মৌর্য – ৩৯

৩৯

গান্ধারা রাজপ্রাসাদে সম্রাজ্ঞী দুরধরা ভালোই আছেন। তক্ষশীলার নামীদামি বৈদ্যরা নিয়মিত তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন। রাজবৈদ্য তো আছেনই। তারপরও তাঁর উৎকণ্ঠার শেষ নেই। কোনো একটি ব্যাপারকে কেন্দ্র করে তাঁর উৎকণ্ঠার সূচনা হয় এবং ক্রমে ক্রমে গাছপালার মতো শাখা- প্রশাখায় বিস্তৃতি ঘটায়। তাঁর আজকের উৎকণ্ঠার কারণ সামাণ্য। এই কয় দিন বড় উৎকণ্ঠায় সময় গেছে। তার যৌক্তিক কারণও ছিল। সম্রাট যুদ্ধক্ষেত্রে, সম্রাজ্ঞী উৎকণ্ঠিত থাকবেন, তা-ই স্বাভাবিক। গতকল্য তিনি মৌর্যদের প্রাথমিক বিজয়ের কথা শুনেছেন এবং জেনেছেন সম্রাট অক্ষত ও ভালো আছেন। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এত দিনের উৎকণ্ঠা দূর হলো বটে, কিন্তু সেস সংবাদ তাঁকে খুব আনন্দ দিল না।

আজ বিষয়টা ভিন্ন। যে দূত সুসংবাদ নিয়ে এসেছে, সে মন্দাকিনীকে সঙ্গে নিয়ে যাবে, সম্রাটের এই নির্দেশ। মন্দাকিনী কেন যাবে? এ প্রশ্ন থেকেই উদ্ভুত উৎকণ্ঠা। সাধারণভাবে চিন্তা করলে এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। সম্রাটকে সব সময় ঘিরে রাখে সুন্দরী তরুণীরা! এরা তাঁকে নিরাপত্তা দেয়। এ ছাড়া সম্রাটের সেবায় আরও অনেক দাসী নিয়োজিত থাকে। সম্রাজ্ঞী নিজেও বুঝতে পারছেন না এই ইস্যুতে কেন তাঁর অস্থির লাগছে। দাসীদের তিনি তখন বিবস্ত্র গায়ে জল ঢালতে বলেন। এক ওঝা পাটালিপুত্রে ঝাড়ফুঁক করেছিল, এখন তিনি তাকে কোথায় পাবেন, তা ভাবতে গিয়ে ‘ছৈরতাড়না’ আরও বেড়ে গেল।

চাণক্যের গোয়েন্দা নির্জলা দুদিন আগে এসেছিল। সম্রাজ্ঞীর প্রধান দাসীর সঙ্গে তার খুব ভাব। কথায় কথায় জানিয়েছিল, গ্রিক সম্রাটের এক কন্যা আছে। মৌর্য তাঁকে দেখেছেন।

কোথায় দেখেছেন?

তা তো বলতে পারি না।

এতে কী হয়েছে?

সম্রাজ্ঞী দুরধরাকেও এভাবে দেখে বিয়ে করেছিলেন।

প্রধান দাসী বলল, এ দেখার সঙ্গে সে দেখার পার্থক্য অনেক। মাথা থেকে তা দূর করে দাও। গোয়েন্দারা মাথা থেকে কিছু দূর করে না। তবু সে আর এ নিয়ে কথা বলে নি। প্রধান দাসী এটুকু কথাই দুরধরার কানে তুলেছিল। সে বীজ যে অঙ্কুরদ্‌গমে পরিণত হয়েছে, মন্দাকিনীর যুদ্ধশিবিরে যাওয়ার সংবাদে তা টের পাওয়া গেল। সম্রাজ্ঞী অবশ্য এখনো তা উপলব্ধি করতে পারছেন না। এত দাস-দাসীবেষ্টিত থেকেও চন্দ্রগুপ্তের কোনো চারিত্রিক দুর্নাম নেই, দুরধরার এই হচ্ছে সম্রাটের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। তারপরও মানুষের মন বলে কথা। কখন কী মর্জি হয়, কে জানে?

.

এদিকে সম্রাট মহামন্ত্রী, প্রধান সেনাপতি ও প্রতিটি বাহিনীর কর্মাধিকারিকদের নিয়ে পরিকল্পনা সভায় বসেছেন। যুদ্ধে বিজয়লাভের পাশাপাশি ক্ষয়ক্ষতির হিসাব-নিকাশ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়ন এ সভার উদ্দেশ্য।

সম্রাট বললেন, গ্রিকরা পাহাড়-জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে বসে থাকবে না, গুপ্ত আক্রমণ শানাবে! তাই এ পর্যায়ে আমাদেরও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে মনে হয়। তার আগে জানা দরকার আমাদের কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং এদের ক্ষতির পরিমাণই-বা কত।

মহামন্ত্রী চাণক্য কর্মাধিকারিকদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত, প্রথমে তোমরা বলো।

নৌজাহাজের অধিকর্তা (অ্যাডমিরাল) বললেন, নৌবাহিনীর তেমন ক্ষতি হয় নি। গ্রিকরা নৌযুদ্ধের জন্য কোনো ঝুঁকি নেয় নি। মনে হয় নৌযুদ্ধের পরিকল্পনা ছিল দ্বিতীয় পর্যায়ে।

সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে পদাতিক বাহিনীর, বলে একটা হিসাব দিলেন কর্মাধিকারিক (জেনারেল), নিহত পঞ্চান্ন হাজারের কিছু বেশি। তবে এ ক্ষেত্রে গ্রিকদের সংখ্যা ষাট হাজারের কাছাকাছি। আহত প্রায় ত্রিশ হাজার।

হস্তী মারা গেছে এক শ আশিটি। আহত দেড় শতাধিক। গজারোহী সৈন্য মারা গেছে প্রায় দুই হাজার। অশ্বারোহী সৈন্য নিহত হওয়ার তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে। অশ্বযান ব্যবহারকারীসহ প্রায় এগারো হাজার। গ্রিকদের উনিশ হাজারের বেশি। অশ্ব মারা গেছে দুই পক্ষ মিলিয়ে প্রায় সাড়ে আট হাজার। অশ্বারোহী তির, সারিসা, বল্লম এবং অন্যান্য অস্ত্রের আঘাতে নিহত হওয়ার পর সওয়ারিবিহীন ঘোড়াকে কেউ আঘাত করে নি। কারণ, ঘোড়া কাদের, যুদ্ধের মাঠে তা চিহ্নিত করা শক্ত হয়ে পড়ে। এগুলোকে মৌর্য অধিকারে আনার পর শনাক্ত করা হচ্ছে। একই কারণে স্বতন্ত্রভাবে মৌর্যদের কত অশ্ব খোয়া গেছে, তা নির্ণয় করতে সময় লাগছে। লরি ও রথীদের ভাষ্য, ষাঁড়ের গুঁতোয় অনেক গ্রিকের মৃত্যু হয়েছে। রথ চূর্ণ করে দেওয়ার ফল এটি। ষাঁড়েরা ক্ষিপ্ত হয়ে আক্রমণ চালিয়েছে। এতে পাল্টা আক্রমণে দুই শ নিরানব্বইটি ষাঁড় মারা গেছে। রথী মারা গেছে আট শর কিছু বেশি। গুপ্ত সম্রাটদের যেমন তির-ধনুক, তেমনি ষাঁড় হচ্ছে মৌর্যদের জাতীয়তার প্রতীক।

আহত পশুদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে বললেন সম্রাট। আহত সৈনিকদের চিকিৎসা যুদ্ধের ময়দান থেকেই শুরু হয়েছে। সম্রাটের রাজকীয় বাহিনীর হস্তী এবং অশ্বরা বিশেষ গুরুত্ব পেল চিকিৎসার ক্ষেত্রে। বিশেষ করে হস্তী আয়ুর্বেদ। তখন বেশ রাজকীয় গৌরবের আসনে হস্তী আয়ুর্বেদ।

সম্রাট এবারে মহামন্ত্রী চাণক্যকে পরবর্তী পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা জানাতে বললেন।

যুদ্ধের ধরন এখন পাল্টাতে হবে, সম্রাট। পার্বত্য এলাকা থেকে এদের নামিয়ে আনার কৌশল উদ্ভাবনই প্রথম কাজ। এখন আমাদের সমস্ত বাহিনীকে যুদ্ধে নামানোর দরকার নেই। আমাদের সেনারা শুধু প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় থাকবে। গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়াতে হবে। খোঁজখবর নিয়ে বাকি ব্যবস্থা। কৌশল ও পরিকল্পনাটা আপনাকে পরে জানাচ্ছি। এ নিয়ে ব্যাপক চিন্তাভাবনার প্রয়োজন আছে।

সম্রাট বললেন, আচ্ছা।

সম্রাট যেন কী নিয়ে খুব ভাবছেন, মাঝেমধ্যেই তাঁর মানসিক অনুপস্থিতি টের পাওয়া যায়। চাণক্যের ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়াল না। তাঁর মনে হলো, সম্রাটের আধ্যাত্মিক অনুশীলন (কাউন্সেলিং) প্রয়োজন। এ ব্যাপারে অবশ্য সম্রাটকে কিছু বললেন না।

প্রধান সেনাপতিকে নিয়ে চাণক্য নিজের ছাউনিতে গেলেন। প্রথমেই নির্দেশ দিলেন, যুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে না, এমন পশুগুলোকে বিষ দিয়ে হত্যা করো। প্রধান সেনাপতি বললেন, সম্রাট চাচ্ছেন চিকিৎসা।

চিকিৎসা হবে যেগুলো ব্যবহারযোগ্য। অন্যগুলোর চিকিৎসা, খাদ্য ও পরিচর্যা ব্যয় বহন করার কোনো অর্থই হয় না। যা বলছি করো। সম্রাটের তা জানার দরকার নেই। আরেকটা বিষয়, বলে একটু থামলেন, পরে বললেন, গ্রিক সৈন্যদের ব্যবহৃত যেসব পোশাক, শিরস্ত্রাণ, বর্ম, জুতা, সমর আভরণ ও যুদ্ধাস্ত্র পাওয়া গেছে, সবগুলো আমার কাছে জমা দাও।

এগুলোর কী প্রয়োজন, মহামন্ত্ৰী?

প্রয়োজন আছে। সুবন্ধু, তুমি এগুলো বুঝে নেবে। এমনকি তাদের ফেলে যাওয়া পতাকাও। সুবন্ধু বুঝতে পারছেন না এগুলো দিয়ে কী হবে।

সবাইকে না জানিয়ে চাণক্য আরেকটি কাজ করলেন, তিনি ভদ্রবাহুকে পাটালিপুত্র থেকে নিয়ে আসার জন্য লোক পাঠালেন এবং দুই লাইনের একটি পত্র লিখলেন :

আচার্য,

সিন্ধু উপত্যকার উদার ও মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি আপনার উপস্থিতি কামনা করছে। আমি প্রতীক্ষায় আছি।

চাণক্য।

.

সেলুসিড শিবিরেও প্রাথমিক পরাজয়ের কারণ ও যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সম্রাট সেলুকাস উত্তেজিত। প্রস্তুতি ও পরিকল্পনায় ঘাটতি ছিল বলে তাঁর বিশ্বাস। তাঁর জেনারেলরা মুখ ভার করে বসে আছেন। ক্রুদ্ধ সম্রাট কথার বাণ ছুড়ছেন তাঁদের দিকে। তোমাদের ব্যর্থতা সব পরাজয়ের ইতিহাসকে ম্লান করে দিয়েছে। মহাবীর আলেকজান্ডার বেঁচে থাকলে লজ্জায় মরে যেতেন। আহত-নিহত সৈন্যদের তোমরা ফেলে এসেছ। গ্রিক ও সেলুসিড পতাকা পর্যন্ত ফেলে দিয়ে এসেছ। পতাকার সম্মান আর নিরাপত্তাবোধ তোমাদের নেই। যুদ্ধে পশ্চাদপসরণ করার নির্দেশ সম্রাটই দিয়েছিলেন। কিন্তু এ কথা বলবে কে? যিনি বলবেন, তাঁর দিকে কথা সারিসার আঘাত আসতে থাকবে অনবরত। তাই সবাই চুপ। এ বয়সে সম্রাটের প্রায়ই ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। উত্তেজিত হয়ে পড়েন। ব্যবহারের মধ্যে শালীনতা থাকে না। পরে অবশ্য শান্ত হয়ে যান। জেনারেলরা তা দেখে অভ্যস্ত। কথা সারিসার আঘাত সয়ে সয়ে এঁরা ওই সময়টার জন্য অপেক্ষা করেন।

কাঙ্ক্ষিত সময়টা এল। জেনারেল ফিলেকাস সাহস করে বললেন, মহামান্য সম্রাট, আমরা আমাদের দায় স্বীকার করছি। এই পরাজয়ের ব্যর্থতা আমাদের। এ জন্য আপনি যে শাস্তি দেবেন, আমরা তা মাথা পেতে নেব। তার আগে আমরা একটা সুযোগ চাই, আপনার নির্দেশ চাই, মৌর্য সম্রাটকে আপনার পদতলে এনে ফেলতে চাই, যেভাবে রাজা পুরুকে মহাবীর আলেকজান্ডারের পদতলে ফেলেছিলেন আপনি। সে গৌরবময় অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি চাই।

জেনারেল ফিলেকাসের এ বক্তৃতায় অন্য জেনারেলরা চাঙা হয়ে উঠলেন। সম্রাটের চেহারায়ও ভাবান্তর দেখা গেল।

আমাদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, আমরা পেছনে সরে এসেছি, আত্মসমর্পণ করি নি। তাদেরও ক্ষয়ক্ষতি কম হয় নি।

এ কথা বলে আবার বক্তব্য শুরু করলেন জেনারেল ফিলেকাস। আমাদের জওয়ানেরা যুদ্ধের মাঠে শত্রুসৈন্যদের ওপর বীরের মতোই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সূর্যাস্ত অবধি মরণপণ যুদ্ধ করে গেছে। প্রাণ দিয়েছে। পরাজয় মেনে নেয় নি। আমাদের যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করা কৌশলমাত্ৰ। যুদ্ধ শেষ হয় নি, যুদ্ধ শেষ হবে মৌর্যদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। আমরা আবার সর্বশক্তি নিয়ে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। এবারে শর্ষেফুল দেখবে ওরা, জানবে কত ধানে কত চাল। আপনি শুধু নির্দেশ দিন, মহামান্য সম্রাট।

ফিলেকাস লক্ষ করলেন, সম্রাট কাবু হয়ে গেছেন। বক্তৃতার মাঠ এখন তাঁদের দখলে। অন্য জেনারেলরাও কথা বলার জন্য উসখুস করছেন।

লাউডিসের স্বামী জেনারেল কিউকেকাস বললেন, মহামান্য সম্রাট, হস্তীবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আমাদের প্রজেইসিং যোদ্ধাদের নেই। আমরা ভাবতেও পারি না এত বড় এক হস্তীবাহিনী নিয়ে চন্দ্রগুপ্ত সমরে লিপ্ত হবেন। আপনার মনে থাকার কথা, রাজা পুরুরও ছিল গজারোহী সৈন্য, আপনার অধিনায়কত্বে সহজেই তাদের হারিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এখন আমাদের কৌশল উদ্ভাবন করতে হবে কেমন করে বিশাল এ বাহিনীকে পর্যুদস্ত করা যায়। ওদের সৈন্যসংখ্যা আমাদের প্রায় দ্বিগুণ। আমাদের কাতুইকোই সৈন্যরা বেশ অদক্ষ, যুদ্ধক্ষেত্রে তা প্রমাণিত হয়ে গেল। তাদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। বরাবরের মতোই আমাদের অশ্বারোহী বাহিনী দারুণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। পদাতিক বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি বেশি, আমার মনে হয়, সেলুসিড যুদ্ধকৌশল রপ্ত করতে আরও দুয়েকটি যুদ্ধে তাদের পরীক্ষা দিতে হবে। আমাদের আধুনিক যুদ্ধকৌশলের কাছে মৌর্যরা পরাজিত হবেই। সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

এখন আমরা সুবিধাজনক অবস্থানে আছি। এ দেশের প্রকৃতি আমাদের হয়ে যুদ্ধ করছে ওদের বিরুদ্ধে। পাহাড়-জঙ্গলের জন্য ওরা আক্রমণ করে আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না। আমরাই বরং আক্রমণ করলে ওদের বিষদাঁত ভেঙে দিতে পারব, বললেন ফিলেকাস।

সম্রাট প্রশ্ন করলেন, এভাবে কত দিন অপেক্ষা করব আমরা?

আমাদের প্রস্তুতি শেষ হলেই সমতল ভূমিতে নেমে পড়ব। তবে মাঝেমধ্যে ত্বরিত আক্রমণ করে ব্যতিব্যস্ত করে রাখব তাদের। বুঝতেই দেব না আমরা কী মহাপরিকল্পনা করছি এবং আমাদের সৈন্যসংখ্যা কত।

বেশ, তাই করো। জেনারেল কিউকেকাস বললেন, মহামান্য সম্রাট, সম্রাট টলেমির কাছে সৈন্য সাহায্য চাওয়া যায় কি না, তা বিবেচনা করে দেখতে পারেন।

সম্রাট বললেন, তুমি ভালো কথা বলেছ। কিন্তু তিনিও তো নানা চাপে আছেন। তাঁর নৌসেনারা বেশি দক্ষ। আমাদের প্রয়োজন পদাতিক আর অশ্বারোহী সৈন্য। আমাদের অনুরোধে যদি সৈন্য পাঠানও, নিয়মিত বাহিনীর কাউকে পাঠাবেন না। এরা এখন নানা ফ্রন্টে আছে। পাঠাবেন অনিয়মিত বাহিনীর ক্লেবুচোই সদস্যদের। এরা আমাদের কাতুইকোইয়ের মতোই। এ ছাড়া আসতে অনেক সময় লেগে যাবে। যা করার আমাদেরই করতে হবে। বাহিনীগুলোকে সংগঠিত করো। আর অ্যাপোলোর কাছে প্রার্থনা করো।

ফিলেকাসের একটি কথা প্রায় ঠোঁটের কাছে এসে ফিরে গেছে। তিনি এন্টিওকাসের কথা বলতে গিয়ে বলেন নি। জেনারেল হিসেবে খুবই নামডাক ছিল তাঁর। প্রাদেশিক শাসক হিসেবে একটি বাহিনীও আছে তাঁর। সেলুকাস প্রতিজ্ঞা করেছেন, এই ছেলের কাছ থেকে কোনো সাহায্য নেবেন না। ফিলেকাসের মনে হয়েছে, সিদ্ধান্তটা ভুল।

সম্রাট ফিলেকাসদের বললেন, যা ভুল হয়ে গেছে, তা থেকে শিক্ষা নাও, পরিকল্পনা করো, কল্পনাপ্রবণ হও এবং স্বপ্ন দেখো। তিন দিনের মধ্যে আমি একটি লাগসই পরিকল্পনা চাই। আর চাই শত্রুদের খোঁজখবর, পাঠাও গোয়েন্দাদের। কাতুইকোই সৈন্যদের শাণ দাও। আর ভুল চাই না।

.

চাণক্যের সামরিক গোয়েন্দারা সেনাপতি সদাচারের ওপর নজর রেখেছিল। যুদ্ধে আন্তরিকভাবেই মরণপণ লড়াই করেছেন তিনি। তবে তাঁর যুদ্ধ সংস্কৃতি ছিল একান্তই নিজস্ব। তাঁর ব্যক্তিত্বের কাছে মৌর্যদের হাবাগোবা প্রধান সেনাপতিও নস্যি।

চাণক্য ব্যাপারটিকে তাঁর ভাবনার মধ্যে রাখলেন। তিনি নিজেও সেদিন এ সৈনিকের ব্যক্তিত্বের পরিচয় পেয়েছেন। হঠাৎ করেই তাঁর মাথায় একটি ফন্দি এল। তিনি এ সেনাপতিকে কাজে লাগাবেন। খবর পাঠালেন তিনি সেনাপতিকে।

সুবন্ধু বললেন, আচার্য, আপনি তাঁকে কোথায় পাঠাচ্ছেন?

সে পার্বত্য রাজার সেনাপতি ছিল। পার্বত্য যুদ্ধকৌশল ভালো জানার কথা। আলাপ করে দেখি।

সেনাপতি সদাচার চাণক্যকে অভিবাদন জানিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন।

চাণক্য বললেন, যুদ্ধে তোমার নৈপুণ্যে আমি মুগ্ধ। আমার মনে হচ্ছে সেদিন তোমাকে শাস্তি দিলে আমি ভুল করতাম। এখন তোমাকে একটি বড় দায়িত্ব দেব বলে ভাবছি।

আপনার সদিচ্ছা আমাকে ভালো পথ দেখাবে। আপনার মূল্যায়নে আমি অনুপ্রাণিত।

পার্বত্য যুদ্ধে তোমার ভালো অভিজ্ঞতা আছে বলে আমার ধারণা। গ্রিকরা পাহাড়-জঙ্গলে অবস্থান নিয়েছে। বলো, এ মুহূর্তে কি আমাদের এদের আক্রমণ করা উচিত?

না, তাতে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হবে। আমাদের উচিত হবে এদের অবস্থান-এলাকাটি চিহ্নিত করা। তারপর এদের ঘিরে ফেলা তিন দিক থেকে।

তিন দিক থেকে কেন?

একদিক খোলা রাখতে হবে, যাতে এরা বের হতে পারে। বের না হতে পারলে মরণকামড় দেবে। বের হওয়ার সুযোগ দিলে বের হওয়ার পথে তাদের সৈন্যদের হত্যা করা সহজ হবে।

বের হওয়ার পথে অতিরিক্ত সৈন্য আসার সুযোগও তো থেকে যায়।

তা যায়। সেখানে আমাদের সৈন্যরা দুই পাশে অপেক্ষমাণ থাকবে। শুধু বের হতে যাওয়া সৈন্যদের নয়, যারা আসতে চাইবে, এদেরও নিঃশেষ করা যাবে।

এলাকাটা অনেক বড়।

কিছুকাল ঘিরে রাখলে এরা বের হয়ে আসতে বাধ্য হবে। খাদ্য সরবরাহের প্রয়োজন আছে।

বেশ, তোমার কাজ হলো এদের অবস্থান এলাকাটা ঘুরে দেখে মতামত দেওয়া। তোমার সঙ্গে প্রয়োজনীয় সংখ্যক যোদ্ধা নিয়ে যাও। আমি প্রধান সেনাপতিকে বলে দিচ্ছি।

পর্বতরাজের সৈন্যরা আমার সঙ্গে থাকলে কাজটা সহজ হবে।

বেশ, তা-ই হবে।

সেনাপতি সদাচার চলে যাওয়ার পর সুবন্ধু বললেন, পর্বতরাজের সৈন্যদের তার সঙ্গে দিলে এরা পক্ষ ত্যাগ করতে পারে।

আমার তা মনে হয় না। এ ছাড়া আমাদের সৈন্যরাও তার সঙ্গে থাকবে। তবে আমি ভয় পাচ্ছি অন্য জায়গায়। বর্তমান প্রধান সেনাপতি পদ হারাতে পারে, যা শুভকর হবে না। গাধার পিঠে চড়া সহজ, তেজি ষাঁড়ের পিঠে চড়তে গেলে গুঁতো খেতে হয়। তাই পূর্বের সিদ্ধান্তটাই কার্যকর করে ফেলব কি না ভাবছি।

কী সিদ্ধান্ত, আচার্য?

সেদিন তাকে মুক্তি দিয়েছিলাম তার অধীন বিরোধী সৈন্যদের হাতের মুঠোয় আনার জন্য। এরা এসে গেলে তাকে শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সে যুদ্ধে ভালো করেছে। না হয় যুদ্ধক্ষেত্রেই শেষ করে দেওয়া হতো।

এ কথা শুনে সুবন্ধু হেসে দিলেন।

হাসছ কেন তুমি?

তাকে আপনি বিশ্বাস করে পাঠাচ্ছেন শত্রুদের অবস্থান জানতে।

সেখানেও তার মৃত্যু হতে পারে। ধরা পড়লে বিশ্বাসঘাতককে ওরা রক্ষা করবে না। তুমি প্রধান সেনাপতিকে সংবাদ পাঠাও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *