অ্যান্ড্রু এসেছিল

অ্যান্ড্রু এসেছিল

স্কুল ও কলেজগুলোতেও নানা ধরনের ভূতের খবর পাওয়া যায়। এবারের ঘটনাটি ইংল্যাণ্ডের চ্যারিং ক্রস থেকে দুই মাইল দূরের বিখ্যাত বি. স্কুলের। বর্ণনাকারী মার্টিন ফ্ল্যামারিকের মুখ থেকেই বরং এটা শুনি।

১৮৭০-এর আগস্টের এক সন্ধ্যা। স্লোয়েইন রোডে হঠাৎই বি. স্কুলের পুরানো বন্ধু জ্যাক অ্যাণ্ডুর সঙ্গে দেখা। বহু বছর তার সঙ্গে দেখা নেই। সঙ্গে এক মহিলা। দীর্ঘদেহী, চোখা চেহারার এই নারী নিঃসন্দেহে বিদেশী। এতটাই সুন্দরী যে চেহারা থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারছিলাম না।

‘আমি দুঃখিত, গল্প করার জন্য দাঁড়াতে পারছি না,’ বলল অ্যান্ড্রু। ‘তাড়া আছে খুব। রাতেই স্পেনের বার্সেলোনার উদ্দেশে ইংল্যাণ্ড ছাড়ছি। এখন ওখানেই থাকি। ‘অ্যাংলো- বার্সেলোনিয়ান’ নামের একটা ইংরেজি পত্রিকায় চাকরি করি। ডিসেম্বরে স্কুলের অনুষ্ঠানে আসছ তো?’

জানালাম, ইতোমধ্যে প্রধান শিক্ষককে আমার উপস্থিত থাকার বিষয়টা নিশ্চিত করেছি।

‘তাহলে ভালই হলো। আমিও থাকব। হাউস সাপারে একটা বক্তব্যও দেয়ার কথা আমার। বড়দিনে স্পেনে থাকার ইচ্ছা নেই আমাদের। ইংল্যাণ্ডেই বন্ধু ও আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সময়টা কাটাব। তখন তোমার সঙ্গে দেখা হবার অপেক্ষায় থাকলাম। অনেক কিছু বলার আছে। এখন কেন দাঁড়াতে পারছি না আশা করি বুঝতে পারছ। গুড লাক, বন্ধু।’ এই বলে চলে গেল তারা। ঘুরে তাকিয়ে ভিক্টোরিয়ার একটা বাসে উঠতে দেখলাম। অ্যাণ্ডুর সঙ্গে দেখা হয়ে সত্যি খুব ভাল লাগছিল। কারণ আমার বি. স্কুলের ঘনিষ্ঠ দোস্তদের একজন ছিল সে। এক ক্লাসে একই সঙ্গে ভর্তি হই। স্কুল ছাড়ার পর মাঝখানের দীর্ঘ সময়ে একবার ছাড়া দু’জনের আর দেখাই হয়নি।

সে মেয়েটার সঙ্গে কেন পরিচয় করিয়ে দিল না এটা ভেবে অবাক লাগল। তবে এটাও ঠিক তাদের খুব তাড়া ছিল। নিঃসন্দেহে নারীটি তার স্ত্রী। সৌভাগ্য আর কাকে বলে! এত সুন্দরী একটা বউ পেয়েছে। চোখা চেহারা, রসালো ঠোঁট, টানা টানা চোখ, লম্বা পা। উঁচু হিল পরে ছিল। মোজার ফুটো দিয়ে গোলাপী পা দেখতে পাচ্ছিলাম। আবার ভাবলাম, হয়তো তার বোন। তাহলে আমার একটা সুযোগ তৈরি হয়। হয়তো আমাকে বার্সেলোনায় তাদের বাড়িতে যাওয়ার দাওয়াতও দেবে। বার্সেলোনা নিয়ে রীতিমত পড়াশোনা শুরু করে দিলাম। জ্যাককে লম্বা-চওড়া একটা চিঠিও পাঠালাম। তবে বন্ধুর চিঠি পেয়ে কিছুটা দমে গেলাম। ওই মহিলা কিংবা বাড়িতে দাওয়াতের ব্যাপারে কিছু বলেনি। স্কুলের পুরানো দিনের কথা বারবার লিখেছে। অনুষ্ঠানটার ব্যাপারে তার বেজায় আগ্রহ, কোথায় আমাদের দেখা হবে এসব বিষয়ে লিখেছে। এভাবে কয়েকবার চিঠি চালাচালি হলো। শেষবার তার চিঠি পেলাম নভেম্বরের ২৫ তারিখ। তারপর আর কোন খবর পেলাম না। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ ইংল্যাণ্ডের জাহাজে চেপে বসার কথা।

শেষ পর্যন্ত এল ঘটনাবহুল সেই সন্ধ্যা। একটা বক্তব্য দেয়ার কথা আমারও। বক্তা হিসাবে আমি একেবারেই গড়পড়তা ধরনের। তাছাড়া বড়দের সামনে বলা এক জিনিস আর স্কুলের ছেলেদের সামনে বলা আরেক কথা। শুরুর অনুষ্ঠানে অন্তত হাজারখানেক পুরানো ছাত্র উপস্থিত ছিল নতুনদের পাশাপাশি। স্কুলের সঙ্গীতটা যখন হলো মনে হচ্ছিল যেন শব্দে কানে তালা লেগে যাবে। ছাত্ররা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গেল হাউস সাপারের জন্য। স্কুল-দালানের প্রবেশ পথে অ্যাণ্ডুর আমার সঙ্গে দেখা করার কথা। ‘গানের সময় সম্ভবত উপস্থিত থাকতে পারব না, তবে স্কুলের পুরনো দালানটার সামনে সাড়ে নয়টার দিকে হাজির হতে ভুল হবে না।’ বলেছিল সে।

কিন্তু জ্যাকের কোন দেখা নেই। একই সঙ্গে হতাশ ও ক্রুদ্ধ হলাম। কেন এল না? আমার সঙ্গে কি তবে মজা করল? প্রধান শিক্ষক সি. গ্রের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি বললেন অ্যাণ্ডুর একটা বক্তব্যও দেয়ার কথা। আসবে না, এমন কিছুও জানায়নি। নিশ্চিতভাবেই ভোজের আগেই হাজির হয়ে যাবে। এই আশা নিয়ে অন্য অতিথিদের সঙ্গে হলে প্রবেশ করলাম। সেখানে বয়সে বেশ কয়েক বছরের ছোট দু’জন প্রাক্তন ছাত্রের মাঝখানে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। খাবারটাও খুব একটা পছন্দ হলো না। খাওয়া শেষে একটার পর একটা মিনিট পেরোতে লাগল এবং আরও বেশি করে অধৈর্য হয়ে উঠতে লাগলাম। জ্যাকের জন্য রীতিমত উদগ্রীব হয়ে উঠেছি। হঠাৎই মনে হলো মাঝখানের বিশটা বছর যেন এক লহমায় নেই হয়ে গেছে। সত্যি আমি যেন এখনও স্কুলে পড়া সেই ছেলেটি, বালক মনের সেই উত্তেজনা, ভয় সব কিছুই অনুভব করতে পারছি। আমার বাম পাশে তিনটা সিট পরে জ্যাকের আসন। কিন্তু জায়গাটি ফাঁকা, জ্যাক আসেনি। সে শেষপর্যন্ত আমাদের বোকা বানিয়েছে। চেয়ারে পিঠটা এলিয়ে দিয়ে, ভাগ্যকে অভিসম্পাত দিলাম। হঠাৎ শরীরে শীতল একটা অনুভূতি ঘুরে তাকাতে বাধ্য করল আমাকে। দেখলাম, লাজুক জ্যাক কোন্ ফাঁকে তার আসনে এসে বসে আছে।

এটাকে কল্পনা ভেবে, চোখ বন্ধ করলাম। যখন চোখ খুললাম দেখলাম, জ্যাক এখনও সেখানে আছে।

‘জ্যাক!’ সামনে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললাম, ওর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করলাম, ‘জ্যাক!’

তবে অ্যান্ড্রু জবাব দিল না। মনে হচ্ছে শুনতে পায়নি। সিটে চুপচাপ বসে আছে। কনুইদুটো টেবিলের ওপর। চোখ নিচের দিকে। ছোটবেলাতেও এভাবেই বসে থাকত, মনে পড়ল। এসময়ই আমার পাশের একজন জানতে চাইল আমি কী চাচ্ছি? মি. অ্যাণ্ডুর কাঁধে টোকা দিতে বললাম। সে আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল। ‘মি. ফ্ল্যামারিক, স্কুলবেলা থেকেই কি এরকম মস্করা করতে পছন্দ করো?’

জবাব দিতে যাব এসময় হাউস-শিক্ষক বক্তব্য শুরু করার ঘোষণা দিলেন। আমার এবং জ্যাক দু’জনেরই কথা বলার কথা। এসময়ই আমাকে চমকে দিয়ে তিনি ঘোষণা করলেন, জে. এল. অ্যান্ড্রু দুর্ভাগ্যজনকভাবে উপস্থিত হতে না পারায় তার বদলে অন্য একজন প্রাক্তন ছাত্র বক্তব্য দেবেন।

‘জ্যাক এখানে নেই!’ নিজেকেই প্রশ্ন করলাম। ‘হয় হাউস-শিক্ষক পাগল হয়ে গিয়েছেন, নতুবা আমি। তাকে এত পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছি কীভাবে তাহলে?’ এসব যখন ভাবছি তখনই আমার বন্ধুর চেহারাটা ঝাপসা হতে হতে মিলিয়ে গেল। হাউস-শিক্ষকই ঠিক তাহলে। জ্যাক এখানে নেই।

ওই সময়ই শরীরের শীতল অনুভূতিটার কথা মনে হলো। নিশ্চিত হয়ে গেলাম মোটেই ভুল দেখিনি, কোন ধরনের আত্মার কারসাজি ব্যাপারটা। যা হোক, আমার সময় হলে বক্তব্য দিলাম। তবে জ্যাকের চেহারাটা তাড়া করে বেড়ানোয় মনোযোগ দেয়া কঠিন হচ্ছিল। রাতে যখন বিছানায় গেলাম তখনও ওর কথা ভুলতে পারছিলাম না।

‘এটা খুব অদ্ভুত! অ্যান্ড্রু আমাদের বিষয়টি জানালই না, ‘ পরদিন হাউস-শিক্ষক বললেন, ‘তার কাছ থেকে বিষয়টা ব্যাখ্যা করে একটা চিঠি আশা করেছিলাম। কিন্তু কিছুই আসেনি। হয়তো সে তোমাকে লিখবে। কী হয়েছে জানাতে ভুলো না।’ তাঁকে কথা দিয়ে আর কাউকে বিদায় জানানোর জন্য অপেক্ষা না করে রেলস্টেশনের দিকে রওয়ানা হলাম।

ব্রুক স্ট্রিট, আমার খাস কামরা। অন্য দিনের থেকে তাড়াতাড়িই আজ বিছানায় গেলাম। একপর্যায়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। পাশের গির্জার ঘড়িতে দুটো বাজার ঘণ্টা বাজতেই হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। মনে হলো যেন ভারী একটা কিছু আছে বিছানায়। হাত বাড়াতেই আতঙ্কিত হয়ে আবিষ্কার করলাম একটা মাথায় পড়েছে হাতটা। চুল থেকে চুইয়ে পানি পড়ছে। এতটাই ভয় পেলাম যে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। এভাবে কতক্ষণ কাটিয়েছি বলতে পারব না। হঠাৎ বুঝতে পারলাম ভারী ওজনটা আর বিছানায় নেই। ওটা বিদায় নিয়েছে। কেন যেন মনে হলো এই ভৌতিক ঘটনার সঙ্গে স্কুলের ওই ঘটনার সম্পর্ক আছে। অ্যাণ্ডুর কি তবে কিছু হয়েছে? বার্সেলোনায় যেতে হবে আমাকে, স্থির করে ফেললাম।

সকালে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা জিনিস নিয়ে ভিক্টোরিয়ার উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। কয়েকদিন পরের এক সন্ধ্যায় পৌছলাম বার্সেলোনা। হোটেলে জিনিসপত্তর রেখে জ্যাক যে পত্রিকা অফিসে কাজ করে সেখানে গেলাম। তবে আমাকে মোটেই সাদর অভ্যর্থনা জানাল না তারা। বলল অ্যান্ড্রু আর এখানকার স্টাফ নয়, তার ঠিকানাও জানা নেই তাদের। আর জানা থাকলেও তাতে আমার কোন লাভ হবে না। তাদের চেহারায় অদ্ভুত এক হাসি খেলা করতে দেখলাম।

মনে হলো জ্যাককে ঘিরে একটা রহস্য দানা বাঁধছে। হয়তো পত্রিকার লোকেরা ওর সম্পর্কে কিছু জানে, কিন্তু বলতে চাইছে না। তারপর গেলাম আমাদের দূতাবাসে। ওটা বন্ধ, কাল এগারোটার আগে খুলবে না। হাতে এখনও কয়েক ঘণ্টা সময় আছে। কী করব বুঝতে না পেরে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে লাগলাম। একপর্যায়ে একটা মার্কেটের মাঝখানের চত্বরের সামনে চলে এলাম। কয়েকটা গ্যাস ল্যাম্পের আলোয় আঁধার খুব কমই দূর হচ্ছে। চতুর্ভুজাকৃতির জায়গাটা খোয়া দিয়ে বাঁধানো। ইংল্যাণ্ডে এ ধরনের চত্বর আরও অনেক দেখেছি। বেশ অন্ধকার নেমে এসেছে ইতোমধ্যে। বিকালের দিকে শহরের ওপর ঝুলে থাকা ভারী কুয়াশা এখন ভারী বৃষ্টি হয়ে নেমে এসেছে। দ্রুতই রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গেল। আমি হোটেলে ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরব, এসময় মৃদু একটা গোঙানির মত শুনলাম মনে হলো। পাকা চত্বরটির মাঝখান থেকে আসছে শব্দটা। কাউকে কি খুন করা হচ্ছে? নাকি এটা আমার জন্য একটা ফাঁদ! আবারও গোঙানির শব্দ শুনলাম। নিশ্চিতভাবেই কেউ খুব যন্ত্রণায় এমন শব্দ করছে, আমার ভেতরের সমস্ত দ্বিধা চলে গেল।

রিভলভারটা হাতে নিয়ে পিচ্ছিল পাথরের ওপর দিয়ে নিঃশব্দে শব্দ লক্ষ্য করে এগুতে লাগলাম। বৃষ্টি ও আলোর স্বল্পতা হেতু সামনে কয়েক ফুটের বেশি দৃষ্টি যাচ্ছে না। পথে কোন ধরনের বাধা থাকতে পারে এটা ভাবিনি। হঠাৎ কাঠের একটা মঞ্চের মত জায়গায় হোঁচট খেলাম। এটার ওপরে উঠব নাকি পাশ কাটিয়ে যাব ভাবছি, এসময়ই দেখলাম আমার কাছেই একটা চৌকির ওপর একটা লোক বসে আছে। বয়স খুব বেশি নয়, পরনে কালো একটা স্যুট। মুখটা হাত দিয়ে ঢাকা থাকায় চেহারা দেখতে পাচ্ছি না। মাথায় টুপি নেই। উন্মুক্ত মাথায় অনবরত বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে। তারপর গড়িয়ে পড়ছে শরীর বেয়ে নিচে।

বাহুতে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এমন বৈরী রাতে এখানে বসে কী করছে। সে কি অসুস্থ? আমি কি তার জন্য কিছু করতে পারি? জবাবে ভয়ানকভাবে গুঙিয়ে উঠল লোকটা। ধীরে ধীরে মুখ তুলল। ওহ্, খোদা, এ তো জ্যাক। এতটাই বিস্মিত যে কথা বলার ভাষাও হারিয়ে ফেললাম। কেবল অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইলাম।

‘জমে গিয়েছি প্রায়,’ বিড়বিড় করে বলল সে, ‘চার রাত ধরে এখানে বসে আছি।’

‘চার রাত,’ বিস্মিত কণ্ঠে প্রতিধ্বনি তুললাম, ‘হায়, ঈশ্বর! তুমি উন্মাদ হয়ে গেছ, জ্যাক!’.

মাথা ঝাঁকাল সে। সেখান থেকে পানি টপ টপ করে পড়ল আমার কাপড়ে।

‘না,’ বলল সে, ‘আমি পাগল হইনি। এখানেই আছি।’ তারপর নিজের দিকে একবার তাকিয়ে যোগ করল, ‘তোমাকে বলে কোন লাভ নেই। বুঝবে না।’

‘আমাদের শেষবার দেখা হবার পর নিঃসন্দেহে অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে,’ মত প্রকাশ করলাম, ‘একটা মোটামুটি মাথা গোঁজার মত জায়গায় পৌঁছার পরে আশা করি গোটা বিষয়টা বুঝিয়ে বলবে। আমার ধারণা কোন ধরনের মানসিক যন্ত্রণা এবং বৃষ্টিতে ভেজা এই দুইয়ে মিলে তোমার মাথাটা গেছে। এখন বাড়ি গিয়ে এক বোতল হুইস্কি সাবাড় করা উচিত তোমার।’

‘না,’ ক্লান্ত কণ্ঠে বলল, ‘ওখানে আর কখনও যেতে চাই না। বরং তোমার আস্তানায় নিয়ে চলো।’

কী করা যায় বুঝতে না পেরে রাজি হলাম। খুব দ্রুতই শর্টকাটে আমাকে হোটেলের কাছে নিয়ে এল সে। অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকাল হোটেলের মালকিন মহিলা। আমার বন্ধুটির মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল যা মহিলাটিকে একই সঙ্গে ভীত করেছে এবং চমকে দিয়েছে। অবশ্য আমি খুব একটা বিস্মিত হলাম না এতে। কারণ জ্যাকের গাল অস্বাভাবিক রকম সাদা, চুল ভেজা, চোখ অস্বাভাবিক বড় এবং কেমন যেন রক্তাভ হয়ে আছে। সাপার রুমে আমরা ঢুকতেই অন্য অতিথিরা দূরে সরে গেল। ফলে বড় একটা টেবিল শুধু দু’জনের জন্য দখলে পেতে কোন অসুবিধা হলো না। চমৎকার স্বাদের খাবার পরিবেশন করা হলো। ঠাণ্ডা রোস্ট চিকেন, সালাদ, মিষ্টান্ন, কমলার জুস এবং ওপরতোর বিখ্যাত ওয়াইন। আমি রীতিমত খাদকের মত খেলাম। তবে জ্যাক একটা কিছু স্পর্শ করল না।

হতাশার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম। ও যে পাগল হয়ে গেছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই আমার। ‘তোমার ব্যাপার- স্যাপার বুঝতে পারছি না মোটেই। কয়েকদিন ধরেই কিছু খাচ্ছ না নাকি?’ জানতে চাইলাম।

‘সোমবার থেকে,’ জবাব দিল জ্যাক, ‘আজ শুক্রবার। সোমবার সকালে পাউরুটি আর কোকো খেয়েছি।’

তারপর স্কুলজীবনের গল্প করতে লাগলাম। তবে তার এখনকার জীবন, এখনকার বাড়ি, আর ওই সুন্দরী নারী যাকে জ্যাকের স্ত্রী ভেবেছি, এগুলো সম্পর্কে কিছুই বলল না।

বেশ খরচ হলেও ওর জন্য একটা কামরার ব্যবস্থা করলাম। সেখানে বেশ রাত পর্যন্ত গল্প করলাম।

‘ঠিক আছে,’ ঘড়ির কাঁটা দুটোয় পৌঁছলে অবশেষে বলল সে, ‘বুড়ো বন্ধু, এবার যাও, আমাকে এখানে রেখে। সকালে হয়তো এখনকার আমার সঙ্গে একটু পার্থক্য চোখে পড়বে। তবে যা-ই ঘটুক, আর তোমাকে লোকেরা যা-ই বলুক, সত্য অনুসন্ধানের চেষ্টা কোরো।

কথা শেষ করে শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিল। হতবুদ্ধি অবস্থায় কামরা থেকে বেরিয়ে এলাম। পরের দিন সকালে কী অবস্থায় তাকে পাব এ ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই আমার। তবে যে কোন কিছুর জন্যই মানসিকভাবে প্রস্তুত আমি। তবে পরে যেটা জানতে পারি সেটা ছিল আমার জন্য বড় এক ধাক্কা।

সকালে জ্যাকের কামরায় গিয়ে দেখলাম রাতে যে অবস্থায় রেখে গিয়েছিলাম সে অবস্থাতেই আছে বিছানায়। মাথাটা একটু দরজার দিকে ঘোরানো। হালকাভাবে স্পর্শ করলাম তাকে। কিন্তু কোন সাড়াশব্দ পেলাম না। কপাল ছুঁলাম। বরফের মত ঠাণ্ডা। মাথাটা ধরতেই এক পাশে হেলে পড়ল নিষ্প্রাণভাবে। কোটের কলার সরাতেই গলাটা উন্মুক্ত হলো। ওটা নীল, ফোলা আর…। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠে কামরা থেকে ছুট লাগালাম।

একজন চিকিৎসক ডাকা হলো।

ডাকা হলো। তাকেসহ বন্ধুর শয্যাপাশে এলাম। মৃতদেহটা দেখেই ভয় আর বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল। তারপর মৃতদেহের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বলল, ‘ঈশ্বর! সে এখানে কীভাবে এল? জ্যাক অ্যান্ড্রু, খুনিটা, সোমবার সকালে জনসমক্ষে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে! এ কী করে সম্ভব!’

এই ঘটনার পর বেশ কয়েকদিন অসুস্থ হয়ে বিছানায় কাটালাম। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে জনের শেষ শব্দ কয়টা, ‘সত্য অনুসন্ধানের চেষ্টা কোরো!’

সুস্থ হয়েই খোঁজ-খবর শুরু করলাম। যাকে হত্যার অভিযোগে জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে তার নাম কারলোটা গডিভেজ, যে মহিলার সঙ্গে সে বাস করত। লণ্ডনে জ্যাকের সঙ্গে যে সুন্দরীটি ছিল এ-ই সে বুঝতে সমস্যা হলো না আমার।

জ্যাকের সঙ্গে যখন প্রথম দেখা হয় তখন কারলোটা ছিল বিবাহিত। স্বামী হারমান গডিভেজের সঙ্গে থাকত কার্টাজেনায়। জ্যাকের প্রেমে পড়ে তার সঙ্গে পালায় নারীটি। তবে প্রতিবেশীরা নিয়মিতই প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে ঝগড়ার শব্দ শুনতে পেতেন। যখন কারলোটাকে তার সাজঘরে হার্টে ছুরিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায় স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ গিয়ে পড়ে অ্যান্ড্রুর ওপর।

ইংরেজ রাষ্ট্রদূত তখন এখানে ছিলেন না। তাঁর বদলে দায়িত্ব পালন করছিলেন একজন স্পেনীয়। তাছাড়া তথ্য- প্রমাণ ছিল জ্যাকের বিরুদ্ধে। একে বিদেশী, তাতে আবার তেমন ক্ষমতা নেই। তাছাড়া একজনকে বলির পাঁঠা বানানোর দরকার ছিল পুলিসের। অতএব মরতে হলো জ্যাককে।

যা হোক, আমি কার্টাজেনা গিয়ে একজন গোয়েন্দা নিয়োগ করলাম হারমান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য। তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু প্রমাণও মিলল। কিন্তু স্পেনীয় পুলিস কোন ব্যবস্থাই নিল না। স্পেনের আইন-কানুনের এই হতাশাজনক অবস্থা দেখে লণ্ডনে ফিরে এলাম। তবে জ্যাকের ব্যাপারে মুখ খুললাম না এখানে। এমনকী আমাদের স্কুলের বন্ধুরা এখনও জানে না জ্যাকের ভাগ্যে কী হয়েছে। তবে স্কুলে এখনও ওর ভূত দেখা যায়, যেমন দেখা যায় যে হোটেলে আমি ওকে নিয়ে গিয়েছিলাম সেখানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *