মৌর্য – ৩৭

৩৭

নিকোমেডেস এসেছে। আগের মতোই চঞ্চল ও উচ্ছ্বাসপ্রবণ।

দেখ, তুই আমার পিছু লাগবি না। আমরা এখন বড় হয়েছি, বললেন কর্নেলিয়া।

তা তো দেখতেই পাচ্ছি। চুল লম্বা হয়েছে। হাত লম্বা হয়েছে। আরও কত কী দেখা যাচ্ছে, যা আগে দেখা যেত না। মন উড়ে বেড়াচ্ছে, আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।

লম্বা হাতে একটা ঘুষি মেরে তোর নাকটা ফাটিয়ে দেব।

তুই তো দেখছি আগের মতোই দস্যি আছিস। আয় আমরা আপস করে নিই। বলে ছেলেবেলার মতো নিকোমেডেস ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমা এগিয়ে দিল। কর্নেলিয়া তা মেনে নিয়ে তাঁর তর্জনী এবং মধ্যমা স্থাপন করলেন অঙ্গুলিদ্বয়ের ওপর।

মা সব কথা বলেছে। তোর মানসিক অস্থিরতার কথাও জেনেছি। বন্ধু হিসেবে তোকে একটা পরামর্শ দেব, অযাচিত ভাববিনে, তোর উচিত চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে দেখা করা।

তার সঙ্গে দেখা হবে যুদ্ধের ময়দানে।

তাহলে তুই এখানে কেন? চল যুদ্ধের ময়দানে যাই।

নিশ্চয়ই যাব। যুদ্ধ এখনো শুরু হয় নি, আর তোর যাওয়ার দরকার কী? তুই তো যুদ্ধ করতে জানিস না।

তুই বোধ হয় জানিস না, টলেমির সেনাবাহিনীতে কাজ করছি আমি।

পিসি সে কথা কখনো বলেন নি।

মা সে কথা জানেন না।

বলিস কী?

শখ করে করছি, নিয়মিত না।

নানা (টলেমি) মিসরীয় বাহিনীতে কাজ করার সুযোগ দিলেন। আমাকে অবশ্য নৌবাহিনীতে কাজ করতে হয়।

টলেমি সেলুকাসের চাচা। বয়সে প্রায় সমসাময়িক। আলেকজান্ডারের একজন জেনারেল ছিলেন। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তিনি মিসর দখল করে নেন এবং নিজেকে শাসক ঘোষণা করেন। তিনি একসময় নিজেকে মিসরের একজন ফারাও হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করেন। তার বংশধরেরা প্রায় তিন শ বছর মিসর শাসন করেছেন। কর্নেলিয়া বললেন, তুই নৌসেনা, তোকে নিয়ে কী কাজ হবে?

আরে, আমি সেলুসিড বাহিনীতে যুদ্ধ করব নাকি, আমি তোকে প্রোটেক্ট করব। তোর দেহরক্ষী হিসেবে যাব।

তোর দেহরক্ষা করবে কে?

দেহরক্ষার অর্থ জানিস?

মানে কী?

দেহরক্ষা মানে মৃত্যু।

আচ্ছা, তোর মৃতদেহই রক্ষা করব আমি, বলে হাসলেন কর্নেলিয়া। তোর সামরিক পোশাক

আছে?

আছে।

পরিধান করে আয়। আমিও আমারটা পরে নিই।

এখনই যাবি নাকি?

না। আমাদের কেমন লাগে, দেখতে হবে না? আমরা পোশাক পরে লাউডিসকে চমকে দেব।

কেন?

সে এক জেনারেলের বউ, কিন্তু ভিতুর ডিম। লাউডিস তোকে খুব পছন্দ করে। জানি।

তোর গার্লফেন্ড কেউ নেই?

নিকোমেডেস হেসে দিয়ে বলল, কেন শত্রুর খোঁজ করছিস? আগে চন্দ্রগুপ্তকে হত্যা করে আয়।

বলবি না, এই তো?

ফাওলিনের কথা কেউ জানে না। মা-ও না।

তাহলে তোর মাথা খেয়ে বসে আছে ফাওলিন। কে সে?

এক জেনারেলের মেয়ে। নিজের ছবি এঁকেছে সে, দেখবি?

কই, দেখি। ছবি দেখে অবাক হন কর্নেলিয়া। আরে, এ দেখছি এক পুতুল!

দেখে সে রকমই মনে হয়। মা মিসরীয়। তাই দেখতে এমন হয়েছে।

ছবি তো দারুণ আঁকে।

বলতে পারিস।

তোর ছবি আঁকে নি?

এঁকেছে। দুটোই তার কাছে রয়ে গেছে।

দুটো মানে?

একটি কাপড়ে, আরেকটি অন্তরে।

পাজি কোথাকার। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। চমৎকার তো।

এখন কাউকে বলবি না। মাকে একেবারেই না।

যা, এবার তৈরি হয়ে আয়।

সামরিক পোশাকে দুজনকে দেখে লাউডিস ভাবলেন, নিম্নপদস্থ অফিসাররা কেউ দেখা করতে এসেছে। এরা হয়তো এখনো যুদ্ধে যায় নি অথবা সেলুসিয়া রক্ষার দায়িত্বে আছে। না চিনতে পারার কারণ হলো, হেলমেটের সঙ্গে মুখাবরণীটা এমনভাবে যুক্ত যে শুধু চোখ দুটোই দেখা যায়। গলাবন্ধ, বর্ম, কোমরবন্ধনী, গ্লাবস সারা শরীর ঢেকে রেখেছে। কর্নেলিয়ার হাসি হাসি ভাব। কিন্তু নিকোমেডেস সৈনিকোচিত গাম্ভীর্য বজায় রেখেছে। চোখ দেখেই বোঝা যায়। আরেকটি পার্থক্য আছে, গভীরভাবে দেখলে বোঝার কথা। পোশাকে সেলুসিড আর্মির নতুন মাত্রা, যেটি টলেমির আর্মিতে নেই।

লাউডিস এসব লক্ষ না করেই ফরমালভাবে বসতে বললেন। খোঁজখবর নিলেন। কথা বলছে শুধু নিকোমেডেস। কর্নেলিয়া শুধু মাথা নাড়ছেন। যতক্ষণ ধরা পড়া না যায়। এরই মধ্যে হারমিজ এসে উপস্থিত হয়েছে। কর্নেলিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, আন্টি, তুমি এ পোশাক পরেছ কেন?

লাউডিস অবাক হয়ে বললেন, আন্টি?

মা, তুমি চিনতে পারো নি? কর্নি আন্টি, কী বোকা তুমি!

কর্নেলিয়া! ও কে? লাউডিস অবাক হলেন।

তুই দিদি চিনতে পারলি না? নিকোমেডেস।

তাই তো বলি, সেলুসিড ইউনিফর্ম তো এ রকম নয়। নিকো, তুই আগের মতোই আছিস। আর থাকতে পারলাম কোথায়, কর্নেলিয়ার সঙ্গে আপস হয়ে গেছে। কোনো লাগালাগি নয়। আমাদের বঞ্চিত করলি?

দেখ নিকো, আমাদের লাগালাগি আর মারামারিটা ওদের কত পছন্দ। শোন দিদি, আমরা যুদ্ধে যাচ্ছি। তুই তোর স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলে তৈরি হয়ে নে, তবে যুদ্ধের পোশাকেই তোকে যেতে হবে।

কী মজা, আমিও যাব, বলে লাফাতে শুরু করল হারমিজ।

এই মেয়ে থাম, তোর মা গেলে তো তুই যাবি, তোর মা মনে হয় যাবে না। যা ভিতুর ডিম।

কর্নেলিয়ার কথার পিঠে লাউডিস বললেন, সত্যি সত্যিই তুই যুদ্ধ করতে যাচ্ছিস? নিকো, তুই বল তো ভাই, তার মাথা কি ঠিক আছে?

আমার মাথা ঠিক আছে। তুই দেখে নিস, মৌর্য সম্রাটকে আমি বন্দী করে আনবই।

পাগলামি করবি না, বলে দিচ্ছি। যুদ্ধটা ছোটদের খেলা নয়। নিকো, পিসি তোকে যেতে দিল?

যেতে দেবে না কেন? ও তো সৈনিক।

সেলুসিড আর্মির হয়ে কী করে যুদ্ধ করবে?

যুদ্ধ করবে না। আমার বডিগার্ড হিসেবে সঙ্গে যাবে।

তুই রাজি হলি, নিকো? তোর কি কোনো সম্মানবোধ নেই?

আপসের মামলা রে দিদি। রাজি না হয়ে উপায় কী?

উদ্দেশ্যটা কী তোদের, বল তো?

নিকোমেডেস বলল, কর্নি চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে দেখা করতে চায়।

আমি চেয়েছি, না তুই পরামর্শ দিয়েছিস?

ওই একই হলো। আমরা পরস্পরের সম্মতিতে যেতে সম্মত হয়েছি।

আমি যুদ্ধে যেতে চেয়েছি, সাক্ষাৎ করতে নয়।

পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রাক্কালেই সাক্ষাটা হবে। ওই মধুর দৃশ্যটা দেখার জন্যই মুখিয়ে আছি।

যুদ্ধের দৃশ্য তোর কাছে মধুর দৃশ্য, না?

আমার কাছে এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর নেই। তুই একজন সম্রাটকে বন্দী করবি, এ দৃশ্য মধুর না হয়ে পারে?

মজা করছিস?

লাউডিস হেসে দিয়ে বললেন, আপসচুক্তি কি তাহলে ভেঙে গেল?

কর্নেলিয়া দ্রুত বললেন, না না, চুক্তি আমাদের ঠিক আছে, না রে নিকো?

অবশ্যই। আমরা যা-ই বলি না কেন, চুক্তি আমাদের ঠিক থাকবে। শৈশবের মতো কর্নি মারামারি করলেও তা ভাঙবে না, বলে উচ্ছ্বসিত হাসি হাসল সে।

আসলেই কি যাচ্ছিস তোরা?

নিকোমেডেস বলল, একটা মিশন আছে আমাদের। অভিযানও বলতে পারিস।

কী অভিযান?

কর্নেলিয়াকে চন্দ্রগুপ্তের মুখোমুখি করা।

উদ্দেশ্য?

উদ্দেশ্য মহৎ। দুজনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা। আমার মনে হয় কর্নেলিয়াকে দেখলেই বেটা আত্মসমর্পণ করবে। তোর জেনারেলরা বিনা যুদ্ধে জয়লাভ করবে।

প্রতিক্রিয়া দেখবি তুই? তোর মাথাটা কেটে নেবেন সম্রাট। পাগলামি ছেড়ে দে। তুই সৈনিক হয়েছিস, যুদ্ধের নীতি-নিয়ম কিছু জানিস না।

তাহলে পরীক্ষাটা হয়ে যাবে যুদ্ধ বড়, না প্রেম বড়। যুদ্ধ আর প্রেম কোনো নিয়ম মেনে চলে না। গেলে তুই তা দেখবি।

আমি যাব তোদের এসব ছেলে মানুষি দেখতে? আমি কখনো যাব না।

হারমিজ এতক্ষণ আশা করেছিল তার মা-ও যাবেন। হতাশ হয়ে অনুনয়ের সুরে বলল, চলো না, মাম্মি। বাপির যুদ্ধ দেখব। চলো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *