খেলতে-খেলতে
মা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত ডেকেই চলেছিলেন, কিন্তু সুনীতের কোনও খেয়াল নেই। পার্সোনাল কম্পিউটারের ওপর হুমড়ি খেয়ে দু-হাতে বোতাম টিপে যাচ্ছিল ও। আর কম্পিউটারের পরদায় খুদে একটা কালো বেড়াল এদিকওদিক লাফিয়ে বেড়াচ্ছিল।
‘ক্যাট’ খেলাটা গতকালই পেয়েছে গৌতমের কাছে। এমনি-এমনি অবশ্য দেয়নি। ক্যাটের বদলে ‘ডিগার’ গেমটা ওকে দিতে হয়েছে। আগে স্কুলের কম্পিউটারে বসে দিব্যি কম্পিউটার গেম্স খেলা যেত, কেউ কিছু বলত না। কিন্তু গত মাসে রঞ্জন গেম্স খেলার সময়ে কী করে যেন কম্পিউটারের হার্ড ডিস্কে ভাইরাস ঢুকিয়ে ফেলেছিল। ব্যস!
ওদের কম্পিউটার-টিচার মিস্টার গোম্স। দেখতে এমনিতেই লাল, তার মুখটা আরও লাল হয়ে গিয়েছিল। আর সঙ্গে-সঙ্গে নবাবি ফরমান জারি হয়ে গিয়েছিল, ‘নো গেম্স।’ যদি কাউকে দেখা যায় গেম্স খেলছে কম্পিউটারে, তাহলে সঙ্গে-সঙ্গে স্কুল থেকে বিদায়। ওদের প্রিন্সিপাল মিস্টার স্টুয়ার্টও খুব কড়া ধাতের মানুষ। উনিও গোম্সের কথায় একমত। তা ছাড়া, গোম্স স্কুলের সবচেয়ে সিনিয়ার টিচার।
মা কাছে এসে পিঠে হাত রাখতেই সুনীত বোতাম টেপা থামাল। তখন রঙিন পরদায় বেড়ালটা সবে একটা ডাস্টবিনের টিন থেকে লাফ দিয়ে কাঠের বেড়াটা টপকে কাপড়-ছড়ানো দড়ি ধরে ঝুলছে।
সুনীত বিরক্ত মুখে ফিরে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, ‘কী যে ডাকাডাকি করো না! কী হয়েছে?’
মা-ও বিরক্তভাবে বললেন, ‘কী আবার হবে, খাবার ঠান্ডা হচ্ছে। ক’টা বাজে খেয়াল আছে? তোমাকে কম্পিউটার কিনে দেওয়াটাই ভুল হয়েছে। বলছি তোমার বাবাকে- ·ľ
সুনীত কি-বোর্ড ছেড়ে উঠে পড়ল। কম্পিউটার অফ করে দিল। দেওয়ালঘড়ির দিকে তাকাল, রাত দশটা বাজতে আর পাঁচ মিনিট। এখন খেয়ে না নিলে কাঁটায়-কাঁটায় এগারোটায় নতুন খেলাটা চালানো যাবে না। স্পষ্ট মনে আছে, লোকটা বলেছে রাত এগারোটার আগে গেম্সটা না খেলতে। তাহলে নাকি আসল মজাটাই পাওয়া যাবে না। নতুন এই খেলাটার কথা এখনও কাউকে বলেনি সুনীত। কারণ, বলতে বারণ করে দিয়েছে বারবার।
খাবার টেবিলে বসে চুপচাপ খেতে-খেতে সকালে দেখা লোকটার কথা মনে পড়ছিল সুনীতের। ও তখন গৌতমের সঙ্গে স্কুলের বন্ধ সদর দরজায় এসে লোহার গরাদের ফাঁক দিয়ে ঝালমুড়ি কিনছে। প্রথমে খেয়াল করেনি। হঠাৎ কে যেন বলে উঠল, ‘খোকা, কম্পিউটার গেম্স নেবে? একেবারে নতুন, ম্যাজিকের মতো।’
চমকে তাকিয়েছিল সুনীত। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পরনে তালিমারা একটা ছাই রঙের ওভারকোট। ময়লা গায়ের রং। ভাঙা তোবড়ানো গাল। কপালে অসংখ্য ভাঁজ। আর চোখ দুটো যেন বরফের টুকরো।
কথা বলতে-বলতে কোটের পকেট থেকে একটা ঝকঝকে ফ্লপি ডিস্ক বের করে এনেছিল লোকটা। বাড়িয়ে ধরেছিল সুনীতের দিকে। আরও কীসব বলছিল, কিন্তু রাস্তা দিয়ে ট্রাম ছুটে যাচ্ছিল। তার ঘড়ঘড় শব্দে কিছু শোনা যায়নি।
ঝালমুড়ি কেনা হয়ে গিয়েছিল। গৌতম লোকটার চেহারা দেখে চাপাগলায় বলেছিল, ‘স্টোনম্যান। জলদি চলে আয়।’
কিন্তু সুনীত যে গেম্স-পাগল। তা ছাড়া, গৌতমের মতো ভীতুও নয়।
সুতরাং সে গৌতমকে থামতে বলে লোকটাকে জিগ্যেস করে বসল, ‘কত দাম?’ ‘দাম?’ অদ্ভুতভাবে খ্যা-খ্যা করে হাসল লোকটা। বলল, ‘এর কোনও দাম নেই, খোকাবাবু। জানের কি কোনও দাম হয়, অ্যা? এই নাও। তবে ঠিক রাত এগারোটায় গেম্সটা চালাবে। তার আগে না।’
গরাদের ফাঁক দিয়েই ফ্লপিটা সুনীতের দিকে এগিয়ে দিল লোকটা। ওর শিরা বের করা হাতে হাত ঠেকে গেল সুনীতের। উঃ, কী ঠান্ডা! বরফ যেন। চমকে হাত টেনে নিল ও। দেখল, লোকটা হাসছে মিটিমিটি। হলদেটে দাঁত বের করে বলল, ‘খোকাবাবু, তোমাকে দেখতে খুব সুন্দর। এইরকমই আমার পছন্দ—কিন্তু মনে থাকে যেন, রাত এগারোটার আগে না…।’
এই কথা বলে অদ্ভুত লোকটা জোরকদমে হাঁটা দিল বড় রাস্তা ধরে। ওর শরীরটা যেন বাতাসে ভর করে ভেসে যাচ্ছিল।
টিফিন শেষের ঘণ্টা বাজতেই ঘোর কাটল সুনীতের। গৌতম ওর জামা ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে ছুটতে শুরু করেছে ক্লাসরুমের দিকে। সঙ্গে অন্য ছেলেরাও ছুটছে। হইহই, এক জটপাকানো চিৎকার। তারই মধ্যে লোকটার কথা কানে বাজছিল, ‘…ঠিক রাত এগারোটায়…।
খাওয়া শেষ হতেই আবার কম্পিউটার রুমে এসে ঢুকল সুনীত। এগারোটা বাজতে পনেরো মিনিট বাকি। ওকে আবার এ-ঘরের দিকে আসতে দেখে মা অনুযোগ করছিলেন কিন্তু বাবা থামিয়ে দিয়েছেন মা-কে। বলেছেন, ‘কম্পিউটার ছাড়া এখানকার ছেলেমেয়েরা এক-পা চলতে পারে না। ও তুমি বুঝবে না। এ এক অবাক-করা যন্ত্র।’
সুতরাং লোকটার দেওয়া ফ্লপি ডিস্কটা ড্রয়ার থেকে বের করে নিয়ে বসল সুনীত। তাকিয়ে রইল ঘড়ির দিকে। ফ্লপিটা কেমন অদ্ভুত ঠান্ডা। ঠিক লোকটার হাতের মতো?
দেওয়াল-ঘড়িতে এগারোটার ঢং-ঢং আর সঙ্গে-সঙ্গেই কাজ শুরু।
কম্পিউটার অন করে দিল সুনীত। দু-বার ‘এনটার’ বোতামটা টিপে ডস্ প্রম্পটে চলে এল। তারপর ‘সি’ ড্রাইভ থেকে ‘এ’ ড্রাইভে গিয়ে ফ্লপিটা ঢুকিয়ে দিল ‘এ’ ড্রাইভের স্লটে। ডাইরেক্টরি দেখল : একটাই মাত্র ফাইল রয়েছে ফ্লপিটায়। নাম ‘ওয়ান্ডার’। সুতরাং দ্রুতহাতে কি-বোর্ডের বোতাম টিপতে লাগল সুনীত। আর কম্পিউটারের পরদায় নানা রঙে ফুটে উঠল নানা লেখা। লেখাগুলো পড়তেপড়তে সুনীতের মনে হচ্ছিল ওই হিম-চোখ লোকটা যেন ওকে পড়ে শোনাচ্ছে কথাগুলো :
‘কম্পিউটারের আশ্চর্য জগৎ নিয়ে ম্যাজিকের মতো এই খেলা “ওয়ান্ডার ওয়ার্ল্ড”। এটা আমার আবিষ্কার। আমাদের দুনিয়ায় মাত্র দুটো জগৎ রয়েছে : একটা কম্পিউটারের বাইরের জগৎ, যেখানে বসে তুমি কি-বোর্ডের বোতাম টিপছ। আর-একটা কম্পিউটারের ভেতরের জগৎ—আশ্চর্য জগৎ, যেখানে বসে আমি কথা বলছি…।’
সুনীতের বেশ মজা লাগল। এরকম কম্পিউটার গেম্স ও জীবনে দেখেনি। লেখাগুলো পড়তে-পড়তে ওর গায়ে কাঁটা দিল। কেমন যেন শীত করে উঠল । সে কি ঘরের এয়ার কন্ডিশনের জন্য?
টিভি পরদায় লেখাগুলো তখন পালটে গেছে। ফুটে উঠেছে নতুন লেখা : ‘এবারে কম্পিউটারের আশ্চর্য জগতে ঢুকে পড়ার জন্যে ফাংশান-কি এফ-ওয়ান বোতামটা টেপো।’
বিন্দুমাত্রও সময় নষ্ট না করে এফ-ওয়ান বোতামটা টিপল সুনীত। সঙ্গে -সঙ্গে রঙিন পরদায় পরপর ফুটে উঠল। ছবির মেলা—ঘর-বাড়ি, বাগান, পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল—কত কী! একে-একে সরে যাচ্ছে চোখের সামনে থেকে। আর ছবিগুলো কী আশ্চর্যরকম নিখুঁত! ঠিক যেন রঙিন ফোটোগ্রাফ। কম্পিউটার গ্রাফিক্স নিয়ে এত নাড়াচাড়া করেছে, সুনীত, কিন্তু এরকম নিখুঁত ছবি কখনও দেখেনি।
ছবির মেলা হঠাৎই থেমে গেল। তারপরই লেখা ফুটে উঠল পরদায় : ‘এইবার আসল খেলা শুরু। এই খেলায় ভীষণ মনোযোগ দরকার। আর দরকার নিরিবিলি ঘর—যাতে কেউ তোমাকে দেখতে না পায়। সেইজন্যেই বলেছি, রাত এগারোটার আগে এ-খেলা খেলবে না। তোমার আশেপাশে কেউ নেই তো? “ওয়াই কিংবা এন” বোতাম টিপে জবাব দাও “হ্যাঁ” অথবা “না”।’
সুনীত জানে, কেউ নেই। বাবা এখন বিছানায় শুয়ে গল্পের বই পড়ছেন, আর মা কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত উলবোনা মেশিনে নতুন-নতুন নকশা তুলছেন। তা সত্ত্বেও ও ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকাল পিছন দিকে। তারপর ‘এন’ বোতাম টিপে জবাব দিল, ‘না, ঘরে আর কেউ নেই।’ তখন আবার নতুন নির্দেশ ফুটে উঠল পরদায় : ‘এবারে তুমি তোমার ইচ্ছেমতো তৈরি করো আশ্চর্য জগৎ। তোমার খুশিমতো ঘর-বাড়ি, বাগান, সমুদ্র, পাহাড়—সব সাজিয়ে নাও। ঠিক যেমনটি তোমার পছন্দ।’
তারপরই পরদায় ফুটে উঠল কোন-কোন বোতাম টিপতে হবে তার লিস্ট সুনীত কাজ শুরু করল সঙ্গে সঙ্গেই।
দ্রুত হাতে বোতাম টিপে ও সাজাতে লাগল ঘর-বাড়ি। নানা রঙের নানারকম বাড়ির নকশা থেকে ও ওর পছন্দসই বাড়িটা বেছে নিল। তারপর তার খুঁটিনাটি রদবদল করে তৈরি করল সুন্দর একটা বাড়ি। কম্পিউটার গ্রাফিক্সে খেয়ালখুশিমতো যেভাবে ছবি আঁকে, এও ঠিক তেমনই।
বাড়ি তৈরি শেষ হতেই সুনীত তার লাগোয়া একটা ফুলবাগান জুড়ে দিল। তারপর বাড়ির পিছনে এঁকে দিল একটা পাহাড়। তার মাথায় বরফ। বাঃ, বেশ চমৎকার লাগছে বাড়িটা! আপনমনেই ভাবল সুনীত। এবারে একটা সমুদ্র জুড়ে দিলে কেমন হয়?
যা ভাবা তাই কাজ। একটা সমুদ্র জুড়ে দিল টিভির ছবিতে। তাতে মাঝারি মাপের ঢেউ। বাড়ি থেকে বেশ একটু দূরে সমুদ্রের শুরু। মাঝের জায়গাটায় বালি। বালিতে দুটো রঙিন ছাতা এঁকে দিল ও। এবারে দারুণ সুন্দর লাগছে। নোনা হাওয়ায় ছাতার ঝালরগুলো উড়ছে। বেলাভূমিতে শব্দ করে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের ঢেউ। বাতাসে উড়ছে জলকণা। আর বাগানের রঙিন ফুলগাছগুলো খুশিতে মাথা নাড়ছে। এই তো আশ্চর্য জগৎ!
ছবি আঁকা শেষ হতেই ‘কন্ট্রোল’ বোতাম টিপে দিয়ে সুনীত জানাল যে, ওর কাজ শেষ। আর সঙ্গে-সঙ্গেই রঙিন হরফে ফুটে উঠল নতুন লেখা : ‘এবারে তাহলে গৃহপ্রবেশ হয়ে যাক। এসো, ঢুকে পড়ো তোমার বাড়িতে। “অলটারনেট” আর “কন্ট্রোল” বোতাম টিপে রেখে “স্পেসবার’’টা টেপো।’
কেমন যেন ঘুম-ঘুম পাচ্ছিল সুনীতের। যেন একটা ঘোরের মধ্যে ও ডুবে যাচ্ছিল ‘ওয়ান্ডার ওয়ার্ল্ড’ এ-কম্পিউটারের আশ্চর্য জগতে। টিভি পরদায় ফুটে ওঠা নির্দেশ পালন করতে এতটুকু দেরি করল না ও। অলটারনেট, কন্ট্রোল আর স্পেসবার—ব্যস। সঙ্গে-সঙ্গেই সমুদ্রের জোলো হাওয়া এসে লাগল ওর চোখেমুখে।
কী আশ্চর্য! এই তো সেই রঙিন ছাতা দুটো। দিব্যি ছোঁওয়া যাচ্ছে! আর ওই তো নীল সমুদ্র! কী সুন্দর লাগছে ঢেউগুলো! রোদ-ঝকঝকে বালির ওপরে কিছুক্ষণ ছুটোছুটি করল সুনীত। দূরে দাঁড়ানো সুন্দর বাড়িটা দেখল। দেখল তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা বরফের সাদা টুপি পরা পাহাড়ের চুড়োটা। সত্যি, অদ্ভুত! কম্পিউটারের ভেতরের জগৎটা তাহলে মিথ্যে নয়—সত্যি!
হঠাৎই ওর মনে পড়ল, কম্পিউটার ওকে বাড়িতে ঢুকে পড়তে নির্দেশ দিয়েছে। সুনীতের বাড়ি। এত সুন্দর বাড়ি ও জীবনে কখনও দেখেনি। কাল স্কুলে গিয়ে গৌতমকে এই গেম্সটার কথা বলবে। ও যে সে-কথা মোটেই বিশ্বাস করবে না, সুনীত সেটা বাজি রেখে বলতে পারে।
এবারে ছুটে বাড়িটার কাছে গেল ও। সদর দরজাটা সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। টিভি পরদার ছবিতে এটা নজরে পড়েনি। সুনীত দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল বাড়ির ভেতরে। ক্যাঁচ-ক্যাচ শব্দ হল নতুন বাড়ির দরজায়। ঘরের ভেতরে কয়েকটা মাকড়সার জালও ওর নজরে পড়ল। আর একইসঙ্গে কেমন শীত-শীত করে উঠল হয়তো পিছনের পাহাড়ের চুড়ো থেকে ঠান্ডা নেমে আসছে।
ঘরটা মাপে বেশ বড়। তবে আবছা অন্ধকার আর চেহারায় পুরোনো। সিমেন্ট খসে পড়া বড়-বড় থাম। সিলিঙের ফাঁকে-ফোকরে নড়াচড়ার শব্দ। শোনা যাচ্ছে পাখি-টাখির ডানার ঝাপটানি। ডানদিকের দেওয়ালে বসানো কাচের শার্সি দিয়ে একফালি রোদ এসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। সেই আলোর রেখায় উড়ে বেড়াচ্ছে অসংখ্য ধূলিকণা। আর ঘরের একেবারে শেষপ্রান্তে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে।
শীতটা ধীরে-ধীরে বাড়ছিল। দু-হাত বুকের কাছে জড়ো করে সুনীত এগিয়ে গেল সিঁড়িটার দিকে। কেউ যেন ওকে টানছিল। ধুলোমাখা সিঁড়ির ধাপে পায়ের ছাপ ফেলে ও ওপরে উঠতে লাগল ।
দোতলায় দু-পাশে দুটো বিশাল ঘর। তার মাঝে অন্ধকার একটা অলিন্দ। অলিন্দের শেষে একটা বারান্দা। তার দরজার চৌকো ফ্রেমে দিনের আলো দেখা যাচ্ছে।
হঠাৎই বাঁ-দিকের ঘর থেকে একটা লোক বেরিয়ে এল অলিন্দে। পিছনে আলো থাকায় লোকটার সিলুয়েট ছবি ধরা পড়ল সুনীতের চোখে। ছায়াটা – দ্রুতপায়ে ওর দিকে এগিয়ে এল। যেন হাওয়ায় ভেসে পৌঁছে গেল ওর কাছে। খুব চেনা সুরে হাসল লোকটা। বলল, ‘এসো খোকাবাবু, এসো…।’
লোকটার ওভারকোট থেকে ন্যাপথলিনের গন্ধ নাকে আসছিল সুনীতের। একই সঙ্গে ভীষণ অবাক লাগছিল ওর। কম্পিউটারের আশ্চর্য জগতে এই লোকটা কেমন করে ঢুকে পড়ল?
লোকটা ওর হাত চেপে ধরল। কী ঠান্ডা হাত! সুনীতের হাত যেন অবশ হয়ে গেল। লোকটার সঙ্গে দু-পা হেঁটে যেতেই ডানদিকের ঘরটার ভেতরে চোখ পড়ল ওর। আবছায়া অন্ধকারে কয়েকটা ফুটফুটে সুন্দর ছেলেমেয়ের মলিন মুখ। সুনীতের নজর লক্ষ করে লোকটা মন্তব্য করল, ‘ওরাও তোমার মতো কম্পিউটার গেমস্-পাগল। তাই তোমারই মতো ঢুকে পড়েছে কম্পিউটারের আশ্চর্য জগতে।’
ঠিক তখনই মায়ের মুখটা মনে পড়ল সুনীতের। অমনিই সব ভুলে গেল ও। একটানে লোকটার হাত ছাড়িয়ে নিল। তারপর ছুটে গেল বারান্দার দরজার দিকে।
লোকটা প্রথমটায় ভ্যাবাচাকা খেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে তাড়া করল সুনীতকে।
কিন্তু ততক্ষণে সুনীত পৌঁছে গেছে বারান্দায়। বারান্দায় এসেই এক অদ্ভুত দৃশ্য ওর নজরে পড়ল।
ওর চোখের সামনেই একটা ঘর। ঘরটা খুব চেনা। ওর কম্পিউটার-রুম। ঘরের চেয়ার, টেবিল আর কম্পিউটারের কি-বোর্ডটা দেখা যাচ্ছে। হঠাৎই ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়লেন মা। ওর খালি চেয়ারটা দেখে অবাক হয়ে বোধহয় একটা চিৎকার করে উঠলেন। কোনও শব্দই শুনতে পেল না সুনীত। ওর চোখ গেল ঘরের দেওয়াল-ঘড়িটার দিকে। কাঁটায়-কাঁটায় বারোটা। পেণ্ডুলামটা দুলছে, কিন্তু কোনও শব্দ হচ্ছে না।
‘মা! মা!’ করে ডেকে উঠে সামনে হাত বাড়াল সুনীত। আর তখনই লেন্সের মতো বাঁকানো কাচের দেওয়ালটা ওর হাতে ঠেকল।
সুনীত চিৎকার করে উঠল পাগলের মতো। দুমদুম করে কিল মারতে লাগল কাচের দেওয়ালে। যে করে হোক, দু-জগতের মাঝের এই দেওয়ালটা ওকে ভাঙতেই হবে। তাই কাঁধের ওপরে সদ্য চেপে বসা ঠান্ডা হাতটাকে ও মোটেই আমল দিচ্ছিল না।