মৌর্য – ২

অন্ত পাল ও দৌবারিককে সঙ্গে নিয়ে ঘোড়া ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে চন্দ্রগুপ্ত ও চাণক্য ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলেন। একটা নিরাপত্তা বাহিনীর ক্ষুদ্র অথচ চৌকস দল নিরাপদ দূরত্বে থেকে তাঁদের অনুসরণ করছে।

কিয়দ্দুর যাওয়ার পর একটি বাজার পাওয়া গেল। বাজারে লোকসমাগম আছে। চন্দ্রগুপ্ত ঘোড়া থেকে নামলেন এখানে। বোধ হয় হাটবার। দূরদূরান্ত থেকে ক্রেতা-বিক্রেতা এসেছে। বাজারে ব্যবসায়ীদের স্থায়ী ঘর আছে। ঘুরেফিরে দেখলেন। না, ব্যবসায়ীরা লোকদের ঠকাচ্ছে না। এখানে কড়ি নয়, কাকনিকা মুদ্রা দিয়ে ক্রয়-বিক্রয় চলছে। ওজনের বালাই নেই, চোখের আন্দাজে পরিমাণ ঠিক করে দরদাম হচ্ছে। চন্দ্রগুপ্তের ইচ্ছা হলো সব মিলিয়ে এরা কেমন আছে জানতে। একজন বলল, ভালো আছে, নন্দদের সময়ের চাইতে ভালো। নতুন রাজা কর কম নিচ্ছেন, তাই সব জিনিসের দাম সাধ্যের মধ্যে। সুখেই আছে। রাজকর্মচারীরা বাজার দেখভাল করছে। সরবরাহ বেশ, মজুতদারি নেই। কৃত্রিম সংকটের ষড়যন্ত্র করলে বিচার হচ্ছে, শাস্তি হচ্ছে।

সরকারি কর্মচারীরা দুর্নীতি করছে কি না, তা জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের একজন বলল, মাছ কখন জলপান করছে, তা নির্ণয় করা যেমন কষ্টকর, রাজকর্মচারীরা ঘুষ খাচ্ছে কি না, তা বলাও শক্ত। চাণক্যের কথাটা খুব পছন্দ হলো। তিনি তা নোট করে নিলেন।

এই বাজার থেকে আরেক বাজারে গিয়ে থামলেন এঁরা। বাজারটি গ্রামপর্যায়ের। সেচের সেঁওতি, শিকারের যন্ত্রপাতি, কাঠ, বাঁশ ও বেতের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিক্রয় হচ্ছে এখানে। কোনো দ্রব্যের দর-কষাকষি চলছে। রাজার মনে হলো, কিছু কিছু দ্রব্যের নির্দিষ্ট দাম থাকা দরকার। একটু অগ্রসর হয়ে খোলা জায়গায় গিয়ে চাণক্যকে লক্ষ্য করে বললেন, আচার্য, আমার মাথায় একটা ব্যাপার ঘুরছে। বাজারের নিম্নপর্যায় থেকে শুরু করে রাজসরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত ব্যাপারগুলো দেখার জন্য নিয়ন্ত্রণকারী নিয়োগ করা যায় না?

মহামান্য সম্রাট, একই বিষয় ভাবছিলাম আমিও। প্রশাসনিক শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সব পর্যায়েই সরকারের দায়িত্বশীল লোক থাকা দরকার।

আচার্য, তাহলে পাটালিপুত্রে ফিরেই একটা পরিকল্পনা দিন। আমার বিশ্বাস, আপনি অসাধারণ এক পরিকল্পনা দিতে পারবেন।

চাণক্য মনে মনে ভাবলেন, আগামীকালই তার একটা রূপরেখা জানতে পারবেন সম্রাট। মুখে বললেন, আমি চেষ্টা করব। আপনার ইচ্ছাই প্রতিফলিত হবে। শুভস্য শীঘ্রম।

এঁরা এ স্থান ত্যাগ করে ঝিলাম নদীর পাশে চলে এলেন। বিকেলের সোনালি রোদে ঝিলামের পানি ঝলমল করছে। এক জায়গায় এসে দৌবারিক বললেন, মহামান্য সম্রাট, আমাদের রাজ্যের সীমানা এখানে শেষ।

তার মানে আর যাওয়া যাবে না? সম্রাট প্রশ্ন করে হাসলেন। কিন্তু থামলেন না, ঘোড়ায় চড়েই এগিয়ে চললেন। দৌবারিক চাণক্যের দিকে তাকালেন। চাণক্য বললেন, আমরা ঘোড়ার ব্যবসায়ী, যেতে বাধা দেখছি না।

কিছু দূরে একটা সুরম্য অট্টালিকা দেখা গেল। সম্রাট বললেন, এ অট্টালিকা কার? দৌবারিক বললেন, মহামান্য সম্রাট, এটা গ্রিক সম্রাট সেলুকাস নিকেটরের প্রমোদপ্রাসাদ। সম্রাজ্ঞী আপামা অব সোগদিয়ানার জন্য নির্মাণ করে দিয়েছেন, বললেন অন্ত পাল। চাণক্য বললেন, আলেকজান্ডারের পদাতিক বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন। সম্রাটের মৃত্যুর পর অধিকৃত পূর্বাঞ্চলে সেলুসিড সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন।

আমি এ প্রমোদপ্রাসাদ দেখতে যাব। সম্রাটের এ কথা শুনে দৌবারিক সম্ভাব্য ঝামেলার কথা ভেবে অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেলেন। মৃদুস্বরে চাণক্যের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। চাণক্য তাঁকে কিছু না বলে অন্ত পালকে বললেন, তুমি আগে গিয়ে অবস্থা দেখে এসো। আমরা ঘোড়ার ব্যবসায়ী, এ কথা যেন মনে থাকে।

প্রাসাদের সামনে একটা বিরাট উদ্যান। উদ্যানে ইরানি গোলাপ, গ্রিক ক্যামেলিয়া আর ভারতীয় নানা ফুল ফুটে আছে। চাণক্য বললেন, আপামা পুষ্পপ্রেমী সম্রাজ্ঞী। পারস্যের রাজকন্যা।

পারস্যরাজ স্পিটাম্যানের মেয়ে? সম্রাটের এ প্রশ্নের জবাবে চাণক্য বললেন, স্পিটাম্যানের পরাজয়ের পর রাজকন্যাকে সঙ্গে নিয়ে ভারত অভিযানে আসেন সেলুকাস। এক বছর পর তাঁদের প্রথম সন্তান এন্টিওকাসের জন্ম হয়। পরের বছর আপামাকে বিয়ে করেন বেশ ঘটা করে।

আলেকজান্ডারও পারস্যের রাজা দরায়ুস তিনের কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন।

অনেক মেসিডোনিয়ানই পারস্যে বিয়ে করেছিলেন। সবাই তাঁদের ‘সুসা স্ত্রী’দের ছেড়ে চলে গেলেও সেলুকাস আপামাকে ছেড়ে যাননি, তাঁকে সম্রাজ্ঞীর মর্যাদায় বাকি জীবন সঙ্গে রেখেছেন।

‘সুসা স্ত্রী’ মানে কী?

পারস্যের সুসায় এঁরা সবাই স্ত্রী পরিগ্রহ করেছিলেন, বললেন চাণক্য

সবাই? শুনে হাসলেন সম্রাট।

দিয়াদোচি থেকে সাধারণ সৈন্য, প্রায় সবাই। এটা একধরনের বর্বরতা। বিজয়ীরা বিজিতদের প্রতি এ রকম ব্যবহারই করে আসছে, বললেন চাণক্য।

এঁরা অট্টালিকার বহিরতোরণে পৌঁছালে দ্বারবারিক দুজন গ্রিক সেনা পোশাকে মার্চ করে এসে তাঁদের সামনে দাঁড়াল। অন্ত পাল বললেন, আমরা আরবীয় ঘোড়ার ব্যবসা করি। বড় অভিজাত ঘোড়া। ভেতরে যেতে দাও, এ নিয়ে কথা বলব।

দ্বারবারিকদের কাছে তাদের ঘোড়া বিক্রেতা বলেই মনে হলো। একজন বলল, দাঁড়াও, আমি ভেতর থেকে অনুমতি নিয়ে আসি।

রাজকুমারী কর্নেলিয়া আরবীয় ঘোড়া খুব পছন্দ করেন। তিনি নদীপাড়ে কতিপয় গ্রিক তরুণীর সঙ্গে খেলা করছিলেন। দ্বারবারিকের কথায় তিনি আগ্রহ দেখালেন এবং এঁদের ভেতরে নিয়ে আসতে নির্দেশ দিলেন।

ঝিলাম নদীর দিকে মুখ করে অট্টালিকাটি নির্মাণ করা হয়েছে। সামনে ফুলের বাগান। নদীতীরে শানবাঁধানো ঘাট। বিকেলের সোনালি রোদ সবকিছুকে স্বর্ণময় করে তুলেছে। রাজকুমারী খেলার পোশাকে শানবাঁধানো ঘাটের ওপর বসলেন। দ্বারবারিকদের একজন চন্দ্রগুপ্তদের মাথা নত করে অভিবাদন জানাতে বললেন। এঁরা তাই করলেন। কিন্তু চন্দ্ৰগুপ্ত মৌর্য রাজকুমারীর ওপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলেন না। রাজকুমারীর চুল জুলফির মতো ছাঁটা। ফ্রকটাও সে রকম করে শরীরের সঙ্গে আঁটা। জুতো পরেছেন মোজা ছাড়া, পায়ের সবটাই ফাঁকা। এটা গ্রিক তরুণীদের ঐতিবাহী পোশাক। মাথায় যথারীতি শিরস্ত্রাণ আছে।

তাহলে তোমরা ঘোড়ার ব্যবসায়ী?

চাণক্য বললেন, আমাদের কাছে মঙ্গোলীয়, আরবীয়—সব রকম ঘোড়াই আছে। রাজকুমারীর যদি কোনোটা পছন্দ হয়। চাইলে ভারতীয় খর্বাকৃতির ঘোড়াও সরবরাহ করা যাবে।

রাজকুমারী বললেন, না না, তোমার মতো খর্বাকৃতির ভারতীয় ঘোড়া আমার চাই না।

রাজকুমারীর কথা শুনে গ্রিক তরুণীরা হেসে লুটোপুটি খেল। লজ্জার ভান করে চাণক্য সম্রাটের দিকে তাকালেন। সম্রাট তখনো রাজকুমারীর দিকে তাকিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেছেন।

রাজকুমারী আবার বললেন, আরবীয় ঘোড়া দেখাও তোমরা।

অন্ত পাল চন্দ্রগুপ্তের ঘোড়াটাই নিয়ে এলেন। সাদা ঘোড়া। তেলতেলে। ঘোড়াটা রূপসী রাজকুমারীকে দেখে মাথা নাড়ছিল, ছটফটও করছিল। রাজকুমারীর একে ভালো লেগে গেল। বললেন, এটাই আমি নেব।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এবার চাণক্যের দিকে তাকালেন। চাণক্য রাজকুমারীকে বললেন, একবার চড়ে দেখবেন, রাজকুমারী?

রাজকুমারী কাউকে কিছু না বলেই লাফ দিয়ে ঘোড়ার ওপর চড়ে বসলেন। ঘোড়াটা অসহিষ্ণুভাবে লাফাতে শুরু করল। চন্দ্রগুপ্ত দৌড়ে এসে ঘোড়ার লাগাম ধরে রাজকুমারীর দিকে একেবারে কাছে থেকে তাকিয়ে বললেন, ক্ষমা করবেন, রাজকুমারী, এটি আপনার বশ্য নয়, আরেকটি দেখাই।

রেগে গিয়ে রাজকুমারী বললেন, বশ্য নয়, এমন ঘোড়া নিয়ে এসেছ কেন?

তার কোনো জবাব না খুঁজে পেয়ে অথবা জবাবের চেষ্টা না করেই রাজকুমারীর রাগান্বিত চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলেন চন্দ্রগুপ্ত। তাঁকে বিচলিত নয়, মুগ্ধই মনে হলো।

এই অবস্থায় চাণক্যকেই কথা বলতে হলো, রাজকুমারী, এটি আপনার মতোই কম বয়সী এক অনভিজ্ঞ ঘোড়া, তা বুঝতে পারি নি। আমাদের অনেক সুদর্শন ও প্রশিক্ষিত ঘোড়া রয়েছে, একদম নাদুসনুদুস। আপনার পছন্দ হবে।

রাজকুমারী এ কথায় আরও খেপে গেলেন। পরে নিজেই সংযত হয়ে বললেন, মানুষের সঙ্গে ঘোড়ার তুলনা করতে হয় না। বেশ, অন্য ঘোড়াগুলো দেখাও।

চাণক্য এবার চন্দ্রগুপ্তের দিকে তাকালেন। চন্দ্রগুপ্ত খুব কাছে থেকে রাজকুমারীর দিকে তাকিয়ে আছেন। রাজকুমারীও তাঁর দিকে তাকালেন। হঠাৎ চার চোখ মিলিত হয়ে গেল। চন্দ্রগুপ্ত যেন শরবিদ্ধ হলেন, তৎক্ষণাৎ অশ্বরশি ছেড়ে দিয়ে সরে এসে নিচের দিকে তাকালেন। রাজকুমারী এর অর্থ বুঝতে পারলেন না, তিনিও অশ্ব থেকে নিচে নেমে এলেন এবং চাণক্যকে উদ্দেশ করে আবার বললেন, কী, অন্য ঘোড়াগুলো আনুন।

অন্য ঘোড়াগুলো এত সুন্দর ছিল না। তাই আরেক দিন বেশ কটা সুন্দর ও অতিবশ ঘোড়া নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অশ্ব বিক্রেতারা ফিরে এলেন। চন্দ্রগুপ্ত বার কয়েক ফিরে তাকালেন, কিন্তু রাজকুমারী অশ্ব বিক্রেতাদের প্রতি দ্বিতীয়বার আর তাকানোর প্রয়োজন বোধ করলেন না। ঝিলাম নদীর জল পড়ন্ত বিকেলের সোনালি রোদে যেভাবে ঝলমল করে বইছিল, সেভাবেই বইতে থাকল। বাগানের নানা দেশীয় ফুল যেভাবে বাতাসে দোল খেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে হাসছিল, সেভাবেই জড়াজড়ি করতে থাকল। রাজকুমারীরা আবার নিজেদের গ্রিকদেশীয় খেলায় মত্ত হলেন। শুধু চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য পূর্বের অবস্থায় থাকতে পারলেন না, কোথায় যেন একটু সমস্যা হচ্ছে। সমস্যাটি হৃদয়ঘটিত। সেখানে কী যে ঘটছে এবং কতটা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ঘটছে, তা নির্ণয় করার ক্ষমতা এই সম্রাটের নেই। তাই তিনি খানিকটা অস্থিরও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *