ঝামেলাকে নিয়ে ঝামেলা
মানতেই হবে এ-অন্যায়টা একটু অন্যরকমের। সাধারণ চুরি, ছিনতাই, মা:
কেপমারি বা রাহাজানি যেরকমটা হয়ে থাকে, ঠিক সেরকম নয়। বরং হাই-টেক যুগের সঙ্গে মানানসই এক হাই-টেক ক্রিমিনালের অভিনব কুকীর্তি। কোটিপতি ব্যবসায়ী গণপতি শাসমল সকাল দশটা নাগাদ কাঁকুড়গাছির একটি ‘এনিটাইম মানি ট্রান্সফার’ বুথে ঢুকেছিলেন। এ.টি.এম.টি. বুথে ঢুকে কম্পিউটারের বোতাম টিপে কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হোল্ডার নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে অন্যান্য ব্যাঙ্কের নানান অ্যাকাউন্টে ইচ্ছেমতো টাকা ট্রান্সফার করতে পারেন—শুধু সেই অ্যাকাউন্ট নম্বরগুলো জানলেই হল। কম্পিউটারাইজ্ড্ ব্যাঙ্কিংএর যুগে এই সুবিধে রীতিমতো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
এয়ার-কন্ডিশন্ড বুথে ঢুকে গণপতি শাসমল মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিলেন। মনিটরে নিজের অ্যাকাউন্টের ব্যালান্স দেখছিলেন আর হাতে-ধরা একটি চিরকুটে লেখা হিসেব অনুযায়ী বিভিন্ন পাওনাদারের অ্যাকাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করছিলেন।
হঠাৎই তাঁর ঠিক পিঠের কাছ থেকে কেউ স্পষ্ট গলায় বলে উঠল, ‘আমি একটা অ্যাকাউন্ট নম্বর বলছি। এক্ষুনি এই অ্যাকাউন্টে দু-লাখ টাকা ট্রান্সফার করুন। অ্যাকাউন্ট নম্বর 01204-0036795। যদি আপনি আমার কথা না শোনেন, তা হলে এটাই আপনার শেষ এ.টি.এম.টি. ভিজিট। কারণ…
গণপতি শাসমল চমকে পিছনে ফিরে তাকিয়েছেন, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। শব্দটা খুব চাপা, অনেকটা রেস্তোরাঁর মিউজিক সিস্টেমের মতো। কিন্তু স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করা কথাগুলো নিশির ডাকের মতো কিউবিল-এর ভেতরে অলসভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
‘…কারণ, আমার কথামতো কাজ না করে আপনি এই বুথ থেকে বেরোনোমাত্রই প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণ হবে। তাতে এই বুথ এবং আপনি—দুজনেই “নেই” হয়ে যাবেন। আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয় তা হলে বুথের দরজার লকের কাছটা ভালো করে দেখুন…।
গণপতি শাসমল এসি বুথে দাঁড়িয়ে ঘামতে শুরু করলেন। তাঁর ভয়ার্ত চোখ তখনও খুঁজে চলেছে কথাগুলো কোথা থেকে আসছে। সত্যিই কি তিনি জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে দাড়িয়েছেন? এরপরই ফুলস্টপ!
‘…লকের কাছটা ভালো করে দেখুন। দরজার পাল্লা আর ফ্রেমের মাঝে প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভের মোল্ড লাগানো আছে। আপনি বুথ থেকে বেরোনোর জন্যে যেই পাল্লাটা টেনে খুলবেন সঙ্গে-সঙ্গে ফিউজ উড়ে গিয়ে ফু স্ স্ স্…।’ শেষ শব্দটা বিস্ফোরণের শব্দের একটা মিনিয়েচার নকল বলা যেতে পারে।
পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মোছার চেষ্টা করলেন গণপতি। একইসঙ্গে তাঁর চোখ গেল দরজার লকের দিকে। কী যেন লাগানো রয়েছে জোড়ের কাছটায়! গণপতির শিরদাঁড়া বেয়ে একটা লাউডগা সাপ হাঁটতে শুরু করল।
‘অ্যাকাউন্ট নম্বরটা আবার বলছি : 01204-0036795। এবার তাড়াতাড়ি ট্রান্জ্যাকশন কমপ্লিট করুন। কুইক।’
গণপতি কি লোকটার কথা শুনবেন, নাকি বেঁচে থাকার তাগিদে আজীবন এই বুথের ভেতরেই বসে থাকবেন?
‘পাঁচমিনিটের মধ্যে ট্রাজ্যাকশন কমপ্লিট করুন, নইলে বুথ উড়িয়ে দেব।’ গণপতি আর ভরসা পেলেন না। পটাপট কম্পিউটারের বোতাম টিপতে শুরু করলেন।
একটু পরে আবার সেই নেশা ধরানো কণ্ঠস্বর শোনা গেল : দু-লাখের কম দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। তা হলে আমাকে আরও খারাপ কাজ করতে হবে। আর…কাউকে এই ঘটনার কথা বলবেন না। পুলিশকে তো নয়ই।
দু-লাখ টাকা নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করার পর গণপতি চুপচাপ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। ততক্ষণে কম্পিউটারের মনিটরে ব্যাঙ্কের হেড-অফিসের সুদৃশ্য বিল্ডিং-এর রঙিন ছবি ফুটে উঠেছে। তার সঙ্গে লেখা : ‘এ.টি.এম.টি. ব্যবহার করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমাদের গ্রাহকদের ব্যাঙ্কিং সুরক্ষায় আমরা সবসময় পাশে আছি।’
লেখায় ধন্যবাদের পর কথায় ধন্যবাদ পাওয়া গেল। অচেনা কণ্ঠস্বর আলতো করে বলল, ‘ধন্যবাদ। এবার আপনি নিরাপদে বুথ থেকে বেরোতে পারেন। আমি এক্সপ্লোসিভের ফিউজটা ডিঅ্যাক্টিভেট করে দিয়েছি।’
বুথের ঠান্ডা থেকে রাস্তার গরমে বেরিয়ে গণপতি শাসমল দারুণ আরাম পেলেন। বুকভরে শ্বাস টেনে তিনি টের পেলেন যে, এতক্ষণ তাঁর ঠিকমতো শ্বাস নেওয়া হয়নি।
গণপতি শাসমল থেকে ঘটনার শুরু। তারপর, একমাসের মধ্যে, এরকম আরও তিনটি ঘটনা ঘটে গেল। একটি এসপ্লানেডে, একটি ভবানীপুরে, আর একটি সল্টলেকে। তিনটি ক্ষেত্রেই ব্যাঙ্ক-গ্রাহকরা ভয় পেয়ে টাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন।
খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই হইচই শুরু হয়ে গেল শহরে। টিভি, ইন্টারনেট আর খবরের কাগজ ব্যাপারটা নিয়ে মস্ত শোরগোল শুরু করে দিল। পুলিশমহলে চলতে লাগল ঘন-ঘন মিটিং। একরাশ আতঙ্ক নিয়ে মানুষ এ.টি.এম.টি. বুথ ব্যবহার করতে লাগল। কারণ, পেপারলেস ব্যাঙ্কিং-এর যুগে এ.টি.এম.টি. ব্যবহার না করে উপায় নেই।
এদিকে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের কর্মকর্তারা একজোট হয়ে বারবার আলোচনায় বসতে লাগলেন। আজ কলকাতা শহরে ব্যাপারটা ছড়িয়ে পড়েছে—কাল যে মুম্বই, দিল্লি এবং অন্যান্য শহরে ছড়িয়ে পড়বে না তার গ্যারান্টি কী! শেষ পর্যন্ত ব্যাঙ্কিং ব্যবসা লাটে না ওঠে!
এই অদ্ভুত ব্যাপারটা নিয়ে সারা শহর যখন টগবগ করে ফুটছে তখন কীভাবে যেন পুলিশমহল আর ভারত সরকারের ওপরমহলের যোগাযোগে ঝালা-পালার ছোটকা এর মধ্যে জড়িয়ে পড়ল।
দুই যমজ ভাই চন্দ্রকান্ত আর ইন্দ্রকান্ত তখন গরমের ছুটিতে দার্জিলিং বেড়াতে যাওয়ার জন্য তৈরি। ছোটবেলায় ওরা দুজনে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করত বলে ছোটকা ওদের নাম রেখেছে ‘ঝালা-পালা’। এ.টি.এম.টি. বুথের রহস্যটা হাতে আসতেই ছোটকা ওদের ডেকে বলল, ‘ঝালা-পালা, শোন। এ.টি.এম.টি. থেকে অদ্ভুত কায়দায় ডাকাতির ব্যাপারটা আমার ঘাড়ে এসে পড়েছে। কিন্তু তোরা তো আজ রাতেই ট্রেন ধরবি। ভীষণ মিস করবি…কিন্তু কিছু তো করার নেই!’
ইন্দ্রকান্ত বেজার মুখে বলল, ‘ছোটকা, দার্জিলিং যেতে আর ইচ্ছে করছে না। তার চেয়ে তোমার সঙ্গে থাকলে অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং হত।’
চন্দ্রকান্ত তখনও ঠিক করে উঠতে পারেনি কোনটা বেশি অ্যাট্রাক্টিভ— দার্জিলিং না এ.টি.এম.টি. মিস্ট্রি। তাই ও পকেট থেকে একটা পঞ্চাশ পয়সার কয়েন বের করল টস করার জন্য।
ছোটকা ওদের মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘এখন আর কোনও উপায় নেই রে। দাদা, বউদি রেগে ফায়ারবল হয়ে যাবে। বরং তোরা ফিরে এসে গল্প শুনিস।’
ঝালা-পালার ছোটকা ভারত সরকারের গোপন তদন্ত বিভাগে কাজ করে। আর ইলেকট্রনিক্স-এ দুর্দান্ত এক্সপার্ট। সেই কোন ছোটবেলা থেকেই নানান অটোমেটিক জিনিস তৈরি করত। বছরদুয়েক আগে পঞ্চাশ কেজি ওজনের একটা বাচ্চা-রোবট তৈরি করে ছোটকা ঝালা-পালাকে প্রেজেন্ট করেছে। বাচ্চা-রোবটটা সবসময় ঝামেলা করে বলে ছোটকাই ওর নাম রেখেছে ঝামেলা।
ছোটকা বলল, ‘ঝামেলা আমার কাছে থাক। আমার কাজে একটু-আধটু হেল্প হতে পারে। তোরা ঝামেলাকে ছেড়ে সাতটা দিন থাকতে পারবি না?’ ঝালা-পালা একসঙ্গে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ পারব।’ এমন সময় ওরা ঝামেলার পায়ের শব্দ শুনতে পেল। ঠং-ঠং করে পা ফেলে
এদিকেই আসছে।
হাফপ্যান্ট পরা তিনফুট হাইটের রোবটটা হেলেদুলো ঘরে এসে ঢুকল। মাথাটা পাঁচনম্বর ফুটবলের মতো প্রকাণ্ড—রুপোর মতো ঝকঝক করছে। হাতপাগুলো কাঠির মতো সরু লিকলিকে। গায়ে একটা রংচঙে হাফশার্ট। ওর চোখ দুটো দেখতে টেনিসবলের মাপের কাচের গুলি—ঠেলে বেরিয়ে আছে বাইরে। আসলে ও-দুটো পুঞ্জাক্ষি, যেমনটা মাছির থাকে। অনেকগুলো লেন্স মিলিয়ে তৈরি এই পুঞ্জাক্ষি দিয়ে ঝামেলা প্রায় একমাইল দূর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পায়।
বলের মতো চোখ দুটো ঘুরিয়ে মিহি ধাতব স্বরে ঝামেলা ঝালা-পালাকে বলল, ‘স্বার্থপরতা মানবধর্ম। আমাকে ফেলে রেখে দিব্যি দার্জিলিং গয়ং গচ্ছতি। রোবটরা এমন স্বার্থপর নহে। তাহারা ফ্যান্টাসটিক উদার।’
ছোটকা হেসে বলল, ‘ঝামেলা দেখছি ডায়ালগে হেভি উন্নতি করেছে! বাংলা, সংস্কৃত, ইংরেজি পাঞ্চ করে কথা বলছে! ঝালা-পালা, তোরা তো দারুণ ট্রেনিং দিয়েছিস রোবটটাকে!’
ঝামেলার শিক্ষানবিশি এখনও চলছে। কথা বলার সময় ও সবকিছু কেমন জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ফেলে। কোনও-কোনও শব্দ উচ্চারণ করতে কষ্ট হয়। তার সঙ্গে আছে গুরুচণ্ডালীর সমস্যা।
ইন্দ্ৰকান্ত ঝামেলাকে বলল, ‘দার্জিলিং যেতে পারছ না বটে, তবে তার বদলে একটা দারুণ ইন্টারেস্টিং ব্যাপারে ছোটকার সঙ্গে থাকতে পারছ। তুমি ভীষণ লাকি।’
ঝামেলা পিছনে হাত রেখে গম্ভীর সুরে বলল, ‘ঠিক আছে। যাচ্ছ যাও— তবে ওখানে গিয়ে বেশি হুটোপাটি করিয়ো না। তোমরা যা দুরন্ত প্রকৃতির বালক! তোমাদিগকে নিয়ে বড্ড দুশ্চিন্তা হয়!’
ছোটকা ঝামেলার মাথায় আলতো করে একটা চাঁটি মেরে বলল, ‘রোবটটাতো বড় এঁচোড়ে পাকা হয়ে গেছে দেখছি!’
ঝামেলা হঠাৎই ছোটকাকে ঘিরে ঘুরপাক খেতে লাগল। ওর কপালে বসানো ছোট-ছোট লাল-নীল বাতিগুলো এলোমেলোভাবে জ্বলতে-নিভতে লাগল। ঝামেলার কখন যে কী মতিগতি হয় সে ও-ই জানে!
ছোটকা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না এ.টি.এম.টি.-র মাধ্যমে অন্য অ্যাকাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করিয়ে ওই ইলেকট্রনিক ডাকাতটা শেষ পর্যন্ত টাকাটা হাতে পাচ্ছে কেমন করে।
এ-ব্যাপারে তদন্তে নেমে পুলিশের কাছ থেকে ভারী অদ্ভুত রিপোর্ট পেল ছোটকা। পুলিশ হেডকোয়ার্টারে বসে স্পেশাল মিটিং-এ আলোচনার সময় অফিসার-ইন-চার্জ যোগিন্দার শুক্লা বললেন, ‘আমরা ব্যাঙ্কের কম্পিউটার ডেটাবেস ঘেঁটে যে চারটে অ্যাকাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করা হয়েছে তার নম্বরগুলো পেয়েছি। শুনলে আপনারা অবাক হবেন, চারটে অ্যাকাউন্ট নাম্বার চাররকম। এবং তার মালিকরা জানেন না এই টাকা কেন হঠাৎ তার অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করা হয়েছে।’
‘তা হলে ক্রিমিনালটার লাভ কী?’ ছোটকা জানতে চাইল।
এবার উত্তর দিলেন ইনভেস্টিগেটিং অফিসার রিমিন গুপ্ত : ‘মিস্টার চৌধুরী, লাভটা গতকালই জানা গেছে। আমরা শহরের সবকটা এ.টি.এম.টি. বুথে ওয়াচ রাখছিলাম। তা ছাড়া ওই চারটে অ্যাকাউন্টের টাকা লেনদেনের ওপরেও নজর রাখছিলাম। ওই হাইটেক ক্রিমিনালটা কী করেছে জানেন?’ হাসলেন রিমিন। মেটাল ফ্রেমের চশমাটা নাকের ওপরে ঠিক করে বসিয়ে বললেন, ‘ওই চারটে অ্যাকাউন্ট থেকে আবার নতুন চারটে অ্যাকাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করেছে। তারপর তারই একটা অ্যাকাউন্টকে টার্গেট করে সেই অ্যাকাউন্ট হোল্ডারকে দিয়ে ক্যাশ উইথড্র করিয়েছে।’
‘মাই গুড্নেস!’ ছোটকা অবাক হয়ে বলল, ‘সেই ভদ্রলোক কি ব্যা রটা আপনাদের কাছে রিপোর্ট করেছেন?’
‘হ্যাঁ। ওঁর নাম সঞ্জীব মিত্র—মিলেনিয়াম হাই স্কুলের টিচার। ওঁকে আমরা ডেকে পাঠিয়েছি। বাইরের ঘরে উনি অপেক্ষা করছেন। এ ছাড়া আরও চারজন রয়েছেন—ওঁরা সবাই বোমার ভয়ে অন্য অ্যাকাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করেছেন। আমরা অলরেডি কথা বলেছি। আপনি ইচ্ছে করলে ওঁদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।’
ছোটকা মনে-মনে হিসেব করছিল। ক্রিমিনালটা মোট ন’জনকে এ.টি.এম.টি. বুথে অদ্ভুত কায়দায় পাকড়াও করেছে। তারপর নানান অ্যাকাউন্টে টাকা চালাচালি করে শেষ পর্যন্ত ক্যাশ টাকা হাতিয়েছে। এটা তো সে প্রথমেই করতে পারত। করেনি তার কারণ পুলিশকে সে ঘোল খাওয়াতে চেয়েছে।
এই কেসের ফাইলটা ছোটকা এতবার পড়েছে যে, প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে। তা ছাড়া কেসের ইম্পর্ট্যান্ট পয়েন্টগুলো ছোটকা ঝামেলাকে দিয়ে মুখস্থ করিয়ে নিয়েছে। যখন খুশি ওকে নির্দেশ দিলেই ও গড়গড় করে হুবহু সব উগরে দিতে পারবে।
মিটিং রুমের এক কোণে ঝামেলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। ছোটকা ওর চলাফেরা আর কথা বলার সার্কিট দুটো অফ করে রেখেছিল। শুধু চোখ আর কান অ্যাক্টিভ ছিল। ঝামেলার কান বলতে যা বোঝায় সেরকম কিছু নেই—তার জায়গায় আছে দুটো ফুটো। কিন্তু ওর শ্রবণক্ষমতা পশুপাখিকেও হার মানায়। সূক্ষ্ম আলট্রাসনিক শব্দও ওর ওই ‘কানে’ ধরা পড়ে।
ছোটকা চলাফেরা আর কথা বলার সার্কিট দুটো অন করে দিতেই ঝামেলা বলল, ‘বাব্বাঃ, এতক্ষণ নিশ্চুপ করিয়া থাকার কী যে কেষ্ট তাহা বোনে-বোনে বুঝিতে পারলাম।’
ছোটকা অনুমান করতে পারল ‘কেষ্ট’টা ‘কষ্ট’ হবে। কিন্তু ‘বোনে-বোনে’ মানেটা কী! ঝামেলার তো কোনও বোন নেই!
‘বোনে-বোনে মানেটা কী বলো তো? ঠিক বুঝতে পারলাম না।’
ঝামেলা হাত-পা নেড়ে মাথা ঘুরিয়ে বলল, ‘বোনে-বোনে মানে হাড়ে-হাড়ে। কী যে তব বুদ্ধি!’
ছোটকা এ-নিয়ে আর কথা বাড়াল না। সত্যি, ঝামেলাটা বড্ড জ্যাঠা হয়ে উঠেছে।
বাইরের ঘরের দিকে যেতে-যেতে ছোটকা চাপা গলায় বলল, ‘শোনো, এখন আমি কয়েকজন লোকের সঙ্গে এই কেসের ব্যাপারে কথা বলব। তুমি চুপচাপ সব রেকর্ড করে নেবে।’
‘তথাস্তু।’ ঝামেলা বলল ।
কাচের দরজা ঠেলে ওরা বাইরের ঘরটায় এল।
বিশাল ঘর। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। তিনদিকে কাচের দেওয়াল। ফ্লুওরেসেন্ট বাতির নরম সাদা আলো সারা ঘরে ছড়িয়ে রয়েছে। একটা ডোমেস্টিক-রোবট ট্রে-তে করে সবাইকে চা-কফি সার্ভ করছে। ঘরের তিনটে দরজার কাছে তিনটে সিকিওরিটি রোবট চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। দরজা দিয়ে যারাই আসা-যাওয়া করছে ওরা তাদের আইডেন্টিফিকেশান নাম্বার জেনে রেকর্ড করে নিচ্ছে। রোবটগুলোর চেহারা বেশ দশাসই আর লম্বা।
রিমিন গুপ্ত ছোটকা আর ঝামেলার পিছন-পিছন হেঁটে আসছিলেন। ঘরে ঢোকার সময় সিকিওরিটি রোবট ওঁদের আই.ডি. নম্বর জানতে চাইল। ওঁরা নম্বর বলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন।
ঝামেলা হেলেদুলে সিকিওরিটি রোবটটাকে পেরিয়ে যাওয়ার সময় ওটা চাপা ব্যঙ্গের গলায় বলে উঠল, ‘আমি লম্বা, তুই বেঁটে।’
ঝামেলা ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘আমি স্বাধীন, তুই চাকর।’ তারপর তাড়াতাড়ি পা ফেলে ছোটকার কাছাকাছি পৌঁছে গেল—পাছে লম্বা রোবটটা তেড়ে আসে।
একটা বৃত্তাকার সোফায় সঞ্জীব মিত্র ও অন্যান্যরা বসেছিলেন। রিমিন ওঁদের কাছে গিয়ে বললেন, ‘আপনাদের সঙ্গে আমরা আর-একবার কথা বলব। সঞ্জীববাবু, আপনি প্রথমে আসুন…।’
একটা প্রকাণ্ড কাচের টেবিলের কাছে ছোটকা আর ঝামেলাকে নিয়ে গেলেন রিমিন ঃ ‘মিস্টার চৌধুরী, এখানে বসেই আপনি ওঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে নিন। কী, কোনও অসুবিধে হবে না তো?’
‘না, না, বরং সুবিধেই হবে।’
ছোটকা আর রিমিন গুপ্ত টেবিলের একদিকে বসে পড়লেন। ঝামেলা বসতে যাচ্ছিল, কিন্তু চেয়ারগুলো কাচের তৈরি বলে কী ভেবে আর বসল না—চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে রইল।
সঞ্জীব মিত্র ছোটকাদের মুখোমুখি বসলেন।
তারপর শোনালেন ওঁর কাহিনি।
সঞ্জীব মিত্রের কাহিনিটা গণপতি শাসমলের মতোই। শুধু অন্য কোনও অ্যাকাউন্ট নম্বরে টাকা ট্রান্সফার করার বদলে ওঁকে মেশিন থেকে ক্যাশ উইথড্র করতে বলা হয়েছে।
সঞ্জীব মিত্র মাথা ঝুঁকিয়ে কথা বলছিলেন। ওঁর ফরসা মুখে লালচে আভা। বাঁ চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপছে। নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে ভদ্রলোক বেশ নার্ভাস হয়ে পড়েছেন।
‘…দেখুন, ওই দু-লাখ টাকা আমার নয়। কে আমার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়েছে জানি না। তাই ওরকম ভূতুড়ে আদেশ পাওয়ামাত্রই আমি ভয় পেয়ে দু-লাখ টাকা ক্যাশ উইথড্র করে নিই…।’
‘উইথড্র করে টাকাটা কী করলেন?’ ছোটকা জিগ্যেস করল।
‘লোকটা যেমন অর্ডার দিল তাই করলাম। টাকাটা মেশিন থেকে বেরিয়ে আসামাত্রই ওটা গোছা ধরে মেশিনের পাশ ঘেঁষে এক কোণে গুঁজে রাখলাম। তারপর বুথ থেকে বেরিয়ে সোজা হাঁটা দিয়েছি—আর পেছন ফিরে তাকাইনি।’
রিমিন বললেন, ‘আপনি চলে যাওয়ার পরই ওই ক্রিমিনালটা নিশ্চয়ই ওই বুথে গিয়ে ঢুকেছে। এবং টাকাটা তুলে নিয়ে চম্পট দিয়েছে।’
ছোটকা বলল, ‘সেটাই ওভিয়াস’।
সঞ্জীব ইতস্তত করে বললেন, ‘দেখুন…আমার হয়তো অতটা ভয় পাওয়া উচিত হয়নি, কিন্তু প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ শুনে আর ঝুঁকি নিতে সাহস হয়নি। অবশ্য লোকটা ধাপ্পা দিয়েও থাকতে পারে।’
রিমিন মাথা ঝাঁকালেন, বললেন, ‘না, ধাপ্পা নয়। আমরা এ.টি.এম.টি. বুথগুলোর ফোরেনসিক অ্যানালিসিস করেছি। তাতে আমরা অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের ট্রেস পেয়েছি। আর সামান্য লেড অ্যাজাইডও পাওয়া গেছে। লেড অ্যাজাইড এক্সপ্লোসিভের প্রাইমার মেটিরিয়াল।’
সঞ্জীব মিত্রকে ছেড়ে দিয়ে ছোটকা রিমিনকে বলল, ‘আরও তিনজনের কাছ থেকে ক্যাশ টাকা হাতানো বাকি রয়েছে। এ.টি.এম.টি. বুথগুলোর ওপরে আমাদের কড়া নজর রাখতে হবে।’
রিমিন বললেন, ‘আমরা তো কনস্ট্যান্ট ওয়াচ রেখেছি—।’
‘না, ঠিক ওরকম নয়–আমার এই স্পেশাল অ্যাসিস্ট্যান্ট বাচ্চা-রোবটটা স্পেশাল ওয়াচ রাখবে।’
রিমিন ঝামেলার দিকে তাকালেন, বোধহয় ওর স্পেশালিটি খুঁজতে চাইলেন। ঝামেলা মাথা ঝুঁকিয়ে রিমিনকে কুর্নিশ করল।
সঞ্জীব মিত্রের পর বাকি চারজনের সঙ্গেও কথা বলল ছোটকা৷
মোটাসোটা গণপতি শাসমল ঘন-ঘন শ্বাস নিয়ে ওঁর গল্পটা বললেন, তারপর অবাক হয়ে বললেন, ‘ক্রিমিনালটা বুথের ভেতরে কেমন করে কথা বলছিল বলুন তো!’
ছোটকা হেসে বলল, ‘সিল। একটা কর্ডলেস মাইক্রোস্পিকার লোকটা বুথের ভেতরে ফিট করে দিয়েছিল। আর তার সঙ্গে বোধহয় একটা মিনিয়েচার ভিডিয়ো ক্যামেরাও লাগিয়েছিল…সেটা দিয়ে এ.টি.এম.টি. মেশিনের মনিটর আর আপনাকে লক্ষ রাখছিল।’
‘তারপর কাজ শেষ হয়ে গেলে ওগুলো আবার খুলে নিয়ে গেছে।’ রিমিন ছোটকার কথার পিঠে যোগ করলেন।
গণপতির পর ছোটকা কথা বলল মেঘা দাশগুপ্তের সঙ্গে।
মেয়েটি রোগা, ফরসা। চোখে ছোট-ছোট কাচের বিদেশি চশমা। ঠোঁটে ক্যাডবেরি লিপস্টিক। ইকো, জিও, ম্যাথ নিয়ে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। হাবভাবে একটা বিশ্রী বড়লোক-বড়লোক গন্ধ ঠিকরে বেরোচ্ছে।
ছোটকার প্রশ্নের উত্তরে মেঘা বলল, ‘লুক, আমার পাঁচ-ছ’টা এ.টি.এম.টি কার্ড আছে। আই ডোন্ট রিমেমবার হুইচ ওয়ান আই ওয়জ ইউজিং দ্যাট ডে। পসিব্লি আমেরিকান এক্সপ্রেস। এনিওয়ে…সাডেন্লি কে যেন খুব কাছ থেকে কথা বলে উঠল। আমি তো চমকে উঠেছি। তারপর…।’
সেই এক গল্প। নতুন কোনও সূত্র পেল না ছোটকা।
মেঘা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলেই চলল,…‘ক্যালকাটা পুলিশের তো ভীষণ নামডাক শুনি…অবশ্য মিডিয়াগুলো আজকাল তেমন রিলায়েল নয়। নইলে ক্যালকাটা পুলিশ এই হরিবল ক্রিমিনালটাকে অ্যারেস্ট করে ফাঁসিতে লটকাতে পারছে না! বলে কি না বুথ এক্সপ্লোড করে উড়িয়ে দেবে! ক্যান য়ু ইম্যাজিন দ্য লেভেল অফ অডাসিটি! মানুষের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা! পুলিশ কিছু করতে পারবে বলে আমার মনে হচ্ছে না। আজকাল হাই আই. কিউ.-র ক্যান্ডিডেটরা মোটেই পুলিশে চাকরি করতে আসছে না। আর ওল্ড ব্রেন যেসব পুলিশে আছে সেগুলোয় সব রাস্ট পড়ে গেছে।’
ছোটকা মুচকি হেসে মন্তব্য করল, ‘ম্যাডাম, উপদেশের জন্যে ধন্যবাদ।’ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মেঘা। পোশাকটা ঠিক করে নিয়ে বলল, ‘আমি ড্যাডিকে ব্যাপারটা একটু দেখতে বলব। বলব, য়ু ক্যানট ডিপেন্ড আপন দ্য হোপলেস কপ্স।’
মেঘার উত্তেজনা আর বিরক্তি দেখে ছোটকা বেশ মজাই পাচ্ছিল। আড়চোখে রিমিন গুপ্তের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসল। সন্দেহ নেই মেঘা বড়লোকের আদরে আর পয়সায় বখে যাওয়া মেয়ে।
‘আই ডোন্ট কেয়ার অ্যাবাউট দ্য ব্লাডি টু ল্যাক্স। কারণ, টাকাটা বড় কথা নয়—সেফটিটাই আসল…।’ মেঘা একটানা বকেই যাচ্ছিল।
রিমিন ওর জঙ্গি কথার স্রোতকে বাধা দিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘আপনার ড্যাডি কী করেন? পুলিশে চাকরি করেন?’
‘চাকরি! হোয়াট ডু য়ু মিন? আমার ড্যাডির নাম অরিন্দম দাশগুপ্ত-দ্য ফেমাস বিজনেস টাইকুন…।’
রিমিন হেসে বললেন, ‘হি মাস্ট বি আ ভেরি ইন্টেলিজেন্ট ম্যান। আপনি এবার আসতে পারেন।’
মেঘা ব্যঙ্গের খোঁচাটা বুঝতে পারল। কী একটা বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। তারপর গটগট করে হাঁটা দিল।
মেঘার পর সর্বেশ্বর সরকার।
ছোট ব্যবসায়ী। বয়েস হয়েছে। তাই বোধহয় একটু বেশিই ভীতু।
সর্বেশ্বর মাথার চুলে বেশ কয়েকবার হাত বোলালেন। চোখে বসানো মেটাল ফ্রেমের চশমা বারকয়েক খুললেন, পরলেন। তারপর বললেন, ‘আর বলবেন না, মশাই! ওটা এ.টি.এম.টি. বুথ, না ডেথ চেম্বার? আমি তো ঠিক করেছি নেক্সট থ্রি মান্থস্ ওইসব বুথ-ফুথে ঢুকব না।’
‘কেন? তিনমাস কেন?’ রিমিন জিগ্যেস করলেন।
‘তিনমাসের মধ্যে আপনারা ক্রিমিনালটাকে পাকড়াও করতে পরবেন না? সেইজন্যেই তিনমাস বলেছি। না, মশাই—গতিক সুবিধের মনে হচ্ছে না। আপনাদের ফেস-টেস দেখে মনে হচ্ছে, আরও টাইম লাগবে।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কী যেন ভাবলেন সর্বেশ্বর। তারপর বললেন, ‘তা হলে স্ট্রেটকাট বলি। যদ্দিন না আপনারা ওই শয়তানটাকে ধরতে পারছেন তদ্দিন আমি ওই ডেথ চেম্বারগুলোর দিকে এগোচ্ছি না। বলে কি না বুথ উড়িয়ে দেবে! ভাবা যায়, দীনবন্ধু…।’ ছোটকা ভুরু কুঁচকে জিগ্যেস করল, ‘দীনবন্ধু মানে??
হাসলেন সর্বেশ্বর ঃ দীনবন্ধু বলে ভগবানকে ডাকাডাকি করলাম। রাখলে উনিই রাখবেন…।’
‘আর মারলে উনিই মারবেন।’ হেসে যোগ করল ছোটকা।
রিমিন বললেন, ‘আপনার কোনও চিন্তা নেই, মিস্টার সরকার। তিনমাস অনেক সময়—তার আগেই আমরা ক্রিমিনালটাকে অ্যারেস্ট করে ফেলব।’ ‘দীনবন্ধু ভরসা।’ বলে বিদায় নিলেন সর্বেশ্বর।
সবশেষে জুবিন প্রধান। বছর তিরিশ-বত্রিশের স্বাস্থ্যবান তরুণ। সে সরাসরি বলেই বসল, এই ক্রিমিনালকে পাকড়াও করা পুলিশের কর্ম নয়। কারণ টেকনোলজিতে কলকাতা পুলিশ এই লোকটার চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে।
ছোটকা জুবিনের গল্পটা শুনল। মোটামুটি একই গল্প। তবে জুবিন একটা
বাড়তি তথ্য দিল, বলল, ‘আমার মনে হয়, ক্রিমিনাল একজন ওল্ড ম্যান। ‘কেন?’
‘কারণ, আমি বুথ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর একজন ফিটফাট বৃদ্ধ মানুষকে সেটায় ঢুকতে দেখেছি।’
এই তথ্য পেয়ে ছোটকা এবং রিমিন গুপ্ত নড়েচড়ে বসলেন। ছোটকা আরও অনেক প্রশ্ন করল জুবিনকে। কিন্তু বাড়তি আর কোনও খবর পাওয়া গেল না। জুবিন বলল, ও ভয় পেয়ে যাওয়াতে বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়ায়নি।
বৃদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে জুবিন জানাল, সাধারণ প্যান্ট-শার্ট পরা, মাথায় সাদা চুল, চোখে বোধহয় চশমা ছিল। পুলিশের ইন্টারোগেশানের সময় জুবিনের খেয়াল না থাকায় এই তথ্য জানাতে পারেনি।
রিমিন গুপ্ত বললেন, ‘আপনি কেন ওই বৃদ্ধকে সন্দেহ করছেন, মিস্টার প্রধান? উনি তো একজন অর্ডিনারি এ.টি.এম.টি. কাস্টমারও হতে পারেন?’ ‘হতে পারে…তবে…’ কিছুক্ষণ কী যেন চিন্তা করল জুবিন। তারপর ঃ তবে ওই বৃদ্ধের গতিবিধি খুব পিকিউলিয়ার ছিল—সন্দেহ করার মতো।’
‘যেমন?’ জানতে চাইল ছোটকা।
‘লোকটার হাতে একটা বাক্সমতন কী যেন ছিল। তা ছাড়া বারবার চোরাচাউনিতে এদিক-ওদিক দেখছিল।’
ছোটকা টেবিলে আঙুলের ডগা ঠুকল। ছোট্ট করে বারদুয়েক ‘হুঁ’ বলল, জুবিন যা বলছে তার মধ্যে সারবস্তু কিছু থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু একজন বৃদ্ধ কি তা হলে শখে এইরকম হাই-টেক ডাকাতি করছেন? ছোটকার ভুরু কুঁচকে গেল।
রিমিনের সঙ্গে কথা শেষ করে ছোটকা ঝামেলাকে নিয়ে রওনা হল।
হেড কোয়ার্টারের বাইরে এসে একটা সরু চুরুট ধরাল ছোটকা। বলল, ‘এসি অফিসে বসে এতক্ষণ চুরুট না খেয়ে একেবারে হাঁফিয়ে উঠেছি।’
উত্তরে ঝামেলা কোনও কথা বলল না। শুধু পকেট থেকে রুমাল বের করে নাকে চাপা দিল।
পরদিন থেকে ঝামেলাকে সঙ্গে নিয়ে ছোটকার এ.টি.এম.টি. বুথে নজরদারি শুরু হল।
ব্যাঙ্কের বড়কর্তাদের কাছ থেকে একটা এ.টি.এম.টি. মাস্টারকার্ড নিয়েছে ছোটকা। এই কার্ড দিয়ে যে-কোনও এ.টি.এম.টি. বুথে ঢোকা যায়। ছোটকা একটা বুথে ঢুকে টাকা লেনদেনের ভান করে। আর প্রায় আট-নশো মিটার দূর থেকে ঝামেলা সেই বুথটার ওপরে নজর রাখে। তারপর ছোটকা চলে যায় আর-একটা বুথে। তারপর আর-একটায়।
এইভাবে একটানা বাইশদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ঘটনাটা আচমকাই ঘটে গেল।
ছোটকা তখন শ্যামবাজার অঞ্চলের একটা এ.টি.এম.টি. বুথে ঢুকেছে। হঠাৎ শুরু হয়ে গেল ঘোষণা : ‘আমি একটা অ্যাকাউন্ট নম্বর বলছি। এক্ষুনি এই অ্যাকাউন্টে…।’
সঙ্গে-সঙ্গে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে ঝামেলার কোড নম্বর ডায়াল করল ছোটকা। এই কোড ডায়াল করলেই ঝামেলার শরীরে বসানো ইনবিল্ট টেলিফোন সিস্টেম অ্যাক্টিভ হয়ে ওঠে।
ছোটকা ফোনে কথা বলল, ‘ঝামেলা, ক্রিমিনালের গলা শুনতে পেয়েছি! তোমার অ্যাকশান শুরু করে দাও!’
ঝামেলা বহুদূরে দাঁড়িয়ে একটা পার্কের রেলিং-এ হেলান দিয়ে ঝিমোচ্ছিল। হঠাৎই ওর কানে সিগনাল বেজে উঠল। তারপর ছোটকার কথা।
ছোটকার কথা শোনামাত্রই ও চোখের নিমেষে চনমনে হয়ে উঠল। বলল, ‘ওকে বস।’ তারপর ওর পুঞ্জাক্ষি এক বৃদ্ধের খোঁজ করে চলল।
ছোটকা বুথের কাচ ভেদ করে বাইরে নজর চালাচ্ছিল। গাড়ি-ঘোড়া আর লোকজনের ভিড়ে আলাদা করে কাউকে চোখে পড়ল না। কিন্তু সময় চলে যাচ্ছে। ছোটকার পক্ষে এ.টি.এম.টি-র বোতাম টিপে অন্য অ্যাকাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করা সম্ভব নয়। তা হলে দেরি দেখে ক্রিমিনালটা হয়তো রেগে গিয়ে বুথটাকেই উড়িয়ে দেবে!
ঠিক তখনই ঝামেলার গলা শোনা গেল স্পিকারে : ‘বৃদ্ধ মানুষটিকে দেখতে পাইয়াছি। চক্ষে টেলিস্কোপ। হস্তে একটি কালো বাক্স। মস্তকে সাদা চুল। বক্ষে লাল ফুল।’
‘জলদি লোকটাকে ঠেকাও—নইলে এই বুথ উড়িয়ে দেবে! কুইক!’ ঝামেলা মোটেই ছুটতে পারে না। চেষ্টা করলে বড়জোর তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারে। ও সেভাবেই এগিয়ে চলল বৃদ্ধ লোকটির দিকে।
জুবিন প্রধান ঠিকই বলেছিল। সাধারণ প্যান্ট-শার্ট পরা, মাথায় সাদা চুল, চোখে চশমা, আর বাড়তির মধ্যে জামার বুকপকেটে একটা লাল রঙের ফুল আঁকা রয়েছে। একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে একটা মিনি টেলিস্কোপ তাক করে বুড়ো লোকটা বোধহয় ছোটকার ওপরে নজর রাখছিল।
লোকটার কাছাকাছি পৌঁছে ঝামেলা একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করল। লোকটার কানের নীচে চোয়ালের কাছটায় কেমন সরু কালো দাগ। অনেকটা কথা-বলা পুতুলের জোড়া দেওয়া চোয়ালের মতো।
লোকটা মাইক্রোফোনে ছোটকাকে হুমকি দিচ্ছিল : ‘…এই বুথ থেকে বেরোনোর চেষ্টা করলেই সাংঘাতিক এক বিস্ফোরণ হবে। জলদি টাকাটা ট্রান্সফার করুন…।’
ছোটকা তখন মরিয়া হয়ে ঝামেলাকে বলছে, ‘ঝামেলা, অ্যাকশান! কুইক! আর সময় নেই!’
ঝামেলা বলল, ‘অপরাধীর চোয়ালের নিকটে—অর্থাৎ, মস্তকের গ্রাউন্ড ফ্লোরে–একটি জোড়ার দাগ দেখিতে পাইতেছি। বড় আশ্চর্য!
ঝামেলাকে নিয়ে এই হল এক ঝামেলা। বাচ্চা-রোবট বলে ওর কৌতূহল বড় বেশি। আসল কাজ ছেড়ে…।
ছোটকা আর ভরসা পেল না।
পকেট থেকে ডায়মন্ড কাটার বের করে এ.টি.এম.টি. বুথের কাচের দেওয়াল কাটতে শুরু করল। কয়েকসেকেন্ডের মধ্যেই বুথের একপাশের দেওয়ালের কাচ কেটে ছোটকা বাইরে বেরিয়ে এল।
কাচ ভেঙে পড়ল ঝনঝন শব্দে। আর ছোটকা তিরবেগে ছুটতে শুরু করল। ঠিক তখনই বুড়ো লোকটা হাতে-ধরা কালো বাক্সটার কী একটা বোতাম চাপ দিল।
সঙ্গে-সঙ্গে বিশাল এক বিস্ফোরণ। এ.টি.এম.টি. বুথটা চৌচির হয়ে ছিটকে লাফিয়ে উঠল শূন্যে। তার সঙ্গে আগুন আর কালো ধোঁয়া।
রাস্তার লোকজন চিৎকার চেঁচামেচি করে দিশেহারা হয়ে ছুটে পালাতে লাগল। ছুটন্ত গাড়ি কর্কশ শব্দে ব্রেক কষল। সব মিলিয়ে এক প্রকাণ্ড ডামাডোল শুরু হয়ে গেল।
বৃদ্ধ লোকটির পিছনে দাঁড়িয়ে ঝামেলা বলে উঠল ‘চোয়ালে জোড়াতালি দেওয়া বৃদ্ধ! ছোটকাকে তুমি অ্যাটাক করলে! তোমার আস্পর্ধা তো স্মল নয়!’ বুড়ো লোকটা যুবকের ক্ষিপ্রতায় ঝামেলার দিকে ঘুরে তাকাল। কোথা থেকে
সে যেন একটা লেজার গান বের করে ফেলেছে।
ঝামেলা হাসল। হাসিটা অনেকটা পেন্ডুলামের জলতরঙ্গ বাজনার মতো শোনাল। ও আঙুল তুলে বৃদ্ধের পায়ের কাছে কী একটা দেখিয়ে বলল, ‘জবকল্পহরিনামপটহস্ত…।’
ঝামেলা অনেক সময় এরকম অর্থহীন শব্দ বলে বাংলা উচ্চারণ প্র্যাকটিস করে।
ওর অদ্ভুত কথায় ‘জোড়াতালি দেওয়া’ বৃদ্ধ মাথা নীচু করে নিজের পায়ের দিকে তাকাল। এবং চোখের পলকে ঝামেলার ধাতব ডানহাত বৃদ্ধের ব্রহ্মতালুতে আছড়ে পড়ল। ঢুঁ শব্দটি না করে বৃদ্ধ ক্রিমিনাল তৎক্ষণাৎ খসে পড়ল মাটিতে। ঝামেলা তখন উত্তেজনায় ‘ফুজিয়ামা! ফুজিয়ামা!’ বলে চেঁচাচ্ছে। আর ওর জ্বলছে-নিভছে।
কপালের বাল্বগুলো
উত্তেজিত হলে বা খুশি হলে বাচ্চা-রোবটাটা কেন যে ‘ফুজিয়ামা! ফুজিয়ামা!’ বলে চেঁচায় তা ঝালা-পালা বা ছোটকা কেউই জানে না।
ছোটকা ছুটতে-ছুটতে যখন অজ্ঞান-বৃদ্ধের কাছে এসে হাজির হল তখন ঝামেলা ঝুঁকে পড়ে বৃদ্ধের টিকোলো নাক ধরে টানছে।
ছোটকা হাঁফাতে-হাঁফাতে কী একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই বৃদ্ধের নাকটা লম্বা হয়ে ছিটকে চলে এসেছে ঝামেলার হাতে। সেই সঙ্গে মুখের আদলের একটা পলিমারের মুখোশ।
ওরা দুজনেই চমকে উঠল।
বৃদ্ধের মুখটা আসলে মুখোশ!
মুখোশের আড়ালে যে-মুখটা দেখা গেল সেটা ছোটকার চেনা। ওদের পায়ের কাছে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে জুবিন প্রধান।
ছোটকা মোবাইল ফোনে রিমিন গুপ্তকে খবর দিল। দশমিনিটের মধ্যেই ওঁরা দলবল নিয়ে হাজির। তখন ছোটকা ঝামেলাকে বলল, ‘আজকের মতো ঢের হয়েছে! এবার বাড়ি চলো।’
বাড়ি যাওয়ার পথে ছোটকা বলল, ‘জুবিন প্রধানের একটা কথায় খটকা লেগেছিল। ও বলেছে, ও ভয় পেয়ে গিয়েছিল—অথচ বৃদ্ধ লোকটিকে দেখার জন্যে ও সেখানে অপেক্ষা করছিল। আসলে ও পুলিশকে মিসগাইড করতে চেয়েছিল। তাই হাই-টেক ডাকাতের ভিকটিম সেজে থানায় গিয়ে হাজির হয়েছিল। অবশ্য তুই তো রোবট, এতসব কী আর বুঝতে পারবি!’
ঝামেলা ঠং-ঠং শব্দে লাফাতে-লাফাতে বলল, ‘তোমার কী নিদারুণ বুদ্ধি! আমি বুঝিতে পারি আর না পারি মাথা নাড়িতে দোষ কী! ফুজিয়ামা! ফুজিয়ামা!’