধারে। স্মিথের বাংলো থেকে চার মাইলটাক দূরের এই গ্রামটি পাহাড়ের লাগোয়া। আকারেও বেশ বড়। গ্রামের চারধারে ক্যাকটাসসহ নানা জাতের কাঁটাঝোপের বেড়া। এখানকার অনেক গ্রামেই এটা চোখে পড়ে। বাইরের লোককে দূরে সরিয়ে রাখাই লক্ষ্য। মোটামুটি হাজারখানেক লোক বাস করে গ্রামটিতে। অসভ্য অধিবাসীদের শরীরে কাপড়-চোপড়ের বড্ড অভাব।

স্মিথ এখানে এসেছেন ট্যাক্স আদায়ের জন্য। ট্যাক্স ধার্য করা হয়েছে মাথা প্রতি এক শিলিং। এই টাকাটা ব্যয় করা হবে রাস্তা তৈরিতে। শুরুতে চলল লোক গোনার কাজ। এর মধ্যেই একদিন একদল ফুলানি হাজির হলো। এই জাতের লোকেরা শ্বেতাঙ্গদের রীতিমত দেবতাজ্ঞান করে। শ্বেতাঙ্গদের প্রভাব বেশি যেসব এলাকায় সেসব এলাকায় থাকা তাদের পছন্দ। কাঁদতে কাঁদতে স্মিথের পায়ের কাছে ময়লা কম্বলের একটা পুঁটলি রেখে বলল, ‘হুজুর, আমাদের বড় বিপদ। রক্ষা করেন।’

এদিকটায় গরু চুরির ঘটনা ঘটে হরহামেশাই। আর ফুলানিরা দক্ষ পশু-পালক। বলা চলে গরু-মোষ পেলেই এরা জীবনধারণ করে। শুরুতে স্মিথের তাই মনে হলো গরু চুরির বিচার চাইতে এসেছে এরা। কিন্তু একটু পরেই পরিষ্কার হলো ব্যাপারটা আরও অনেক ভয়ানক। পুঁটলিটা খুলতেই চোখ আটকে গেল স্মিথের। আরে, এখানে তো পনেরো-ষোলো বছরের এক কিশোরের মৃতদেহ। গলায় গভীর একটা ক্ষত। দেখে মনে হয় কিছু একটা কামড়ে নিয়ে গেছে খানিকটা মাংস। এটা আর যা-ই হোক বর্শা বা অন্য কোন অস্ত্রের আঘাতে হয়নি। স্মিথের মনে হচ্ছে কোন বন্যপ্রাণীর আক্রমণে এই হাল হয়েছে হতভাগ্য ছেলেটার। তাঁর কাছে কাঁদতে কাঁদতে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইল সবাই। গোটা ঘটনাটা খুলে বলতে বললেন তাদের।

তারা যে কাহিনী বলল তা বেশ অদ্ভুত। দুই দিন আগের এক সন্ধ্যা। অন্য গরুগুলো ফিরে এলেও দুটি গরুর কোন হদিস নেই দেখে ওই ছেলেটাকে পাঠানো হলো ওগুলোর খোঁজে। এমনিতে সে বেশ সাহসী। কিন্তু একটু পরই ফিরে এল ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে। বলল একটা হায়েনা তাকে অনুসরণ করেছিল। শুধু তাই না কোনভাবেই তাড়াতে পারছিল না। ওটার মধ্যে অশুভ একটা কিছু আছে। গ্রামের লোকেরা ছেলেটার কথায় কান না দিয়ে ইচ্ছামত গালমন্দ করল তাকে। বলল, হায়েনা একা একা মানুষের ধারে-কাছে ভিড়তে ভয় পায়। এই ভীতু প্রাণীটার ভয়ে তার মত এক যুবক কিনা পালিয়ে এসেছে। অতএব ছেলেটা কী আর করবে, আবার গেল ওই গরুদুটির সন্ধানে। তবে চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ভয়ে কাঠ হয়ে আছে।

ওই দিন ছিল অমাবস্যা। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এর মধ্যে একটু পর পর হায়েনার ডাক শুনতে পেল ফুলানিরা। এদিকে ছেলেটার কোন খবর নেই। রাতে আর ফিরলই না সে। যেমন খোঁয়াড়ে এল না গরুগুলো।

ভোর হতেই কয়েকজন বেরিয়ে পড়ল ছেলেটা এবং গরুদুটির খোঁজে। একটু পরই ছেলেটার পায়ের ছাপ চোখে পড়ল দলটির। একপর্যায়ে পেল গরুর ছাপও। এখান থেকে জন্তুগুলোকে পেয়ে তাঁবুর দিকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে তরুণ। একটা জায়গায় বেশ বিশৃঙ্খলা হয়েছে মাটির চিহ্ন দেখে তা বোঝা গেল। এর একটু দূরে ঝোপের মধ্যে পাওয়া গেল ছেলেটার মৃতদেহ। গলার একটু মাংস খেয়ে নিয়েছে কিছু একটা। আশ্চর্য ঘটনা, সেখানে গরু বাদে আর কোন জন্তু- জানোয়ারের পদচিহ্ন নেই। তবে কয়েকটা জায়গায় গরুর পেছনে হায়েনার ছাপ দেখে বোঝা গেল গরুগুলোকে সে অনুসরণ করেছিল। স্মিথ বেশ চমকে উঠলেন। একাকী কোন হায়েনা একজন মানুষকে আক্রমণ করার কথা নয়। এদিকে গরুগুলোর পায়ের ছাপ দেখেও এমনটা মনে হচ্ছে না এরা ভয় পেয়ে দৌড়াদৌড়ি করেছে। ফুলানিরা তার কাছে কী চায় বুঝতে পারলেন না। কী কারণে এসেছে জানতে চাইলেন।.

ফুলানিদের দেখে মনে হলো সাদা মানুষের এই আচরণে খুব মর্মাহত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এক বুড়ো বলল, ‘হুজুর, তুমি যা ভাবছ তা নয়। ওটা মোটেই হায়েনা নয়। তাহলে গরুদুটোকে তাড়িয়ে বেড়ার ওপাশে রেখে আসত না। কুরগ্রামের ক্যাকটাসের বেড়া ঘেরা খোঁয়াড়টায় সেখানে এখন ঘাস খাচ্ছে আমাদের গরুদুটো। ওটা মোটেই হায়েনা ছিল না, ছিল মায়াবী এক মানুষ।

‘যদি কুরগ্রামের লোকেরা গরুদুটি চুরি করে থাকে তবে অবশ্যই ওদের শাস্তি হবে। কিন্তু ছেলেটার মৃত্যুর সঙ্গে ওদের কোন সম্পর্ক নেই। এটা হায়েনার কাজ। আমি গ্রামে পুলিস পাঠাব গরুর খোঁজে।’

ফুলানিদের মোটেই খুশি মনে হলো না স্মিথের বিচারে। তবে মুখে বেশি একটা প্রতিবাদ করল না। একজন বলে ফেলল, ‘হুজুর, তুমি কি আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে? হায়েনাই যদি নাটের গুরু হবে তবে গরু ফেলে মানুষ শিকারে নামল কেন?’

স্মিথ কোন জবাব দিলেন না। সত্যি বলতে বিষয়টা তাঁর মনেও খচখচ করছিল। একসময় হতাশ ফুলানিরা চলে গেল।

তবে কথামত পরদিন কুরগ্রামে একজন কর্পোরালের নেতৃত্বে চার পুলিস পাঠালেন। হঠাৎ তাদের আগমনে হকচকিয়ে গেল কুরগ্রামের বাসিন্দারা। তারা গরুগুলো সরানোরও সময় পেল না। ধরা পড়ার পর বলল ওগুলো এমনি এমনি ক্যাকটাসের বেড়া ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছে রাতের অন্ধকারে। কিন্তু গরুদুটোকে ওই বেড়া থেকে বের করে আনতে লাগল পাক্কা আধ ঘণ্টা। এতেই পরিষ্কার হয়ে গেল ওগুলো মোটেই একাকী ওখানে যায়নি। এদিকে স্মিথের কড়া নির্দেশ ছিল কর্পোরালের প্রতি চোরকে ধরে আনতে হবে। না পারলে হাতকড়া পড়বে গ্রামের সর্দারের হাতে। পুলিসরা গোটা গ্রাম তল্লাশি চালাল, কিন্তু কে চুরি করেছে বুঝতে পারল না। একপর্যায়ে হন্তদন্ত হয়ে সর্দার হাজির হলো। শুকনো শরীর, পাঁজরের হাড় গোনা যাবে। বয়স অন্তত তিন কুড়ি। সঙ্গে বেশ শক্তপোক্ত, কঠিন কয়েকজন যুবক। সব ঘটনা শুনে সর্দার যেন আকাশ থেকে পড়ল। বলল সে এসব বিষয়ে কিছু জানে না। কর্পোরালের মনে হলো আসলেই সে কিছু জানে না। তলে তলে কলকাঠি নাড়ছে অন্য কেউ। এই বুড়োকে শুধু শো হিসাবে সর্দার করে রাখা হয়েছে। কিন্তু কী আর করা! কর্পোরাল মুসা গোমবি সর্দারকে হাতকড়া পরিয়ে রওয়ানা হলো। যাওয়ার সময় হুমকি দিয়ে গেল চোরকে হাজির করা না হলে সর্দারকে থাকতে হবে কয়েদখানায়।

স্মিথের আস্তানায় আচ্ছাসে জেরা করা হলো সর্দারকে। একটা শব্দও বের করা গেল না তার মুখ থেকে। স্মিথের মনে হলো গোটা গ্রামে এই ঘটনা সম্পর্কে এই বুড়োই বুঝি বা সবচেয়ে কম জানে। সবচেয়ে অবাক ঘটনা, সর্দারকে ছাড়িয়ে নিতে কুরগ্রামের একজন লোকও এল না।

তবে এতেই দমে গেলেন না স্মিথ। নতুন বুদ্ধি বের করলেন। পুলিসের মারফত গ্রামবাসীদের জানালেন গরু যেহেতু তাদের গ্রামে পাওয়া গেছে তাই দণ্ড তাদের হবেই। শাস্তি হিসাবে দশটা ঘোড়া, একশো ছাগল এবং এবারের শস্যের একটা অংশ দিয়ে দিতে হবে। এবার সত্যি টনক নড়ল কুরগ্রামের লোকদের। সর্দারের জন্য তাদের মন একটুও না পুড়লেও জরিমানার কথা শুনে মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। কয়েকজনকে পাঠাল স্মিথের ক্যাম্পে। তারা এসে বেশ নরমভাবেই বলল এই চুরির পেছনে তাদের কোন ভূমিকা নেই। সাহেব কেন তাদের ওপর জুলুম করছেন! স্মিথ বললেন তাহলে তারা আসল চোরকে ধরিয়ে দিক। এবার তারা একজন আরেজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। স্মিথ বুঝলেন একটা ঘাপলা আছে। চেপে ধরলেন। এবার স্বীকার করল সব কিছুই তারা জানে। কিন্তু বলার সাহস পাচ্ছিল না এতদিন। গ্রামের এক পাশে থাকে ‘জু জু’ নামের এক লোক। তাকে সবাই ভয় পায়। সে-ই সব কিছু করছে। দিনে মানুষ থাকলেও রাতে অসম্ভব ক্ষমতাধর এক হায়েনায় নিজেকে পরিণত করতে পারে এই মায়াবী। তার বিরুদ্ধে কিছু বললেই প্রাণ যাবে তাই এতদিন সাহস করেনি তারা। স্মিথ দেখলেন কুরগ্রামের লোক এবং ফুলানিদের কথা মিলে যাচ্ছে। মায়াবীকে ধরে আনার জন্য পুলিস পাঠালেন। তিন দিনের মধ্যে ধরে স্মিথের ক্যাম্পে নিয়ে আসা হলো তাকে।

লোকটাকে দেখে রীতিমত থ হয়ে গেলেন স্মিথ। এ কাকে দেখছেন! মনে হচ্ছে প্রাচীন যুগের কোন গুহামানব বুঝি বা এ যুগে হাজির হয়েছে। গায়ের রং কালো। তবে চোখগুলো নীলাভ। দ্যুতিহীন। আলো সহ্য করতে পারছিল না, পিট পিট করছিল। পেশীবহুল শরীর। গা লোমে ভর্তি বারবার চেষ্টা করছিল ছুটে পালাতে। মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে। স্মিথের দেখেই মনে হলো এ হয়তো এসব কিছু করেনি। গ্রামের লোকেরা আধা মানুষ-আধা জন্তুটাকে বলির পাঁঠা বানাচ্ছে। তারপরও কয়েকদিন এখানে আটকে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। এসময় স্মিথের বন্ধু অস্টারস্টকও উপস্থিত ছিলেন ক্যাম্পে। তিনিও অদ্ভুতদর্শন মানব-জন্তুটাকে দেখে চমকে উঠলেন। স্মিথ নানা ধরনের প্রশ্ন করলেন। একটারও উত্তর দিল না লোকটা। মুখ দিয়ে কেবল লালা গড়াচ্ছিল তার। অতএব কিছু খাবার দিয়ে আটকে রাখা হলো তাকে গোলাকার একটা মাটির ঘরে। খড়ের ছাদ, মাঝে শক্ত তালগাছের খুঁটি। দরজাটা তালাবদ্ধ। বাইরে অস্ত্র হাতে এক প্রহরী রাখা হলো। রাতে কয়েদখানায় উঁকি মেরে স্মিথ আর অস্টারস্টক দেখেন কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমাচ্ছে মানব-জন্তুটা। পানি খেলেও খাবার ছুঁয়েও দেখেনি। তার গা থেকে বের হওয়া বিকট গন্ধে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকাও কষ্টকর হয়ে পড়ল দু’জনের পক্ষে। তাড়াতাড়ি আবার তালা আটকে বের হয়ে এলেন দুই বন্ধু।

রাত তখন দশটা। খাওয়া শেষে বাইরে বসে আছেন দুই বন্ধু। ঘুটঘুটে অন্ধকার। হঠাৎ একটু দূরে একটা হায়েনার ডাক শোনা গেল। টানা, প্রলম্বিত একটা কণ্ঠ। এমন অদ্ভুত কণ্ঠে কোন হায়েনাকে এর আগে ডাকতে শোনেননি তাঁরা। একবার থামছে, তারপর আবার হচ্ছে। হঠাৎ কী একটা সন্দেহ করে দু’জনেই লণ্ঠন হাতে ছুটলেন কয়েদখানার দিকে। যা দেখলেন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এক প্রহরী এবং একজন পুলিস সদস্য মিলেও আটকাতে পারছে না আটক পশু কিংবা মানুষটাকে। খড়ের ছাদের নিচের বাঁশের বেড়াগুলোর ওপরে একটা গর্তমত করেছে সে। ওই ফাঁক দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করছিল। এসময় শব্দ শুনে এগিয়ে আসে পুলিস আর প্রহরী। উপায়ান্তর না দেখে পুলিসটি বন্দুকের কুঁদো দিয়ে এত জোরে মারে লোকটার মাথায় সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায় মাটিতে। কর্পোরাল এবার এগিয়ে এসে তালগাছের খুঁটির সঙ্গে হাতকড়া আটকে দিল বন্দির। সবাই ভাবল এবার আর বাছাধন পালাতে পারছে না।

পরের দিন রাত। প্রহরীর হঠাৎ একটু চোখ লেগে এল। তখনই তার মনে হলো পাশ দিয়ে কী একটা ছুটে গেল। লণ্ঠনের আলোয় দেখল দেয়ালে বিশাল এক গর্ত, ছাদটা নিচের দিকে নেমে এসেছে অনেকটা। সবাইকে সতর্ক করে দিতে শূন্যে গুলি ছুঁড়ল সে। তারপরই ক্যাম্পের প্রান্তে, প্রায় চারশো গজ দূরে পাহারায় থাকা প্রহরীটির গুলির শব্দও শুনতে পেল।

স্মিথ এবং অস্টারস্টক দৌড়ে গিয়ে দেখলেন বন্দি পালিয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো তালগাছের খুঁটি দাঁত দিয়ে দুই টুকরো করে গিয়েছে সে। না হলে পালাতে পারত না। সেখানে পড়ে আছে অনেকটা লালা ও রক্ত। হাতকড়াটা গড়াগড়ি খাচ্ছে মাটিতে। গোটা কামরায় অসহ্য একটা গন্ধ। সাত দিন ধোয়া-মোছার পরে যায় ওই গন্ধ।

সবাই রীতিমত আতঙ্কিত হয়ে পড়ল ঘটনার আকস্মিকতায়। কয়েকজন পুলিস বেরিয়ে পড়ল। তারপরই তারা এসে একটা অদ্ভুত খবর দিল। ওপাশের প্রহরীর গুলিতে একটা হায়েনা মারা পড়েছে। কী আশ্চর্য! এত রাতে মানুষ ভর্তি ক্যাম্পে হায়েনা ঢোকা তো রীতিমত অস্বাভাবিক।

তবে কি ওই হায়েনা আর লোকটা একই ব্যক্তি? স্মিথ, বিশেষ করে তাঁর বন্ধু অস্টারস্টকেরও তা-ই মনে হলো। তাঁরা এগিয়ে গেলেন মৃত হায়েনাটার দিকে। হাঁ করা মুখটা পৈশাচিক। চোয়াল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। প্রহরী বর্ণনা করল ঘটনা।

কয়েদখানা থেকে গুলির শব্দ শুনেই সতর্ক হয়ে যায় সে। বন্দুক বাগিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। হঠাৎ দেখে বিশাল একটা হায়েনা তাকে পাশ কাটিয়ে দৌড়চ্ছে আগুনের দিকে। আগুনে ঢুকেই পড়েছিল প্রায়। শরীরে আঁচ লাগতেই পিছু হটে। তখনই গুলি করে প্রহরী।

বিষয়টা নিয়ে অনেক ভেবেও কূলকিনারা করতে পারলেন না স্মিথ ও অস্টারস্টক। তবে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন হয়তো হায়েনা আর ওই কয়েদী একই। কে না জানে আফ্রিকায় অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে আজও। ফুলানি, কুরগ্রামের লোকেরা, এমনকী তাঁদের অভিজ্ঞতাও তো এই সাক্ষ্যই দিচ্ছে। তাছাড়া লোকটার চোখে একটু সমস্যা ছিল। তাই কি হায়েনাটা আগুনের ভেতরে ঢুকতে যায়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *