মৌর্য – ১৩

১৩

পর্বতেশ্বরের যুদ্ধযাত্রাকালে নির্জলা সঙ্গে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করল। রানি বললেন, মন্ত্রীপত্নী, আপনার সেখানে মন্ত্রীর কাছে চলে যাওয়াই ভালো। বৃদ্ধ বয়সে আমাদের রাজার মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে। নইলে মন্ত্রীপত্নীকে কেউ আটকে রাখে?

নির্জলা এখানে অবস্থান করে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংবাদ সংগ্রহ করেছে, সেগুলো মন্ত্রীর কাছে পৌঁছাতে হবে। সংবাদ সংগ্রহে সে রানির প্রধান দাসীকে ব্যবহার করেছে। দাসীর নাম নির্মলা। নির্মলার কান পাতার অভ্যাস আছে। এটি লক্ষ করেছে নির্জলা। একদিন ডেকে বলল, নির্মলা, তোমাদের এত সুন্দর রাজবাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাবে না?

রানি মাকে বলে অনুমতি নিয়ে আসি?

এসো।

রানি অনুমতি দিলেন এবং নির্মলাকে সঙ্গে সঙ্গে থাকতে বললেন।

রাজপ্রাসাদ দেখার জন্য পা বাড়িয়ে নির্মলা বলল, এই যে প্রাসাদ দেখছেন, এটি ছিল আমাদের বাগানবাড়ি।

এখনো তো বাগান রয়েছে। সুন্দর বাগান।

পাহাড়ের ওপর এ রকম সুন্দর প্রাসাদবাড়ি আর কোথাও দেখবেন না। কিন্তু আমাদের সিন্ধু নদের তীরে যে রাজপ্রাসাদ ছিল, ওইটা দেখলে আপনার মাথা ঘুরে যেত। আলেকজান্ডারের সৈন্যরা সে বাড়িটা দখল করে নিয়ে যায় এবং আমাদের রাজাকে বন্দী করে।

এসব কথা আমি জানি, নির্মলা। বড় দুঃখ হয় সে কথা মনে হলে। তোমার তো বয়স হয়েছে। আর কত এভাবে কাটাবে?

রানি মা পছন্দ করেন, তাই আছি।

নির্জলা নির্মলার হাতে স্বর্ণমুদ্রার একটা থলে গুঁজে দিয়ে বলে, এটা রাখো। তোমাকে আমারও ভালো লেগেছে।

আপনাকেও ভালো লেগেছে আমার।

আচ্ছা নির্মলা, তোমাদের রাজা সুযোগ পেয়েও নন্দরাজ্য দখল করে নি কেন?

এত শক্তি ছিল না। আপনাকে বলি, শোনেন, এখন সুযোগ হয়েছে, আপনাদের সহযোগিতা পেয়েছে, এখন দখল করে নেবে।

এ কথা তুমি কী করে জানলে?

জেনেছি। চুপিচুপি রাজা আর সেনাপতির কথা শুনেছি।

ঠিক শুনেছ?

ওরা বলাবলি করছিল, যুদ্ধে প্রথমে নন্দরাজকে হারাবে, পরে আপনাদের।

তুমি হয়তো ভুল শুনেছ। আমরা মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। একে অন্যের মিত্র আমরা। রাজভ্রাতা বৈরোধক খুব প্রভাবশালী। রাজার অবর্তমানে রাজা হন রাজপুত্র, রাজপুত্র মলয়কেতুকে সে রকম গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো না।

রাজা ভাই বলতে অজ্ঞান। এমন ভাতৃপ্রীতি আমি জীবনেও দেখি নাই। এ নিয়ে রানির সঙ্গে একটু মন-কষাকষি আছে।

সেনাপতি কেমন?

খুবই বুদ্ধিমান। সবার সঙ্গেই ভাব রাখে।

তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা সম্ভব?

আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

আমার সঙ্গে এসো।

এটা সম্ভব নয়। এখন এদের ব্যস্ত সময়।

নির্জলা আরেকটি স্বর্ণমুদ্রার থলে নির্মলার হাতে দিয়ে বলল, এসো তো, এসো।

সেনাপ্রধানের দপ্তর অন্য পাহাড়ের ওপর। নিরাপত্তাবেষ্টনীতে আবদ্ধ। পাহাড়ের পাদদেশে যেতেই থামাল রক্ষীরা। পরিচয় জানতে চাইল।

নির্মলা বলল, মহারানির অতিথি।

এখানে কী প্রয়োজন, একজন রক্ষী জিজ্ঞেস করল। নির্জলা বলল, কী সুন্দর! দেখছি আরকি।

এটা গতিবিধি-সীমিত এলাকা। এখানে দেখার কিছু নেই।

নির্মলা বলল, তিনি সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান।

কী প্রয়োজন?

তাঁকেই বলি। তাঁকে বলুন মৌর্য সাম্রাজ্যের মন্ত্রীপত্নী তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী।

নির্জলার কঠোর বাক্যে রক্ষীটি পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এসে বলল, অনুগ্রহ করে আসুন আমার সঙ্গে।

কথায় নরম সুর দেখে নির্জলা নির্মলার দিকে তাকাল। পরে রক্ষীটিকে অনুসরণ করল।

পাহাড়ের ওপর বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে সেনাপ্রধানের দপ্তর। চারদিকে তাকিয়ে নির্জলা একটা মানচিত্র মস্তিষ্কে এঁকে নিল। তারপর সেনাপ্রধানের কার্যালয়ে ঢুকল।

সেনাপ্রধান বেশ সম্মানের সঙ্গেই নির্জলাকে গ্রহণ করলেন। আরামকেদারায় বসলেন দুজন। নির্মলার অবস্থান হলো বাইরের একটি কক্ষে

নির্জলা বলল, এখন আপনাদের ব্যস্ত সময়। যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি চলছে। তাই বেশি সময় নেব না। আপনার অনেক প্রশংসা শুনেছি আমি। দেখে মনে হচ্ছে আপনি তার চেয়েও চৌকস, বলে হাসল নির্জলা। মৌর্য সম্রাটের মহামন্ত্রী আচার্য চাণক্য আপনার কাছে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন।

কী প্রস্তাব?

মৌর্য সম্রাট এ পার্বত্য রাজ্যের রাষ্ট্রক্ষমতায় দেখতে চান আপনাকে।

এ কথা শুনে সেনাপ্রধান ঘামতে শুরু করলেন। তিনি কী বলবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না।

নির্জলা অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য বলল, এখনই বলতে হবে না, মহামন্ত্রীর সাক্ষাতে যুদ্ধক্ষেত্রে কথা বললেও চলবে। এ কথা আপনার আর আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।

চালের তরলজাতীয় পানীয় নিয়ে এল একজন সৈনিক। এটা অভিজাত পর্যায়ের পানীয়। পরিবেশনের মধ্যেও আভিজাত্যের বনেদি ছাপ, মৌর্যদের যা নেই। পানীয় পান করতে গিয়ে সেনাপ্রধান মহামন্ত্রী সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন। পণ্ডিত ও চৌকস রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁর খ্যাতির কথা সবাই জানেন। এ মন্ত্রীর প্রস্তাবকে খাটো করে দেখা চলে না। বললেন, তাঁকে আমার নমস্কার জানাবেন। আর বলবেন, যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যাপারটা নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাই।

আপনি এখনো বলতে পারেন। একটা ইতিবাচক ইঙ্গিত আপনি দিতে পারেন।

ধন্যবাদ আপনাকে।

নির্জলা পাহাড় থেকে নেমে এল বিজয়িনীর বেশে। তার আগে সৈন্যদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিল।

রানির চাপে নির্জলাকে মৌর্যমন্ত্রীর কাছে যেতে দিতে রাজি হলেন পর্বতেশ্বর। এরা যুদ্ধযাত্রায় একসঙ্গেই যাবেন।

বাহলিক, কিরাত, পারসিক, কম্বোজ, শক ও যবন সৈন্যদের মিলিত বাহিনী পর্বতেশ্বরের সৈন্যবাহিনীতে বহুমাত্রিক শক্তি যুক্ত করেছে। তার চেয়ে বেশি সৃষ্টি করেছে বৈচিত্র্য। তাতে প্রাণপ্রবাহ একক ধারায় প্রবাহিত না হয়ে নানা শাখা-প্রশাখায় প্রবাহিত হচ্ছে। নির্জলা অন্ধকারের মধ্যে আরেকটি আলোকরশ্মি আবিষ্কার করে ফেলল। তিনটি বিষয় সে চাণক্যের কাছে উত্থাপন করবে বলে স্থির করল।

.

কতিপয় যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নন্দরাজের পিঠ প্রায় দেয়ালে ঠেকেছে। পাটালিপুত্রের কাছে দুর্গম এক দুর্গে অবস্থান করছেন তিনি। সারানাথের দিকে পলায়নের একটি পথ ঠিক করে রেখেছেন। সেখান থেকে কপিলাবস্তু যাওয়ার প্রস্তুতিও আছে। তাঁর মহামন্ত্রী রাক্ষস এসব পরামর্শ দিয়ে রেখেছেন।

পর্বতেশ্বর ও মৌর্য সম্রাটের মধ্যে মৈত্রী তাঁকে কিছুটা দুর্বল করে ফেলেছে। তাই পরিকল্পনায় পলায়নের পথও ঠিক করে রাখতে হচ্ছে। গোয়েন্দাদের কথায় যুদ্ধকৌশল পাল্টাতে হয়েছে। মহামন্ত্রী রাক্ষস অবশ্য গোয়েন্দা তথ্যে সন্তুষ্ট নন। একবার রাগত স্বরে বললেন, তোমরা শত্রুপক্ষের গোয়েন্দা, নাকি আমাদের, এটাই তো বুঝতে পারছি না।

গোয়েন্দা তথ্য যুদ্ধকালে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে বিভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গোয়েন্দা তৎপরতায় এগিয়ে চাণক্য। তিনি সামরিক গোয়েন্দাদের আলাদা করেছেন, বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তাই এরা এগিয়ে।

মহামন্ত্রীর উদ্বেগ এ জন্য। নন্দরাজ কোনো ব্যাপারে প্রথমেই হতাশ হয়ে যান না। অভিজ্ঞতা তাঁকে অনেক শিখিয়েছে। রাক্ষসকে তিনি বোঝালেন যে এ যুদ্ধ অনিবার্য। আমি আগে থেকেই জানি একটি আক্রমণ হবে মৌর্যদের পক্ষ থেকে। চাণক্য এখনো তাঁর আক্রমণের কথা ভোলেন নি। তবে আমি অবাক হয়েছি পর্বতেশ্বরের তাঁদের সঙ্গে জোট বাঁধায়। ব্যাপারটা আমাকে ভাবাচ্ছে। এখানে কোনো কৌশল অবলম্বন করা যায় কি না, ভেবে দেখো।

প্রতিবেশী পাঁচটি রাজ্যের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করা যায়। অনেকটা ছাড় দিয়ে এ মৈত্রী স্থাপন করতে হবে। পাঁচটি রাজ্যের নাম বললেন রাক্ষস।

রাজা নন্দ মাথা নাড়লেন এবং আলোচনা শুরু করতে বললেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *