বুদ্ধি যদি বৃদ্ধি পায়

বুদ্ধি যদি বৃদ্ধি পায়

‘সোমা! সোমা! শিগগির একটু বরফ নিয়ে এসো—’ গলা ফাটিয়ে হাঁক ছেড়েছেন পুরন্দর, আর ঘরের সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে একবার যাচাই করে নিয়েছেন ওটা ঠিকঠাক ফুল স্পিডে ঘুরছে কি না। পুরন্দরের মাথার ভেতরটা কীরকম অস্থির-অস্থির করছিল। মনে হচ্ছিল, দুজন ধুনুরি তাঁর মাথার ভেতরে বসে তোশক তৈরির কম্পিটিশান লাগিয়ে দিয়েছে।

বিকুন বেশ ভয়ে-ভয়ে তাকিয়ে রয়েছে বাবার দিকে। বরফ দিয়ে কী করবেন বাবা? মুখ লালচে, থমথমে। বিকুনকে অঙ্ক শেখাতে গিয়ে আজ বোধহয় তাঁর অফিসটাই কামাই হয়ে যাবে!

এর মধ্যে মা-ও এসে হাজির হয়ে গেছেন। আটপৌরে শাড়ি পরে রান্না করছিলেন। হাতে হলুদের রং, মুখে বিনবিন ঘাম। বোঝা যায়, প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যেও জরুরি হাঁক শুনে ছুটে এসেছেন।

সোমা বিকুনের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘কী রে! ও-মা ও-মা করে ডাকছিস কেন? এখন আমার মরবার সময় নেই—–—।’

ও, রান্নার ছ্যাঁকছোঁক শব্দের জন্য মা তা হলে বরফ আনার ব্যাপারটা শুনতে পাননি! বিকুন ভাবল। আর বাবার ‘সোমা’ ডাককে বিকুনের ‘ও-মা’ বলে ভুল করেছেন।

পুরন্দর রাগ-থমথমে গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, ‘ও ডাকেনি, আমি ডেকেছি। জলদি ফ্রিজ থেকে একটু বরফ দাও—একটা রুমালে জড়িয়ে দিয়ো।’ ‘বরফ! বরফ দিয়ে এখন কী করবে? তুমি চান করতে যাবে না? এরপর অফিসে দেরি হয়ে গেলে আবার আমাকে—।’

পুরন্দর এবার ফেটে পড়লেন, ‘বলছি তো জলদি বরফ নিয়ে এসো, আমার মাথায় দেব। ওকে অঙ্ক শেখাতে গিয়ে আমার মাথাটাই কেমন গোলমাল হয়ে গেছে।’

সোমার ভুরু কুঁচকে গেল। বিকুনের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘কী রে, আবার কী ভুল করলি?’

বিকুন ইনিয়ে-বিনিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ওকে থামিয়ে দিয়ে প্রায় গর্জন করে উঠলেন পুরন্দর, ‘ভুল আবার কী! ওকে নিয়ে আমি আর পারছি না। তোমার ছেলের মাথায় কিস্যু নেই। ও…ও একটা শম্বুক নাড়ুগোপাল!’

বিকুন তো একেবারে থ। শম্বুক মানে যে শামুক সেটা ও জানে। কিন্তু শামুক আর নাড়ুগোপালের মধ্যে কোথায় যে মিল তা ওর মাথায় ঢুকছে না। তা ছাড়া, ওই দুটি বস্তুর সঙ্গে বিকুনেরই বা মিল কোথায় !

সোমা জানেন, ভীষণ রেগে গেলে পুরন্দর বিকুনকে ‘তোমার ছেলে’ বলে অভিযোগ করেন।

তিনি কোনওরকমে ঠান্ডা করতে চেষ্টা করলেন উত্তেজিত পুরন্দরকে, ‘আহা, কী হয়েছে বলবে তো—।’

পুরন্দরের কথা থেকে ব্যাপারটা জানা গেল। তিনি সাধারণ একটা আয়ব্যয়ের অঙ্ক বোঝাতে বসেছিলেন বিকুনকে। তাতে রয়েছে, রামবাবু মাসে ২০০০ টাকা আয় করেন, আর প্রতি মাসে তাঁর ১৬০০ টাকা করে খরচ হয়। তা হলে বছরের শেষে তাঁর সঞ্চয় কত? তা অঙ্ক কষা তো দূরের কথা, বিকুনের বক্তব্য, প্রতি মাসে সমান টাকা খরচ হতে পারে না—বিশেষ করে পুজোর মাসে তো খরচ বেশি হবেই! বাবাকে সে স্পষ্ট জানিয়েছে, ‘তুমিই তো সবসময় এ-কথা বলো

ব্যস, অঙ্ক উঠেছে মাথায়। বাবা-ছেলেতে লেগেছে তর্ক। পুরন্দর যতই বোঝান, ‘এটা অঙ্ক।’ বিকুন ততই বলে, ‘না, অঙ্কে ভুল আছে।’

বিকুন যে মাথা নীচু করে এবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সেটা খেয়াল করেছেন সোমা। তাই পুরন্দরকে বলেছেন, ‘তুমি যাও তো, তাড়াতাড়ি চান করে তৈরি হও। ও-অঙ্ক আমি বুঝিয়ে দেব—

ফোঁস করে প্রায় পাঁচ ফুট লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুরন্দর উঠে পড়লেন। তিনি যে পড়াশোনায় বরাবরই তুখোড় ছিলেন এটা আর কাউকে বলা যাবে না। সবই নিয়তি।

বিকুনকে নিয়ে মা-বাবার দুশ্চিন্তা কম নয়। কী করে ছেলেটা এমন বোকাসোকা হল! কেন ওর মাথায় একফোঁটা বুদ্ধি নেই? অথচ ওর দিদি ঝুনু লেখাপড়ায় কী দারুণ! মাধ্যমিক পরীক্ষাতে পাঁচটা বিষয়ে লেটার মার্কস পেয়েছিল, তা ছাড়া স্টার তো বটেই। সামনের বছরে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। সারাদিন শুধু মন দিয়ে পড়ে। মা-বাবা তো ভালো করেই জানেন, ঝুনু সবাইকে খুশি করার মতো রেজাল্ট করবে। আর তারই ছোটভাইয়ের কিনা এই দুরবস্থা!

পড়াশোনা করতে বিকুনের যে খুব একটা খারাপ লাগে তা নয়। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি ভালো লাগে গাছপালা, পাখি আর প্রজাপতি দেখতে। সেগুলো দেখে ও যেসব রঙিন ছবি আঁকে তা দেখে বড়দের তাক লেগে যায়। তা ছাড়া, কবিতা আবৃত্তি করতেও বেশ লাগে ওর। পাড়ার দু-একটা ফাংশানে ও কয়েকবার আবৃত্তি করে বেশ প্রশংসাও পেয়েছে। তখন তো বাবা-মা দুজনেই ওকে আদরটাদর করেছিলেন! অথচ অঙ্ক আর বিজ্ঞানের মাথা না খুললে সেই দুজন মানুষই কেমন যেন হয়ে যান। আচ্ছা, সবাই কি সব পারে! কেন যে সবসময় দিদির কথা বলে বিকুনকে সবাই খোঁচা দেয় কে জানে! দিদি মোটেই ছবি আঁকতে পারে না। আর আবৃত্তির ব্যাপারে ওর বিন্দুমাত্রও উৎসাহ নেই।

কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, বিকুনকে নিয়ে মাঝেমধ্যেই বাবা-মা বেশ মুশকিলে পড়ে যান। এমনকী অপ্রস্তুতের একশেষও হয়েছেন এক-একবার।

এই তো গত সপ্তাহে সোনামাসিরা বেড়াতে এসেছিলেন বিকুনদের বাড়িতে। সোনামাসি ভীষণ ভালোবাসেন বিকুনকে। সবসময় ওর জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসেন। সেদিন সন্ধেবেলা মাসি-মেসো, ওঁদের দুই ছেলেমেয়ে—নিশানদাদা আর রীতাদিদি, মা-বাবা, ঝুনু-বিকুন—সবাই মিলে খুব হই হুল্লোড়, গল্পগুজব হচ্ছিল। তারই মধ্যে বিকুন ফস্ করে হঠাৎ বলে বসেছে, ‘সোনামাসি, জানো তো, স্কুলে বন্ধুরা আমাকে বুদ্ধুমাস্টার বলে ডাকে।’

সোনামাসি অবাক হয়ে জিগ্যেস করেছেন, ‘সে আবার কী নাম!’ বিকুন বেশ ডাঁটের মাথায় বলেছে, ‘বুঝলে না, যাদের মাথায় খুব বুদ্ধিমানে, অনেক বুদ্ধিমানের মোট বুদ্ধির চেয়েও বেশি বুদ্ধি—তাদেরকেই বুন্ধুমাস্টার বলে…বন্ধুরা বলেছে।’

হাসিঠাট্টার তাল কেটে গেল। সবাই চুপ। তারপর হাসিতে ফেটে পড়েছে নিশান, রীতা আর ঝুনু। বাবা আর সোনামেসো ওদের ধমক দিয়েছেন। বিকুন লক্ষ করেছে, মা-বাবার মুখ কেমন লালচে হয়ে গেছে। একটু পরেই মা ওকে নিয়ে চলে এসেছেন পাশের ঘরে। প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বলেছেন, ‘তোর কি কোনওদিন এতটুকু বুদ্ধি হবে না মাথায়!’

হয়তো সেই কারণেই পরদিন সকালে ঝুনু রবীন্দ্রনাথের ‘মাকাল’ কবিতাটি বিকুনের সামনে এগিয়ে দিয়ে বলেছে, ‘তুই এবার থেকে শুধু এই কবিতাটাই আবৃত্তি করবি, বুঝলি?’ বলে ঝুনু বেরিয়ে গেছে কোচিং ক্লাসে।

বিকুন যখন সত্যি-সত্যিই সেটা মুখস্থ করে আবৃত্তির চেষ্টা করছি। তখন মা কোথা থেকে এসে ওকে থামিয়েছেন।

প্রায়ই এইরকম সব ব্যাপার হয় বলে বিকুন সবসময় ভাবে, ইস. নামার যদি সত্যি-সত্যি অনেক-অনেক বুদ্ধি হত! মাঝে-মাঝে ও স্বপ্ন দেখে, চোখের পলকে কঠিন-কঠিন সব অঙ্ক কষে ফেলছে, আর বাবা-মা চোখ ছানাবড়া করে ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছেন।

ক’দিন পর ঠিক এইরকম অবস্থাই হল পুরন্দরের। সকালবেলা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আয়েশ করে খবরের কাগজ পড়াটা তাঁর রোজকার অভ্যেস। সেদিন কাগজের তিন নম্বর পৃষ্ঠার একটা বিজ্ঞাপনের দিকে চোখ পড়তেই তাঁর চোখ ছানাবড়া, মুখ হাঁ। তিনি ভুল দেখছেন না তো! সাতবার পড়ার পরেও যখন বিজ্ঞাপনটা এতটুকু পালটে গেল না, তখন তিনি বুঝলেন ব্যাপারটা স্বপ্ন নয়, বাস্তব। পাশের টেবিলে চা জুড়িয়ে জল হয়ে যেতে লাগল, কিন্তু পুরন্দরের চোখ বিজ্ঞাপনের দিকে একেবারে গঁদের আঠা দিয়ে সাঁটা।

বিজ্ঞাপনটা এইরকম ঃ

বুদ্ধি বিকাশ কেন্দ্র

পরিচালক : ড. বিকাশ বর্ধন (বিদেশ প্রত্যাগত)

এই চিকিৎসা কেন্দ্রে ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের

আই. কিউ./বুদ্ধি বাড়ানো হয়।

আধঘণ্টায় নিশ্চিত ফল। পরীক্ষা প্রার্থনীয়।

.

তার নীচে সেই বিদেশ প্রত্যাগত ডাক্তারবাবুর চিকিৎসা কেন্দ্রের ঠিকানা ও ফোন নাম্বার দেওয়া রয়েছে।

ব্যাপারটা মাথায় ঢুকতেই সোমার নাম ধরে হাঁক পাড়লেন পুরন্দর। বিকুনের বুদ্ধিতে শান দেওয়ার এরকম অপূর্ব সুযোগ আর কোথায় পাওয়া যাবে!

সোমা এসে হাজির হতেই পুরন্দর বিজ্ঞাপনটা ওঁকে দেখালেন। তারপর বললেন, ‘আজ আর অফিস যাব না। ঝুনু কলেজে বেরিয়ে গেলে বিকুনকে নিয়ে

চলো, আমরা এই সেন্টার থেকে একবার ঘুরে আসি। দেখি না কী হয়!’ সোমা ইতস্তত করে বললেন, ‘কত টাকা নেবে কে জানে! তা ছাড়া…ইয়ে…মানে, ঠকাবে না তো?’

– ‘টাকার চিন্তা তুমি কোরো না- ।’ হাত নেড়ে জবাব দিলেন পুরন্দর, ‘আর ঠকালেই হল! বিজ্ঞাপনে তো লিখেছে আধঘণ্টায় নিশ্চিত ফল। ফল না পেলে টাকা দেব কেন।’

সুতরাং বিকুনকে সঙ্গে নিয়ে সোমা এবং পুরন্দর কাঁটায়-কাঁটায় ঠিক দশটার সময় বেরিয়ে পড়লেন বিকুনের বুদ্ধিবৃদ্ধি অভিযানে। ট্যাক্সি ধরে আধঘণ্টার মধ্যেই তাঁরা পৌঁছে গেলেন ‘বুদ্ধি বিকাশ কেন্দ্র’র ঠিকানায়।

কেন্দ্রের চেহারাটা বেশ আহামরি। কাচের দরজা। তার ওপরে ডক্টর বিকাশ বর্ধনের নাম লেখা। নামের শেষে ডিগ্রি জানাতে ইংরেজি বর্ণমালার প্রায় ছাব্বিশটা হরফই ফুটকি দিয়ে বসানো। আর তার পাশে ‘বিদেশ প্রত্যাগত’ ব্যাপারটাও জানানো আছে।

চেম্বারে ঢুকে একজন রিসেপশনিস্টের কাছে নাম-ধাম ইত্যাদি বিবরণ লিখে দিলেন পুরন্দর। তারপর সোমা আর বিকুনকে নিয়ে একটা লম্বা সোফায় বসলেন। ঘরে আরও কয়েকজন বাবা-মা তাঁদের ছেলেমেয়েকে নিয়ে অপেক্ষা করছেন। তাঁদের প্রত্যেকের মুখেই কেমন একটা আশঙ্কার ভাব।

রিসেপশনিস্ট মেয়েটি একটা পার্সোনাল কম্পিউটার সামনে নিয়ে বসে ছিল, আর তার কি-বোর্ডের বোতাম টেপার ফাঁকে ফাঁকে পাশে রাখা একটা টেলিফোন তুলে নিয়ে কীসব কথা বলছিল। হঠাৎই ফোন নামিয়ে রেখে সে ডেকে উঠল, ‘মিস্টার নকুল সামন্ত।’

ঘরের এককোণে বসে থাকা এক রোগামতন ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমিľ

রিসেপশনিস্ট মেয়েটি ভেতরের দিকে যাওয়ার একটা কাচের দরজা দেখিয়ে বলল, ‘যান, ভেতরে যান ছেলেকে নিয়ে।’

নকুল সামন্ত তাঁর স্ত্রী ও ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন। বিকুন এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে ঘরটাকে খুঁটিয়ে দেখছিল। তিনটে কী সুন্দরসুন্দর ক্যালেন্ডার! একটাতে পাহাড়ের ছবি, একটায় জঙ্গলের মাঝে হাতির পাল, আর একটাতে হাতে আঁকা নদী আর গাছপালা। এ ছাড়া, আরও একটা বিশাল রঙিন ছবি টাঙানো রয়েছে ঘরে : মানুষের মগজের ছবি। ছবিতে অনেকগুলো লাল-নীল তিরচিহ্ন আঁকা। তাদের পাশে-পাশে ইংরেজিতে অনেক কথা লেখা।

হঠাৎই ভেতরের দরজা ঠেলে তিনজন বেরিয়ে এল বাইরে। একজন পুরুষ, একজন মহিলা, আর একটি বছর আটেকের মেয়ে। মেয়েটির চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। বাইরের দরজার দিকে ওরা হেঁটে যাচ্ছিল। তখনই মেয়েটি হঠাৎ বিরক্তভাবে বলল, ‘বাপি, আমার চশমার ডানদিকের লেন্সের ফোকাল লেংথটা ঠিক নেই— দু-মিলিমিটারের মতো গোলমাল রয়েছে।’

পুরন্দর লক্ষ করলেন, বাবা-মা বেশ অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। তারপর দুজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে-করতে বেরিয়ে গেলেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর বিকুনের ডাক পড়ল।

ভেতরের ঘরে ঢুকে তো সোমা আর পুরন্দরের একেবারে তাক লেগে যাওয়ার জোগাড়। বিকুনও বেশ অবাক হয়ে গেল। ও হাঁ করে সবকিছু দেখতে লাগল।

বেশ বড় ঘর। ঘরটা সিনেমা হলের মতো ঠান্ডা। তার একপাশে বিশাল টেবিল সামনে নিয়ে বসে আছেন বেঁটেখাটো একজন টাক-মাথা মানুষ। পোশাকে বেশ চেকনাই রয়েছে। গলায় স্টেথো, ঠোটের ফাঁকে চুরুট। চুরুটটা নিভে গেলেও ভদ্রলোক বোধহয় সেটা টের পাননি, কারণ মাঝে-মাঝেই ওটাকে নেড়েচেড়ে টান মারছেন। আর তাঁর মুখে সবসময়েই একটা হাসি লেগে রয়েছে।

ঘরের দেওয়ালে নানারকম রঙিন চার্ট আর ছবি টাঙানো। একপাশে নানা যন্ত্রপাতি আর একটা অদ্ভুত ধরনের গদিওয়ালা চেয়ার।

পুরন্দরদের দেখে ভদ্রলোক চুরুটটা টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। তারপর একগাল হেসে নমস্কার জানিয়ে বললেন, ‘আসুন-বসুন। আমারই নাম ডক্টর বিকাশ বর্ধন। তবে ওটা আমার ছদ্মনাম। আসল নাম হরিপদ তলাপাত্র। বুঝতেই পারছেন, নামটাই এমন যে, ও-নাম শুনে রুগিটুগি বিশেষ আসত না। তাই নাম পালটে বিকাশ বর্ধন নাম নিয়েছি। নামটা এমনিতে বেশ ভালো— তার ওপর বুদ্ধি বাড়ানোর কাজ নিয়ে যখন আছি তখন “বিকাশ”, “বর্ধন”—এইসব ক্যাচি ওয়ার্ডগুলো পেশেন্টদের মা-বাবাদের কাছে খুব এফেক্টিভ হবে।’

পুরন্দর আর সোমা হতবাক হয়ে ডাক্তারবাবুটিকে দেখছিলেন। ছদ্মনামধারী ডাক্তার! এঁর কাছে এসে ওঁরা ভুল করেননি তো! প্রায় ধপাস করেই ওঁরা দুজনে বিকাশ বর্ধনের মুখোমুখি চেয়ারে বসে পড়লেন। সোমা হাত ধরে টেনে বিকুনকে বসিয়ে দিলেন নিজের পাশের চেয়ারটিতে।

‘ডাক্তার জেঠু, আপনি ফরেনে গিয়েছিলেন?’ ফস্ করে প্রশ্ন করে বসল বিকুন।

ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেন ডক্টর বর্ধন। বললেন, হ্যাঁ, জেঠু, ফরেন… ইয়ে…মানে নেপাল আর ভুটানে আমি অনেক বছর ছিলাম। ওখানেও এই বুদ্ধিতে শান দেওয়ার কাজ করতাম।’

‘ডাক্তারবাবু, আমাদের এই ছেলেটার মাথায় ভীষণ বুদ্ধি কম। যদি আপনি ওর একটা ব্যবস্থা করেন…।’ সোমা রীতিমতো কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বললেন।

‘নো প্রবেলম।’ বলে হাসলেন ডক্টর বর্ধন। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে চলে এলেন বিকুনের কাছে। তারপর সোমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বুদ্ধি বেশি হলে আমার কাছে কেউ আসে না।’

এইবার বিকুনকে লক্ষ্য করে তিনি জিগ্যেস করলেন, ‘বলো তো জেঠু, ইফ যদি ইজ হয় বাট কিন্তু হোয়াট মানে কী?’

বিকুন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ডাক্তারবাবুর দিকে।

ডক্টর বর্ধন হাতে হাত ঘষে আবার হাসলেন। বিকুনের দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়ে বললেন, ‘পারলে না তো! ওই সেনটেন্সটার মধ্যে, ইফ, ইজ, বাট আর হোয়াট শব্দগুলোর বাংলা মানে কায়দা করে বলা আছে।’

সোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল ডাক্তারবাবুর ওপরে ওঁর ভরসা অনেক গুণ বেড়ে গেছে।

এইবার টেবিল থেকে একটা কাগজ তুলে নিয়ে কী যেন পড়লেন ডক্টর বর্ধন। তারপর বিকুনের দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘তোমার ভালো নাম শুভঙ্কর মিত্র?’

বিকুন ঘাড় নাড়ল।

‘বাঃ, চমৎকার নাম! এইবার এসো তো, শুভঙ্করবাবু, এদিকটায় এসে বসো তো এই চেয়ারটায়—।’ বিকুনকে ডেকে বিশেষ ধরনের গদিওয়ালা চেয়ারটায় বসতে বললেন বিকাশ বর্ধন। তারপর সোমা আর পুরন্দরের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘ঘাবড়াবার কিছু নেই। আই. কিউ. মিটার দিয়ে ওর আই. কিউ.-টা প্রথমে একবার টেস্ট করে নেব।’

বিকুন ভয়ে-ভয়ে গদিওয়ালা চেয়ারটায় গিয়ে বসল। ডক্টর বর্ধন কাপের মতো ছোট-ছোট চারটে টার্মিনাল লাগিয়ে দিলেন ওর মাথার চারপাশে। তারপর দূরে একটা বোর্ডের কাছে সুইচ অন করে একটা ডিজিটাল মিটারে কীসব দেখলেন। পরক্ষণেই সুইচ অফ করে আক্ষেপের ‘চুকচুক’ শব্দ করলেন, মাথা নাড়লেন ধীরেধীরে। বললেন, ‘খুবই স্যাড ব্যাপার। শুভঙ্করকে নিয়ে আপনাদের তো প্রবলেম হবেই। ওর আই. কিউ. মাত্র ৮৮। যাদের বুদ্ধি স্বাভাবিক বলা হয়, তাদের আই. কিউ. হয় ১০০। আর যাঁরা খুব নামকরা বিজ্ঞানী, তাঁদের আই. কিউ. জেনারেলি খুব বেশি হয়। যেমন, অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের আই. কিউ. ছিল ১৪৬।’

পুরন্দর আমতা-আমতা করে বললেন, ‘বিকুনের—মানে, শুভঙ্করের আই. কিউ.-টা ওইরকম বাড়িয়ে দেওয়া যায় না?’

ঘাড় নাড়লেন ডক্টর বর্ধন। হেসে বললেন, ‘যায়, যায়, নিশ্চয়ই যায়। তবে বুঝেশুনে ধাপে-ধাপে বাড়াতে হবে—যাতে ও বুদ্ধিবৃদ্ধির চাপটা সইতে পারে। ও নিয়ে চিন্তা করবেন না, ওটা আমার ব্যাপার। আজ আমি কয়েকটা স্পেশাল ডোজ দিয়ে ওর বুদ্ধি বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দিচ্ছি। ওর ব্রেনের, মানে, সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ারের প্যারিটাল লোব আর ফ্রন্টাল লোবে একটু এক্সাইটিং সিগনাল দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। নানারকম সেন্স আর ইন্টেলেকচুয়াল অ্যাক্টিভিটি প্যারিটাল লোব থেকেই জন্ম নেয়। আর ফ্রন্টাল লোবের কাজ হল যুক্তিপ্রয়োগ আর উদ্ভাবনী ক্ষমতায় সাহায্য করা। এই দুটো লোবকে একটু চাঙ্গা করে দিলেই শুভঙ্করের বুদ্ধি বেড়ে যাবে। তবে এই বাড়তি বুদ্ধির এফেক্ট মাত্র তিনদিন—মানে ৭২ ঘণ্টা থাকবে। যদি ব্যাপারটা ঠিকমতো শুভঙ্করের সুট করে যায় তা হলে আর কোনও প্রবলেম নেই—তিনদিন পর ওকে নিয়ে আসবেন, ওই বর্ধিত বুদ্ধিটা একেবারে পারমানেন্ট করে দেব। মানে, কংক্রিট ঢালাই যাকে বলে— ‘ –

কথা বলতে-বলতে শুভঙ্করের চেয়ারের মুখোমুখি রাখা কয়েকটা লোহার স্ট্যান্ডের কাছে চলে গেছেন ডক্টর বর্ধন। তারপর একটা বড় বাক্স থেকে চারটে বড়-বড় চাকতি বের করে পাশাপাশি দাঁড় করানো স্ট্যান্ডগুলোয় ফিট করে দিয়েছেন। চক্রগুলোয় দাবার ছকের মতো কালো-সাদা ছক কাটা রয়েছে। সেই ছকগুলো চক্রের কেন্দ্র থেকে শুরু হয়ে মাপে ক্রমশ বড় হতে হতে এগিয়ে এসেছে চক্রের কিনারায়।

বিকাশ বর্ধন কোথায় কী একটা বোতাম টিপে দিতেই চক্রগুলো ধীরে-ধীরে ঘুরতে শুরু করল।

এইবার সুইচ টিপে ঘরের সবক’টা আলো নিভিয়ে দিলেন তিনি। তারপর হঠাৎই দেখা গেল চারটে জোরালো আলোর ছটা এসে পড়েছে চারটে চক্রের ওপরে। বিকুনের মাথায় লাগানো টার্মিনালগুলো পালটে দিয়ে আরও কীসব সুইচ খটাখট করে বিকাশ বর্ধন গম্ভীর গলায় বললেন, ‘বিকুনবাবু, তুমি পালা করে পরপর ওই চারটে চক্রের দিকে একমনে তাকিয়ে যাও। লক্ষ্মী ছেলে! দেখবে, একটু পরেই তোমার বুদ্ধি বেড়ে যাবে। আর তোমার লেখাপড়ার খিদে এমন বেড়ে যাবে যে, সবাই একেবারে চমকে যাবে।’

হালকা আলোর আভায় বিকাশ বর্ধনের মুখ দেখা যাচ্ছিল। তাঁর চোখেমুখে উৎসাহ আর আগ্রহ ফেটে পড়ছে।

বিকুন কেমন যেন ঝিমুনির ঘোরের মধ্যে বলে উঠল, ‘ডাক্তার জেঠু, শুধু চক্রগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলেই হবে?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। চক্রগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলেই তোমার বুদ্ধি একেবারে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকবে।’

‘আমার মাথার ভেতরটা কেমন চুলকোচ্ছে—’ বিকুন একটু ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘যেন অনেকগুলো শুঁয়োপোকা হেঁটে বেড়াচ্ছে…।’

ইউরেকা! শুঁয়োপোকা! ব্রেনোটিকা!’ উৎফুল্ল হয়ে হাতে হাত ঘষলেন বিকাশ বর্ধন : ‘সাকসেসফুল, মিস্টার মিত্র, সাকসেসফুল! ওই শুঁয়োপোকার ব্যাপারটাই হল আসল—মানে, ওটাই হল মগজের ভেতরে বুদ্ধির কামড়। আর কোনও চিন্তা নেই আপনাদের। আজ বুধবার। আপনারা শনিবার এরকম সময়ে শুভঙ্করকে আমার এখানে নিয়ে আসুন—তখন একেবারে ফাইনাল ঢালাই করে দেব।’

মাত্র ৫০০ টাকা নিলেন বিকাশ বর্ধন। পুরন্দর যা ভেবেছিলেন তার তুলনায় বলতে গেলে একেবারে জলের দর।

‘বুদ্ধি বিকাশ কেন্দ্ৰ’ থেকে বেরিয়ে আসতে-আসতে সোমা চাপা গলায় পুরন্দরকে জিগ্যেস করলেন, ‘কী গো, ডাক্তারবাবু তো বললেন ওর বুদ্ধি বেড়ে গেছে, কিন্তু আমরা বুঝব কেমন করে!’

বিকুন মা-বাবার একটু আগে-আগে হাঁটছিল। হঠাৎই পিছনে তাকিযে সোমাকে লক্ষ্য করে বলে উঠল, ‘মা, তুমি একটু সাবধানে হাঁটো। এ-জায়গাটার মেঝের সঙ্গে তোমার জুতোর হিলের কোইফিশেন্ট অফ কাইনেটিক ফ্রিকশন ভীষণ কম। সাবধানে না হাঁটলে তুমি পা পিছলে পড়ে যাবে—।’

সোমা বিকুনের কথা শুনতে-শুনতে সত্যিই পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিলেন, পুরন্দর ওঁকে সময়মতো ধরে ফেলে পদভঙ্গের হাত থেকে রক্ষা করলেন। তারপর অবাক চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘কী ফ্রিকশন বললি?’

বাবার প্রশ্নের উত্তরে বিকুন বিজ্ঞের মতো জবাব দিল, ‘স্ট্যাটিক কোইফিশেন্ট অফ ফ্রিকশন—স্থিতীয় ঘর্ষণ গুণাঙ্ক। মেঝের সঙ্গে মায়ের জুতোর হিলের যে ঘষা লাগছে তা থেকে এটা হিসেব কষে বের করা যায়। সে ভীষণ জটিল ব্যাপার…।’

পুরন্দর ঘাবড়ে গেলেন, কিন্তু খুশিও হলেন ভেতরে-ভেতরে। ঘণ্টা দেড়েক আগে শোনা আট বছরের মেয়েটির কথা মনে পড়ে গেল তাঁর। চশমার লেন্সের ফোকাল লেংথের গোলমাল নিয়ে কী যেন বলছিল মেয়েটা। এইটুকু এইটুকু বাচ্চা ছেলেমেয়ে এরকম সব দুর্বোধ্য কথাবার্তা বলছে! বিকাশ বর্ধনের এক্সপেরিমেন্ট সাকসেসফুল হলে কি এইরকমই হয়?

বাড়ি ফেরার পথে বেশ কয়েকবার পুরন্দর আর সোমাকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে হল। কারণ ফ্রিকশনের কীসব দিয়ে শুরু করেছিল বিকুন, পথে গতিবেগ, ত্বরণ, বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের শতকরা হিসেবের গরমিল, বুলবুলি পাখি কেন সাধারণত জোড়ায়-জোড়ায় থাকে, পিঁপড়ে কেন লাইন ধরে চলে- এসব বিষয় নিয়ে পুরন্দর আর সোমাকে প্রায় কাহিল করে দিল।

দুপুরে বাড়ি ফিরে পুরন্দর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেন। ‘বুদ্ধি বিকাশ কেন্দ্র’র গোটা ব্যাপারটা তাঁর কেমন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল।

একটু দম নিয়ে পুরন্দর যখন স্নান করতে যাচ্ছেন, তখন দেখলেন, বিকুন স্নানটান সেরে ডাইনিং টেবিলে বসে অঙ্ক বই নিয়ে একমনে পাতা ওলটাচ্ছে। পুরন্দর খুশি হলেন। যাক, ছেলেটার তাহলে অঙ্কে আগ্রহ বেড়েছে!

তিনজনে যখন খাওয়া শুরু করলেন তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। পুরন্দর গম্ভীরভাবে জিগ্যেস করলেন, ‘অঙ্ক বই নিয়ে কী করছিলি?’

একগ্রাস ভাত মুখে পুরে দিয়ে বিকুন নির্বিকারভাবে জবাব দিল, ‘মুখে-মুখে বইয়ের সমস্ত অঙ্কগুলো একবার করে করে নিলাম।’

পুরন্দরের খাওয়া থেমে গেল।

সোমার হাতে ধরা ডালের হাতা থেকে ডাল চলকে পড়ে গেল।

মুখে-মুখে বইয়ের সমস্ত অঙ্ক কষে ফেলেছে বিকুন!

পুরন্দর তাকালেন সোমার দিকে। সোমার কপালে ভাঁজ পড়েছে। ওঁরা দুজনে হাঁ করে বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে।

এরপর প্রায় দেড় দিন বিকুন শুধু বইপত্র নিয়ে কাটাল।

নিজের যত বইখাতা তার সমস্ত লেখা গোগ্রাসে গিলল। তারপর শুরু করল তিনরকম ডিক্শনারি আর দিদির বই। সেগুলো শেষ হয়ে গেলে পাড়ার লাইব্রেরিতে হানা দিল। এ ছাড়া, আরও কোথায় কোথায় যে ও ঘুরে বেড়াল কে জানে!

যতক্ষণ ছেলেটা বাড়িতে থাকে ততক্ষণই নানা বিচিত্র বিষয় নিয়ে ওর যত অদ্ভুত-অদ্ভুত কথা।

একদিন সন্ধেবেলা ঝুনু মাকে বলছিল, পাশেই ওর বন্ধু অরুণাদের বাড়িতে যাবে ভিডিয়োতে সিনেমা দেখতে। বিকুন ইংরেজি খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিল। ফস্ করে জিগ্যেস করল, “দিদি, বলতো, ভিডিয়ো কথাটার মানে কী?’

ঝুনু ভাইয়ের দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ ফেরাল মায়ের দিকে। ওর মুখ বেজার। এ আবার কী বিপদ!

বিকুন বলল, ‘ভিডিয়ো মানে হচ্ছে, আমি দেখি। তেমনই অডিয়ো মানে হচ্ছে, আমি শুনি। এ দুটোই ল্যাটিন শব্দ।’

ঝুনু বেশ ভয়ের চোখে ভাইকে খানিকক্ষণ দেখল। তারপর সরে পড়ল সেখান থেকে।

সেদিন রাতেও সেই একই ব্যাপার।

রেডিয়োতে গান শোনা পুরন্দরের বরাবরের অভ্যাস। নিজে এককালে সংগীতচর্চা করতেন, হয়তো সেইজন্যই। ট্রানজিস্টর রেডিয়ো হাতে নিয়ে মেজাজে আধুনিক গান শুনতে-শুনতে এঘর-ওঘর আর বারান্দা করছিলেন তিনি। বিকুন হঠাৎই বলে উঠল, ‘বাবা, বড্ড ডপ্লার এফেক্ট হচ্ছে।’

‘ডপ্লার এফেক্ট!’ পায়চারি থামিয়ে চোখ কপালে তুললেন পুরন্দর। ‘জানো না, চলতে-চলতে শব্দ করলে সেই শব্দ যে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে শোনে, তার মনে হয় শব্দের কম্পাঙ্ক পালটে গেছে!’

পুরন্দরের বিষয় ছিল ইকনমিক্স। ডপ্‌প্লার কী-না-কী- -এই ব্যাপারটা বোধহয় বিজ্ঞানের। কিন্তু তিনি ধৈর্য না হারিয়ে বিকুনের খুব কাছে এসে মোলায়েম গলায় জিগ্যেস করলেন, ‘ব্যাপারটা আর-একটু খোলসা করে বল তো—ঠিক বুঝলাম না।

বিকুন নড়েচড়ে বসল। বলল, ‘শোনো। তুমি ধরো স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছ। আর দূর থেকে হুইসল বাজিয়ে ট্রেন আসছে। তখন তোমার কানে হুইসলের শব্দটা অনেক বেশি তীক্ষ্ণ শোনাবে। মানে হুইসলের শব্দের ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে গেছে বলে মনে হবে। আবার এর উলটোটাও হতে পারে। ট্রেন যখন হুইসল বাজিয়ে তোমার কাছ থেকে দূরে চলে যাবে তখন সেই শব্দের তীক্ষ্ণতা অনেক কম মনে হবে। এই ব্যাপারটা প্রথম ব্যাখ্যা করেন অস্ট্রিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী সি. জে. ডলার।’ পুরন্দর ছেলের কথা শুনতে-শুনতে রেডিয়োর সুইচ অফ করে দিয়েছিলেন। এবার হাঁ করে নিজের ছেলেকে দেখতে লাগলেন।

বিকুন এতটুকু বিচলিত না হয়ে বলল, ‘এরকম করে তাকিয়ে থেকো না, বাবা, তোমার রেটিনার ক্ষতি হতে পারে। রেটিনায় যেসব রড আর কোন রয়েছে…।’

পুরন্দর ছেলেকে বাধা দিলেন, ‘থাক, থাক, আর তোকে বুঝিয়ে বলতে হবে না—।’

তখন বিকুন বলল, ‘বড্ড গরম লাগছে। পাখার আর. পি. এম.-টা একটু বাড়িয়ে দেবে, বাবা?

‘আর. পি. এম.!’

‘রিভোলিউশাস পার মিনিট—সংক্ষেপে আর. পি. এম.। তোমরা যাকে চলতি কথায় স্পিড বলো আর কী!

পাখার স্পিড বাড়িয়ে ফুলস্পিড করে দিলেন পুরন্দর। তারপর মানে-মানে সরে পড়লেন ছেলের কাছ থেকে।

রাতে এই আতঙ্কজনক পরিস্থিতি নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে আড়ালে একটু আলোচনা করতে চাইলেন পুরন্দর।

সোমা প্রায় কাঁদো-কাঁদো অবস্থায় নিজের হেনস্থার কথা জানালেন স্বামীকে। বললেন, ‘আর বোলো না! আজ সকালে বিকুন রান্নাঘরে ঢুকে আমাকে খাবারদাবারের ক্যালরি, মেটাবলিজ্ম, গ্যাসের দহন, পরিবেশ দূষণ এসব নিয়ে একেবারে নাজেহাল করে ছেড়েছে। তারপর বলে কী, নুনের মধ্যে আছে সোডিয়াম আর ক্লোরিন। নুন নোনতা। আর চিনির মধ্যে আছে কার্বন, হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন। চিনি মিষ্টি। এরকম তফাত হল কেন? তারপর টাইঅ্যালিন নামে কী একটা জিনিসের নাম করে বলল, ওটা নাকি একটা এনজাইম, আমাদের থুতুর মধ্যে আছে। আবার সেটার বানান নাকি ‘পি’ অক্ষর দিয়ে শুরু। আমি তখন তরকারিতে হলুদগুঁড়ো দিচ্ছিলাম, বলে কি হলুদের মধ্যে কী-কী রাসায়নিক উপাদান আছে বলো তো মা।’সোমা কাতর গলায় অনুযোগ করে বললেন, ‘তুমি বলো, এসব আমি কখনও বলতে পারি?’

পুরন্দর সিগারেট খাচ্ছিলেন। তাতে হিংস্রভাবে এক লম্বা টান মেরে বললেন, ‘বিকাশ বর্ধন বলেছিলেন, ঠিক তিনদিন এর এফেক্ট থাকবে। তিনদিন শেষ হতে আর কত ঘণ্টা বাকি আছে বলো তো?’

সোমা কাঁদো-কাঁদো গলায় বললেন, ‘প্রায় সাঁইতিরিশ ঘণ্টা!

সাঁইতিরিশ ঘণ্টা! সাঁইতিরিশ ঘণ্টা বিকুনের বুদ্ধিবৃদ্ধির এফেক্ট ঠিকমতো সহ্য করতে পারলে হয়! ভাবলেন পুরন্দর।

ব্যাপারটা যে ঝুনুর পক্ষেও বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটা পরদিন ওর অসহায় অবস্থা দেখেই বোঝা গেল। ও মাকে এসে অভিযোগ জানাল, বিকুনের সঙ্গে এক ঘরে বসে ও আর পড়বে না। বিকুন প্রায় মিনিটে-মিনিটে ওকে থামিয়ে দিয়ে কীসব উলটোপালটা বোঝাচ্ছে।

সোমা ঝুনুকে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু ঝুনুর তখন শান্ত হওয়ার মতো মনের অবস্থা আর নেই। ও প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘সব তো মনে নেই…তবুও ওর যে ক’টা প্রশ্ন মনে আছে শোনো। ওডোমিটার কাকে বলে? ইংল্যান্ডের কোন রাজা ইংরেজি বলতে পারতেন না? জেরান্টোলজিস্টরা কোন বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন? মোটরগাড়ির চাকায় খাঁজ কাটা থাকে কেন? বাংলাভাষায় কোন তিনটে অক্ষরের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি? ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে বিজ্ঞানী স্টিফেন কী যেন…।’

সোমা সত্যি-সত্যি কেঁদে ফেললেন। বললেন, ‘এ কী বিপদে পড়লাম বল তো! এ কী সর্বনাশ হল আমাদের!’

ঝুনু হাত দিয়ে চোখ মুছে বলল, ‘আর সর্বনাশ! অপর্ণাদি বলেছেন বিকুন সামনে বসে থাকলে উনি আমাকে আর পড়াবেন না।’

অপর্ণাদি ঝুনুর প্রাইভেট টিউটর। সেন্ট্রাল ক্যালকাটা গার্লস স্কুলের শিক্ষিকা। প্রায় তিনবছর ধরে ঝুনুকে পড়িয়ে আসছেন।

সোমা কান্না থামিয়ে চোখ বড়-বড় করে জিগ্যেস করলেন, ‘সে কী! অপর্ণাদিকে বিকুন আবার কী করেছে?’

‘কী আবার, ওই আই. কিউ.-র ওভারডোজ!’ বিরক্তভাবে বলল ঝুনু।

সোমা দুশ্চিন্তায় চোখ বুজে ফেললেন। বোধহয় ভগবানের নাম-টাম নেওয়ার চেষ্টা করলেন। সত্যি, শেষ পর্যন্ত কী যে হবে কে জানে! ছেলেটা এ দু-দিনে একটাও ছবি আঁকতে বসেনি, এক লাইনও কবিতা আওড়ায়নি। বারান্দায় একটিবারও যায়নি গাছপালা বা পাখি দেখতে। তা ছাড়া, বিকেলে আজ আর খেলতে বেরোয়নি। কাল সন্ধের মুখে বাড়ি ফিরে এসে গম্ভীর গলায় মাকে বলেছে, ‘আমি আর টিটো, তাতন, চুনির সঙ্গে খেলব না। ওরা আমার সঙ্গে খেলতে চাইছে না।’

সোমা ব্যাপারটা খানিক যেন আঁচ করতে পারলেন। তবু জানতে চাইলেন, ‘সে কী রে, কেন?’

বিকুন গজগজ করতে-করতে উত্তর দিল, ‘কে জানে কেন! আমি কাল বল খেলার সময় ওদের বারনুলির থিয়োরেম আর ম্যাগনাস এফেক্টের কথা জিগ্যেস করেছিলাম। তাতে ওরা কেমন ভয় পেয়ে গিয়ে আমাকে ফেলে পালিয়ে গেল।’

সোমা অবাক হলেন না। কারণ আজ প্রায় একই কারণে বিকুনের স্কুল থেকে হেডমাস্টারমশাই ফোন করেছিলেন পুরন্দরের অফিসে। ফোন করে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনার ছেলের মাথায় বোধহয় সামান্য কিছু প্রবলেম হয়েছে। সেটা সেরে না ওঠা পর্যন্ত ওকে স্কুলে পাঠাবেন না। মাস্টারমশাইরা কেন জানি না খুব ভয় পেয়ে গেছেন।’

সোমা বেচারা ঝুনুকে একবার দেখলেন, তারপর আড়চোখে ঘড়ির দিকে তাকালেন। ডক্টর বর্ধনের হিসেবমতো এখনও প্রায় চোদ্দো ঘণ্টা বাকি।

চোদ্দো ঘণ্টার মধ্যে প্রায় আট ঘণ্টা বিকুন ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। সেটুকু সময়ই যা নিশ্চিন্ত! বাকি সময়টা পুরন্দর-সোমা বেশ ভয়ে-ভয়ে কাটিয়েছেন। ছেলেকে আশেপাশে দেখতে পেলেই পুরন্দর হয় বাথরুমে ঢুকে ছিটকিনি এঁটে দিয়েছেন নয়তো সটকে পড়েছেন রাস্তায়। আর সোমা কাজের ছুতো করে সারাক্ষণ এঘর ওঘর ছুটোছুটি করে বেড়িয়েছেন। ঝুনু বিজ্ঞ ভাইয়ের কবল থেকে বাঁচতে বইপত্র নিয়ে চলে গেছে অরুণাদের বাড়ি।

বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ বিকুনকে ঘিরে জড়ো হল সবাই। ও তখন একমনে ইংরেজি খবরের কাগজ পড়ছে। তখনকার মতো ওরা সরে গেলেও ঘুরেফিরে নজর রাখতে লাগল বিকুনের ওপরে। একটু পরেই দেখা গেল বিকুন ইংরেজি কাগজের ক্রসওয়ার্ডটা চটপট সল্ভ করছে। ওরা কাছাকাছি আসতেই বিকুন মুখ তুলে বাবা-মা-দিদিকে একবার সামান্য অবাক চোখে দেখল, তারপর আবার মন দিল শব্দছকের দিকে।

পুরন্দর আজ অফিস কামাই করেছেন। ঝুনুও কলেজে যায়নি। বিকাশ বর্ধনের কথা যদি সত্যি হয় তা হলে আজ বারোটা নাগাদ তাঁর অভিনব চিকিৎসার এফেক্ট শেষ হওয়ার কথা। সেই মাহেন্দ্রক্ষণটিতে পুরন্দর বিকুনের কাছে হাজির থাকতে চেয়েছেন। কে জানে, নতুন করে আবার কোনও বিপত্তি হবে কি না! ঝুনুও একই আগ্রহে ক্লাস ডুব মেরেছে। আর সোমা বারবার তাকাচ্ছেন দেওয়াল ঘড়ির দিকে। সময়টা ঠিক কখন?

কাঁটায়-কাঁটায় বারোটা বেজে পাঁচ মিনিটে ঘটনাটা ঘটল। শব্দছকের শেষ শব্দটা খুঁজতে গিয়ে আটকে গেল বিকুন। ওর দুচোখে কেমন এক শূন্যদৃষ্টি। একটা হাত এলোমেলোভাবে মাথায় বোলাচ্ছে। ওর মুখ থেকে ‘উঃ’, ‘আঃ’, ‘ইস’ ইত্যাদি টুকরো শব্দ বেরিয়ে আসছে থেকে-থেকে।

পুরন্দর অতি উৎসাহে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কীরে, লাস্ট শব্দটা পারছিস না?’

বিকুন কেমন বিমূঢ় গলায় জবাব দিল, ‘না। দেখো না, শব্দটা একেবারে মাথায় এসে গিয়েছিল, কিন্তু ফস্ করে কী যে একটা ওলটপালট হয়ে গেল…।’ পুরন্দর খুশির এক চিৎকার করে সোমাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘এক মিনিট দাঁড়াও, আমি একছুট্টে ওর অঙ্ক বইটা নিয়ে আসি। ওটা দিয়েই ফাইনাল টেস্ট করব…।’

কথা শেষ হওয়ার আগেই পুরন্দর ঘর থেকে উধাও। আর সোমা বিকুনের কাছটিতে এসে ওর মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। ঝুনু তখনও অবাক চোখে ভাইকে দেখছে।

বলতে গেলে দশ সেকেন্ডের মধ্যেই পুরন্দর সেই অঙ্ক বই নিয়ে বিকুনের সামনে এসে হাজির, এবং চোখের পলকে আয়-ব্যয়ের সেই সহজ অঙ্কটি মেলে ধরেছেন ছেলের সামনে।

‘বল তো! এই সহজ অঙ্কটা মুখে-মুখে বুঝিয়ে দে তো আমায়।’

বিকুন গম্ভীরভাবে বিড়বিড় করে অঙ্কটা রিডিং পড়ল। তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে মন্তব্য করল, ‘অঙ্কটায় ভুল আছে, বাবা। প্রতি মাসে কখনও সমান টাকা খরচ হতে পারে না। বিশেষ করে পুজোর মাসে তো খরচ বেশি হবেই!’

আর যায় কোথায়! পুরন্দর হাত-পা শূন্যে ছুড়ে পাক্কা দু-হাত লাফিয়ে উঠলেন। চিৎকার করে বললেন, ‘হিপ হিপ হুররে! সোমা, দ্যাখো, দ্যাখো, বিকুন আবার অঙ্কে কাঁচা হয়ে গেছে। ওঃ, বাঁচা গেল!’

সোমা ছেলেকে একেবারে জাপটে ধরলেন। ওঁর চোখে জল এসে গেল। ধরা গলায় বললেন, ‘বুঝলে, আমার বোকাসোকা সুন্দর ছেলেটাই অনেক ভালো। ওর মুখটা কী মিষ্টি! কী সুন্দর আঁকতে পারে ও! আর আবৃত্তিতে তো একেবারে চ্যাম্পিয়ান! আমার আর বুদ্ধিমান ছেলের দরকার নেই গো!’

ঝুনু বিকুনের ছোট্ট মাথাটায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। নরম গলায় বলল, ‘মা, যা স্বাভাবিক তাকে কখনও চাপ দিয়ে বোধহয় পালটাতে নেই। পালটালে তার ফল ভালো হয় না—।’

পুরন্দর হেসে বললেন, ‘এইজন্যেই কথায় বলে, খোদার ওপর খোদকারি করতে নেই। আমি যাই, যতই বেলা হোক, এককেজি মুরগির মাংস নিয়ে আসি। বিকুনের অনারে আজকের স্পেশাল মেনু কষা মাংস আর পরোটা উইথ জলপাইয়ের চাটনি। ঝুনু, আজ তুই মায়ের সঙ্গে রান্নায় হাত লাগাবি।’

বাজারের থলে হাতে বেরোনোর সময় সোমার কানের কাছে মুখ এনে পুরন্দর চাপাগলায় বললেন, ‘ভাগ্যিস হরিপদ তলাপাত্রের কথায় বিকুনের বুদ্ধিটা ফাইনাল ঢালাই করিনি! তা হলে এক্ষুনি হয়তো ছেলেটা আমাকে মুরগির মাংসের কেমিক্যাল কম্পোজিশন জিগ্যেস করে বসত।’

স্বামীর কথায় সোমা খিলখিল করে হেসে উঠলেন। দুপুরের রোদ তখন জানলায় খেলা করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *