মৌর্য – ৩২

৩২

চাণক্য আজীবিকদের একটি মঠে গেছেন। বিহারসংলগ্ন মঠে আচার্যরা আছেন, শ্রমণরাও আছে। আজীবিক ধর্মটা হচ্ছে শ্রমণ বিদ্রোহের ফল। কেন এরা জৈন কিংবা বৌদ্ধধর্মের শিক্ষা ও আদর্শ পরিত্যাগ করে বিদ্রোহ করেছে, তা বলা মুশকিল। নিয়তিনির্ভর এই ধর্মের কাছে চাণক্যের মতো একজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের আত্মসমর্পণও বিস্ময়কর ও রহস্যজনক। ব্যক্তিজীবনে তিনি অত্যন্ত বাস্তববাদী মানুষ, তীক্ষ্ণ ধীসম্পন্ন ও কূটকৌশলী। ইচ্ছার পরাধীনতা যে ধর্মের মূল কথা, হতাশা, নাস্তিক্য ও কৃচ্ছ্রব্রত যে ধর্মের মূলমন্ত্র, চাণক্যের প্রকৃতির সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। তাহলে রহস্যটা কী?

চাণক্যের আগমনে মঠ স্বাভাবিকভাবেই প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। চাণক্য একা নন, সুবন্ধুকেও নিয়ে এসেছেন। সুবন্ধু শুধু তাঁর নীতিজ্ঞান শিষ্য নন, ভাবশিষ্যও। স্বাভাবিক কারণেই আচার্যগণ ধর্মের সাধারণ বিষয় নয়, উচ্চমার্গীয় ধর্মতত্ত্ব ও বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিক বিষয় নিয়ে কথা বলেন। মঠের প্রধান আচার্য বললেন, ভারতীয় দর্শনের কর্মফলবাদ হচ্ছে একটা ভুল ও বিভ্রান্তিকর মতবাদ। কারণ, সবকিছুই ঘটছে পূর্বনির্ধারিত মহাজাগতিক নিয়মে। মানুষ যা করছে, মহাবিশ্বের নিয়মই তা তাকে করাচ্ছে।

আচার্য একটু থামলেন। আবার বললেন, সবকিছু পূর্বনির্ধারিত বলে ধর্ম-কর্ম ভাগ্যে পরিবর্তন আনতে পারে না। সত্য নির্বাচন প্রচেষ্টা তাই অর্থহীন। নীতির প্রশ্নও তাই অবান্তর। নীতির তত্ত্বটা একেবারেই ভুয়া।

আচার্য দার্শনিক বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে বললেন, সত্তার প্রকৃতি ও জ্ঞানসংক্রান্ত দর্শনশাস্ত্র কিংবা অধিবিদ্যা পরমাণু তত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এখানে সবকিছুই পরমাণুর মিশ্রণ। গুণাগুণটা ধরা পড়ে পরমাণুর যৌগকর্মে। তবে এসব যৌগিক ও প্রাকৃতিক কর্মকাণ্ড মহাজাগতিক শক্তি পূর্বেই নির্ধারণ করে রেখেছে।

এ পর্যায়ে চাণক্য হাত তুলে আচার্যকে থামতে ইঙ্গিত করলেন ও বললেন, ধর্মবিশ্বাস ও ধর্ম প্রতিপালনের জন্য কথাগুলো বেশ ভারী। আমরা এখানে ভবিষ্যতে সহজ কথা শুনব। তবে এখন ধ্যাননিমগ্ন হতে চাই, আচার্য, এটাই আমার জন্য পরম প্রার্থিত।

আচার্য ও মহামন্ত্রী চাণক্য ধ্যাননিমগ্ন হলেন। এখানে তিনি আসেন কিছু সময় নিবিড়ভাবে একা থাকার জন্য। দর্শন ও জ্ঞানচর্চার কাজটি তিনি সব সময়ই করেন, রাজনীতির কূটকৌশলের ঘুঁটি-চালাচালিও সার্বক্ষণিক চলে। ভারী বিষয়গুলোর মধ্যে এখন আর তাঁর কোনো আনন্দ নেই। এসব চালাচালি করে তিনি যে ঈশ্বর থেকে, মানবসমাজ থেকে, এমনকি নিজের থেকেও দূরে সরে গেছেন, তা উপলব্ধি করেই ভাগ্যের ওপর নিজেকে সঁপে দিয়েছেন এবং জীবনের জটিলতা থেকে বহু দূরে এসে ধ্যানমগ্ন হতে চেয়েছেন!

মঠ থেকে যাওয়ার পথে সুবন্ধুকে বললেন, কী বুঝলে?

সুবন্ধু এ রকম প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। হকচকিত হয়ে আচার্যের দিকে তাকালেন। আচার্য হেসে দিয়ে বললেন, এখানে এসে একটু দম নিলাম। এখন আচার্য ভদ্রবাহুর কাছে যাব, সেখানে দম নেওয়া বায়ুটা বিশুদ্ধ করা যাবে।

আমি জনতাম না আচার্য আপনি ভদ্রবাহুকে এত পছন্দ করেন।

পৃথিবীতে নিজেকে তুরে ধরার প্রধান উপায় হলো মানুষ চিনতে পারা। তিনি এমন এক স্বচ্ছ আয়না, যাঁর মধ্যে পাপ-পুণ্য সবই ভেসে ওঠে। নিজেকে দেখতে হলে তাঁর মুখোমুখি দাঁড়াবে।

তাঁর ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে আপনি একাত্ম নন কেন?

অর্থাৎ আমি জৈনধর্মে বিশ্বাসী নই কেন? ওটা পালন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

সুবন্ধু ভেবে পেলেন না চাণক্য ভদ্ৰবাহু সম্পর্কে এতটা উচ্চ ধারণা কেন পোষণ করেন। হয়তো উচ্চতা পরিমাপ করার একটা মানদণ্ড চাণক্যের মধ্যে আছে। অযচ সুলভদ্ররা তাঁকে গুরু হিসেবে শ্রদ্ধা করেন বটে কিন্তু এতটা উচ্ছ্বসিত নন। হয়তো তাঁর সান্নিধ্যে সব সময় থাকেন বলে অথবা উচ্চতাটা পরিমাপ করার সক্ষমতা নেই বলে উচ্ছ্বসিত নন।

.

ভদ্রবাহু সুলভদ্রসহ আলোচনা করছেন। ব্যাপারটা একটু জটিল। তবে তা কোনো ধৰ্মীয় বা আধ্যাত্মিক বিষয় নয়, বাস্তব জীবদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বিষয়। তাঁর এক শিষ্য এসেছে জমি বিক্রয়ের পরামর্শের জন্য। জমিটা সে প্রতিবেশীর কাছে বিক্রয় করতে চায় না। প্রতিবেশী জোর করছে সে নেবে—অর্থ দিয়েই নেবে।

স্থুলভদ্র বলছেন, তুমি তোমার জমি যে কারোর কাছে বিক্রয় করতে পারো।

ভদ্রবাহু তাঁর মতের বিরোধিতা করে বললেন, তুমি ভুল বলেছ। অগ্রক্রয়াধিকার বলে একটা কথা আছে। কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে কথাটা পরিষ্কার করেছেন। তোমার নয় জমিটা, সব জমিই রাজার। তুমি হস্তান্তর করতে পারো অর্থের বিনিময়ে। তাই রাজার আইন তোমাকে মান্য করতে হবে। প্রতিবেশীর কাছেই জমি বিক্রয় করবে।

এ সময় আচার্য চাণক্য উপস্থিত হলেন। আলোচনার বিষয় এবং ভদ্রবাহুর সিদ্ধান্তের কথা শুনে উচ্ছ্বসিত হাসি হেসে বললেন, আচার্য ঠিক কথাই বলেছেন।

।ধন্যবাদ আপনাকে আপনার মন্তব্যের জন্য।

কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি সব বিষয়ে আপনার বাস্তব জ্ঞান দেখে। কোনো আধ্যাত্মিক আচার্য এ রকম বাস্তব ও বস্তুনিষ্ঠ হন না।

যুদ্ধযাত্রার কথা বলুন, কবে যাত্রা শুরু করবেন।

এটা নির্ভর করছে সম্রাটের ইচ্ছার ওপর।

জানেন, কৌটিল্যের অনেক বিষয়ের সঙ্গে আমার মত মিলে যায়।

যেমন?

কৌটিল্য যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তির কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, সব অবস্থাতেই শান্তি সম্পদ সৃষ্টি, উন্নয়ন ও নিরাপত্তায় জনসাধারণের জন্য সহায়ক। আর যুদ্ধ শুধু ধ্বংস, ক্ষতি, ব্যয় ও ঘরছাড়া করে। যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। আপনি নিশ্চয়ই কথাটা জানেন। বলে মিটিমিটি হাসলেন ভদ্ৰবাহু।

চাণক্যও হাসলেন, অর্থাৎ কথাটা তিনি ভালোভাবেই জানেন। বললেন, তারপরও এ যুদ্ধের পরামর্শটা আমার। কারণ আছে। আপনি সম্ভবত তা জানেন। তবে তা-ই একমাত্র কারণ নয়। গ্রন্থে যা-ই বলা হোক, বাস্তব ভিন্ন। যুদ্ধ হয় প্রতিরক্ষার জন্য, যুদ্ধ দেশ দখল করার জন্যও, কৌটিল্য কথাটা জানেন। সে জন্য বলেন, যুদ্ধজয়ের অর্থ হচ্ছে ভূমির দখল, শত্রুদের নিধন, শক্তি প্রয়োগে বিরোধ নিষ্পত্তি, লোকেদের পক্ষ, এমনকি ধর্মত্যাগ, কুসংস্কার আর প্রপাগান্ডার ছড়াছড়ি, পক্ষ-বিপক্ষে সৈন্যের মৃত্যু-ধ্বংস এবং এর জন্য আনন্দ আর নারী এবং সম্পদের অধিকার, বলে আবার হাসলেন চাণক্য।

ভদ্রবাহু বললেন, সম্রাট যখন জানতে চাইলেন এ যুদ্ধের ফলাফল কী হবে, আমি বলে দিলাম, মৌর্যদের বিজয় সুনিশ্চিত। এ যুদ্ধটা মনে হয় খুবই অনিবার্য।

চাণক্য প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলেন। আজ আজীবিক মঠে দীর্ঘক্ষণ ধ্যাননিমগ্ন রইলাম। কিন্তু কি জানেন, আচার্যরা ভাবেন, জ্ঞানগর্ভ কথা শুধু আমাকেই শোনাবেন—হোক বিজ্ঞান, দৰ্শন বা তাত্ত্বিক কিছু। এসবে কি শান্তি আছে? এখানে (মঠে) এসে নির্ভার হতে চাই আমি। আপনার সান্নিধ্যও আমাকে শান্তি এনে দেয়।

সুবন্ধুকে উদ্দেশ করে বললেন, যাও, স্থূলভদ্রকে নিয়ে কোথাও থেকে ঘুরে এসো।

স্থূলভদ্র ও সুবন্ধু বাইরে গেলেন।

আমি বলেছি যুদ্ধ করেই রাজকুমারীকে জয় করতে হবে, পূর্বকথার জের ধরে বললেন চাণক্য। আমার মনে হয় আকাঙ্ক্ষাটা প্রেমঘটিত। কথায় সে রকম মনে হলো সম্রাটের, বললেন ভদ্রবাহু। যোগ করলেন, আমার জানামতে পত্র যোগাযোগও হয়েছে।

তা আমি জানি। গুপ্তচরেরা সে কথা আমাকে বলেছে।

যুদ্ধজয়ের আগে তাহলে হৃদয় জয় করেছেন সম্রাট। সাক্ষাৎ হলো কোথায়?

ঝিলাম নদীর প্রমোদপ্রাসাদে। রাজকুমারী চিনতে পারেন নি। সম্রাট অশ্ব ব্যবসায়ীর বেশে প্রবেশ করেছিলেন।

অদ্ভুত এক গল্প। তবে আমি অবাক হচ্ছি অন্য একটি ব্যাপার ভেবে। মাতা বিমাতাসুলভ আচরণ করলেও সম্রাট নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং অন্য রাজা বা সম্রাটদের মতো দাসী কিংবা অন্য নারীতে আসক্ত নন।

এ নিয়ে আমিও ভেবেছি। যুদ্ধজয়ের পরও নয় কেন?

ব্রাহ্মণ হলে হয়তো আসক্তি থাকত, বলে হো হো করে হেসে দিলেন ভদ্ৰবাহু।

ব্রাহ্মণরা জীবনবাদী মানুষ। ভোগ তো এঁরা পেয়েই থাকেন। মহাভারতে যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেকে ব্রাহ্মণদের মধ্যে দাসী বিতরণ করা হয়েছিল।

আপনি তো ব্রাহ্মণ্যত্ব পরিত্যাগ করে চলে এলেন আচার্য। আমাকে ছাড়তে হলো শৈশবে, বলে আবার হো হো হাসলেন ভদ্রবাহু এবং শেষে বললেন, নারীরাও মানুষ, রাজা ও ব্রাহ্মণদের এ রকম আচরণে নারীর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। আমিও ব্রাহ্মণ ছিলাম বলে এ কথা বলতে পারলাম।

সেলুকাস পারস্য জয়ের পর রাজকুমারী আপামাকে ভোগসঙ্গী করেন। তাঁদের প্রথম সন্তান এন্টিওকাসের জন্মের পর তাঁদের বিয়ে হয় বেশ ধুমধাম করে। এটি সম্ভব হয়েছে আপামার ব্যক্তিত্ব আর প্রেমের জন্যই। আমাদের সম্রাট বিয়ে করতে চান গ্রিক রাজকুমারীকে।

ওদের সমাজে যেটা স্বাভাবিক, আমাদের ভারতীয় সমাজ ও সংস্কারে তা চলে না। শুনেছি সেলুকাসের দ্বিতীয় স্ত্রী তাঁর সৎছেলে এন্টিওকাসকে বিয়ে করেছে। ভারতীয় সমাজ কখনো তা মানবে না।

সেলুকাস বেঁচে থাকতেই এ ঘটনা ঘটেছে। কী মর্মান্তিক! রাজকুমারী সম্পর্কে আমাদের গোয়েন্দারা খোঁজখবর নিয়েছে। তিনি মর্যাদাসচেতন। তাঁর মা ও এন্টিওকাসকে তিনি ক্ষমা করেন নি। পিতার ওপরও এ ব্যাপারে তাঁর চাপা ক্ষোভ রয়েছে।

আপনি আপনার কাজ করেছেন আচার্য। সম্রাট কি তা জানেন?

সম্রাট অনেক কিছুই জানেন না। তাঁকে সব জানতে দেওয়া যায় না। তবে তরুণ বয়স থেকে এখন তাঁর মধ্যে যে ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে, তা খুবই লক্ষণীয়। তাতে আমি আপনার আশীর্বাদের ছায়া দেখি।

এভাবে বলছেন কেন? সম্রাট বানানোর কৃতিত্ব আপনার, এ কথা সবার জানা। আর মানুষ তৈরি করেছেন আপনি। সে কৃতিত্ব আপনাকেই দিতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *