অভিশপ্ত অরণ্য হইয়া বাচিয়ু

অভিশপ্ত অরণ্য হইয়া বাচিয়ু

রোমানিয়ার ক্লাজ-নেপোকার কাছে ছোট্ট এক বন হইয়া বাচিয়ু। আয়তন মোটে ২৫০ হেক্টর। কিন্তু আকারে ছোট হলে কী হবে নানা ধরনের অতিপ্রাকৃত ও ব্যাখ্যাতীত ঘটনার জন্য এ বনকে চেনে সবাই এক নামে। রোমানিয়ার বারমুডা ট্রায়াঙ্গলও বলেন কেউ কেউ। ভুতুড়ে ছায়ামূর্তি, খালি চোখে দেখা যায়নি এমন সব ছবি ক্যামেরায় আসা, এমনকী ভিনগ্রহের যান বা উড়ন্ত সসার নামার কাহিনীও ডালপালা বিস্তার করেছে এই অরণ্যকে ঘিরে। জঙ্গলটার বয়সও কম নয়, পঞ্চান্ন হাজার বছর। এটা যে অঞ্চলে অবস্থিত সেই ক্লাজ-নেপোকা আবার ঐতিহাসিকভাবে কাউন্ট ড্রাকুলার বাসস্থান হিসাবে পরিচিত ট্রানসিলভানিয়ার অংশ। তাই হইয়া বাচিয়ু পরিচিতি পেয়েছে আরও বেশি।

এই বনে ঘুরে বেড়ানো পর্যটকদের হঠাৎ অস্বস্তি হতে শুরু করে। কেউ আবার বলে, অদৃশ্য কিছু তার দিকে নজর রাখছে। যদিও কাউকে দেখা যায় না। এখানকার গাছপালাগুলোও কেমন অদ্ভুত।

এক মেষপালক দুইশো ভেড়াসহ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পরই জঙ্গলটা অভিশপ্ত হিসাবে কুখ্যাতি অর্জন করে আশপাশের এলাকাগুলোয়। ছেলেটাকে ভেড়ার পাল নিয়ে ভেতরে ঢুকতে দেখে অনেকেই। তবে আর ফিরে আসেনি কখনও। অরণ্যটির কাছাকাছি বাস করা লোকজন এর ভেতরে ঢুকতে ভয় পায়। তাদের ধারণা এই জঙ্গলে একবার যে ঢোকে তার ফিরে আসার গ্যারান্টি নেই। সাহসী কিছু মানুষ অবশ্য ভিতরে ঢোকে কখনও-সখনও। তবে তাদের নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। যেমন শরীরে র‍্যাশ ওঠা, বিষাদভাব, বমি, আঁচড়, দুশ্চিন্তাসহ বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা।

১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে ভুতুড়ে এই জঙ্গল একেবারে অন্য একটি কারণে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে। এসময় আলেকজাণ্ডার সিফট নামের এক জীববিদ জঙ্গলের ওপরে উড়ন্ত সসার সদৃশ কিছু বস্তুর ছবি তোলেন। ১৯৬৮ সালের ১৮ আগস্ট এমিল বার্নিয়া নামের এক সামরিক প্রকৌশলীও জঙ্গলের ওপর দিয়ে ফ্লাইং সসার উড়ে যাওয়ার এক ছবি তুলে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান। ১৯৭০- এর দশকে আরও অনেকেই এখানে উড়ন্ত সসার দেখার দাবি তোলেন। আবার ব্যাখ্যাতীত সব আলো খেলা করতে দেখা যায় অরণ্যের গভীরে।

ম্যারা এই বনে ঢোকে তাদের বেশিরভাগেরই অসুস্থবোধ হতে থাকে, মাথাটা একেবারে হালকা মনে হয়। কখনও কখনও আবার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এলোমেলো আচরণ করতে থাকে। অতিপ্রাকৃত বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের দাবি অশরীরীর উপস্থিতির কারণেই এমনটা ঘটে। তাঁদের দাবি উড়িয়ে দেয়া কঠিন। কারণ এখানে নানান ধরনের অদ্ভুত কাণ্ড-কারখানার প্রমাণ মিলেছে বিভিন্ন সময়। রহস্যময় আলো দেখার কথা বলে জঙ্গলে ঢোকা প্রায় সবাই-ই। হঠাৎ বনের শান্ত পরিবেশ নষ্ট করে দেয় নারী কণ্ঠের শব্দ, খিলখিল হাসি। হঠাৎ হাজির হয় ছায়ামূর্তি, গায়েব হয়ে যায় আবার। আবার বন থেকে বেরিয়ে আসার পর কেউ কেউ শরীরে আবিষ্কার করে ক্ষতের চিহ্ন। যেন নখ দিয়ে আঁচড় কেটেছে কেউ। পোড়া দাগও পাওয়া যায় কোন কোন পর্যটকের দেহে।

অনেকে আবার মনে করে অন্য জগতে যাওয়ার দরজা এই হইয়া বাচিয়ু। ভেতরে ঢুকে অনেক লোকেরই আর ফিরে না আসার গল্প চালু আছে। কারও কারও মতে সংখ্যাটা এক হাজার ছাড়িয়েছে। হঠাৎ বইতে শুরু করে বাতাস। ভেতরে ঢোকার পর সময় এলোমেলো হয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন কোন কোন অভিযাত্রী। কেউ বেশ কিছুটা সময় কী করেছেন বলতে পারেন না। যেমন পাঁচ বছরের এক স্থানীয় মেয়ে গাছপালার মাঝে হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে যায়। পাঁচ বছর পর ফিরে পাওয়া যায় তাকে। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার যে পোশাকটা পরা ছিল পাঁচ বছর আগে সেটাই পরনে, এই সময়টা কোথায় ছিল, কী করেছে এ ব্যাপারে মেয়েটার কোন ধারণাই নেই। অবশ্য কোন কোন গল্পে দাবি করা হয় তার গায়ের রংটা বেশ বদলে গিয়েছিল।

এই বন ঘিরে আরেকটি ঘটনা প্রচলিত আছে। একসময় এখানে বেশ কিছু রোমানীয় চাষী খুন হয়। তাদের অতৃপ্ত আত্মারা নাকি এখনও ঘুরে বেড়ায় জঙ্গলে। নিজেদের দুর্দশার জন্য এরা বেশ খেপে থাকে। পর্যটকদের সামনে হঠাৎ হাজির হয়ে তাদের চমকে দেয় এই অশরীরীরা। কখনও শূন্যে ভাসতে দেখা যায় সবুজ চোখ। ভারী কালো কুয়াশায় ঢেকে যায় চারপাশ। বেশিদিন হয়নি টেলিভিশনের জন্য অতিপ্রাকৃত এক কাহিনী বানানোর জন্য ক্যামেরা নিয়ে জঙ্গলের অপেক্ষাকৃত খোলা জায়গায় বসে ছিলেন এক রিপোর্টার। রাতে তাঁকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় অদৃশ্য কোন শক্তি। গাছপালার মাঝখানে হঠাৎ জ্বলে ওঠে চোখ ধাঁধানো আলো।

জঙ্গলের মাঝখানে একটা খোলা জায়গা আছে যেখানে কোন গাছপালা জন্মে না, সেখানে ভুতুড়ে ঘটনাগুলো ঘটে সবচেয়ে বেশি। মোটামুটি বৃত্তাকার জায়গাটা পরীক্ষা করে দেখা গেছে ওখানকার মাটির মধ্যে উদ্ভিদ জন্মানোর জন্য প্রয়োজনীয় কোন কিছুরই ঘাটতি নেই। বলা হয় এই গোল জায়গাটিই ভূতেদের আস্তানা। একটি সূত্রের দাবি, এখানে ঘুরে বেড়ানো প্রেতাত্মারা জায়গাটিকে আগলে রেখেছে। কারণ এটাই অন্য পৃথিবীতে যাওয়ার গুপ্তস্থান। এদিকে এই অরণ্যে তোলা বিভিন্ন ছবিতে পাওয়া গেছে ভাসতে থাকা আকৃতি, রহস্যময় মানুষের কাঠামো।

সন্দেহ নেই মানুষ এ বনের অনেক কাহিনীকেই রং চড়িয়ে বলে। তবে এখানে যে অস্বাভাবিক কোন শক্তির উপস্থিতি আছে তা অস্বীকার করার জো নেই। গভীর জঙ্গলের ভেতর থেকে ভেসে আসতে দেখা যায় অনেকগুলো গোল আলো। তাপ শনাক্তকারী যন্ত্র ব্যবহার করে এই আলোগুলোয় কোন তাপের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। বনে ঢোকার পর অনেকেরই হারিয়ে যাওয়া পুরানো সব স্মৃতি মনে পড়ে যায়, কিন্তু এই এলাকা ছাড়ার পর আবার হারিয়ে যায় ওই স্মৃতিগুলো।

স্বাভাবিকভাবেই বনটা পৃথিবীর নানা প্রান্তের গবেষকদের আকৃষ্ট করেছে। জার্মানি, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও হাঙ্গেরিসহ অনেক দেশের গবেষকই বহু সময় দিয়েছেন এখানকার রহস্য সমাধানে। কারও কারও তোলা ছবি ওয়াশ করার পর তাতে মিলেছে ভৌতিক মুখ বা কাঠামো। এর কোন কোনটা খালি চোখেও ধরা দিয়েছিল। কোনটা আবার কেবল ছবিতেই দেখা গিয়েছে। বেশিরভাগ অতিপ্রাকৃত বিশেষজ্ঞের ধারণা রোমানিয়ার সবচেয়ে ভৌতিক জায়গা এই মুহুর্তে হইয়া বাচিয়ু। ট্র্যাভেল, অ্যাণ্ড লেইজার ম্যাগাজিন এবং বিবিসির মত বিখ্যাত পত্রিকাও একে পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত ভৌতিক এলাকা ও অরণ্যের তালিকায় রেখেছে। তাই সাহস করে রোমাঞ্চপিয়াসী পর্যটকরাও হানা দিচ্ছে অরণ্যটিতে। কয়েক বছর আগে হলিউড অভিনেতা নিকোলাস কেইজ এক ছবির শুটিং করতে এসেছিলেন রোমানিয়ায়। তখন ক্লাজ-নেপোকায় আসেন রহস্যময় অরণ্যটিকে একবার দেখতে। জঙ্গলটির আরও একটা অদ্ভুত বিষয় অনেকেরই চোখে পড়ে। এখানকার কোন কোন গাছ বাঁকা হয়ে আছে। রহস্যময় কোন অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রভাবেই নাকি এটা হয়।

শুধু যে ভুতুড়ে কাণ্ড-কারখানার জন্য এলাকাটি বিখ্যাত তা কিন্তু নয়। এ অরণ্যের আশপাশের এলাকায় নানা ধরনের উৎসবও হয়। ক্লাজ-নেপোকা এমনিতেও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য পর্যটক টানে। এখন অনেক পর্যটকই ভুতুড়ে বনের রাস্তা ধরে সাইকেল চালান, এঁদের কারও কারও টুকটাক সমস্যা হওয়ার খবর পাওয়া গেলেও বেশিরভাগই কিন্তু ফিরে এসেছেন বহাল তবিয়তে। কাজেই একবার চেষ্টা করেই দেখতে পারেন অরণ্যটার রহস্য সমাধানে। উপরি হিসাবে পেতে পারেন ভালুক, হরিণসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর দেখা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *