কুইন মেরির প্রেতাত্মারা

কুইন মেরির প্রেতাত্মারা

যখন জাহাজ ছিল তখন কুইন মেরিতে নানান ভুতুড়ে কাণ্ড- কীর্তির কথা শোনা যেত। তারপর একে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার লং বিচে বিলাসবহুল এক হোটেলে রূপান্তরিত করা হয়। আশ্চর্য ঘটনা, এরপর এতে অতিপ্রাকৃত ঘটনা কমে তো নি-ই বরং বেড়েছে। হোটেল মালিকরাও বিষয়টা ভালভাবেই নিয়েছেন। কারণ আখেরে তাঁদের লাভই হয়েছে এতে!

যেদিন প্রথম সাগরে নামে সেদিন থেকেই শুধু জাহাজকুলে নয় গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে কুইন মেরির নাম। যে কোন জাহাজের উদ্বোধন বিশাল এক ব্যাপার। কুইন মেরির বেলায় আরও প্রকটভাবে কথাটা সত্যি। বিশেষ করে এর মালিকদের জন্য। ইংল্যাণ্ডের কানরাড লাইন ছিল এর মালিক। জাহাজটার পেছনে দু’হাতে টাকা খরচ করা হয়। প্রায় ১০২০ ফুট লম্বা জাহাজটির ওজন ৮১২৩৭ টন। এখানে জানিয়ে রাখা ভাল, টাইটানিক ছিল ৮৮২ ফুট লম্বা, আর ওজনে ৪৬৩২৯ টন।

১৯৩৪ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সাগরে ভাসে কুইন মেরি। তবে এর মালিকদের হতাশ করে লেডি মেবেল ফর্টেস্কু- হ্যারিসন ভবিষ্যদ্বাণী করেন, ‘আরএমএস কুইন মেরি জনপ্রিয়তার শিখরে উঠবে তখনই যখন সে আর সাগরে নামবে না এমনকী কোন যাত্রীও বহন করবে না। তার এই সাফল্য দেখে যাওয়ার জন্য এখনকার অনেকেই থাকবে না, এমনকী আমিও।’

সত্যি তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী যখন সত্যি হলো তখন তা দেখবার জন্য বেঁচে নেই ফর্টেস্কু-হ্যারিসন। ব্রিটিশ জাহাজ, যেটা কিনা একসময় পরিচিত ছিল ‘আটলান্টিকের রানি’ হিসাবে, সেটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে একটি ভাসমান হোটেল হিসাবে। ১৯৯০-এর দশকে কুইন মেরি হোটেলের পাবলিক রিলেশন অফিসার হিসাবে কাজ করা এলিজাবেথ বোর্সটিঙের মতে ফি বছর হাজার হাজার অতিথি ভাসমান হোটেলটিতে আসে শুধু এখানকার অশরীরীদের কাণ্ড-কীর্তি দেখার জন্য।

হোটেলে পরিণত হবার পর যেন ভুতুড়ে হিসাবে এর সুখ্যাতি কিংবা কুখ্যাতি আরও বহুগুণ বেড়ে যায়। ওখানে অন্তত গোটা বিশেক অতৃপ্ত প্রেতাত্মাকে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। ধারণা করা হয় এদের সবগুলোই জাহাজ হিসাবে সাগরে ঘুরে বেড়াবার সময় থেকেই এর সঙ্গী। তবে তখন এদের প্রতাপটা আরও কম ছিল।

প্রথম ছয় বছরের ভ্রমণে জাঁকালো জাহাজটি রাজকীয় অতিথি, নায়ক-নায়িকাসহ ধনকুবেরদের খুব পছন্দের ছিল। তারপরই ১৯৩৯ সালের ৩০ আগস্ট বদলে যায় সব কিছু। সেবারের বিলাসযাত্রায় জাহাজে ছিলেন ২৫৫০ জন ধনী ও নামী-দামি ব্যক্তি। সেই সঙ্গে প্রায় সাড়ে চার কোটি ডলারের স্বর্ণপিণ্ড বহন করছিল কুইন মেরি। হঠাৎই নির্দেশ এল জাহাজের ২০০০-এর বেশি ঘুলঘুলির সবগুলো ঢেকে দেয়ার জন্য। গোটা জাহাজের সব যাত্রীর জীবন নির্ভর করতে থাকে তখন কারও চোখে ধরা না পড়ার ওপর। কারণ ইংল্যাণ্ড এবং ফ্রান্স কেবলই জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। আটলাণ্টিকের বরফশীতল জল ঢেকে গেছে নাৎসী যুদ্ধ জাহাজ ও সাবমেরিনে।• আকাশে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে হিটলারের অনুগত বাহিনীর যুদ্ধবিমান।

সৌভাগ্যক্রমে যাত্রার বাকি সময়টা জার্মানদের নজরে পড়ল না কুইন মেরি। এটাই ছিল প্রমোদতরী হিসাবে এর শেষ ভ্রমণ। তারপর একে রূপান্তরিত করা হয় সেনাবাহী এক জাহাজে, যেটার ডাক নাম ছিল, ‘গ্রে গোস্ট’ বা ‘ধূসর প্রেতাত্মা’। বন্দরে পৌছার সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের ভেতর থেকে আরাম-আয়েশের সব উপাদান ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়। জাহাজটির বাইরের অংশ মেটে ধূসর রং করা হয়। শত্রুর চোখের আড়ালে রাখার জন্যই এটা করা হয়।

যুদ্ধকালীন সময়ে আটলান্টিক পাড়ি দেয়া ছিল খুব ঝুঁকিপূর্ণ। জাহাজটির ২৮.৫ নট গতিকে কাজে লাগানোর জন্যই এর এই রূপান্তর। যদিও এর দুরন্ত গতিই যুদ্ধের সময়ের ভয়াবহ এক দুর্ঘটনার মূল কারণ। বলা হয় কুইন মেরির গায়ে ভুতুড়ে তকমা লাগার প্রধান কারণও এটি। কুইন মেরি ও তার অনেক ছোট পাহারাদার সঙ্গী কারাকোয়া একসঙ্গে ভ্রমণ করছিল। জার্মানদের বোকা বানানোর জন্য এলোমেলো বা আরও পরিষ্কারভাবে বললে আঁকাবাঁকাভাবে চলছিল জাহাজদুটি। কোনভাবে হিসাবে একটা ভুল হয়ে যায়। ‘ধূসর প্রেতাত্মা’ সরাসরি গিয়ে আঘাত করে কারাকোয়াকে। প্রচণ্ড গতির বিশাল দানবাকৃতি জাহাজের ধাক্কায় আক্ষরিক অর্থে দুই টুকরো হয়ে যায় কারাকোয়া।

প্রহরী জাহাজের ৪৩৯ জন নাবিকের ৩৩৮ জনই মারা যায়। এদের বেশিরভাগেরই মৃত্যু হয় আটলান্টিকের হিমশীতল জলে ডুবে। তাদের চোখের সামনেই বড় জাহাজটি ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছিল, কারণ যুদ্ধকালীন সময়ে থেমে মৃত্যুপথযাত্রী লোকগুলোকে উদ্ধারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল। একই সঙ্গে দুর্ঘটনা এবং ডুবন্ত লোকগুলোকে ফেলে পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ-এতটাই মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে ‘ধূসর প্রেতাত্মা’-র নৌসেনাদের যে ওই জাহাজের পরিবেশটাই অন্যরকম হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে তখন থেকেই অতিপ্রাকৃত কিছুর আছর হয় এর ওপর।

নিরাপদে বন্দরে ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গে ৭০ টন সিমেন্ট দিয়ে মেরামত করা হয় জাহাজটি। কিন্তু এটা মোটেই নাবিকদের মনোজগতে কিংবা এর ওপর যে অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রকাশ ঘটেছে তাতে কোন প্রলেপ দিতে ব্যর্থ হলো। এত কিছুর পরও যুদ্ধে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেল জাহাজটি। এমনকী যুদ্ধের চূড়ান্ত মুহূর্তে ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল সবসময় আটলান্টিক পাড়ি দিতে কুইন মেরিকে বেছে নিতেন।

১৯৪৫ সালে শান্তি ফিরে এলেও প্রমোদতরী থেকে নৌসেনা আনা-নেয়ার যানে রূপান্তরিত জাহাজটি সেনা, নাবিক ও বৈমানিকদের সেবাতেই ব্যবহৃত হতে লাগল। বলা চলে আরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে সে এখন। মোট ১৩০০০ যুদ্ধবিধবা এবং তাদের সন্তানদের আমেরিকা এবং কানাডায় পৌঁছে দিল। এজন্য মোট ছয়বার ভ্রমণ করতে হয় একে। পরের বিশ বছর কুইন মেরি আবারও যাত্রী পরিবহন করল। এর মধ্যে মাঝে মাঝে ছিলেন সমাজের অভিজাত ব্যক্তিরাও।

১৯৬৭-র ডিসেম্বরে কুইন মেরির সাগরযাত্রার অবসান ঘটল। অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলো তাকে। এসময় একে কিনে নিল আমেরিকার শহর লং বিচ কর্তৃপক্ষ। সাড়ে ৩৪ লাখ ডলার দিয়ে জাহাজটি কিনল তারা। স্থায়ীভাবে তার জায়গা হলো লং বিচে। এর মাধ্যমে একত্রিশ বছর আগে লেডি মেবেল ফর্টেস্কু-হ্যারিসনের করা ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হবার পথে প্রথম ধাপ সম্পন্ন হলো। এরপর থেকে জাহাজটি আর কোন যাত্রী বহন করেনি। তেমনি আর একবারের জন্যও সাগরে যাত্রা করেনি। এদিকে ব্রিটিশ জাহাজের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হলো জাহাজটির নাম। একটি দালান হিসাবে একে নথিভুক্ত করা হলো। এর জনপ্রিয়তাকে পর্যটক টানার কৌশল হিসাবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিলেন মালিকেরা। জাহাজটিকে হোটেলে রূপান্তরের কার্যক্রম শুরু হলো।

এসময়ই মালিকরা আবিষ্কার করলেন এর ব্যতিক্রমী অতীতের কারণে এখানে আস্তানা গেড়েছে বহু প্রেতাত্মা। হালের যে অংশটা কারাকোয়াকে আঘাত করে ওই অংশটিতে ভুতুড়ে কাণ্ড-কীর্তির সংখ্যা যেন বেশি। একজন কর্মচারী ওই জায়গাটিতে রাতে একটা রেকর্ডার রেখে যায়। পরদিন রেকর্ড অন করতেই দুটো জাহাজ ঠোকাঠুকির ভয়ানক আওয়াজ শোনা গেল। কেউ কেউ আবার এই জায়গায় নানা ধরনের অদৃশ্য কণ্ঠ ও রক্ত হিম করা চিৎকার শুনতে পাওয়ার দাবি করে।

অনেকেই অদ্ভুত সব আওয়াজ শোনার কথা বলে। কেউ বলে জাহাজের গায়ে হাত দিয়ে ঠক ঠক করার শব্দ শুনতে পেয়েছে। কেউ আবার প্রমত্ত ঢেউয়ের এবং ধাতব পদার্থ ছেঁড়ার আওয়াজ শোনে। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ হলো অশুভ চিৎকার এবং গোঙানি। লোকে বলে ওই প্রহরী জাহাজের ক্রুদের চিৎকার ওগুলো। মৃত ওই নাবিকেরা কোনভাবে কুইন মেরির পরিবেশের সঙ্গে আটকে গিয়েছে।

অবশ্য এসব ঘটনার শুরু কিন্তু কুইন মেরি হোটেলে পরিবর্তিত হওয়ার আগে থেকেই। কুইন মেরির একসময়কার চীফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন জন স্মিথ। অবসর নেয়ার পর ওই সংঘর্ষে জাহাজের যে অংশটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেখানে কোন কিছু দিয়ে আঘাত করার ও ঢেউ বাড়ি খাওয়ার ছলাত ছলাত শব্দ শুনতে পাওয়ার কথা বলেন। জাহাজটাকে খুব ভালভাবে চিনতেন স্মিথ। শব্দের উৎস খুঁজে বের করার জন্য চিরুনি অভিযান চালালেন। কিন্তু এসব শব্দের কোন ব্যাখ্যা আবিষ্কারে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত উপসংহারে পৌঁছেন বহু বছর আগের ওই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পৈশাচিক প্ৰতিধ্বনি শুনতে পেয়েছেন।

যুদ্ধকালীন সময়ের সেই দুর্ঘটনার পাশাপাশি তৈরির সময় এক বিস্ফোরণেও কিছু প্রাণহানি হয় জাহাজটিতে। এগুলোতে নিঃসন্দেহে এর ভেতরে অতিপ্রাকৃত শক্তি জেঁকে বসে। তারপর আবার জাহাজে অন্তত ৪৮টি অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে।

এদেরই একজন জন পেডার। ডেকের নিচে ডোরওয়ে ১৩ এই তরুণ ক্রুর জন্য প্রচণ্ড অশুভ হয়ে দেখা দেয়। ১৯৬৬ সালের ১০ জুলাই ১৮ বছরের এই তরুণ তার রুটিন কাজ করছিল। হঠাৎ ওয়াটার টাইট দরজা বন্ধ হয়ে মৃত্যু হয় তার। এলিজাবেথ বোর্সটিং স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, নীল ওভারঅল পড়া শ্মশ্রুমণ্ডিত এই তরুণের অবয়বকে পুরানো ইঞ্জিন রুমের আশপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে প্রায়ই।

এখনকার কর্মচারীরা ছাড়াও পর্যটকদের অনেকেরও আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হয়েছে। একসময় কুইন মেরি হোটেলের ট্যুর গাইড এবং সিকিউরিটি অফিসার ছিলেন ন্যান্সি ওজনি। বলেন, এক রাতে পর্যটনের এলাকাটা বন্ধ করার সময় পাশে কিছু একটার উপস্থিতি টের পান, ‘ঘুরে দেখলাম একজন লোক আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।’ অবশ্য তিনি স্বীকার করেছেন একজন পর্যটকের পেছনে রয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু না। তবে লোকটার যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে অন্য কিছু মনে হতেই পারে আপনার। ওই রহস্যময় লোকটির পরনে ছিল ময়লা নীল ওভারঅল, মুখে দাড়ি, গায়ের রং অস্বাভাবিক রকম সাদা, চেহারাটা আশ্চর্য ভাবলেশহীন। সব কিছু মিলিয়ে তাকে কোনভাবেই পর্যটক মনে হচ্ছিল না।

জাহাজের ভেতরের সুইমিং পুলটা এখনও আছে। তবে কেবলমাত্র মানুষের দেখার জন্যই এটা। এখন আর রক্তমাংসের কোন সাঁতারু ব্যবহার করে না। তবে দু’জন নারী ভূতকে এর সুবিধা নিতে দেখা যায়। একজন ট্যুর গাইডের অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা হয়। তার মনে হয় অন্য পৃথিবীর কিছু একটা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সাঁতারুর পোশাক পরে ছিল ওই প্রেতাত্মাটা। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে রহস্যময় সেই সাঁতারু যেমন হঠাৎ হাজির হয় তেমনি হঠাৎ গায়েব হয়ে যায়।

আরেকজন গাইড জানায় এক নারীকে ১৯৩০-এর দশকের একটা সাঁতারের পোশাক পরে একটা প্রায় শুকনো সুইমিং পুলে লাফ দেয়ার প্রস্তুতি নিতে দেখে। ওই মহিলাকে লাফ না দিতে সতর্ক করে চিৎকার দিয়ে ওঠে গাইড। তারপর সিকিউরিটি গার্ডের খোঁজে তাকায়। যখনই আপাতদৃষ্টিতে আত্মহত্যা করতে যাওয়া মহিলার দিকে ফেরে, দেখে সে সেখানে নেই।

১৯৮৩ সালের ঘটনা। কুইন মেরি হোটেলের কর্মচারী লেস্টার হার্ট সুইমিং পুলের এক পাশে ছিল। এসময় উল্টো পাশে সোনালী চুলের, ফুল হাতা সাদা গাউন পরা এক নারীকে দেখতে পায়। কিন্তু নারীমূর্তিটাকে খুব ঝাপসা মনে হচ্ছিল তার। যেন মাঝখানে একটা স্বচ্ছ পর্দা আছে। তারপর আরও ঝাপসা হতে হতে মিলিয়ে যায় ওটা।

এতে বেশ হকচকিয়ে গেলেও এ ধরনের ঘটনার জন্য কিছুটা হলেও মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে যায়। একদিন সুইমিং পুলের কাছেই পর্যটকদের জন্য বানানো একটা দোকানে কাজ করছিল সে। এসময় পানির ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দ শুনতে পায়। যেন কেউ সাঁতার কাটছে। সুইমিং পুলে সামান্য হলেও পানি রাখা হত দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য। তাই হার্টের মনে হলো কোন অতিথি হয়তো সীমা অতিক্রম করে এতে গোসল করতে নেমে পড়েছে। যে কাজ করছিল তা বাদ দিয়ে সুইমিং পুলের দিকে দৌড়ল সে। ওখানে কেউ নেই। তবে নিচে নামার মইয়ের কাছের পানি তখনও কাঁপছে। ভেজা এক পায়ের ছাপ এগিয়ে গিয়েছে ডেক ধরে এক দরজার দিকে।

ওটা দেখে হার্টের মনে হয় কোন একজন বেপরোয়া অতিথির কাণ্ডই এটা। অতএব পায়ের ছাপ অনুসরণ করা শুরু করে। মনে আশা এটা তাকে সাঁতারুর কাছে নিয়ে যাবে। তারপরই হঠাৎ করে অদৃশ্য হলো পায়ের ছাপ। সবচেয়ে আশ্চর্য ঘটনা, এখানকার খুব স্পর্শকাতর অ্যালার্ম সিস্টেম সর্বক্ষণ চালু থাকলেও পুলের চৌহদ্দিতে কোন কিছুর উপস্থিতি ওটা শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে।

হার্ট নিশ্চিত হয়ে গেল সুইমিং পুলের কোন একটা প্রেতাত্মার উপস্থিতিই একটু আগে টের পেয়েছে। হয়তো ১৯৩০-এর দশকের সুইমিং স্যুট পরা প্রেতাত্মাটাই এটি। এদিকটাতেই আরেকটা প্রেতাত্মার আনাগোনার কথা বলে অনেকে। ওটার পরনে থাকে ১৯৬০-এর দশকের পোশাক।

আরও কিছু প্রেতাত্মার আড্ডাখানা এই সুইমিং পুল এলাকা। সাধারণত একটা শিশু কণ্ঠের হাসি শোনা যায়। তবে কখনও একটা গোমড়ামুখো ছোট্ট বালকের অবয়বও চোখে পড়ে। হয়তো সে এতটা অসুখী থাকত না যদি জানত তার মত আরও অনেক অতৃপ্ত আত্মার আবাসস্থল এই কুইন মেরি জাহাজ বা হোটেল। কুইন মেরির একটা কামরা আগে শিশুদের খেলার জায়গা হিসাবে ব্যবহৃত হত। এখন ওটা স্টোর। ওখানে অনেকেই শিশুদের খেলার শব্দ শুনতে পায়, যদিও কাউকে দেখতে পাওয়া যায় না। জন্মের অল্প পরে মৃত্যুবরণ করা একটা বাচ্চার কান্নাও শোনা যায় কখনও কখনও।

তবে এই হোটেলের সবচেয়ে বিখ্যাত ভূত নিঃসন্দেহে উইন্সটন চার্চিল। যদিও তাঁর প্রেতাত্মাকে নিয়মিত দেখা যায় না। স্টোররুমে এখনও হঠাৎ হঠাৎ তাঁর বিখ্যাত সিগারের ধোঁয়া ভেসে বেড়াতে দেখা যায়। কখনও ওটার গন্ধও পান কেউ কেউ।

কুইন মেরি জাহাজের ভাণ্ডার . রক্ষক, যে এক ডাকাতিচেষ্টার সময় মারা যায়, সে-ই নাকি বি-৩৪0 কামরাটাকে ভুতুড়ে করে রেখেছে। হোটেলের অনেক অতিথিই বিভিন্ন বস্তু যেমন কাপ-প্লেট কামরাটায় উড়ে বেড়াতে দেখেছেন, কখনও আপনাআপনি খোলে, বন্ধ হয় ড্রয়ারগুলো। আবার ঘুমাতে গেলে তাদের বিছানা ধরে কেউ টানতে থাকে।

আরও কয়েকটি প্রথম শ্রেণীর কামরাও অতিপ্রাকৃত উপস্থিতির জন্য বিখ্যাত। রাতে শোনা যায় পানি পড়ার শব্দ। সকালবেলা বিনা কারণে বেজে ওঠে ফোন। মাঝরাতে হঠাৎ একে একে জ্বলতে শুরু করে একটার পর একটা বাতি। অতিথিরা শুনতে পান ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ, কখনও আবার অদৃশ্য কোন শক্তি টান দিয়ে নিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে তাদের কম্বল।

জাহাজের রান্নাঘরটা যেখানে ছিল সেখানে একটা অতিপ্রাকৃত কিছুর আনাগোনা আছে। ধারণা করা হয় সেটি খুন হওয়া এক ব্যক্তির আত্মা। প্রচণ্ড রাগী ও অশান্ত এক আত্মা ওটা। এমনকী যখন ‘গ্রে গোস্ট’ নাম নিয়ে যুদ্ধকালীন সময়ে ঘুরে বেড়াত তখনও এর উপস্থিতির কথা শোনা যায়। ওই সময় সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয়া এক তরুণ রাঁধুনিকে আক্রমণ করে। ওই ঘটনা নিয়ে জাহাজে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে এবং একপর্যায়ে ওই তরুণকে একটা গরম স্টোভের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলা হয়। কিচেনের চারপাশে এখনও প্লেট, কাপ এসব ছুঁড়ে মারে ওই অতৃপ্ত আত্মা। কখনও অবিচারের শিকার হওয়া লোকটার করুণ আর্তনাদ শোনা যায়। ওই জায়গার বাতিগুলো আপনাআপনি জ্বলতে নিভতে থাকে। রান্নাঘরের নানা সরঞ্জাম গায়েব হয়ে যায় হঠাৎ হঠাৎ।

কুইন মেরির সব ভূতেরাই যে মানুষ ছিল তা নয়। একটা কুকুরের চিৎকার শোনা যায় প্রায়ই। জীবিত থাকা অবস্থায় ওটা ছিল একটা আইরিশ সেটার। বলা হয় মালিকের খোঁজে সবসময় ছটফট করতে থাকে ওই কুকুরভূত। কুইন মেরি যখন একটা প্রমোদতরী ছিল তখন পোষা প্রাণী জাহাজে তোলা যেত। তবে ভিআইপি যাত্রী ছাড়া অন্যদের পোষা প্রাণীদের রাখতে হত সানডেকের একটা বিশেষ কামরায়। ওটাই খোঁয়াড় হিসাবে ব্যবহৃত হত। এক ইংরেজ যখন ভ্রমণে বের হতেন সঙ্গে নিয়ে যেতেন প্রিয় আইরিশ সেটার কুকুরটাকে। ভাল প্রশিক্ষণ পাওয়া কুকুরটা মালিকের সঙ্গে জাহাজের চারপাশে ঘুরে বেড়াতে খুব ভালবাসত। তবে সে এটাও জানত এরপর তাকে আবার আটকা পড়তে হবে ওই খোঁয়াড়ে।

তো এই রুটিনটা নিত্যই চলে আসছিল। একদিন হঠাৎ কুকুরটা জোরে জোরে চেঁচাতে লাগল এবং কুকুর রাখার ঘরটার দরজায় জোরে জোরে আঁচড়াতে লাগল। মনে হচ্ছে যেন ওখান থেকে বেরিয়ে যেতে চায় সে। আপাতদৃষ্টিতে ওটার মধ্যে কোন সমস্যা দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু অস্থিরভাবে গোটা কামরাটা চক্কর কাটতে শুরু করে।

খোঁয়াড়ের সুপারভাইজার একজনকে পাঠাল কুকুরের মালিকের কেবিনে। আশা করল হয়তো মালিক তার প্রাণীটাকে শান্ত করতে পারবেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা গেল লোকটা বিছানায় মরে পড়ে আছে। কুকুরটা নিশ্চয়ই অজানা কোনভাবে নিজের বন্ধু ও প্রভুর মৃত্যু টের পেয়েছিল। তাই এমন অস্থির আচরণ করছিল।

কুকুরটা এতটাই আঘাত পায় ঘটনার অল্প কিছুদিনের মধ্যে সে-ও মারা যায়। এখনও তার আর্তনাদ শোনা যায়। কেউ কেউ ওই শব্দ অনুসরণ করে এর উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু যতই সেদিকে যেতে থাকে ভুতুড়ে আওয়াজটা আরও দূরে সরে পড়তে থাকে। হয়তো এটা দিয়ে বোঝা যায় দুর্ভাগা প্রাণীটা এখন মানুষের ধরাছোঁয়ার চেয়ে অনেক দূরে।

সিনিয়র সেকেণ্ড অফিসার উইলিয়াম স্টার্কের প্রেতাত্মাকে শনাক্ত করা যায় খুব সহজেই। কারণ বিশাল কুইন মেরির গোটা এলাকাজুড়ে চক্কর দিতে দেখা যায় তাকে। ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বরে জাহাজেই মৃত্যু হয় স্টার্কের। মাতাল অবস্থায় ভুলে বোতল থেকে টেট্রাক্লোরাইড খেয়ে ফেলে সে। সাথে সাথে মৃত্যু হয় তার। শেষ ককটেলটা যে ভয়ানক বিষাক্ত ছিল এখনও এ ব্যাপারটা বুঝতে না পারায় তার অতৃপ্ত আত্মাটা দ্বিধাগ্রস্তভাবে ঘুরে বেড়ায় হয়তো। তবে একেবারেই নিরীহ ধরনের আত্মা সে।

সাদা ইউনিফর্ম পরা এবং অনেকগুলো সম্মানসূচক ফিতা জামায় আটকানো আরেক গর্বিত নাবিকের আত্মাকেও ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় কুইন মেরিতে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলে তার অবয়বটা পরিষ্কার হলেও একেবারে স্বচ্ছ।

কুইন মেরির প্রধান লাউঞ্জ এখন কুইন’স সেলন বা অভ্যর্থনা কক্ষ হিসাবে পরিচিত। এখানেও আছে এক অশরীরীর আনাগোনা। কর্মচারীদের বর্ণনায় সাধারণ এক সাদা সান্ধ্য পোশাকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় অপরূপা এক নারীকে। কখনও ছায়ার মধ্যে একাকী নাচে সে। হোটেলে ভ্রমণের সময় একটা ছোট্ট মেয়ে এমন একজনের কথা বলে। গাইড কিছু না দেখতে পেয়ে ট্যুর চালিয়ে যায়। মেয়েটা বারবার ওই নারীকে দেখার কথা বলতে থাকে। অবশ্য মেয়েটার মত আরও অনেক পর্যটকই তাকে দেখেছে।

কুইন মেরির একটা অংশকে পুরানো এক ইংলিশ পানশালার আদলে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এখানে একটা অশরীরীর উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। সবসময় নিজের উপস্থিতি জানান দেয় না সে, যখন দেয় রীতিমত জাহির করে। একটার পর একটা প্লেট উড়ে গিয়ে আছড়ে পড়তে থাকে দেয়ালে। ঝুলতে থাকা ছবি এমনকী ঘড়িও উল্টো হয়ে যায়।

ইঞ্জিন রুম যেখানে ছিল সেখানে সাদা ওভারঅল পরা একটা লোককে কাজ করতে দেখা যায় কখনও। ধারণা করা হয় জাহাজের গোড়ার দিকের এক অফিসার তিনি। মেইন ডেকের নিচে আরেকটা অতিপ্রাকৃত শক্তির উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। যদিও দেখা যায় না তাকে। তার দৌড়ে যাওয়ার এবং ওই সময় শিকল নাড়ানোর শব্দ পাওয়া যায়।

যেখানে প্রথম শ্রেণীর স্যুইটগুলো সেখানে চমৎকার পোশাকের ফিটফাট এক আত্মাকে দেখা যায়। কালো চুলের লোকটার গায়ে থাকে ১৯৩০-এর দশকের একটি স্যুট। এক আলোকচিত্রী নিজের অজান্তেই তার ছবি তুলে ফেলে। ওই ট্যুর গাইড জাহাজের ভেতরের ছবি নিচ্ছিল। এক পর্যায়ে একটা আয়নার ছবি তোলে সে। যখন ছবিগুলো ধোয়া হয় আয়নায় লম্বা, কালো চুলের এক লোকের প্রতিবিম্ব দেখা যায়। বিষয়টা অস্বাভাবিক মনে হওয়ার কারণ ছিল না, কিন্তু সমস্যা হলো লোকটার পরনের স্যুটটা ছিল ১৯৩০-এর দশকের। যে সময় ছবি তোলা হয় তখন ট্যুর গাইড একাই ছিল। আর সে নিশ্চয়ই এত পুরানো জমানার একটি স্যুট পরে ছিল না।

কেউ জানে না কুইন মেরির কয়টা ভূত বাতি জ্বালা- নেভানোর খেলায় অংশ নেয়। তেমনি বন্ধ দরজা খুলে যাওয়া কিংবা খোলা দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়া অতি স্বাভাবিক ঘটনা। এখানকার একটা ভূত এসব বিষয়ে অবিশ্বাসী রিপোর্টার টম হেনিসির ধারণা বদলে দেয়।

১৯৮৩ সালের মার্চের একটা রাত কুইন মেরিতে একা কাটান টম হেনিসি। এই রাতটির কথা ভুলবেন না কখনও। পরিকল্পনামত কুইন মেরির সবচেয়ে ভুতুড়ে জায়গাগুলোয় রেখে যাওয়া হয় তাঁকে। শ্যাফট অ্যালিতে কাটান পঁয়ত্রিশ মিনিট। এসময় অস্বাভাবিক একটা কিছু তাঁর সঙ্গে যোগ দেয়। হঠাৎ ভুতুড়ে একটা দুম দুম শব্দ কানে আসে। সাহসের সঙ্গে শব্দ লক্ষ্য করে এগোন তিনি। কিন্তু যখনই কাছে আসেন ওটা থেমে যায়। ঘুরে যেদিক থেকে এসেছেন সেদিকে রওয়ানা দেন। এসময়ই তাঁর পথে কোথা থেকে এসে পড়ে বিশাল এক তেলের ড্রাম। ঘুরে অপর একটা পথ বেছে নেন। তারপর কী মনে করে আবার পুরানো পথে ফিরে আসেন। এবার পথ আটকাল একটা নয় বরং দুটো তেলের ড্রাম। এসময়ই মনে হলো তাঁর পায়ের নিচের ক্যাটওয়াক কাঁপছে। যেন কিছু একটা তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। হেনিসি এবার আর সাহস ধরে রাখতে পারলেন না। ঘুরে অন্য দিকে ছুটলেন।

মোটামুটি স্নায়ু শান্ত হয়ে এসেছে তাঁর। এসময় মনে হলো কাছেই কোথাও কয়েকজন মানুষ কথা বলছে। কান পাততেই বুঝলেন তিনজন লোক আলোচনায় মগ্ন। একপর্যায়ে কেবল একজনের কথা শুনতে পেলেন। তবে ওই একজনের কথাটা পরিষ্কার শুনতে পেলেন। সে বলছে, ‘বাতিটা নিভিয়ে দিচ্ছি আমি।’ সৌভাগ্যক্রমে অন্ধকারে নিমজ্জিত হবার আগেই আতঙ্কিত রিপোর্টার শ্যাফট অ্যালি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন।

টম হেনিসি কুইন মেরি থেকে বেরিয়ে এলেন এক বদলে যাওয়া মানুষ হিসাবে। ওই জায়গায় আর কখনও একা সময় কাটানোর কথা চিন্তাই করেননি তিনি। হাজারো মানুষ ফি বছর কুইন মেরি হোটেলে ভ্রমণ করে নিদেন পক্ষে একটা ভূতকে দেখার জন্য। অনেকের ইচ্ছা পূরণও হয়।

শেষ কথা, ১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি হলিউডে মৃত্যুবরণ করা লেডি মেবেল ফর্টেস্কু-হ্যারিসনের কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। কুইন মেরি স্থায়ীভাবে ডকে জায়গা নেয়ার পরেই খ্যাতির চূড়ায় উঠল। যখন ভবিষ্যদ্বাণী করেন তখন ওটা অবিশ্বাস্যই মনে হয়েছিল, কিন্তু ওটার উদ্বোধনের সময় তাঁর বলা কথাগুলো অতীতের জাহাজ, অধুনা এই জনপ্রিয় হোটেলের সঙ্গে তাঁর নামটাও ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় করে রাখল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *