কালো মৃত্যুদূত

কালো মৃত্যুদূত

অশুভ কালো কুকুর নিয়ে এর আগেও টুকটাক লিখেছি। এবারের অধ্যায়টি মূলত এ বিষয়ে গবেষণা করা জে. ওয়েন্টওয়র্থ ডের লেখার রূপান্তর। এখানে এ বিষয়ে আগ্রহী আরও একজন নারীর অভিজ্ঞতা এবং সংগ্রহ করা নানান ঘটনার বিবরণ তুলে ধরেছেন ওয়েন্টওয়র্থ।

উইকেন ফ্যানের জলার ওপরের আকাশে চাঁদ উঠেছে। লাল, গোলাকার। এখানকার জলাভূমি, ডোবা, নলখাগড়ার বন সব আছে সেই হাজার বছর আগের মতই। এর ধারেই একটা সরাইখানায় বসে আগুন পোহাচ্ছে কিছু মানুষ।

‘জলার তীর ধরে যাব আমি। মূল রাস্তা দিয়ে যাওয়ার চেয়ে এভাবে গেলে অন্তত এক মাইল পথ বেঁচে যাবে।’ আমার সিদ্ধান্ত জানালাম।

‘ওই জলা এলাকায় রাতে কালো শয়তান ছুটে বেড়ায়, স্যর।’ মুখে ঢুকে পড়া আগুনের সাদা ছাই থু করে ফেলে বলল জ্যাক বার্টন, ‘ওই পথে যাব না আমি। অনেক টাকার লোভ দেখালেও না।’

‘কারোরই যাওয়া উচিত নয়,’ সুর মেলাল উপস্থিত কয়েকজন, ‘এক মহিলার কী হয়েছিল মনে করতে পারছ, জ্যাক? ওই কুকুরটা তার কাছে এসেছিল রাতে। কয়দিন পরেই মারা যায় সে।’

‘ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি,’ বলে ফ্রেডের দিকে ফিরে জানতে চাইলাম, ‘যাবে তুমি? আমার পথেই পড়ে তোমার বাড়ি। বেশ কতকটা সময় বেঁচে যাবে তোমার।’

ঘোড়ার মত ত্রাহিস্বরে চেঁচিয়ে উঠল ফ্রেড, ‘না, স্যর, না, স্যর। কেউ আমাকে রাতে ওই জলার তীর ধরে নিতে পারবে না। এমনকী ইংল্যাণ্ডের রাজাও নয়। তোমার কাছে হাঁস মারার একটা বন্দুক আছে জানি, এর বদলে যদি মেশিন গান থাকত তবুও নয়। যদি যাও, কুকুরটা তোমারও বারোটা বাজাবে।’

একেবারে ছোটবেলা থেকেই ফ্রেডকে চিনি। জলা এলাকায় আমার শিকারের দিনগুলোতে সে ছিল একেবারে যাকে বলে নিয়মিত সহচর। কোন পরিস্থিতিতেই পিছু হটতে দেখিনি তাকে। কিন্তু আজ রাতে সে ভয় পেয়ে গিয়েছে। এমনকী স্বীকারও করছে তা।

‘তুমি কেন এত ভয় পাচ্ছ, ফ্রেড?’

‘বলেছিই তো, ওই কালো কুকুরটা। ওটা এই জলার তীর ধরে রাতের বেলা ঘুরে বেড়ায়। মাস্টার ওয়েন্টওয়র্থ, ওটা আলকাতরার মত কালো, বাছুরের সমান বড়। চোখজোড়া গাড়ির হেডলাইটের মত। তোমার দিকে একবার দৃষ্টি দিলেই হয়েছে, প্রাণে বাঁচবে না।’

‘কিন্তু, ফ্রেড, বুনো হাঁসের পেছনে এখানে রাতের পর রাত ঘুরে বেড়িয়েছে বাবা। তাঁর তো কিছু হয়নি।’

‘স্বীকার করছি, তিনি তা করেছেন। তবে তাঁর ভাগ্য ভাল অশুভ কালো কুকুর তাঁকে চেহারা দেখায়নি, যদি দেখাত তবে তিনি মারা পড়তেন।’

ফ্রেড বলল কয়েক বছর আগে তার বোন এই এলাকায় এক চন্দ্রালোকিত রাতে দেখা করতে আসে তার প্রেমিকের সঙ্গে। তখন কালো কুকুরটার মুখোমুখি হয়ে যায়।

‘স্যর, কুকুরটা তীর ধরে চুপিসারে এগিয়ে আসে ছায়ার মত। ওটার মাথা ছিল নিচের দিকে। যখন আমার বোনের থেকে বিশ গজ দূরে মাথা উঁচু করে তার দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকাল, চোখজোড়া ছিল রক্তের মত লাল। আমার বোনের আত্মা শুকিয়ে যায়। ঘুরে জলার তীর ঘেঁষে উল্টো দিকে দৌড়তে শুরু করে। প্রেমিকের সঙ্গে যখন দেখা হলো তার গায়ে ঢলে পড়ল জ্ঞান হারিয়ে।’ .

‘তার প্রেমিক কি কিছু দেখেছিল, ফ্রেড?’

‘না, স্যর।’

‘কিন্তু তোমার বোন যদ্দূর জানি এখনও বেঁচে আছে। অশুভ জিনিসটা তাকে মারতে পারেনি। আমাদেরও পারবে না।

‘আমার বোনকে তুমি দেখেছ, ওর মত শক্ত মেয়ে আর হয় না, স্যর। তারপরও এক হপ্তা বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেনি। স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়েছিল।’

অতএব ফ্রেড আমার সঙ্গে ওই জলা এলাকাটা পার হলো না। সঙ্গে বন্দুক এমনকী এক কোয়ার্ট (প্রায় এক লিটার) বিয়ারের লোভ দেখিয়েও সে রাতে কারও ভয় জয় করতে পারিনি। যখন পরদিন সকালে ফ্রেডকে বললাম ওই রাতে একাই বহাল তবিয়তে জলাভূমির তীর ধরে বাড়ি ফিরে এসেছি, তখন সে উত্তর দিল, ‘তোমাদের মত পুরনো রাজ বংশের মানুষদের কালো কুকুর কখনও কখনও একটু ছাড় দেয় বৈকি।’

ভুতুড়ে এক কুকুরের কিংবদন্তি গ্রেট ব্রিটেনের পুব অংশে ডালপালা মেলেছে বহু বছর ধরে। আমার খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবী লেডি ওয়ালসিংহ্যাম এর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন। এমনকী এর দেখাও পেয়েছিলেন!

এক রাতে সাফোকের লিস্টনে তখনকার লেডি রেনডলশ্যামের সঙ্গে একটা গির্জার গোরস্থানের কাছে বসে ছিলেন। উদ্দেশ্য অশুভ কালো কুকুরের দেখা পাওয়া। আনুমানিক বারোটার দিকে, সমাধিফলকগুলোর মাঝখান থেকে একটা বিশাল কালো ছায়া বেরিয়ে এল, তারপর এক লাফে গির্জার নিচু সীমানা দেয়াল পেরিয়ে বালুর টিলাগুলোর দিকে রওয়ানা হলো। এই দুই নারীর কেউই কুসংস্কারাচ্ছন্ন কিংবা মাতাল ছিলেন না।

নরফোকের ব্ল্যাক শাক নামে পরিচিত কিংবদন্তির সেই কালো ভুতুড়ে কুকুরই আমাদের এই কালো শয়তান। বলা হয় নরফোকের ওই শয়তান কুকুর ক্রোমার এবং শ্যারিংহ্যামের মাঝখানের পাহাড়ি পথ ধরে নিঃশব্দে চলাফেরা করে। এখানকার বাসিন্দাদেরকে এমনকী দশ পাউণ্ড এবং এক বোতল বিয়ারের লোভ দেখালেও তারা রাতে এই পাকদণ্ডী পথে চলতে রাজি হবে না।

ডব্লিউ. এ. ডাট তাঁর দ্য নরফোক ব্রডল্যাণ্ড বইয়ে লিখেছেন, ‘নরফোকের সবচেয়ে ভয়ানক প্রেত বলা চলে ব্ল্যাক শাককে। অ্যাংলো-স্যাক্সন শব্দ স্কাক্কা বা সিয়োক্কা থেকে এসেছে এই শাক শব্দটি। অর্থ শয়তান। এই পৈশাচিক কুকুর গায়ে-গতরে বড় আকারের একটা বাছুরের সমান, ঝোপঝাড়ের ছায়া ধরে নিঃশব্দে চলাফেরা করে সে। একা চলা পথচারীদের অনুসরণ করে, হলুদ চোখের ভয়ানক দৃষ্টি দিয়ে তাদের আঁতকে দেয়। এর সঙ্গে দেখা হওয়া মানে এক বছরের মধ্যে হতভাগ্য লোকটির মৃত্যু। বার্টন ব্রডের কাছের নিটিসহেড লেন তার হানা দেয়ার পছন্দের এক জায়গা। তবে কলটিশাল ব্রিজও তালিকায় ওপরের দিকেই থাকে। ওটার ওপর দিয়ে প্রায়ই মুণ্ডুবিহীন অবস্থায় চলাফেরা করতে দেখা যায় তাকে।’

তবে এই ভুতুড়ে কুকুরের এক অদ্ভুত সংস্করণ নাকি ক্যাম্ব্রিজশায়ারের কাছে সাফোক সীমান্তের সুঘ হিল লেনে ঘুরে বেড়ায়। ক্যাম্ব্রিজের প্যান্টন স্ট্রিটের পুলিস কনস্টেবল এ. টেইলর আমাকে বলেছিল তার যৌবনকালে ওয়েস্ট র‍্যাটিং থেকে বালশামের দিকে যাওয়া পথটায় শাগ মাঙ্কি নামের এক অদ্ভুত জীব ঘুরে বেড়াত। একটা মোটা চামড়ার কুকুর এবং বড় চোখের বানরের সঙ্কর নাকি ছিল ওটা। কখনও পেছনের পায়ে ভর দিয়ে চলত, কখনও আবার চারপায়ে ছুটে বেড়াত।

নরউইচের কাছের হ্যাম্পনেলের বাসিন্দা মিসেস সোফিয়া উইলসনও কালো কুকুরের অস্তিত্বে প্রবলভাবে বিশ্বাসী। তিনি আমাকে লেখেন, ‘হ্যাম্পনেল থেকে মার্কেট হোল নামে একটি রাস্তা চলে গিয়েছে। একষট্টি বছর আগে যখন হ্যাম্পনেলে প্রথম বাস করতে শুরু করি আমার স্বামী আমাকে বলে এখানকার অনেক বাসিন্দাই এ ধরনের অশুভ একটা কিছু দেখার কথা বলেছেন। আমার প্রিয়তম স্বামী মারা গিয়েছেন। ওই অশুভ কালো কুকুরও আমার কাছে স্রেফ এক কিংবদন্তি হিসাবেই ছিল। তারপরই এক রাতে আমার চব্বিশ বছরের ছেলেটা নরউইচ থেকে যখন এল, দেখলাম ওর চেহারা আতঙ্কে ফ্যাকাসে। সে অসুস্থ কিনা জানতে চাইলে বলল, মার্কেট হল ধরে আসার সময় বিশাল একটা কালো কুকুর তার বাইকের ঠিক মুখোমুখি চলে আসে। সে যখন সংঘর্ষটা এড়াবার কোন উপায় দেখছে না তখন জন্তুটা বেমালুম গায়েব হয়ে যায়। বাইক থেকে নেমে চারপাশে তাকিয়েও সে কিছু দেখতে পায়নি। তখনই ভয় পেয়ে যায়।’

গেলডেস্টোনের ধারের ওয়েভেনে উপত্যকার গ্রামগুলোতেও এ ধরনের অশুভ একটা কিছুর আনাগোনার খবর পাওয়া যায়। সাধারণত বিশাল একটা কুকুরের বেশেই ওটাকে দেখা যায়, তবে কুকুর এত বিশাল হয় না। সাধারণত অশুভ কিছু ঘটতে যাওয়ার আগে ওটা দেখা দেয়।

গ্রামের এক মহিলা জানান, গিলিংহ্যাম থেকে গেলডেস্টোনে যাওয়ার পথে এক রাতে ওটাকে দেখেন। তাঁর বর্ণনায়, ‘আমাদের বিয়ের পর পরই এটা ঘটে। আটটা থেকে নয়টার মাঝামাঝি তখন। গেলডেস্টোনের কাছের একটা লেনে তখন ছিলাম আমরা দু’জন। এসময়ই মিসেস এস.-এর সঙ্গে দেখা হয় আমাদের। তিনজন হাঁটতে শুরু করি। এসময়ই পেছনে একটা শব্দ পাই। অনেকটা একটা কুকুর দৌড়ে আসার মত। ভাবলাম কোন কৃষকের কুকুর। কাজেই মনোযোগ দিলাম না। আমাদের পেছনে লেগে রইল ওটা। পিট! পেট! পিট্! পেট! পিট! পেট!

‘মিসেস এস.-কে জিজ্ঞেস করলাম কুকুরটা কী চায়? ‘চারপাশে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘কোন্ কুকুরের কথা বলছ?’

কেন, তুমি ওটার শব্দ শুনতে পাচ্ছ না?’ অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, ‘গত পাঁচ মিনিট কিংবা এর বেশি সময় ধরে জানোয়ারটা আমাদের অনুসরণ করছে। জোস, তুমি শুনতে পাওনি?’

ওহ! পাগল হয়ে গেলে নাকি! কোন শব্দ-টব্দ হচ্ছে না,’ তিরস্কার করল আমার স্বামী, ‘আমার হাতটা ধরে তাড়াতাড়ি পা চালাও।

‘জোস এবং মিসেস এস.-এর মাঝখানে থেকে ভয়ে ভয়ে হাঁটতে লাগলাম।

‘এসময়ই মিসেস এস. বললেন, ‘এখন ওটার শব্দ পেয়েছি। আমাদের সামনে। ওই তো তাকাও!’

‘সত্যি! সামনে একটা জন্তু, বিশাল একটা কালো কুকুরের মতই লাগছে। তবে এটা আসলে কুকুর নয়। অশরীরী কিছু একটা। ভয়ঙ্কর জিনিসটাকে বিভিন্ন জায়গায় দেখা গিয়েছে এর আগে, বেশ অশুভ কিছু ঘটনাও ডেকে এনেছে সে। গির্জার কাছ পর্যন্ত এটা আমাদের আগে আগে চলল। তারপর এক লাফে দেয়াল টপকে সমাধিগুলোর মাঝখানে অদৃশ্য হলো।’

জেলার অনেকেই ওই অশুভ জিনিসটাকে দেখে। তবে ওটার ঘুরে বেড়ানোর প্রিয় জায়গা গেল্ডারস। বিকলস রোডের ধারের একটা জংলা জায়গা এই নামে পরিচিত। এ ব্যাপারে বেশ খোঁজ-খবর নেয়া মি. মোরলে এডামস জানান, কেউ যদি ভয় না পায় তবে কেবল তার পিছু পিছু যাবে জিনিসটা। ওই সময়ে পেছনে তাকানো উচিত না। তাহলে পাগলা কুকুরের মত তেড়ে আসবে। কেউ কেউ বলে রাস্তাঘাট থেকে ছোট ছেলে-মেয়েদের কাপড় কামড়ে টেনে নিয়ে যায় এই মৃত্যুকুকুর।

এসেক্স, ডর্টমুর এসব জায়গায়ও এই অশরীরী কালো কুকুর দেখা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়। কালো কুকুরের ডোরচেস্টশায়ারের কিংবদন্তিতে অনুপ্রাণিত হয়েই স্যর আর্থার কোনান ডয়েল লেখেন রহস্যকাহিনী দ্য হাউণ্ড অভ দ্য বাস্কারভিলস।

কালো কুকুরের ব্যাপারে আগ্রহী মানুষের অভাব নেই। ১৯৫৬ সালের ২৯ আগস্ট মিসেস বারবারা কেরবেনেল আমাকে একটা চিঠি লেখেন। এতে ডেভনে এই কালো কুকুরের উপস্থিতি বিষয়ে নানা ধরনের তথ্য দেন।

‘১৯২৫ সালে আবিষ্কার করি নির্দিষ্ট একটা রাস্তা ঘিরে কালো কুকুর দেখা যাওয়ার ঘটনা অনেক বেশি শোনা যায়। কপলস্টোন থেকে টরিংটনের দিকে গেছে রাস্তাটা। মোটামুটি ২১ মাইল এলাকায় এর আনাগোনা বেশি। এক ওয়াগনচালক আমাকে তার অভিজ্ঞতার কথা বলে। পঁয়ষট্টি থেকে সত্তর বছরের লোকটার সোজাসাপ্টা এবং সত্য কথা বলিয়ে হিসাবে নাম আছে এলাকায়। কপলস্টোনের কারখানাগুলো থেকে টরিংটনে চল্লিশ বছর নিয়মিতই রাতের বেলা জিনিসপত্র আনা- নেয়া করেছে ওয়াগনে করে। প্রথমবার যখন দেখে তখন বেশ নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। দ্রুত গিয়ে আশ্রয় নেয় তার বিশাল ওয়াগনের ক্যানভাসের হুডের তলায়। তবে এরপর যখন মাঝে মাঝেই প্রায় ছোটখাট একটা গরুর সমান ওই কালো কুকুরটা দেখা দিতে লাগল রাতে, তখন আর খুব একটা ভয় পায়নি। ঘোড়াগুলোও শুরুতে ওটাকে দেখে ত্রাহি চিৎকার জুড়ে দিত। পরে অভ্যস্ত হয়ে যায়। কুকুরটা ওয়াগনের পাশে পাশে ছুটত। তবে কখনও ওই প্রাণীটাকে সে স্পর্শ করত না, এমনকী ওটার সঙ্গে ভাব আদান-প্রদানেরও চেষ্টা করত না।’

ডেভনের পাহাড়ের ওপর ছোট্ট এক গ্রাম ডাউন সেন্ট মেরি। এখানে একটা প্রাচীন স্যাক্সন গির্জাও আছে। গ্রামবাসীরা জানায় রাতে গির্জার আশপাশে হাজির হয় টরিংটনের কালো কুকুর। বিশেষ করে গ্রামের কামার ওটাকে বেশ কয়েকবারই দেখেছে। গির্জা আর একটা স্কুলঘরের মাঝখান দিয়ে ছুটে যেত অদ্ভুতুড়ে জিনিসটা। এসময় কখনও ওটা মাথা দিয়ে বাড়ি দিত স্কুলদালানকে। এতে ওই দালানের কিনারাটা আংশিক ভেঙেও যায়।

আরেকটা অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে এই গ্রামেরই এক লোক। যুবা বয়সে সে কয়েকজন বন্ধুসহ বড়দিনের উৎসবের রাতের খাওয়া শেষে কপলস্টোনের দিকে ফিরছিল। এসময়ই হঠাৎ কালো কুকুরটার রাস্তা ধরে এগিয়ে আসার শব্দ পায়। তাড়াতাড়ি ওটাকে এড়াতে দৌড়ে একটা মাঠে গিয়ে আশ্রয় নেয় ছেলেরা। দেখে বাছুরের সমান একটা কুকুর, কুচকুচে গায়ের রং, জ্বলজ্বলে চোখ, স্কুলদালানের দিকে ছুটছে। একটু পরেই একটা সংঘর্ষের শব্দ শোনে, অনুমান করে ওটার মাথার আঘাতে স্কুলের দেয়াল থেকে পাথর খসে পড়ছে। এক মুহূর্ত দেরি না করে দৌড়ে বাড়িতে হাজির হয় তারা।

কালো কুকুরের চলাচলের এলাকা হিসাবে যে লাইন বা রাস্তাটা আমি আবিষ্কার করেছি তার সমান্তরালে গিয়েছে উইক হিল নামের এক গ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিমের এক খাড়া পাহাড়ি রাস্তা। ওখানে অ্যালেন’স উইক নামে একটা খামারও আছে। এখানে কোন ঘটনা জানতে পারি ভেবে খোঁজ-খবর নেয়ার চিন্তা করি। তারপরই মনে পড়ে আমাদের গ্রামের দোকানটা যে মহিলা চালায় সে একসময় ওখানে থাকত। তার বাবা এখনও ওই এলাকাতেই থাকেন। দোকানে এসে জানতে চাইলাম, ‘টরিংটনের কালো কুকুরের কথা কি শুনেছ?’

আমি যখন কথা বলছিলাম তখনই গ্রামের দু’জন মহিলা ভেতরে ঢুকল কিছু কিনতে। দোকানি মিসেস জুয়েল খুব আলাপী এবং ভাল মানুষ। কিন্তু হঠাৎই সে বলে উঠল, ‘না, কখনওই না।’ তারপর আমাকে বিদায় জানিয়ে ওই দুই মহিলার সঙ্গে আলাপ শুরু করল।

তার এই ব্যবহারে হতবিহ্বল হয়ে চলে গেলাম। আধ ঘণ্টাটাক পরে আবার যখন দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্ছি মিসেস জুয়েল দরজার সামনে এল। আমার বাহু ধরে বলল, ‘মনে কষ্ট নিয়ো না। এসো, তোমাকে অনেক কথাই বলার আছে আমার।’ তারপর টেনে তার পার্লারে নিয়ে গেল আমাকে।

‘টরিংটনের কালো কুকুরের ব্যাপারে তুমি কী জানতে চাও?’

জবাবে জানালাম এই কুকুরটার বিশেষ করে উইক হিলের আশপাশে এর বিচরণের ঘটনাগুলো নিয়ে জানতে আগ্রহী আমি।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল মহিলা। হয়তো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তারপর ঝেড়ে কাশল, ‘ওটা সবসময়ই ওখানে আছে। সবাই প্রাণীটার কথা জানে। তবে ওটার কথা বললে মন্দভাগ্য তাড়া করে। আমি জানি না তোমাকে কুকুরটার কথা বলে নিজের বিপদ টেনে আনছি কিনা।

তারপর ফিসফিস করে বলতে শুরু করল। সে চাইছিল না এখানকার কেউ তার এই কথা শুনুক। উইক হিলেই বেশি আসে ওটা। ওখানেই প্রথম দেখে। তখন তার বয়স এই দশ। ১৮৭০ সাল কি এর দু’এক বছর আগে বা পরের ঘটনা। রাত এগারোটা। বাবার সঙ্গে একটা উৎসবের খাওয়া শেষে বাড়ি ফিরছিল। উইক’ হিলের অ্যালেন’স উইক খামারের কাছেই তাদের বাড়ি। চন্দ্রালোকিত এক রাত ছিল সেটা। হঠাৎ তাদের পেছনে একটা কিছুর শব্দ শুনে সচকিত হয়ে ওঠে দু’জনে। পিছু পিছু আসছে একটা বিশাল কালো কুকুরের মত জন্তু। বাবার হাত চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠে সে। বাবা বলেন তখন, ‘আমার হাত ধরো, কথা বলবে না একটুও। আস্তে হাঁটো, কাঁদবে না।’

মোটামুটি সিকি মাইল জন্তুটা তাদের পেছন পেছন আসে। ওটার জিভটা বেরিয়ে ছিল মুখ থেকে। টকটকে লাল। একপর্যায়ে সে এবং তার বাবা যখন রাস্তা ছেড়ে কটেজের দিকে চলে যায় কুকুরটা তাদের গেটের পাশ দিয়ে ছুটে অদৃশ্য হয়। তার বাবা তখন বলেন, এই অশরীরী কুকুরটা বহু বছর ধরে এভাবেই মাঝে মাঝে চেহারা দেখিয়ে আসছে। কারও ক্ষতি করে না। মিসেস জুয়েল জানায়, পর পর কয়েক রাত ওটার কথা ভেবে ঘুম হয়নি তার।

চোদ্দ বছর বয়সে আবার কুকুরটা দেখে সে। সমবয়সী দুটি মেয়ের সঙ্গে একটা ফার্ম থেকে ফিরছিল। উইক হিলের দিকে যাওয়া একটা মেঠো পথ পেরোচ্ছিল মেয়েরা। তিনজনই দেখে মাটিতে নাক প্রায় ঠেকিয়ে দৌড়চ্ছে বিশাল ওই জানোয়ারটা, আর প্রচণ্ড শব্দে গর্জাচ্ছে। মনে হচ্ছিল কুকুরদের গোটা একটা দল চিৎকার করছে খেপে গিয়ে। আরেকবার বাড়িতে পৌছার ঠিক আগে তাকে অতিক্রম করে যায় কুকুরটা। ওটার পথ থেকে লাফিয়ে সরে যায় সে, আর কুকুরটা পরমুহূর্তে হঠাৎই অদৃশ্য হয়।

বহু বছর পর, তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে ততদিনে, টরিংটন মার্কেট থেকে একটা টাট্টুতে চেপে ফিরছিল বাবার সঙ্গে। টরিংটন এবং অ্যালেন’স উইকের মাঝখানে হঠাৎ একটা ডোবামত জায়গা থেকে লাফিয়ে তাদের সামনে চলে আসে ওই অশুভ কালো জন্তুটা। টাট্টুটা এতটাই ভয় পেয়ে যায় যে, পাগলের মত ছুটতে শুরু করে তাদের নিয়ে। সে আমাকে এটাও জানায় কিছুদিন আগেও (১৯২৫-২৬) ওই এলাকায় একে দেখা গিয়েছে। যদিও বিষয়টা নিয়ে কেউ মুখ খোলেনি।

১৯৩২ সালের ঘটনা। বিডফোর্ডের দুই মাইল দূরে এক যাজকের বাড়িতে বাস করছিলাম আমরা। ওই সময় আমার বোন এবং তার স্বামীও ছিল আমাদের সঙ্গে। বোন জামাইয়ের তখন ছুটি চলছিল। জানুয়ারির এক রাতে উইংলেইফে এক আত্মীয়ের বাড়িতে ডিনারের দাওয়াতে গিয়েছিল স্বামী-স্ত্রী। ফেরে মধ্যরাতের একটু পরে। টরিংটন থেকে বিডফোর্ডের রাস্তাটা পড়ে তাদের এই যাত্রায়। ঘুমিয়ে পড়ায় রাতে তাদের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে আমার বোন জানতে চায় বিডফোর্ড এবং উইংলেইফের মাঝখানের পথে কালো কুকুরের দেখা দেয়ার ব্যাপারে কিছু জানি কিনা। জবাবে জানাই ওই রাস্তায় এ ধরনের কিছুর কথা শুনিনি। তখন আমার বোন আমাকে তাদের গত রাতের অভিজ্ঞতাটা বলে।

টরিজের পাশের ফ্রিথেলস্টকের নিচের রাস্তা ধরে গাড়ি চালিয়ে আসছিল তারা। হঠাৎ গাড়ির হেডলাইটের আলোয় যেটাকে দেখা গেল সেটা দেখতে কুকুরের মত হলেও এত বিশাল কুকুর কোন মানুষ কখনও দেখেছে কিনা বলতে পারবে না। ওটা তাদের এতটাই কাছে ছিল যে সংঘর্ষ এড়াবার জন্য কড়া ব্রেক কষতে হলো তার স্বামীকে। তারপরও তাদের ধারণা ছিল কুকুরটা আঘাত পেয়েছে। কিন্তু গাড়ি থামার পর কোথাও দেখা গেল না ওটাকে।

আমার ম্যাপটা এনে সামনে মেলে দিতেই ওরা আমাকে দেখাল কোথায় ঘটনাটা ঘটে। ওখান থেকে সরতে হলে জন্তুটাকে হয় এক পাশের খাড়া পাথুরে পাহাড় বাইতে হত, নইলে উঁচু দেয়াল লাফিয়ে টপকে নদীতে পড়তে হত। কিন্তু কোনটাই সম্ভব নয়।

আমার বোন সকালরেলায়ও ওই ঘটনাটার কথা মনে করে কাঁপছিল। কোন কুকুর হতেই পারে না ওটা, এটা তার বিশ্বাস। এদিকে আমার বোনের স্বামী সবসময়ই একজন অতি যুক্তিবাদী মানুষ। তার মতে সব অদ্ভুত ঘটনারই কোন না কোন জাগতিক ব্যাখ্যা থাকতে বাধ্য। কিন্তু সে আমাকে বলল বিশাল ওই জিনিসটার হঠাৎ শূন্য থেকে হাজির হওয়া কিংবা আবার ওটার মিলিয়ে যাওয়ার কোন ব্যাখ্যা অন্তত তার কাছে নেই।

আশি বছর বয়সী মি. ফ্রিম্যান, একসময় যিনি যাজক ছিলেন, আমাকে ১৯২৩ সালে বলেন, ট্রভেরটনে এখনও কালো কুকুরটাকে দেখা যাওয়ার ঘটনা ঘটে।

লাইম রেজিসের সীমানার ঠিক বাইরে, একটা লেনের কিনারে এক সরাইখানা আছে, যেটার নাম ব্ল্যাক ডগ বা কালো কুকুর সরাইখানা। বলা হয় রাতের বেলা একটা বিশাল কুকুর ছুটে এসে ওই সরাইখানার এক কিনারার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। এতে হঠাৎ হঠাৎ ওই অংশের দেয়াল ধসে যেত।

থেলব্রিজের কাছে একটা জায়গা আছে যার নাম ব্ল্যাক ডগ। উনিশশো সালের দিকে ওখানে এমনকী স্থায়ী. একটা ছোট বসতিও ছিল না। কেবল ছিল একই নামের একটা সরাইখানা এবং এক কামারশালা।

ট্রভেরটনের চৌহদ্দিতেও কালো কুকুরের কিংবদন্তি ডালপালা মেলেছে। ওখানে বাস করা ব্ল্যাকমোর নামের উচ্চশিক্ষিত এক ভদ্রলোক বলেছিলেন তিনি এবং তাঁর বাবা দু’জনেই ভয়াল ওই কালো কুকুরকে দেখেছেন। শুধু তা-ই না, এক প্রজন্মের পর আরেক প্রজন্ম ধরে লোকেরা একে দেখে আসছে। কীভাবে এটা সম্ভব তাঁর জানা নেই।

ডেভনে কালো কুকুরটার উপস্থিতির ব্যাপারে মিসেস কেরবেনেলের এই গবেষণার পর আশা করি পাঠকদের পক্ষে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব হবে।

এখানে বর্ণনা করা বেশিরভাগ ঘটনাই আশি-নব্বই বছর কিংবা আরও বেশি আগের। কিন্তু ইংল্যাণ্ডের বিভিন্ন জায়গায় এখনও কালো কুকুর দেখা যাওয়ার ঘটনা শোনা যায়। ভবিষ্যতে সত্য হরর কাহিনী সিরিজের অন্য কোন পর্বে কালো কুকুরের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো নিয়ে লেখার ইচ্ছা রইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *