আইরিশ কনের ভূত

আইরিশ কনের ভূত

ছেলেটা যদি চিৎকার করে না উঠত, তবে বেবিসিটার মেে ভেবে বসত সে স্বপ্ন দেখছে।

পুরনো কিনসেল দুর্গ এবং এর ভূতের গল্পটা মেয়েটার জানা। এখানে বদলি হয়ে নতুন আসা অফিসার এবং তাঁর পরিবারের বাচ্চাদের দেখাশোনার দায়িত্ব নিতে রাজি হওয়ায় এমনকী বন্ধুরা তাকে গালমন্দও করেছিল। কিন্তু সাগরতীরের আইরিশ এই বন্দরশহরে একটা তরুণী মেয়ের জন্য পছন্দসই চাকরি জোগাড় করা মোটেই সহজ ছিল না। তাছাড়া এসব ভূত-প্রেতের কিচ্ছায় তার বিশ্বাস নেই। তারপরই শ্বেতবসনা ওই নারীকে সে নিজেই দেখে বসল।

কয়েক ঘণ্টা আগেই বাচ্চাদুটো ঘুমিয়ে পড়েছে। তবে তরুণী জেগে ছিল। ছোট্ট ছেলে আর মেয়েটার সঙ্গে একই কামরায় ঘুমাতে একটুও খারাপ লাগে না তার। এটা তার চাকরির অংশ। সে বাচ্চাদের পছন্দ করে এ ব্যাপারেও সন্দেহ নেই। ঘুমন্ত অবস্থায় তাদের নিয়মিত কোমল শ্বাস- প্রশ্বাসের শব্দ তাকে আনন্দ দেয়। ছোট্ট বিছানাদুটোর দিকে তাকিয়ে হাসল মেয়েটা। এসময়ই কামরাটার অপর পাশে একটা কিছুর দিকে দৃষ্টি গেল তার।

তরুণী এক নারীর দেহ এগুচ্ছে বাচ্চাদুটোর দিকে। গোটা পোশাকটা সাদা। দেখে পুরানো দিনের বিয়ের পোশাকের কথা মনে পড়ে। কাপড়ের সাদা ফুলের মত সাদা তার মুখ ও হাত। কামরাটার ওই পাশে কোন দরজা কিংবা জানালা নেই। তাহলে সে এল কোন্ দিক থেকে? আবার মেঝের ওপর দিয়ে আসছে যে কোন শব্দই হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ভেসে ভেসে এগুচ্ছে।

মেয়েটা এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছে যে, নড়তে পর্যন্ত পারছে না। দু’জনের মধ্যে ছোট যে বাচ্চাটা, ভেসে ভেসে তার কাছে গিয়ে থেমে গেল শ্বেতবসনা নারী। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে শুধু চেয়েই আছে ন্যানি মেয়েটা। ছোট্ট ছেলেটির হাতজোড়া বুকের ওপর ভাঁজ করা। দীর্ঘক্ষণ ঘুমন্ত শিশুটির দিকে তাকিয়ে থাকল নারীমূর্তিটি। তারপর ফ্যাকাসে একটা হাত আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে ছেলেটার কবজি স্পর্শ করল।

‘তোমার ঠাণ্ডা হাতটা সরাও।’ চেঁচিয়ে উঠল ছেলেটা। তবে সে পুরোপুরি জেগে ওঠার আগেই বাতাসে মিলিয়ে গেল শ্বেতবসনা নারী।

‘এটা সত্যি, স্যর, আমি নিজ চোখে দেখেছি! এখন যেমন তখনও তেমনি পূর্ণ সজাগ ছিলাম। আমার মনে হয় না ছেলেটাকে আঘাত করার কোন ইচ্ছা তার ছিল। তবে ও মহিলার স্পর্শ টের পায়। বড্ড শীতল ছিল ওটা। তাই ঘুমের মধ্যেই চেঁচিয়ে ওঠে।’

তরুণ কর্মকর্তাটি মাথা নাড়লেন। হয়তো, কিনসেল দুর্গের শ্বেতবসনা নারীর কাহিনী সত্যি! তাঁর আগে এখানে বদলি হয়ে আসা অনেক অফিসারই ওই নারী কিংবা তার প্রেতাত্মাকে দেখার দাবি করেছেন। সবার বর্ণনাও ছিল একই রকম। ফ্যাকাসে চেহারার এক নারী, পুরানো ধরনের কনের পোশাক তার পরনে। এখানকার পুরানো লোকেরা বলে, সে হচ্ছে দুর্গের প্রথমদিককার এক গভর্নর কর্নেল ওয়ারেনডারের মেয়ের প্রেতাত্মা। তরুণ অফিসারটিও তার গল্পটা জানেন। দুঃখজনক ও মর্মান্তিক এক কাহিনী সেটা।

১৬৬৭ সালে দুর্গটি নির্মাণের অল্প পরেই এর গভর্নরের দায়িত্ব পান কর্নেল ওয়ারেনডার। আইন-কানুন এবং নিজের কর্মচারী-সৈনিকদের বিষয়ে কঠোর ছিলেন খুব। তবে একই সঙ্গে মেয়ে উইলফুলকে খুব ভালবাসতেন। স্যর ট্রেভর অমহার্সট নামের অভিজাত এক তরুণকে ভালবাসত উইলফুল। দু’জনেই একে অপরকে বিয়ে করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল। কর্নেলও উপযুক্ত এক তরুণকে বেছে নেয়ায় মেয়ের প্রতি খুব সন্তুষ্ট ছিলেন।

গ্রীষ্মের এক বিকালে জমকালোভাবে, অনুষ্ঠিত হলো তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান। একে অপরের প্রতি গভীর ভালবাসা নিয়ে দুই তরুণ-তরুণী হাঁটতে থাকে দুর্গের পথ ধরে। এসময়ই উইলফুলের নজর যায় ফুলগুলোর দিকে

‘এই, দেখো!’ বিস্মিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল সে, দুর্গের পাথুরে দেয়ালের ওপাশ থেকে অনেক নিচে পাথরের পাশে ফুটে থাকা ফুলগুলোর দিকে আঙুল তুলল। ‘ওগুলো কী সুন্দর!’ স্যর ট্রেভরের হাতে চাপ দিল। ‘ওহ, আমি যদি ওগুলো দিয়ে বানানো একটা তোড়া পেতাম।’

দুর্গের এই প্রান্তে কর্নেল ওয়ারেনডারের রেজিমেন্টের এক তরুণ সিপাহী টহল দিচ্ছিল। উইলফুল যখন কথাগুলো বলছিল তখন পাশ দিয়ে যাচ্ছিল সে।

‘মাফ করবে, ম্যাম।’ বলল সিপাহী, ‘জায়গা ছেড়ে যাওয়ার নিয়ম নেই আমার। তবে ফুলগুলো যদি খুব ভাল লেগে থাকে, তবে নিচে নেমে ওগুলো তোমার জন্য আনতে পারি।’

‘ওহ! অবশ্যই!’ খুশিতে ডগমগ হয়ে বলল উইলফুল, ‘ধন্যবাদ! অনেক ধন্যবাদ!’

ওপর থেকে নিচের পাথরগুলো দেখল সৈনিক। তারপর নববিবাহিত দম্পতির কাছে এসে বলল, ‘তোমার স্বামীকে একটু সময়ের জন্য আমার জায়গায় পাহারায় থাকতে হবে, আমি কিছু রশি জোগাড় করে আনছি।’ পাথরের দেয়ালের গায়ে রাইফেলটা ঠেস দিয়ে রাখল সৈনিক। তারপর ইউনিফর্মের ওপর চাপানো জ্যাকেটটা খুলে ফেলল। ‘আমার মোটেই সময় লাগবে না, স্যর। কোন ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। তবে পোস্ট ছেড়ে গেছি কেউ জানুক, এটা চাইছি না।’

‘ওহ, অবশ্যই।’ বললেন স্যর ট্রেভর। তারপর নিজের কোটটা খুলে গায়ে চাপালেন সৈনিকের জ্যাকেট। রাইফেলটা তুলে নিলেন হাতে। ওদিকে সৈনিকটি দ্রুতপায়ে হাঁটতে শুরু করেছে।

অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে শক্ত এক গোছা দড়ি নিয়ে হাজির তরুণ। তারপর ওই দড়ি বেয়ে সাবধানে পাথুরে দেয়ালের পাশ দিয়ে ফুলগুলোর দিকে নামতে লাগল। এদিকে স্যর ট্রেভর সৈনিকের জ্যাকেট পরে টহল দিতে লাগলেন। যখনই উইলফুলের পাশ দিয়ে যাচ্ছেন স্বামীর দিকে তাকিয়ে ফিক ফিক করে হাসছে মেয়েটা।

এই সময় সাগরে ডুব দিল সূর্যটা। সন্ধ্যাটা ক্রমেই শীতল হয়ে উঠছে। রাইফেল নিয়ে টহল দেয়ার ফাঁকে স্যর ট্রেভরের মনে হলো, রাতের বাতাসে উইলফুলের নিশ্চয়ই অনেক ঠাণ্ডা লাগছে। সৈনিকটি ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার জন্য চমৎকার একটা ফুলের তোড়া নিয়ে আসার প্রতিজ্ঞা করে উইলফুলকে দুর্গে তাঁদের কামরায় যেতে রাজি করালেন।

স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু দিয়ে বিদায় জানিয়ে উঁকি দিলেন দেয়ালের ওপাশে। সৈনিকটির এত দেরি হচ্ছে কেন বুঝতে পারছেন না। তবে এখান থেকে এই অন্ধকারে নিচের জায়গাটা দেখতে পাচ্ছেন না। ডাক দিলেও সাগরের ঢেউয়ের শব্দের কারণে সৈনিকটি শুনতে পাবে না।

স্যর ট্রেভরের অনেক পরিশ্রম গিয়েছে আজ। অপেক্ষা করার ফাঁকে একটু বসে জিরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। শীতল পাথুরে দেয়ালে হেলান দিয়ে সাগরের শব্দ শুনতে শুনতে বিয়ের দিনটি এবং সুন্দরী প্রিয়তমা স্ত্রীর কথা হয়তো ভাবছিলেন। একপর্যায়ে ক্লান্তিতে দু’চোখ বুজে এল তাঁর।

স্যর ট্রেভর ঘুমিয়ে যাবার পর বেশি সময় কাটেনি। এসময় কর্নেল ওয়ারেনডার রাতের টহলে বের হয়েছেন, দুর্গের সৈনিকরা ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে কিনা দেখতে। আধো আলো-ছায়ায় নিজের জামাতাকে চিনতে পারলেন না কর্নেল। যখন দেখলেন ইউনিফর্ম পরা কাঠামোটা রাইফেল কোলের ওপর রেখে দেয়ালে ঠেস দিয়ে ঘুমুচ্ছে প্রচণ্ড রেগে গেলেন।

‘সৈনিক, এই তোমার টহল দেয়ার নমুনা?’ জানতে চাইলেন কর্নেল।

ঘুমে তলিয়ে থাকা স্যর ট্রেভর নড়লেন না পর্যন্ত।

‘আমার প্রশ্নের জবাব দাও।’ চিৎকার করে বললেন কর্নেল। রাগটা ক্রমেই বাড়ছে তাঁর। এবারও স্যর ট্রেভর নড়লেন না।

কর্নেল নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি হারিয়েছেন ততক্ষণে। হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করে ফেললেন মুহূর্তের মধ্যে। ‘আমার কমাণ্ডে কোন প্রহরী ডিউটির সময় ঘুমায় না।’ রাগে চেঁচিয়ে উঠেই সিপাহীর জ্যাকেটের উজ্জ্বল বোতাম সই করে ট্রিগার টিপে দিলেন। স্যর ট্রেভরের হৃৎপিণ্ড ভেদ করল তাঁর বুলেট।

কর্নেল ওয়ারেনডার যখন দেহটা পরীক্ষা করতে গেলেন তখনই ভয়াবহ ভুলটা বুঝতে পারলেন। আতঙ্কিত কর্নেল তক্ষুণি দুর্গের চিকিৎসককে আনতে লোক পাঠালেন। তবে ইতোমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। স্যর ট্রেভর সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছেন।

তার বাবা প্রিয়তম স্বামীকে মেরে ফেলেছে এটা সহ্য করা উইলফুলের জন্য ছিল অসম্ভব। যখন এটা শুনল উন্মাদ হয়ে গেল। বিয়ের পোশাকে দৌড়ে গেল সে জায়গাটায় যেখানে স্বামী বিদায় জানিয়ে তাকে শেষবারের মত চুমু খায়। পাথরের হাঁটাপথে স্বামীর রক্ত দেখে যন্ত্রণায় কেঁদে উঠল হতভাগা মেয়েটা। তারপর কেউ বাধা দেয়ার আগেই লাফ দিল দেয়ালের ওপাশে। নিচের পাথুরে দেয়ালে আছড়ে পড়ে মৃত্যু হয় তার সঙ্গে সঙ্গে।

ওই রাতেই পাপবোধ, মানসিক যন্ত্রণা ও মেয়ের পরিণতিতে স্তব্ধ কর্নেল কোয়ার্টারে নিজের কামরায় দরজা আটকে দেন। যে পিস্তল ব্যবহার করে বোকার মত বিয়ের রাতে মেয়েকে বিধবা বানান সে পিস্তলের গুলিতে আত্মাহুতি দেন নিজেও।

গত কয়েক শতকে তরুণী এই কনের প্রেতাত্মাকে দেখা গিয়েছে বহুবার। যে কামরাটা তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল সেখানে এবং যে পথে শেষ সময়টা কাটিয়েছে প্রিয়তমের সঙ্গে সেখানেই ফিরে ফিরে আসতে দেখা যায় উইলফুলের প্রেতাত্মাকে। কখনও কখনও খুব রাগী দেখায় তার চেহারা। তবে বেশিরভাগ সময় দুঃখী, হতাশাগ্রস্ত এক নারীর প্রতিমূর্তি হয়েই হাজির হয়।

ওই রাতে ছোট্ট ছেলেটার কবজি স্পর্শ করার কারণ সম্ভবত বাবার বোকামি আর হিংস্রতার কারণে যে পরিবারের স্বাদ সে পায়নি তার আকাঙ্ক্ষা। আদর্শ এক স্ত্রী এবং মা হবার স্বপ্ন বুকে নিয়েই মারা যায় দুর্ভাগা মেয়েটা। তার বদলে সে কিনা হলো কিনসেল ফোর্টের শ্বেতবসনা প্রেতিনী।

কিনসেল দুর্গের শ্বেতবসনা প্রেতাত্মার গল্প আসলে এক কিংবদন্তী। উইলফুল ওয়ারেনডারের ভূতই যে সে এ ব্যাপারে নিশ্চিত কোন তথ্য-প্রমাণ নেই। তবে বিগত বছরগুলোতে যারাই তাকে দেখেছে একই বর্ণনা দিয়েছে, সাদা বিয়ের পোশাকের এক তরুণী। অনেক উচ্চপদস্থ সামরিক কর্তাসহ অজস্র মানুষ এই ভূত দেখেছে। নিয়মিত হাজির হওয়া প্রেতাত্মার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই প্রেতিনী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *