পাশের বাড়ির বন্ধু
একদিন ভোরবেলা জানলা দিয়ে নজর পড়তেই পাপু অবাক হয়ে গেল। পাশের বাড়িটায় লোকজন এসেছে। এতদিন ধরে বাড়িটা খালিই পড়ে ছিল। অনেকটা পোড়ো বাড়ির মতো। আর চেহারাটাও ভারী অদ্ভুত। প্রায় পাঁচতলা উঁচু গির্জার মতো। ছুঁচোলো মাথাটা সোজা আকাশমুখো উঠে গেছে।
কিন্তু চেহারায় বড়সড়ো হলে হবে কী, বাড়িটার চারদিক আগাছার জঙ্গ লে ভরে গেছে। সারা গায়ের পলেস্তারা খসে গেছে। জানলাগুলোর হালও সেইরকম। রাত্তিরে দেখলে গা-ছমছম করে পাপুর। অন্ধকারে কালো কুচকুচে দেখায় বাড়িটা। একটা তালঢ্যাঙা ভূত যেন টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দিনেরবেলা দেখলে অবশ্য অতটা ভয় করে না। তবে স্কুলে যাওয়ার পথে পাপু রোজই বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে। চারপাশে মরচে-ধরা লোহার রেলিং। বিশাল লোহার গেট। তার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় বাড়িটার ভারী সদর-দরজাবন্ধ। আর নীচের দিকটা ঢাকা পড়ে গেছে আগাছায়।
বাড়িটা যে কবে কে তৈরি করেছে তা কেউ জানে না, বাবাও না। পাপু বাবাকে জিগ্যেস করেছিল। তাতে বাবা বলেছেন, ‘এদিকে সবই তো নতুন ফ্যাক্টরি কোয়ার্টার। কী করে একটা পোড়ো বাড়ি মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে কে জানে! হবে হয়তো কোনও সাহেবসুবোর ফেলে-যাওয়া বাড়ি।
উত্তরটা পাপুর মনে ধরেছিল। কারণ সত্যিই এ-অঞ্চলের প্রায় সব বাড়িই নতুন। বছর দশেক হল কয়েকটা বড়-বড় কলকারখানা চালু হওয়ায় নতুন বসতি গড়ে উঠেছে। হয়েছে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, দোকানপাট সবকিছু, অথচ একইসঙ্গে রয়েছে সবুজ মাঠ, ফুলের বাগান, গাছপালা। আর তারই মাঝে-মাঝে সুন্দর-সুন্দর ছোট-ছোট নতুন বাড়ি। ব্যতিক্রম শুধু আগাছায় ভরা ফাঁকা জমিতে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল পোড়ো বাড়িটা।
সেই বাড়িতেই নতুন লোক এসেছে।
পাপু তাড়াতাড়ি বাবাকে ডেকে নিয়ে এল জানলার কাছে। বলল, ‘ওই বাড়িটায় নতুন লোক এসেছে, বাবা।’
বাবা ফ্যাক্টরিতে বেরোনোর জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। পাপুর কথায় উঁকিঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, ‘না, দেখতে পাচ্ছি না। যাকগে, পরে নিশ্চয়ই আলাপ হয়ে যাবে।’
বাবা অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর মাকে ধরে নিয়ে এল পাপু। বলল, ‘মা, ওই দেখো! ও-বাড়িটায় লোক এসেছে।’
মা ভালো করে তাকিয়ে রইলেন পোড়ো বাড়িটার ভাঙা জানলার দিকে। কিন্তু না, কোনও মানুষজনই নজরে পড়ল না। তখন মা বললেন, “ঠিক আছে, এখন রান্না বসাই গিয়ে, পরে আবার দেখব। তুমি পড়তে বোসো। এখন দেরি করলে পরে আবার স্কুলের দেরি হয়ে যাবে।’
মা চলে গেলেন। পাপু বুঝল, মা কিংবা বাবা, দুজনের কেউই ওর কথাকে বিশেষ আমল দেননি। নেহাতই কথার পিঠে দুটো কথা বলে চলে গেছেন। পাপুর একটু রাগও হল। বড়রা সবসময়েই এইরকম। ছোটদের গ্রাহ্যই করতে চান না। পাপু বই নিয়ে পড়তে বসল বটে, কিন্তু ওর চোখ বারবারই ছুটে যেতে লাগল ওই পোড়ো বাড়ির জানলাগুলোর দিকে। এতদিনের পুরোনো ভাঙাচোরা বাড়িটা হঠাৎই কারা ভাড়া নিল, নাকি কিনে নিল? পাপুর বেশ অবাক লাগছিল। স্কুলে রওনা হওয়ার ঠিক আগেই আশ্চর্য ঘটনাটা ওর চোখে পড়ল।
যে-জানলা দিয়ে পাপু নজর রাখছিল, তার কিছুটা অংশ একটা নিম গাছের ডালপালা-পাতায় ঢাকা। তা ছাড়া, পোড়ো বাড়িটার তেতলার জানলাটা খুব একটা যে কাছে তাও নয়। কিন্তু তবুও পাপুর দেখতে কোনও অসুবিধে হল না।
তেতলার জানলা দিয়ে একটা ছোট বাক্সমতো কী যেন পড়ে গেল নীচের আগাছার জঙ্গলে। আর তার ঠিক পরেই একজন লোক গরাদ-ভাঙা জানলা দিয়ে বাইরে উঁকি মারল। নীচে তাকিয়ে কিছুক্ষণ কীসব দেখল। আশপাশে একবার চোখ বুলিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর স্পাইডারম্যান’ কমিকসএর পিটার পার্কারের মতো পোড়ো বাড়িটার দেওয়াল বেয়ে তরতর করে হেঁটে নেমে এল নীচে। বাক্সটা খুঁজে নিয়ে আবার একইভাবে তেতলায় উঠে জানলা দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল।
বলতে গেলে পাপুর দম আটকে আসছিল। ও একছুটে গিয়ে ‘স্পাইডারম্যান’ কমিকস-এর পাতা খুলে বসল। পিটার পার্কারের ছবিটা একদৃষ্টে দেখতে লাগল। তা হলে কি পাশের বাড়িতে কোনও মাকড়সা-পরিবার এসে উঠেছে? পার্কারের গল্প তা হলে গল্প নয়! পাপু ভাবল মাকে ডেকে এক্ষুনি এই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা জানায়। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল, মাকে বলে লাভ নেই, মা পাপুর কথা একটুও বিশ্বাস করবেন না। বলবেন, ‘ও তোমার চোখের ভুল। আর রাজ্যের গল্পের বই পড়ার নেশাটা একটু কমাও তো!’
সুতরাং এই দুর্দান্ত অভিজ্ঞতার কথা অতিকষ্টে বুকে চেপে পাপু স্কুলে চলে গেল।
কিন্তু সেখানে গিয়ে আর গোপন রাখতে পারল না। প্রাণের বন্ধু বিজনকে সব খুলে বলল ও। বিজন কাছাকাছিই একটা কোয়ার্টারে থাকে। রোজ বিকেলে আরও সব বন্ধুবান্ধব মিলে ওরা পাপুদের বাড়ির কাছে মাঠে খেলা করে। বিজন বলল, ‘চল, বিকেলে খেলার সময় বাড়িটার দিকে নজর রাখব।’ যে কথা, সেই কাজ।
বিকেলে খেলতে বেরিয়ে পাপু, বিজন, আর ওদের অন্য বন্ধুরা বাড়িটার দিকে নজর রাখতে লাগল। চট করে কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল না বাড়িটায় কেউ আছে। খেলাধুলো ছেড়ে যখন ওরা গোয়েন্দাগিরিতে নামবে বলে মতলব আঁটছে, ঠিক তখনই বাড়ির দরজাটা খুলে গেল।
আর বেরিয়ে এল ওদেরই বয়েসি একটি ছেলে। ফুটফুটে, হাসিখুশি মুখ। বড় লোহার গেটটা খুলে সে সোজা এগিয়ে এল পাপুদের কাছে। বলল,
‘আমার নাম টনি। আমি তোমাদের সঙ্গে খেলব। তোমাদের নাম কী?’
পাপু, বিজন, সবাই যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তোতলানো স্বরে আলাপ সেরে নিল নতুন বন্ধুর সঙ্গে।
কথায়-কথায় জানা গেল, টনিরা আজ খুব ভোরে এসেছে। এ-বাড়িটা ওদেরই ছিল। তবে এদিকে আসা হয়নি। হঠাৎ দরকার পড়ায় বাবা-মা-টনি হঠাৎ করে চলে এসেছে।
তখনও বেশ দিনের আলো ছিল। ওরা দল করে টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলতে লাগল ।
খেলা শুরু হলেও পাপুর বারবার সকালের ঘটনার কথা মনে পড়ছিল। দেওয়াল বেয়ে নেমে-আসা ওই ভদ্রলোক নিশ্চয়ই টনির বাবা। টনিকে জিগ্যেস করবে সে কথা? নাকি…।
পাপু একপাশে বসে স্কোর লিখছিল আর এলোমেলো ভাবছিল। এখন টনি ব্যাট করছে, বিজন বল করছে। অন্য প্রান্তে রয়েছে ওদেরই আর-এক বন্ধু তাতান।
কেউ একজন আউট হলেই পাপু নামবে ব্যাট হাতে। কিন্তু হঠাৎই টনি বলটাকে ওপরের দিকে মারল। মারতে গিয়ে খুব যে একটা জোর খাটিয়েছে, তা মনে হল না। কিন্তু বলটা সেই যে সোজা ওপরের দিকে উঠে গেল আর নীচে পড়ল না।
টনি মুখে অপরাধী ভাব ফুটিয়ে বলল, ‘কিছু মনে কোরো না। মারটা একটু জোরে হয়ে গেছে।’
বিজন অবাক হয়ে একবার আকাশের দিকে, আর একবার টনির দিকে দেখতে লাগল। ঘটনাটা ওদের বন্ধুরা কেউই বিশ্বাস করতে পারছিল না।
মাঝপথে খেলা পণ্ড। সুতরাং ওরা গল্প করতে করতে যে-যার বাড়ির দিকে চলল। পাপু টনিকে বলল, ‘আমি পাশের বাড়িতেই থাকি।’
টনি সেটা শুনে বলল, ‘আমাদের বাড়িতে একদিন বেড়াতে এসো। মাবাবা তোমাকে দেখলে ভীষণ খুশি হবে। কাল আসবে নাকি?’
পাপু বলল, “ঠিক আছে। মা যদি বারণ না করে তা হলে আসব।
ওদের বাড়িটা সম্পর্কে পাপুর ভীষণ কৌতূহল হচ্ছিল। কৌতূহল হচ্ছিল টনি আর তার বাবা-মা সম্পর্কেও।
টনি হাত নেড়ে লোহার গেট দিয়ে ঢুকে পড়ল। তারপর…পাপু স্পষ্ট দেখল, মরচে-ধরা লোহার গেটটা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেল। অথচ টনি একটিবারও পিছন ফিরে তাকায়নি। ও তখন সদরদরজা ঠেলে বাড়িতে ঢুকছে। সদরদরজাটাও একইভাবে বন্ধ হয়ে গেল।
যদিও তখন সন্ধের আঁধার নেমে আসছে, তবুও পাপুর যে দেখতে এতটুকু ভুল হয়নি তা ও হলফ করে বলতে পারে।
বাড়িতে ঢোকার মুখে ও আবার দেখল, টনিদের বাড়িটার সবক’টা জানলায় একসঙ্গে দপ্ করে আলো জ্বলে উঠল। আলোগুলোর রং কেমন যেন অদ্ভুত। এরকম আলো পাপু আগে কখনও দেখেনি। তা ছাড়া, ওই পোড়ো বাড়িতে এত আলোর ব্যবস্থা ছিল!
পাপু ঠিক করল, বিশ্বাস করুক আর না করুক, আজ ও মা-বাবাকে সব খুলে বলবে। আর কাল বিকেলে ও টনিদের বাড়িতে বেড়াতে যাবে।
অদ্ভুত সব চিন্তা মাথার ভেতরে ঘুরপাক খাওয়ার দরুন পড়াশোনায় ঠিকমতো মন বসল না পাপুর। শেষে রাতে খাওয়ার সময় ও মাকে আর বাবাকে টনিদের কথা বলল। কোনও কথাই বাদ দিল না।
ওর কথা শুনে বাবা তো গলা ফাটিয়ে হেসে উঠলেন। ‘এসব তোমার কমিকস পড়ার ফল। ভালো করে রাত্তিরে ঘুমোও, দেখবে কাল সকালেই সব ঠিক হয়ে গেছে।’
পাপু বলল, ‘না বাবা, সব সত্যি। আমি নিজের চোখে দেখেছি। বিশ্বাস করো।’
তখন মা বললেন, “ঠিক আছে, কাল বিকেলে তোমাকে নিয়ে আমরা টনিদের বাড়িতে বেড়াতে যাব। তোমার বাবাও যাবে আলাপ করতে। দেখবে, তখন তোমার ভুল ভেঙে যাবে।’
পাপু আর কী করে, চুপচাপ খেয়ে উঠে পড়ল।
ঘুমিয়ে পড়ার আগে ওর মনে হল, ওইসব উদ্ভট ব্যাপারগুলো ঠিক-ঠিক ও দেখেছিল তো! নাকি…।
সে-রাতে পাপু স্পাইডারম্যান কমিকস-এর পিটার পার্কারকে স্বপ্ন দেখল।
পরদিন সকালে উঠে শুধু পাপু নয়, মা-বাবাও একেবারে তাজ্জব। ভেলকিবাজি, ভানুমতীর খেল, নাকি ময়দানবের কীর্তি? সবাই দু-চোখ কচলে বারবার দেখতে লাগল আশ্চর্য ঘটনাটা।
টনিদের বাড়িটা সূর্যের আলোয় যেন ঝকঝক করছে। কোনওদিন যে সেটা পোড়ো বাড়ি ছিল সেটা বিশ্বাস করাই এখন মুশকিল।
পাপু মা-বাবার গোল-গোল চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী, এখন বিশ্বাস হল তো আমার কথা! দেখলে তো টনিরা কীরকম সব আশ্চর্য কাণ্ড করতে পারে!’ মা কোনওরকমে থেমে-থেমে বললেন, ‘এ যে একেবারে নতুন বাড়ি!’ বাবা বাড়ির চারপাশের আগাছার জঙ্গলের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘শুধু ওই জঙ্গল আর মরচে ধরা লোহার রেলিংগুলো না থাকলে বাড়িটা আর চেনাই যেত না।’
পাপু আগ্রহ-ভরা গলায় বলল, ‘টনিকে একবার ডেকে জিগ্যেস করব, বাবা?’ মা তাড়াতাড়ি বাধা দিলেন, ‘না, না, তার দরকার নেই! শেষপর্যন্ত কী থেকে কী হবে…।’
বাবা সাবধানি সুরে পাপুকে বললেন, ‘তুমি যেন একা-একা ওদের বাড়িতে যেয়ো না।’
পাপু ঘাড় নাড়ল। তারপর হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসল।
বাবা ফ্যাক্টরিতে বেরোনোর পর থেকেই পাপু জানলার কাছে সর্বক্ষণ খাড়া হয়ে রইল। তীক্ষ্ণ নজর চালিয়ে টনিদের বাড়ির ভেতরটা দেখতে চেষ্টা করল। কিন্তু কোনও লাভ হল না। টনি, ওর বাবা কিংবা মা, কাউকেই দেখা গেল না। পাপু অবাক হয়ে ভাবছিল, কোন শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় বাড়িটা রাতারাতি ভোল পালটে ফেলল!
উত্তরটা ও পেল স্কুলে যাওয়ার সময়।
পাপু একা-একাই স্কুলে যায়-আসে। এদিককার রাস্তাঘাটে গাড়িঘোড়া কম। শুধু একটু যা সাইকেলের ভিড় রয়েছে। ও সবে টনিদের বাড়িটা ছাড়িয়ে এগিয়েছে, এমন সময় ওর ঠিক সামনে হাজির হল টনি। যেন বাতাস থেকেই ফুটে উঠল ওর নতুন বন্ধুর চেহারা।
‘কোথায় যাচ্ছ, স্কুলে?’ টনি জিগ্যেস করল।
পাপু নিজেকে সামলে নিয়ে কিছুটা ভয়ে-ভয়েই বলল, ‘হ্যাঁ।’ তারপর একটু থেমে আবার বলল, ‘তুমি স্কুলে ভরতি হবে না?’
টনি হাসল। হেসে বলল, ‘না। আমি তো দেশের বাড়িতে স্কুলে পড়ি। তোমাদের এখানে স্কুল-কলেজে যা শেখায়, সব আমার জানা। আমাদের স্কুলে পড়া খুব কঠিন। তুমি বুঝবে না।’
পাপু কিছুটা অপমানবোধ করল। বলল, ‘তোমার দেশের বাড়ি কোথায়?’ টনি হাত ছড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘সে অনেক দূর। জায়গার নাম বললে তুমি চিনবে না।’
পাপু কথা বলতে-বলতে এগোচ্ছিল। টনিও ওর পাশে-পাশে হাঁটছিল। স্কুলের কাছাকাছি এসে পাপু বলল, ‘আচ্ছা, তোমাদের বাড়িটা রাতারাতি কে মেরামত করল বলো তো?’
টনি স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘কে আবার! বাবা।’
‘একা?’
‘হ্যাঁ, একা। কেন?’
‘তোমার বাবা দেওয়াল বেয়ে হাঁটতে পারেন?’
পাপু টনিকে খোঁচা দিয়ে অপমানের শোধ নিতে চাইছিল, কিন্তু ওর কথায় টনি আগের মতোই স্বাভাবিকভাবে জবাব দিল, ‘শুধু বাবা কেন? মা-ও পারে, আমিও পারি। দেখবে?’ বলেই টনি একছুটে সামনের একটা কোয়ার্টারের দেওয়াল বেয়ে দোতলায় উঠে গেল, তারপর একইভাবে আবার নেমে এল।
পাপু হাঁ করে তাকিয়ে আছে দেখে টনি বলল, ‘শুধু আমি কেন, আমাদের দেশের সবাই পারে। তুমি বিকেলে আমাদের বাড়িতে এসো, তোমাকে আরও সব অদ্ভুত-অদ্ভুত জিনিস দেখাব। খুব মজা পাবে তুমি।’
পাপুর সবকিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল। কী ভেবে ও কোনওরকমে বলল, ‘সন্ধেবেলা যাব। আমার মা-বাবাকে নিয়ে যাব। নইলে একা-একা আমাকে ছাড়বে না।’
টনি হেসে বলল, ‘নিয়ে এসো ওঁদের। আলাপ হলে আমার মা-বাবাও খুব খুশি হবে। আমাদের দেশের বাড়ির দারুণ-দারুণ সব গল্প শোনাব। আচ্ছা, ওই যে তোমার স্কুল এসে গেছে, আমি এখন যাই। সন্ধেবেলা আবার দেখা হবে।’
পাপুর চোখের সামনে টনি আবার যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল। স্কুলে বিজনকে সব ঘটনা জানাতেই ও বলল, ‘সন্ধেবেলা যাবি যা, তবে সাবধানে থাকিস।’
পাপু গম্ভীর হয়ে ভাবছিল। ক্লাসের পড়া ওর মাথায় ঢুকছিল না।
স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে আর খেলতে বেরোল না পাপু। শুধু মায়ের কাছে বসে জেদ ধরল টনিদের বাড়িতে ওকে নিয়ে যেতে হবেই। কারণ টনি কত মজারমজার খেলা দেখাতে পারে, পড়াশোনায় কত ভালো, ও পাপুকে নিশ্চয়ই সব শিখিয়ে দেবে। তা ছাড়া, টনির কাছে ওর দেশের গল্প শুনবে পাপু। টনি বলেছে দারুণ-দারুণ সব গল্প শোনাবে।
বাবা অফিস থেকে ফিরেই রাজি হয়ে গেলেন এককথায়। মনে-মনে তাঁরও বোধহয় খুব কৌতূহল হচ্ছিল। সুতরাং অল্প সময়ের মধ্যেই তিনজন তৈরি হয়ে বেরিয়ে এলেন বাড়ি থেকে।
বিকেল পেরিয়ে তখন সন্ধে হয়ে গেছে। টনিদের তালঢ্যাঙা বাড়ির ছোটছোট জানলায় গতকালের মতোই অদ্ভুত আলো জ্বলছে। মা-বাবার হাত ধরে লোহার গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল পাপু। তারপর আগাছা মাড়িয়ে সদর-দরজা। দরজা খুলে ভেতরে।
ভেতরে ঢুকতেই মেঝেটা নিঃশব্দে ওপরে উঠতে লাগল। ঠিক যেন অটোমেটিক লিফট। তারপরই টনি আর ওর মা-বাবার দেখা পাওয়া গেল। বিশাল ঘর। অনেকগুলো টিভির পরদায় নানান রঙিন লেখা। তাদের সামনে অসংখ্য রঙিন বোতাম। কম্পিউটার নাকি? পাপু কম্পিউটারের ছবি বইতে দেখেছে।
টনির বাবা দ্রুত হাতে নানান বোতাম টেপাটেপি করছিলেন, ওদের দেখেই হেসে অভ্যর্থনা জানালেন। টনির মা সুন্দর সুন্দর খাবার সাজিয়ে দিলেন প্লেটে। ওরা আনন্দে গল্প করতে লাগল। টনিদের দেশের হরেকরকম অদ্ভুত গল্প পাপুদের অবাক করে দিচ্ছিল। টনির বাবা বারবার করে বললেন, ‘চলুন না, আমাদের দেশে ক’দিন বেড়িয়ে আসবেন। কোনও অসুবিধে হবে না। আজ রওনা হলে ধরুন কাল পৌঁছে যাবেন। আর যদি বলেন তো পরশু আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব। চলুন, চলুন। গেলে খুব ভালো লাগবে। তা ছাড়া, আমাদেরও ক’টা দিন বেশ ফুর্তিতে কাটবে।’
পাপু আর টনি ছুটোছুটি করে খেলছিল। পাপু নেমন্তন্নের কথা শুনে বাবাকে আর মাকে রাজি করানোর জন্য বারবার করে আর্জি পেশ করতে লাগল। সকলের অনুরোধে ওঁরা শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন।
তখন টনির বাবা হেসে বললেন, ‘তা হলে আর দেরি নয়, এখনই রওনা হওয়া যাক।’ বলে তিনি কম্পিউটারের কাছে গিয়ে পরপর কয়েকটা বোতাম টিপলেন।
একটা গুড়গুড় শব্দ শুরু হল। তারপর ভোঁ-ভোঁ। শেষে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে টনিদের গোটা বাড়িটা শূন্যে উঠতে লাগল রকেটের মতো।
পাপুর মা চিৎকার করে উঠলেন। বাবা বললেন, ‘এসব কী হচ্ছে!’
টনির বাবা হেসে বললেন, ‘কোনও ভয় নেই। আমরা আপনাদের এপসিলন এরিড্যানির সতেরো নম্বর গ্রহে নিয়ে যাচ্ছি। সেখানেই আমাদের দেশ। পৃথিবী থেকে সাড়ে দশ আলোকবর্ষ দূরে। যেটাকে আপনারা আমাদের বাড়ি ভাবছেন, সেটা আসলে একটা মহাকাশযান। অনেকদিন আগে পৃথিবীতে এসে বিকল হয়ে পড়েছিল। অন্য একটা মহাকাশযান আমাদের এখানে পৌঁছে দিয়ে গেছে এই মহাকাশযানটাকে মেরামত করে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। তাই এখন নিয়ে যাচ্ছি।’
টনির মা বললেন, ‘আমরা পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার চেষ্টাতেই বারবার এই গ্রহে যাতায়াত করি। এবারে আপনাদের পাপুর সঙ্গে আমাদের টনির যা ভাব হয়েছে তাতে আমরা খুব খুশি। তা ছাড়া, আপনাদের সঙ্গেও আলাপ করে খুব ভালো লেগেছে। মিছিমিছি ভয় পাবেন না। মনে করুন না, ছুটিতে ক’দিন কোথাও বেড়াতে যাচ্ছেন! মাত্র কয়েকটা তো দিন, তার বেশি তো নয়।’
পাপুর মা-বাবার ভয় আস্তে-আস্তে কেটে যাচ্ছিল। রকেটযান তখন সাংঘাতিক গতিতে ছুটে চলেছে। সামনের টিভি-পরদাগুলোয় অসংখ্য তারা দেখা যাচ্ছে।
টনি ঘরের দেওয়ালে ছাদে ইচ্ছেমতো ছুটোছুটি করছিল। খেলা করছিল পাপুর সঙ্গে। পাপু কিন্তু এতটুকু ভয় পায়নি। সেও খেলা করতে-করতে লাফিয়েলাফিয়ে টনিকে ছুঁতে চেষ্টা করছিল।
সেদিকে তাকিয়ে পাপুর বাবা টনির বাবাকে বললেন, ‘বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছেন চলুন, কিন্তু দেওয়ালে হাঁটাহাঁটি করাটা আমাকে অবশ্যই শিখিয়ে দিতে হবে।’ পাপুর মা বললেন টনির মাকে, ‘আমাকে নতুন-নতুন কয়েকটা রান্না শিখিয়ে দেবেন, দিদি।’
পাপুর বাবা সে-কথা শুনে বললেন, ‘যে আছে যার তালে!’ এ-কথায় চারজনেই একসঙ্গে হেসে উঠলেন।