কিলবার্ন স্টুডিয়োর ভুতুড়ে ঘটনা

কিলবার্ন স্টুডিয়োর ভুতুড়ে ঘটনা

ও’ডনেলের ভুতুড়ে বাড়ি আর জায়গা নিয়ে গবেষণা করার বাতিক ছিল। একদিন আলাপের সময় তাঁর বন্ধু জর্জ নিয়াল বললেন কোন বাড়ি ভুতুড়ে হওয়ার সঙ্গে এর পরিবেশ বা আবহাওয়ার যোগ আছে। যখন কোন বাড়ির পরিবেশ বা আবহাওয়া অস্বস্তিকর লাগবে তখন সেখান থেকে কেটে পড়া বা বাড়ি বদল করাই উত্তম। তাঁর মতে সমতল ও পাহাড়ি এলাকার থেকে নিচু এলাকায় এবং জঙ্গলাকীর্ণ জায়গায় খুন- খারাবি আর ভুতুড়ে ঘটনা বেশি ঘটে। যেমন ব্রিস্টল, বাথ এবং ক্লিভডনের মত এলাকাগুলোতে ভুতুড়ে বাড়ি ও জায়গার খবর বেশি পাওয়া যায়। কারণ এসব জায়গা নিচু। লণ্ডনের প্রসঙ্গ এলে এক্ষেত্রে সবার আগে আসবে কিলবার্নের নাম। এটাই লণ্ডনের সবচেয়ে ভুতুড়ে জায়গা। এখানকার পরিবেশটাই আসলে অতিপ্রাকৃত ঘটনার উপযোগী। তারপরই নিয়াল লিন্টন ওয়াইজম্যান নামের এক শিল্পীর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন।

সাদা-কালো ছবি আঁকতে ভালবাসতেন লিন্টন। মনের মত একটা স্টুডিয়ো খুঁজছিলেন অনেক দিন। শেষমেশ মোটামুটি পছন্দ হলো কিলবার্নের স্টেশনের ধারের একটি জায়গা। ওখানে আঁকাআঁকির সব সরঞ্জাম নিয়ে উঠে পড়তেও সময় লাগল না।

এক বিকালের ঘটনা। এক আত্মীয়ের একটা বইয়ের জ্যাকেটের কাজে বেশ খাটাখাটনির পর একটু বিরতি টানতে চাইলেন। চেয়ারটা ফায়ারপ্লেসের আগুনের সামনে নিয়ে একটা সিগার ধরালেন। এক চিত্রনায়িকার সঙ্গে লিণ্টনের বিয়ের কথা প্রায় পাকাপাকি। কিন্তু আর্থিক কিছু সমস্যার কারণে ওটা ঝুলে আছে। মেয়েটার কথা ভাবতে ভাবতে চেয়ারে হেলান দিয়ে পাইপ টানছেন। এসময় হঠাৎ তাঁর মনে হলো একমাত্র চাচার কথা। ভদ্রলোক চিরকুমার। তাঁর কাছে অনেক প্রত্যাশা লিণ্টনের। তাঁর মনে হলো চাচার খোঁজ-খবর পাওয়া যাচ্ছে না অনেক দিন। কয়েকবার চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু কোন উত্তর পাননি। তবে কি তিনি অসুস্থ? লিণ্টনের ওপর চাচার রাগ করার কোন কারণ নেই। আগামীকাল অবশ্যই আবার চিঠি লিখবেন তিনি। যদি তারপরও উত্তর না পান তবে সোজা টরকুয়েতে তাঁর বাড়িতে হাজির হয়ে চমকে দেবেন।

আসলে শিল্পী হিসাবে কদর থাকলেও এটা দিয়ে টাকা কামিয়ে বড়লোক হওয়ার ইচ্ছা তাঁর নেই। কিন্তু প্রেমিকার কথা চিন্তা করে এখন অর্থ-কড়ির কথা ভাবতে হচ্ছে তাঁকে। চিরকুমার বড়লোক চাচা যদি একটু এই তরুণ ভাতিজার কথা ভাবেন তবেই রক্ষা। আর চাচার কথা ভাবতে ভাবতে পাইপ টানতে টানতে, কখন চেয়ারে হেলান দেয়া অবস্থায় একটু তন্দ্ৰামত চলে এল বলতেই পারবেন না। এসময় একটা শব্দে তন্দ্রা টুটে গিয়ে সোজা হয়ে বসলেন। স্টুডিয়োর দরজায় একটা করাঘাতের আওয়াজ। হতভাগাটা কে! বিরক্ত হয়ে ভাবলেন লিণ্টন। বাড়ির ঝি তো চলে গেছে আগেই। এখন তো সামনের বেলটা না বাজিয়ে কারও ভেতরে ঢুকতে পারার কথা নয়।

‘ভেতরে এসো,’ বললেন।

তারপরই বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করলেন দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করছে আধুনিক সাজসজ্জার এক তরুণী। জামাটা ঘন নীল, স্কার্ট খুব ছোট, কোটটা জাঁকালো, তাতে চমৎকার সব বোতাম শোভা পাচ্ছে। উঁচু হিলের চামড়ার জুতো পায়ে। মুখে মোহনীয় হাসি। হাসিটা ভালভাবে দেখতে পেলেন কারণ ওই মুহূর্তে হঠাৎ আগুনের শিখাটা বেশি করে জ্বলে উঠে তার মুখে পড়ে আলো। এমন এক চেহারা যেটা একজন এক পলকের জন্য দেখলেও সহজে ভুলবে না। নাকটা একটু বাঁকা, ভরাট স্তনদুটো যেন কাপড়ের শাসন মানতে চাইছে না, চোখের পাপড়ি ঘন। তবে লিন্টনকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করল তরুণীর চোখজোড়া। গভীর চোখদুটো নীল, এর মধ্যে এমন একটা প্রাণবন্ত ভাব আছে যা আগে কখনও দেখেননি তিনি। তবে দৃষ্টিতে কেমন একটা অস্থিরতা আছে। সব কিছু মিলিয়ে এই সৌন্দর্য তাঁকে রীতিমত টানতে লাগল। চোখজোড়ার মোহনীয় ক্ষমতায় এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন যে, মুখের ভাষা হারিয়ে ফেললেন। শেষ পর্যন্ত কথা শুরু করল মেয়েটাই।

‘যাক, তোমাকে পেয়ে গেলাম। আর তুমি তো কাজও করছ না।’

কিছু বলার আগে আরেকবার তরুণীর দিকে তাকালেন। হাতের আঙুলে বেশ কয়েকটা আংটি শোভা পাচ্ছে। নখগুলো লম্বা, একটু বাঁকা, সেখানে আগুনের শিখা পড়ে ঝকমক করছে।

‘কিন্তু তুমি ঢুকলে কীভাবে?’ বিস্ময় কাটিয়ে জানতে চাইলেন লিণ্টন।

‘বেল বাজিয়ে,’ হেসে জবাব দিল তরুণী, ‘এটা খুব সহজ। অন্য কোন দিন বলব। এখন চলো আমার সঙ্গে। তোমাকে নিতে এসেছি।’

‘আমাকে নিতে!’ হতবাক লিণ্টন রীতিমত হাঁসফাঁস কণ্ঠে বললেন। ভালভাবে চোখ রগড়ে দেখলেন, না এটা স্বপ্ন নয়।

‘হ্যাঁ, ভুল শোনোনি। তোমাকে নিতে। দ্রুত হ্যাট আর কোট তুলে নাও। দোরগোড়ায় গাড়িটা অপেক্ষা করছে।’

রহস্যময় এই নারীর কথামত কাজ করতে শুরু করায় নিজেই অবাক হয়ে গেলেন লিণ্টন। কে সে? তাঁকেই বা কেন নিতে এসেছে? এটা জিজ্ঞেস করার বদলে তার মোহনীয় চোখের জাদুতে যেন রীতিমত সম্মোহিত হয়ে গিয়েছেন।

‘ঠিক আছে,’ বললেন লিন্টন। তারপর কোটটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি আসছি। যাচ্ছি কোথায়?’

‘কেন, বাসায়,’ হেসে জবাব দিল নারীটি। ‘মনে হয় যেন তুমি কিছু জানো না। একজন মানুষ তোমাকে দেখতে পাগল হয়ে গিয়েছে। আমাকে দু’দণ্ড শান্তি দিচ্ছিল না। শেষমেশ প্রতিজ্ঞা করলাম গাড়ি নিয়ে এসে তোমাকে নিয়ে যাব। দুঃখজনক হলেও তোমার বাড়িতে ফোন নেই।’

‘আশা করি শীঘ্রিই আনতে পারব,’ কুণ্ঠার সঙ্গে বললেন লিণ্টন, ‘সত্যি বলতে, যখন ওটার খরচ পোষাতে পারব।’

‘পোষাতে পারবে!’ তার কথার প্রতিধ্বনি তুলল নারীমূর্তি, ‘তোমার চিত্রকর্মগুলোই যথেষ্ট। এগুলো দিয়েই টাকার পাহাড় বানাতে পারো। এখন জলদি চলো, তুমি বড্ড ধীর।’

বাড়ির দরজায় সত্যি একটা গাড়ি অপেক্ষা করছিল। তবে ভাড়া করা। সঙ্গীর সঙ্গে বিনা দ্বিধায় তাতে চেপে বসলেন লিন্টন।

গাড়ি চলতে শুরু করল। একটা রাস্তা ছেড়ে আরেকটা রাস্তায় ঢুকে পড়ছে ওটা। গ্যাসের ল্যাম্পের উজ্জ্বল আলোয় ভেতরটা আলোকিত। কিলবার্নের ভেতরই আছে তারা। সব কিছুই বাস্তব। একই সঙ্গে আবার কেমন জানি ধোঁয়াটে লাগছে তাঁর কাছে। তাঁর সুন্দরী সঙ্গী একটু পর পরই তার ছোট্ট, নরম হাত লিণ্টনের হাতের ওপর রাখছে। ভঙ্গিটা এমন যেন, বহু দিনের বন্ধুত্ব দু’জনের। আশ্চর্য হলেও লিন্টন উপভোগই করছেন। মনে হচ্ছে মেয়েটির তাঁকে নিতে আসা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। যদিও তিনি তার নামও জানেন না, এমনকী তাকে কখনও দেখেছেন এটাও মনে পড়ছে না। একপর্যায়ে বড় একটা স্কয়ারের এক কোনার একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়িটি। নিঃসন্দেহে সমাজের অভিজাত লোকেরাই বাস করেন এখানে।

গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমে তরুণী তাকে অনুসরণ করার ইশারা করল লিন্টনকে। কয়েকটা সিঁড়ি পেরিয়ে ওপরে উঠে চাবি দিয়ে দরজাটা খুলে ফেলল, তারপর ভেতরে ঢুকল। লিন্টন তার সঙ্গে ভেতরে পা রাখতেই অদ্ভুত একটা নৈঃশব্দ্য চেপে ধরল তাঁকে। সব কিছু অদ্ভুত রকম সুনসান। মেয়েটা প্রতি কদম ফেলার সঙ্গে সঙ্গে বিশাল বাড়িটায় তার হিলের শব্দের প্রতিধ্বনি হচ্ছে। তবে বাড়িটা চমৎকারভাবে সাজানো-গোছানো। কোথায় যেন একটা অসামঞ্জস্য আছে বুঝতে পারছেন না।

তাঁর চিন্তা বুঝতে পেরেই যেন সে বলে উঠল, ‘আশা করি তুমি মাফ করবে আমাকে। বাসাটা অতিরিক্ত চুপচাপ লাগছে। রাঁধুনির বোনের বিয়ের পার্টিতে যেতে চাকর- বাকরেরা এতটাই চেপে ধরল মানা করতে পারিনি।’

‘তাহলে বাড়িতে আমরা একা,’ যন্ত্রমানবের মত বললেন লিণ্টন।

একা!’ তার কথার পুনরাবৃত্তি করল নারী। নীল চোখে রহস্যময় হাসি। তারপর আবার বলতে শুরু করল, ‘যে কেউ তোমার চেহারার দিকে তাকালেই বুঝবে আমাকে ভয়ানক একটা কিছু ভেবে বসে আছ। কোন ধরনের স্ক্যাণ্ডাল কিংবা ব্ল্যাকমেইলের একটা আশঙ্কাও নিশ্চয়ই মনে দানা বাঁধছে। এখানে এসে একটু অপেক্ষা করো। এই ফাঁকে পোশাকটা বদলে নিচ্ছি। আজকে তার শরীরটা খুব একটা ভাল না। তাকে বিছানায় রেখে এসেছি।’

লিন্টনকে একটা কামরায় ঢুকিয়ে বাতি জ্বেলে ওপরের তলার দিকে দৌড়ে গেল তরুণী। সে চলে যাবার পর বেশ ক্লান্তি অনুভব করলেন লিন্টন। সারা দিনেই আঁকাআঁকি করেছেন। মৃদু আলো ছড়াতে থাকা গ্যাস বাতিটার সামনে একটা চেয়ারে গা ডুবিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। এই ফাঁকে গোটা বিষয়টি নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। এটা ঠিক তিনি রোমাঞ্চ পছন্দ করেন, যেখানে বিপদ কিংবা রোমান্স আছে তা টানে তাঁকে। কিন্তু এর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে তাঁকে। এখন তিনি খুব ক্লান্ত। তারপর আবার গোটা বিষয়টা কেমন খাপছাড়া, রহস্যময়। এই নারী কে? তাঁকে কেনই বা এ বাড়িতে নিয়ে এসেছে? সব কিছু এমন চুপচাপ কেন? তাঁর জন্য কে অপেক্ষা করে আছে? হঠাৎ মৃদু একটা শব্দ, অদ্ভুত একটা আওয়াজ, অনেকটা অপ্রত্যাশিত কোন ব্যথায় কেউ কেঁদে ওঠার মত, সচকিত করে তুলল তাঁকে। উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে তাকালেন। তবে শব্দটা আর শুনতে পেলেন না। আগের মতই নৈঃশব্দ্যের একটা চাদরে ঢাকা পড়ল গোটা বাড়ি। চেয়ারে ঠেস দিলেন আবারও। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দরজা খুলে ওই তরুণী সামনে এসে দাঁড়াল।

প্রেমিকার প্রতি বিশ্বস্ততায় কোন খাদ নেই লিণ্টনের। কিন্তু এই রহস্যময় নারীর প্রতি অপ্রতিরোধ্য একটা আকর্ষণকে দমন করা কষ্টকর হয়ে পড়ছে তাঁর জন্য। এই মুহূর্তে মাদাম ভারতেয়োল্লির ডিজাইন করা আধুনিক একটা পোশাক গায়ে চাপিয়েছে সে। তাকে এতটাই সুন্দর লাগছে যে দাঁড়িয়ে নির্লজ্জের মত তাকে দেখতে লাগলেন।

‘কী, লিণ্টন,’ হেসে সামনের আয়নার দিকে তাকিয়ে কোঁকড়ানো চুলগুলো একটু ঠিক করে নিয়ে বলল, ‘এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? আমার মধ্যে কি কিছু দেখতে পাচ্ছ? ও, একটা কথা, কয়েক মিনিট আগে কি একটা শব্দ শুনতে পেয়েছ?’

‘আমার মনে হয়েছিল কেউ একজন ব্যথায় চিৎকার করে উঠেছিল। পরে মনে হলো, না, তন্দ্রায় বোধহয় স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম।’ জবাব দিলেন লিণ্টন।

‘না, তুমি সত্যি শুনেছ। ওটা আমি,’ নারীটি জানাল, ‘আমাদের পাজি বিড়ালটা আমাকে আঁচড়ে দিয়েছে, দেখো।’ বলে একটা হাত তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিল। ওটার পেছনে লাল, লম্বা একটা দাগ নজরে পড়ল লিণ্টনের। কেন যেন কেঁপে উঠলেন যুবক। যে কোন ধরনের রক্ত দেখলেই গা ছমছম করে ওঠে তাঁর।

‘কী ভয়ঙ্কর!’ বললেন লিণ্টন, ‘আশা করি ওটাকে কয়েক ঘা লাগিয়ে দিতে পেরেছ।

‘আরে, না। ধরতেই পারিনি। তবে একবার না একবার ঠিকই ধরা খাবে। সবসময় কাউকে না কাউকে আক্রমণ করবেই ওটা। কাল না পরশুই তো রাঁধুনিকে কামড়ে দিতে চেয়েছিল। এখন আর এসব কথা নয়। সাপারের সময় হয়েছে, চলো!’

হল পেরিয়ে ডাইনিঙে ঢুকল তারা। দু’জনের জন্য একটা টেবিল সাজানো হয়েছে সেখানে। এই সময়টার কথা কখনও ভুলবেন না লিণ্টন। কোঁকড়া চুলের ওই নীলনয়নার থেকে দৃষ্টি ফেরাতেই পারছিলেন না। যখন দৃষ্টি সরিয়েছেন তখনও নরম হাত, লম্বা আঙুল-নখ আর হাতেরই সাদা চামড়ার মাঝে সেই লাল আঁচড়টার দিকেই তাকিয়েছেন। মেয়েটার দিকে এতটাই মনোযোগ ছিল কী খেয়েছেন বলতে পারবেন না। নিজেকে অ্যালকোহলবিদ্বেষী বলে পরিচয় করিয়ে দিলেও আজ রাতে তরুণী যা-ই সামনে দিয়েছে গিলেছেন। একসময় শেষ হলো খাওয়া। তাঁর দিকে ঝুঁকে এল মেয়েটা। সুন্দর চোখজোড়ায় দুর্বোধ্য দৃষ্টি ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ লুকানো আছে আমার হাতায়। দেখতে চাও?’

‘অবশ্যই,’ জবাব দিলেন লিণ্টন। 1

‘তাহলে চলো,’ এই বলে চেয়ার থেকে উঠে পথ দেখাল। তবে তার পিছু নিয়ে এগুতে লিন্টনের বেশ বেগ পেতে হলো। মাত্রাতিরিক্ত ওয়াইনের প্রতিক্রিয়া। রীতিমত টলছেন তিনি। হল অতিক্রম করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা সিঁড়ির সামনে থেমে দাঁড়িয়ে মেয়েটা বলল, ‘এখানে কি একটা মিনিট অপেক্ষা করতে পারবে? আমি গিয়ে দেখি সব ঠিকঠাক আছে কিনা।’ তারপর অদৃশ্য হলো মেয়েটা। আবার একা লিণ্টন। কৌতূহল নিয়ে চারপাশে তাকালেন। কেমন কু গাইছে মনে। এই মহিলা কি তবে এই বাড়িতে একাই থাকে? চাকর-বাকরদের ব্যাপারে বলা কথাটা কি সত্যি! আর অন্য একজনের কথা বলেছে সে-ই বা কোথায়? দেয়ালের একটা কুলুঙ্গিতে আবলুস কাঠের ফ্রেমে আটকানো বিশাল এক গ্র্যাণ্ডফাদার ক্লক। এক মনে ওটার দিকে তাকিয়ে ওটার টিক টিক শব্দ শুনতে লাগলেন। এসময়ই তরুণীটি এসে তাঁকে নিয়ে একটু দূরের আরেকটা কামরায় ঢুকল। তাঁর কাঁধে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল, ‘আগুনের পাশের চেয়ারটায় তোমার জন্য একটা চমক অপেক্ষা করছে।’ কথা বলার সময় তার শ্বাসের গন্ধ তাকে রীতিমত আচ্ছন্ন করে ফেলল। মেয়েটা তাঁর আরও কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল। এতটাই আপ্লুত হয়ে পড়লেন যে জড়িয়ে ধরে কোমলভাবে কয়েকটা চুমু দিলেন। কয়েক সেকেণ্ডে লিণ্টনের বাহুবন্ধনে আটকা থাকল মেয়েটা। তারপর হঠাৎ জোর করে ছাড়িয়ে নিল। তারপর হাসতে হাসতে তাঁর গায়ে টোকা দিয়ে কামরা থেকে বের হয়ে গেল, যাবার সময় দরজাটা ধাক্কা দিয়ে গেল।

‘চেয়ারের দিকে তাকাও,’ চেঁচিয়ে উঠল সে, ‘তাড়াতাড়ি! এত ধীর কেন তুমি?’ এসময়ই ক্লিক করে একটা শব্দ হলো। মনে হয় বাইরে থেকে দরজাটা আটকে দেয়া হয়েছে। এসময় আগুনটা হঠাৎ যেন ফুঁসে উঠল। এতে ধরা পড়ল সামনের চেয়ারটায় তাঁর দিকে পেছন ফিরে বসে আছে ফ্ল্যানেলের পোশাক পরা কেউ। লোকটার পাদুটো ছড়ানো। মাথাটা চেয়ারের পেছনে বিশ্রামরত। এতে পেছন থেকে মুখটা দেখতে পেলেন এখন লিণ্টন। তখনই মনে হলো অবয়বটার মধ্যে কোন একটা অস্বাভাবিকতা আছে। মুখটা সবুজ। চোখটা আধবোজা। মুখটা হাঁ করে আছে। ততক্ষণে কৌতূহলী হয়ে উঠেছেন লিন্টন। চেয়ারটার সামনে গিয়ে আধশোয়া লোকটার দিকে তাকালেন সরাসরি। যা দেখলেন আতঙ্কে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলেন। লোকটা আর কেউ নন-তাঁর চাচা। তাঁর অস্বাভাবিকভাবে শুয়ে থাকার কারণ পরিষ্কার। তিনি মারা গিয়েছেন। গলা কাটা। আ পরিষ্কারভাবে বললে ধারালো কিছু দিয়ে বারবার আঘাত কর। হয়েছে তাঁর গলায়। আবিষ্কারটা এতটাই ভয়ানক যে কিছু সময়ের জন্য চিন্তা করার শক্তিও হারিয়ে ফেললেন লিন্টন। জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইলেন কতক্ষণ। কেউ যেন বা পাজোড়া আঠা দিয়ে আটকে দিয়েছে মেঝের সঙ্গে। তারপর হঠাৎই কাজ করা শুরু করল তাঁর শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো। দরজার দিকে দৌড়ে গেলেন সাহায্যের, আশায়। ওটা আটকানো। দরজায় করাঘাত করতে লাগলেন জোরে। এসময় বাইরে থেকে শোনা গেল নারীকণ্ঠের অট্টহাসি।

‘ওহ, কত্ত বোকা তুমি। কেমন লাগল আমার সারপ্রাইজটা? চাচার টাকা চেয়েছিলে? কিন্তু হেরে গেলে। সব এখন আমার। বিয়ের সময়ই উইল করিয়ে সব আমার নামে লিখিয়ে নিয়েছি। আর তোমাকেও জেলে ঢুকতে হচ্ছে!’ হাসতে হাসতেই বলল তরুণী।

‘মানে? এই, শয়তান, তুমি কী বলতে চাচ্ছ?’ রাগে চেঁচিয়ে উঠলেন লিন্টন।

‘ফাঁদে আটকা পড়েছ তুমি। রেহাই পাওয়ার কোন সুযোগ নেই। দরজা তালা লাগিয়ে দিয়েছি। জানালাগুলোয় গ্রিল আছে। তোমার পোশাকের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবে কেমন বুদ্ধি করে তোমাকে ফাঁসিয়েছি। যখন তুমি আমাকে চুমু খাচ্ছিলে এবং আমার পোশাক আর চুল থেকে সুগন্ধ নিচ্ছিলে, তখন তোমার চাচার কিছু রক্ত তোমার পোশাকে লাগিয়ে দিয়েছি। এখন হাসতে হাসতে মরে যাচ্ছি আমি। এক ঢিলে বুড়ো স্বামী এবং তার বেকুব ভাতিজার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছি। এবার পুলিস ডাকতে চললাম।’

লিন্টন দরজার পাশেই টেলিফোনের কাছে যাওয়ার শব্দ শুনল তার। জেরাল্ড রোড পুলিস স্টেশনে ফোন দিয়ে সে বলছে, ‘আমি ইন্সপেক্টর, সার্জন কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত যে কাউকে চাই। তাড়াতাড়ি আসুন দয়া করে। ইটন স্কয়ারের নম্বর বাড়িতে একটা হত্যাকাণ্ড হয়েছে। আমার স্বামীকে তার ভাতিজা মেরে ফেলেছে। সৌভাগ্যক্রমে ঘটনাটা দেখে ফেলেছি আমি, বুদ্ধি করে আসামীকেও ওই কামরায়ই আটকে ফেলতে পেরেছি। খোদার দোহাই, শীঘ্রি আসুন।’

তারপরই তরুণীটি সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। হতাশ, বিপর্যস্ত লিন্টন মেঝের ওপর বসে পড়লেন। এভাবে কতক্ষণ কেটেছে বলতে পারবেন না। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ কানে এল। একজন লোকের কর্কশ কণ্ঠ, তারপর ভারী কিছু পদশব্দ। পরমুহূর্তে সিঁড়ি বেয়ে তাদের ওঠার থপ থপ আওয়াজ। একমুহূর্ত পরই ল্যাণ্ডিঙে উঠে এল পদশব্দ। -তারপর চাবি দিয়ে দরজা খোলার আওয়াজ। দরজাটা যখন খোলা হচ্ছে, আশ্চর্য একটা অনুভূতি হলো লিণ্টনের, পরমুহূর্তেই জ্ঞান হারালেন তিনি।

যখন চোখ খুলে আশপাশে তাকালেন, বিস্মিত হয়ে দেখলেন, তাঁর স্টুডিয়োতে ফিরে এসেছেন। আগুনের সামনে ঠিক আগের অবস্থানেই, নিজেকে আবিষ্কার করলেন। পৈশাচিক ওই মহিলা হাজির হওয়ার ঠিক আগের অবস্থায় আছেন যেন। এসময়ই দরজায় করাঘাতের আওয়াজ। তবে স্টুডিয়োর নয়, ঘরের প্রধান দরজায়। বারবার শব্দটা হতেই লাগল। সিঁড়ি বেয়ে নেমে দরজা খুলতেই একটা ছেলের দেখা পেলেন। হাতে একটা নোট। এখন পুরো সচকিত লিন্টন পড়তে শুরু করলেন, ‘প্রিয় ভাতিজা, অনেক দিন হলো আমার কোন খবর না পেয়ে তুমি নিশ্চয়ই চিন্তিত। তোমাকে না জানিয়ে একটা কাণ্ড করে ফেলেছি আমি, বিয়ে করেছি। আমার স্ত্রী চমৎকার এক আমেরিকান তরুণী। আশ্চর্য বিষয়, এখন যেখানে তুমি থাক একসময় সেখানেই থাকত সে। তোমাকে দেখতে অধীর হয়ে আছে ও। আজ রাত আটটায় কি আমাদের সঙ্গে ডিনার করবে? রাগ কোরো না। তোমার চাচা রবার্ট।

‘ও, একটা কথা, আমার বাসা বদলেছি। আমার পুরনো বাড়িটা ছিল চিরকুমার একজনের উপযুক্ত। কিন্তু একজন বিবাহিত লোকের জন্য না। আমার নতুন ঠিকানা…

ঠিকানাটার দিকে তাকালেন লিন্টন। ইটন স্কয়ারের একটা বাড়ির নম্বর। বিপদের একটা আশঙ্কায় দৌড়ে ওপরে উঠে কাপড় বদলালেন। এবং যথাসময়েই চাচার বাসায় পৌঁছলেন।

ভেতরে ঢুকতেই একটা ধাক্কা খেলেন। ঘণ্টাখানেক আগে ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে যে বাড়িটায় এসেছিলেন সেটার সঙ্গে এর দারুণ মিল। ওই ঘড়িটা, ওটার টিকটিক আওয়াজ শুনতে পেলেন। বাড়িটাও কেমন সুনসান। ‘ড্রইং রুমে প্রবেশ করতেই তাঁর চাচা একটু লজ্জিত ভঙ্গিতে স্বাগত জানালেন। তাঁর গলার দিকে চোখ চলে গেল লিণ্টনের। সেখানে কোন ক্ষত নেই। কীভাবে প্রিয়তমার দেখা পেয়েছেন চাচা সে বর্ণনা দিচ্ছিলেন, এমন সময় ভেতরে ঢুকল এক নারী।

‘লিণ্টন, এই আমার স্ত্রী।’ বলে উঠলেন চাচা। তবে তার কোন প্রয়োজন ছিল না। এ তো নীলনয়না সেই নারী। তাঁর স্বপ্নে যে হাজির হয়েছিল।

‘এই হচ্ছে গল্প,’ সমাপ্তি টানলেন নিয়াল, ‘লিন্টনের মুখ থেকে শুনেছি। ওটা কি স্বপ্ন নাকি অন্য কিছু এর কোন উত্তর সে পায়নি। তার কি এখন চাচাকে সাবধান করে দেয়া উচিত? কী বলো, ও’ডনেল?’

‘জটিল এক প্রশ্ন। ভেবে দেখতে হবে,’ বললেন ও’ডনেল।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *