মৌর্য – ৯

সম্রাজ্ঞী দুরধরার জন্য বিশেষ স্বাস্থ্যব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একজন চিকিৎসক, দুজন চিকিৎসাসেবায় পটু দাসীকে সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োগ করা হয়েছে। সম্রাট নিজেও নিয়মিত খোঁজখবর নিচ্ছেন।

এরই মধ্যে মন্দাকিনী এসে সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎপ্রার্থী হলো। গ্রিক রাজকুমারীর পত্র এসেছে। অনেক দূরের পথ। এক হাজার মাইলের বেশি দূরে। কবুতরটি ক্লান্ত হয়ে গেছে। পথে খাদ্যাভাবে অনেকটাই দুর্বল। মনে হয় আকাশপথে বহুবারই যাত্রাবিরতি করেছে। তবু আসতে পেরেছে, সেটাই বড় কথা। পত্রলেখকের সঙ্গে মজা করলেও গ্রিক রাজকুমারী এই প্রাণীটির প্রতি দারুণ মমতা দেখিয়েছেন। তাকে পেট ভরে খাইয়েছেন। তার যত্নের কোনো ত্রুটি হয় নি।

সম্রাট হাতের কাজ শেষ করে মন্দাকিনীকে আসার অনুমতি দিলেন। মন্দাকিনী অভিবাদন শেষে পত্রটি সম্রাটের দিকে এগিয়ে দিল। মুখে বলল, গ্রিক রাজকুমারী পাঠিয়েছেন। সম্রাট তাঁর সব রাজকীয় শিষ্টাচার ভঙ্গ করে একটি দাসীর সামনেই উন্মাদের মতো পত্রে বারবার চুম্বন করতে থাকলেন। ভেতরে কী লেখা আছে, সে ব্যাপারে একটুও ভাবলেন না এবং মন্দাকিনীর সামনে এ বালখিল্য আচরণে একটুও কুণ্ঠিত হলেন না। বরং মন্দাকিনীকে কাছে টেনে তার কপোলেও একটি চুম্বন এঁকে দিয়ে বললেন, পড়ো দেখি কী লিখেছেন রাজকুমারী।

মন্দাকিনী পত্রটি পাঠ করে তার প্রতিটি বাক্যের অনুবাদ করে সম্রাটকে শোনালেন। সম্রাট যতই শুনছেন, উল্লসিত হচ্ছেন এবং সে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন মাত্রাহীনভাবে। পত্রপাঠ একবার শেষ হয়, আবার পাঠ করতে বলছেন মন্দাকিনীকে। মনে হচ্ছে একটি নতুন সাম্রাজ্য তিনি জয় করে ফেলেছেন। এ পত্রেরও উত্তর দিতে হবে। মন্দাকিনীকে বললেন, তুমি তার একটি সংস্কৃত অনুবাদ লিপিবদ্ধ করে আজকেই দেবে। আমি পত্রের উত্তর লিখব সংস্কৃতে, তুমি গ্রিক ভাষায় তা অনুবাদ করে পাঠাবে।

মন্দাকিনী পত্র নিয়ে চলে যাচ্ছিল। সম্রাট বললেন, দাঁড়াও। তিনি তাঁর গলা থেকে পুণ্ড্রবর্ধনের হিরের একটি হার খুলে তার কণ্ঠে পরিয়ে দিলেন। মন্দাকিনী অভিভূত হতো, কিন্তু হলো না। কারণ, সে সম্রাটের উচ্ছ্বাসটা দেখেছে।

.

রাতে সম্রাট খুব অস্থির হয়ে উঠলেন। তিনি নিজেই আধ্যাত্মিক গুরু আচার্য ভদ্রবাহুর কক্ষে উপস্থিত হলেন। ভদ্রবাহু ধ্যান করছিলেন। যোগাচার মতে ধ্যান সমাপ্ত করে সম্রাটের কাছে এসে বসলেন। বললেন, চন্দ্র, এটা ধ্যান, শেষ না করে ওঠা যায় না, আশা করি তুমি তা বুঝতে পারবে। তোমাকে বসিয়ে রাখার জন্য দুঃখিত। সংবাদ দিয়ে এলে না কেন?

আমার কোনো অসুবিধে হয় নি, আচার্য। আপনার ধ্যানে বিঘ্ন সৃষ্টি করছি বলে দুঃখ হচ্ছে। আপনার স্বাস্থ্য কেমন যাচ্ছে?

ভালোই যাচ্ছে। নিয়মের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সবকিছু। স্বাস্থ্য ঠিক রাখা নির্ভর করে নিয়ম মেনে চলার মধ্যে। এবার বলো, এই রাতের বেলায় তোমার আগমনের কারণ কী?

আচার্য, গ্রিক রাজকুমারীর কথা বলেছিলাম আপনাকে।

আমি ভেবে দেখেছি। তোমার ডান হাতটা দাও তো একটু দেখি। ভদ্ৰবাহু বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সম্রাটের হাত দেখলেন। অনেকক্ষণ পর্যন্ত দেখলেন। পরে চোখ তুলে তাকালেন চন্দ্রগুপ্তের দিকে! চন্দ্রগুপ্ত উদ্‌গ্রীব হয়ে আছেন। আবার হাতটা নিয়ে তাতে চোখ রাখলেন এবং এক টুকরো বস্ত্রে হাতটির সব রেখাসহ চিত্র অঙ্কন করলেন। কী সব গাণিতিক হিসাব-নিকাশও করলেন। পরে বললেন, হস্তে সংস্থান আছে। সবকিছুই শুভ। তবে একটু বিলম্বযোগ রয়েছে। তুমি অগ্রসর হতে পারো।

সম্রাট খুশি হয়ে গেলেন। বললেন, আচার্য, নগর জৈন মঠের জন্য আমি কিছু অনুদান দিতে চাই, আপনি গ্রহণ করলে কৃতার্থ হই।

বেশ দেবে। বলে নিজ কর্মে মনোযোগ দিলেন আচার্য।

সম্রাট ফিরে এলেন তাঁর কক্ষে। এসেই চাণক্যকে ডেকে পাঠালেন। চাণক্য এলে সরাসরি বললেন যে তিনি গ্রিক রাজকুমারীকে বিয়ে করতে চান, কালই প্রস্তাব পাঠাতে হবে।

চাণক্য তক্ষশীলা থেকে ফিরে আসার পর এ নিয়ে প্রচুর ভেবেছেন ও পরিকল্পনা এঁটেছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে যে আশা পোষণ করছিলেন, আজ তার সুযোগ এল। একটু ভেবেচিন্তে স্বভাবজাত গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন, মহামান্য সম্রাট, আমার বিবেচনায় প্রস্তাব পাঠিয়ে কোনো লাভ হবে না। সম্রাট সেলুকাস তাতে রাজি হবেন না। উপায় একটিই আছে, গ্রিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের পরাজিত করা।

সম্রাট বললেন, তাহলে আপনি যুদ্ধের কথা বলছেন?

চাণক্য তাঁর দীর্ঘকাল লালিত বাসনার কথা জানালেন, গ্রিকদের বিরুদ্ধে আমাদের এমনিতেও যুদ্ধ করতে হবে। ভারতবর্ষের অণুপরিমাণ জায়গাও কোনো বিদেশি দখল করে রাখুক, তা আমরা চাই না। আলেকজান্ডারের সময়ে তাঁর ভারতীয় সৈন্যবাহিনীতে আপনাকে পাঠিয়েছিলাম তাদের সংবাদ সংগ্রহ এবং তাদের বিরুদ্ধে নানা প্রপাগান্ডা ছড়ানোর জন্য, সে কথা নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে!

আছে আচার্য, আমি তখন চৌদ্দ বছরের এক তরুণ। বেশ, যুদ্ধের প্রস্তুতি নিন। আমরা গ্রিকদের আক্রমণ করব।

না সম্রাট, এখনই গ্রিকদের বিরুদ্ধে আক্রমণ অভিযান নয়। তার আগে নন্দরাজ্য আক্রমণ করে তার বাকি অংশ দখল করে নিতে হবে।

নন্দরাজ্য আক্রমণ কেন?

দুটি কারণে। ঘরের পাশে শত্রু রেখে বাইরে আক্রমণ করতে গেলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা। যুদ্ধ দীর্ঘ সময় স্থায়ী হতে পারে। আমরা গ্রিকদের সমরশক্তি সম্পর্কে অবহিত নই। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, নন্দরাজ্য জয় করার মধ্য দিয়ে গ্রিকদের জানান দেওয়া যে আমরা কতটা শক্তিশালী। এ ছাড়া এ সময়ে গোয়েন্দাদের পাঠিয়ে গ্রিকদের শক্তি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে যুদ্ধ পরিকল্পনা ও কৌশল প্রণয়ন করা যাবে। মহামান্য সম্রাট, আপনি নিশ্চয়ই প্রথম নন্দরাজ্য আক্রমণের তিক্ত অভিজ্ঞতা দ্বিতীয়বার অর্জন করতে চান না।

চন্দ্রগুপ্ত চাণক্যের এসব যুক্তি মানতে চাইতেন না, যদি না আধ্যাত্মিক গুরুর ‘বিলম্বযোগের কথা মনে হতো। যা করুন, দ্রুতভাবে করুন। বললেন তিনি।

চাণক্য খুশি হয়ে বললেন, শুভস্য শীঘ্রম। চাণক্য চলে যাওয়ার পর সম্রাজ্ঞী দুরধরা সম্রাটের কক্ষে এলেন। মন্ত্রী কেন এসেছিলেন?

নন্দরাজ্যের বাকি অংশ দখল করতে অভিযান চালাতে চান।

আপনি কী বললেন?

শীঘ্রই অভিযান শুরু করতে বলেছি।

আমার এই রকম সময়ে বললেন।

সম্রাট অবাক হলেন, সব যুদ্ধ অভিযানে যিনি প্রেরণা জুগিয়েছেন, তিনি এ কথা বলছেন! সম্রাট তাঁকে কাছে টেনে বসালেন। বললেন, সম্রাজ্ঞী, আপনি সব কাজেই আমার প্রেরণা। আমি বুঝতে পারি নি তাতে আপনার সমর্থন থাকবে না।

আমার সমর্থন নেই, সে কথা আমি বলি নি।

তাহলে?

বলছিলাম সময়ের কথা

আপনি নিশ্চিত থাকুন, যুদ্ধ শীঘ্রই শেষ হবে। আমরা সঠিক সময়ে পৌঁছে যাব।

যুদ্ধের সময় আপনি রাজপ্রাসাদে থাকবেন না, অভিযানে থাকবেন।

এটাই তো নিয়ম। সম্রাট স্বয়ং যুদ্ধ অভিযানে নেতৃত্ব দেবেন। আমার বিশ্বাস, বিজয়ী হয়ে এসে আপনার সন্তানের আগমন প্রতীক্ষা করব। রাজপুত্রের জন্ম দেবেন আপনি। অনেক দিন ধরে জন্মোৎসব চলবে। সারা বিশ্ব জানবে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও সম্রাজ্ঞী দুরধরা এক পুত্রসন্তানের জনক-জননী হয়েছেন। আমরা বিজয়োৎসব তখনই করব না, একসঙ্গে করব। কারণ, এটাই যে আমাদের সবচেয়ে গৌরবময় বিজয়।

যদি যুদ্ধে পরাজিত হন।

এ কথা বলছেন কেন, সম্রাজ্ঞী? এই যুদ্ধে যে আমাদের বিজয়ী হতেই হবে। আপনি আশঙ্কা করছেন কেন? আপনার কাছে কি কোনো সংবাদ আছে?

না, তা নেই। সম্রাট, আপনাকে পরীক্ষা করে দেখলাম, আপনি কতটা শক্ত। বলে হাসলেন সম্রাজ্ঞী।

আমি জানি আপনি কতটা প্রেরণার উৎস। আমার বিশ্বাস, যুদ্ধের মাঠে আপনার এই প্রেরণাই আমাকে শক্তি জোগাবে।

আপনি এখন শয়ন করবেন না, সম্রাট?

আমি আরও কিছু সময় কাজ করব। তারপর শয়ন করব। আপনি যান। শয়ন করুন। বেশি রাত পর্যন্ত জাগরণ করবেন না। এখন স্বাস্থ্যের দিকে বেশি মনোযোগ দিতে হবে।

সম্রাজ্ঞী উঠে গেলে সম্রাট গ্রিক রাজকুমারীকে পত্র লিখতে বসলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *