ভুতুড়ে বাড়ি মন্টিক্রিস্টো

ভুতুড়ে বাড়ি মন্টিক্রিস্টো

রায়ানরা বলে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে ভুতুড়ে বাড়ি হলো মন্টিক্রিস্টো। অলিভ রায়ান এবং তাঁর স্বামী রেগ রায়ান ১৯৬৩ সালে এই ভুতুড়ে জায়গাটি কেনেন। অলিভ বলেন যখন তাঁরা হাজির হন বাড়িটাতে কোন বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকলেও এর বাতিগুলো জ্বলছিল। তাঁরা ভেবেছিলেন চোরেরা এসেছে বাড়িটায় যেসব মূল্যবান জিনিসপত্তর আছে সেগুলো হাতিয়ে নিতে। অলিভ এবং বাচ্চাদের গাড়িতে রেখেই রেগ গেলেন ভেতরে, কী হয়েছে দেখতে। কিন্তু সদর দরজার সামনে হাজির হতেই সব বাতি নিভে গিয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত হলেন। প্রথম দিনের এই ঘটনার পর একের পর এক অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে লাগল। ওপরের বারান্দায় প্রায়ই হিল পরা এক নারীর পদশব্দ শুনতে পেতে লাগলেন স্বামী-স্ত্রী। ওই বারান্দাটা তখন ছিল ছোট-বড় গর্তে ভরপুর এবং একেবারেই ব্যবহার অযোগ্য। কারও সাহায্য ছাড়াই জিনিসপত্র নড়াচড়া করে বেড়ায় আজব এই বাড়িতে। শোনা যায় অস্বাভাবিক শব্দ। মাঝে মাঝেই অশুভ একটা অনুভূতি হয় মনে। তবে ১৯৬০-৭০-এর দশকে মানুষের মধ্যে কুসংস্কার ছিল অনেক বেশি। তাই এসব অভিজ্ঞতা আশপাশের লোকদের কাছে তখন বলতেন না পরিবারের সদস্যরা।

ব্রায়ান পরিবার এখন বাড়িটাতে গোস্ট ট্যুর পরিচালনা করেন। রাতে থাকার ব্যবস্থাও আছে। জায়গাটার বেশ কিছু অস্বাভাবিক ছবিও ক্যামেরাবন্দি করতে পেরেছেন তাঁরা।

ধারণা করা হয় মোটমাট এগারোটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে এখানে। রায়ান পরিবারের সদস্যদের অনুমান এই অস্বাভাবিক মৃত্যুগুলোর কারণেই বাড়িটাতে নানা ধরনের অতিপ্রাকৃত ঘটনা ঘটে। আর এভাবে মারা যাওয়া মানুষগুলোর আত্মারাই মুক্তি না পাওয়ায় ঘুরছে বাড়ির সীমানার ভেতরে।

অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের জুনিতে অবস্থিত ভিক্টোরিয়ান ম্যানর ধাঁচের এই বাড়িটি। পঞ্চাশ বছর ধরে এই অদ্ভুতুড়ে বাড়িতে বাস করছেন অলিভ রায়ান। তিনি দাবি করেন বাড়ির আসল মালিক ক্রিস্টোফার এবং এলিজাবেথ ক্রউলির উপস্থিতি এখনও টের পান তিনি। ১৯১০ সালে ক্রিস্টোফার এবং ১৯৩৩ সালে এলিজাবেথ মারা যান। কিন্তু তাতে তাঁদের প্রেতাত্মাদের এই বাড়িতে হানা দেয়া থেমে থাকেনি। ক্রিস্টোফার উইলিয়াম ক্রউলি এই ম্যানর হাউস বানিয়েছিলেন ১৮৮৫ সালে।

একবার শুনলাম ব্যালকনি থেকে কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে। ব্যালকনির কাছে আসতেই পদশব্দও শুনলাম। কিন্তু সেখানে পৌঁছে কাউকে পেলাম না। আসলে আমি এবং আমার প্রয়াত স্বামী রেগ এখানে আসার প্রথম দিন থেকেই অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে থাকে। সবসময়ই মনে হত কেউ আমাকে দেখছে। আমার ধারণা এ বাড়িতে যেসব দুর্ঘটনা কিংবা অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় সেসবই এসব ভুতুড়ে ঘটনার জন্য দায়ী। একটা ছোট বাচ্চা ন্যানির কোল থেকে সিঁড়িতে পড়ে গড়াতে গড়াতে মারা যায়। সে অবশ্য দাবি করে রায়ান দম্পতি বাচ্চাটাকে তার হাত থেকে অদৃশ্য কিছু একটা ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এদিকে মি. ক্রউলির কারণে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়া এক চাকরানীও ব্যালকনি থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। কেউ কেউ আবার বলে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে মারা হয়েছে। তার প্রেতাত্মার দেখা মেলে মাঝে মাঝেই। এদিকে খড়ের গাদায় আগুন লেগে মারা যায় আস্তাবলে কাজ করা একটি ছেলে। ১৯৬১ সালে এখানকার এক কেয়ারটেকারও গুলি খেয়ে মরে। এ বাড়ির এক হাউসকিপার তার উন্মাদ ছেলেকে বাইরের একটা ছাপরায় শিকল দিয়ে বেঁধে রাখে দীর্ঘ ত্রিশ বছর। ওর নাম ছিল হ্যারল্ড স্টিল। চুল না কাটার কারণে চারপাশে নেমে এসে এবং জট বেঁধে বীভৎস হয়ে ওঠে হ্যারল্ডের চেহারা। রাতের বেলা পৈশাচিক কণ্ঠে চিৎকার করত সে। আশপাশের বাড়িগুলোতে বাস করা বাচ্চারা ভাবত একটা দানবকে আটকে রাখা হয়েছে ম্যানসনের ভিতরে। তারা ওর খোঁজে আসত পর্যন্ত। রাতের বেলা এখনও লোকেরা হ্যারন্ডের বুনো চিৎকার আর শিসের শব্দ শুনতে পায়।’ বলেন, অলিভ রায়ান। এক কথায় একটা ভুতুড়ে বাড়ির তকমা গায়ে সাঁটার জন্য যা যা দরকার এর সব উপাদানই মজুত আছে মন্টিক্রিস্টো হাউসে।

অলিভের ছেলে লরেন্স এই বাড়িতে বেড়ে উঠেছে। সে জানায় ছোট বয়স থেকেই বুঝতে পারে বাড়িটাতে সব কিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে না। চার বোনের সঙ্গে এখানেই বেড়ে ওঠে সে। ‘বাড়িটা কেনার পর মা-বাবাকে এটার সংস্কারে অনেক টাকা ব্যয় করতে হয়। এটার ছিল বেশ জরাজীর্ণ অবস্থা। আর পরিত্যক্ত অবস্থায় লুটেরারা যা পেরেছে এখান থেকে নিয়ে গিয়েছে। বাবার সবসময় একটু দোতলা বাড়ির স্বপ্ন ছিল। এর মাধ্যমে তা পূরণ হয়। এটা কেনেন এক হাজার ডলারে। এতে তখন ছিল অর্ধেকখানি ধসে পড়া মূল ভবন, ইটের একটা দালান, ভৃত্যদের কোয়ার্টার ও আস্তাবল। বাবা পেশায় ছিলেন একজন দর্জি। রোজগারের জন্য রাত- দিন খাটতেন। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে আমাকে ঘিরে অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা হয় বাড়ির লোকেদের। মা-বাবা বলরুমে একটা পার্টির আয়োজন করেছিলেন। বেশ রাত হয়ে গেলে এক বোন আমাকে বিছানায় পৌঁছে দেয়। একটু পরই বোনদের কেউ না কেউ এসে আমাকে দেখে যাচ্ছিল। আমার সবচেয়ে ছোট বোনের বয়স তখন বারো। যখন আমাকে দেখে যেতে এল, আবিষ্কার করল একজন লোক আমার বিছানার কিনারায় বসে একদৃষ্টিতে দেখছে আমাকে। তারপরই বোনের দিকে ফিরে অশুভ একটা চাহনি দিল। চিৎকার করে দৌড়ে বলরুমে গিয়ে মা-বাবাকে সে জানাল আমার রুমে অদ্ভুত, অচেনা এক লোক বসে আছে। যখন তারা এল লোকটা নেই, আমি দিব্যি ঘুমাচ্ছি। পুরনো দিনের একটা পোশাক পরে ছিল রহস্যময় ওই মানুষটি, জানায় আমার বোন। অনুমান করা হয় ওটা মি. ক্রউলির ভূত। এই ঘটনার পরে আরও কয়েকবার চেহারা দেখিয়েছে সে। আমার বয়স যখন তেরো তখন প্রথম ঘটনাটা জানতে পারি বোনের কাছ থেকে। ওই কামরাটা আমার এখনও অপছন্দ। মনে হয় কেউ যেন আমাকে দেখছে। তবে মি. ক্রউলির চেয়ে বেশি অশুভ আর বিরক্তিকর হলো মিসেস ক্রউলির ভূত। সে লোকজন একেবারেই সহ্য করতে পারে না। কখনও কখনও কোন হতভম্ব পর্যটককে ‘বেরিয়ে যাও’ বলে চমকেও দিয়েছে ভূতটা। মি. ক্রউলি মারা যাওয়ার পরও আরও তেইশ বছর এ বাড়িতে কাটিয়েছিল ভদ্রমহিলা। বেঁচে থাকা অবস্থায় যেমন অতিথি পছন্দ করত না এখনও ওই একই অবস্থা। আঠারো মাসের ছোট্ট মেয়ে মেগডেলেন ক্রউলির ভূত দেখার কথাও বলে কেউ কেউ। আসলে গৃহকর্ত্রী মিসেস ক্রউলি চাকর-বাকর ও কর্মচারীদের সঙ্গে খুব বাজে ব্যবহার করত। ধারণা করা হয় মেগডেলেনকে ওই ন্যানি মেয়েটা ইচ্ছা করে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল সিঁড়ি থেকে। ওই জায়গাটায় গেলেই কোন কারণে সবার মন খারাপ হয়ে যায়।

এটা কি ঘটনাটা আগে থেকে জানা থাকায় নাকি মেয়েটার অতিপ্রাকৃত উপস্থিতির কারণে বলতে পারব না। তবে সেখান থেকে অনেককেই কাঁদতে কাঁদতে বের হতে দেখেছি। আমাদের গোস্ট ট্যুরগুলো পরিচালনা করা হয় মোমের আলোয়। অতিপ্রাকৃত ভ্রমণ শেষে যাঁরা ভৃত্যদের পুরনো কোয়ার্টারে রাত কাটান তাঁদের হয় জীবনের সেরা ঘুমটা হয়, নতুবা ঘুম আসে না একেবারেই। এমনও আছে গোটা রাতটা এখানে কাটানও না কেউ কেউ। গাড়িতে চেপে শহরে চলে যান। আমি একজন প্রফেশনাল স্টান্টম্যান। তবে প্রতি হপ্তায় একবার হলেও বাড়িতে আসি। ভুতুড়ে ঘটনা বাদ দিলে ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায়ও এটি একটা চমৎকার দালান। মা-বাবা অনেক কষ্ট করে একে আবার পুরনো চেহারা ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাই এই দালানটা নিয়ে আমি গর্বিত। যদিও এখানে এলে ভয়ের একটা অনুভূতি অনেক সময় কাজ করে আমার মধ্যেও।’ এদিকে তার স্ত্রী সোফিয়া এখানে আসার পর অদ্ভুত এক অনুভূতির শিকার হয়। তার মনে হয় এ বাড়িতে আগেও এসেছে সে। একপর্যায়ে অনুভব করে ক্রউলিদের সময় এই বাড়ির একজন পরিচারিকা হিসাবে কাজ করত সে। ওই সময়ের অনেক স্মৃতিই মনে পড়ে তার। কখনও কখনও বাড়ির পুরানো ভৃত্যদের দেখতে পায়। এমনকী মি. ক্রউলির উপস্থিতিও টের পায়। তাই মন্টিক্রিস্টোর সঙ্গে তার সম্পর্ক অনেক গভীর। তবে সত্যি তার পুনর্জন্ম হয়েছে নাকি অন্য কোন শক্তি তাকে এমন ধারণা দিচ্ছে বোঝা মুশকিল। এখন অবশ্য গোস্ট ট্যুরগুলো পরিচালনায় বড় ভূমিকা থাকে সোফিয়ার। ভূত নামাবার মিডিয়াম হিসাবেও কাজ করে।

এই বাড়ি থেকে তোলা কিছু কিছু ছবি আসলেই পিলে চমকে দেবে আপনার। একটা ছবিতে ছায়াময় এক কাঠামোকে একটা ঘোড়ার গাড়ির ওপরে ঝুলে থাকতে দেখা যায়। আরেক ছবিতে আবার রহস্যময় এক হাতের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। অপর এক ছবিতে আয়নাতে দেখা যায় আদিবাসী এক ভৃত্যের ঝাপসা চেহারা। এক পর্যটক পুরানো এক বেডরুমের ছবি তুলেছিলেন। দেখা যায় বাম পাশে ছায়াময় একটা আকৃতি ভাসছে। এই বাড়িতে আসা অনেকেই অতিপ্রাকৃত উপস্থিতি টের পেয়েছেন।

রায়ান পরিবারের পরিচালিত ট্যুরে অনেক পর্যটকই অদৃশ্য কিছু একটা তাঁদের স্পর্শ করেছে দাবি করেছেন। রাতে ঘুমাতে গিয়ে কেউ ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠেন। কেউ আবার শরীরে কোন একটা অদৃশ্য কিছুর ওজন অনুভব করেন।

অবশ্য বিজ্ঞান লেখক ফিলিপ বেল এখানকার রহস্যময় ব্যাপারগুলোর একটা ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেন কিছু কিছু শব্দের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য এতই কম যে মানুষের কানে পৌছে না। কিন্তু শরীর এটা অনুভব করতে পারে। তখনই নানা ধরনের ভুতুড়ে অনুভূতি হয় তাদের। তবে মি. রায়ান বলেন, এই বাড়িতে একটা ভ্রমণ অবিশ্বাসীদের চিন্তাধারা বদলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। ‘অনেক অবিশ্বাসীই এ বাড়িতে ঢুকেছেন। তবে যখন বেরিয়ে যান, অতিপ্রাকৃত শক্তির উপস্থিতি এবং মৃত্যুর পরের জগৎ সম্পর্কে দ্বিতীয়বার ভাবতে শুরু করেন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *