নার্স ব্ল্যাক

নার্স ব্ল্যাক

১৮৫০-এর দশকে চার্লস কিন এবং তাঁর স্ত্রী অ্যালেন ইংল্যাণ্ডের মঞ্চে ছিলেন অতি পরিচিত মুখ। অভিনেতা- অভিনেত্রী ও ম্যানেজার দুই ভূমিকাতেই তাঁরা ছিলেন সফল। নানা ধরনের বিচিত্র বিষয়ের প্রতিও ঝোঁক ছিল এই দম্পতির। কাজেই তাঁদের এক নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে যখন ভৌতিক ঘটনা ঘটল বিস্তারিত বর্ণনাসহ তা লিপিবদ্ধ করেন কিন। আর তাঁর মাধ্যমে এর কাহিনীটা আসায় এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ কম।

মিসেস কিনের বোন অ্যান ট্রির সঙ্গে বিয়ে হয় জন ক্যাম্বল চ্যাপম্যানের। একসময়ের এই থিয়েটার ম্যানেজার তখন বিখ্যাত এক প্রকাশক। তাঁদের পরিবারটি ছিল বিশাল। মোটমাট এগারোটি সন্তান ছিল ওই দম্পতির। ছোট বাচ্চাগুলোর জন্য লণ্ডনের আবহাওয়া একটু অস্বাস্থ্যকর মনে হওয়ায় তাঁরা একটু মফস্বল এলাকায় সরে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

হার্টফোর্ডশায়ারের চেসহান্টে একটা বাড়ি পছন্দ হয় তাঁদের। ওটার মালিক স্যর হেনরি মিউক্স। এই বিশাল পরিবারের সদস্যদের দেখভালের জন্য ছিল জনা আটেক চাকর-কর্মচারী। তবে বাড়িটা এত বড় যে সবারই জায়গা হয়ে গেল হেসে-খেলে। বড় মাঠ, লন এমনকী কিছু উঁচু গাছও আছে। চাই কী এগুলো বেয়ে উঠে দুরন্তপনার পরীক্ষাও দিতে পারে তারা। মিসেস চ্যাপম্যান গোটা বাড়িটা ঘুরে-ফিরে দেখে স্বাভাবিকভাবেই খুব খুশি।

প্রায় দুইশো বছরের পুরানো বাড়িটা সতেরো শতকের শেষভাগের কোন একসময় বানানো হয়েছে। প্রাচীন ওক গাছের খাম্বা খাড়া করে রেখেছে দালানটাকে। ফায়ারপ্লেসগুলো বড় আর নকশা করা। মাঝখানে একটা চওড়া সিঁড়ির পাশাপাশি দুই পাশে ভৃত্যদের ব্যবহারের জন্য সরু দুটো সর্পিলাকার সিঁড়িও আছে। ছোট শিশুদের খেলার জন্য আছে একটি আলাদা ঘর বা নার্সারি। এর পাশাপাশি চিলেকোঠায় কয়েকটা ঘর আবিষ্কার করে বাচ্চারা এবং এতে তাদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা ভৃত্যরা দারুণ খুশি হয়ে উঠল।

সাপ্তাহিক ছুটির দিনে মুক্ত বাতাসের লোভে জন চ্যাপম্যানের অনেক বন্ধু-বান্ধবই এখানে হাজির হয়ে যান। এই দম্পতি সবসময়ই দিল-দরিয়া ও অতিথিবৎসল। লণ্ডনের বন্ধুদের তা অজানাও নয়। এদিকে জন চ্যাপম্যানও সপ্তাহে দু-একটা দিন ব্যবসার প্রয়োজনে লণ্ডনে কাটিয়ে দেন। কখনও স্ত্রীকেও সঙ্গে নিয়ে যান। এখানকার বাড়িতে দু- একটা কামরা সবসময়ই অতিথিদের জন্য তৈরি রাখা হয়। হঠাৎ জানান না দিয়ে হাজির হয়ে গেলেও বিন্দুমাত্র বিরক্ত হন না অ্যান চ্যাপম্যান। এক কথায় চমৎকার, আধুনিকা এক নারী তিনি। জন মাঝে মাঝেই ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানান এমন একজন আদর্শ স্ত্রী পাবার জন্য।

অ্যান কোন হাউসকিপার রাখেননি। নিজেই বাড়ির বিষয় তদারক করেন। কোন অতিথি আসার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়ার ব্যবস্থা করেন। শুধু তাই না, অতিথিরা যে কামরাগুলোতে থাকবেন নিজে একবার সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে আসেন। এদের মধ্যে সেরাটা বরাদ্দ থাকে গুরুত্বপূর্ণ বা তাঁদের খুব কাছের মানুষদের জন্য। ওই কামরাটা পরিচিত ওক বেডরুম নামে। ভারী ওকের প্যানেল, বিশাল খাট এবং পর্দায় ওক পাতার ছবির কারণেই এমন নামকরণ। কামরাটা একটু অন্ধকার হলেও সবার বেশ পছন্দ হয় এর আভিজাত্যের জন্য। অ্যান এই কামরাটা সবসময় যেন রেডি থাকে এ বিষয়ে চোখ-কান একটু বেশিই খোলা রাখেন।

শরতের এক সন্ধ্যা। ধীরে ধীরে অন্ধকাররা আলোদের হটিয়ে জায়গা দখল করে নিচ্ছে। কয়েকটা বালিশ নিয়ে ওক বেডরুমের সামনে হাজির হলেন অ্যান। এক লেখক বন্ধুকে বাড়িতে নিয়ে এসেছেন জন। ফ্লিট স্ট্রিটের অফিসের গোলমালের চেয়ে তাঁর লেখার বিষয়ে বাড়ির শান্ত পরিবেশে আলাপ করাটাই ভাল মনে হয়েছে। বালিশগুলোর তদারকিতে যে মেয়েটা সে একেবারেই নতুন এসেছে। তাই নিজেই বিষয়টা দেখভাল করছেন অ্যান।

ওক বেডরুমের তালাটা পুরানো। ওটা খুলতে একটু ঝক্কি পোহাতে হয়। হাতে বালিশ থাকায় আরও বেশি বেগ পেতে হলো অ্যানকে। যখন কামরায় ঢুকলেন বোঝাটা নামিয়ে রেখে একটা মোমবাতির খোঁজ করলেন আলো জ্বালতে। এই কামরাটায় বিছানাটা ঠিকঠাক করার জন্য এটা দরকার।

মোমবাতির খোঁজে যখন হাত বাড়ালেন তখনই একটা জিনিস আবিষ্কার করে থমকে গেলেন। কামরাটায় তিনি একা নন। দূরের জানালাটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক নারী। এক পলকেই অ্যান বুঝে গেলেন সে হালকা-পাতলা দেহের এক তরুণী। লম্বা চুল নেমে গেছে অনেকটা পর্যন্ত। পশমী পেটিকোটের ওপর সাদা একটা শাল চাপিয়েছে। জানালা গলে আসা আবছা আলোতেঁ সিল্কের কাপড়টা ঝিকমিক করে উঠতে দেখলেন অ্যান। ব্যগ্রভাবে সামনের দিকে ঝুঁকে আছে মেয়েটা, জানালা দিয়ে যেন নিচের বাগানে কিছু একটা দেখছে।

খুব একটা চিন্তা না করেও অ্যানের মনে পড়ে গেল, ভৃত্যরা সবাই চা খাচ্ছে, আর ছেলে-মেয়েরা নার্সারিতে। এটা তাদের কেউ নয়। একটা সম্ভাবনাই বাকি আছে, তা হলো অচেনা কেউ কোনভাবে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু অ্যান বুঝতে পারলেন সিঁড়ি পেরিয়ে এখানে আসা তার পক্ষে অসম্ভব, কেউ না কেউ দেখতই। হঠাৎই অ্যানের মনে হলো স্বাভাবিক কোন কিছু দেখছেন না তিনি। ভয়ে কেঁপে উঠল শরীরটা। কী মনে করে চোখের সামনে একটা হাত নিয়ে এলেন। যখন ওটা সরালেন মেয়েটা অদৃশ্য হয়েছে।

রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে তাঁর আতঙ্কে। তবে ভয়ে নিজের কাজ থেকে বিরত থাকবেন এমন মহিলা তিনি নন। কাঁপতে থাকা হাতে বিছানাটা গোছগাছ করলেন।

ঘটনাটা কাউকে বললেন না, এমনকী স্বামীকেও। পরদিন সকালে যখন অতিথি নাস্তা করতে খাবার রুমে এলেন, আশঙ্কা নিয়ে তাঁর দিকে তাকালেন অ্যান। তিনি কী বলেন এটা ভেবে। নাকি এখনই একটা ঘোড়ার গাড়ি ডেকে তাঁকে লণ্ডন পৌঁছে দিতে বলেন আবার। কিন্তু তাঁকে বেশ হাসি- খুশিই দেখাল। বরং গৃহকর্ত্রীকে আরামদায়ক শয্যা এবং কামরার জন্য ধন্যবাদ দিলেন। অ্যান মনে মনেই বললেন, তবে কি ভুল দেখেছেন? আলোর খেলা ছিল ওটা? কই, অতিথির তো কোন সমস্যাই হয়নি রাতে!

কয়েকদিনের মধ্যেই আরও বড় চমকটা হাজির হলো অ্যানের জন্য। ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে নার্সারিতে সময় কাটানো মেয়েটা, কিটি ব্রকেট যার নাম, হাজির হলো কাঁদতে কাঁদতে। আতঙ্কে কাঁপছে সে। এতটাই ভয় পেয়েছে যে প্রথমে কী বলছে বোঝাই গেল না। তবে একটু ধৈর্য ধরে প্রশ্ন করে অ্যান বুঝতে পারলেন সমস্যাটা কোথায়। নার্সারির ময়লাগুলো বাড়ির পেছনের ভাগাড়ে ফেলতে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল সে। এসময়ই বাইরের উঠনের দিকের ছোট্ট জানালাটায় একটা মুখ দেখতে পায়। চেহারাটা কেন তাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে এটা বোঝানো বেশ কষ্টকর হলো কিটির জন্য। তবে তার এলোমেলো কথা থেকে অ্যান বুঝতে পারলেন বুড়ি এক মহিলার মুখ ওটা। ভয়ানক কুৎসিত। চুল ঢাকা ছিল পুরানো আমলের ক্যাপ দিয়ে। সবচেয়ে বড় কথা তার দৃষ্টিটা ছিল অশুভ।

মেয়েটার ভয় বাড়িয়ে দেয়ার কোন ইচ্ছাই অ্যানের নেই। তাই বললেন ওটা নিশ্চয়ই এক বুড়ি জিপসি। কাউন্টির এই অংশে এরা অনেকই আছে। কিটি তখন জিজ্ঞেস করল, তাহলে ওই মহিলা উঠনে ঢুকল কেমন করে? একমাত্র রান্নাঘর ছাড়া আর কোন পথ নেই ওখানে ঢোকার। রাঁধুনি নিশ্চয়ই একজন জিপসি বুড়িকে তার পাশ দিয়ে চলে যেতে দেবে না? অ্যানকে স্বীকার করতে হলো বিষয়টা রহস্যময়। মেয়েটার ভয় দূর করতে দু’জন মিলে ছোট্ট জানালাটা দিয়ে তাকালেন উঠনের দিকে। জায়গাটা খালি। রাঁধুনির সঙ্গে কথা বলতে জানাল তার কাছে জিপসি মহিলা তো নয়ই, কেউই আসেনি আজ সকালে। অ্যান মেয়েটাকে বললেন, মনে হয় আলোর কারসাজিতে ধোঁকা খেয়েছে সে।

দুই রাত পর নতুন একটা ঘটনা হাজির হলো অ্যানের সামনে। বাড়ির একজন মেইড রাতে চড়া একটা শব্দ শুনতে পায়। যেন উঠনে লোহার ডাণ্ডা দিয়ে কিছু একটা পিটাচ্ছে কেউ। তার খাস কামরার পাশেই জায়গাটি। এদিকে আগের ওই তরুণী মেয়েটা, মানে কিটি নিশ্চিত করল গত রাতে সে-ও ওই একই ধরনের শব্দ শুনেছে। রান্নাঘরে দুধ গরম করতে গিয়েছিল তখন।

পরের কাহিনীটার উদ্ভব হলো নার্সারি থেকে। ছোট্ট মারিয়া, বেশ সাহসী সে, অতিরিক্ত কল্পনাপ্রবণও নয়, বলল ঘুম থেকে জেগে দেখে নার্সারির দরজার কিনারা দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে বিশ্রী, কদাকার চেহারার এক বুড়ি। মা তাকে বুঝিয়ে বললেন, এটা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু অ্যান ঠিকই বুঝতে পারলেন মেয়ে সত্যিই অশুভ বুড়িকে দেখেছে!

পুরো হপ্তাটাই জন চ্যাপম্যান লণ্ডনে কাটিয়েছেন। শুক্রবার রাতে বাড়িতে ফিরবেন ভেবে বেশ শান্তি লাগছে অ্যানের। ছেলে-মেয়ে ও কর্মচারীদের সামনে হাসি-খুশি থাকার অভিনয় চালিয়ে যেতে যেতে রীতিমত অধৈর্য হয়ে পড়ছিলেন। এই গ্রাম এলাকার কুসংস্কারাচ্ছন্ন মেয়েগুলো একবার গোটা বিষয়টার সঙ্গে ভূত-প্রেতের সম্পর্ক আছে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হলেই হয়েছে! অ্যান ভয় পাচ্ছেন এই মেয়েদের কে আবার তাঁর সামনে হাজির হয়ে চাকরি ছাড়ার নোটিশ দেয়! তাছাড়া তাঁর নিজের জন্যও এই ঘটনাগুলোর বাস্তবসম্মত একটা ব্যাখ্যা জানা প্রয়োজন। একপর্যায়ে রহস্যটা সমাধান করার শেষ চেষ্টা হিসাবে বাড়ির সব ভৃত্যকে ডেকে বললেন তাঁদের বাড়ির আশপাশে জিপসিদের আসার খবর মিলেছে। চুরি-ডাকাতি করার জন্য কেউ আবার ভেতরে লুকিয়ে আছে কিনা দেখার জন্য তল্লাশি চালাতে হবে। মেয়েরা যথেষ্ট আগ্রহ নিয়েই কাজ করল। প্রতিটি আলমারি, প্যানেল, পাতালঘর, চিলেকোঠা থেকে শুরু করে বাড়ির এমনকী বাইরের ঘরগুলোর আনাচে-কানাচে খোঁজা হলো। কিন্তু কোন জিপসির নাম-গন্ধও পাওয়া গেল না। অবশ্য তিনি যে তাতে খুব একটা বিস্মিত হলেন তা না।

জন চ্যাপম্যান আসার সময় সমাগত হতেই অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন অ্যান। কিন্তু যখন এলেন, দেখা গেল একা আসেননি। সঙ্গে প্রকাশনা সংস্থার সদস্য মি. হলকে নিয়ে এসেছেন। অ্যান তাঁকে হাসিমুখে স্বাগত জানালেন। যখন দেখলেন ভদ্রলোক স্বামীর সঙ্গে গল্প করছেন, সিঁড়ি ধরে ওক রুমের দিকে রওয়ানা হলেন ওটাকে রাতে অতিথি থাকার জন্য প্রস্তুত করতে।

স্বামী ঘরে ফেরাতে বেশ নির্ভার লাগছে তাঁর। আপাতত এমনকী ভুতুড়ে কাণ্ড-কীর্তির কথাও বিস্মৃত হয়েছেন। এসময়ই হঠাৎ চওড়া সিঁড়িতে তাঁর পেছনে পদশব্দ শুনলেন। ঘাড় ফেরালেন কে দেখবার জন্য।

কেউ নেই। সিঁড়িটা একেবারে খালি, নিচে ছায়াময় হলওয়েতেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

আতঙ্কিত হয়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে আবার নিচে নেমে, ছেলে-মেয়েদের নার্সারিতে হাজির হলেন। তাদের হৈ চৈ আর কোলাহলে একটু একটু করে স্বাভাবিক হলেন। রাতের খাবারের আগ পর্যন্ত ওখানেই কাটালেন। ডিনারটা সবাই চমৎকারভাবেই সারলেন। পুরুষরা স্টাডিতে সিগার টানতে টানতে আলাপ করতে লাগলেন, অ্যান বসলেন সুঁই-সুতো নিয়ে। কয়েক মুহূর্ত পর দরজায় একটা নক হলো। বৈঠকখানার দায়িত্বে আছে মধ্যবয়স্ক মহিলাটি। মিসেস টেওয়িন নামেই সে পরিচিত। এমনিতে শান্ত স্বভাবের ও ধীর-স্থির হলেও কামরায় ঢুকল যখন তাকে খুব বিপর্যস্ত দেখাল। চেহারাটা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে, কাঁপছে থরথর করে। অদৃশ্য কারও পায়ের আওয়াজ শুনেছে সে, জানতে পারলেন অ্যান। সিঁড়ি বেয়ে ওক রুমে যাওয়া পর্যন্ত পায়ের আওয়াজটা তাকে অনুসরণ করেছে, সে যখন ঢুকেছে তখনও শব্দটা ভেতরে ঢুকেছে। যখন ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড়িয়েছে মিসেস টেওয়িন, তখন শব্দটাও থেমে যায়। কয়েক রাত আগে এই মহিলা দরজায় নক করার আওয়াজ শুনেছে। এবারের ঘটনায় এতটাই ভয় পেয়ে গেছে যে চাকরি ছাড়তে চাইছে।

অ্যান তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে শান্ত করে বললেন, সকালে বিষয়টা নিয়ে ভাবা যাবে। যা হোক, একটু পানি মিশানো ব্র্যাণ্ডি খেয়ে ঘুমাতে গেল মহিলা।

ওই রাতে স্বামীকে সব কিছু খুলে বললেন অ্যান। অনেক স্বামীই হয়তো বৃত্তান্ত শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তেন। স্ত্রীকে একটু কম কল্পনাপ্রবণ হওয়ার পরামর্শ দিতেন। কিন্তু থিয়েটারের সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িত থাকায় এ ধরনের অতিপ্রাকৃত বিষয়ের প্রতি বেশ আগ্রহ জন্মেছে জনের। শুধু তাই না এমনটা যে ঘটতে পারে এটা মনেও করেন। অ্যানকে ‘জড়িয়ে ধরে বললেন, আগামী হপ্তাটা এখানে থেকেই কাজ করবেন তিনি। আর নিজেই রহস্যটা সমাধানের চেষ্টা করবেন।

তাঁকে হতাশ হতে হলো না। পরের কয়েকদিন এই অদৃশ্য পদশব্দ শোনা গেল। কয়েকটা ভৃত্য এবং বড় দুই মেয়ে শব্দটা শুনল। শুধু যে ওক বেডরুম এবং সিঁড়িতেই আওয়াজ শুনেছে তা নয়, বাড়ির আরও নানা প্রান্তেই পায়ের আওয়াজ শোনা গিয়েছে। এক রাতের ঘটনা। বিছানায় শুয়ে আছেন অ্যান। হঠাৎ দরজার দিকে পদশব্দ শুনতে পেলেন। এক ছুটে গিয়ে দরজা খুললেন। কিন্তু ল্যাণ্ডিং একেবারে খাঁ খাঁ করছে। পরের রাতে জন দেখলেন ‘বালিশের নিচে কিছু একটা লুকাচ্ছেন অ্যান। ঘটনাটা কী জানতে চাইলে কিছু বললেন না তাঁর স্ত্রী। নিজে খোঁজ করতেই আবিষ্কার করলেন একটা রিভলভার। এবার মুখ খুললেন অ্যান। অশরীরীটার মোকাবেলা করতে ওটা রেখেছেন। জন বললেন এতে কোন লাভ তো হবেই না, উল্টো বাড়ির লোকজন আহত হতে পারে। বুঝতে পেরে বালিশের নিচ থেকে রিভলভার সরালেন অ্যান, তবে নাগালের মধ্যেই রাখলেন অস্ত্রটা।

এমনকী এখন ভৃত্যদের সামনেও আর অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে না এমন ভান করেন না অ্যান। ভয়ানক একটা কিছু বাড়ির মধ্যে ঘোরাফেরা করছে বুঝতে পেরে চাকর-বাকররা বাড়ির ভেতরেই দল বেঁধে চলাফেরা করে। বিশেষ করে বড় দুই মেয়ে পেটি এবং মারিয়ার মধ্যেও ভয়টা ছড়িয়ে পড়েছে। রাতে নার্সারিতে আবারও ভয়ানক মুখটা দেখা যাবার পর ছোট ছেলে-মেয়েগুলোও কেমন একটা অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। এক রাতের ঘটনা। ভৃত্যরা ডিনারে বসেছে। হঠাৎ কামরার দরজাটার খিলে টান পড়ল। তারপরই আস্তে আস্তে খুলে গেল দরজাটা। কাউকে দেখা গেল না। আবার বন্ধ হয়ে গেল। সবাই ভয়ে পেয়ে গেল। একটা মেয়ে জ্ঞান হারাল। কিটি চিৎকার শুরু করে দিল উন্মত্তের মত।

জন চ্যাপম্যান সব কিছু শুনে পরের দিন চাকরদের ডিনারের সময় ওই কামরাটায় রইলেন, যদি আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। সত্যিই তা-ই ঘটল। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গিয়েও এই রহস্যময় দরজা খোলা ও বন্ধ হওয়ার পেছনে কার ভূমিকা তা উদ্‌ঘাটন করতে পারলেন না। তবে কাজটা যে রক্ত-মাংসের কারও নয় তা বুঝতে অসুবিধা হলো না।

পরদিন বিকালে জরুরি কাজে লণ্ডনে যেতেই হলো জনকে। স্ত্রীকে বললেন রাতে কামরায় সঙ্গে একজন ভৃত্যকে রাখতে। মিসেস টেওয়িনকে বেছে নিলেন অ্যান। চ্যাপম্যানদের বেডরুমের কোনার ছোট্ট বিছানাটায় ঘুমাবে সে।

রাত আনুমানিক একটার দিকে অপর খাটে বিড়বিড় শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল অ্যানের। ‘আমাকে জাগাও! আমাকে জাগাও!’ বলছে মিসেস টেওয়িন। চোখদুটো বন্ধ, তবে মুখে যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট। নিজের বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে মহিলাকে ধাক্কা দিয়ে জাগালেন। মালকিনকে ভয়ানক এক দুঃস্বপ্নের কবল থেকে তাকে বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ দিল মিসেস টেওয়িন। জেগে ওঠার প্রাণপণ চেষ্টা করেও সফল হচ্ছিল না সে।

বলল স্বপ্নে সে চলে গিয়েছিল ওক রুমের বিছানায়। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল এক তরুণী। ফ্যাকাসে মুখ। লম্বা, ঘন কালো চুল তার। গায়ে ছিল পুরানো দিনের সাদা ঢিলে গাউন বা রোব। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে কামরার অপর একটা মহিলার দিকে তাকিয়ে ছিল। বিছানার পাশে ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সে। এই মহিলাটাই ভয় পাইয়ে দেয় মিসেস টেওয়িনকে। অদ্ভুত রকম অপরিচ্ছন্ন মহিলাটি, তবে চেহারাটা এতটাই অশুভ যে ভাবলে এখনও গা শিরশির করে উঠছে। তার পরনেও ছিল পুরানো ফ্যাশনের পোশাক। দুর্গন্ধে ভরা ধূসর চুলের ওপর চাপিয়েছিল একটা টুপি।

‘বাচ্চাটাকে তুমি কী করেছ, এমিলি? কী করেছ বলো!’ ব্যঙ্গ করে সে জিজ্ঞেস করল তরুণীকে।

‘ওহ! আমি ওকে মারিনি। ওকে রক্ষা করেছি। বড় হয়ে নম্বর রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে ভারত গিয়েছে।’

তারপর তরুণী বিছানার কাছে এসে ঘুমন্ত মহিলাকে সরাসরি বলল, ‘আগে কখনও কাউকে বলিনি। তবে তোমাকে বলছি এখন। আমার নাম মিস ব্ল্যাক। আর ওই বুড়ির নাম নার্স ব্ল্যাক। এটা তার নাম নয়, তবে আমাদের পরিবারের সঙ্গে অনেক দিন ধরে থাকায় এই নামেই তাকে ডাকি আমরা।’

এ পরিস্থিতিতে বিছানার সামনে হাজির হয়ে বুড়ি তার কথায় বাধা দেয় এবং ঘুমন্ত মিসেস টেওয়িনের কাঁধে হাত রাখে। কিছু একটা বলে। যেটা মনে করতে পারছে না এখন। তবে যে জায়গাটিতে অশুভ মহিলা হাত বুলিয়েছে সেখানে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। সে বুঝতে পারছিল তার জেগে ওঠার দরকার। তাই মালকিনকে ডাকছিল।

পরের দিন সকালেই বেরিয়ে পড়েন অ্যান। এই বাড়ি আর এর পুরানো বাসিন্দাদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতে। কেউ তেমন কিছু বলতে না পারলেও এই এলাকার পুরানো, এক বাসিন্দা কিছু তথ্য দিলেন। সত্তর-আশি বছর আগে, এই ১৭৭৫-এর দিকে, মিসেস রেভেনহল নামের এক ভদ্রমহিলা ওই বাড়িতে থাকতেন। তাঁর এক ভাতিজি, যার নাম মিস ব্ল্যাক, মহিলার সঙ্গে থাকত। এর বাইরে আর কিছু জানেন না ওই ভদ্রলোক।

তবে মিসেস অ্যানের সাহসের প্রশংসা করতেই হয়। কারণ এরপর এক রাত একা ওক রুমে ঘুমালেন তিনি। আবারও সেই সাদা তরুণীকে দেখলেন, এবার কামরার এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁদছে, হাত ঝাঁকাচ্ছে। নিচে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে বেদনার্ত চোখে। পরের দিন এক মিস্ত্রীকে ডাকা হলো মেঝের ওই অংশের কাঠের পাটাতন তুলে ফেলতে। তবে একসময় ওখানে যা-ই থাকুক না কেন নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অস্বাভাবিক ঘটনা কমতে লাগল বাড়িটাতে। একপর্যায়ে থেমে গেল একেবারে। বেশ নিশ্চিন্ত হলো পরিবারটি। কিন্তু তখনও একটা ঘটনা ঘটার বাকি। রহস্যময় ঘটনা শুরুর কয়েক বছর পর ব্যবসার প্রয়োজনে জন চ্যাপম্যান পরিবারসহ আবার লণ্ডনে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। যাবার জন্য স্থির করা দিনটির কয়েকদিন আগের এক সকালে ঘুম ভেঙে অ্যান দেখেন তাঁর খাটের কিনারে কালো মুখের এক লোক দাঁড়িয়ে। পরনে জ্যাকেট, গলায় লাল স্কার্ফ। যখন তার দিকে তাকালেন সে অদৃশ্য হলো। পাশে শুয়ে থাকা জন কিছুই টের পাননি। অ্যান কিছু বলেনওনি।

কয়েকদিন পর দেখা গেল বাড়ির কয়লার মজুত শেষ। চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বাড়িটা উষ্ণ রাখতে আরও কিছু দরকার। জন বললেন আজ লণ্ডন যাওয়ার পথে অর্ডার দিয়ে যাবেন। পরদিন সকালে অ্যান তাঁকে ধন্যবাদ দিলেন বিষয়টা মনে রাখার জন্য। কিন্তু তিনি জানালেন একেবারেই ভুলে গিয়েছিলেন কয়লার ব্যাপারটা। চাকরদের কেউও কয়লার অর্ডার দেয়নি। অ্যান নিজেই গ্রামে গিয়ে তদন্ত করা স্থির করলেন। কয়লা • ব্যবসায়ী জানাল, সে কয়লা পাঠায় ফ্যাশনেবল জ্যাকেট পরা, গলায় লাল স্কার্ফ জড়ানো এক কালো মুখের তরুণের অর্ডারের প্রেক্ষিতে। সে তাকে না চিনলেও ভেবেছে চ্যাপম্যানদের নতুন কর্মচারী।

যখন সত্যি ভুতুড়ে বাড়িটা ছেড়ে লণ্ডনের নতুন বাড়িতে উঠলেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন মি. এবং মিসেস চ্যাপম্যান’। তখনই জন জানালেন, তিনি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন চেস্টনাটের ওই বাড়িটা আসলেই ভুতুড়ে। অসুখী ওই তরুণী মা আর অশুভ নার্স ব্ল্যাকের প্রেতাত্মার কারণে তাঁদের আগে অনেক ভাড়াটেই বাড়িটা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *